তরঙ্গিনী পর্ব-০৭

0
290

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৭)

#আরশিয়া_জান্নাত

আজকাল আরাফ তার সবকিছুই তৈরী পায়, ঘুম থেকে উঠেই দেখে বেডসাইডে গ্রিন টি, অফিসের জন্য আইরন করা ফরমাল ড্রেস, ওয়ালেট, ওয়াচ সব কিছুই একদম হাতের কাছেই রেডি থাকে। আরাফ ব্যাপারটা বেশ ইনজয় করে। তাই যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট চিরকুটে ধন্যবাদ লিখে ফুলদানী থেকে তাজা ফুল নিয়ে রেখে যায়।
দুপুরে সে যত ব্যস্তই থাকুক না কেন রেবাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে লাঞ্চ করেছে কি না, কিছু লাগবে কি না। যদিও আরাফ জানে বাসায় কোনোকিছুরই অভাব নেই, বা কিছু না থাকলেও আনার মতো লোক আছে। তবুও সে এসব ছোটখাটো প্রশ্নের বাহানায় রেবার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যায়।
অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা প্রচন্ড বিরক্ত লাগে তার। ঢাকা শহরের বিখ্যাত জ্যাম এড়ানোর উপায় নেই। আজকাল তার এই সময়টা কাটে রেবাকে ভেবে। মনের মাঝে প্রশান্তি ছেয়ে যায়, একটু পরেই রেবার হাসিমুখ দেখবে ভাবতেই অসহনীয় যানজটের যন্ত্রণা ভ্যানিশড হয়। আরাফ তীব্রভাবে টের পায় রেবার জন্য তার বুকে বিন্দু বিন্দু করে জমতে থাকা ভালোবাসা সাগরে পরিণত হচ্ছে। রেবা নিঃশব্দে তার মনে যে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছে তার খবর হয়তো সে নিজেও জানে না। রেবাকে সে প্রথম দেখেছিল একটা প্রেজেন্টেশনে। বিয়ের আগে রেবা যে অফিসে জব করতো সেখানেই একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে আরাফের অফিস থেকে টিম যায়। আরাফ ভার্চুয়ালী সবটাই দেখে, রেবার স্পষ্ট বচনভঙ্গী, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর কনফিডেন্টলি দেওয়া। এসব সাধারণ বিষয়গুলিই বেশ আকৃষ্ট করে। আরাফ সরাসরিই রেবাকে দেখার জন্য সিলেট আসে, কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে তার গতিবিধি। এমন ভদ্র মার্জিত মেয়ে কারই না পছন্দ হয়? এদিকে বিয়ের জন্য তার বাবা-মা বেশ কয়েকমাস ধরেই পাত্রী দেখছিলেন, তাদের কাছে সে অকপটেই রেবার কথা বলে। তারপর সবটা পারিবারিকভাবেই সম্পন্ন হয়। রেবার কাছে বিয়েটা হুট করে হওয়া ঘটনা হলেও আরাফের জন্য এটা মোটেও হঠাৎ ঘটা কিছু নয়। তাছাড়া রেবার অতীত সম্পর্কেও তার একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। তাই তো শুরু থেকেই সে রেবাকে অসম্ভব ভালোবেসেছে, তাকে সময় দিচ্ছে নিজেকে সামলিয়ে নেয়ার। আরাফ জানে রেবা মানুষকে অনেক ভালোবাসতে পারে, ওর মনে প্রিয়জনের জন্য কঠিন মায়া জমে থাকে। আরাফ শুধু অপেক্ষা করছে তার তরঙ্গিনীর মনে নিজের একটা শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে। অতীতের দেওয়া ক্ষতে প্রলেপ হয়ে সেখানে সর্বত্র সেই আসীন হবে। রেবার পুরোটা জুড়ে কেবল আরাফ থাকবে। যেমন করে আরাফের সবটা জুড়ে কেবলই রেবা আছে,,,, এটা সময়সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয় এমনটাই বিশ্বাস করে সে। তাইতো প্রতিনিয়ত নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করে না। রেবাও জানুক তাকে ভালোবাসার জন্য রক্তের সম্পর্কের বাইরেও একজন আছে, যে তার ইহকাল ও পরকালের সঙ্গী হয়ে দীর্ঘপথ পারি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
ভাইয়া ফুল‌ নিবেন? একদম তাজা ফুল,

ছোট্ট একটা মেয়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে আরাফের। কাচ নামিয়ে বলে, কি ফুল আছে?

