#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৮)
নুসরাত জাহান লিজা
“মাথা কাজে লাগাও, সবসময় সেটা গরম করে কাজ হয় না।”
আজমলের কথায় আরিফ উত্তর দিল, “ওইটারেও উধাও করে দেই?”
“আহ্! তাতে আমাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে প্রেসার আসছে। সব তোমার জন্য। এমন কিছু করো, যাতে সাপকেও বশ করা যায় আর লাটিতেও হাত না লাগাতে হয়। টোপ ফেলো। একটা অব্যর্থ টোপ কিন্তু তোমার হাতে আছে।”
আজমল খান এতটাই ঠান্ডা আর নিষ্পৃহ গলায় কথাটা বললেন যে আরিফ কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল ভেতরে ভেতরে।
“বুঝতে পারোনি এখনো?” এবার তার গলায় ছেলে উদ্দেশে মৃদু ভর্ৎসনা।
আরিফ ক্ষণেক চিন্তা করেই তার ইঙ্গিত ধরতে সক্ষম হলো। এভাবে তো সে আগে ভাবেনি। রবিন যে বেঁচে আছে, এই খবর আগে আফনানকে দিতে হবে। এরপর সময় বুঝে কোপ।
আফনানকে যে জাগতিক কোনো প্রলোভনে হাত করা যাবে না, এমনকি জীবন নাশের হু ম কি দিয়েও নয়, এটুকু এই কয়েকদিনে ওরা খুব ভালো করে বুঝে গেছে। তবে যে ওদের হাতে আছে তার জীবনের দাম ওই তরুণের কাছে সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাবে৷
ছেলে যে তার কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে এতে আজমল খান খানিকটা প্রসন্ন হলেও আরও আগে এটা ভাবেনি কেন ভেবে অনেকটা অপ্রসন্নও তিনি। তার তিলতিল করে গড়ে তোলা এই সাম্রাজ্য, যেখানে প্রাচুর্য আর ক্ষমতা দুইয়ের সহাবস্থান, সেটা তার সন্তান কতটা ধরে রাখতে পারবে, তাই নিয়ে তিনি সন্দিহান।
মায়ের মতো স্বল্প বুদ্ধির হয়েছে তার সন্তান, তার বুদ্ধির ধার এজন্যই পায়নি আরিফ। বিয়ে করার সময় এই জিনিসটা তার মাথায় রাখা উচিত ছিল। অবশ্য স্বল্প বুদ্ধির স্ত্রীর বিনিময়ে শ্বশুরের বাৎসল্যে তিনি আজ এত পাকাপোক্ত ভিত্তি পেয়েছেন পায়ের তলায়। তবে তার উত্তরাধিকার কিন্তু যোগ্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।
***
আফনান ইদানিং ভীষণ ক্লান্তিবোধ করছে। সবকিছু কেমন করে যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিলয়ের কল্যাণে মিডিয়া এখনো তৎপর। নতুন ইস্যুতে এই ইস্যু স্যোশাল মিডিয়ার নজরের বাইরে চলে গিয়েছিল, সেটাও পুনরায় জেগে উঠছে। তবুও ঘরের পরিবেশ দেখলে আফনানের মনে হয় সে যেন বৃথাই এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আজ নয়দিন হয়েছে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ নিখোঁজ হবার। তার কোনো চিহ্নই যেন অবশিষ্ট নেই। পৃথিবী থেকে মানুষ এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই?
