জোনাকি প্রদীপ পর্ব-২+৩

0
293

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

নিলয়ের সাথে আনিকার সম্পর্ক শুরু হয়েছিল কলেজে পড়ার সময় থেকে। আনিকার পরিবার অনেক বেশি কনজারভেটিভ। সম্পর্কের কথা যখন তারা জানতে পারে, তখন প্রবল আপত্তি করেছিল। মাঝে যোগাযোগ বন্ধ ছিল অনেকদিন। কিন্তু চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল কথাটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওদের পরস্পরের প্রতি মনের টান এতে যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল।

নিলয়ের আনার্স থার্ড ইয়ারে থাকা অবস্থায় আনিকারও সেখানে চান্স হয়। তখন ওদের মধ্যে আবার কথোপকথন শুরু হয়। ক্যাম্পাসে প্রায়ই তাদের একসাথে দেখা যেত। পরে নিলয়ের পরিবারের মধ্যস্থতায় তাদের মতের পরিবর্তন হয়। ঠিক হয় দুজনের পড়াশোনা শেষ হলেই ওদের বিয়ে দেয়া হবে।

নিলয় পড়া শেষে একটা একটা জনপ্রিয় পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আছে প্রায় দেড় বছর হলো। আনিকার সদ্যই মাস্টার্স শেষ হয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো চার হাত এক করে দিচ্ছে দুই পরিবার।

দুজনের চোখে মুখ এখন নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর। কত রাত ওদের কেটেছে হারানোর ভয় নিয়ে। অবশেষে পরিণতি পাচ্ছে সম্পর্কটা।

“সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।”

আনিকার উচ্ছ্বসিত গলাটা যেন নিলয়েরও মনের কথা৷ আহা, প্রাপ্তি!

***
আফনানের আপাতত কিছু করার নেই। সকালের খাবার খেয়ে সে বাগানে এসে বসেছে। বাগানের গাছগুলোতে যত্নের ছাপ। কী একটা ফুলের সৌরভ ভেসে এসে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে।

এই বাড়িতে সকালের আর রাতের খাবারের সময় একটা উৎসবের আমেজ লেগে থাকে বলে ওর মনে হয়। তিন ভাইয়ের সন্তান সন্ততি মিলিয়ে উনিশ জন, সাথে আরও চারজন এই বাড়িতে নিয়মিত থাকে। এখন তো আত্মীয়স্বজনে ভরা বাড়ি। নিলয়দের বাড়ির এই জিনিসটা আফনানের ভালো লাগে।

মা, বোন আর আফনানকে নিয়েই ওর পরিবার। বোনের বিয়ে হওয়ায় দু’জন মাত্র মানুষ। সেই তুলনায় এখানে তো রীতিমতো জনারণ্য।

মা’কে কল করে কথা বলল সে। ওর মা আয়েশা ভীষণ শক্ত ধাতের মানুষ। ওদের দুই ভাইবোনকে যেভাবে আদরে-শাসনে বড় করেছেন, তাতে মা’য়ের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আফনানের মন বিগলিত হয়ে উঠে।

সে মাঝে বহুদিন নিলয়দের বাড়িতে আসেনি। এবার তাই অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ছে বাড়িটার। নিলয় আনিকার সাথে ফোনে কথা বলছে, শফিক আর রোমেল বাজারে গেছে কিছু জিনিসপত্র কিনতে।

আফনানের সারারাত ঘুম হয়নি একফোঁটা। এখন মাথা ব্যাথা করছে বলে যায়নি। ইরাকে এদিকে আসতে দেখল। সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে মেয়েটা। হাঁটা চলায় এক ধরনের চপলতা এখনো বিদ্যমান।

“আফনান ভাইয়া? আমাকে তোমার মনে আছে?”

“তোকে মনে থাকবে না? তোর যন্ত্রণায় চকলেট ছাড়া তোদের বাড়িতে আসা যেত নাকি!”

