জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব-০৭

0
270

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-৭)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

১৫.
বাড়িতে আসার পর গাড়ি থেকে প্রথমেই মৌসন্ধ্যা নেমে পড়ল। গ্রীষ্ম একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজেও বের হলো। শরৎ এর সিটের পাশের দরজাটা খুলে গ্রীষ্ম শরৎকে ডাকতে থাকে,
-‘শরৎ! এই শরৎ!’

শরৎ নড়ে চড়ে উঠল ডাক শুনে। ঘুম ভাঙছেনা দেখে গ্রীষ্ম হাত দিয়ে তাকে ঝাকানি দিলো। তাতে শরৎ ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হলো। তারপর ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে সে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। গ্রীষ্ম সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার মৌসন্ধ্যার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। মৌসন্ধ্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাকেই দেখছিল। আকস্মিক গ্রীষ্ম তার দিকে তাকাতেই সে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল। গ্রীষ্ম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার থেকে দৃষ্টি সরায়। গাড়ির দিকে আরেকটু ঝুঁকে বর্ষাকে ডাকে,
-‘বর্ষা! ওঠ, বাড়িতে এসে পড়েছি।’
বর্ষা সাড়া দিচ্ছিল না। গ্রীষ্ম আবার ডাকল,
-‘বর্ষা!’
বর্ষার ঘুম ভাঙে। সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। কীভাবে যে ঘুমিয়ে গেল! বর্ষা গাড়ি থেকে নামতেই মৌসন্ধ্যা ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। বর্ষা দৌঁড়ে গিয়ে তার হাত ধরে ফেলে।
-‘আমাকে ফেলে যাচ্ছিস কেন? স্বার্থপর মেয়েছেলে!’

গ্রীষ্ম তাদের যাওয়ার পানে এক পলক চেয়ে থেকে পুনরায় গাড়িতে উঠে বসল। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আসতে হবে।

————
রাতে কেউ কেউ খাবার খেয়েছে কেউ কেউ খায়নি। অধিকাংশই খায়নি বলা চলে। ছোট বাচ্চা গুলোকে তাদের মা জোর করেই খাইয়েছে। এই ছোট বাচ্চা গুলোর মধ্যে চৈত্র, বর্ষা, মৌসন্ধ্যাও রয়েছে। সবাইকে তাদের নিজ নিজ মায়েরা রুমে এনে খাবার খাইয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে বর্ষা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। পাশ থেকে মৌসন্ধ্যা বলছে,
-‘বেশি খা’রা’প লাগলে ওয়াশরুমে যা। পেট ক্লিয়ার করে নিলেই শান্তি পাবি।’
-‘আরে!! তুই বুঝছিস না। পেট আমার ফেটে যাওয়ার উপক্রম।’
-‘আমি মামানিকে ডেকে আনি দাঁড়া।’
-‘আম্মুকে ডাকার দরকার নেই। সব হয়েছে তার জন্য। বলেছি খাবো না তবুও জোর করে খাইয়ে দিল। উফ!’
-‘মামানি তো তোকে এরকম ক’ষ্ট দিতে চায়নি। তুই যেন খালি পেটে না ঘুমাস সেই কারণেই তো খাওয়ালো।’
-‘চুপ কর তো! জ্ঞান দিবি না একদম।’

মৌসন্ধ্যার রাগ উঠল সে বসা থেকে উঠে বর্ষার মাথায় একটা গাট্টা মে’রে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে বর্ষা চেঁচামেচি করতে লাগল।

মৌসন্ধ্যা রুম থেকে বের হয়ে চৈত্রের কাছে গেল। গিয়ে দেখে চৈত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। অতঃপর হতাশ হয়ে সেখান থেকেও চলে এলো। পুরো বাড়ি এখন কিছুটা নিরব। রাতের বারোটা বাজে। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

মৌসন্ধ্যার এই শুনশান বাড়িটি আপাতত বেশ ভালো লাগছে। সে ভাবল নিচে গিয়ে একটু হেঁটে আসবে। কিন্তু সে যখন সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতে গেল তখন খেয়াল করল নিচে জুন আর গ্রীষ্মের নানার বাড়ির কিছু লোক বসে আছেন। নিজেদের মধ্যেই কথা বলছেন। মৌসন্ধ্যা আর সেদিকে গেল না। আজকে জুনের বিয়ের পর তার মায়ের শরীরের অবস্থা একটু খা’রা’প হয়ে যাওয়ার ফলে তারাও কয়েকজন আজ এইখানেই আছেন।