আজ থানায় এসেছিল। ওসি শাফকাত আলীর সাথে কথা হয়েছে। তারা যে কী করছে, তার-ও কোনো তাল মিল নেই। কেমন গা ছাড়া ভাব তাদের মধ্যে। যেন অন্যদিকের ইশারার অপেক্ষা করছে। অদৃশ্য কারোর অঙ্গুলিহেলন ব্যতিরেকে তাদের সচল হবার কোনো সম্ভাবনা সে দেখছে না।
ওদিকে শায়লাকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেও সে সম্মত হয়নি। বলেছে, “মানুষটা কত ক্লান্ত হয়ে ফিরবে বলো তো। তখন আমাকে তো খুঁজবে সবার আগে। আমি ছাড়া ওর তো আর আপন বলে কেউ নেই। আমি এখানেই অপেক্ষা করব।”
অগত্যা সে আর মা শায়লার সাথেই থাকছে।
এরইমধ্যে একদিন ওদের বাবা একদিন এসেছিলেন এই বাসায়। আয়েশাকে কথা শোনাতে এসেছিলেন। মেয়েকে কেন বড় ঘরে বিয়ে দিতে পারেনি, এই নিয়ে। তবে আয়েশা অবশ্য তাকে ছেড়ে কথা বলেননি।
“আমি আমার মেয়ের ব্যাপারে যা ভালো, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাইরের লোকের কথা শুনতে চাই না।”
“আমি বাইরের লোক? ভুলে যেও না, ওরা আমারও সন্তান।”
“সেই কথা এতদিনে মনে হয়েছে? আসলে আপনি সবসময় আমার ভুল খুঁজতে চেয়েছেন সবসময়। কোনো ভুল হলেই যেন আমাকে খোঁচা দিতে পারেন। তাই আজও আপনি চিন্তিত হয়ে আসেননি, এসেছেন খুশি হয়ে। আমাকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন ভেবে। তবে আমি আমার সন্তানদের মানুষ করে তুলতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। তারা সাদা কালো চিনতে পারে। আরেকটা কথা, আমাকে এখন আর তুমি বলবেন না। একজন ভদ্রমহিলার সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন”
মা’য়ের এই দৃঢ়তা আফনানের বড্ড ভালো লাগে৷ এতকিছুর সাথে লড়াই করেও সমস্ত প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি কোনোদিন মুহূর্তের জন্য নুয়ে পড়েননি। আফনান মনোবল পায় এতে৷ এই যে ভেঙে পড়া সময়, বিমর্ষতা, সব যেন এক তুরিতে সহস্র ক্রোশ দূরত্বে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে লড়াই থামাবে না, রবিনের ঘটনায় যারা যারা জড়িয়ে আছে, সবার মুখোশ সে টেনে খুলবে।
এরপর লোকটা হম্বিতম্বি করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। শায়লাকে বলেছিলেন,
“তোর মায়ের জন্য তোর আজ এই অবস্থা। তাও তোর ওই মহিলার সাথে গদগদ?”
শায়লা রেগে গিয়ে বলেছিল, “এটা আমার বাড়ি। আমার বাড়িতে আমার মা থাকবে। আপনি চলে যান প্লিজ। খারাপ কিছু বলতে চাই না।”
আফনানকে অবশ্য তিনি ঘাটাবার সাহস করেননি। সে-ও মা আর বোনের জবাবের পরে আর কিছু বলেনি। শুধু তার সাথে বের হবার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে বলেছে, “আপনার মিথ্যে কনসার্ন আমাদের দেখাবেন না দয়া করে। আপনি আর কখনো না এলে খুশি হবো। আমাদের জন্য কখনো আপনি ছিলেন না, এখন নেই।”
***
ইরা ফেসবুকে ভীষণ এক্টিভ। পড়ার ফাঁকে একটু ছুতো পেলেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগইন করে নিউজফিড স্ক্রল করতে থাকে। সেখানে অবশ্য রবিন নামের একজনের নিখোঁজ হবার খবর সে পড়েছে, কিন্তু খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হয়নি৷ আজ নিলয়ের করা রিপোর্ট ওর সামনে এলো। ভাইয়ের প্রতিবেদন ওর খুব ভালো লাগে বলেই দেখছিল। সেখানে আফনানের নাম দেখল। এলাকাটাও ওদের। এরপর সে এই বিষয়ক আরও পোস্ট ঘেঁটে নিশ্চিত হলো, এটা আফনান ভাইয়া। ভেতরে কোথাও যে ধ্বক করে উঠল।
সে ছুটে গেল নীরার ঘরে। নীরা ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ে একদমই সময় দেয় না। ওর নাকি ভালো লাগে না৷ হঠাৎ কখনো সখনো মন চাইলে আসে। এসব নাকি ভূতের বেগার খাটুনি। সে যে এসব জানে না, তা ইরা নিশ্চিত।
নীরা তখন নিজের ঘরেই ছিল। কী একটা বই পড়ছিল গভীর মনোযোগের সাথে।
“আপু, তুমি জানো আফনান ভাই…”
বাকিটা বলার আগেই নীরা বই থেকে মুখ না তুলেই স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোর পড়াশোনা নেই?”
