জোনাকি প্রদীপ পর্ব-১০+১১

0
197

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১০)
নুসরাত জাহান লিজা

পুকুরপাড়ে তিনজন ভিন্ন সত্তা আপাতত মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেও তাদের চিন্তার স্রোত ভিন্ন দিকেই বইছে। এই যেমন, সায়মন প্রাণপণে জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছে কারণ তাতে যদি নীরা একবার মুগ্ধ চোখে তাকায়। ওর মনে সদ্যোজাত যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে নীরাকে উপলক্ষ করে সেটা বড়ই বিষম বস্তু বলে ঠাহর হচ্ছে ওর কাছে৷ সে-ই চোখে নিজের জন্য ন্যানোসেকেন্ডের মুগ্ধতাটুকুই যেন আপাতত সায়মনের কাছে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা মাছ ধরা সেখানে নিতান্তই গৌণ, কেবল অতল চোখের একফোঁটা বিস্ময়াভিভূত তরল দৃষ্টিই মূখ্য।

নীরার কাছে বিষয়টা হারজিতের। একদা যার জন্য ওর ভেতরে আবেগের থই থই জোয়ার ছিল, সেখানে বহুদিন ধরেই ভাটার টান। আফনান যা কিছু ভালোবেসে করত, নীরা বোকার মতো সেসবই রপ্ত করতে চাইত মরিয়া হয়ে। কী ভেবেছিল সে, একদিন লোকটাকে চমকে দেবে। মিষ্টি হেসে লাজুক স্বরে বলবে,

“দেখো, আমি কিন্তু একদম তোমার মনের মতো হয়ে উঠেছি।”

আর আফনান প্রগাঢ় প্রেম সিক্ত চোখে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বিস্মিত গলায় বলবে,
“আমি মনে মনে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে যেমন ছবি এঁকেছিলাম, তুমি ঠিক তেমন। এমন আরাধ্য জিনিস কেমন সাধনা ছাড়াই পেয়ে গেলাম। জীবনের বাকি পথটুকু চলার জন্য সঙ্গী হিসেবে আমি তোমাকেই চাই নীরা।”

এককালের লালিত স্বপ্নের কথাগুলো মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নীরার। কী ভূতে ওকে তখন পেয়েছিল কে জানে! নিজেকে ভিন্ন ছাঁচে ফেলে নিজস্বতাকে বলি দিয়ে কাউকে পেতে চাইবার মতো গ্লানিকর আর কিছু হয় নাকি! ছিঃ! নিজের উপরেই গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হলো নীরার। নিজেকেই সেধে নিজে অপমান করার মতো ক্লেদ পৃথিবীতে আর কিছুতে নেই। কী অপরিসীম অপমান আর লজ্জায় ভেঙেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, সে লজ্জা কী ভয়াবহ সংগ্রাম করে নিজের হৃদয়ের আগুনেই পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে, সে কথা অন্য কেউই জানে না।

প্রথম দিকে একজনের চোখে পড়ার জন্যই নানা কিছু শেখার পাগলামি করেছিল। পরে সেসব আরও ভালো মতন শিখেছে, দক্ষতা অর্জন করেছে তা কেবল নিজের জন্য। নিজেকে সবধরনের পরিস্থিতির জন্য সদা প্রস্তুত রাখার জন্য। আজ মনে হলো নিজের প্রস্তুতি পর্বের ছোটখাটো একটা পরীক্ষা।

ওমন মুখ গুঁজে পড়াশোনা করেছে, তাও নিজের জন্য। কোনোদিন কেউ যেন নীরাকে প্রত্যাখ্যান করবার মতো স্পর্ধা না দেখাতে পারে। উল্টো সে-ই সবাইকে প্রত্যাখ্যানের জ্বালা বুঝিয়ে দিতে চায়। মনে মনে খুব করে চাইত একদিন আফনান ওর প্রতি এতটুকু অনুভূতি লালন করুক, সেটা কিন্তু পুরোনো ভালোবাসার টানে নীরা চায়নি। চেয়েছিল, অপমানের তীব্রতা ভেতরটা কেমন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, কতটা দগ্ধে ছাই করে দেয় তা বুঝিয়ে দেবার জন্য।