“আমি তখন ছোট ছিলাম।” গোমড়া মুখে বলল ইরা।

আফনান হাসল। ইরা প্রশ্ন করল, “তুমি হঠাৎ করে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলে কেন?”

“তুই এখনো তেমন বড় হোসনি ইরা।”

“কারণটা কি নীরা আপু?”

চমকে উঠে ইরার মুখের দিকে তাকাল আফনান। সহসা উত্তর খুঁজে পায় না সে৷

“আমি তখন সিক্সে না সেভেনে পড়তাম। নীরা আপু আগে একটুও পড়াশোনা করতে চাইত না৷ তুমি যখন থেকে আসা বন্ধ করলে তারপর আপুকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম একদিন রাতে৷ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে সারারাত আমার পাশে শুয়ে খুব কেঁদেছিল। ওই শেষ। এরপর আর কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি আপুকে৷ সারাদিন মুখ গুঁজে শুধু পড়াশোনা করত। ক্লাসে কোনোদিন বিশের এপাশে না আসা মেয়েটা ইন্টারমিডিয়েটে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিল। অনার্সের এখন অব্দি সিজিপিএ দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্টও যদি একইরকম হয়, তাহলে তো হলোই।”

শুনতে শুনতে আফনানের মনের মধ্যে কী যেন হচ্ছিল। একরাশ কৌতূহল ওকে টেনে ধরছিল, আবার মনের অন্য আরেকটা অংশ ওকে বারণ করছিল এসব শুনতে।

“নীরা আপুর ভয়ংকর জেদ আফনান ভাই। যখন ওর জেদি চেহারাটা দেখি আমার ভীষণ ভয় করে। এমনিতে অবশ্য খুব ভালোবাসে আমাকে। ওর ওই জেদটাই যা..”

“এসব ভুলভাল থিওরি কোথায় পেয়েছিস? কীসে যেন পড়িস তুই?”

“এডমিশন টেস্ট দেব।”

“ধ্যানটা ওদিকে রাখ।”

“আমি কিন্তু কাউকে বলব না, ভয় নেই। নীরা আপুকেও না।”

আফনান ম্লান হেসে বলল, “তোকে ছোট ভেবেছিলাম। তুই তো বিচ্ছু রে।”

ইরা একগাল হেসে বলল, “তোমার দিক থেকে নীরা আপুর জন্য…”

“ইরা, সময় এক জায়গায় থেমে থাকে না। নীরা এখন অনেক পরিণত, বদলে যাওয়া মানুষ। ওসব ছেলেমানুষি ভাবনা ওর মধ্যে আর নেই। আমার দিক থেকে আগে থেকেই তেমন কিছু নেই।”

বলল বটে কিন্তু গলায় জোর পেল না। আদতে নীরাকে সে তেমন একটা মনেও রাখেনি বোধহয়। মাঝেমধ্যে মনে হতো দেখা হলে একবার দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু গতকাল থেকে মনে হচ্ছে বিষয়টা বোধহয় এতটাও সহজ নয়। প্রগাঢ় অনুশোচনা ওকে দগ্ধ করছে। এতদিন এই আকুণ্ঠ ক্লেদ কোথায় ছিল সে জানে না। এখানে অন্য অনুভূতি তাই খুঁজতে চায় না আফনান। ঠিকঠাক একটা ক্ষমা পেলেই স্বস্তি।

“আফনানা ভা…”

“ইরা, আমি এই বিষয়ে তোর সাথে আর কোনো কথা বলতে চাইছি না।”

ইরার হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল নিমিষেই। আফনানের মনে হলো একটু যেন রূঢ়স্বরেই বলেছে কথাটা। কতদিন ধরে সে চেষ্টা করছে এই গলায় সে কখনো কথা বলবে না। এতদিন সেটা নিয়ন্ত্রণেও ছিল। এখন নীরার প্রসঙ্গ আসতেই নিজের স্নায়ুর উপরে কেন যেন নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

চলে যেতে উদ্যত ইরাকে থামিয়ে এগিয়ে এসে আফনান বলল, “ইরা, এই ভাইকে ক্ষমা করা যায়?”

