জোনাকি প্রদীপ পর্ব-১৪+১৫

0
172

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৪.১)
নুসরাত জাহান লিজা

আফনান মা’কে নিয়ে শায়লার বাসায় এসেছে সাথে সাথেই। বোনের ভয়ার্ত আর্তি শুনে নিজেকে কে-ই বা ধরে রাখতে পারে!

এসে দেখল শায়লা কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

“কোনো খবর পাওয়া গেল?” আফনানের প্রশ্নে রবিনের এক দূর সম্পর্কের খালা আমেনা বেগম ওদের সাথে এই বাসায় থাকেন। তিনি বললেন,

“না। শফিকরা খুঁজতেসে। পায় নাই এহনো।”

শায়লার মাথায় হাত দিয়ে বৃথা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে আফনান বলল, “আমি শফিকের সাথে কথা বলি গিয়ে। এই অবস্থায় তোর এভাবে ভেঙে পড়াটা ক্ষতিকর। একটু শান্ত হ।”

বিলাপের মতো করে শায়লা বলল, “একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ, এইভাবে বলা নেই কওয়া নেই, কই গেল?”

আফনান বলল, “আমি দেখছি, হয়তো ফোনে চার্জ নেই। জরুরি কোনো কাজে ফেঁসে গেছে। তুই একটু শান্ত হয়ে বস। আমি আসছি।”

এখানে নষ্ট করার মতো সময় নেই আফনানের। সত্যিই কোনো বিপদ হলো কিনা দেখা দরকার সবার আগে। রবিনের দায়িত্বজ্ঞান টনটনে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে টেনশনে ফেলে সে এভাবে ডুব দেবার মানুষ নয়। কেন যেন মনে কু ডাকছে।

শো-রুমে এসে দেখল আরিফ বসে আছে। শফিক ছুটোছুটির মধ্যে আছে। মুরাদ কাছ থেকেই আফনান ব্যবসায়িক ঝামেলার আদ্যোপান্ত শুনল।

এলাকার প্রভাবশালী লোক আজমল খান। তার বখে যাওয়া আদুরে পুত্র আরিফ বাবার ছত্রছায়ায় চাঁ দা বা জি করে বেড়ায়। এলাকায় ত্রা স সৃষ্টি করেছে। এর সাথেই গতকাল বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। তাতে রবিন গা করেনি।

আজ নাকি হু ম কি দিয়েছে যে, “আমার সাথে তেরিবেরি করে টিকতে পারবেন না। কত তালেবর দেখলাম৷ আপনে তো মিয়া চুনোপুঁটি। তাই চলাফেরা সাবধানে কইরেন।”

রবিনকে টলাতে অসমর্থ হয়ে বড় কোনো ক্ষতি করে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়।

সবটা শুনতে শুনতেই শফিক এলো। সে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেছে। কিন্তু কোত্থাও নেই। দোকান বন্ধ করে ওদের দুজনকে সাথে নিয়ে প্রথমে ওরা স্থানীয় হাসপাতালে খোঁজ করল। হদিস মিলল না। এরপর গেল থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করার জন্য।

ওসি সাহেবের নাম শাফকাত আলী। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স মনে হলো।

“কখন থেকে মিসিং?”

“আজ বিকেল চারটার দিকে দোকান থেকে বেড়িয়েছে। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।” শফিক উত্তর দিল।

“এখন বাজে সাড়ে দশটা৷ এত তাড়াতাড়ি জিডি করতে এলেন, তিনি তো বাচ্চা ছেলে না। হয়তো কোথাও…”

“আসলে একটা হুমকি এসেছিল, সেজন্য। পরে যদি দেরি হয়ে যায়।”

“তাই নাকি? তা এতক্ষণ এটা বললেন না কেন?”

এবার আফনান মুখ খুলল, “দেখুন, বেশ কয়েকদিন থেকে ঝামেলা হচ্ছে। রবিন কিন্তু জিডিও করেছিল আরিফ খানের নামে। আপনারা ব্যবস্থা করেছেন কি?”