নীরার মনে হলো সে স্পষ্টভাবে আফনানকে পড়তে পেরেছে এবার। ওর প্রতিশোধ চরিতার্থ করার সময় আসন্ন। ওই অতি নিষ্ঠুর লোকটার মধ্যে যে সত্যিই কোনোদিন ওর জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুভূতির দেখা মিলবে এটা নীরা কস্মিনকালেও ভাবেনি, ক্ষীণ একটা সাধ ছিল কেবল, প্রতিশোধ নেবার সাধ।

আড়চোখে নীরা একবার সায়মনকে দেখল। এই ছেলের যে ওর প্রতি সামান্য হলেও একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে এটুকু সে বুঝতে পারছে। মুখে যতই বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব বলুক, ভেতরে ভেতরে অন্যকিছুই এটা তার অগোচরে নেই। চকিতে মনে হলো সায়মন প্রতিশোধ চরিতার্থ করার মোক্ষম হাতিয়ার হতে পারে। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা বোধ করল।

একবার আফনানের দিকে দৃষ্টি ফেরাল, সোম্য চেহারা, চোখ একরাশ সরলতা। যখন হাসে মনে হয় যেন অতি কাছের কেউ, ভীষণ আপন আপন লাগে। অথচ নীরার হৃদয়ে জন্মানো প্রথম ভালোবাসার বীজ চারাগাছে রূপান্তরিত হতে না হতেই কী নির্দয়ের মতো সমস্তটা উপড়ে ফেলেছিল। একটা ব্যাপারেই নীরা আফনানের কাছে কৃতজ্ঞ, সেটা হলো ওর সেই অপমানে ডুবে যাবার গল্পটা সে নিলয় ভাইয়াকে জানায়নি। তাহলে সে কাউকে মুখ দেখাতে পারত না।

“কার ছিপ যে বেচারা মাছ পছন্দ করবে সে নিয়ে চিন্তায় আছি।” সায়মন ঠাট্টাচ্ছলে বলল কথাটা।

নীরা আরেকবার ভেবে দেখল, এরপর সায়মনকে নিয়ে করা পরিকল্পনা নাকচ করে দিল। জীবনটা কারোর মস্তিষ্কপ্রসূত ফিকশন নয়। এমন একজনকে সে এসবের মধ্যে কিছুতেই টেনে আনতে চায় না যার আগে থেকেই ওর প্রতি মোহ রয়েছে। যদি সায়মন এটাকে কোনো ইঙ্গিত ভেবে বসে মিথ্যে দুনিয়া গড়ে নেয় মনে মনে! না, সে এটা করতে পারে না। জীবনটা নীরার, প্রতিশোধ স্পৃহাটুকুও ওর একান্ত নিজস্ব। তাছাড়া নীরা অন্যের সাহায্য প্রত্যাশী নয় কখনো। সে নিজের সুপ্ত বাসনা ঠিকই চরিতার্থ করবে, তবে নিজের মতো করে।

*
আফনানের কাছে খেলার ফলাফলটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীরার কাছে হারতে ওর খারাপ লাগবে না কখনো। তবে নীরার উপস্থিতিতে সায়মনের কাছে হারবে এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। তাই ছাড় দেবার মনোভাব ওর মনে এই মুহূর্তে নেই।

সায়মনের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে ওর জন্ম হয়নি। সেই ছেলেবেলা থেকে ওকে জীবনের পথ চলতে হয়েছে সংগ্রাম করে। বাবা সম্পর্কের একজন লোকের কল্যাণে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’ শব্দটা ওর ভাগ্যের সাথে জুড়ে গিয়েছিল।

মায়ের জীবনযুদ্ধ সে নিজের চোখে অবলোকন করেছে। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছেড়ে প্রায় রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছিল ওদের। মা নিজের আত্মসম্মানবোধকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন চিরকাল। যার কাছ থেকে নির্ভরতা পাবার কথা তার কাছ থেকে যদি অসম্মান আর অবিশ্বাসের ঝুঁড়ি মেলে তবে একলা থাকাই শ্রেয়, এই বোধটুকু তার মা ওদের দুই ভাইবোনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ভাইদের সাহায্যও হাত পেতে নেননি কোনোদিন।

