টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব (বিশেষ পর্ব- শেষ)

0
354

#টক_ঝাল_মিষ্টি (বিশেষ পর্ব- শেষ)
নুসরাত জাহান লিজা

অনেকক্ষণ হলো সকলেই লাবণ্যদের বাড়িতে ফিরেছে। ওর চাচা-চাচি বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার দুঃখও প্রকাশ করতে ভুললেন না, লাবণ্য তাদেরকে আস্বস্ত করে বলল,

“দেখো, এভাবে বলো না তো। এখানে তোমাদের কোনো ভুল নেই। ও কতটুকু নিতে পারছে সেটা বুঝে নিজেরই না করা উচিত ছিল।” তবুও তাদের মুখের মালিন্য কা*ট*ল না।

অনিকেতের প্রতি ওর একটা চাপা অভিযোগ মিশে রইল। কিন্তু এখন এই অসুস্থ অবস্থায় কথা শোনাতে ইচ্ছে করল না। প্রাণবন্ত মানুষটা কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। ছেলেটার চোখে লাবণ্যর কথা শোনার তৃষ্ণা প্রবল। কিন্তু সে কিছুই বলল না। উৎকণ্ঠার পাশাপাশি কিঞ্চিৎ হলেও সে রেগে আছে। ভালো মতো দুটো কথা বলতে গেলে দেখা যাবে কড়া করে বলে ফেলছে। তাতে অযথা তিক্ততা তৈরি হতে পারে। তাই আপাতত কথা না বলাই শ্রেয়তর মনে হলো।।

কেবল হাত দুটো নিজের দুই হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বসে রইল৷ আন্তরিকতা মাখা সামান্য স্পর্শেরও যেন সমস্ত অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমান শুষে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। যা হয়তো অনেকসময় মুখের কথাতেও সম্ভবপর হয় না।

রাহেলা, শফিককে সাথে নিয়ে এসেছিলেন ছেলের অসুস্থতার খবর শুনে। অনেক পীড়াপীড়ি সত্বেও থাকতে রাজি হলেন না, সন্ধ্যের খানিক পরে তারা ফিরে গেছেন৷

যাবার আগে রাহেলা মজার ছলে লাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“লাবণ্য, কয়দিন পরে যখন তোদের বাচ্চা হবে, তখন এই আধপাগলটাকে কীভাবে সামলাবি রে?”

অনিকেত নিজের মায়ের সাথে আধপাগল বলার প্রতিবাদ করে যাচ্ছিল, কিন্তু লাবণ্য একটা কথাও বলতে পারল না। কেমন যেন লজ্জা লাগল, অধোমুখে বসে রইল। আরক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছিল ওর পুরো মুখাবয়বে।

***
শায়লা লাবণ্যকে নিজের ঘরে ডাকলেন। এরপর পাশে বসিয়ে হাত ধরে বললেন, “তুই আসার পর থেকেই এমন মুখ ভার করে রেখেছিস কেন? অনিকেতকেও দেখলাম কেমন দূরে দূরে।”

“এমনিতেই মা। তেমন কিছু হয়নি।”

“আমি জানি অনিকেত তোকে কতটা বুঝতে পারে, তুইও অনেক সমঝদার। ঈদের দিনটা এভাবে গেল। ছেলেটার খেয়াল রাখিস।”

লাবণ্য মাকে বুঝতে পারে, তিনি খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। যতটা আকারে ইঙ্গিতে বলা যায় সেভাবে ওকে বললেন। নিজেদের শুরুর টম এন্ড জেরি কেমিস্ট্রির সাথে বর্তমান অবস্থা চিন্তা করলে সবকিছু কেমন বিচিত্র মনে হয়। সহ্য না করতে পারা মানুষটাই কেমন জীবনের সাথে অপরিহার্য হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।

