ডানা মেলে উড়ি পর্ব-০১

0
313

#ডানা_মেলে_উড়ি
#ফাহমিদা_লাইজু
প্রথম পর্ব

কিছুক্ষণ আগেই বড় চাচা-চাচী আর সোনিয়া এসেছে কোন খবর না দিয়েই।
চাচা-চাচী ঢাকায় আসলে সবসময় শিমু আপুর বাসায় উঠেন,পরে কোন এক সময় আমাদের এখানেও বেড়াতে আসেন কিন্তু এবার লাগেজ নিয়ে সরাসরি আমাদের এখানে উঠলেন।সোনিয়া কত হাসি খুশি থাকে।এবার এলো মুখটা মলিন,চোখের নিচে কালি নিয়ে,এসেই শুয়ে পড়ল।একটা কথাও বলল না।চাচী বললেন ওর শরীর খারাপ।কোন একটা ঝামেলা স্পস্ট বুঝলাম।

চাচা-চাচীর কুশল জিজ্ঞেস করে আমি আবার রুমে গিয়ে পড়ার টেবিলে গেড়ে বসলাম।

—আপ্পি জান সনি আপুর বাচ্চাটা নাকি পেটের ভিতরে মরে গেছে ।
এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলল টুসি।
আমার মন একদম পড়ায় ঢুকে ছিল।টুসির কথা শুনে চমকে উঠলাম।
আমি চোখ পাকিয়ে টুসির দিকে তাকালাম।
—আমি সত্যি বলছি আপ্পি ।চাচী খুব কেঁদে কেঁদে মা কে বলেছেন।
—আমি পড়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে,টুসিকে জিজ্ঞেস করলাম-
—তুই কি ভাবে শুনেছিস?
টুসি উত্তর না দিয়ে, মুখ ভার করে চলে গেল।
আমার ভেতরটা কেমন করতে লাগল।এটা কিভাবে সম্ভব? টুসি নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে ভাবতে ভাবতে মায়ের রুমে গেলাম।
আসলেই চাচী কাঁদছেন, মা উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।চাচা আর বাবা গম্ভীর হয়ে বসে আছেন।
আমাকে দেখেই বাবা বললেন-
—মিথি তুমি তোমার রুমে যাও,পড়ায় মন দাও।
মায়ের দিকে তাকাতেই মা আমাকে ইশারা দিলেন চলে যেতে।
আমি গেস্ট রুমে চলে গেলাম,সনি দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডাকলেও কোন উত্তর দিল না। ভাবলাম ঘুমিয়ে আছে।

বারান্দায় গিয়ে দেখি টুসি মুখ চেপে কাঁদছে। বুঝলাম মায়ের বকা খেয়েছে।ক্লাস সেভেনে পড়ে মেয়ে তবুও বাচ্চাদের মত স্বভাব।কিছু বললেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলে।
এখন ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার মানেই হয়না,রাগ না কমা পর্যন্ত একটা কথাও বলবে না।

অন্য সময় হলে ওকে জোর করে আদর করে দিতাম।এখন শুধু সোনিয়ার কথা মাথায় ঘুরছে। অন্য কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
আগামীকাল থেকে আমার তৃতীয় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে।পড়ায় একদম মনোযোগ দিয়ে পারছিনা।

পাঁচ মাস আগে সনির বিয়ের প্রস্তাবের কথা যখন জানালেন চাচা,বাবা একদম সাফ জানিয়েছিলেন, ‘এই বিয়েতে আমার মত নেই,মেয়েকে এইচএসসি পরীক্ষার আগে এই সব কি শুরু করলেন? মেয়েকে যোগ্য করে তুললে পাত্ররাই আপনার মেয়েকে খুঁজে বের করবে ।যদি নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন ,যেমন করেছেন শিমুর বেলায় তাহলে আমরা কেউ বিয়েতে যাবো না, আর কোন কিছুই আমাকে জানাবেন না।’

তখন থেকেই বাবা রেগে আছেন।বাবা আসলেই আমাদের নিয়ে যান নি।চাচা সনির বিয়ে দিয়ে দিলেন।ছেলের একমাত্র যোগ্যতা হলো বিদেশে থাকে।ছয় মাসের ছুটিতে এসেছে।
বিয়ের ছবিও দেখেছিলাম।সনির জামাইকে মনে হচ্ছিল ভালোই।তাহলে কি থেকে কি হলো? বাবার রাগের কারনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা আমাদের জানাননি চাচা।