“ব্যবস্থা তো মুখ দিয়ে করা যায় না। উপর মহলে তাদের বিরাট প্রভাব। হাতেনাতে প্রমাণ ছাড়া এসবে এগুনো যায় না, সব কিছুর একটা প্রসিডিওর আছে।”

“এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে কাজ শুরু করুন প্লিজ। আরিফ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন।” আফনান এবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ গলায় কথাগুলো বলল।।

“শোনেন, আপনার বয়সে সবার রক্ত গরম থাকে। তাই এভাবে বলছেন। আমরা আমাদের মতো কেসটা নিয়ে এগুব। আপনার কথায় তো প্রসাশন চলবে না।”

“আমি অনুরোধ করছি, প্লিজ, দেখুন রবিনের স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। ভেঙে পড়েছে। এটা একটা মানবিক আবেদন হিসেবে দেখুন প্লিজ।”

ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলেও অপরিসীম ধৈর্য ধরে নিজেকে শান্ত রাখল আফনান৷

“দেখুন, আমি কাজ শুরু করব। কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে লাগছেন, সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে। তার বাবা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। তার উপর আছে টাকা। টাকা আর পাওয়ার এই দুইটা থাকলে পুরো দুনিয়া তার হাতের মুঠোয় থাকে। মাথা গরম না করে বাসায় যান, আমরা দেখছি কদ্দুর কী করা যায়।”

“টাকা আর পাওয়ার যাদের নেই, তারা কি দেশের নাগরিক নয়? তাদের কি বেঁচে থাকার, আইনের সেবা পাবার অধিকার নেই?” উদগত রাগ চাপা দেয়া কঠিন হলো আফনানের জন্য।

বোনের অসহায় করুণ মুখটা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। মেয়েটা ভীষণ আআবেগপ্রবণ।

“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন আফনান সাহেব। যা বলছি সেটা করুন। কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেন না। যান।” শীতল গলায় বললেন শাফকাত।

এবার যেন খানিকটা নরম হলেন তিনি, মোলায়েম গলায় বললেন, “যার টাকা আছে, মানুষ তাকে মাথায় তুলে নাচে। সাথে পাওয়ার থাকলে তো সাত খু ন মাফ। তাদের ভুল আসলে ভুল নয়। তেল দেয়া মানুষ মৌমাছির মতো ছোঁক ছোক করে তাদের চারপাশে। তারা দিন বললে দিন, রাত বললে মানুষ মেনে নেয় এটাই রাত। সাদা কালো, তারা এদের চোখে দেখে। এটাই এখনকার নীতি। যার টাকা নেই, তার আদতে কোনো দাম নেই৷ মানুষ হয়তো তাকে বড়জোর সিমপ্যাথি দেখায়, কিন্তু কেউ তাকে আসলে গণ্য করে না। এটা নিরেট সত্য।”

বেরিয়ে আসতে আসতে আফনানের রাগ চড়ল। টাকা, ক্ষ ম তাই শেষ কথা। সততা, নীতিবোধ, মানবিকতা এসব কোথায়! অনেক আগে পড়া জীবনানন্দের একটা কবিতার লাইন এই চরম উত্তেজনার মধ্যেও মাথায় ঘুরল আফনানের।

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই;
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।”

কেন এমন হয়! সে একটা ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিল আফনান। আজ রাতটুকু সে অপেক্ষা করবে। কায়মনোবাক্যে সে চাইল রবিন যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে।

কিন্তু যদি না আসে, তবে পুলিশ কতদূর কী করতে পারবে তার নমুনা সে আজ পেয়েছে। সকাল হোক, সে নিজে গিয়ে দেখা করবে আরিফের সাথে। তা সে যেই হোক, যাই হোক।

