তরঙ্গিনী পর্ব-০১

0
485

#তরঙ্গিনী
#আরশিয়া_জান্নাত

দীর্ঘ এক বছর অবহেলা,অপমান সহ্য করেও যখন তৌকিরকে ধরে রাখা যায় নি। তখন জেদের বশেই ও যাওয়ার একমাসের মধ্যেই আমি সম্পূর্ণ অচেনা একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াই।

তৌকির আমার জীবনের প্রথম প্রেম, যাকে ভালোবেসে আমি কিশোরী থেকে তরুণী হয়েছি। এই দীর্ঘ সময়ের প্রণয় ফিঁকে হয়ে পড়তে শুরু করলো গতবছর তার সরকারী চাকরি হবার পর থেকে। আমি তার ব্যবহারে এতোটাই কুঁকড়ে গিয়েছিলাম যে একপর্যায়ে নিজেকে তার অযোগ্য মনে হতে শুরু হলো।

আসলেই তো সে এখন ভালো জব করছে,কত সুন্দরী মেয়ে তার জন্য মরিয়া। কত ভালো ভালো প্রপোজাল রেডি। সে যাকেই বলবে সেই তাকে বিয়ে করতে একপায়ে রাজি। সেখানে আমি বুড়িয়ে যাওয়া মেয়ে। যার বিয়ের বাজারে কদর পড়তে শুরু করেছে ২২ পেরুনোর পরেই। ১৮বছরের কাউকে বাদ দিয়ে ২৫বছরের কাউকে কি আর মনে ধরবে?
তবুও পরিবারে নিজের মান রাখতে বেহায়ার মতো সব সহ্য করলাম একটু যদি মন গলে! নয়তো এ ঘরে আমার মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়েছি এই মানুষটার জন্য তার হিসেব খুলেও যদি মা বসেন আমার লজ্জার অবধি থাকবেনা। কতবার বলেছিল ঐসব অপেক্ষার দাম থাকেনা, শেষ পর্যন্ত দুদিক হারাবি। এখন‌ বোধকরি মায়ের কথাগুলোই ফলেছে।
তৌকির যখন সত্যিই বিয়ে করে নিলো অতি রুপবতী কম বয়সী মেয়েকে আমি সারাটাদিন দরজা বন্ধকরে অন্ধকার ঘরে ছিলাম। চোখের কোণ ভিজেনি একটুও,নতুন‌করে আর কাঁদবো কি? আমি যা অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার এই এক বছরে ঢের দিয়েছি। চোখের পানি ফুরিয়েছে। বুকের উপর টিকিয়ে রাখার যে গুরুভার ছিল তা নেমে গেছে। আমি মুক্ত হবার আনন্দে ভাসছি যেন! ওর বিয়ের ছবির দিকে চেয়ে জেদ চেপেছিল আমিও শীঘ্রই বিয়ে করবো। ওর চেয়ে বড় পদের কাউকেই করবো। যেন দেখিয়ে বলতে পারি আমি অযোগ্য নই।

আমি ফাইজাতুন নূর রেবা। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে ছোটখাটো জব করি। মা আর বড় ২ভাইবোন নিয়ে আমার পরিবার। বড় আপা ঢাকায় থাকেন আর ভাইয়া চাকরীসূত্রে একেকবার একেক জেলায়। বাবার রেখে যাওয়া পুরনো দোতলা বাড়িটায় কেবল আমি আর মা থাকি। অবশ্য দুই ভাড়াটেও আছে নিচতলায়।
তৌকিরের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন বড় আপা প্রায়ই নানান ছেলের কথা বলতো। আমি তখন সেসব তোয়াক্কা করিনি। কিন্তু এবার কোনো ডিটেইলস না শুনে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলাম উচ্চপদস্থ কি না বল, আর কিছু জানতে চাইনা টাকাওয়ালা হলেই হবে!

আমার এহেন বাক্য শুনে আপার চোখ দুটো বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বললেন, হ্যাঁ রে রেবা তোর কি কিছু হয়েছে? হঠাৎ টাকাওয়ালা খুঁজছিস? টাকায় সব সুখ নেই তুই না বলতি সবসময়?

আমি ঈষৎ হেসে বললাম, টাকা- ক্ষমতা এসবই বেঁচে থাকার উপকরণ আপা! সুখ খুঁজে লাভ কি? তোর খোঁজে তেমন কেউ থাকলে বল, এখুনি বিয়ে করতে আমি প্রস্তুত।
আমার এইসব কথা আপার মাথায় না ঢুকলেও মা ঠিকই বুঝলেন আমি অভিমানে শক্ত হয়ে গেছি। তাই আপাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আর কি আমার বিয়ে হলো সম্পূর্ণ অচেনা একজনের সাথে। যাকে আমি চিনি না, জানি না চোখের দেখাও দেখিনি। অথচ কি মজবুত এক সম্পর্কেই না জড়িয়েছি!