ইরা বুঝল এভাবে হবে না, অন পয়েন্ট বলতে হবে। নইলে থেমে যেতে হবে।
“নীরা আপু, একজন গু ম হয়েছে, জানো? আফনান ভাইয়…”
এবার নীরা ঝট করে মুখ তুলল, মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া পড়েছে।
“কী..”
প্রশ্ন করার আগেই ইরা বলল, “আফনান ভাইয়ার বোন শায়লা আপুর হাজব্যান্ডকে কয়েকদিন ধরে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এসবের মধ্যে পলি টি ক্যাল ইস্যু জড়িয়ে গেছে। আফনান ভাইয়া ওদের বিরুদ্ধে গিয়ে…..”
এবার নীরার চোখেমুখে আশঙ্কার ছাপ, জিজ্ঞেস করল, “তুই কী করে জানলি?”
“নিলয় ভাইয়াদের টিভি চ্যানেলের পেইজ থেকে।”
বলেই ওর ফোনটা বাড়িয়ে দিল। নীরা শান্তভাবে দেখল। এরপর প্রশ্ন করল, “নিলয় ভাইয়াকে একটা কল দিতে হবে।”
“আফনান ভাইয়ার সাথে কথা বলবে না? বেচারা একটু স্বস্তি পেত।”
নীরা উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে। এই মেয়ের মনে কী চলছে তার থই পাবার সাধ্য ইরার নেই।
***
আফনান এখান থেকে ওখানে, এর কাছ থেকে ওর কাছে ছুটে ফিরছে। শফিককে আপাতত শো-রুমটাই সামলাতে বলেছে সে। নিলয় অন্যান্য ব্যস্ততা সামলে আবারও এসেছিল দু’দিন আগে।
আজ মনে হচ্ছিল কেউ ওর পিছু পিছু আসছে। এই গলিটা নিরিবিলি। ঘুরে তাকাতেই দেখল একটা লোক কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চেনা চেনা লাগায় এগিয়ে এলো। বয়স ওর থেকে অনেক কম। তাই বলল,
“আমাকে ফলো করছিলে কেন?”
ছেলেটা যেন নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল। এবার গলা উঁচিয়ে ধমকে উঠল আফনান, “কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও!”
“আমি, আমি, ওই যে ওই রবিন, তারে আমি দেখছি।”
“কোথায়?” এবার আফনান আরও এগিয়ে এসে ওর হাত চেপে ধরল, “কথা বলবি না? না বললে…”
“আমি আরিফ ভাইজানের ওইখানে কাম করি। ট্যাকার জন্যে। লেখাপড়া বেশি করি নাই৷ তাই এই কাম করি, পেটের দায়ে। কিন্তু চোখের সামনে এসব অন্যায়…”
একটু বলে লোকটা থামল, আফনানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল ক্রমশ।
“উনারে ধইরে আরিফ ভাইয়ের একটা সিক্রেট হাউসে রাখছে। মারধর করতে দেখছি একদিন।”
এবার আফনান উত্তেজিত হলো, “সিক্রেট হাউজ কই?”
