জোনাকি প্রদীপ পর্ব-৮+৯

0
207

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৮)
নুসরাত জাহান লিজা

মস্ত চাঁদটা ঢাকা পড়ল কালো মেঘের ছায়ায়। আফনানের হৃদয়ের মতো ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে আকাশটাও যেন খানিকটা ম্লান হলো নিমিষেই। সেটা অবশ্য একেবারেই ক্ষণেকের জন্য। পলকের ব্যবধানে দীপ্তি ফিরে পেয়ে ঝিকঝিক করে উঠল সমস্ত আকাশটা। অন্তরিক্ষ জুড়ে আলো আঁধারির খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। কিন্তু আফনানের হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে কেবলই কালবৈশাখীর ঘনঘটা। এই নিকষ কালো মেঘের ছায়া থেকে আফনানের মুক্তি কবে, সে জানে না!

সিগারেট ধরাতে গিয়ে পকেটে লাইটার পাওয়া গেল না। সেটা ঘরেই রয়ে গেছে। এখন সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। আকাশের চাদরে জোৎস্না আর মেঘের লুকোচুরি খেলা উপভোগ করতে করতে কতটা সময় গড়াল সে জানে না। যখন মনে হলো এবার সায়মন ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। তখন আলতো পায়ে এসে বিছানার একপাশে গা এলিয়ে দিল। বলাই বাহুল্য ঘুম অধরাই রইল আফনানের কাছে।

***
সকালে নিলয় আনিকাসহ বাড়ির প্রায় সকল সদস্য বসার ঘরে উপস্থিত ছিল। অতিথিদের আগে খাওয়া হয়ে গেছে। বাড়ির সদস্যরাও বেশ কয়েকজন খেয়ে বেরিয়েছে। আফনান, সায়মন, শাফিনসহ নিলয়ের বাকি বন্ধুরা এলো খেতে। নীরা, ইরাও বসে রয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ইলার প্রাইভেট আছে বলে তাড়াহুড়ো করছিল। ওর মা দাবড়ি দেখিয়ে বললেন,

“ঘুম থেকে আগে উঠতে কী হয়েছিল? নিজে দেরি করে উঠে এখন তাড়া দেয়া? এরপর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে যদি না উঠেছিস, বালতি ভর্তি করে পানি গায়ে ঢেলে দেব বলে দিলাম।”

ডাইনিং টেবিলে না বসে প্লেট হাতে করে সবাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে।

আনিকা আর নিলয়ও ওদের সাথেই বসেছে। আফনান ভাতের প্লেটে হাত চালাচ্ছিল, মুখে রুচছিল না। নিলয়ের মায়ের হাতের রান্না ওর পছন্দের হওয়া সত্বেও কেন যেন গলা দিয়ে নামছে না।

“নিলয়, আমি একটু পরেই চলে যাচ্ছি।”

“বুঝলাম না?”

“আসলে এবার তো অনেকদিনই থাকলাম তোর বিয়ে বলে। পরশু পর্যন্ত আমার ছুটি। আজ বাড়িতে না গেলে সত্যিই কুলিয়ে উঠতে পারব না রে। তাছাড়া মা..”

ইরা আর ইলা দু’জন একেবারে রিফ্লেক্স বসত একসাথে নীরার দিকে তাকিয়েছে। নীরা ভাত মুখে তুলতেই যাচ্ছিল, ওর হাত মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল, যা অন্যরা না খেয়াল করলেও ওদের দৃষ্টি এড়াল না। ইলা চকিতে একবার ইরার দিকে তাকিয়ে বোনের অভিব্যক্তিতে বুঝল, শুধু সে একাই নয়, আরেকজনও এই যুগলের গোপনে গোপনে যে হৃদয়ঘটিত টানাপোড়েন চলছে সে সম্পর্কে অবগত। ইরা বিস্তারিত জানে কিনা তা জানবার কৌতূহল ইলা আপাতত চেপে রাখল। কারণ প্রাইভেটের জন্য না বেরুলেই নয়। তবে ইচ্ছে করেই সে খুব ধীরগতিতে খাবার মুখে পুরতে লাগল। যাতে সদ্য চলমান ঘটনাটা চাক্ষুষ দেখার সুযোগ না হারাতে হয়।

“মার খাবি আফনান। আন্টির সাথে আমার কাল কথা হয়েছে। আজকে বৌভাত ফেলে তুই চলে যেতে চাস কেন?”

