#ডাক্তার_মিস
পর্ব ২৭
(কপি করা নিষেধ)
রায়হানের পাশে দাঁড়ানো পুরুষটি এবার বললেন,
“চেয়ারম্যান সাহেবকে চেন তুমি? উনার কথা এত গল্প করেছি, বলোনি তো। এক্সট্রাঅর্ডিনারি মানুষ তিনি। এলাকার ইয়ং ছেলেদের রোল মডেল। এমন একজন মানুষ তোমার বন্ধু ছিল। ভাবতেই ভালো লাগছে।”
অপ্রস্তুত বোধ করলো কথা।
তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুমি তো কখনো ওর নাম বলোনি।
“তাছাড়া আমরা বন্ধু ছিলাম না, হয়ত তাই আপনার স্ত্রী ভুলে গিয়েছেন।“ , শীতল কন্ঠে বলল রায়হান।
এবার আহত দৃষ্টিতে ফিরে চাইলো কথা। ব্যাপারটা কথার স্বামী মহাশয়ের দৃষ্টিগোচর না হলেও আড়চোখে কথার দিকে তাকিয়ে থাকা বুশরার চোখ এড়ালো না। কথার পরিচয় জানার পর থেকেই সূক্ষ বেদনায় নীল হচ্ছে ও।
কথার স্বামী (বর্তমান) এই এলাকার একজন প্রশাসনিক কর্তাব্যাক্তি হিসেবে আছেন বছরখানেক। তাই তাদের মধ্যে সখ্যতা বেশ। সেই সুবাদেই সস্ত্রীক বিয়েতে দাওয়াত।
“তা যাই বলুন, আমাদের বাসায় কিন্তু নবদম্পতির পদধূলি চাই। এই কথা… বলো না ক্যানো??“
কথা সায় জানালো। ঠিক তখনই একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা ফোনকল আসায় দুঃখ প্রকাশ করে কথা বলতে বলতে বাহিরে চলে গেলেন তিনি।
“আপনারা কথা বলুন, আমি দেখি রুকু এসেছে কি না।“
এইটুকু বলে সরে পড়লো বুশরা। আপাতত ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না ওর। তাছাড়া ওর যে ভূল ধারনা হয়েছিল সেটা কেটে গেছে। দুজন মানুষ যাদের মধ্যে গভীরতম একটা সম্পর্ক ছিল, নিয়তি তাদের সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তাদের কিছুটা প্রাইভেসি দেওয়া প্রয়োজন মনে করে বুশরা।
বুশরা আড়াল হতেই কথা প্রথম মুখ খুললো, “আমরা বন্ধু ছিলাম না?”
“না তো। আমরা প্রেমিক প্রেমিকা ছিলাম। তারপর স্বামী-স্ত্রী। অবশ্য ওই বিয়েটা অস্বীকার করেছো।“
“নিজের রিসিপশনে এসব কথা বলা কি খুব জরুরী? তোমার নববিবাহিত বউয়ের কানে গেলে কি বিষয়টা ভালো হবে?”
“তোমার কি মনে হয়? আমার বউ কেন আমাদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে গেল?”
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে প্রাক্তনের দিকে তাকালো রুপকথা।
রায়হান বলল, “যার হাতে ভাঙ্গা হৃদয়টা সারা জীবনের জন্য তুলে দিব তার কাছে স্বচ্ছ থাকাটা কি জরুরী না? আফটারঅল বিশ্বাসঘাতকতা আমার রক্তে নেই।”
এটুকু বলে হনহন করে চলে গেল রায়হান। কিছুদুর আগাতেই বুশরার দেখা পেল। ধীরপদে পাশে গিয়ে বসে পড়লো।
“থ্যাঙ্কস”
বুশরা ফিরে তাকালো ওর দিকে।
“আর ইউ ওকে?”
“অবশ্যই।“, ঢৃড়ভাবে বলার চেষ্টা করলেও সূক্ষ কাপনটা টের পেল বুশরা। ডান হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে মানুষটার হাতের উপর রাখলো। বিয়ের পরে এটাই হলো ওদের প্রথম স্পর্শ। কেউ না দেখলেও অদৃশ্য নির্ভরতার আশ্বাস অনুভব করলো রায়হান। দুজন দুজনার দিকে তাকালো এক পলক। চোখে চোখে কিছু কথা কি হলো? কি জানি। তবে সেই মুহুর্তটাকে ফ্রেমে বন্দি করলো রুকাইয়া। ওই যে বলে না? ক্যান্ডিড।
বিয়ের পরের দিনগুলোর সাথে আগের দিনগুলোর বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। সকাল সকাল দুজনেই বেরিয়ে যায় কাজের খাতিরে। বুশরা ফেরে সন্ধ্যায়। রায়হানের বেশিরভাগ দিনই গভীর রাত। রুকাইয়া ফিরে গেছে ঢাকায়। বুশরার সন্ধ্যাবেলাটা আগের মতই কাটে শিউলি বেগমের সাথে।
আজ অবশ্য সন্ধ্যা থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত। কথা বলতে ভালো লাগছেনা। তাই মাথা ব্যাথার অযুহাতে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে।
চিন্তা করছে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে। রায়হানের সাথে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতিচারন করে আনমনে। মানুষটা ভালো না বাসলেও সম্পর্কের প্রতি শুরু থেকেই স্বচ্ছ, দায়িত্ববান। স্ত্রীর সম্পুর্ন সম্মান দিতে কুন্ঠা বোধ করেনি কখনো। তবু অধৈর্যভাবে ভাবছে কবে সম্পর্কটা আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মত ভালবাসাময় হবে। বুশরা একবার ভাবে নিজে একধাপ সামনে আগাবে। আবার ভাবে, রায়হান সময় চেয়েছিল, আর ও স্বজ্ঞানে তাতে সম্মতি দিয়েছিল। তাই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে সবকিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করে ও।
শিউলি বেগম একবার এসে দূর থেকে দেখেই চলে যেতে উদ্যত হলেন। ভেবেছেন মাথাব্যাত্থা হয়ত, এত ধকল যায় মেয়েটার উপর, একটু ঘুমাক।
“আম্মা।”
“ঘুমাসনি?”