অনিকেত রাতে তেমন কিছু খেল না। এখন একটু ভালো লাগছিল শরীরটা। বেশ ধকল গেছে বলে লাবণ্য ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। মাঝে অল্পস্বল্প কিছু কথা হয়েছে, কিন্তু মান অভিমান পর্ব শুরু হয়নি।

অনিকেতের ভেতরটা লাবণ্যর চোখে এতটাই স্বচ্ছ যে তাতে অতি সূক্ষ্ম কোনো অভিমানের আঁচড় পড়লেও সে স্পষ্ট দেখতে পারে, তা সে আঁচড় যতই আণুবীক্ষণিক হোক না কেন! আজও অন্যথা হলো না। অনুশোচনায় ওর মন ভারাক্রান্ত হলো। ওর পছন্দ করা পাঞ্জাবি হারিয়ে ফেলেছিল বলে খারাপ লেগেছিল। অথচ সে নিজেও একই দোষে দুষ্ট।

কতটা খুশিমনে এতটা ভালোবেসে একটা প্রত্যাশা রেখে নিশ্চয়ই শাড়িটা কিনেছিল। ওই শাড়িতে লাবণ্যকে দেখতে কেমন লাগবে, তাও হয়তো ভেবেছিল! সে কি-না অবলীলাক্রমে সেই ভালোবাসাটুকু অগ্রাহ্য করে গেল।

লাবণ্য আচমকাই অনিকেতের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। কোনোভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারল না।

অনিকেতের ঘুম ভেঙে গেল, সে ক্ষণকাল অপেক্ষা করল কী হচ্ছে তা অনুধাবন করতে। এরপরও বুঝতে অসমর্থ হয়ে উদভ্রান্ত গলায় বলল,

“কী হয়েছে? এ্যাই, এভাবে কাঁদছো কেন? আমি এখন ঠিক আছি তো। লাবণ্য…” অনিকেত বলে চলল।

কিন্তু লাবণ্য কিছুতেই সুস্থির হলো না, ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেল। অনিকেত ওকে শক্ত হাতে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে গেল।

***
সকাল সকাল ঘুম ভাঙল লাবণ্যর। অনিকেতকে ডাকল না একবারও। উঠে মনে মনে সারাদিনের পরিকল্পনা স্থির করে নিল। এরপর আস্তে-ধীরে তৈরি হয়ে সকালে খাবার সময় হলে অনিকেতের ঘুম ভাঙালো।

প্রথমে ঘুম থেকে উঠা নিয়ে কিঞ্চিৎ গাইগুই করছিল, কিন্তু যখনই আধঘুমন্ত আধখোলা চোখ লাবণ্যের উপরে পড়ল, বেচারা প্রবল বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে রইল ক্ষণকাল। এরপর বহু সং*গ্রামের পরে বাণী ফুটল গলায়।

“তোমাকে মাঠ ভর্তি সার বাঁধা সরিষা ফুলের মতো দেখাচ্ছে।”

লাবণ্যর মুখে কাঠিন্য ফুটতে ফুটতে সে প্রশ্রয়ে হেসে ফেলল। এমন অদ্ভুত উপমায় ওর ইতিকর্তব্য কী তাই স্থির করতে খানিকটা সময় লাগল। তবে মানুষটা যখন সুন্দর গাধা অনিকেত, তখন এমন উদ্ভটরকম অথচ ভালো লাগায় ছেঁয়ে থাকা উপমায় সে এতদিনে ভালোই অভ্যস্ত।

“শাড়িটা পছন্দ হয়নি, তবুও পরলে কেন?” কিছুটা যেন অনুযোগ মিশে রইল অনিকেতের গলায়!

“যেখানে এক পৃথিবী মায়া মিশে থাকে সেখানে পছন্দ অপছন্দ জরুরি নয়। জানো না?”

অনিকেত এবারে আকর্ণ হাসল। এই উদ্ভাসিত হাসিটুকুর জন্য লাবণ্য সারাজীবন আধপাগল ছেলেটার সব ভুল অনায়াসে মাফ করে দিতে পারে!

