তরঙ্গিনী পর্ব-০২

0
358

#তরঙ্গিনী (পর্ব-২)

#আরশিয়া_জান্নাত

আরাফ একটু একটু করে আমার অনেকটা সামনে এসে গেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে থেমে গেছি পেছনে থাকা টুলের কারণে, আরাফ আমার একদম পাশ ঘেষে ড্রেসিং টেবিলের উপর ঘড়ি আর ব্রোঞ্জ রাখলো। তার ব্যবহৃত পারফিউমের ঘ্রাণ তীব্রভাবে টের পাচ্ছিলাম এতোটাই সন্নিকটে ছিল সে। আমি রুদ্রশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছি দেখে সে হাসলো। হঠাৎ আমার আধভেজা চুল ঝাকিয়ে বলল, কি ব্যপার জবাব দিলেন‌ না যে?
আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম, ছোট ছোট চোখ দুটোয় মুগ্ধতা বিরাজমান, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। উচ্চতায় আমি তার বুক সমান হওয়ায় হালকা ঝুঁকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছে, আমি অস্বস্তিতে সরে যেতে চাইতেই ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম অমনি সে শক্তহাতে আমায় টেনে বুকে নিলো। তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে সে আমি স্পষ্ট শুনছি। সে আমায় জড়িয়ে রেখেই বলল, এত অসাবধানতা? পড়ে হাড়গোড় ভাঙবার ফন্দি আছে নাকি হু?

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে সরে বললাম, এইটুকুতে কারো হাড়গোড় ভাঙে না!

সেটা কি অনুমান করা যায়? অনেকসময় অল্প আঘাতেও মানুষ রক্তাক্ত হয়ে যায়। এই যেমন সূচ ফুটলে! তাই কোনোকিছুকেই ক্ষুদ্র ভাবার অবকাশ নেই। ওপস কথার ছলে ভুলেই গেছি, আপনার জন্য গিফট রেখেছি, দেখেছেন?

আমি মাথা নাড়তেই সে উত্তর কোণটায় ইশারা করে বলল, ঐ যে দেখুন।

আমি দেখলাম একটা বই ভর্তি বুকশেল্ফ। কাচের ভেতর উঁকিঝুকি দিচ্ছে শরৎচন্দ্র, বিভূতি আর হুমায়ুন আহমেদের অনেকগুলো বই। সামনেই ইজিচেয়ার আর ছোট্ট টি-টেবিল, চারদিকে ছোট বড় কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট।

আমি ঐদিকটা দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো বই পড়তে ভালোবাসেন, কিন্তু তিনি আমার ভুল ভাঙিয়ে বললেন, এই কোণটা আপনার জন্যই নতুন করে সাজানো হয়েছে।
শুনেছি আপনি বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন, তাই ভাবলাম এরচেয়ে ভালো গিফট আর কিছুই হতে পারেনা আপনার জন্য! পছন্দ হলো?

আমি স্পাইডার প্ল্যান্ট হাতে নিয়ে বললাম, অসম্ভব সুন্দর পরিকল্পনা। আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

রেবা?

জ্বি

আপনার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে নিঃসংকোচে জানাবেন কেমন? আমার পরিবারের মানুষগুলো মন্দ নয়,শুধু সংখ্যায় একটু বেশি। আমার বাবারা চার ভাই, দুই বোন। ফুপিরা আশেপাশেই থাকেন, তাই বলতে গেলে বেশিরভাগ সময় তারা এখানেই কাটায়। আর এই বাড়িটায় আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি। আত্মীয় স্বজন সব একদম কাছের সবাই। এই হৈ হুল্লোড় কোলাহল মেনে নিতে পারলে এখানে আপনার অন্য কোনো অসুবিধা হবে না আশা করি। আমি জানি আপনি একক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন, তাই এমন পরিবেশে শুরুতে এডজাস্ট করতে কষ্ট হবে। তবে চিন্তা করবেন না, আমার মা চাচীরা আপনাকে ঠিকই আপন করে নিবে। উনাদের মতো মানুষ হয় না। নিজের বলে বলছি না উনারা সত্যিই এমন। বাকি ইনফরমেশন আমি কাল দেবো। আপনি শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।

আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

হু লনে একটু হেঁটে আসবো। শরীরটা ভারভার লাগছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন কেমন? আমি দরজা লক করেই যাচ্ছি, আপনার জেগে থাকতে হবেনা।

সে চাবি নিয়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল। আমি বেডে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আরাফের কথা। লোকটা সুদর্শনই বলা চলে, লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। কথা শুনে মনেই হয়নি এতো ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে। আমি তার সম্পর্কে কিছু না জানলেও সে ঠিকই আমার পছন্দ জেনে নিয়েছে। আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তবেই এমন ঘটছে? হাতে চিমটি কাটতেই বুঝলাম, না এটা সত্যিই। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। তবে যখন ঘুম ভাঙলো নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজনের নিবিড় আলিঙ্গনে,,,