মৌসন্ধ্যা দোতলায় এদিক ওদিক বিচরণ করতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে গ্রীষ্মের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ মনে পড়ল আহরারের কথা। গতরাতে যখন সে গ্রীষ্মের খোঁজে এসেছিল তখন তো আহরারই দরজা খুলেছিল। আর তার সাথে মশকরা করছিল। তখন রা’গ লাগলেও এখন মনে পড়তেই তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দেখা গেল। আহরার চলে গেছে। অবশ্য সে যখন চলে গিয়েছিল তখন মৌসন্ধ্যা দেখেনি। বর্ষার সাথে নাকি আহরারের কথা হয়েছে। কাল আবার আসবে বলেছে। এইখান থেকেই জুনের রিসিপশনে যাবে বলেছে। মৌসন্ধ্যা ফিরে আসতে নিলেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। সে থমকে গিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে উদাম শরীরে গ্রীষ্ম বের হয়েছে রুম থেকে। মৌসন্ধ্যা ব্যাপারটায় ল’জ্জায় পড়ে গেল। গ্রীষ্মের ও একই অবস্থা! মৌসন্ধ্যা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সে এটা ভেবেই অবাক। সে নিজেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মৌসন্ধ্যা চলে যেতে উদ্যত হলেই গ্রীষ্ম বলল,
-‘তুমি ঘুমাওনি?’
মৌসন্ধ্যা চাইছেনা গ্রীষ্মের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারউপর সে যেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তাতে চোখ তুলে তাকাতেও ল’জ্জা লাগছে। তাকালেই নিজেকে বে’শ’র’ম মনে হচ্ছে। সে নিচের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,
-‘ঘুম আসছেনা।’
-‘তোমার কি রাত জাগার অভ্যেস আছে?’
-‘না সেরকম না। আসলে মাঝে মাঝে আমার ঘুম আসতে চায়না।’

গ্রীষ্ম যেন কৌতুক করেই বলল,
-‘ঘুম আসতে চায়না! কেন? কোনো বিশেষ কিছু নিয়ে চিন্তা করো নাকি!’

মৌসন্ধ্যা চট করেই গ্রীষ্মের দিকে তাকালো। আর তখনিই গ্রীষ্মের চওড়া কাঁধ, প্রশস্ত বুকে তার চোখ আটকা পড়ল। গ্রীষ্মের বুকে কোনো লোম নেই। ব্যায়াম করা সুঠাম দেহটা চোখে লাগার মতোন। মৌসন্ধ্যা দৃষ্টি সরায়। তার হাত পা কাঁপছে। এমন অদ্ভুত লাগছে কেন সে জানেনা। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-‘ঘুম না আসার কোনো বিশেষ কারণ থাকেনা। ঘুম আসছেনা মানে আসছেনা।’
-‘তুমি ভুল বলছ। ঘুম না আসার জন্য অনেক কারণ থাকে। ধরো, কেউ কেউ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে যার ফলে সে দিন রাত পরিশ্রম করে, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে সে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। আর কেউ কেউ পারিবারিক কলহ থেকে ডিস্টার্বড থাকে, তাই তাদেরও ঘুম আসেনা। আর কেউ কেউ প্রেম, ভালোবাসার জন্যে শান্তিতে ঘুমাতে পারেনা। তা তোমার কোনটা?’

মৌসন্ধ্যা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। গ্রীষ্ম এসব কি বলছে তাকে! মৌসন্ধ্যা কিছু বলবে তার আগেই পেছন থেকে তাকে কেউ একজন ডাকে,
-‘মৌ!’

শরৎকে দেখে মৌসন্ধ্যা ভ’য় পেয়ে যায়। এত রাতে তাকে এখানে দেখে নিশ্চয়ই সে এখন তাকে কথা শোনাবে। শরৎ আরেকটু এগিয়ে এলো। বলল,
-‘তুই এইখানে কী করছিস?’
-‘এই তো একটু হাঁটছিলাম। এখন রুমেই যাচ্ছিলাম।’

গ্রীষ্ম শরৎকে বলল,
-‘আমিই ওকে দাঁড় করিয়েছিলাম শরৎ।’
-‘ও। আচ্ছা।’
গ্রীষ্ম মৌসন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘জৈষ্ঠ্য তুমি রুমে যাও।’

মৌসন্ধ্যা সেই কথা শুনে হাঁটা ধরে পেছন থেকে শুনতে পেল শরৎ বলছে,
-‘ভাই, ওই রুমে আষাঢ় ভাই শুয়েছে, জায়গা নেই। আজকে তোমার সাথে ঘুমাবো।’
-‘আয়!’