বকুল ফুলের,,

আচ্ছা দু ছড়া দাও তো।

মেয়েটা দু ছড়া দিতেই আরাফ হেসে তাকে ২০০৳ নোট দিলো। মেয়েটা বলল, ভাংতি নাই ভাইয়া। একটু দাঁড়ান আমি ভাঙ্গাই আনি।

নাহ নাহ ভাংতি লাগবে না। কিছু কিনে খেও কেমন?

মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া।

আরাফ মৃদু হাসলো।

বাড়ির ভেতর গাড়ি ঢুকতে দেখে রেবা আর তার বাবা লনে বসে দাবা খেলছে। আরাফ সেদিকে আর গেল না, ব্যাগটা রুমে পাঠিয়ে সে ড্রইং রুমেই বসলো। রুহি তাকে দেখে বলল, ভাইয়া জানিস ভাবি তো মাস্টারমাইন্ড, এই নিয়ে ৫রাউন্ড হলো, বাবা একটায়ও জিততে পারেননি বলে খেলা ছেড়ে উঠছেন না। সে না জিতে দম নিবে না। দেখে আয় একবার কেমন গাল ফুলিয়ে বসে আছে হিহিহি।।

এতো হিহি করিস না পেত্নি। বাবা প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছে তো তাই পারছেনা‌। কয়েক দিন প্র্যাকটিস করলে দেখিস তাকে হারানোর জো থাকবেনা।

ভাবীকে গিয়ে বলি তুই এসেছিস? বেচারিও বোধহয় টায়ার্ড হয়ে গেছে কিন্তু মুখলজ্জায় উঠতে পারছেনা। তোর বাহানায় তুলে আনি?

আরাফ টাইয়ের নাট ঢিলে করে সিড়ি দিয়ে যেতে যেতে বলল, বলিস আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, সে যেন আদা চা নিয়ে আসে।

রুহি দৌড়ে রেবার কাছে গেল।


রুহির কথামতো আদা চা নিয়ে এসে দেখি আরাফ মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আজ বোধহয় অনেক প্রেশার গেছে, কাপড়টাও ছাড়েনি এখনো।

আপনার জন্য চা এনেছি।

আরাফ আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো, আমি ড্রয়ার থেকে ভিক্স নিয়ে বললাম আপনার নাকি মাথা ধরেছে মালিশ করে দেই?

আরাফ চা শেষ করে বললো, সমস্যা নেই আমি নিজেই করতে পারবো। চায়ের জন্য ধন্যবাদ।

আমি ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললাম, সবসময় ফরমালিটিস না দেখালেও চলবে। দেখি আমি মালিশ করে দিচ্ছি, দুই মিনিটেই মাথা ব্যথা পালাবে দেখবেন।
আরাফ সুযোগবুঝে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আমি প্রথমে চমকে গেলেও কিছু বললাম না, যত্ন করে তার কপালের চুল সরিয়ে মালিশ করতে লাগলাম। আরাফ চোখ বন্ধ করে বললো, আপনার হাতে ম্যাজিক আছে ম্যাম! আমার ভীষণ আরাম লাগছে, আগে জানলে রোজ আপনাকে দিয়েই মালিশ করাতাম।

তাই বুঝি?

ঠিক তাই। রেবা আপনার প্রিয় ফুল কোনটা?

আমার সব ফুলই প্রিয়।

স্পেসিফিক নেই?

নাহ।

আচ্ছা। আপনার জন্য ফুলের মালা এনেছি, খোপায় দিবেন?

আপনি চাইলে দিবো।

না চাইলে দিবেন না?

আমি তার কথার উত্তর দিলাম না, ফুলের মালাটা দু ভাজ করে খোপায় জড়িয়ে নিলাম।
বকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ আরাফ আমার পেছনে এসে নিবিড় হয়ে দাঁড়ালো, আমার চুলে গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, অনেক মিষ্টি ঘ্রাণ তো! আমি আগে জানতাম না খোপায় জড়ালে বকুল ফুলের সুঘ্রাণ বৃদ্ধি পায়।

তার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার কাঁধে-ঘাড়ে পড়ছে, আমার হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে যেন। আমি চুলের ক্লিপ নেওয়ার ছলে সরে গেলাম, মালায় ক্লিপ সেট করে বললাম, শ্যাম্পু করেছি তো তাই দুটো ঘ্রাণ মিলে এমন লাগছে। আপনার মাথা ব্যথা সেরেছে নিশ্চয়ই? আমি তাহলে যাই?