বিয়ের পর যখন আমি শ্বশুর বাড়িতে পা রাখি আমার বুঝতে বাকি থাকেনা এটা রাজবাড়ীর চেয়ে কম না। ধনীর শৌখিনতায় ভরা বিশাল অট্টালিকা বলা চলে! ঘরভর্তি নামিদামি মানুষের ভিড়ে আমার দমবন্ধ লাগলেও হাসিমুখের মুখোশেই রইলাম পুরোটা সময়। বহুক্ষণ পর আমার চাচী শ্বাশুড়ি ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসে আমায় তুলে নিলেন তিনতলায়। পথিমধ্যে বলতে লাগলেন কত কথা।

“বুঝলে বৌমা বিয়েবাড়ি মানেই মানুষের হট্টোগোল। এতোকিছুর মাঝে আসল কাজ করতেই মনে থাকেনা কারো। নতুন বৌকে ঘিরে বসে গেছে আড্ডাখানা। তাকে যে একটু ফুরসত দিবে এইটুকু আক্কেল কারো নেই। তোমার শাশুড়ি আমায় তাড়া না দিলে আমিও ভুলে বসতাম। সে যাই হোক এই রুমটা তোমাদের। তুমি একটু জিরিয়ে নাও, আমি তোমার জন্য কিছু খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর শোনো কিছু লাগলে ইন্টারকমে কল দিও। বেডসাইডেই টেলিফোন আছে, কেমন?

আমি মাথা নেড়ে হু বললাম। তিনি আমার চিবুক তুলে বললেন, আমাদের আরাফের চোখ আছে বলতে হয়, একদম সোনাবৌ পছন্দ করেছে। মাশাআল্লাহ।
আমি মনে মনে আওড়ালাম আরাফ চৌধুরী।


বিলাসবহুল ঘরটা সাদা ফুলে সাজানো, মোমবাতির হলদে আলোয় অদ্ভুত মায়াময়। আমি সেসব টপকে দখিনের বিশাল বেলকনীতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে যতদূর চোখ যায় সবটা নীল সবুজ বাতিতে সাজানো। আকাশপানে চেয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে। আজ আমার বাসররাত তাই না? এই রাতটাকে ঘিরে কত স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নের কাঙ্খিত মানুষটা আজ কত দূরের কেউ। সে আমাকে ভালোবাসেনা, অন্যকারো সঙ্গে সুখেই আছে।

একটু পরেই হয়তো অচেনা মানুষটা এসে স্বামীর অধিকার ফলাবে। এই শরীরটায় স্পর্শ করবে! কিন্তু আমিতো সবসময় সেই একজনকেই চেয়েছিলাম। এই মন কি মেনে নিতে পারবে এসব? পরক্ষণেই মনে হলো সিনেম্যাটিক ভাবনায় ডুবে আছি আমি। মোহরানা আদায় করে পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে যে বিয়ে করেছে সেই তো প্রকৃত হকদার। এখন তাকে আমার মন মানুক বা না মানুক, ভালোবাসুক বা না বাসুক কিছু করার নেই।
দরজায় কড়া পড়তেই পেছন ফিরে দেখি দুজন মেয়ে এসেছে। একজন খাবার সাজিয়ে রাখছে আরেকজন বলল, ভাবী তুমি কিছু খেয়ে নাও। চাচীমা তো আমাদের উপর রেখে আগুন,আমরা দুইজন থাকতে আমাদের ভাবী কিভাবে অনাহারে এতক্ষণ বসে আছে এসব নিয়ে আচ্ছামতোন ঝেড়েছে। তুমি যদি এখনো কিছু না খাও আমাদের রক্ষে নেই।
ওপস পরিচয় দিলাম না আমি রুহি আর ও পিহু। আমরা তোমার দুইমাত্র ননদ। হিহি

তোমরা দেখতে বেশ মিষ্টি তো। যাক ভালোই হলো আমার দুজন সঙ্গী হলো!

পিহু উঠে বললো, ভাবী নাও সব সাজিয়ে দিলাম তুমি বসো।

আমি একা খাবো? তোমরাও বসোনা বোন?