“আমার তো পরশু পর্যন্ত ছুটি। কাল ফিরে সব গোছগাছ করতে দেরি হয়ে যাবে। তার থেকে…”

নিলয় রাগতস্বরে বলল, “তুই আজ যেতে পারবি না, এটাই শেষ কথা।”

“তুই রাগ…”

“ভাইয়া, উনার হয়তো সত্যিই জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তুই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আটকাচ্ছিস, উনার হয়তো এর থেকেও নিজের কাজটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।”

নীরার কথায় আফনান চোখ তুলে মেয়েটাকে নিরীক্ষণ করল চকিতে। চোখ দুটোয়ে ফুটে আছে নীরব অভিমান। তবে অভিব্যক্তি অত্যন্ত কঠিন।

বোনের গলার কাঠিন্যের বিপরীতে নিলয় আফনানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “থাকতে হবে না, যা তুই।”

এবার আনিকা মুখ খুলল, “আফনান ভাই, বৌ-ভাতে আপনি না থাকলে ও ভীষণ মন খারাপ করবে। আপনি থেকে যান প্লিজ। অন্তত রাতটুকু। ভোরেই নাহয় চলে যাবেন।”

এমন আবদার আফনান ফেলতে অসমর্থ হলো। ইলা মায়ের এবারের ধমকে বেরিয়ে যেতে যেতে দেখল, নীরার মুখের কাঠিন্য কিছুটা যেন কমেছে। কোমল একটা আভা মুখ জুড়ে। বাড়িতে ভিড়ভাট্টা কমলেই ইরাকে গিয়ে সে ঠিক চেপে ধরবে। অবশ্য বলতে রাজি হবে না কিছুতেই। কী করে ইরাকে রাজি করানো যায় এমন উপায় ভাবতে হবে।

***
সায়মন খাবার পর থেকেই সুযোগ খুঁজছিল নীরার সাথে খানিকক্ষণ কথা বলার। কিন্তু মেয়েটা যে কোথায় আছে তাই ওর জানা নেই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে তাতেও সংকোচবোধ করছে। যদিও সে বরাবরই স্পষ্টভাষী, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলতে অনীহা। অকপট কথা বলতেই ভালোবাসে। তা সত্ত্বেও আজ তা করতে পারল না। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল, ভাবল কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করবে। নিচ তলার মুখে বকুলকে দেখল।

“সায়মন, কী করিস?”

“কিছু না চাচি। কী করা যায় তাই ভাবছি।”

গলা খাঁদে নামিয়ে এনে বকুল বললেন, “নীরার সাথে কথা হয়েছে?”

সায়মন সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই বকুল বললেন, “কেমন দেখলি? মনে ধরল?”

“তোমার কী মনে হয় চাচি?”

“নীরা মনে না ধরার মতো মেয়েই নয়।” ভাইঝির প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ল তার গলায়।

“আর আমি কেমন? আমাকে একটু সাহস টাহস দাও। তোমার ভাইয়ের মেয়েকে আমার ভয় লাগে। খুবই আনপ্রেডিক্টেবল কথাবার্তা বলেন। তবে দারুণ। আমার দিক থেকে গ্রিন সিগনাল। ওদিক থেকে কীভাবে গ্রিন সিগনাল পাওয়া যাবে, সেই টিপস দিও তো।”

“আমি কেন বলব? মেয়েদের পটানোর জন্য ছেলেদের জন্মগত প্রতিভা থাকে। সেটা কাজে লাগা।”

সায়মন হেসে ফেলল। বকুল চাচি হলেও ভীষণ বন্ধুত্বপূর্ণ। সায়মনের মা ভীষণ কড়া ধাতের মহিলা। তাই যাবতীয় আবদার ছিল তার চাচির কাছে। বকুলও সবসময় প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। আবার যদি কিছু ভুল মনে হতো, তখন সেটা শুধরেও দিয়েছেন। তার ওই বাড়ির সকলের মধ্যেই অত্যন্ত সহজাত সম্পর্ক বিদ্যমান। যে সকলেই পরস্পরের বন্ধু, বয়স সেখানে শুধুই সংখ্যা। তবুও ভব্যতা, শিষ্টাচার কেউ ভুলে যায়নি।

“তা মহারানী ভিক্টোরিয়া এখন কোথায়?”