আপাতত শায়লার মুখোমুখি হওয়াটাই সবচাইতে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হলো আফনানের। কীভাবে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! একা একা! নিজেকে এতটা অসহায় কোনোদিন লাগেনি আফনানের।
………
ক্রমশ

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৪.২)
নুসরাত জাহান লিজা

শাফিন চলে যাবে, নীরার কাছে বিদায় নিতে এসেছে। নীরা তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে।

“আর দুটো দিন থেকে যা, একসাথে যাওয়া যাবে তাহলে।”

“না নীরা আপু। এখানে সময়টা চমৎকার কেটেছে। আঙ্কেল, আন্টিকেও খুব ভালো লেগেছে।”

“বাবা, মাকে বলেছিস?”

“হ্যাঁ। খেয়ে একেবারে বিদায় নিয়ে এসেছি।”

নীরা এগিয়ে যাচ্ছিল, পথে ইরার সাথে দেখা।

“সাত সকালে বস্তা বেঁধে কই যান?”

ইরাকে স্পষ্টতই অবজ্ঞা করে শাফিন নীরাকে বলল, “তাহলে আসছি আপু।”

“সাবধানে যাস। পৌঁছে কল করিস।”

ইরা বলল, “নীরা আপু, একেবারে চলে যাচ্ছেন উনি?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি মাত্র ঘুম থেকে উঠলে। তোমার নামতে হবে না। আমি উনার সাথে যাচ্ছি।”

“ওর সাথে তোর কেন যেতে হবে?”

“এগিয়ে দিয়ে আসি। অতিথিকে বিদায়টা ঠিকঠাক দিতে হয়।”

ততক্ষণে শাফিন সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেছে। ইরা নীরাকে বলল,

“আপু, আসছি। এসে কথা বলি।”

বলেই ঝড়ের বেগে শাফিনের পিছু নিল। এদের মধ্যে কী ব্যাপার সে বুঝেই উঠতে পারল না।

নীরা খেয়াল করল বাগানে সায়মন টুথব্রাশ মুখে পায়চারি করছে। চোখাচোখি হতেই অপ্রস্তুত হেসে তড়িঘড়ি নিজেকে লুকিয়ে ফেলল সে। নীরার হাসি পেয়ে গেল৷

ওর ঘুম পাচ্ছে আবারও। কিন্তু এখন ঘুমানো যাবে না। কারণ ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে৷

***
“কী ব্যাপার? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। আপনি ভাব নিচ্ছেন কেন?”

ইরার কথায় শাফিন হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ভাবটা আপনার নিজস্ব সম্পত্তি। আমি সেটার ভাগ চাই না।”

“বিদায়ের সময় বলে যেতে হয় বাড়ির সবাইকে। এই ভদ্রতা জানেন না?”

“না। শিখিনি কখনো।”

“শিখে নেবেন। নইলে সভ্য সমাজে চলতে পারবেন না।” ইরা রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, “এত্ত জোরে কেউ হাঁটে নাকি? আপনি কি উসাইন বোল্টের কম্পিটিটর হিসেবে দুইশ মিটার স্প্রিন্টে নেমেছেন নাকি! অদ্ভুত লোক!”

“আমাকে জ্ঞান দেবার জন্য আপনি হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে পিছু পিছু আসছেন কোন দুঃখে?”

“দুঃখে না সুখে। আপনি আমার উপরে রেগে আছেন সেটা জানি। আজ চলে যাবেন জানতাম না।”

“জানলে কী করতেন?”

“পার্টি করতাম। একটু সুস্থির হয়ে দাঁড়ান দেখি। এভাবে দৌড়ে দৌড়ে কথা বলা যায় নাকি!”

