ডানা মেলে উড়ি পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
293

#দুই_পর্বের_গল্প(২য়পর্ব)

#ডানা_মেলে_উড়ি

আত্নীয়-স্বজনের বাসা অনেকটাই এড়িয়ে যায় সোনিয়া।কেউ কেউ এমন প্রশ্ন করে, কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মত।আর একটা ফিসফিস শুরু হয়।মনে হয় সনির প্রসঙ্গ ছাড়া আলাপ করার মত দুনিয়ায় আর কোন টপিক নেই।

আমাদের এক আত্নীয়ের বিয়েতে বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেলেন।স্বভাব মতো সনি বলছে যাবে না।বাবা বলছেন সবাইকেই যেতে হবে।

সনি আমাকে বলল-
—মিথি আপু তুমি চাচ্চুকে বুঝিয়ে বল আমি যাবো না।
—বাবাকে আমি কি বুঝাবো?আমি নিজেও চাইছি তুই যাবি।আর কত দিন এড়িয়ে চলবি সবাইকে?যত ভয় পাবি তত ভয় তোকে জড়িয়ে ধরবে।সব কিছুর মোকাবেলা তোকে করতে হবে।আর আমি তো সাথে থাকবো।দেখ তোর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য কি তুই দায়ী?তোর দোষ কোথায়?তাহলে কেন তুই মুখ লুকিয়ে রাখবি?
শোন , কেউ কিছু বললে সোজা উত্তর দিয়ে দিবি।তুই না পারলে আমি তো আছিই।

মনে হলো না আমার কথা সোনিয়ার মনপূত হলো।অনেক ঘটনা ঘটেছে ,চেনা আত্মীয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনতে হয়েছে তাই ও আর চেনা- জানাদের সামনে যেতে চায় না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হলো সনি।

আমাদের সম্পর্কে ফুফু হয় ,উনার মেয়ের বিয়ে।অন্য এক আত্নীয় কুজ্ঞু আন্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন সবাইকে ফুফু।বাবা-মা অন্যদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেই উনি বললেন-
—তোমার তো বিয়ে হয় নি। মেয়েদের মাস্টার্স করার আগেই বিয়ে দিতে হয়।তা না হলে সহজে বিয়ে হতে চায় না।
—আমি হেসে হেসে বললাম –
—কি বলছেন আন্টি,এখনই কি বিয়ে করবো।পড়া কমপ্লিট করে ভালো কোন জবে ঢুকে পরে বিয়ে করবো।বাবা আমাদের সব সময় বলেন, মেয়েদের সাবলম্বী হয়ে বিয়ে করা উচিত।

আন্টি মুখে এমন ভাব ফুটিয়ে তুললেন,যেন আমি গর্হিত কোন কথা বলে ফেলেছি।উনি এবার সনির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে ফুফুকে জিজ্ঞেস করলেন –

—এটা কে?

সোনিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিতেই আন্টি বলে বসলেন-
—ও তোমার সেই ডিভোর্সি ভাতিজি না,বিয়ে হয়েছিল যে,পরে ডিভোর্স হয়ে যায়।আহারে কি লক্ষী মেয়ে।ওর কপালটা এমন হলো! তোমার স্বামী কি খুব মারতো?আহারে বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে গেল।

উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সোনিয়ার ব্যথায় উনি চোখের পাতা এক করতে পারেননি এত দিন ।উনি যদি একটু সনির দিকে ভালো করে খেয়াল করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন,উনার কথায় যে কষ্ট ঝরে পড়ছে সেটা সনির বুকে ফোস্কা ফেলে দিচ্ছে।

সোনিয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে ফেলল।আমিই উত্তর দিলাম-
—জ্বী আন্টি সে-ই এই সোনিয়া।বুঝতে পারছি ওর ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আন্টি ওর ডিভোর্স হয়েছে বলে ওর কি ডিভোর্সি পরিচয় হয়ে গেল?

আমি আরো কিছু বলতে চাইছিলাম ফুফু আমাকে ইশারা করলেন চুপ করতে।
আমার ফুফু কোন কথা বলছেন না,আন্টি মনে হয় প্রভাবশালী টাকা ওয়ালা লোকের স্ত্রী।উনাকে রাগিয়ে দিতে চান না।
যদিও আমার কথাবার্তা শুনে উনি অলরেডি রেগে গেছেন।
উনি বলতে লাগলেন-
—আজ কালকার ছেলে মেয়ে সব বেয়াদব, মুরুব্বিদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না।

বাবা এসে কি হয়েছে জানতে চাইলে,উনি বাবাকে একগাদা কথা বলে ফেললেন।

বাবা খুব শান্তভাবে বললেন-

—আপা আমার মেয়েকে আমি খুব ভালো করে চিনি।ও কখনো অযৌক্তিক কথা কাউকে বলে না,এই শিক্ষা আমি ওদের দেইনি।
—ও তাই তো বলি ,এত সাহস হয় কি করে মেয়ের,বাবাই তো উষ্কানিদাতা। তোমার এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে? সারাজীবন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে?
—কি যে বলেন আপা,বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য কি পড়াশোনা করছে?আর বিয়ে ,ওর ইচ্ছে হলে করবে।