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। শাড়িটায় চমৎকার মানিয়েছে। মনে হচ্ছে বুঝি এটা তোমার জন্যই বানানো।”

লাবণ্য অনিকেতের পাশে বিছানায় বসা ছিল, সামনেই ড্রেসিং টেবিল। তার আয়নায় চকিতে চোখ গেল লাবণ্যর।

সত্যিই মানিয়েছে তো! কী আশ্চর্য! ভালোবাসার অপার্থিব যাদুবলে সকল অসুন্দরও কেমন সুন্দর হয়ে ওঠে। যে জিনিসে এতটা ভালোবাসা, এতটা মায়ার মাখামাখি থাকে, সে জিনিস সুন্দর না হয়ে যাই-ই না!

শাড়ির কল্যাণে নাকি এই উপহারে জড়ানো ভালোবাসার সৌন্দর্যে লাবণ্যর পুরো অবয়বে অদ্ভুত এক দীপ্তি ঝিকমিক করছিল যেন। সে আচ্ছন্ন গলায় বলল,

“এরপর আমি যত শাড়ি পরব, সব তোমার পছন্দের হতে হবে।”

অনিকেত মোহাবিষ্ট নয়নে লাবণ্যকে দেখছিল এতক্ষণ, এবার বলল, “সর্বনাশ। আমার পছন্দে আমার ভরসা নেই, আমি জানি তোমারও নেই।”

“ভালোবেসে যা আনবে তাই পরব। ভালোবেসে গায়ে জড়াব।”

অনিকেতের মনে এই কয়দিনে যতটা অভিমান জমেছিল, সব ধুয়েমুছে বিলীন হয়ে গেল নিমিষেই। মেয়েটা একটু বেশিই কঠিন, কিন্তু ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। সে এখনো ওকে ‘মায়াগিরি’ বলে ডাকে মনে মনে। মেয়েটা অতি মায়াবতী, একইসাথে আ” গ্নে” য়” গি” রি” ঠাসা থাকে মাথায়। হঠাৎ হঠাৎ তাতে লা””ভা দেখা যায়। দুইয়ের সংমিশ্রণে ‘মায়াগিরিই মানানসই লাগে’। সেই কবে চিঠিতে এটা লিখে জানিয়েছিল, কিন্তু কখনো সামনা-সামনি বলার সাহস করে উঠতে পারেনি।

অনিকেত হঠাৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এমন সকাল সকাল এত সাজগোজ কীসের জন্য?”

“আজ খালামনির বাসায় দাওয়াত আছে। রেডি হও।”

অনিকেত মাত্র মুহূর্ত কয়েক আগে আবেশে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরেছিল, এই উত্তরে ছিটকে সরে গেল। আঁতকে উঠে বলল,

“আবার দাওয়াত! আমি যাব না…না মানে, না গেলে হয় না?”

লাবণ্য হেসে ফেলল, এরপর অনিকেতের কানের কাছে মাথা বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“যখন যেখানে ‘না’ বলার, তখন দৃঢ়ভাবে তা বলবে। সুন্দর করেও অনিচ্ছা প্রকাশ করা যায়৷ তাতে কেউ কিছু মনে করবে না।”

অনিকেতকে তবুও দ্বিধায় ভুগতে দেখে সে আবারও বলল, “কী হলো? আমার কথা বুঝতে পেরেছো? মনে থাকবে?”

একরাশ দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়িয়ে অনিকেতের জবাব, “থাকবে।”

এরপর সহসাই একগাল হেসে নিঃশঙ্ক চিত্তে বলল, “তুমি আছো তো! এবার নিশ্চয়ই সবকিছুর মতো এটারও খেয়াল রাখবে।”
……..
(সমাপ্ত)
(ইহা কিঞ্চিৎ পুতুপুতু প্রেম হলো কি? পুরনো লেখার বর্ধিত অংশ কেমন লেগেছে আপনাদের?)