টিপ টিপ বৃষ্টিতে পর্ব-০১

0
642

#টিপ_টিপ_বৃষ্টিতে
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

সাদাসিধে একটা বিছানার মধ্যে বসে আছে লাল টুকটুকে বেনারসি গায়ে জড়িয়ে, লম্বা ঘোমটা দিয়ে ঐশী।
যেখানে আজ ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ মুখরিত হয়ে থাকার কথা।ফুলে ফুলে সাজানো বিছানা থাকার কথা ঐশী সেখানে আজ অন্য কেউ। ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় বলা বড্ড কঠিন। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো ১২টার উপরে বাজে স্বামী নামের রসকষহীন কাঠখোট্টা মানুষটির জন্য বসে আছে ২ঘন্টা ধরে। আদৌও জানা নেই আসলেই কি সে আসবে না-কি না।
স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডুব দিলো ঐশী আজ বিয়ে শুরু হওয়ার ঠিক কিছু সময় আগের ঘটনার মধ্যে,

[ লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পড়ে, চোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে বউ সেজে বিয়ের পিরিতে বসে তাকিয়ে আছে সামনে বড় চাচ্চুর মেয়ে বিথী আপুর হাতের দিকে।

প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিথী আপু।

বিয়ে বাড়ির লোক জন কানাঘুষা শুরু করেছে।

ছেলের বাবা নানা ভাবে বড় আব্বু কে বুঝানোর চেষ্টা করছে। উনার ছেলে এমন নয়।

ঐশী অনূভুতিহীন হয়ে চারপাশ চোখ বোলালো। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এত দিন একটু একটু করে কল্পনায় সাজানো সংসারটা সেকেন্ডই ভেঙে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে রিপোর্ট টা হাতে নিলো আর আল্লাহর কাছে মনে মনে হাজার বার দোয়া করছে। এই রিপোর্ট যেনো মিথ্যা হয়। আবার একবার চোখ বোলালো রিপোর্টে জ্বলজ্বল করে লেখা প্রেগন্যান্সি পজিটিভ। নিজের আপন বড় বোনের জায়গায় যাকে এতদিন জায়গা দিলো আজ সেই মেয়েটি তার হবু স্বামীর বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে!!

আরেকটু দেরি হলে কি হতো ভাবতেই সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো ঐশীর। ওর কারণে ওর বড় বোনের জীবনটা নরক হয়ে যেতো। রাস্তায় বের হলে এই নিষ্ঠুর সমাজের মানুষ গুলো ঘৃনার চোখে তাকাতো। কেউ বা ছি!ছি করতো।

বীথি ঐশীর এক হাত আঁকড়ে ধরে বলে উঠলো, ‘ ঐশী বোন আমার। আমি কখনো জানতাম না তোর সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ ১৫দিন নানার বাড়িতে আমি। এরি মধ্যে তোর বিয়ে ঠিক আমার শরীর খারাপ হয়ে বসলো। কিছু খেতে পারি না, মাথা ঘোরানো সব মিলিয়ে নিজের খবর ছিলো না। কাল যখন জানতে পারি আমি মা হতে যাচ্ছি তখন আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়ে ছিলো। আমি বার বার আকাশের নাম্বারে কল, মেসেজ দিয়েছি কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ। আজ যখন ওর এক বন্ধু কে কল দেই ওই ভাইয়া আমাকে সব বলে। প্রথম ভেবে ছিলাম কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু এটার সাথে যে তোর জীবন জড়িতো। আমি চাই না তোর জীবন নরক হয়ে উঠুক।

আজাদ সাহেব রেগে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ বিথী বাসার ভেতর যাও। আমি এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না।

বিথী ছলছল চোখে নিজের বাবার দিকে তাকালো।

ঐশী চমকে আজাদ সাহেব এর দিকে তাকালো। একটা বাবা কি করে তার মেয়ের হাতে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখেও এই কথা বলতে পারে।

বিথীর আম্মু সাজিদা বেগম ভয়ে এক কোনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন। এখন মেয়ের পক্ষ ধরে কিছু বলতে গেলে উনার নিজের গালেই চার পাঁচটা পড়বে।

