জোনাকি প্রদীপ পর্ব-০১

0
388

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১)

ডান চোখের কাজল কিছুতেই ঠিকঠাক দেয়া যাচ্ছে না বল ভীষণ বিরক্ত হলো নীরা। একবার চোখের নিচে লাগিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছিল। তাই কোনো রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। কাজলের কৌটো হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো নিজের ঘর থেকে। ইরাকে খুঁজছে। ওর ছোট চাচার মেয়ে। কাজের সময় কাউকে পাওয়া যায় না। এটাই সবচাইতে বড় সমস্যা।

ভাইয়ার বিয়ের বাকি আর মাত্র তিনদিন। বাড়িতে পুরোদমে সংস্কার কাজ চলছিল। সেটা শেষ যদিও। এখন রুম গোছাগাছ চলছে। আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনাও শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। নীরা নিজেও বাসায় এসেছে সপ্তাহখানেক হলো। অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভাইয়ার বিয়েটাও এরমধ্যে পড়ে গেল।

সবার মধ্যে এমন এক চোখে কাজল নিয়ে ঘোরাটা অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকর। ইরার ঘরে ওকে না পেয়ে ভাইয়ার ঘরের দিকে গেল নীরা। ইরাকে সামনে পেলে ভীষণ ঝগড়া করবে সে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে।

ভাইয়ার ঘরে রীতিমতো আড্ডা বসেছে মনে হচ্ছে। হৈ হৈ, হাসি ভেসে আসছে। ভেতরে যাবে কি যাবে না ভাবছিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

“আরে, তুই নীরা না? কতদিন পরে দেখলাম।”

চমকে পেছনে তাকাল নীরা। আর স্থির হয়ে গেল।

“কত বড় হয়ে গেছিস?”

এবার নিজেকে সামলে নিল নীরা।

“মানুষ যেহেতু, সময়ের সাথে সাথে বড় হব এটাই তো নিয়ম আফনান ভাই। আপনি কেমন আছেন?”

একফোঁটা জড়তা নেই নীরার গলায়। অথচ কোনো একসময় লোকটাকে দেখলে বুক টনটন করে উঠত। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ উঠানামা হতো বলেই কিনা দম বন্ধ হয়ে আসত। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর কী যে বোকার মতো পালিয়ে বেড়িয়েছে সবকিছু থেকে নাকি নিজের কাছ থেকেই! তবে সময়টা ওর প্রয়োজন ছিল। আজ চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় কথা বলতে পারত না এতটা সময় না গড়ালে। নিজেকে গড়ে না নিলে।

আফনানকে দেখে নীরা একটুও বিস্মিত হয়নি। ভাইয়ার বিয়েতে তার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ আসবে না এটা হতেই পারে না। তবুও আচমকা এতগুলো বছর পরে সামনা-সামনি দেখে মুহূর্তের জন্য স্নায়ুবিক ক্রিয়া স্তিমিত হয়ে এসেছিল যেন। কী একটা মোহ গ্রাস করতে চাইছিল। তবে ওই একটা ক্ষণের জন্যই। এরপর সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। নীরার মস্তিষ্কের শক্ত খুলিকে পরাস্ত করার সাধ্য ওর মনের এখন আর নেই৷

“ভালোই। তোর সাথে আমার একটা কথা ছিল।”

“আমার সাথে? আমার সাথে আবার কী কথা?”

“আসলে সেদিন আমি… স্যরি রে..”

হাসল নীরা। এরপর খুব ধীর গলায় বলল, “সেদিনের এক কিশোরী মেয়ে কী বলতে কী বলেছিল! আপনিও না, সেটা এখনো ধরে বসে আছেন! আমার তো কিছুই মনে নেই, সেদিনের কথা, সেই সময়কার অনুভূতি, কিচ্ছু মনে নেই। আপনার সামনে আজ যে দাঁড়িয়ে আছে, সে একজন পূর্ণ বয়স্ক তরুণী। আবেগে ভেসে যাবার বয়স এখন আর তার নেই। আপনাকে তো আফনান ‘ভাই’ বললাম। আগে হলে বলতে পারতাম?”

আফনান পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল একবার, হাসিটা যেন কিঞ্চিৎ ম্লান, নাকি নীরার মনের ভুল!

“তুই আগে আমাকে তুমি করে বলতিস।”

“তাই বোধহয়। আসলে অনেকদিনের ব্যাপার তো। এতদিনে এত লম্বা সময়ে ব্রম্মপুত্রে কত জল গড়িয়েছে তার হিসেব করেছে কেউ? আগে কী করতাম ঠিক মনে নেই।”

“আমার মনে হয়েছিল আমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেছিলাম।”

নীরার চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে আসছে। মনে মনে বলল, “শুধুই বাড়াবাড়ি? একটা কিশোরী মেয়ের হৃদয়ের সমস্ত আবেগ তুমি দুমড়ে মুচড়ে পায়ে দলেছিল। একটা স্যরি’র এত শক্তি নেই যে তোমাকে ক্ষমা করে।”

“আরে তোরা ভেতরে না এসে এখানে কী করিস?”

ভেতর থেকে ভাইয়া হাঁক ছেড়ে ডাকলেন। নীরা ভেতরে যেতে যেতে একটু চেঁচিয়ে বলল, “তোমার সব ফ্রেন্ড বিয়ে করে ফেলল, তুমি কবে বিয়ে করবে আফনান ভাই? আমাদের দাওয়াত না দেয়ার মতলব নাকি?”