সেই আন্টি ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলেন।

এমন কথা প্রতিনিয়ত শুনতে হয় সনিকে।শুনতে শুনতে এখন আর কষ্ট, খারাপ কিছুই আর লাগে না।

সময় সময়ের নিয়মে গড়িয়ে গেল।আমি সংসার, বাচ্চা, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

এক দিন অফিসে অরুপ নামের একটা ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে শুনে আমি মনে করতে পারলাম না কে?
গেস্ট কর্নারে গিয়ে দেখলাম লম্বা,হ্যাংলা-পাতলা, উজ্জ্বল শ্যামলা , কোঁকড়ানো চুলের একটা ছেলে। একটা মায়া আছে চেহারায়।আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।
আমি বসতে হাত দিয়ে ইশারা করে,ওকে জিজ্ঞেস করলাম-
—আমি কি আপনাকে চিনি?
—আপু আমাকে আপনি তুমি করে বলবেন।আমি সনির বন্ধু অরুপ।আসলে বন্ধু ঠিক না।আসলে..
আমি অরুপের কথা শেষ করার জন্য অপেক্ষায় রইলাম,ওর দিকে তাকিয়ে।
অরুপ চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল-
আমরা এক সাথে পড়লেও ওর বন্ধু হতে পারিনি।আসলে আমি ওর শুধুই বন্ধু হতে চাইনি।

—তুমিও কি সনির সাথে ইংল্যান্ড যাচ্ছ?
—না আপু। আমার স্কলারশিপ হয় নি। আমি চেষ্টা করছি।সনির স্কলারশিপ হয়েছে এতেই আমি খুশি।

—তুমি কি সনির পাস্ট সম্পর্কে জান?
—জ্বী আপু জানি।সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
—আসলে সমস্যা কি,তুমি কেন আমার কাছে আসলে বুঝতে পারছি না।
—সনি ওর পাস্ট নিয়ে পরে আছে।ও বলে কাউকে ভালোবাসার অধিকার তার নেই।আমাকে ও ভালোবাসে না।আমি এই কথা বিশ্বাস করি না আপু। আমি, আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি ওর চোখে।

—অফিসে আমি তোমাকে আর বেশি সময় দিতে পারবো না।সরি। তুমি চাইলে ফোনে কথা বলতে পারবো।
—ঠিক আছে আপু।আপনি যখন বলবে ফোনে কথা বলবো।

বাসায় গিয়ে সনির কাছে ফোন দিলাম।ওরা শপিং এ গেছে।আর সতের দিন বাকি ,সনি চলে যাবে,তাই মা আর টুসিকে নিয়ে বের হতে হচ্ছে এটা সেটা কিনতে।

সনির কাছে সম্পূর্ণ ব্যপারটা জানতে হবে।

শুক্রবার সকালেই মায়ের বাসায় চলে এলাম সবাই।বিকেলে সবাই সবার মতো বিছানায়।আমি সনিকে নিয়ে ছাদে গেলাম। কোন ভনিতা না করেই বললাম-
—অরুপ গত পরশু আমার অফিসে এসেছিল।
সনি কারেন্টে শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো।ওর মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হলো-
—মানে?
—মানে অরুপ এসে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল।এর পরে বেশ কয়েকবার ফোনেও কথা হয়েছে।
—আমি তো ওকে মানা করে দিয়েছি।
—তুই ওকে পছন্দ করিস না?
মাথা নিচু করে সনি বলল-
—না
বলার সময় ওর গলাটা কেঁপে উঠলো।
—মিথ্যে বলছিস কেন আমাকে?
ওর হাত দুটো ধরে বললাম-
—তোর মন যা চায় বল আমাকে ।

— অরুপ তোকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে তোকে।আমার মনে হয় তুই ও অরুপকে ভালোবাসিস।
—না না একদম না।
—আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো।
কাঁদবি না এক দম কাঁদবি না বলছি।
—ওকে ভালোবাসি আপু।সব সময় মানা করেছি,রাগ দেখিয়েছি, খুব বেশি পাত্তা দেইনি। কিন্তু এখন দেশের বাইরে এত দূরে চলে যাচ্ছি খুব খারাপ লাগছে।ওর যাওয়া হচ্ছে না সে জন্য ও খারাপ লাগছে।
—তাহলে তুই কি করতে চাস?
—কিছুই না।কাউকে ভালোবাসার অধিকার আমার নেই।
—কে বলেছে তোকে ,তোর ভালোবাসার অধিকার নেই? অধিকার আদায় করে নিতে হয়।একটা ভালো ছেলে তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে,ওকে তুই ফিরিয়ে দিস না।আমাদের সৃষ্টি কর্তা আমাদের থেকে যা নিয়ে নেন তার কয়েকগুণ ফিরিয়ে দেন।তুই কথায় কথায় একদিন বলেছিলি আমি কোথায় চাকরি করি।অরুপ সেই কথা মনে রেখে , আমার কাছে ছুটে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি অরুপ ও ইংল্যান্ড যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।ওদের পারিবারিক অবস্থা ও সব দিক দিয়ে ভালো।
—আমার সেই খানেই ভয়।ওর পরিবার জানতে পারলে কখনো আমাকে মেনে নিবে না।
—সেটা পরে দেখা যাবে।অরুপ বলেছে,আগে তোর মতামত এর পরে ওর বাবা-মাকে ও রাজি করাবে।