মা নিজের জমানো টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনেছিলেন, সেটা চালিয়েছেন বহুবছর। অবশ্য ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ ওদের বাবার মাসোহারা হিসেবে দুই ভাইবোন পেয়েই যেত। এতে কোনোদিন তিনি বাঁধা দেননি। এটা ওদের প্রাপ্য বলেই মেনেছিলেন। তবে তিনি একটা কানাকড়ি নেননি কোনোদিন। এমনকি নিজের অসুখের চিকিৎসার জন্যও নয়। তখন আফনান সদ্য অনার্সে ভর্তি হয়েছে। টিউশনির টাকা কখনো জমেনি। ছেলেবেলায় ওর খুব ইচ্ছে হতো গিটার শিখতে। কিন্তু সেটাও বিসর্জন দিয়েছিল। ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসত, কিন্তু সেদিকেও সময় দেবার ফুরসত হয়নি। মা নিষেধ করলেও এসএসসির পর থেকেই টিউশনি করতে শুরু করে। তবে বন্ধুদের সাথে সময়টা দারুণ কাটত। মা, বোন আর বন্ধু ওটুকুই ওর স্বস্তির জায়গা।

শিকারে যাওয়া, বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি এসব হয়েছে বন্ধুদের সুবাদেই। মেধাবী আর সুদর্শন হবার সুবাদে কিছু মেয়ে ওর আশেপাশে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আফনান একটা দূরত্ব রেখেছে সবসময়। হয়তো নীরার ওই আকুতিভরা টলটলে চোখের জন্যই একটা ঈষৎ অপরাধবোধের ভার সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে ছিল কাঁধে। এবার আসার পর, এতবছর পর নীরাকে সামনে থেকে দেখার পর মনে হচ্ছে সেটা নিছক অপরাধবোধ ছিল না। খানিকটা টান ছিল তাতে। আবার এক্সট্রা প্রিভিলেজপ্রাপ্ত সায়মনের উদ্দেশ্য জেনে বুঝল ভালোবাসার একটা আগ্নেয়গিরি ওর হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে সুপ্ত ছিল। সেখান থেকে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ওর সমস্ত হৃদয়ে, মননে।

নিজের এহেন ভাবনায় নিজেই চমকে গেল আফনান, কবে থেকে সে এমন ঠুনকো মনের হয়ে গেল! সায়মনের এখানে কী দোষ! এমন হিংসুটে সে তো কোনোদিন ছিল না। ভালোবাসা হারাবার ভয় কি সহজাত বোধশক্তি লুপ্ত করে দেয়? তবুও কেন ছেলেটার ভাগ্যকে ঈর্ষা হচ্ছে! অসহনীয় যন্ত্রণা আফনানকে যে কী ভীষণ দগ্ধে মা*র*ছে, তা কেউ জানে না।

“কার টোপ মাছ গিলবে এটা নিতান্তই ভাগ্যের উপর। এভাবে প্রতিযোগিতায় নামাটা কি ছেলেমানুষি নয়?”

আফনান এবার ম্রিয়মাণ গলায় কথাটা বলতেই নীরা উত্তর দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে যেতে হলো। ইলা আর ওদের ছোট চাচার বছর দশেকের ছেলে ইমতু এসে বলল,

“তোমরা এখানে? ওদিকে লোকজন এসে পড়েছে। বড়চাচা তোমাকে খুঁজছে নীরা আপু। চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। চলো, চলো।”

সায়মন বলল, “তাহলে বরং আজ ইতি টানা যাক। পরে কোনোদিন আবার একসাথে হলে নিষ্পত্তি হবে না হয়।”

নীরা খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করে উঠে দাঁড়াচ্ছিল তখনই আফনানের ছিপে মাছ উঠল। সে উল্লসিত গলায় বলল,

“আমি জিতে গেছি নীরা।”

নীরা ততক্ষণে ছিপ রেখে দিয়ে দাঁড়িয়েছে, চলে যেতে উদ্যত হতে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আফনানের চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত শীতল গলায় বলল,

“আফনান ভাই, খেলার সমাপ্তি ঘোষণার পরে আর হারজিতের প্রশ্ন থাকে না। সবকিছুর একটা সময় থাকে। সময় চলে গেলে জিতে যাওয়া মূল্যহীন। এটুকু বুঝতে না পারলে চলে? চিরকাল এমন টিউব লাইট-ই থেকে গেলেন।”

কথাটা বলেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না৷ বাকিরা ওর পিছু নিয়ে চলে গেল। খেলা সাঙ্গ হলে ফলাফলে আর কাজ কী! মূল্যহীন এক জয় নিয়ে সে সেভাবেই বসে রইল পুকুরপাড়ে। নিজেকেও কেমন মূল্যহীন বলে মনে হলো।