আরাফ লনে এসে বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো। রেবাকে সে বিয়ে করেছে নিজের পছন্দেই। বিয়ের জন্য বহুদিন যাবত মেয়ে দেখা হচ্ছিল, আরাফ সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয় নি কখনোই। কিন্তু যখন রেবার ছবিটা সে দেখে বুকের ভিতর অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করে। তার মনের ক্যানভাসে না চাইতেই আঁকিবুকি শুরু হয় রেবাকে ভবিষ্যত ঘরণী হিসেবে ভেবে। সে ঠিক করে ফেলেছিল এই মেয়েকে সে অনেক ভালোবাসবে, অনেক ভালো রাখবে। কিন্তু রেবা শুরু থেকেই অন্যমনষ্ক। পরিবারের অনুপস্থিতিতে ঠিক করে দুটো কথা বলারো সুযোগ পায়নি আরাফ। কেমন যেন সংকোচে থাকে, অস্বস্তিতে ভুগে। আরাফ মনকে বোঝায় বিয়ের সময় এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক না। নতুন মানুষদের মাঝে এসে হুট করে মিশে যায় নাকি কেউ? তবুও খচখচানি একটু থেকেই যায়।
সে যখন ফেরে রাত প্রায় ২টা বাজে। খুব সাবধানতার সাথে লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে যেন রেবার ঘুম না ভাঙে। দরজা বন্ধ করে ডিম লাইট অন করতেই চোখ যায় বিছানায়। রেবা ততক্ষণে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে। তার গোলাপী মুখখানি ঘুমের রেশে ভীষণ আদুরে হয়ে উঠেছে। হালকা কোঁকড়ানো দীঘল চুল একপাশে ছড়িয়ে মহারাণী কি গভীর ঘুমেই না আচ্ছন্ন!
আরাফ তার সম্মুখে শুয়ে এক হাতে ভর দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে চাইলো।
রেবার চিবুকে অল্পখানি খাঁজ আছে, তাতে থাকা কালো তিলটা তার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাপড়ির ন্যায় কোমল চিকন ঠোঁট, বড় বড় চোখে ঘন পাপড়ি, বা’গালে বসন্তের দাগ, সবকিছুই যেন আরাফকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করলো। আরাফ ডানহাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে রেবার গাল স্পর্শ করলো। এইটুকুতে তার মন ভরলোনা একটুও, সে সাবধানে রেবার গালে চুমু খেয়ে আলতো করে বুকে জড়িয়ে বলল, আমি যে এতো ধৈর্যশীল হবো আগে জানতাম না বিশ্বাস করুন। আপনার মতো অপ্সরিকে পাশে পেয়েও অনাদরে রাখা এই মুহূর্তে কঠিন তপস্যার চেয়ে কম না। কিন্তু আমি কেবল অধিকারের জোরে আপনাকে চাই না। আপনাকে জয় করতে চাই, আপনার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে চাই, তার আগ পর্যন্ত বুকে পাথর বেঁধে রাখবো। ঘুমন্ত অবস্থায় যেটুকু ছুয়েছি জানি এ অজানাই থাকবে, তবুও ক্ষমা চাইছি আমার বুকের ধূ ধূ মরুপ্রান্তরে জলছাপ হয়ে আসা তরঙ্গিনীর কাছে। আমার লাজুকলতা বৌ!
🌸🌸🌸
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম কি করবো। আরাফ সাহেব বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন, ওদিকে বাইরের কোনো ঘরই আমি চিনিনা, বের হয়ে কোথায় যাবো সেটাও বুঝতে পারছিনা। তাই খানিকক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম বের হয়ে দেখি কেউ না কেউ ঠিক দেখিয়ে দিবে। দরজা খুলে বের হতেই দেখি রুহি আর পিহু এদিকেই ঘোরাঘুরি করছিল। আমাকে দেখেই উচ্ছাসিত গলায় বললো, ভাবী তুমি উঠেছ তাহলে, আমরা সেই কখন থেকে ছটফট করছি তোমায় নিতে, কিন্তু মায়ের কড়া বারণ যতক্ষণ না তোমরা বের হচ্ছ আমরা কেউ যেন ডিস্টার্ব না করি। তাই এখানেই ঘুরঘুর করছিলাম। ভাইয়া উঠেনি?

না উনি ঘুমাচ্ছেন,আমি কি ডেকে দিবো?

