তরঙ্গিনী পর্ব-০৮

0
304

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৮)

#আরশিয়া_জান্নাত

সকালে ঘুম থেকে জাগার পর আরাফ চারদিকে তাকালো, নাহ আজকেও রেবা তার আগে উঠে গেছে। খানিকটা মন খারাপ নিয়েই শুয়ে রইলো সে, এমন সময় রেবা তার জন্য গ্রীন টি নিয়ে আসে।

আস্সালামু আলাইকুম, সুপ্রভাত।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম।

আপনার চা,

ধন্যবাদ।

রেবাকে বেডে বসতে দেখে খানিকটা অবাকই হলো আরাফ, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কিছু বলবেন?

রেবা খানিকটা জড়সড় হয়ে বলল, গতকালকের জন্য সরি। আমি আসলে,,

রেবাকে থামিয়ে আরাফ বলল, ঐ টপিক ভুলে যান রেবা। আমি সেজন্য ভীষণ লজ্জিত পারলে আমায় ক্ষমা করুন।

আপনার দোষ ছিল না এখানে, আপনার রাগ করা জায়েজ ছিল। আমি আপনার স্ত্রী, আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার উপর। প্রতিটা মানুষেরই জীবনসঙ্গীকে নিয়ে কিছু এক্সপেক্টেশন থাকে, আপনারো আছে স্বাভাবিক। আমি সেসব ঠিকঠাক ফুলফিল করতে পারছিনা। স্ত্রী হিসেবে আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে না পারা আমার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আপনি আমাকে একটু সময় দিন আমি বেস্ট ওয়াইফ হয়ে দেখাবো,,

রেবা! আমি জানি না আপনি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কেমন দৃষ্টিতে দেখেন, কিংবা এর মর্মার্থ কি জানেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি শুধুমাত্র দায়িত্ব কর্তব্যের দোহাই দিয়ে এটা টিকে থাকেনা, না এর ভীত মজবুত হয়। এখানে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, আস্থা, থাকতে হয়। ধীরে ধীরে অভ্যাসে মায়া জন্মায়। এটাতো কয়েক দিনের ব্যাপার না, আল্লাহ যদি চান আমরা মৃত্যুর পরও একসঙ্গে থাকবো। বুঝতে পারছেন কতটা দৃঢ় হতে হবে এই সম্পর্ক?
আপনার ডেডিকেশন আমি বিগত আট মাসে দেখেছি, আপনি একজন দায়িত্ববান মানুষ এতে সন্দেহ নেই। আমার পরিবারের প্রতি আপনার অনুরাগ আমি দেখেছি। আর রইলো আমার প্রতি ভালোবাসা, সমস্যা নেই ধীরে ধীরে সব হবে, আমি আপনার জন্য ততদিন অপেক্ষা করবো।

আপনি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, আপনার প্রয়োজনীয়তা আছে। আপনি চাইলেই আমায়,,

প্লিজ রেবা না, আমায় এভাবে জাজ করবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে প্রয়োজনে চাই না। আমি আপনাকে এমনভাবে চাইনা যাতে আপনার মন থেকে সম্মতি নেই। যেদিন আপনি মন থেকে আমায় ভালোবাসতে পারবেন কেবল সেদিনই সব হবে।

যদি এতে অনেক সময় লাগে? এক জীবন কেটে যায়?

আরাফ ম্লান হাসলো, “অপেক্ষা শুদ্ধতম ভালোবাসার লক্ষণ” তাই না? তাছাড়া আমি জানি আমার বৌয়ের মনে অসম্ভব দয়ামায়া। তার মনে আমার জন্য ভালোবাসা জন্মাবেই, জানেন তো বিয়ের সম্পর্কে আল্লাহর বিশেষ রহমত থাকে। এখানে ভালোবাসা হয়েই যায়,,

কিন্তু অনেকে যে ভালো না বেসেও বছরের পর বছর সংসার করে যায়, তাদের মাঝে কি রহমত নেই?

কে বলেছে ভালোবাসা নেই? একটা বিড়ালছানাকে ক’টা মাস পালন করলেই মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা জন্মে যায়। আর জলজ্যন্ত মানুষের প্রতি জন্মায় না এ বিশ্বাসযোগ্য বলুন? তবে হ্যাঁ মনমতো মানুষ না পেলে অভিযোগ থাকে, একটা শূন্যতা থাকে। তবে ভালোবাসা থাকেনা এ কথা মুখে বললেও প্রকৃত অর্থে এটা ভিত্তিহীন। তবে মনে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা থাকলে ভিন্ন,,

রেবা চমকে গেল আরাফের কথায়। আরাফ উঠে বলল, রেবা একটা মতামত নেওয়ার ছিল।

জ্বি বলুন?

একটা প্রজেক্টের জন্য আমাকে ৬মাস ঢাকার বাইরে থাকতে হবে। বাবা-মা চাচ্ছেন আপনাকে সঙ্গে নিতে। আপনার মতামত কি? আপনি ওখানে আমার সঙ্গে একা থাকতে পারবেন নাকি এখানেই থাকবেন?