“নিজের ঘরে হয়তো। তুমি সবার সাথে কথা বল। আরও একদিন তো আছিস। কথা বলার সুযোগ পেয়ে যাবি।”

সায়মন এগুতে যাচ্ছিল, বকুল ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “নীরাকে কিন্তু আগেই বিয়ের কথাবার্তার ব্যাপারটা বলিস না। তাহলে নিজেকে গুটিয়ে নেবে। তোর সাথে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করতে পারে।”

সায়মন বাগানে চলে এলো হাঁটতে। নীরা কারোর সাথে আগে থেকেই কমিটেড কিনা জানাটা সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। যদি সত্যিই ওমন হয়, কেন যেন ভয় হলো সায়মনের। এত অল্প সময়ে এমন অনুভূতি সত্যিই হয়!

আজ বাড়ির ছাদে বৌভাতের আয়োজন হচ্ছে। সকাল থেকে ডেকোরেশন আর ক্যাটারিংয়ের কাজ করছে। তাই চিলেকোঠার ঘরে বসার উপায় নেই। ওর মধ্যেই আফনান যে কী করে ঘুমুচ্ছে কে জানে।

***
গতকাল থেকে শাফিন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। এই ভরদুপুরে নীরার সাথে দেখা হতেই তা কয়েকগুণ বাড়ল।

“ক্যামেরা হাতে মেয়েদের ছবি টবি তো খুব তুললি দেখলাম, আর কিছু করেছিস?”

নীরার এমন প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেল শাফিন। বিচ্ছু মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর নামে নালিশ করেছে। নইলে আপু তো কখনো এভাবে বলে না।

“এই তো এখানে সেখানে ঘুরছি।”

“শোন, করার মতো অনেককিছু এখানে পাবি। চাইলে উত্তর দিকে যে পুকুরটা আছে সেখানে বরশী দিয়ে মাছ ধরতে পারিস। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

এবার শাফিন স্বস্তি পেল, মনে মনে ইরার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করল।

“ওটা তোমাদের পুকুর? তাহলে তো দারুণ হয়।”

ওরা দু’জন পুকুরের দিকেই পা বাড়াচ্ছিল, কোত্থেকে ইরা চলে এলো।

“ফটোগ্রাফার সাহেব? আপনার পরবর্তী মিশন কী?”

“পুকুরে মাছ ধরতে যাব।”

“বাহ্! ফটোগ্রাফার থেকে সোজা জেলে! আপনি মাল্টিট্যালেন্টেড দেখছি। খালি কারোর ফোন নম্বর কালেক্ট করার…”

একটু আগে যে মনে মনে খানিকটা কৃতজ্ঞ হয়েছিল, সেটা একটানে কেটে দিল শাফিন। এরপর মনের ওই অংশটায় পুরো দোয়াত সুদ্ধ কালি ঢেলে চিরতরে ঢেকে দিল। তড়িঘড়ি করে বলল,

“আমি ভদ্র ছেলে তো। ভদ্র কাজে এক্সপার্ট। অন্যকিছু তাই হয় না।”

“তোদের কী ব্যাপার বল তো। টম এন্ড জেরির মতো লেগে আছিস শুরু থেকে।”

ইরা দুষ্ট হেসে বলল, “তোমার ভাই অনেক ট্যালেন্টেড তো আপু, তাই প্রশংসা করছিলাম। বিয়ের দিন কী হয়েছে জানো…”

শাফিন বিপন্ন চেহারা নিয়ে বলল, “নীরা আপু, একটু পরেই তো কণেপক্ষরা আসতে শুরু করবে। সময় পাওয়া যাবে না।”

তিনজন পুকুর পাড়ে এসে থামল। সেখানে আফনান বসেছিল। শান বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে বসে উদাস দৃষ্টিতে জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে গভীরভাবে কী যেন ভাবছিল।

নীরা একবার ভাবল সেখানে যাবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মত পরিবর্তন করল। কারোর জন্য সে নিজের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করবে কেন! ওদের বাগান আর পুকুরের দেখাশোনা করে মুরাদ নামের একটা ছেলে। নীরা তাকে ডেকে বরশী দিয়ে যেতে বলল।

পেছনে ওদের হাঁকডাক শুনে আফনানের ধ্যান ভাঙল। উঠে দাঁড়াল, এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “পুরো বাহিনী নিয়ে মৎস্য শিকারে এসেছিস দেখছি। তোরা পারিস নাকি আমি দেখিয়ে দেব?”

