জোনাকি প্রদীপ পর্ব-১৬+১৭

0
170

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা

আরিফ খানের আড্ডাখানা থেকে বেরিয়ে শফিককে সাথে নিয়ে থানায় এলো আফনান। ওসি শাফকাত আলী নেই৷ একজন কনস্টেবল জানালো তিনি আসছেন। ওরা দু’জন থানার সামনের চায়ের দোকানে এসে বসল।

আফনানের মাথা ঝিমঝিম করছে। রাতে একফোঁটা ঘুম হয়নি। শায়লার অবস্থা শোচনীয়। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না৷ জোর করেও খাবার মুখে তোলা যাচ্ছে না। আয়েশা বহু কষ্টে দুটো খাইয়ে দিয়েছেন।

“তোর পেটে একজন আছে। তার ক্ষতি করবি?” মা’র বলা এই কথাটাতে কিছুটা কাজ হয়েছে।

সকালে বেরুবার আগে আকুল হয়ে শায়লা বলছিল, “রবিনকে নিয়ে ফিরবি তো!”

আফনান বোনের মাথায় হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তার এই বোনটা অভিমানী হলেও বেশ বুদ্ধিমতী। স্বজন হারানোর আশঙ্কা মেয়েটাকে কেমন দিশেহারা বানিয়ে দিয়েছে। উদভ্রান্ত দৃষ্টি, মাঝেমধ্যে নিস্প্রভ হয়ে যায়। ভাই হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।

শাফকাত আলীর সাথে দেখা হতেই তিনি জানালেন কাজ শুরু করেছেন তারা। তবে মর্গে নতুন একটা বেও য়া রি শ লা শ এসেছে। সেটাকে যদি তারা সনাক্ত করতে পারে।

আফনানের গলার স্বর রূদ্ধ হয়ে এলো। বুকে দমচাপা ব্যথা হলো। সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করল, “হে আল্লাহ। ভেতরে যেন রবিন না থাকে।”

শায়লা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। বিয়ের পর থেকেই আফনান দেখেছে শায়লা আর রবিন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারে না। কাজের সময়টুকু ছাড়া কোথাও গেলে একসাথে যায়। সামান্য জ্বর হলেও অন্যজন অধীর হয়ে পড়ে। কী করে সহ্য করবে!

নতুন প্রাণের আগমনী বার্তায় দুজনে মিলে কত স্বপ্ন বুনেছিল অনাগত প্রাণকে ঘিরে। সেই স্বপ্ন…
আর ভাবতে পারে না আফনান।

“কই, আসুন!”

এবার সচকিত হলো আফনান। লা শ দেখে এতক্ষণ আটকে রাখা দম ছাড়ল। না, এটা রবিন নয়।

“রবিনের সমস্ত ডিটেইলস আমাদের দেবেন।”

“আপনারা খুঁজে বের করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন তো!”

“শুনুন আফনান, আমরা প্রফেশনাল জায়গা থেকে কাজ করি। আপনি যার নামে জিডি করেছেন, তাকে বড়জোর নর্মাল জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি। এরবেশি জানি না। নিশ্চয়তা দিতে পারব না।”

“আপনি এসব খোলাখুলি আমাকে বলছেন কেন?”

“কারণ একজন মানুষ হিসেবে আমারও কিছু মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট আছে।”

শাফকাতের কথার তাৎপর্য কতটা আফনান বুঝল জানে না। তবে এটুকু বুঝল, তিনি যতই আন্তরিক থাকুন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার আসলেও কিছু করার নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়লার বাসায় ফিরবে কিনা ভাবছিল, কিন্তু সাহস হলো না আফনানের। শফিককে কাজে পাঠিয়ে দিল। রবিন আপাতত নেই, কিন্তু ওর কাজগুলো যেন পড়ে না থাকে।

আফনান রাস্তায়, ফুটপাতে এলোমেলো হাঁটল বহুক্ষণ। হঠাৎ মনে হলো কেউ ওকে অনুসরণ করছে। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে হদিস পেল না। কতক্ষণ পরে ওর মোবাইল বেজে উঠল,

“দুই ঘণ্টা সময় দিলাম। এরমধ্যে কেস না তুইলে নিলে তোর খবর আছে।”

হুমকি, এই তো। এভাবেই গর্ত থেকে বেরুবে ওরা। তবে ওদের সাথে সে একা লড়তে পারবে তো!

