নন্দিতা পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
389

#নন্দিতা
পর্ব-০৭
#kheya

আরও একবার কবরস্থানে আসতে হলো রায়াজের। একদম ইচ্ছে ছিলোনা তার এখানে আসার।
সামনে থাকা মানুষটাকে তো ঘৃণা করে সে।নাহ করত।লাশকে কী ঘৃণা করা যায় নাকি।মোটেও যায়না।মানুষ মারা গেলে তার সব ভুল নাকি মাফ করে দিতে হয়।তবে কী রাসেলকে মন থেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে রায়াজ।

রাসেলের দাফন শেষ করে সবাই রায়াজের মামাবাড়ি গেলো।একমাত্র ছেলে হারানোর শোকে পাগল হয়ে আছে রাসেলের মা।

আজ সকালেই রাসেলকে মৃত অবস্থায় পায় পুলিশ।নন্দিতাকে যে ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গেছিলো সেখানেই কালরাতে রাসেলকে ঢুকতে দেখা যায়।পুলিশের কড়া নজরদারির পর ভোররাতে মিশন শুরু করলে ভেতরে গিয়ে তারা রাসেলকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে।পরবর্তীতে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষনা করে।
রাসেলের মাথায় গুলিবিদ্ধ ছিলো।বন্দুকটা তার নিজের হাতেই ধরা ছিল।
সে যে আত্মহত্যা করেছে তা বুঝতে বাকি রইলোনা পুলিশের।

ফরেনসিক টেস্ট এর জন্য রাসেলের লাশ পুলিশ নিয়ে গেলেও রাসেলের বাবা অনেক কায়দা করে তা ছাড়িয়ে আনে।

দাফন শেষে পুলিশ ঘটনাস্থলে পাওয়া একটা চিঠি রায়াজকে দিলো।
রায়াজ চিঠিটা পড়তে শুরু করল

” হয়ত চিঠিটা তোমরা যখন পাবে তখন আমি থাকবোনা নয়ত তোমরা কখনো এটা পাবেই না।
আমার জীবনটা এমন কেন করে দিলে বাবা,মা।তোমরা তো আমার বাবা মা।তোমরা কেন জেনে বুঝে আমাকে অন্ধকার এ জগতে ঠেলে পাঠিয়ে দিলে।তোমরা তো কখনো আমাকে বোঝাও নি যে এটা খারাপ এটা করিস না।এটা অন্যায় এটা করো না।উল্টো আমি যখন যা চেয়েছি দিয়েছো।জানো বাবা
আমি ভীষণ বাজে কিছুতে জড়িয়ে গেছি বাবা।মানুষমারা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। আমি নন্দিতাকে শেষ করে দিয়েছি জানো বাবা।আমার নন্দিতাকে।
সেদিন আমি প্রচুর নেশা করেছিলাম জানো বাবা।আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।এসিড দিয়ে নন্দিতার মুখটা জলসে দিয়েছিলাম। তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তার মুখ অসুন্দর হলেও তাকে আমি ভালোবাসি।
মেয়েটা একটুও ছটফট করেনি জানো বাবা।একদম চুপ ছিল।পালানোর ও চেষ্টা করেনি জানো বাবা।মরে গিয়েছিল হয়ত।ওকে দেখার তৃষ্ণা আমার কিছুতেই মিটছিল না জানো।তাই তো ওকে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে দেখেছিলাম।প্রাণ ভরে দেখতাম ওকে আমি।আমি ভুলে গিয়েছিলাম জানো জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।নন্দিতা আমাকে বলেছিল জানো সে আমাকে ভালোবাসেনা।
যখন আমার নেশা কাটলো আমি পাগলপ্রায়।নন্দিতাকে হারানোর ক্ষত একসহজে ভালো হবার নয়।আমি ভীষণ ভুল করেছি জানো।আমি আর সহ্য করতে পারছিনা এসব।আমাকে মাফ করে দিও।আমি বিদায় নিচ্ছি। আমি তো খারাপ ছিলাম না।তোমরা বানিয়েছিলে।আমার পাপের দ্বারা নিজের যে সম্পদের পাহাড় গড়েছো তা নিয়ে খুশি থাকো।