আপনার সঙ্গে যাবো,,

আরাফ হাসলো, দুষ্টমি করে বলল, ভয় লাগবে না? ওখানে তো সবাই থাকবেনা, আমি যদি কিছু করে বসি??

রেবা কাবার্ড থেকে আরাফের শার্ট বের করতে করতে বলল, আমায় ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, আপনাকে আমি একা ছাড়ছি না।


ছোট চাচী অনেকটা আফসোসের সঙ্গেই বলল, বুঝি না বাপু এই ছেলেটার ব্যস্ততা কবে কমবে। ওরা হানিমুনে কোথাও যাচ্ছে না কেন?

সেজো চাচী বলল, কিভাবে যাবে কোথাও, বিয়ে হলো এর মাঝে দুই ঈদ গেল। এখন আবার রাজশাহী যাচ্ছে। বড় ছেলের বৌ হলে এমনই হয়।

প্রথম মাসেই পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। আরাফ যে এমন আনরোমান্টিক হবে জানলে আমিই পাঠিয়ে দিতাম।

ভাগ্যিস বড় ভাবীর কানে তুলেছিলাম বৌটাকেও সঙ্গে পাঠাও। ঐখানেও ওদের ভালোই কাটবে আশা করি।

ঠিক বলেছ। ভাবী-দাদী যখন নেই চাচীদেরকেই এসব দেখতে হবে। নয়তো প্রজন্ম আগাবে কিভাবে?

হিহিহি তা যা বলেছিস ছোট।

আমি মায়ের ঘরে যেতেই মা বললেন, বৌ মা
রাজশাহীতে আমাদের একটা গেস্ট হাউজ আছে। তোর বাবা চাচারা কাজে গেলে সেখানেই উঠেন। তোরাও সেখানেই থাকবি। ভয়ের কিছু নেই, তোর সাহায্য করার জন্য দুজন থাকবে। রান্নাটা শুধু তোকে করতে হবে। পারবি না?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, পারবো।

আচ্ছা বেশ। তৈরী হয়ে নে আজ বিকেলেই হয়তো রওয়ানা হবি। কি রে মন খারাপ লাগছে? আমাদের কথা ভাবিস না, ক’টা দিনেরই তো ব্যাপার ফের আমার সন্তানেরা আমার বুকেই ফিরবে। তোরা একে অপরের খেয়াল রাখিস কেমন?

আমি কিছুক্ষণ নীচে তাকিয়ে বললাম, মা আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?

মা আমার কথা শুনে জড়িয়ে ধরে বললেন, বোকা মেয়ে আমার জিজ্ঞাসা করতে হয়? তোর যখন ইচ্ছে হবে তখনই ধরবি।

আমি চোখের কোণ মুছে বললাম, আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে মা, আমি আপনাদের অনেক মিস করবো,,,,

অনেকটা মন খারাপ নিয়েই আমি আরাফের সঙ্গে রাজশাহীর উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিলাম। আরাফ আমার মুখ দেখে বলল, রেবা আপনার বেশি খারাপ লাগলে যেতে হবে না। আমি একা থাকতে পারবো।

আপনি ওখানে একা থাকলে আমার সাথে সাথে বাড়ির সবার টেনশন থাকবে, আমি থাকলে অন্তত স্বস্তি হবে। তাছাড়া আমি জানি আপনি বুয়াদের রান্না পছন্দ করেন না। সারাদিন কাজ করে এসে নিজে রান্না করে খাবেন, আমি থাকতে এতো কষ্ট করতে হবেনা।

বেশ তবে, আপনি রান্না করতে পারেন তো?

আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে মন দিলাম, রান্না পারি কি না কে জানে? হয়তো পারি নয়তো পারি না। কিন্তু আপনি আমায় ছাড়া ভালো থাকেন না এইটা জানি বলেই একা ছাড়ছি না,,,
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে, আমিও না ঘুমিয়ে জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। অতঃপর এজ ইজুয়াল ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি ।

আরাফ তার কাঁধে রেবার অস্তিত্ব পেয়ে মৃদু হাসলো। রেবার হাতটা মুঠোয় নিয়ে তার উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বলল,আমার ঘুমের রাণী!”

পূর্ব আকাশে কেবল রক্তিম আভা ছড়াতে শুরু করেছে একটু পরেই সূর্যোদয় হবে। আরাফের ডাকে ঘুম ভাঙে আমার। আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, পৌঁছে গেছি?
আরাফ বলল, আসুন আমার সঙ্গে।

আমি গাড়ি থেকে নেমে তাঁর পিছু হাটতে লাগলাম। রাস্তার পাশের ঢালু পথ দিয়ে আমরা অনেকটা দূর হেটে এসেছি,

রেবা ভয় লাগছে?