সহসা ওর মনে হলো নিলয়ের কথা। এই মুহূর্তে ওর মতো একজন সাহসী ক্রাইম জার্নালিস্টের সাহায্য ওর সবচেয়ে দরকার। কাজের সূত্রেই এসব ফিল্ডের অনেক প্রভাবশালী লোকজনের সাথে ওর পরিচিতি আছে। তাদের মাধ্যমে যদি কিছু করা যায়।

মিডিয়া অব্দি যদি এই খবরটা পৌঁছানো যায়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। রবিনের ইতোমধ্যে খারাপ কিছু করে ফেলেনি তো ওরা! নইলে এতটা ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে কেন ধামাচাপা দিতে! চকিতে মনে এমন ভাবনা এলেও প্রাণপণে তা সরিয়ে দিল আফনান৷ কোনোধরণের দুর্ভাবনা সে আগ বাড়িয়ে প্রশ্রয় দিতে চায় না।

রবিনের নিখোঁজ হবার জন্য যারা দায়ী, তাদের টেনে বের করতে পিছপা হবে না আফনান। তাতে যা হয় হোক, সে পরোয়া করে না। জীবনে বহুবার সে পরাজিত হয়েছে। এবার আর চায় না।

***
সায়মন ফেরার আগে একবার নীরার সাথে দেখা করবে ভেবেছিল। সেই মনোভাব বকুলের কাছে ব্যক্ত করল সে।

“তোমাদের আদরের পাত্থর কোথায়? তার দর্শন কি একবার পাওয়া যাবে?”

বকুল হেসে বললেন, “সব পাথরের সংস্পর্শে কী আর ব্যথা হয় রে? কিছু পাথর তো পরশ পাথর হয়! নীরা হলো পরশ পাথর।”

“সেই, আর আমি কী? তার গুণমুগ্ধ ভক্ত। কবে সেই পরশ পাথরের সুমতি হবে আর আমার প্রতি সদয় হয়ে আমার ভাগ্যাকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ সে পাল্টে দেবে!”

বকুল আলতো করে চাপড় মারলেন সায়মনের হাতে।

“তোর সবেতেই ফাজলামো। পাজি ছেলে!”

“দুষ্টু ছেলের সাথে মিষ্টি মেয়ের কম্বিনেশন হয় শুনেছি। নীরা দেখতে মিষ্টি, কিন্তু পাথর হৃদয়। আমার ক্ষেত্রে হবে দুষ্টু ছেলে প্রস্তর মেয়ের কম্বো। অবশ্য যদি মহারাণীর কৃপা হয়!”

“তা ওই প্রস্তর গলাতে চেষ্টা করতে হয় তো।”

সায়মন হাসলেও এই প্রথম কেন যে শঙ্কা হলো মনে। এত কঠিন কেন মেয়েটা! মাঝেমধ্যে এমনভাবে তাকায় ওর ভেতরে সমীহ জাগানিয়া ভয় হয়! পারবে তো তাকে জয় করতে!

***
ইরা পড়া থেকে কিছুটা বিরতি নিয়ে নিজের মোবাইলটা হাতে নিল। হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি এসেছে। নম্বরটা শাফিনের। মন আন্দোলিত হলো।

একটা ছবিতে ক্লিক করতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ওর হাতে বসা প্রজাপতি। সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটা এত জীবন্ত হয়েছে। নিজের ছবি দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেল।

বাচাল হলে কী হবে, ছেলেটার ছবি তোলার হাত তো দারুণ। নিলয় ভাইয়ার বিয়ের ছবিগুলোও সুন্দর হয়েছে।

উত্তরে ধন্যবাদ লিখতে ইচ্ছে করল না। লিখল,

“ছবি তো সুন্দর হয়েছে। পেমেন্ট না নিয়ে চলে গেলেন যে!”