“আমি চিনি না। একটা কাজে আমারে নিয়া গেসিল। কিন্তু রাস্তাঘাট কিচ্ছু দেখতে পারি নাই। চোখ বাঁ ইন্ধা নিয়া গেসিল। কয়েকজন ছাড়া কেউই জানে না ওইটা কোন জায়গায়।”
“তুমি সত্য বলছ তার নিশ্চয়তা কী? তুমি যে আরিফের লোক না বিশ্বাস করব কেন?”
“বিশ্বাস না করা আপনের ব্যাপার। কিন্তু আমি গরীব মানুষ। অন্যায় করলেও, ভিতরে এহনও একটা মানুষ বাইচ্যা আছে। আমারে ছাইরা দ্যান ভাই। কেউ দেখলে আমার জান যাইব। ঘরে পরিবার অপেক্ষা করে।”
আফনান এবার আর অবিশ্বাস করতে পারল না। বলল, “তুমি আমাকে আরিফের আস্তানার খোঁজ দিতে পারবে? তোমার ভালো জীবনে আসার পথ আমি করে দেব যদি বেঁচে থাকি।”
“আমি চেষ্টা করমু। আমার মোবাইল নাম্বার।”
“তোমার নাম?”
“মনির।”
একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা বিদায় নিল। আফনান এত নিরাশার মাঝে কিঞ্চিৎ আশার আলো পেল যেন৷ না, না, সে বৃথা খড়ের গাদায় সূঁচ হাতড়াচ্ছে না। কিছুটা হলেও আশা এখনো বেঁচে আছে। নতুন উদ্যমে বুক বাঁধল।
***
মনির তখন মহাসুখে আরিফের সাথে কথা বলছিল।
“তোর কথা বিশ্বাস করছে?”
“ভাইজান, আমি ষোলো বছর বয়স থেকে থিয়েটার করছি। কাঁচা অভিনয় আমি করি না। তবে আফনান লোকটা ধূর্ত না। তাই অত প্যাঁচায় নাই। আমার জন্য কাজটা সহজ হইসে।”
“তোর টাকা পায়ে যাবি।”
“ছিঃ ভাইজান! কী বলেন! আপনে খালি আপনার নেক নজর আমার উপরে রাইখেন। আর কিছুই লাগব না।”
***
আফনান রাতে মায়ের সাথে কথা বলছিল। তখনই ওর মোবাইল বেজে উঠল। কিন্তু ধরার আগেই কেটে গেল। মিসড কল সে গুরুত্ব দিল না প্রথমে। তবে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটা মেসেজ এলো পরপর।
সেখানে আসা ছবিতে ওর চোখ স্থির হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। রবিনের ছবি। হাত পা চেয়ারের সাথে কষে বাঁধা। চোখেও কালাও পর্দা দেয়া। মনির সত্যিই বলেছিল তবে।
“যা করছো, তা যদি বন্ধ না হয়, কোনো আভাস পাওয়া মাত্র এর গল্প শেষ হবে। তার পর কা টা আ ঙ্গু ল পাঠাইতে আমাদের ভুল হবে না। বেচাল কিছু করার চেষ্টা করলেই একটা একটা করে আঙ্গুল হাওয়া হবে।”
লেখাটার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল আফনান৷ তখনই ঘরে এলো শায়লা।
………..
(ক্রমশ)
#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১৯)
নুসরাত জাহান লিজা
শায়লার মিষ্টি মুখে এই কয়েকদিনে বিষাদের পাকাপাকি ছাপ পড়ে গেছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। কথা দিয়ে মাতিয়ে রাখা মেয়েটা যেন কোন ভোজবাজিতে বোবা বনে গেছে। চোখ কোটরাগত। বোনের দিকে তাকিয়ে আফনানের ভেতরটায় একরাশ হাহাকার হু হু করে উঠল।
আয়েশা গিয়ে হাত ধরে শায়লাকে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। আরও স্ফীত হয়ে উঠেছে উদর, আর অল্প হয়তো অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবীতে সে জন্ম দেবে নতুন একটা প্রাণ। ওর এই মুহূর্তে কত স্বপ্ন দেখার ছিল, যার সান্নিধ্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ছিল, সে… আর ভাবতে পারল না আফনান।
“মা রে, এভাবে থাকলে তোর যদি একটা অনর্থ হয়ে যায়!”