“আমি পারি আফনান ভাই। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তোমার টাইমের ভ্যালু অনেক। জায়গায় অজায়গায় তার অপচয় কোরো না।”

আফনানের মুখ নিমিষেই ম্লান হলো, তাই দেখে ইরা এগিয়ে এসে বলল, “আমাকে শিখিয়ে দাও ভাইয়া। আমি পারি না।”

ইরার আন্তরিক ভঙ্গিতে অস্বস্তি কাটল। মুরাদ ছিপ নিয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশটা আবারও প্রতিকূল হয়ে উঠল আফনানের জন্য, সায়মনের আগমনে।
………
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা

নীরা শাফিনকে দেখিয়ে দিচ্ছে কী করে ছিপ ফেলতে হয়। ইরার আবদার পূরণ করছে আফনান।

“জায়গাটা খুব সুন্দর।” সায়মনের কথা শুনে ওর দিকে তাকাল সবাই।

“আমি কি তোমাদের সাথে যোগ দিকে পারি?”

“কেন নয়?” মৃদু হেসে বলল নীরা।

ভরদুপুরে রোদের উত্তাপ থাকলেও জোর হাওয়া বইছে বিধায় ঈষদুষ্ণ রোদ ঠিক গায়ে লাগছে না। নীরার খোলা চুলগুলো বড্ড বেপরোয়া, হাত দিয়ে বারবার পেছনে সরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু লাভ খুব একটা হচ্ছে না। ইরার চুল শক্ত করে বাঁধা।

সায়মন এসে সিঁড়ির একটা ধাপে বসতে বসতে বলল, “একসময় বেশ অভ্যাস ছিল। এরপর পড়াশোনার চাপে আর হয়নি। আজ ঝালিয়ে নেয়া যাবে।”

আফনান ছিপ ফেলে অপেক্ষা করছিল কখন কোনো মাছ টোপ গিলে নেয়। সে বলল,

“আমারও শিকার আর বড়শী দিয়ে মাছ ধরার প্রবল শখ ছিল একসময়। বহুদিন এসব থেকে দূরেই আছি।”

শাফিন উৎসাহ নিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। কখন নীরার ইশারা পাবে আর জীবনের প্রথম মৎস্য শিকার সফল হবে। সেদিকেই দৃষ্টি রেখে সে বলল, “আমিই খালি আনাড়ি। সবাই দেখছি অভিজ্ঞ।”

ইরা ফোড়ন কেটে বলল, “আমার যে ছবিগুলো তুলেছেন, সেসবে যেন আপনার আনাড়িপনা না পাই।”

“সে আমি ভালোই পারি। বুঝলেন? সবেতেই অকর্মা নই।”

“ও, তাই? আমি ভেবেছিলাম আপনি একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি।”

শাফিন কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ওর ফেলা ছিপ নড়ে উঠল। নীরা শাফিনের হাত ধরে ওটা ঝটকা টানে তুলে ফেলল। একটা মাছ উঠেছে। সবার মনোযোগ সেদিকে চলে গেল।

“আপনি অলরাউন্ডার দেখছি।” সায়মন মুগ্ধ গলায় নীরাকে কথাটা বলল।

“সেরকম কিছু নয়। পরিচিত একজন এসবে মেতে থাকত। তার উৎসাহ দেখে আমিও আগ্রহী হয়েছিলাম ছেলেবেলায়। তার কাছ থেকেই শিখেছিলাম।”

নীরা একবার আফনানের দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। আফনানের মনে পড়ল তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছিল সবে। এই পুকুরপাড়েই বন্ধুদের আড্ডা জমত বেশি। সবাই এটা সেটা কত কী নিয়ে কথা বলত। সে তখন গভীর মনোযোগের সাথে এই কাজটা করত। তখন নীরা যেন কীসে পড়ত! এইটে না-কি নাইনে সেটা মনে পড়ছে না আফনানের। প্রায়ই মেয়েটা এসে ঘ্যানঘ্যান করত,