নাহ

বেশ।

একটু পরেই দেখি একটা বিশাল বড় সজনে গাছ, সামনেই বিশাল জলরাশি। সুয্যিমামা সবেই কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। লাল থালার মতো তেজহীন সূর্য যখন পূর্ব আকাশে উদয় হলো, জলের তরঙ্গে তার প্রতিফলন দেখতে এতোটাই মনোমুগ্ধকর আমি সত্যিই আগে জানতাম না। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, মৃদুমন্দ বাতাস, আর সুনসান নিরবতা। প্রকৃতির এই অকৃত্রিম সৌন্দর্যতায় আমি একদম বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম।
আরাফ বলল, জানেন সবাই চাঁদ দেখতে পছন্দ করলেও আমি সূর্য দেখতে পছন্দ করি। আপনার ভালো লেগেছে?

আমি দু’হাত মেলে চোখ বন্ধ করে বললাম, ভীষণ ভালো‌ লেগেছে, একদম মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
দমকা হাওয়া আমার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যায়। আমি উপভোগ করতে থাকি সময়টা।

একটা বাগানবাড়িতে আমাদের গাড়িটা ঢোকে, একজন লোক এসে দরজা খুলে বলে, আস্সালামু আলাইকুম আরাফ বাবা।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম রহিম চাচা। কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন? পথে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?

নাহ কোনো সমস্যা হয়নি। রেবা ইনি হচ্ছেন আমাদের রহিম চাচা, বলতে পারো উনাদের কোলেপিঠেই আমরা বড় হয়েছি। চাচা এ আপনার বৌমা।

আস্সালামু আলাইকুম চাচা।

ওয়ালাইকুম আস্সালাম মা। আরাফ বাবা বৌমা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। মাশাআল্লাহ, আল্লাহ তোমাদের সুখী করুক। আসো বৌমা ভেতরে আসো।

আমি চারদিক দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকলাম, কি সুন্দর গাছগাছালিতে ভরা একটা বাড়ি।

রেবা আপনি উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি এখুনি আসছি।

রহিম চাচা আমায় একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমাদের ঘর। আমি যাই খাওয়ার ব্যবস্থা করি।

আমি রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ বসলাম, তারপর ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। এখানে আমার মতো শান্তপ্রিয় মানুষের বেশ ভালোই কাটবে আশা করা যায়। আমি শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখি আরাফ নাস্তা নিয়ে বসে আছে,

তাড়াতাড়ি আসুন খিদেয় আমার পেট চো চো করছে।

আমি তার পাশে বসতেই সে পরোটা ছিড়ে ডিম দিয়ে আমার মুখে তুলে দিলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বললেন আপনার অনেক খিদে পেয়েছে অথচ তুলে দিলেন আমাকে?
আমাদের বাড়িতে তো সবাই একসঙ্গে খেতাম। তাই আপনাকে কখনো লোকমা তুলে দিতে পারিনি। জানেন তো স্ত্রীকে লোকমা তুলে খাইয়ে দিলে প্রতি লোকমায় নেকি পাওয়া যায়? আমিতো ঠিক করেছি এখানে যতদিন থাকবো আমরা একপ্লেটে খাবো। মোহাব্বত না জন্মে যাবে কই?

হাহাহা। আপনি আসলেই অনেক কিউট!

আপনি এই প্রথম আমায় নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিলেন! এমন হ্যান্ডসাম হয়ে লাভ কি হলো বলুন? আজ পর্যন্ত নিজের বৌ ভালোমতো দেখলো না। ৮মাস পরে কিউট অন্তত বলেছে!

আমি তার দিকে ভালোমতো তাকালাম, ডার্ক এশ কালারের টিশার্ট পড়ে সাধারণ বেশে থাকা একজন চমৎকার ব্যক্তি আমার সামনে বসা। যার রোমশ হাত, কিংবা বলিষ্ঠ দেহ যে কারোই আকর্ষণ কাড়বে। সে আসলেই অসম্ভব সুদর্শন।

হেই রেবা খালি চোখেই স্ক্যান করছেন নাকি? এভাবে কেউ দেখে? ছেলে বলে কি আমার লজ্জা নেই হুম?

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ভীষণ লজ্জা না? আর আপনি যে সবসময় আমায় দেখেন ওটা কি হু?

আমার দেখতে ভালো লাগে তাই দেখি, আপনাকে দেখলে আমার চোখের জ্যোতি বাড়ে, শান্তি লাগে।

আমারো দেখতে ভালো লাগছে তাই দেখছি। তাছাড়া নিজের বরকেই তো দেখছি পরপুরুষকে তো না। যাই হোক নিন হা করুন, সব নেকি আপনিই নিবেন আমি নিবো না তা তো হবে না?

আরাফ হাসলো, হেসেই বলল, আপনি বড্ড হিংসুটে তো, আগে জানতাম না।

আপনি অনেক কিছুই জানেন না। সমস্যা নেই ধীরে ধীরে সব জানবেন।

তাই বুঝি?

হুম ঠিক তাই,, বলেই আমি হাসতে লাগলাম আর আরাফ আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

চলবে,,