নীরার ইঙ্গিতপূর্ণ কথার তাৎপর্য সে উপলব্ধি করেছে। ওকে যে নীরা পড়ে ফেলেছে এটা ভাবতেই কেমন অস্বস্তি হলো। নীরা ওকে এই মাত্র এটাই বলতে চাইল, সময়ে যা ফিরিয়ে দিয়েছিল, এখন আর তা চাইবার কোনো অধিকার আফনানের নেই। চাইলেও তার ছিঁটেফোঁটা মূল্য নেই কারোর কাছে, জগতের কাছে, নীরার কাছে।

আফনান ছেলেবেলা থেকেই শক্ত মনের মানুষ। তবুও আজ কেন যে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে! পুকুরপাড়ের প্রায় উত্তাপহীন রোদ, ওই দূরের পাখিরা, আকাশ, তাতে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা, সূর্যটা, এমনকি ওর কাছের পানিটাও ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে৷

এখান থেকে যদি ভোরবেলা চলে যায়, আবার কবে নীরার সাথে দেখা হবে সে জানে না। এরমধ্যেই নীরা যদি সায়মনকে বেছে নেয়! এ ওর কিছুতেই সইবে না। একবার একটা চেষ্টা কি করবে! অসম্ভবপর শেষ চেষ্টা! মাঝ সমুদ্রের হাল ভাঙা নাবিক মনে হলো নিজেকে।
……..
(ক্রমশ)

#জোনাকি_প্রদীপ (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা

রোকেয়ার সাথে সায়মনের কথা হয়েছে। ছেলেটাকে তার বেশ মনে ধরেছে। নীরা যেমন চাপা স্বভাবের মেয়ে, সায়মন আবার ঠিক ততটাই খোলা মনের। কথা বলে ভীষণ বিনয়ী মনে হয়েছে, সাথে ভদ্রতাবোধ ঠনটনে। নীরাকে যেন খুব ভালো মতো বুঝতে পারে, এমন ছেলেই তিনি তার আত্মজার জন্য চাইতেন। সাথে বাড়তি প্রাপ্তি ছেলেটা বোধবুদ্ধি সম্পন্ন, দেখতেও ভালো, ভালো পেশা, বকুল সবসময় খেয়াল রাখতে পারবে। সবমিলিয়ে রোকেয়ার মনে হয়েছে সায়মনই তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র। হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বকুলকে ডেকে তিনি নিজের সম্মতি জানিয়েও দিলেন। বললেন,

“তোমার ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলি। আমার তো পছন্দ হয়েছে সায়মনকে।”

“ভাইজানেরও ঠিক পছন্দ হবে ভাবি। সায়মন সোনার টুকরো ছেলে।”

রোকেয়ার একটা চাপা কষ্টবোধ আছে নিলয়ের বিয়ে নিয়ে। ছেলের প্রতি এক ধরনের অন্ধ মমত্ববোধ তার হৃদয়ে আছে। নীরার জন্যও আছে, তবুও প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন নিলয়কে দিয়ে বলেই কিনা, কোথাও গিয়ে যেন তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছেন।

সেই ছেলের বিয়ে তিনি নিজে পছন্দ করে পাত্রী বাছাই করে এরপর দেবেন বলে ভেবেছিলেন৷ কিন্তু নিলয় সেই অল্প বয়সেই আনিকাকে পছন্দ করল। তার জন্য মরোমরো অবস্থা। পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বিষয়টা মেনে নিয়েছেন, বিয়েটা যেন হয় তার ব্যবস্থাও করেছেন। তবুও চাপা একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা তার ভেতরে বিদ্যমান।

নীরার পাছে কারোর সাথে মন দেয়া নেয়া সেরে ফেলে এটা তিনি চান না৷ কন্যার বিয়েটা তিনি নিজের মনের মতো করে দিতে চান। তবে মেয়েটা এত জেদি, আর ঠান্ডা স্বভাবের যে তিনি মাঝেমধ্যে কিঞ্চিৎ সমীহ করে কথা বলেন। বুঝতে পারেন না ঠিকঠাক। কোনো বাড়তি আবদার নেই, গলা উঁচিয়ে কথা বলে না, তবুও যেন বিয়ের কথাটা বলাটা তার কাছে কঠিন মনে হয়। কারণ এর আগে একবার কথা উঠতেই মেয়ে চার মাস বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। নিলয় আর ওর বাবার সাথে আবার খুব সহজ। ওদের দুইজনের সাথে আলাপ করে নীরাকে রাজি করাবেন বলে ভেবে নিলেন৷