ইরার মুখে হাসি ফিরে এলো। সে বলল, “যায়। যদি আগের মতো চকলেট দাও৷ আমাকে ভুলে গিয়ে আমার জিনিস আনোনি, এটা তার শাস্তি।”

আফনান হেসে বলল, “ঠিক আছে, পেয়ে যাবি।”

ইরা ছটফট করে হেঁটে চলে গেল। আশ্চর্য, আফনানের কেন যেন ভীষণ জানতে ইচ্ছে হলো, নীরা ওকে নিয়ে এখন কী ভাবছে!

নীরা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ওর বন্ধু মহলের সকলেই বিয়ে করে ফেলছে বা ফেলেছে। ও কবে করবে। মা প্রতিদিন বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে, ইউনিভার্সিটিতে কয়েকজন প্রস্তাবও দিয়েছিল প্রেমের। কই, সে তো সাড়া দিতে পারেনি।

অবচেতনেই একটা অশ্রুসিক্ত কাতর মুখ ওকে তাড়া করেছে সবসময়। সেখানে কি কেবলই অনুশোচনার বীজ ছাড়া অন্যকিছু প্রোথিত নেই? কে জানে! প্রাণপণে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল আফনান। নিলয় ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। বন্ধুর ভীষণ প্রিয় আদরের বোন নীরা। বন্ধুত্বের দাম ওর কাছে অনেক বড়।

ভাবনাগুলোকে প্রাণপণে সরিয়ে মাথা তুলতেই ওর চোখ চলে গেল দোতলার উঁচু রেলিং দেয়া খোলা বারান্দায়। সেখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরা। দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির। আফনানের বুক সহসা কেন যেন হিম হয়ে এলো!

একবার সামনা-সামনি প্রাণ খুলে কথা বলার প্রবল তৃষ্ণা ওকে পিপাসার্ত করে ফেলল। আচ্ছন্নের মতো আফনান তাকিয়ে রইল সেদিকে!
…….
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

নিলয়ের সাথে আনিকার সম্পর্ক শুরু হয়েছিল কলেজে পড়ার সময় থেকে। আনিকার পরিবার অনেক বেশি কনজারভেটিভ। সম্পর্কের কথা যখন তারা জানতে পারে, তখন প্রবল আপত্তি করেছিল। মাঝে যোগাযোগ বন্ধ ছিল অনেকদিন। কিন্তু চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল কথাটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওদের পরস্পরের প্রতি মনের টান এতে যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল।

নিলয়ের আনার্স থার্ড ইয়ারে থাকা অবস্থায় আনিকারও সেখানে চান্স হয়। তখন ওদের মধ্যে আবার কথোপকথন শুরু হয়। ক্যাম্পাসে প্রায়ই তাদের একসাথে দেখা যেত। পরে নিলয়ের পরিবারের মধ্যস্থতায় তাদের মতের পরিবর্তন হয়। ঠিক হয় দুজনের পড়াশোনা শেষ হলেই ওদের বিয়ে দেয়া হবে।

নিলয় পড়া শেষে একটা একটা জনপ্রিয় পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আছে প্রায় দেড় বছর হলো। আনিকার সদ্যই মাস্টার্স শেষ হয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো চার হাত এক করে দিচ্ছে দুই পরিবার।

দুজনের চোখে মুখ এখন নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর। কত রাত ওদের কেটেছে হারানোর ভয় নিয়ে। অবশেষে পরিণতি পাচ্ছে সম্পর্কটা।

“সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।”

আনিকার উচ্ছ্বসিত গলাটা যেন নিলয়েরও মনের কথা৷ আহা, প্রাপ্তি!