ইতি
এক উন্মাদ ”

রায়াজের মাথা কাজ করছেনা। ভীষণ শূন্য শুন্য লাগছে সব।সত্যি তো রাসেল এমন ছিল না।তবে এমন কেন হলো।

রাসেলের বাবা এবার কেঁদে উঠলো

” আমার ভুলের জন্য আমার ছেলেটাকে হারালাম আজ।নিজের টাকার লোভে আমার ছেলেটাকে আমি অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়েছিলাম।পাপ করেছি আমি।ভীষণ পাপ করেছি।”

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল রাত।কী হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছেনা।নেশায় বাজে ভাবে আসক্ত হওয়ায় যে রাসেল হুস জ্ঞান হারিয়ে এসব করছিল সে বুঝলো।তবে নন্দিতা।

“””””
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে রাসেলের মা রায়াজকে নিজের কাছে ডাকে একান্ত কিছু কথা বলার জন্য।

” রায়াজ আমার কাছে বস।”

” কি বলবে মামনি। ”

” আমি যা বলব চুপচাপ শুনবি শুধু।নন্দিতা মরেনি।ও বেঁচে আছে ভালো আছে।সেদিন রাসেল করে তুলে নিয়ে এসেছিল আমি জানতাম।নন্দিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য ভীষণ ছটফট করছিল।পালানোর চেষ্টাও করেছিল।তবে রাসেলের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল।রাসেলের হাত থেকে বাঁচতে স রাসেলের মাথায় আঘাত করেছিল।রাসেল বেহুশ হয়ে গেছিলো।আমি সবই জানতাম।তাই তো আমি গিয়েছিলাম ওকে বাঁচাতে।
আমি জানতাম আমার ছেলেটা তখন পুরোপুরি নেশার ঘোরে ছিলো।সে কী করতো কোনো হুশ তার ছিলোনা।একটা নিষ্পাপ মেয়েকে এমন জায়গায় কীভাবে রেখে আসতাম।
নন্দিতার জায়গায় অন্যকেউ এলেও সে বুঝতো না।
কিছু টাকা আর পরিচিত লোকদের খাটিয়ে মর্গ থেকে নন্দিতার বয়সী একটা মৃত মেয়ের লাশ এনে রেখেছিলাম সেখানে।রাসেল ওকেই নেশার ঘোরে নন্দিতা ভেবেছিল।
নন্দিতা ভালো আছে।তবে এতদিন রাসেলের ভয়ে আমি চুপ ছিলাম। তবে আর তো কোনো ভয় নেই।আমার বুক তো খালি হয়েছে। আমি নন্দিতার মায়ের শূন্য বুকটা আবার পূর্ন করে দিতে চাই। ”

বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলো রাসেলের মা।রায়াজের ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি।তবুও মাথায় ঘুরছে অনেককিছু এ অল্পকদিনে কতকিছু হয়ে গেলো।মানুষের এ সংক্ষিপ্ত জীবনে কোনকিছু হওয়াই যে অস্বাভাবিক না তা সে ভালোই উপলব্ধি করল।

রাসেলের মায়ের থেকে একটা ঠিকানা নিয়ে রায়াজ জলদি গেলো নন্দিতাকে আনতে।ইতিমধ্যে অবৈধ মাদকব্যবসা ও নারী পাচারের সাথে যুক্ত থাকায় রাসেলের বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

———

রাসেল নন্দিতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।সে এতদিন কীভাবে ছিল।কেন লুকিয়ে ছিলো কিছু জানার দরকার মনে করেনা সে।আপাতত ফুফুর বুকে তার কলিজার টুকরাকে ফিরিয়ে দিতে পারলেই শান্তি।

নন্দিতাকে দেখা মাত্র বাড়ির সবাই ভীষণ অবাক হলো।নন্দিতা মা তো সোজা জ্ঞান হারালো।

রায়াজ সবাইকে সবটা খুলে বলল।নন্দিতা বেশ চুপচাপ হয়ে আছে। সবকিছুতেই ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।

মাকে দেখা মাত্রই আমার বুকের মাঝে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। একদিনে বেশ বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নন্দিতার মা বলল