সনি কোন উত্তর দিল না, দুরে বহু দুরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

আসলেই ঝামেলা হলো।অরুপের বাবা-মা কিছুতেই রাজি না সনিকে ছেলের বৌ করতে। অরুপ তার মাকে আমার ফোন নাম্বার দিল আমার সঙ্গে কথা বলতে-
উনি প্রথমেই বললেন-
—আমার ছেলেটাকে তোমরা রেহাই দাও।
আমি তো অবাক।
—আপনার ছেলেকে কি বেঁধে রেখেছি?সনি তো অরুপকে এখনো কোন কথা দেয় নি।ও বলেছে আপনাদের মতামতই আসল।
—সব জেনেশুনে এমন একটা মেয়েকে ছেলের বৌ করতে পারি?
—কেমন মেয়ে?আমাকে একটু খুলে বলুন তো সনি কেমন মেয়ে?
—একটা বিবাহিত মেয়েকে, অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করলে কেমন দেখায়?
—ছেলেদের বৌ মরে যায়,তারা যে কোন বয়সের অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে পারে।একটা মেয়ে কেন পারবে না? সনির জীবনে যে দূর্ঘটনা ঘটেছিল সেটা যে কারো জীবনে ঘটতে পারে।তাই বলে তার জীবনটা ধুঁকে ধুঁকে শেষ করে দিতে হবে? পৃথিবীর সমস্ত রং,রুপ তার জন্য সাদাকালো হয়ে যাবে?
সনি, জেনেটিক্স সাইন্স নিয়ে পি এইচ ডি করে দেশে ফিরে আসুক বা না আসুক ,যেখানেই থাকুন , অবশ্যই সম্মানের সাথে থাকবে।
যেখানে ওর অতীত নিয়ে এমন ঘাঁটাঘাঁটি করা হবে সেখানে ওর না জড়ানোই ভালো।

আপনার ছেলেকে আপনি সামলান।ওকে বলবেন আর যেন আমার কিংবা সনির সাথে যোগাযোগ না করে।

ফোন রেখে বুঝলাম আমি কাঁপছি। আমার হাসব্যান্ড এসে আমাকে ধরে বসালো।পানি এনে খাওয়ালো।আস্তে আস্তে আমার রাগ কমলো কিন্তু শুরু হলো মাথা ব্যথা।
এখন আমি সনিকে কি বলবো?কোন মুখে ওকে বোঝানো কথা আমি ফিরিয়ে নিব? কেন ওর সাথে এমনটা ঘটবে?
সনি বলবে,’বলেছিলাম না আপু কাউকে ভালোবাসার অধিকার আমার নেই।’এই বলে সনির ঠোঁট দুটো হাসবে কিন্তু হৃদয়টা কাঁদবে।
বাবাকে বলেছিলাম সব কথা জানাবো।এখন কি জানাবো আমি?

অরুপের প্রসঙ্গে আর কোন কথা কেউ বললাম না।সবাই মনে হয় অজান্তেই সব বুঝে গেছে।

সনির মুখটা খুব মলিন মনে হয়।যদিও ও সবার সাথে হাসছে,কথা বলছে, শপিং করছে। তবুও আমি বুঝতে পারি।
চাচা-চাচীও এলেন সনির সাথে কিছু দিন থাকবেন বলে।

সনির ফ্লাইট আর বার ঘন্টা পরেই।সব কিছু প্যাক করা শেষ। সন্ধ্যার পরে সাতটার মতো বাজে, কলিং বেল বেজে উঠলো। অরুপের বাবা-মা,ভাইকে নিয়ে অরুপ হাজির।
অরুপের মা,মানে আন্টি সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। সনির হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন।
সবাই কথাবার্তা বলে ঠিক হলো কাজী ডাকতে হবে।

বিয়ের বর-কনে না সেজেই সনি আর অরুপের বিয়ে হয়ে গেল।তাদের বাসর ও হলো না।তবে ওরা দুজনে ছাদে সূর্যোদয় দেখলো।

বিয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সনি আর অরুপ অনেক দুরে চলে যাচ্ছে ।দোয়া করি খুব তাড়াতাড়ি ওরা কাছাকাছি হোক।

বিদায়ের আগ মুহূর্তে অরুপ , সনির হাত শক্ত করে ধরে ছিল।হয়তো সনিও ধরে ছিল।

(সমাপ্ত)

ফাহমিদা লাইজু