১৬.
সকালে ঘুম থেকে উঠে আরেক দফা ব্যস্ততা চোখে পড়ল মৌসন্ধ্যার। আজ জুনের বৌভাতের অনুষ্ঠান। অবশ্য এখন সবাই সেটাকে রিসিপশন বলে। বৌভাত কথাটা যেন আজকাল ওল্ড ফ্যাশন।

বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা আজকে শাড়ি পরবে ঠিক করেছে। বর্ষার রুপালী রঙের সিল্কের শাড়ি আর মৌসন্ধ্যার হালকা গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি। দুজনেই এক সাথে মার্কেটে গিয়ে শাড়িগুলো কিনেছিল। আর জুয়েলারি হিসেবে দুজনেই সাদা পাথরের মধ্যে খুব সুন্দর কানের দুল আর হার পরেছে। মৌসন্ধ্যার চুলে খোপা করে দিলো বর্ষা। তবে সে নিজের চুল খোলা রেখেছে। মৌসন্ধ্যা খোলা চুলে তেমন একটা থাকতে পারেনা।

চৈত্র আজকে থ্রী পিস পরেছে। সে বর্ষা আর মৌসন্ধ্যাকে দেখে বলল,
-‘তোমাদের কি সুন্দর লাগছে গো! ইশ আমিও এমন শাড়ি পরতে চেয়েছিলাম। আম্মু দিলোনা।’
বর্ষা বলল,
-‘তুই বড় হলে পরিস।’
-‘তো আমি কি ছোট নাকি?’

মৌসন্ধ্যা নিচে নামতেই তার মা মুগ্ধ চোখ একবার মেয়েকে দেখে নিলো। মেয়েটা ভীষণ রূপবতী। একবার তাকালে মন আর পেট কিছুই বোধ হয় ভরবেনা। তিনি মেয়ের কানের পিছে একটু কালি লাগিয়ে দিলেন। মৌসন্ধ্যা মায়ের দিকে বিরক্তির চোখে তাকায়। এই কালোটিপের চক্কর থেকে সে যে কবে বের হতে পারবে?

মৌসন্ধ্যা তার মায়ের সাথে গেল না। গতকাল মেয়ে দেরিতে খেয়েছে একা সময় কাটিয়েছে শুনে তিনি ভীষণ রে’গে গেছেন। ঠিক করেছেন রিসিপশনে তার সাথেই নিয়ে যাবে আর চোখে চোখে রাখবেন। কিন্তু মায়ের কথা শুনে সে রাজি হলো না। বর্ষার সাথেই যাবে সে। অতঃপর তিনি মেয়ের উপর বিরক্ত হয়ে বোনদের সাথে চলে গেলেন।

মৌসন্ধ্যা আর বর্ষা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে। একে একে গাড়ি যেগুলো ফিল আপ হচ্ছে সেগুলো চলে যাচ্ছে। তারা একটাতেও উঠছেনা। মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘কিরে! আমরা দাঁড়িয়েই থাকব? যাব না!’
-‘যাব তো। ভাইয়ার গাড়িতে যাব।’
-‘আষাঢ় ভাইয়ের গাড়িতে?’ মৌসন্ধ্যা চমকে উঠে বলল।
বর্ষা স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমি যাব না।’
-‘কেন?’
-‘এমনিতেই।’
-‘আহ! তুই কালকের ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে আছিস? তুই ছোট বাচ্চা!’
-‘হ্যাঁ, আমি ছোট বাচ্চা-ই।’

তাদের কথার মধ্যেই আষাঢ়, শ্রাবণ, মুকিত নেমে আসে। তাদেরকে দেখে মুকিত হেসে বলল,
-‘কী ব্যাপার বোনেরা আমার! এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা? রোদে স্কিন ন’ষ্ট হয়ে যাবে।’