তখনি দরজায় কেউ নক করলো, রুহি দরজা খুলে বলল, আমাদের বসতে হবে না, তোমার বর এসে গেছে। নে ভাইয়া তুই ভাবীর সঙ্গে বসে যা। আচ্ছা ভাবী আমরা যাই কেমন?

আমি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। গাড়িতে করে আসবার সময় লোকটাকে অস্পষ্ট দেখেছি, কিন্তু এখন বদ্ধ ঘরে আলোর ছটায় স্পষ্ট মূর্তিমান দেখে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগলো।
ভরাট কন্ঠে সে বলল, দাঁড়িয়ে গেলেন কেন বসুন। এ কি আপনি এখনো বধূসাজে? এতোসব পড়ে আছেন এতক্ষণ?চেইঞ্জ করেননি কেন?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, একটু আগেই রুমে এসেছি,

ওহ আচ্ছা এতোক্ষণ পঙ্গপালের মাঝেই আটকে ছিলেন! শুনুন আমার পরিবারে বিশাল জনসংখ্যা। এদের মাঝখানে যে পড়ে তার আর রক্ষে নেই। যাই হোক আপনি বরং আগে খেয়ে নিন তারপর চেইঞ্জ করবেন। আমার তো ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। আসলে বিয়ে অন্যেরটাই মজা ইচ্ছামতো খাওয়া যায় আনন্দ করা যায়, নিজের বিয়েতে কোনোটাই করা যায় না।
একি বসছেন না কেন? নিন শুরু করুন।

আমি গুটিশুটি হয়ে তার পাশেই বসলাম। সে আমার দিকে একপলক তাকালো। তারপর কি যেন ভাবলো। খাবার শেষ করেই সে কাবার্ড থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে দিয়ে বলল, শাড়ি পড়তে আপত্তি আছে?

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। সে মুচকি হেসে বলল, বেশ তবে!

আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গা ভর্তি গয়না খুলে রাখলাম, সে একমনে আমার দিকে চেয়ে রইলো কিন্তু সাহায্য করলো না। আমি কিছুটা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলাম না। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে ভালোমতো মেকাপ তুলে শাওয়ার নিলাম। কি যে শান্তি লাগছিল তখন। যেন সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই হাওয়া।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখি আরাফ রুমে নেই। গয়না সব বক্সে গুছিয়ে রাখছিলাম আর ভাবছিলাম আজকের দিনটার কথা। তিনটা শব্দের কত জোর তাই না? মুখে উচ্চারণ করতেই সব বদলে যায়। গতকাল রাতেও যে ঘরটায় ছিলাম আজ থেকে সে ঘরের অতিথি হব। এই নতুন পরিবারটাই আজ থেকে আমার পরিবার হবে। আমি কি পারব এতোগুলো নতুন মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে? কিংবা আরাফের সাথে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর আচারণ করতে? যেভাবে তৌকিরকে ভালোবেসেছিলাম তেমন করে আর কাউকে ভালোবাসা কি আদৌ আমার পক্ষে সম্ভব? জেদের বশে আগপিছ না ভেবে বিয়ে তো করেছি কিন্তু এই সম্পর্ক বয়ে চলব কিভাবে? বুকের ভেতরটা অজানা শঙ্কায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তখনই দরজায় নক করে আরাফ ঢুকলো,হাসিমুখে বলল, এখন আপনাকে দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল।

শেরোয়ানীর বোতাম খুলতে খুলতে হঠাৎ বলল, রেবা আপনার কি এই বিয়েতে অমত ছিল? পূর্বে কাউকে ভালোবাসতেন? এমন নয়তো পুরনো একজনকে ভুলতে নতুন কাউকে খুঁজে নিলেন?

আমি হতবিহ্বলের মতো চেয়ে রইলাম আরাফের দিকে। আরাফ ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমার মনে হলো সে বুঝি আমার অতীত জেনে গেছে। এখনই আমায় ছুড়ে ফেলে দিবে? বিয়ের রাতেই আমি ডিভোর্স পাবো? আবার যদি না বলি হামলে পড়বে আমার উপর? আমার এখন কি বলা উচিত? আমি কি চুপ থাকবো নাকি উত্তর দিব? সত্যিটা বলাটা কি সমিচীন হবে? এমন জেদ শুনে উনি যদি আমাকে স্বার্থপর ভাবেন? কিংবা তৌকিরের মতোই আজেবাজে গালি দেন?
আমি এসির নিচেও তরতর করে ঘামতে লাগলাম আর পেছোতে লাগলাম তার প্রতিটি কদমে একটু একটু করে,,,

চলবে,,,