আয়েশার শঙ্কিত গলায় আফনান সচকিত হলো।
নিজের পেটে হাত বুলিয়ে শায়লা বলল, “মা, আমি বেঁচে আছি খালি এর জন্য। রবিন কেন কথা রাখল না?”
ওর গলার কম্পন আফনান অনুভব করল। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। ভাই হিসেবে অযোগ্য মনে হলো। ওর এত প্রিয় বোনটা এত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না।
“রবিন ফিরবে শায়লা, তুই এত ভাবিস না। আল্লাহ তোর কাছে ওকে ঠিক ফিরিয়ে দেবে। দেখিস।”
বলার সময় আফনানের বুকের ভেতরে তোলপাড় হয়ে গেল। সত্যিই সে কিছু করতে পারবে তো! নাকি মিছে আশ্বাস দিল সে জানে না।
“আফনান, ও বেঁচে আছে তো! রবিন আমাকে আর বাবুকে নিয়ে কত প্ল্যান করেছিল, জানিস? বলত, ছোট্ট একটা প্রাণকে প্রথম কোলে নিয়ে সে কী কী করবে! বলত মেয়ে হবে না ছেলে তা জানি না। আমাদের সন্তান যেন সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসে। আরও বলত, ‘তুমি এত কষ্ট করছ এখন, ওর পৃথিবীতে আসার পর দেখবে আমি সব সামলে নেব।’ পেটে প্রাণের অস্তিত্ব জানন দিলে কেমন ছেলেমানুষি করত, তুই দেখিসনি। মানুষটা এত পাগল।”
বলতে বলতে কোন সূদুরের স্বপ্নালু জগতে হারিয়ে গিয়েছিল যেন। আচমকাই বাস্তবতা সম্পর্কে সচকিত হলো, এরপর বলল, “ওকে দেখতে পারবে তো রবিন?” বলেই কেঁদে ফেলল। সেই কান্নায় সাত সমুদ্রের সবটুকু বিষাদ ফেনিয়ে উঠল।
আফনান আর নিজেকে সামলাতে পারল না, ওর চোখও কখন যেন আর্দ্র হয়ে এসেছে। তবে পানিটাকে সে বহু কষ্টে সংবরণ করল। আয়েশা আঁচলে মুখ চাপলেন। আফনান ভেবেছিল একটু আগে কলের ব্যাপারটা শায়লাকে জানাবে না। কিন্তু রবিন বেঁচে এই আশ্বাসটুকু যে বোনকে দিতেই হবে।
তাই বলল, “রবিন বেঁচে আছে শায়লা, অক্ষত আছে। আমি জানতে পেরেছি।”
“মিথ্যে সান্ত্বনা দিস না। আমি…”
আফনান অপারগ হয়ে ছবিটা দেখাল। ছোঁ মেরে ওর ফোনটা হাতে নিল শায়লা। এরপর অপ্রকৃতিস্থের মতো ছবিতে হাত বুলাল। মনে হলো ছবি নয়, ওটাই যেন রক্ত মাংসের রবিন।
এরপর নিচের মেসেজটুকু দেখে ফেলল। প্রমান গুনল আফনান। হু ম কির কথাগুলো পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল শায়লা। প্রথম দুদিনের পরে যে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছিল, আজ আবার সেখানে প্রাণের স্পন্দন খেলল যেন। তবুও আতঙ্কিত বোধ করল আফনান।
কিন্তু কাঁদতে বাঁধা দিল না। আয়েশা শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
আফনান অস্ফুটস্বরে কেবল বলল, “আমি বেঁচে থাকা অব্দি হাল ছাড়ব না শায়লা। দেখিস।”
মনিরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ আপাতত ওর সামনে নেই।
***
নীরা ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির বোধ করছিল। রবিন সংক্রান্ত অসংখ্য পোস্ট সে পড়েছে। মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। আগে ভেবেছিল এক সপ্তাহ পর থেকে ক্লাস শুরু করবে সে। কিন্তু বাড়িতে একটুও ভালো লাগছে না আর। মা সারাক্ষণ সায়মনের নাম জপ করছেন কানের মধ্যে।