প্রায় সাথে সাথে উত্তর এলো, “আপনার পছন্দ হয়েছে। ধরে নিন এটাই আমার পারিশ্রমিক।”

“শুনেছিলাম আপনি প্রফেশনালি ছবি তোলেন। সব ক্লায়েন্টের প্রশংসা পারিশ্রমিক হিসেবে নিলে ব্যবসা তো লাটে উঠবে।”

“ভয় নেই, সবার ক্ষেত্রে এই অফার প্রযোজ্য নয় তো। স্পেশাল কারোর জন্য কেবল।”

ইরা ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ভালোলাগার এক টুকরো ফুরফুরে বাতাস হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ভীষণ ভালো লাগল কথাটা। এত অকপটে কেউ এভাবে বলে! এই ছেলেকে সে ভীতু ভেবেছিল!
…………
ক্রমশ

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা

মায়ের মনোভাব জানার পর নীরার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না সায়মনের সাথে দেখা করবার। তবে বকুল ফুপুর কথা ফেলতে পারল না। প্রধান ফটক পেরিয়ে রাস্তা ধরে দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল।

“নীরা, আপনি আমার সাথে কিছুটা হলেও সহজ হয়েছিলেন। কিন্তু আজ আবার…”

কিছুটা ইতস্তত করে আরেকবার বলতে শুরু করল সায়মন, “আমি বুঝতে পারছি, আপনি হয়তো আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আঁচ করতে পেরেছেন। তাই.. ”

“দেখুন, আমরা চলার পথে নানারকম মানুষের সাথে পরিচিত হই। কিছু সময়ের জন্য হয়তো পথ একসাথে জুড়ে যায়। তার মানে কি এটা যে, গন্তব্য এক?”

সায়মন বুদ্ধিমান ছেলে, কথার তাৎপর্য সে বোঝে। তবুও ওর সামনে দাঁড়ানো এই মানবীর কথাগুলো ভীষণ চাঁছাছোলা বলে মনে হলো। এত সহজে এমন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান কেউ করতে পারে! কিন্তু এই মেয়ে কেমন অবলীলায় ওকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে। তবুও সে দমে গেল না। মনের চোরা গলিপথ ধরে সে বহুদূর এগিয়ে গেছে। যথোপযুক্ত কারণ ছাড়া সে পিছিয়ে আসবে না!

“গন্তব্য এক হতেও পারে। ভুল পথে হেঁটে সঠিক গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় অনেক সময়। মানুষ কি আদৌ তার আল্টিমেট ডেস্টিনেশন সম্পর্কে জানে? যেটাকে সে গন্তব্য বলে ভেবে পথ চলে, সেই পথের শেষে গিয়ে হয়তো বোঝা যায়, ভুল জায়গায় চলে আসা হয়েছে।”

সায়মনের গলার নাছোড়বান্দা ভঙ্গি চিনতে ভুল হলো না নীরার। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক বেয়ে।

“আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেবেন আশা করি। আমার গন্তব্য যাই হোক না কেন, আপনার গন্তব্যের সাথে সেটা মিলবে না।”

“না মেলার তো একটা কারণ থাকে নীরা। আমি কি জানতে পারি?”

নিজের চূড়ান্ত অপমানের ছবিটা সে আঁকতে চায় না। যে কথাটা সকলের কাছে থেকে এতদিন ধরে হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে পেরেক ঠুকে বন্দী করে রেখেছে, তাকে এতদিন পরে কেন সে আলগা করে দেবে! জগদ্দল পাথর হয়ে তা বুকে জমে থাকুক। নইলে তো একেবারে শূন্য হয়ে যাবে! অসীম শূন্যতায় কি বাঁচা যায়! শ্বাস টানা যায়? যায় না, কিচ্ছু যায় না।

তাই বলল, “সেটা আপনার না জানলেও ক্ষতি নেই। আমার মনে হয় না আমি আপনাকে এমন কিছুর ইঙ্গিতও দিয়েছি বলে। তবুও আপনি আমার বন্ধু হতে চেয়েছিলেন। আমিও কিছুটা সহজ হয়েছিলাম। সেই দিক থেকে চাইছি, আমাকে ভুলে যান।”

“ভুলতে চাইলেই কি ভুলে থাকা যায়! কাঁচের মতো হৃদয়ও যদি একবার এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায়, সে কি আর জোড়া লাগে না? লাগে না।”

“আমার বলার প্রয়োজন ছিল, বললাম। আর আমার কোনো দায় নেই।”

“আমি একাই সমস্ত দায় কাঁধে তুলে অপেক্ষায় থাকব নাহয়। ভালো থাকবেন নীরা। আবার দেখা হবে, খুব শীঘ্রই।”

“ভুল করবেন।”

“ভুল সব সময় ভুল হয়? ভুলের শেকড় থেকে কখনো ফুলও ফুঁটতে পারে।”

সায়মন আচমকা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল৷ হয়তো প্রত্যাখানের বেদনা লোকাতে। নীরার এই ব্যথা ভীষণ চেনা। তাই সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল। আর এগিয়ে গেল না।

মানুষ যে কেন কষ্ট বুক পেতে নেয়, সব জেনেশুনে, ইচ্ছে করে!