আরাফ ফাইল হাতে নিয়ে বলল, যান। সারাদিন তো ঘরেই বসেছিলাম, বৌকে রুম থেকে বের হতে দেই নি। এখন যেতে না দিলে হবে? যান বৌমা গিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীর সেবাযত্ন করুন।

আমি তার খোঁচা হজম করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আমার দিকে ফিরে বলল, যাচ্ছেন না কেন? আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারলেই তো আপনি বাঁচেন তাই না? ঠিক আছে আমি কাল থেকে আরো লেটে আসবো, তখন আপনাকে আর কষ্ট করে রুমের বাইরে থাকতে হবে না।

আপনি হঠাৎ রেগে যাচ্ছেন কেন? আমিতো তা বলিনি।

সব কথা মুখে বলতে হয় না রেবা, কর্মকান্ডে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব ছোট লাগে জানেন? মনে হয় আমি নর্দমার কীট যাকে দেখলেও আপনার গা ঘিনঘিন করে উঠে,,,

আল্লাহ কা ওয়াস্তে আপনি থামুন প্লিজ। আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। ব্যাপারটা এমন নয়।

আরাফ কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ফ্লোরে বসেই কাঁদতে লাগলাম। আরাফ আমায় ভুল বুঝছে, ওনি ভাবছে উনার সংস্পর্শ আমি ঘৃণা করি। অবশ্য আমার রিয়েকশনে যে কেউই হয়তো তেমন ভাববে। আমিই বা কি করবো, আমি পারিনা এমন বুক কাঁপানো অনুভূতি নিতে। আমার কি দোষ?

এরপর আরাফ আর এ ঘরে আসেনি। ডিনারে চুপচাপ খেয়ে স্টাডি রুমে ঢুকেছে। আমি দু’বার দরজায় গিয়ে ফিরে এসেছি কিন্তু ভেতরে ঢুকার সাহস হয় নি, অশান্তিতে এ পাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি।

আরাফ স্টাডি রুমে বসেই ভাবতে থাকে তার অভিমান করাটা যৌক্তিক কি না। রেবা কি এখনো বোঝেনা তাকে যদি কাছে পাওয়ার মতলব থাকতো তবে বহু আগেই তো পাওয়া যেত। আরাফ তার সংস্পর্শে থাকে, তার মোহে আচ্ছন্ন থাকে। তাকে অনুভব করতে চায়। এইটুকুতেই তো মনকে শান্ত করে রাখে। রেবা যখন মালাটা দু হাতে জড়াচ্ছিল, তার আচল সরে কোমল পেটটা দেখা গেলেও আরাফ তো সেদিকে তাকিয়ে থাকে নি। নিজের বৌকে আলতো ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্খা মাটি চাপা দেওয়া একটা পুরুষের জন্য কত বড় ত্যাগ সেটা কি রেবা কোনোদিন বুঝবে? রেবার নির্লিপ্ততা কিংবা বিভিন্ন বাহানায় সরে যাওয়াটা আরাফের মনে কত আঘাত করে, বুকটা চিড়ে দেখাতে পারলে হয়তো সে বুঝতো।
রেবা আপনিও হয়তো একদিন টের পাবেন, শরীরের চাহিদাকে উপেক্ষা করে আপনার মনে ফের ভালোবাসার ফুল ফোটাতে আমি কি কঠিন তপস্যা করছি! তখন আমি এক মুহূর্তের জন্যও আপনাকে সঙ্গছাড়া করবো না দেখে নিবেন,,,,,

বহুক্ষণ মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে শেষরাতে রুমে ফিরে। রেবার দিকে ফিরে শুতেই ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে যায় তার। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! ঘুমের মাঝেও কেমন কেঁপে উঠছে যেন!
আরাফ তার দুহাতে আজলা করে রেবার মুখ তুলল, ভেজা গাল মুছে কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমার ভুল হয়েছে রেবা, আমি অযথাই আপনার সঙ্গে খারাপ আচারণ করেছি। আমার আরো ধৈর্যশীল হওয়া উচিত ছিল। আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন কিছু করবো না যাতে আপনার চোখে পানি আসে। তারপর বুকের মাঝে নিয়ে নিজেই কাঁদতে লাগলো।

আমি ঘুমের মাঝেই টের পেলাম কেউ একজন আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, তার চোখের উষ্ণ পানিতে আমার কপাল ভিজে যাচ্ছে। আমি চোখ মেলতেই বুঝলাম এটা আরাফ। মনের মাঝে পরম নির্ভরতা অনুভব করে আমি ঘুমের ভান ধরেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

সেই রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই মানুষটাকে আমি অনেক ভালোবাসবো। অনেক অনেক ভালোবাসবো, মনের সবটুকু দিয়েই ভালোবাসবো। তাকে ভালো না বাসলে অন্যায় হবে, চরম অন্যায়!

চলবে,,,