ঐশীর আব্বু রায়হান সাহেব বললো,’ ভাই মাথা ঠান্ডা করো। বিথী বাড়ির ভেতরে গেলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে..? কিছুই ঠিক হবে না। আর ও বাড়ির ভেতর কেনো যাবে..? এখানেই থাকবে ঐশী যেমন আমার মেয়ে বিথীও আমার মেয়ে।

আজাদ সাহেব লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছেন। কেমন মেয়ে জন্ম দিলেন! আজ সেই মেয়ের জন্য নিজের নাক,কান সমাজের সামনে কাটা গেলো।কাল হয়তো বাসা থেকে বের হলেই লোকে জিজ্ঞেস করবে,’ এত এত বলছি মাইয়া বিয়া দিবা না। পড়াশোনা করাই ডাক্তার বানাই বা। এহন ত দেখি মেলা বড় ডাক্তার বানাইছো বলে হাসি-তামাশা করবে।’

আকাশ রেগে তাকিয়ে আছে বিথীর দিকে। এই মেয়েটা আসার সময় পেলো না। আরেকটু দেরি করে আসলে ওর প্লেন সাকসেসফুল হতো কিন্তু শেষে এসে সব প্লেনে জল ঢেলে দিলো। এত এত কষ্ট করে নিজের আব্বু কে সবাইকে রাজি করাইছে সব শেষ। এখন তো কোনো ভাবেই ঐশীকে বিয়ে করতে পারবে না।

বিথী একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

রায়হান সাহেব চারপাশ তাকিয়ে বুঝলেন এই ঘটনা পুরো এলাকা এতক্ষনে জানাজানি হয়ে গেছে। উনি পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য বললো,’ সাজিদা ভাবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না না করে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হলো বিথী কে রেডি করিয়ে নিয়ে আসেন।
তারপর নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ সুরভি ঐশী কে ভেতরে নিয়ে যাও।

সুরভি বেগমঃ আপনি একবার ভেবে দেখেছেন আপনি কি বলছেন..? আমার এই মেয়েকে এখন কে বিয়ে করবে .? সমাজ কি আমার মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলবে না..!?

রায়হান সাহেবঃ সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে সুরভি আগে নিজের সম্মান বাঁচাতে হবে। এই ঘটনার পর বিথীর কথাও একবার ভাবতে হবে। এখন আবেগের বয়স ভুল না হয় একটা করে ফেলেছে ।

সুরভিঃ আপনার কাছে নিজের সম্মানটা বড় হলো আমার মেয়ে যে কাল ঘর থেকে বের হলেই লোকে বলবে অপয়া,অলক্ষি মেয়ে। বিয়ের দিন বর নিজের…বলেই চুপ হয়ে গেলো.. ছ্যাহ্।

রায়হান সাহেবঃ এখন তুমি কি চাও আকাশের সাথে ঐশীর বিয়ে হোক..? এমন ছেলের সাথে যে কিনা আমাদের মানসম্মান ধূলিসাৎ করে দিলো। আমরা না হয় জানতাম না আকাশ তো বলতে পারতো সবটা।

সুরভি কিছু সময় চুপ থেকে বললো,’ আমি আমার মেয়ের বিয়ে আজ দিবো!! আর এখনি!..

ঐশীর বুক কেঁপে উঠলো। তারাতারি আকাশের দিকে তাকালো । লোকটা ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাঁসি ঝুলিয়ে রেখেছে।

ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো ঐশী। রাগে শরীরের রক্ত গুলো টগবগ করে উঠলো। যদি পারতো এই ছেলের চোখ গুলো সে তুলে নিতো।

বিথী হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করলো। জীবনে সে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে। সে পাপ করেছে তার শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। এক দৌড়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

বিথীর পিছু পিছু ওর আম্মু গেলো।

ঐশী শূন্য দৃষ্টিতে ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন দোষ চরিত্র লোক কে বিয়ে করার আগে সে নিজের জীবন দিবে তাও এই লোককে বিয়ে করবে না।