মুকিতের কথা শুনে দুজনেই হেসে দিল। হাসল মুকিত নিজেও। শ্রাবণ বলল,
-‘আম্মাদের সাথে যাস নাই তোরা?’
বর্ষা ফটাফট জবাব দিল,
-‘না, ভাইয়ার গাড়িতে যাব।’

আষাঢ় একবার মৌসন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আয়!’
শ্রাবণ লাফিয়ে উঠে বলল,
-‘আমাদের সাথে যাবে মানে? জায়গা হবে না।’
বর্ষা বলল,
-‘হবে না কেন? পেছনে তিনজন বসবে সামনে দুইজন। জায়গা ঠিকই হবে।’
আষাঢ় বলল,
-‘শ্রাবণ, মুকিত পেছনে বসে পড় তোরা। বর্ষা তুইও পেছনে বস।’
মুকিত আগেই গাড়িতে উঠে জানালার পাশে বসে পড়ে। শ্রাবণ বলল সে জানালার পাশে বসবে। বর্ষা বলল তাকে জানালার পাশে না দিলে সে বমি করে দিবে। তারপর শ্রাবণ বাধ্য হয়ে মাঝে বসল। আষাঢ় মৌসন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গাড়িতে ওঠ!’
কথাটা বলেই সে দরজা খুলে দিলো। মৌসন্ধ্যা উঠল না। সে একটুও চাইছেনা আষাঢ়ের সাথে যেতে। আষাঢ়, শ্রাবণ দু’টোই অনেক বড় আ’ত’ঙ্ক। মৌসন্ধ্যাকে উঠতে না দেখে আষাঢ় এবার বেশ চেঁচিয়েই উঠল।
-‘গাড়িতে উঠছিস না কেন?’
-‘আমি এই গাড়িতে যাব না।’
আষাঢ় এবার বেশ রে’গে গেল। ধ’ম’কে বলল,
-‘এই গাড়িতে যাবিনা তো কোন গাড়িতে যাবি? আর কোন গাড়ি তোর জন্য অপেক্ষা করছে!’

মৌসন্ধ্যার টনক নড়ল। আসলেই তো এখন তো আর কোনো গাড়ি নেই। তাহলে এখন সে কী করবে! তখনিই দেবদূত হয়ে এলো গ্রীষ্ম। সে এসে বলল,
-‘আষাঢ়! তোরা চলে যা। ও আমার সাথে যাবে।’
-‘তোমার সাথে যাবে মানে? তোমার ফ্রেন্ডরা!’
-‘ওরা ওদের মতো চলে গেছে। আমি একাই যাচ্ছি।’

গাড়ির ভেতর থেকে শ্রাবণ চেঁচিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ ভাই। ওইটাকে নিয়ে যাও, এটাকেও নিয়ে যাও।’
শেষ কথাটা বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বলল। বর্ষা তা শুনে তেলে বেগুনে জ্ব’লে বলে উঠল,
-‘আমি এই গাড়িতেই যাব। তুমি পারলে যাও।’

গ্রীষ্ম তাদেরকে চুপ করতে বলে মৌসন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘তুমি আমার সাথে যাবে?’
মৌসন্ধ্যা সরাসরি গ্রীষ্মের দিকে তাকলো। স্যুট পরিহিত গ্রীষ্মকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। নিঃসন্দেহে গ্রীষ্ম সুপুরুষ তা মানতেই হয়।
মৌসন্ধ্যা আষাঢ়ের গাড়িতে যাবেনা। কথাটা একবার বলে দিয়েছে। এখন যদি সে আষাঢ়ের গাড়িতে ওঠে তবে একটা বড় ধরনের ল’জ্জা পাবে। তার থেকে ভালো গ্রীষ্মের সাথে যাওয়া। লোকটা তো আষাঢ়ের মতো অ’ভ’দ্র আর বে’য়া’দ’ব না! তাই সে চট করেই বলল,
-‘যাব।’

কথাটা শুনেই গ্রীষ্মের চোখেমুখে অন্যরকম প্রশান্তি ফুঁটে উঠল। সে বলল,
-‘একটু অপেক্ষা করো। গাড়ি নিয়ে আসছি।’