এবার শাফিন দাঁড়াল।
“বলুন, কী বলবেন। শুনে কৃতার্থ হই।”

“আমার কথা শুনে কৃতার্থ না হয়ে উপায় নেই।”

শাফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই বিচ্ছু মেয়ের সাথে সে কথায় পারবে না।

“এই কয়দিন তো আপনি আমি একজন আরেকজনের সাথে বেসিক্যালি আপনি আমার সাথে খুব বাজে আচরণ করেছেন।”

“উল্টোটা।”

“যা-ই হোক, কিছুদিন পরে যদি আপনার অনুশোচনা হয় যে আমার মতো শান্ত একটা মেয়ের সাথে এমন করা ঠিক হয়নি। স্যরি বলতে না পারলে শান্তি নেই। অনুশোচনা খুব কঠিন জিনিস। তাই এই সমস্যা থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে এলাম।”

“তা কী সেই মুশকিল আসানের উপায়?”

শাফিনের ফোন আচমকা বেজে উঠল। ইরার হাতেও ফোন।

“আমাকে স্যরি বলার জন্য দিলাম নাম্বারটা।”

বলেই দৌড়ে চলে গেল ইরা। শাফিনের মুখে হাসি ফুটল এবার। ওকে বলে এখন নিজেই দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন! পাগল মেয়ে। সোজা কথা সোজাভাবে বলতে জানে না।

তবে যেমনই হোক, ইরার ভেতরে চমৎকার একটা মন আছে, এই মুহূর্তে উপলব্ধি করল শাফিন। চিৎকার করে বলল,

“আমি অবশ্যই আপনাকে কল করব।”

ইরা একবার থেমে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে আবার দৌড় দিল। শাফিনের হাসি চওড়া হলো।

***
রাত পেরিয়ে গেছে, রবিন ফেরেনি। রাতে বহু কষ্টে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে শায়লাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল। চারদিক থেকে খারাপ যেন আফনানকে আষ্টেপৃষ্ঠে প্যাঁচিয়ে ধরেছে। এভাবে বসে থাকা সম্ভব নয়।

সে সোজা চলে এলো আরিফ খানের পার্টি অফিসে। সাঙ্গপাঙ্গ বেষ্টিত আরিফ অত্যন্ত খোশ মেজাজে আছে বলে মনে হলো।

গার্ড ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না প্রথমে। তবে শেষ অব্দি দিল। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা যেন এখন থেকেই বৃথা বলে মনে হচ্ছিল। শফিককে বাইরে রেখে এসেছে।

আফনান মুখোমুখি হলো আরিফের। চোখে হিংস্র দৃষ্টি লোকটার। বুদ্ধিমান শয়তান বলে মনে হচ্ছে। এমন লোক ভয়ংকর।
……….
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৫)
নুসরাত জাহান লিজা

আরিফ খানের আড্ডাখানা যেটা তার সাঙ্গপাঙ্গের কাছে অফিসঘর হিসেবে পরিচিত, সেখানে এসেছে আফনান। উচ্ছৃঙ্খল, ব খা টে, বিপথগামী কিছু পোলাপান হচ্ছে এই আরিফের সাগরেদ। ভেতরে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। বসার কোনো জায়গা খালি নেই।

“তুমি কে? ডোনেশনের জন্য আসছো? তাইলে পরে, এখন সময় নাই।”

আফনানের মেজাজ চটে গেল, “আমি ডোনেশনের জন্য আসিনি। আপনার সাথে কথা আছে।”

আফনানের দৃঢ় গলায় ঘরের সবকটি লোক টানটান হয়ে বসল। এই ভঙ্গিতে বোধহয় কেউ এই লোকের সাথে কথা বলে না। তোয়াজ শুনতেই অভ্যস্ত।

“এই, গলা নামায়ে কথা বলো ভাইয়ের সাথে। বেয়াদবি আমরা বরদাস্ত করব না।”

আফনান জানে এখন মাথা গরম করবার সময় নয়। রবিনের খোঁজ এরা জেনে থাকলে তাতে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। তাই হাত মুঠো পাকিয়ে নিজেকে সংযত করল সে।

“রবিন কোথায়?”

আরিফ বলল, “রবিন কে?”