***
আফনানের আপাতত কিছু করার নেই। সকালের খাবার খেয়ে সে বাগানে এসে বসেছে। বাগানের গাছগুলোতে যত্নের ছাপ। কী একটা ফুলের সৌরভ ভেসে এসে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে।

এই বাড়িতে সকালের আর রাতের খাবারের সময় একটা উৎসবের আমেজ লেগে থাকে বলে ওর মনে হয়। তিন ভাইয়ের সন্তান সন্ততি মিলিয়ে উনিশ জন, সাথে আরও চারজন এই বাড়িতে নিয়মিত থাকে। এখন তো আত্মীয়স্বজনে ভরা বাড়ি। নিলয়দের বাড়ির এই জিনিসটা আফনানের ভালো লাগে।

মা, বোন আর আফনানকে নিয়েই ওর পরিবার। বোনের বিয়ে হওয়ায় দু’জন মাত্র মানুষ। সেই তুলনায় এখানে তো রীতিমতো জনারণ্য।

মা’কে কল করে কথা বলল সে। ওর মা আয়েশা ভীষণ শক্ত ধাতের মানুষ। ওদের দুই ভাইবোনকে যেভাবে আদরে-শাসনে বড় করেছেন, তাতে মা’য়ের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আফনানের মন বিগলিত হয়ে উঠে।

সে মাঝে বহুদিন নিলয়দের বাড়িতে আসেনি। এবার তাই অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ছে বাড়িটার। নিলয় আনিকার সাথে ফোনে কথা বলছে, শফিক আর রোমেল বাজারে গেছে কিছু জিনিসপত্র কিনতে।

আফনানের সারারাত ঘুম হয়নি একফোঁটা। এখন মাথা ব্যাথা করছে বলে যায়নি। ইরাকে এদিকে আসতে দেখল। সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে মেয়েটা। হাঁটা চলায় এক ধরনের চপলতা এখনো বিদ্যমান।

“আফনান ভাইয়া? আমাকে তোমার মনে আছে?”

“তোকে মনে থাকবে না? তোর যন্ত্রণায় চকলেট ছাড়া তোদের বাড়িতে আসা যেত নাকি!”

“আমি তখন ছোট ছিলাম।” গোমড়া মুখে বলল ইরা।

আফনান হাসল। ইরা প্রশ্ন করল, “তুমি হঠাৎ করে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলে কেন?”

“তুই এখনো তেমন বড় হোসনি ইরা।”

“কারণটা কি নীরা আপু?”

চমকে উঠে ইরার মুখের দিকে তাকাল আফনান। সহসা উত্তর খুঁজে পায় না সে৷

“আমি তখন সিক্সে না সেভেনে পড়তাম। নীরা আপু আগে একটুও পড়াশোনা করতে চাইত না৷ তুমি যখন থেকে আসা বন্ধ করলে তারপর আপুকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম একদিন রাতে৷ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে সারারাত আমার পাশে শুয়ে খুব কেঁদেছিল। ওই শেষ। এরপর আর কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি আপুকে৷ সারাদিন মুখ গুঁজে শুধু পড়াশোনা করত। ক্লাসে কোনোদিন বিশের এপাশে না আসা মেয়েটা ইন্টারমিডিয়েটে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিল। অনার্সের এখন অব্দি সিজিপিএ দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্টও যদি একইরকম হয়, তাহলে তো হলোই।”

শুনতে শুনতে আফনানের মনের মধ্যে কী যেন হচ্ছিল। একরাশ কৌতূহল ওকে টেনে ধরছিল, আবার মনের অন্য আরেকটা অংশ ওকে বারণ করছিল এসব শুনতে।

“নীরা আপুর ভয়ংকর জেদ আফনান ভাই। যখন ওর জেদি চেহারাটা দেখি আমার ভীষণ ভয় করে। এমনিতে অবশ্য খুব ভালোবাসে আমাকে। ওর ওই জেদটাই যা..”

“এসব ভুলভাল থিওরি কোথায় পেয়েছিস? কীসে যেন পড়িস তুই?”