তাই আজ দুপুরেই রওনা হবে ঢাকায়। আগে নিলয়ের বাসায় উঠবে। হলে এক সপ্তাহ পর থেকেই থাকবে। নিলয়ের সাথে কথা বলা ওর ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু হুটহাট ফোন করে আফনানের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করতে কোথাও যেন তীব্রভাবে বাঁধা পেয়েছে। তাই ওখানে থাকলে বিস্তারিত খবরাখবর অন্তত সে জানতে পারবে।
ব্যাগে সব নিয়েছে কিনা দেখছিল, এরমধ্যে রোকেয়া এলেন।
“সায়মন এসেছে। বকুল বলল সে-ও ঢাকায় যাবে। আমি বললাম তোর সাথে যেতে। ভরসা পাই।”
“মা, আমি বেশিরভাগ সময় একাই গেছি। তোমার ভরসা ছিল না?”
থতমত খেয়ে গেলেন রোকেয়া, কোনোমতে বললেন, “না, তুই যেরকম ভাবছিস সেরকম না আসলে। একই জায়গায় একই দিনে যাবি। তাই…”
“মা, প্লিজ, আমার এসব ভালো লাগে না।”
“দেখ, ছেলেটা বড় মুখ করে বলেছি, তুই না করে দিলে খুব খারাপ দেখায়। আমি ছোট হয়ে যাব।”
“আগ বাড়িয়ে বলার দরকারটাই বা কী ছিল?”
“তুই সায়মনের সাথে যাবি, আর কিচ্ছু শুনতে চাই না।”
নীরার মেজাজের পারদ বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করলেও শান্ত থাকল। এই বিষয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। মায়ের প্রস্তাব আজকের মতো মেনে নিল।
আফনানকে একবার কল করার ইচ্ছে কয়েকদিন থেকে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় দমিয়ে রেখেছে। পাশে দাঁড়িয়ে কিছু করতে না পারল, শুধু শুধু কথা বলে লাভ কী। নীরা জানে না, প্রিয়জনের একটা ভরসার কথাও মস্ত বড় অনুপ্রেরণা হয়ে সঞ্জিবনী শক্তি দেয়।
***
ইরা পড়ায় ভীষণ মনোযোগী হয়েছে হঠাৎ করে। যে করেই হোক, ওকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। নইলে শাফিনের সান্নিধ্য পাবে কী করে!
“ইরাপু, আফনান ভাইয়ার কী অবস্থা? টিভিতে খবরে দেখলাম। নীরাপু এটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। জানিস?”
চমকে উঠে ইলার দিকে তাকাল ইরা।
“নীরা আপুর কথা তুই…”
“আমাকে যত ছোট মনে করো, আমি কিন্তু তত ছোট নই। তবে অত বড়ও নয়। আরও বড় হলে আমি নিজেই চলে যেতাম আফনান ভাইয়াকে সাহায্য করতে।”
ইরা নিজেও বিমর্ষচিত্তে ভাবতে লাগল, কী আছে ভবিতব্যে!
***
আফনান গতকাল রাতেই মনিরের সাথে যোগাযোগ করেছে। আজ সন্ধ্যার পরে নদীর দিকের যে নিরিবিলি রাস্তাটা, সেখানে আসতে বলেছে।
আফনান ওর কথা মতোই এসেছে। লোকটাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায় সে ব্যাপারে এখনো সে সন্দিহান। তবে আর উপায় কী! আর কোনো রাস্তা তো নেই। জলে ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, সে-ও সেভাবে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর সম্ভাবণা নষ্ট করতে চায় না।
……..
(ক্রমশ)