আমি পরীক্ষা দিয়ে এসে দেখি বাসার পরিবেশ খুব থমথমে।সবাই লিভিং রুমে বসে মিটিং করছে নিম্ন স্বরে। কিন্তু টুসির কাছে কিছুই গোপন থাকে না,সবসময় ওকে কথা শুনতে পাত্তা না দিলেও আজ চাইছিলাম ঘটনা কি টুসি আমাকে জানাতে আসুক।আমি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতেই টুসি এসে বসলো।
—আপ্পি,সনি আপুর জামাই খুব খারাপ,আপুকে খুব মারে আর গালি দেয়।সনি আপুর পেটে যে তিন মাসের বাচ্চা ছিল তাকেও নাকি মেরে ফেলেছে।
আজকে সনি আপুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল।
তিন মাসের ভ্রুনকেই টুসি বাচ্চা বলছে।

আমি টুসির দিকে তাকিয়ে রইলাম।ওর কথাগুলো শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার চাচাতো বোন হলেও ওকে অনেক আদর করি, নিজের বোনের মত। সোনিয়াকে আদর করে সনি ডাকি।
— আরো অনেক কিছু বলল ,সবাই এত আস্তে কথা বলে সব কিছু বুঝতে পারিনি।
—আচ্ছা ঠিক আছে।আর পাকনামো করতে হবে না।আমি কোনরকম খেয়ে সনির কাছে গেলাম।

বুঝতে পারলাম সনি ঘুমায়নি,এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সনির কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম-
—কেমন আছিস এখন?
সনি দূর্বল গলায় বলল-
—ভালো।
আর কি বলবো বুঝতে পারছি না।ওর অবস্থা দেখে আমার খুব কান্না পাচ্ছে।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।সনি আবার দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

মা আর বড় চাচীর সম্পর্কটা খুব বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ না। আবার খারাপও বলা যায় না। কিন্তু এখন দুজন সারাক্ষণ কথা বলছেন। রান্না ঘরে মাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
—কি হয়েছে মা?আমাকে খুলে বল। আমি কি এখনো ছোট আছি?
বড় চাচী পেছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতে পারিনি।চাচী আমার হাত ধরে বললেন-
—কি আর হইবো,সব কিছু কপালের দোষ। আমার ফুলের মত মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হইয়া গেল।
চাচীর এই কথায় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এমনিতে আমি কারো সাথে বেয়াদবি করি না কিন্তু কেন জানিনা মুখ বন্ধ রাখতে পারলাম না-
—আপনারা নিজে ওর জীবনের এই গতি করে এখন কপালের দোষ দিচ্ছেন?
আমার গলার আওয়াজ শুনে বাবা আর চাচা ও চলে এলেন।
চাচী কাপড়ে মুখ গুজে কাঁদতে শুরু করলেন।কি এমন বলেছি?
মা আমাকে চুপ করতে বললেন।
আমি বাবাকে বললাম-
—বাবা, সনির এই অবস্থার জন্য চাচী কপালের দোষ দিচ্ছেন।বাবা তুমিই বল কার দোষ? তুমি ও তো মানা করেছিলে, এইচএসসি পরীক্ষাটা ও দিতে দিল না।কান্নায় আমার গলা ধরে গেল।টুসি বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।
বাবা আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন।আমাকে বসিয়ে বললেন –
—যা হবার তো হয়েই গেছে,এখন কি করা যায় সেই চিন্তা করছি।
চাচা বললেন-
—কলেজে যাওয়া আসার পথে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করতো। সনির যাওয়া আসা অনিরাপদ হইয়া গেছিলো।থানা পুলিশ কইরাও লাভ নাই। ছাড়া পাইয়া কয়দিন পর আবার আরো খারাপ কিছু যদি কইরা বসে বখাটেরা। নীলকান্ত মামলা করছিল ওর মেয়েরে উত্ত্যক্ত করার জন্য, কয়েকদিন পরেই ঐ বখাটেরা ছাড়া পাইতেই নীলকান্তর মেয়েটারে ছুরি মারলো ।মেয়েটারে হাড়াইলো নীলকান্ত।
ভালো ছেলে পাইলাম তাই বিয়া দিলাম।কে জানতো ঐটা একটা বদমাইশ।
—ভাইজান আমি বলেছিলাম কিন্তু এখানে পাঠিয়ে দেন সনিকে।কথার গুরুত্ব দিলেন না।বিয়ের আগে কত করে বুঝালাম, বুঝলেন না।
চাচা আর একটা কথাও বললেন না।
বাবা বললেন-
—এখন সনির শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। আপনারা তো মত দিচ্ছেন না।
এবার চাচী বললেন-
—শিমু বলতাসে থানা পুলিশ করলে ওর জামাই আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সামনে মুখ দেখাইতে পারবো না।জামাই শিমুরে বলছে,মামলা মোকদ্দমা করলে,মান সম্মান নষ্ট হইবো, শিমুও যেন বাপের বাড়ি চইলা যায়।এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের সংসার কেমনে ভাঙ্গি?