আফনান একবার চোখ তুলে নীরাকে নিরিক্ষণ করে ভেতরে এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “সব বন্ধুরা যেন তাদের বেটার হাফ নিয়ে আমার বিয়েতে আসতে পারে সেজন্য দেরি করছি। তোরাও দুধ ভাত হিসেবে দাওয়াত পাবি যা, চিন্তা করিস না।”

“কী আর করা! তোমার সামর্থ্য হয়নি সবাইকে দাওয়াত দেয়ার। নাই খেলাম।”

“থাম তো তোরা। তুই এক চোখে কাজল দিয়ে ঘুরছিস কেন নীরা?” নিলয়ের কথায় নীরা বলল,

“এটা স্টাইল। ভাবছি তোর বউকে এভাবে সাজাব বিয়ের দিন।”

“না বোন, কোনো প্রয়োজন নেই। এত আপ-টু-ডেট হবার কোনো দরকার নেই।”

নীরা হেসে বলল, “ভয় নেই। তোর বউ তোর মতো গাধা না। এভাবে সে সাজতে রাজি হবে কেন?”

এবার ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই চোখে যতটুকু যেভাবে দিয়েছি, এপাশেও সেভাবে দিয়ে দে।”

ঘর ভর্তি লোকের সামনে নিঃসংকোচে কথাটা বলে কৌটো এগিয়ে দিল নীরা। ইরা উঠে এসে বলল,

“চলো আপু, তোমার ঘরে যাই।”

যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও ঘর থেকে বের হচ্ছে এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে আর কারোর দিকে একবারও না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল নীরা। দরজা পেরোনোর পর আফনানের ফিসফাস শুনতে পেল,

“তোর বোনের মাথাটা এখনো খারাপ আছে মনে হয়।”

“তুই আমাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে এলি কেন?” আফনানের কথায় মেজাজের পারদ চড়েছে নীরার।

ইরা হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দিল, “তোমার কোনো কিছুতে অপ্রস্তুত লাগে না? সবসময় যা মুখে আসে তাই বলো। যা করতে ইচ্ছে করে সেটাই করো!”

“শোন ইরা, আমি নিজের ইচ্ছেকে প্রায়োরিটি দিই। ইচ্ছে লুকিয়ে লাভ কী? শুধু শুধু বোঝা বাড়ায়, জঞ্জাল তৈরি করে। আমি ফ্রি বার্ড, যখন ইচ্ছে উড়ে যাই, যখন ইচ্ছে ফিরি। জঞ্জাল বইবার ইচ্ছে নেই।”

কাজল দেবার পরে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল নীরা। কৈশোরের ছাপ চেহারা থেকে বহু আগেই মুছে গেছে। বাড়ির সবাই বলে ওর চোখ দুটো নাকি ভীষণ সুন্দর। একবার ওদের বিশ্বিবদ্যালয়ের অন্য ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলে এসে ওকে বলেছিল,

“আপনার চোখ ভীষণ গভীর, সুন্দর।”

নীরা তৎক্ষনাৎ বলেছিল, “বনলতা সেনের মতো?”

ছেলেটা ভ্যাবাচেকা খেয়েছিল। এরপর আর কথা বলতে আসেনি। যারা ওকে চেনে, তারা নীরাকে সহজে ঘাটায় না। কেউ প্রেম নিবেদন করতে এলে হাসিমুখের যেটুকু তাচ্ছিল্য তাদের মেলে, সেটা সহ্য করা শক্ত। সে অবশ্য কারোর সাথে উঁচু গলায় কথা বলে না। শীতলতাটুকুও যথেষ্ট অন্যের মনে ভীত ভাব জাগানোর জন্য।

এমন আচরণের জন্য কখন যে নীরা একা হয়ে গেছে, সে বুঝতেও পারেনি। যখন বুঝতে পেরেছে, তখন আর নিজেকে বদলানোর মনোবাঞ্ছা তৈরি হয়নি। অথচ সে একসময় বয়ে চলা নদীর মতোই চঞ্চল ছিল। ওর হৃদয়েও জোয়ার এসেছিল একবার।

নিলয় বরাবরই বন্ধু অন্তঃপ্রাণ মানুষ। ওর কাছের বন্ধুদের অবাধ বিচরণ ছিল এই বাড়িতে৷ দাদুর বাবা শিকার করতে ভালোবাসতেন৷ সেসব অস্ত্র, বাড়িতে এখনো আছে। ওরা এটার জন্য আস্তানা গাড়ত বাইরের ঘরটায়৷ সপ্তাহ ধরে চলত ওদের দূরের জঙ্গলে শিকার। কিছুদিন আগে ওই ঘরটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

নিলয়ের পাঁচ বছরের ছোট নীরা৷ যৌথ পরিবার। বাবা আর দুই চাচার বিশাল পরিবার একসাথে থাকে। পাঁচিল ঘেরা পুরনো আমলের আট্টালিকা সদৃশ বিশাল বাড়ি। কতদিন পরপর এখন এটার সংস্কার করা হয়। ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি করা হয় না, কারণ এখানে সবার অনেক স্মৃতি। পুরোনো আভিজাত্যের ছাপ বহন করে বাড়িটা, এটাই আদতে সবচাইতে বড় কারণ। তবে আর মনে হয় বেশিদিন এভাবে ধরে রাখা যাবে না।

***
সন্ধ্যা নেমেছে। বাড়ির পেছনের দিকটায় জোনাকির মেলা বসে। যেন একঝাঁক জোনাকি ছোট ছোট প্রদীপ জ্বেলেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে নীরা। কী এক অদ্ভুত টানে ওকে টানে জোনাকিগুলো।
…….
(ক্রমশ)
নুসরাত জাহান লিজা