***
ভোর হতেই আফনান ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে এলো। ভোরের আলো ফুটছে চারপাশে। গেটের কাছে এসে একবার বাড়িটার দিকে ঘুরে তাকাল সে। ঠিক তখনই চোখাচোখি হলো নীরার সাথে। আফনানের মনে হলো মেয়েটা যেন ওরই পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রাতে একবার ওর সাথে কথা বলবে বলে ইরাকে জানিয়েছিল ইচ্ছের কথাটা।। কিন্তু নীরা এলো না। শরীর খারাপের অজুহাতে আসেনি। তাই কথা বলা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। তবে একবার দেখেছে সায়মন আর শাফিনের সাথে কথা বলতে বাগানে।

শাফিন ওর কিছু একটা দেখাচ্ছিল, নীরা স্মিত হাসছিল আর সায়মনের চোখে ছিল একরাশ মুগ্ধতা। আফনান ছাদ থেকে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ। এরপর শাফিন যখন ভেতরে চলে গেল, তখনও দুজন আরও কিছুক্ষণ কথা বলল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আফনানের তখন চিৎকার করে জীবনানন্দ আওড়ানোর ইচ্ছে হচ্ছিল,

“সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ।”

ওর সেই নিঃশব্দ চিৎকার নীরার কান অব্দি যায় না৷ বুকের গহীন প্রকোষ্ঠ থেকে উৎসারিত ওর অভিমান ভরা আকুতি আবারও সেই চোরাকুঠোরীতেই বন্দী হয়ে যায়। তবে তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাতেই অন্তত একবার স্বার্থপর হবে, একটাবার নীরাকে নিজের হৃদয়ের কথাটা বলবে। কিন্তু ওর সাথে কথা বলার জন্য কোনো অবসর মেয়েটার হলো না।

এখন যখন সূর্য আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে, পৃথিবীতে একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে, আফনানের ভেতরটায় তখন সূর্য নেই। ঘুটঘুটে কৃষ্ণপক্ষ রাত সেখানে।

বাড়ির সকলের ঘুম ভাঙিয়ে আফনানের নীরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, “নীরা, একবার আমার সাথে দেখা করে একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবি? আমাকে ছাড়া তুই আর কাউকে ভালোবাসতে পারবি কোনোদিন?”

কিন্তু সে-ও হয় না, কারণ নীরা ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছে। ভালোবাসার যন্ত্রণার মতো দূর্বিষহ যন্ত্রণা বোধহয় আর পৃথিবীতে নেই। আফনান বিড়বিড় করে বলল,

“এই বুঝি ভালো হলো। পৃথিবীর সব নাকি ফিরে ফিরে আসে। আমারও ফিরে এলো, তোকে যে কষ্ট এককালে দিয়েছিলাম, তা সুদ সমেত ফেরত এলো।”

বারান্দায় দাঁড়ানো মানবীর ছবিটা বারবার আফনানের হৃদয়পটে ভেসে উঠতে লাগল। সে জানে ওর জন্যই নীরা দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে দূর থেকে অগোচরে বিদায় জানাবার জন্য। সে রাতে একটা চিঠি লিখে ইরাকে দিয়ে এসেছে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার জন্য।

চিঠিটা কি সে খুলে দেখবে? নাকি ঠাঁই হবে ডাস্টবিনে?

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আজও একটা কবিতা মাথায় হুট করে উঁকি দিয়ে গেল,

“কাছে যাওয়া বড্ড বেশি হবে,
এই এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ভালো;
তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর,
বারান্দাতে বিকেল প’ড়ে এলো।”

কাছে যাওয়া আসলেও কি বেশি হয়ে যেত! আফনানের মনে হলো, সে সেঞ্চুরির সম্ভাবণা জাগিয়ে আউট হয়ে এইমাত্র প্যাভিলিয়নে ফিরে এলো, নিদারুণ হার হলো ওর। প্রতিদ্বন্দ্বী সায়মন তখনও ক্রিজে আছে অপরাজিত। বিজয় না ছিনিয়ে সে থামবে না।

বড্ড ব্যর্থ মনে হলো নিজেকে আফনানের। জীবনের এই খেলায় সে নিদারুণ ভাবে হেরে গেল আজ৷
……..
(ক্রমশ)