এদিকে শ্রাবণ মুকিতকে সরিয়ে বের হয়ে আসল গাড়ি থেকে। তারপর সামনে এসে বসে পড়ল। আষাঢ় তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই বলল,
-‘ভাই! দেরি হয়ে যাচ্ছে চল! ও তো গ্রীষ্ম ভাইয়ের সাথে যাচ্ছে। সমস্যা নেই আর। চল চল! আমার ক্ষুধা লাগছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে খেতে হবে।’

আষাঢ় ক্রু’দ্ধ নয়নে মৌসন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। তারপর দেরি না করেই গাড়ি নিয়ে ছুটলো। মৌসন্ধ্যা সেদিকেই তাকিয়ে রইল। এদিকে গ্রীষ্মও গাড়ি নিয়ে এসেছে। হর্ণ বাজাতেই মৌসন্ধ্যা সেদিকে তাকায়। তারপর গাড়িতে উঠে বসল। আজ আর ভুল করল না! সিটবেল্ট লাগিয়ে নিলো।

গাড়িতে উঠার পর গ্রীষ্ম তার গায়ের কোর্টটা খুলে পেছনের সিটে রাখে। তারপর শার্টের হাতা একটু গুটিয়ে নিয়ে ড্রাইভ করতে থাকে। মৌসন্ধ্যা বাহিরে তাকিয়ে কোলাহল ময় ঢাকা শহর দেখছিল। তারপর গ্রীষ্মের দিকে তাকালো। লোকটা একমনে ড্রাইভ করে চলেছে। পুরুষালি শক্ত হাতটা খুব আকর্ষনীয় লাগল মৌসন্ধ্যার কাছে। নিজের উপরেই সে বিরক্ত হলো। সে কেন গ্রীষ্মকে নিয়ে এতকিছু ভাবছে! কিন্তু চোখ সরালেও নাকের তো আর কোনো গতি করতে পারল না। যার ফলে গ্রীষ্মের পারফিউমের ঘ্রাণটা তার নাকে এসে ধা’ক্কা খায়। সে আনমনেই চোখ বুজে ফেলে। কী রিফ্রেশিং! আর কেমন একটা অনুভূতিপূর্ণ ঘ্রাণ। হ্যাঁ, ঘ্রাণেও অনুভূতি রয়েছে। একটা অন্যরকম অনুভূতি। যার ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। তার এই ভালোলাগার রেশ কাটে রিংটোনের শব্দে। গ্রীষ্মের কল এসেছে। সে বাম হাতে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশ থেকে কি বলল শোনা গেল না। তবে গ্রীষ্মের কথা শুনতে পেল সে।
-‘হ্যাঁ, আমি রওনা দিয়েছি। তোরা কোথায়? আহরার আর সৌম্য আছে তোর সাথে!’
এবারও শোনা গেল না ওপাশের ব্যক্তির কথা। গ্রীষ্ম পুনরায় তার জবাবে বলল,
-‘আচ্ছা তোরা পৌঁছে আমাকে কল করিস। বাবা আর চাচারা সবার আগেই রওনা হয়েছে। আজকে আমারই দেরি। ঠিক আছে তোরা সাবধানে যাস।’

মৌসন্ধ্যা বুঝল যে আহরার আজ এইখানে আসেনি। অন্য বন্ধুদের সাথেই যাচ্ছে সে। যাই হোক! হয়তো সেখানে গেলেই তার দেখা পাওয়া যাবে। গাড়ি যখন একের পর এক দোকান পার হচ্ছিল তখন গ্রীষ্ম বলল,
-‘জৈষ্ঠ্য! তোমার বেলী ফুল ভালো লাগে?

মৌসন্ধ্যা আকস্মিক গ্রীষ্মের এই কথা শুনে কিছটা চমকে গেল। তারপর নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
-‘আমার প্রিয় ফুল বেলী।’
-‘আমারও বেলী ফুল প্রিয়। তবে দ্বিতীয়তে। প্রথমে হলো গোলাপ। ট’ক’ট’কে লাল গোলাপ আমার ভীষণ পছন্দ।’

মৌসন্ধ্যা সেই কথা শুনে মৃদু হাসল। হঠাৎ গ্রীষ্ম গাড়ি থামায়। মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘কী হলো!’
সিটবেল্ট খুলতে খুলতে গ্রীষ্ম জবাব দিল,
-‘একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।’