“যার শো-রুমে গিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে এসেছেন।” শান্ত গলায় বলল আফনান।

“এই ছোকরা, তোমার কি আমারে অনুসন্ধান অফিস মনে হয়? নাকি বাংলাদেশ বেতারের নিখোঁজ সংবাদ? আমি কেমনে জানব সে কই?”

“দেখুন, আপনার হুমকির পরেই সে নিখোঁজ। আপনাকে জিজ্ঞেস করলে আর কোথায় করব?”

“আমার এত খারাপ দিন আসছে যে, দুই পয়সার দোকানদাররে নিয়ে পড়ে থাকব?”

“দুই পয়সার দোকানদারের উপার্জনে কেন লোভ করেছিলেন তাহলে?”

আফনান শেষ পর্যন্ত আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিজেকে। এমনিতে সে ভীষণ সহনশীল। কিন্তু ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে।’ এই মূলমন্ত্রে সে বিশ্বাসী। চোখের সামনে তাই অন্যায্য কিছু হতে দেখল ওর ঘাড়ের রগ ত্যাড়া হয়ে যায়।

কথাটা বলার সাথে আরিফের দুজন সাগরেদ উঠে দাঁড়িয়েছিল, বেপরোয়া ভঙ্গি তাদের হাবভাবে।

“মুখ সামলাইয়া কথা কও।” তাদেরই একজন গর্জে উঠে শাসালো আফনানকে।

আফনান সেই শাসানো গায়ে না মেখে বলল, “রবিন আমার বোনের হাজব্যান্ড। সে গতকাল থেকে নিখোঁজ। আমি আবারও জিজ্ঞেস করছি, বলুন রবিন কোথায় আছে?”

আরিফ খান এবার রণহুংকার ছাড়ল, “অনেকক্ষণ থেকে তোর এসব সহ্য করতেসি। কারোর পাখা কী করে ছাঁটতে হয় তা আনি খুব ভালো করে জানি। ভালোই ভালোই ওয়ার্নিং দিতেসি, এই মুহূর্তে বাইর হ এইখান থেকে। নাইলে তোর কপালে দুঃখ আছে।”

“ভাইয়ে কিন্তু এহনতুরি শান্ত আছে।”

“রবিনের খোঁজ চাই আমি। তাকে কোথায় রেখেছ বলো। আমি ভালোই ভালোই চলে যাই।”

“এই ঘরে কোনো জঞ্জাল চাই না। সাফ কর তো।”

তাদের তথাকথিত ভাইয়ের খেদমতে কে আগে আসতে পারে, তাই নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাচ্ছিল।

একজন এগিয়ে এসে আফনানের কলারে হাত দিতে গেল, আফনানের রিফ্লেক্স ভালো। সে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে লোকটার হাত চেপে ধরল।

“এসবের প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি। তবে রবিনের হদিস কিন্তু আমি খুঁজে বের করবই। এটুকুই বলার ছিল।”

ভেতরে ভাঙচুর হলেও নিজেকে শক্ত রেখে দৃপ্ত পদক্ষেপে বেরিয়ে এলো আফনান। পেছনে কতগুলো ক্রোধান্বিত বিস্মিত দৃষ্টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করল। মৌঁচাকে ঢিল ছুঁড়েছে, কিছু মৌমাছির কামড় তো খেতেই হবে। তবে একলা পারবে না সে। এমন সংঘবদ্ধ চক্রের বিপরীতে সে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে।

কী করা যায় ভাবছে আফনান। তবে এখন ওর মাথায় সবকিছু ছাপিয়ে রবিনের চিন্তা। কোথায় আছে সে! এরমধ্যেই খারাপ কিছু ঘটে যায়নি তো! আশঙ্কায় দুলে উঠে ওর সমস্ত মন।

***
আনিকা আর নিলয়ের দিনকাল চমৎকার কাটছে। হানিমুনে যাবার প্ল্যান করছে। আনিকার ইচ্ছা নেপালে যাবার, ওদিকে নিলয় চাইছিল আপাতত দেশের মধ্যেই যেতে। কারণ ওর ছুটি আর বেশিদিন নেই। বিয়ের পরে এটা নিয়ে দুজনের খানিকটা মন কষাকষি চলছে।

“তুমি আগেও খুব বেশি সময় দিতে পারতে না৷ এখনো সেই একই গল্প। বিয়ের জন্য আরও কিছুদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে না?”