না থাক ভাইয়া নিজেই উঠে যাবে। চলো মায়ের কাছে। বলেই দুজন আমায় ধরে গল্প করতে করতে নীচে নিয়ে গেল।

আমি কিচেনের সামনে যেতেই দেখলাম আমার শাশুড়ি মা আর চাচীরা সবাই মহাব্যস্ত হয়ে নাস্তা বানাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখবো আমি আসলেই ভাবিনি। আমার ধারণা ছিল বড়লোক বাড়ীতে কাজের লোকরাই সব করে। কিন্তু উনারা চার জা পাকা রাধুনী দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কি সুন্দর হেসে খেলে সব তৈরী করছে। আমাকে দেখে ছোট চাচী বললেন, তোরা গিয়ে তবে তুলেই আনলি ওকে? একটুখানি সবুর করা গেলনা? গতকাল এতো দখল গেল একটু বেলা করে ঘুমিয়ে উঠতে দিলি না?
পিহু মুখ ভার করে বলল, আমরা ডাকিনি ছোটমা সত্যি! ভাবী নিজেই উঠেছেন। কি ভাবী বল না?

ছোট চাচী মায়ের হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে বলল, বড় ভাবী দেখি ছাড় তো এবার, যাও নিজের বৌমাকে নিয়ে একটু বসো। বুঝলে বৌমা তোমার শাশুড়ি সারাদিন সংসার সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন, এই রান্নাঘর হলো তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, নিজের ছেলের বৌয়ের জন্য এখানে বসেই তদারকি করছেন কিন্তু নিজে বেরোবার ফুরসত পাচ্ছেন না। এমনি আমাদের বড় ভাবী, এবার তুমি এসেছ তোমার শাশুড়ি একটু দূরে নাও। আমরা এতজন থাকতেও তাকে দু দন্ড বিশ্রামে পাঠাতে পারিনা। তুমিই সেই কাজ কর!

আমি মৃদুকন্ঠে বললাম, মা কাজ কি বেশি? আমি সাহায্য করি আপনি একটু রেস্ট নিন?

মেঝ চাচী হেসে বলল, ও তোমাদের ভাবতে হবেনা তুমি বরং বড়ভাবীকে নিয়ে একটু গল্প করো। আমরা হাতে হাতে সব করে নিচ্ছি।

শাশুড়িমা আমার হাত ধরে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। বাবাকে সেখানে দেখে সালাম দিতেই তিনি বললেন,এসো বৌমা এসো। সব ঠিকঠাক তো?
জ্বি বাবা আপনি ভালো আছেন তো?

হ্যাঁ মা বেশ আছি। তা তোমরা বৌ শ্বাশুড়ি গল্প করতে এলে বুঝি?, বেশ‌ তবে বসো আমি যাই।

মা আমার দিকে ফিরে বললেন, শোন মা তোকে তো আগেই বলেছি আমার ভরা সংসার। মেহমান অতিথি ঘুরেফিরে সব আপনজনেরাই‌। তোর কোনো অসুবিধা হলে মাকে বলিস কেমন? আর শোন বেশি মানুষ দেখে ভয় পাস নে। এটা আজ থেকে তোরো পরিবার। আমার প্রজন্মের বড় বৌ আমি ছিলাম, আমার শাশুড়ি আমার হাতেই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন যেন সবাইকে একডোরে বেঁধে রাখি। তোর প্রজন্মে তুই বড় বৌ। পরবর্তীতে যারা এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবে তাদের একসঙ্গে রাখার দায়িত্ব তোর হবে,,
এবার চল নাস্তা করবি, এখানে কিছু নিয়মকানুন আছে সব তোকে তোর ছোট চাচী শিখিয়ে দিবে, আমরা সবাই একসঙ্গেই খেতে বসি। তাই এখনো নাস্তা বাড়া হয় নি। তোর এতক্ষণে খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

না মা সমস্যা নেই আমি সকালের নাস্তা এমনিতেও দেরিতে করি।

বড়মা নাস্তা খেতে চলো সবাই এসে গেছে,

চল যাই,

আমি মায়ের পিছু পিছু ডাইনিং এ এসে দেখি এক ঝাঁক মানুষ খেতে বসেছে। ২৫/৩০ জন তো নিম্নে! রুহি বললো, ভাবী আরাফ ভাইয়ের পাশে বসো।
আমি দেখলাম তার পাশের চেয়ারটা বাদে সব চেয়ারেই মানুষ। আরাফের পাশে বসতেই সে বলল, ভয় পেলেন‌ নাকি?

আমি মাথা নিচু করে না বললাম। কিন্তু মনে মনে ঠিকই ভয় পাচ্ছিলাম, আমার মতো অন্তর্মূখী মানুষ এতোজনের ভীড়ে টিকে থাকতে পারবে তো?

চলবে,,,