“আমি শিখব, আমাকে শেখাও।”

তখনই সে এর কলাকৌশল শিখিয়েছিল নীরাকে। কিছুদিনের মধ্যেই বেশ দক্ষও হয়ে উঠেছিল। ম্লান হাসল আফনান।

ইরা তখন বেশ ছোট, তবে ওর মনে আছে নীরা ওকে সাথে নিয়ে পুকুরপাড়ে আফনানের কাছ থেকেই শিখেছিল। সে বলল, “গুরুকে ফেইল করানোর একটা সুযোগ আছে নীরা আপু। আমি আর ওই অকর্মা ফটোগ্রাফার বাদে তোমরা তিনজন একসাথে একবার ছিপ ফেলে দেখো না, দেখি কারটায় আগে মাছ উঠে!”

নীরা সাথে সাথে নাকচ করে দিল, “এসব ছেলেমানুষি করার বয়সে আমরা নেই ইরা।”

সায়মন বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল, “আরে হোক না। বেশ মজা হবে কিন্তু। অনেকদিন খেলাধুলা হয় না। একদিন ছেলেমানুষী হোক না-হয়। কী বলেন আফনান?”

আফনান এক পলক নীরার দিকে দৃষ্টি মেলে এরপর হেসে সায়মনের পানে তাকিয়ে বলল, “আমার আপত্তি নেই। তবে কেউ যদি আমার কাছে হেরে যাবার ভয়ে পিছিয়ে যায় সে অন্য কথা।”

নীরা ভাবলেশহীন মুখে বলল, “সেটার জন্য আগে ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আফনান ভাই। বলে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। এরপর ইরাকে বলল, “ইরা তোর হেয়ার ব্যান্ডটা দে তো।”

নীরার যুদ্ধংদেহী অবয়বে হার না মানার দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে নিমিষেই। আফনানের মনে হলো এই মেয়েটাই একসময় কী ভীষণ প্রাণোচ্ছল ছিল! কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ত। সময়ের ব্যবধানে কেমন পাথুরে মনের অধিকারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। সবটাই কি অভিমান! নাকি প্রত্যাখ্যানের সুতীব্র জ্বলুনির পোড়া কাঠকয়লা!

পুরোনো নীরা, যে হাসলে কল্লোলে ভরে উঠত চারপাশ, সেই হাসিটা একবার দেখার ভীষণ ভীষণ লোভ হলো আফনানের। তৃষিত হয়ে উঠল ওর সমস্ত অন্তর।

আপাতত হার জিতের খেলা জমে উঠল পুকুরপাড়ে। সায়মন বলল,

“আপনার কনফিডেন্স ভীষণ ভালো লাগল। সত্যি বলছি, আমার কম্পিটিটর কেবল আপনি হলে আমি নিজে হেরে হলেও আপনাকে জয়ী দেখতে চাইতাম।”

“আমি আপনার দয়া কেন নেব?”

“না না, ছিঃ, ছিঃ! দয়া নয়। বন্ধু হিসেবে বন্ধুকেই জয়ী দেখতে ভালো লাগত বলে।”

“আপনি বেশ বন্ধু অন্তঃপ্রাণ দেখছি। ভালো। তবে এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতাটা আমি পছন্দ করব না। খেলা শেষে হেরে গেলেও তাতে শান্তি পাব।”

“আপনি অন্যরকম, নীরা।”

“কেমন?”

“খেলার পরে বলব। এখন কথা বলতে বলতে আপনি হেরে গেলে ভালো আমার খারাপ লাগবে।”

এবার আর উত্তর দিল না নীরা, সায়মনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল কেবল।

আচমকা কোত্থেকে এক পৃথিবী ঈর্ষার তীর আলোর গতিতে আফনানের বুকে এসে বিঁধল। এতক্ষণের কথোপকথন ওকে বাকরূদ্ধ করে দিয়েছে যেন। কী যে ব্যথা হলো হৃৎপিণ্ডে! প্রগাঢ় ব্যথা!
……….
(ক্রমশ)