” সব ভুলে যা মা আমরা তোকে ভীষণ আগলে রাখবো কেন থেকে।আমি জানতাম আমার মেয়ে এমন কোনো পাপ করেনি যে আল্লাহ তার এমন নিষ্ঠুর পরিণতি দিবে।”

সেদিন মা মেয়ের আনন্দের কান্নায় পুরো বাড়ি ভরে ছিলো।ভাগনীকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে মিস্টার রহমান ও মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালো চোখের জল ফেলেছিলেন।
——
সে ঘটনার পর কেটেছে কয়েকটা মাস।নন্দিতা এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তবে সবটা এখনো ভুলতে পারেনি সে।যে রাসেলের সাথে তার বিন্দুমাত্র ঘনিষ্ঠতা ছিল না সে তার জন্য এমন পাগল কেন হয়েছিলো জানা নেই ।রাসেলের মৃত্যুটা বেশ দুঃখজনক নন্দিতার কাছে্তার জন্যই তো এমন হলো।
তবে নিজেকে স্বাভাবিক করার ভীষণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।রায়াজের ওপর আর দুর্বলতা দেখায়না সে।রাসেলের থেকে এটা সে শিখেছে বুঝেছে জোর

করে ভালোবাসা হয়না।কথায় কথায় ভালোবাসা জাহির করা ঠিক না।

রায়াজের সাথে রিয়ার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই।আবির রিয়াকে ঠকানোর পর রায়াজ তাকে মনোবল দিতে গিয়ে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছিল জানা নেই তার।রিয়ার রায়াজকে ভালোলাগতো।তবে ভালোবাসতোনা হয়ত।পরিবারের কথায় আর নিজের ভালো ভেবে বিয়েতে রাজি হয়েছিল।তবে রায়াজকে যে সে ভালোবাসেনি এটা রায়াজ বুঝে।ভালোবাসলে কী এত সহজে ছেড়ে যেতো।
তবে রিয়ার প্রতি কোনো রাগ ঘৃণা নেই রায়াজের।ভালোবাসার মানুষকে কী ঘৃণা করা যায়।
_________

আজ শুক্রবার।সেদিনের পর কেটেছে কয়েক মাস। ভর দুপুরবেলা ছাঁদে বসে আছে নন্দিতা।নামাজ শেষ করে সবে রায়াজ বাড়ি আসতেই মা তাকে নন্দিতাকে ডেকে নিয়ে যেতে পাঠালো।

রায়াজকে দেখেই মুচকি হাসলো নন্দিতা।বলল

” আপনাকে আজকে বেশ সুন্দর লাগছে রায়াজ ভাই। একদম আমার মনের মতো।”

রায়াজ ভ্রুকুঁচকে বলল

” কী বললি!”

” ভালবাসি রায়াজ ভাই! ভীষণ ভালবাসি আপনাকে ।”

রায়াজ আবার বিরক্ত হলো। এই মেয়ে বদলানোর নয়।

নন্দিতা খিলখিলিয়ে হাসলো

” ভয় পাবেন না রায়াজ ভাই।আমি তো মজা করলাম।”
” গান গাইবেন রায়াজ ভাই!”

পুনরায় রায়াজ ভীষণ বিরক্তির দৃষ্টি নন্দিতার দিকে নিক্ষেপ করে বলল

” এই ভর দুপুরবেলা এমন রোদে বসে কে গান গায় শুনি।”

” কেন আপনি আর আমি গাইবো।মাত্র দুটো লাইন প্লিজ।”

রায়াজ আর কিছু বলেনা।জানে মেয়েটা এখন তার কোনো কথা পাত্তা দিবেনা।তার মনস্থির করলো দুটে লাইন গাইলে মন্দ হয়না।

নন্দিতা গান শুরু করে।রায়াজ ও সুর মেলায়।দুটি সম্পুর্ন বিপরীর ধারার মানুষের সুর আজ একই লাইনে বইছে।গানের ফাকে একবার নন্দিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রায়াজ পুনরায় গান শুরু করে রায়াজ,,,

” ওহে কী করিলে বলো পাইব তোমারে,
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে-
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ,
এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ,
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে –
তুমি আপনি না এলে
কে পারে হৃদয়ে রাখিতে।”

সমাপ্ত