আকাশে আজ ঝলমলে রোদ। প্রখর সূর্যের কিরণ উপেক্ষা করে তাকিয়ে থাকা কষ্টকর। তবুও নীরা দাঁড়িয়ে রইল। সে নিজেই নিঃস্ব, অন্যকে কী করে দেবে!

রোদ জ্বলা দুপুরেও নীরার মনজুড়ে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কালবৈশাখীর আঁধারী মেঘ। সেই মেঘে বৃষ্টি হয় না, কারণ কেবলই তা কঠিন পাথর। তরলীকরণ সেখানে হয় না। জল নেই, উষর মরুভূমি ওর হৃদয় অরণ্যে।

***
ইলা বসে বসে একটা অংকের সমাধান করার চেষ্টা করছিল। পাশাপাশি ইরার হাবভাব খেয়াল করছিল। ইদানিং প্রায় বেশিরভাগ সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। যেন সারাক্ষণ টুথপেষ্টের বিজ্ঞাপন চলছে।

“ইরাপু, কী করো?”

“কিছু না।” আনমনে উত্তর দিল ইরা।

“কিছু না মানুষ কীভাবে করে? তুমি তো ফোনে কী যেন করছো?”

এবার চকিতে ইরা নিজের অনুজের দিকে মুখ তুলে চাইল, এরপর বলল, “এইসব প্যাঁচ আমাকে দেখাবি না। তুই দেখছিসই যেহেতু, তাহলে প্রশ্ন করছিস কেন খামাকা?”

“দেখার সাথে উত্তরের গড়বড় হলো বলেই তো মাথা ঘামাচ্ছি। সরাসরি উত্তর না দিয়ে কথা ঘোরাচ্ছ, তাতেই স্পষ্ট যে তুমি কথা লুকাচ্ছ।”

“ইলা, আল্লাহর ওয়াস্তে তুই কয়দিন তোর ওই হাবিজাবি গোয়েন্দা গল্প পড়া বন্ধ রাখ। মাথা আউলে দিচ্ছিস।”

“একদম হাবিজাবি গোয়েন্দা বলবে না কিশোর পাশাকে। ওইটুকু বয়স, আমার সমান, তাও কী ইন্টেলিজেন্ট!”

“কিন্তু তোর মাথায় জিলাপির প্যাঁচ। সেখানে গোবর ঠাসা। এখন ফ্যাঁচফ্যাচ না করে তুইও পড় আমিও পড়ি।”

“আমি তো পড়ছিলামই। তুমি উড়ুউড়ু করছিলেন।”

ইরা ততক্ষণে বইয়ের উপর থেকে মোবাইলটা সরিয়ে রেখে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দেবার প্রয়াস করছিল। কিন্তু ইলার পরের কথায় থমকে গেল মুহূর্তের জন্য।

“ফটোগ্রাফার ভাইয়ার তুলে দেয়া ছবি একটু বেশি পছন্দ হয়েছে তোমার, সেটা বুঝলাম। সাথে কি ফটোগ্রাফারও?”

এই মেয়ের বয়স কম হলে কী হবে, ইঁচড়েপাকা কচ্ছপ একটা। ইরা ওকে আমলে নেবার চেষ্টা না করে বলল, “এক চড়িয়ে তোর গাল ছিঁড়ে দেব। একদম পাকামো করবি না। পড়।”

ইলা এবার উত্তর না দিলেও সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মুখে। আজ একটা রহস্য সমাধান করা হয়েছে। এবার নীরা আপুরটা।

***
পাঁচ দিন হয়ে গেল রবিন নিখোঁজ। আফনান এই অবস্থায় কর্মস্থলে যেতেই পারছে না। আবার এই দুর্মূল্যের বাজারে এমন একটা চাকরি ছেড়ে দেবার কথাও ভাবতে পারে না। অগত্যা ওদের এনজিওর এদিকে একটা ব্রাঞ্চ আছে। খানিকটা চেষ্টা করে এদিকে ট্রান্সফার হয়েছে। এখনো জয়েন করা হয়নি।