গ্রীষ্ম গাড়ি থেকে নেমে পড়লে মৌসন্ধ্যা আশেপাশের দোকানগুলোর দিকে ভালো করে তাকায়। গ্রীষ্ম যে পাশে বসেছে সেই দিকের অর্থাৎ তার হাতের ডান পাশের দোকানগুলোর দিকে তাকাতেই দেখল সব ফুলের দোকান। গ্রীষ্ম সেদিকেই গেছে। দুই মিনিটের মধ্যেই গ্রীষ্ম ফিরে এলো। তার হাতে কাগজের ঠোঙা। তার ভেতরে কিছু আছে। গ্রীষ্ম সিটবেল্ট লাগিয়ে নিয়ে সেই ঠোঙাটা মৌসন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দিলো। মৌসন্ধ্যা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, হাতে নেয় না। গ্রীষ্ম হেসে বলল,
-‘নাও! বেলী ফুলের মালা এনেছি। অবশ্য লোকটি গাজরা না কি বলল! আমার তো মালা-ই মনে হচ্ছে। খোপায় লাগালে আরো বেশি সুন্দর লাগবে।’

কথাটা শুনে মৌসন্ধ্যা ল’জ্জা পেল। আরো বেশি সুন্দর লাগবে মানে? গ্রীষ্ম কি তাকে ইনডাইরেক্টলি সুন্দর লাগছে বলছে! আর সে কেন তার জন্য ফুল আনতে গেল? গ্রীষ্মের হাত থেকে সে ঠোঙাটা নিলো। তাতে গ্রীষ্ম মৃদু হেসে পুনরায় ড্রাইভ করতে থাকে। মৌসন্ধ্যা দেখল বেশ সুন্দর তাজা ফুল। সে মন ভরে ঘ্রাণ নিলো। তারপর নিজ হাতে খোপায় ফুল গুজতে থাকে। তাতে তার চুড়ির টুং টাং শব্দ হচ্ছিল। গ্রীষ্মের কাছে সেই মুহূর্তটা এত রোমাঞ্চকর লাগছিল! ফুল খোঁপায় লাগানোর পর মৌসন্ধ্যা নিজের পার্স থেকে ছোট একটা আয়না বের করল। সেই আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। আসলেই, ম’ন্দ লাগছেনা। সে গ্রীষ্মের দিকে তাকিয়ে ফুলটার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে চাইলে তার আগেই গ্রীষ্ম বলল,
-‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে জৈষ্ঠ্য!’

মৌসন্ধ্যার মনে হলো তার জনম ভর এমন দারুন রকমের প্রশংসা সে পায়নি। অথচ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে কথাটা কতটাই না কমন! কত জনের মুখ থেকেই তো শুনেছে। আজকে এমন লাগছে কেন?
সে গ্রীষ্মের সেই সৌমদর্শন মুখটার দিকে তাকিয়েই বলল,
-‘আপনাকে ধন্যবাদ। এই এত সুন্দর ফুলের জন্য।’

প্রতুত্তরে গ্রীষ্ম একবার তার দিকে তাকিয়ে হাসে। সেই হাসি দেখেই মৌসন্ধ্যার মনের ভেতরে যে দু’টি চোখ ছিল সেই চোখ দু’টি জ্ব’লে গেল।

এদিকে যে গ্রীষ্ম অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়েছে তা সে বুঝল না। অবশ্য বুঝবে কীভাবে! সে তো চেনেই না। সে এই মুহূর্ত যা চেনে, যাকে চিনে সে হলো গ্রীষ্ম। একমাত্র গ্রীষ্ম!

১৭.
কিছু সময় পর,
গ্রীষ্ম গাড়িতে একটি গান ছাড়ে। মৌসন্ধ্যা সেই সুন্দর রবীন্দ্র সংগীতের মোহনীয় সুরে ডুবে যায়। আচ্ছা? গ্রীষ্মেরও কী তার মতো রবীন্দ্রসংগীত প্রিয়? এই উত্তর তার জানা নেই। এই উত্তর জানার জন্য প্রশ্নও সে করতে পারেনা। সে শুধু গানটা শুনে নিরবে, অনুভব করে।

ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণমঞ্জীরে।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি
তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী
তোমার কনককঙ্কণে।
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো
তোমার অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো
তোমার ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো
তোমার অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়োগ
তোমার অতুল গৌরবে…❣️

#চলবে।