“উহু…। আসো বসো।”
“শরীর খারাপ?”
“না তো।“
“তাহলে অন্ধকারে শুয়ে আছিস ক্যান?”
“এমনি।“
বুশরার মাথার পাশে বসলেন শিউলি বেগম। চুলে বিলি কেটে দিতে গিয়ে দেখলেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা।
“জ্বর আসছে কখন?”
“কি জানি। ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।“
“ক্যান ডাক্তারদের সাথে অসুখের চুক্তি আছে নাকি?”
“হু…”
“কি চুক্তি?”
“হুউউ…”
আরো কিছু জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। উত্তরে বুশরা শুধু হু হা করে গেল। মূলত জ্বরটা অনেক বেশি। আর মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার আরামে আর শরীর খারাপ মিলিয়ে ঘুম ঘুম ঘোরের মধ্যে চলে গেছে ও।
জলপট্টি দিতে হবে। এই চিন্তা করে নিচে গেলেন তিনি। একটা বাটিতে পানি আর একটা সুতি রুমাল নিয়ে সিড়ির ভেঙ্গে উপরে উঠতে লাগলেন তিনি। ঠিক তখনই সিড়ির খিড়কি দুয়ার থেকে ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেন। উপরে না গিয়ে আবার ফিরে আসলেন তিনি। মিনিট পাঁচেকের মাথায় হাতমুখ ধুয়ে মায়ের কাছে আসলো রায়হান।
“তোমার বউয়ের খোঁজ রাখো?”
বউ শব্দটার উপর ইচ্ছা করে জোর দিলেন তিনি। মায়ের কথা বলার ধরনে অবাক হলো রায়হান। বুশরাকে তিনি নাম ধরেই ডাকেন। আর ওদের তিনজনকেই তুই সম্বোধন করেন। দুটো নিয়মের ব্যাতিক্রম একটামাত্র বাক্যে হওয়ার হচকিয়ে গেল রায়হান।
“কি হয়েছে মা?”
“সেটা আমার আগে তোমার জানার কথা বাবা। মেয়েটার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কয়দিন হলো আল্লাহ ভাল জানেন। আর তুমি এক ঘরে থেকেও জানো না। তোমার আব্বা তো এমন ছিলেন না কোনদিন।“
উৎকণ্ঠিত হলো রায়হান। ব্যাস্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় ও?”
একটু নরম হলেন তিনি, “ঘরেই আছে।“
রায়হান ঘরে যেতে উদ্যত হলে শিউলি বেগম তার হাতে পানি ভর্তি বাটিটা দিয়ে বললেন,
“এটা নিয়ে যা।“
ঘরে ঢুকে আঁধার হাতড়ে মৃদু আলো টা জ্বালালো ও। তারপর বিছানার উপর বসে জলপট্টি দিতে উদ্যত হলো। কিন্তু মায়ের হাত থেকে রুমালটা নেওয়া হয়নি। পকেট হাতড়ে নিজের রুমালটা বের করলো রায়হান। তারপর ওটা দিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করলো।
অনেক্ষন জলপট্টি দেওয়ার পরে ভেজা রুমালটা দিয়ে হাত পায়ের তালুও মুছে দিল।
জ্বরটা কমে গেল একসময়। কয়েকবার ডাকাডাকি করলেও ঘুম ভাংলোনা বুশরার। খাবার প্লেটে সাজিয়ে ঘরে দিয়ে গেলেন শিউলি বেগম, রাতে ঘুম থেকে উঠলে যেন খেয়ে ওষুধ খায় তাই।
সাইড ল্যাম্পের আলোয় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে রায়হান। মূলত অপেক্ষা করছে বুশরার ঘুম ভাঙ্গার। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও যখন সেরকম কোন আভাস পেলো না তখন সাইডল্যাম্প বন্ধ করে শুয়ে পড়লো ও।
চোখ বন্ধ করেও রায়হান টের পেল মৃদু কাঁপছে বুশরা। গুটিসুটি মেরে বাচ্চাদের মত ঘুমাচ্ছে ও। মায়া হলো ওর। হাত দিতেই টের পেল বরফশীতল হয়ে আছে বুশরার গা। শীত এখনো না পড়ায় লেপ কাঁথা কিছুই আলমারী থেকে বের করা হয়নি। আর আলমারীর চাবি বুশরার কাছে, এখন আলো জ্বেলে খুঁজতে গেলে বুশরার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে।
তবু মোবাইলের ফ্লাশলাইট জ্বেলে যতটুকু নিঃশব্দে পারা যায় এদিক ওদিক খুঁজলো ও। বিফল মনোরথ হয়ে একটা চাদর নিয়ে এসে আবৃত করে দিলো মেয়েটাকে। উষ্ণতার সন্ধান পেয়ে ঘুমের ঘোরেই রায়হানের দিকে যেন আরেকটু এগিয়ে গেল বুশরা। কাঁপুনিটা আরো ভালভাবে টের পেল রায়হান। আরেকটু নিজের দিকে টেনে নিল মেয়েটাকে। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে হারিয়ে গেল ঘুমের অতল রাজ্যে।
চলবে…