শায়লার অবস্থা ভীষণ শোচনীয়। তবে এখন একটু বুঝতে চেষ্টা করছে, বাচ্চাটাকে সে কষ্ট দিতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যে হুহু করে কেঁদে ফেলে, রাতে ঘুমোয় না। মাঝেমধ্যে কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো একা একা কথা বলে। আয়েশা আর আফনান দু’জনেই ভীষণ চিন্তিত। রেগুলার ট্রিটমেন্ট চলছে, তবে আফনান ভাবছে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট যদি দেখানো যায়! কিন্তু এই এলাকায় সেটা সম্ভব নয়।

ওদিকে নিলয় নিজেই এসেছিল, সাথে ওর পরিচিত কিছু নিরপেক্ষ সাহসী সাংবাদিকদের। রবিনের নিখোঁজ হবার সাথে কোন প্রভাবশালী মহলের আনাগোনা, সেটা নিয়েও তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করেছে। তাতে যে কাজটা হয়েছে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তৎপর হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়ায় চর্চা করছে অনেকেই।

তবুও সময়ের সাথে সাথে আফনানের আশার প্রদীপ টিমটিমে হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে সে নিজে বেশ বড়সড় হু ম কি পেল স্বয়ং আজমল খানের কাছ থেকে।

রাস্তায় হাঁটছিল, তখন একটা গাড়ি থেকে একজন লোক নেমে এসে বলল, “এই, এদিকে এসো। মিনিস্টার স্যার কথা বলবেন।”

এভাবে বলায় আফনানের প্রতিবাদী সত্তা জেগে উঠছিল, কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায় সেটাকে অনবদমিত করে এগিয়ে গেল।

গাড়ির ভেতরে যাবার আগে একজন সিকিউরিটি গার্ড এসে ওর তল্লাশি করল কোনো অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে কিনা! নিশ্চিত হয়ে ইশারা করল, ভেতরে আসতে।

গাড়িতে বসল আফনান, আজমল খানের সৌম্য চেহারা টেলিভিশনে, পোস্টারে দেখা যায়। তবে আজ আফনান কাছ থেকে দেখল প্রথমবার। চোখ দুটো এতটাই ধূর্ত, যেন স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হয় না। গলার স্বর অতিরিক্ত ঠান্ডা।

“তুমি মিডিয়া বিদায় করো। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছ।”

“স্যার, আমি খুব সাধারণ মানুষ। তাদের কাছে জগতের বাকিসব কিছুর চাইতে জীবন আর সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া মিডিয়া খবর পেয়ে এসেছে। এখন প্রায় পুরো দেশের মানুষ জানে। এখন আর আমার হাতে কিছু নেই।”

একেবারে নির্ভয়ে দৃঢ় গলায় বলল আফনান।

“আগুনে হাত দিয়ে ঠিক কোরো নাই হে।”

বাকি আর উত্তর দেয়া হয়নি। তার সময়ের মূল্য অপরিসীম। এত ব্যস্ততার ভীড়ে যে উনি আফনানের মতো নিতান্তই চুনোপুঁটির কাতারে নিজে নেমে এলেন, এটুকুও তো স্বার্থকতা। ওদের মতো ক্ষমতাসীন লোকদেরও সামান্য মাথা ব্যথার কারণ সে হতে পেরেছে।

***
“সামনে নির্বাচন। তুমি তার আগে এসব করে সব ঘেঁটে দিয়েছ।”

কর্তৃত্ব পূর্ণ গলায় বললেন আজমল সাহেব। লোকটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কর্তৃত্বের চিহ্ন। প্রত্যেকেই তাকে অত্যন্ত ভয় পায়। তার পুত্র আরিফ খানও এই দলে। তবে সে বাবার মতো এই জিনিসটা রপ্ত করতে পারেনি। হম্বিতম্বি করা স্বভাব তার।

“আমি কী করলাম? ওই রবিন আমারে লা শ গ…..”

“বুদ্ধির ঢেঁকি তুমি। একটা কাজ ঠিক মতো করতে পারো না। ওরেও কি… ”

“না আব্বা, ওইটার আয়ু নির্বাচনের জন্য বাড়ছে। বস্তির কেসটার একমাত্র আই উইটনেস ব্যাটা। তবে একবার খালি নির্বাচন হয়ে যাক, ওই দোকানদার আর তার শালা দুইটারেই একেবারে শেষ করে দিতে হবে।”
………
(ক্রমশ)