ঐশীর আম্মু নিজের ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে ঐশীর আব্বুর সামনে এসে বললো,’ আমাদের শুভর সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হবে। আপনার এই দুশ্চরিত্র বন্ধুর ছেলের সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিবো ভাবলেন কিভাবে?। যে ছেলে বিয়ের আগেই অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারে সেই ছেলে যে বিয়ের পর অন্য মেয়ের দিকে নজর দিবে না, সে কথা কি সে দিতে পারবে। যাই হোক আমার মেয়ে কিছু তেই এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিবো না। বড় ভাই আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে বিথী কে বিয়ে দিতে পারেন।

সাজাদ সাহেব কিছু না বলে ইশারায় একজন বললেন উনার মেয়েকে রেডি করিয়ে নিয়ে আসতে।

বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হওয়া মেয়ের বাবাই জানে এই সমাজে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন।

আকাশ বিয়ে করবে না বলতে গিয়েও থেমে গেছে। ওর আব্বু চোখ মুখ লাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।

শুভ নামটা শুনেই ঐশী ভয়ে জমে গেছে। এই লোক ওকে একদম পছন্দ করে না। আর এমন গম্ভীর রসকষহীন কাঠখোট্টা লোকের সাথে কিভাবে সারা রাস্তা থাকবে..?উনার রাস ভারি কন্ঠ শুনলে ঐশীর শরীর ভয়ে কেঁপে উঠে। আর এই লোক ঐশীকে একদম সয্য করে না। সেই লোক ওকে বিয়ে করবে!! উনি কি দয়া করছে?ঐশীর কি বিয়েতে না করে দেওয়া উচিৎ? এখন পরিস্থিতি অন্য পর্যায়ে চলে গেছে। বিয়ে করবে না বললে আরো হাজার কথা শুনতে হবে৷ মা বাবা এমনি তেই কম লজ্জিত হয়নি। আর এখন তো মুখও দেখাতে পারবে না।

ইচ্ছে না থাকা সত্যেও বিয়ে হয়ে গেলো।

বিথী যাওয়ার সময় প্রচুর কান্না করলো কিন্তু বড় চাচ্চু একবার ও নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন না।]

এই সব ভাবতে ভাবতে কেটে গেলো আরো অনেক সময় কিন্তু না তাও কেউ আসলো না। বাহিরে টিপ টিপ বৃষ্টি পরছে। ঐশী উঠে গিয়ে খোলা জানালাটা লাগিয়ে দিলো। ঠান্ডা বাতাসে রুম ঠান্ডা হয়ে গেছে।

এই রুমে এর আগে দু বার আসা হয়েছে ঐশীর।তবে ভালো করে কিছু দেখা হয়নি। ঘুরে ঘুরে রুমের জিনিস পত্র গুলো দেখলো।সব কিছু দেখা শেষ আবার এসে আগের জায়গায় বসলো।

অপেক্ষা করতে করতে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে গেলো ঐশী।

সকালে চোখে মুখে পানির ছিটা পরতেই ভয়ে পিটপিট করে চোখ খোলে উপরে তাকালো ঐশী। ছাঁদ কি ফোটা হয়ে গেছে নাকি। কাল রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ওই বৃষ্টির পানি কি ওর উপর পরছে!!

ঐশীর মুখের রিয়াকশন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো পূর্ণা।

ঐশী সামনে তাকিয়ে পূর্ণার হাতে পানির মগ দেখে যা বুঝার বুঝে নিলো।

ঐশী কিছু বলার আগেই দরজার কাছে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ পূর্ণা আম্মু ডাকছে। যা দেওয়ার দিয়ে বের হ।’
ঐশী দরজার দিকে তাকিয়ে ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। এই লোককে দেখলে এত ভয় ঘিরে ধরে কেনো..??

পূর্ণা ঐশীর হাতে বেগুনি রঙের একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ঐশী তাকিয়ে রইলো শাড়িটির দিকে। সে তো কোনো দিন শাড়ি পড়ে নি।

শুভ রুমে ঢুকে একবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো….

চলবে..

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।