আমি এই সব কি শুনছি?চাচা-চাচী শিমু আপুর স্বামীর প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, আর এখন এই সব কি বলছেন?
এই সব বাবা-মায়েরা মেয়েদের জীবনটাকে কোথায় আঁটকে দেন?পড়ালেখা শেষ করতে না দিয়ে একটা খাঁচায় ফেলে দেন।সেই খাঁচায় বেশিরভাগ সময় থাকে হিংস্র পশুর দল। স্বামীসহ, পরিবারের লোকগুলো অসহায় মেয়েটাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে খুবলে খুবলে খায়।এভাবেই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
আবার কখনো সখনো কোন কোন মেয়ের জীবন হয়তো কিছুটা উন্নত হয় যদি স্বামীটা মানুষ হয়।

সব কিছু শুনলাম আমি।
সনির বিয়ের পর প্রথম রাতেই চিনতে পারে স্বামী রুপি পশুটাকে।একটু উনিশ বিশ হলেই চলতে লাগলো অত্যাচার আর অকথ্য ভাষার ব্যবহার।
কিছুদিন পরেই বাচ্চা পেটে চলে এলো।ওদের মতামত হলো ,স্বামী বিদেশ চলে গেলে বৌয়ের মতিগতি খারাপ হয়ে যাবে।একটা বাচ্চা থাকলে অনেকটা নিরাপদ।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে সনির স্বামী সনিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, খাটের কোনায় ধাক্কা লেগে পড়ে যায় সনি। শুরু হয় ব্লিডিং। সারারাত ব্যথায় কাতরেছে মেয়েটা ওরা কিছুই করেনি।সকালে বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।
চাচা-চাচী খবর পেয়ে ছুটে যান। অবস্থা খারাপ দেখে পরে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে যান।এর পর থেকে সনির স্বামী পক্ষের আর খোঁজ নেই।

আমি বললাম-
এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও কেন আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না,শুধু মাত্র শিমু আপুর কথা চিন্তা করে? কোথায় আছি আমরা?সবাই বলে সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, মেয়েদের অধিকার পাচ্ছে কিন্তু কত জন?এভাবেই অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়,আর মনের সুখে অপরাধ করে বেড়ায়।
আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আমরা আছি আসলে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই।

বড় চাচা মাথা নিচু করে বসে রইলেন।বাবা বললেন-
—ভাইজান ওদের আসলেই একটা শিক্ষা দেয়া উচিত।এভাবে ছাড় পেয়ে গেলে আবার অন্য কারো সাথে এমন অন্যায় করবে।আর শিমুর স্বামীর সাথে আমি কথা বলবো,ওর সমস্যা কি?

—ঠিক আছে যেটা ঠিক মনে হয় কর। এতটুকু মেয়ে মিথি মা বুঝতে পারতাছে আর আমি স্বার্থপরের মত চিন্তা করতেছি।এক মেয়ের স্বার্থের চিন্তা কইরা আরেক মেয়েরে ইনসাফ পাওয়া থাইকা বঞ্চিত করতাছি।ওর এই অবস্থার জন্য তো আসলে আমিই দায়ি। আমার ও শাস্তি পাওয়া দরকার।
এই বলে চাচা কেঁদে ফেললেন।চাচী তো আগে থেকেই কাঁদছেন।

সনির স্বামীর ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলো।

আমাদের এখানেই থাকছে সনি।বাবা প্রতিদিন রাতে আমাদের ডেকে নিয়ম করে আমাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন। ‘পড়াশোনা আমাদের শক্তি,এই শক্তি অর্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে’ এই কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন।বাবা আরো বলেন,’সবার আগে নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস থাকতে হবে,আমি পারবো আর আমাকে পারতেই হবে এই নীতিতে চলতে হবে।’

এই ট্রমা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারলো সনি।এই জন্য আমি এবং বাসার সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।পেছনে ফিরে তাকানোর আর প্রয়োজন নেই সনির।
পেছনে তাকিয়ে হরিণের মত সিংহের শিকার হতে চায় না ও। পড়াশোনা শুরু হলো পুরো দমে।সনি , আমাদের সাথে হাসির মুভি দেখে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলে এক সাথে ভিজতে ভিজতে গান গায়।আবার কখনো কখনো রিকশা দিয়ে আমি,সনি আর টুসি তিন জনে এমনিই ঘুরে বেড়াই ঢাকা শহরে।
ইচ্ছে মতো ডানা মেলে উড়ি আমরা।

চলবে।