“এডমিশন টেস্ট দেব।”

“ধ্যানটা ওদিকে রাখ।”

“আমি কিন্তু কাউকে বলব না, ভয় নেই। নীরা আপুকেও না।”

আফনান ম্লান হেসে বলল, “তোকে ছোট ভেবেছিলাম। তুই তো বিচ্ছু রে।”

ইরা একগাল হেসে বলল, “তোমার দিক থেকে নীরা আপুর জন্য…”

“ইরা, সময় এক জায়গায় থেমে থাকে না। নীরা এখন অনেক পরিণত, বদলে যাওয়া মানুষ। ওসব ছেলেমানুষি ভাবনা ওর মধ্যে আর নেই। আমার দিক থেকে আগে থেকেই তেমন কিছু নেই।”

বলল বটে কিন্তু গলায় জোর পেল না। আদতে নীরাকে সে তেমন একটা মনেও রাখেনি বোধহয়। মাঝেমধ্যে মনে হতো দেখা হলে একবার দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু গতকাল থেকে মনে হচ্ছে বিষয়টা বোধহয় এতটাও সহজ নয়। প্রগাঢ় অনুশোচনা ওকে দগ্ধ করছে। এতদিন এই আকুণ্ঠ ক্লেদ কোথায় ছিল সে জানে না। এখানে অন্য অনুভূতি তাই খুঁজতে চায় না আফনান। ঠিকঠাক একটা ক্ষমা পেলেই স্বস্তি।

“আফনানা ভা…”

“ইরা, আমি এই বিষয়ে তোর সাথে আর কোনো কথা বলতে চাইছি না।”

ইরার হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল নিমিষেই। আফনানের মনে হলো একটু যেন রূঢ়স্বরেই বলেছে কথাটা। কতদিন ধরে সে চেষ্টা করছে এই গলায় সে কখনো কথা বলবে না। এতদিন সেটা নিয়ন্ত্রণেও ছিল। এখন নীরার প্রসঙ্গ আসতেই নিজের স্নায়ুর উপরে কেন যেন নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

চলে যেতে উদ্যত ইরাকে থামিয়ে এগিয়ে এসে আফনান বলল, “ইরা, এই ভাইকে ক্ষমা করা যায়?”

ইরার মুখে হাসি ফিরে এলো। সে বলল, “যায়। যদি আগের মতো চকলেট দাও৷ আমাকে ভুলে গিয়ে আমার জিনিস আনোনি, এটা তার শাস্তি।”

আফনান হেসে বলল, “ঠিক আছে, পেয়ে যাবি।”

ইরা ছটফট করে হেঁটে চলে গেল। আশ্চর্য, আফনানের কেন যেন ভীষণ জানতে ইচ্ছে হলো, নীরা ওকে নিয়ে এখন কী ভাবছে!

নীরা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ওর বন্ধু মহলের সকলেই বিয়ে করে ফেলছে বা ফেলেছে। ও কবে করবে। মা প্রতিদিন বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে, ইউনিভার্সিটিতে কয়েকজন প্রস্তাবও দিয়েছিল প্রেমের। কই, সে তো সাড়া দিতে পারেনি।

অবচেতনেই একটা অশ্রুসিক্ত কাতর মুখ ওকে তাড়া করেছে সবসময়। সেখানে কি কেবলই অনুশোচনার বীজ ছাড়া অন্যকিছু প্রোথিত নেই? কে জানে! প্রাণপণে সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল আফনান। নিলয় ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। বন্ধুর ভীষণ প্রিয় আদরের বোন নীরা। বন্ধুত্বের দাম ওর কাছে অনেক বড়।

ভাবনাগুলোকে প্রাণপণে সরিয়ে মাথা তুলতেই ওর চোখ চলে গেল দোতলার উঁচু রেলিং দেয়া খোলা বারান্দায়। সেখানে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরা। দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির। আফনানের বুক সহসা কেন যেন হিম হয়ে এলো!

একবার সামনা-সামনি প্রাণ খুলে কথা বলার প্রবল তৃষ্ণা ওকে পিপাসার্ত করে ফেলল। আচ্ছন্নের মতো আফনান তাকিয়ে রইল সেদিকে!
…….
(ক্রমশ)