“আশ্চর্য! বিয়ে কি খালি আমি একা করেছি নাকি! সবার বিয়ের জন্য কি মাসভর ছুটি দেবে নাকি!”

“তোমার অজুহাত ধুয়ে তুমি পানি খাও।”

“ঠিক আছে। ধুয়ে দাও।” হেসে বলল নিলয়।

আনিকা আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। তবে সেটা প্রকাশও করল না। বলল,

“তা মিস্টার জার্নালিস্ট, এখন তাহলে হানিমুন প্ল্যান আপাতত থাকুক। পরে যখন তুমি টাইম ম্যানেজ করতে পারবে, তখন একেবারে যাবে। সারাজীবন দুইবার হানিমুনে গেছ আমার সাথে, এই খোঁটা শুনতে পারব না।”

“আমি কবে খোঁটা দিলাম?”

“এখন পর্যন্ত দাওনি। তবে দিতে কতক্ষণ! হাজব্যান্ডরা এরকমই হয়।”

“কয়টা বিয়ে করেছ? কয়দিন হলো বিয়ে হয়েছে আমাদের। আর তুমি হাজব্যান্ডের উপরে পিএইচডি করে ফেলেছ।”

“সব এক্সপেরিয়েন্স হাতে-কলমে হয় না মশাই, এটা হলো আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা।”

“ভালো ভালো। দূরদর্শী একটা বউ আমি পেয়েছি।”

“হ্যাঁ, তা তো পেয়েছই।”

“তোমার ভাইভা কবে?”

“সতেরো তারিখ। আর মাত্র দুই সপ্তাহ। টেনশন হচ্ছে।”

“নো টেনশন। তোমার জবটা হবে দেখো।”

“পোস্টিং যে কই দেবে!” নিজের এই শঙ্কাটা প্রকাশ করল না আনিকা। আগে পরীক্ষাটা হোক। টিকলে পরে না হয় দেখা যাবে!

***
নীরা বাবাকে চা দিয়ে বেরুচ্ছিল। রোকেয়া তখন ঘরে এলেন।

“তোর সাথে একটু কথা আছে নীরা।”

“বলো মা।”

“বকুলের ভাসুরের ছেলেটা সায়মন। আজ চলে যাবে। ওর সাথে তোর কথা হয়েছে?”

“কেন মা?” সন্দিগ্ধ গলায় বলল নীরা।

“তেমন কিছু না। ছেলেটা বেশ ভদ্র। আদবকায়দা জানে। খুব মিশুক।”

“হঠাৎ করে তুমি ফুপুর ভাসুরের ছেলের টেস্টিমনিয়াল আমাকে দিচ্ছ কেন মা?”

“এভাবে কথা বলিস কেন?”

“মা, শোনো, কিছু বলার হলে সরাসরি বলো। পাঁচ কিলোমিটার দূরে যাবার জন্য একশো মিটার ঘুরপথে যাওয়ার অভ্যাস বাদ দাও।”

রোকেয়া আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ের সাথে কথা বলতে তিনি মাঝেমধ্যে খানিকটা ভয়ই পান। তারচাইতে বরং বকুল বা ওর বাবাকে দিয়েই কথা বলাবেন। বাবার কথা মেয়ে ফেলতে পারে না।

তবে সায়মনকে তার মেয়ের জামাই হিসেবে দারুণ পছন্দ হয়েছে সবদিক থেকে। ছেলেটা নীরাকে পছন্দও করেছে। তিনি কিছুতেই এই পাত্র হাতছাড়া করতে চান না।
…………
(ক্রমশ)