তার শহরের মায়া পর্ব-০১

0
1781

#তার_শহরের_মায়া😍
#part_1
#writer_Liza_moni

বড় আপুর বরের সাজে যখন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখেছিলাম পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল যেন। অবাক হয়েছিলাম ভীষণ।যার সাথে ৩টা বছরের সম্পর্ক সেই মানুষটি কিনা আমার নিজের বড় আপুর স্বামী হতে যাচ্ছে? কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। গতকাল রাতে ও তো মাহিরের সাথে আমার কথা হয়েছিল। সে তো বলেনি যে আজ ওর বিয়ে।

ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী আমি। পড়ালেখার খাতিরে ঢাকায় যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় মাহিরের সাথে।আস্তে আস্তে ভালো লাগা আর তারপর ভালোবাসা।সব সময় ছেলেদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই পছন্দ করতাম আমি। কিন্তু মাহির কে কেনো জানি খুব ভালো লাগতো।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রিফার জন্মদিনে তাদের বাড়িতে গেলে মাহির আমার পিছু নেয়।রিফার খালাতো ভাই হয় মাহির। প্রতিদিন আমার পিছু নেওয়া, আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করলে তাদের পানিশমেন্ট দেওয়া, প্রতিদিন আমার মেসে আমার রুমের দরজার সামনে ১গুচ্ছ কাঠ গোলাপ রেখে যাওয়া, আমার ছোট ছোট বিষয়ে খেয়াল রাখাই তার প্রতি আমার ভালো লাগার সৃষ্টি করেছিল। তারপর শুরু হলো মেসেঞ্জারে চ্যাট করা।১ঘন্টা,২ঘন্টা করে করে সারা রাত চ্যাট করার অভ্যাস গড়ে উঠা।যত সময় যাচ্ছিল আমি তার শহরের মায়ায় পড়ে যাচ্ছিলাম। একটা সময় সে আমাকে প্রোপজ করে বসলো। আমি ততদিনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি।তাই তার প্রোপজাল আমি গ্রহন করে ফেলি। আমাদের ফ্রেন্ডদের মধ্যে আমি আর মাহির ছিলাম বেস্ট কাপল। আমাদের মাঝে ঝগড়া হতো প্রচুর। তবে একজন আরেকজন কে ভীষণ ভালোবাসতাম। দুজন দুজনের প্রতি বিশ্বাসটা ছিল খুব। চোখ বুজে আমি মাহির কে বিশ্বাস করতে পারতাম।২ বছর আগে মাহির পড়াশোনা শেষ করে এখন একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে।

সে যতই ব্যাস্ত থাকতো না কেন আমাকে সময় দিতে কখনোই ভুলতো না সে। কথা ছিল আমি পরীক্ষা টা দিলেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে আমাদের বাড়িতে।

ভাগ্যের কী পরিহাস। বিয়ের প্রস্তাব আমাদের বাড়িতে ঠিকই পাঠানো হয়েছে তবে সেটা আমার বড় আপুর জন্য।
আমার সেই ভালোবাসার মানুষটি আজ আমায় ঠকালো?

আপুর বিয়ের খবর শুনেছি চার দিন আগে। হঠাৎ করেই নাকি বিয়েটা চার দিন আগে ঠিক করা হয়েছে। আপুর বর ঢাকার তাও জানতাম আমি। আমার খাগড়াছড়িতে আসার কথা ছিল তিন দিন আগেই। তবে আমার পরীক্ষা থাকায় আসতে পারিনি। গতকাল রাতেই পারি জমিয়েছি খাগড়াছড়ির পথে।বড় আপুর বিয়ে নিয়ে খুব আনন্দে ছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে এক অসহ্য যন্ত্রণায়।

.
কীরে অনু? এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে দুলাভাই কে দেখে যাবি নাকি তনু কে রুম থেকে নিয়ে আসবি?যা মা তনু কে নিয়ে এসে তোর দুলাভাই এর পাশে বসা।

মায়ের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল অনুর। চোখ তার লাল হয়ে আছে। চোখে পানি চিকচিক করছে। চাইলেই এখন সবার সামনে কাঁদতে পারবে না অনু।

চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মায়ের আড়ালে চোখের পানি মুছে নিল অনু। মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
এখুনি যাচ্ছি আম্মু।

বুকের বাঁ পাশে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে অনুর। চোখ শুধু ভিজে যাচ্ছে।
তনুর রুমে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায় অনু।তার পা সায় দিচ্ছে না এগিয়ে যেতে।তনু বউ সেজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লাজুক হাসছে।তনু কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এই বিয়েতে কতো খুশি।
আয়নায় অনুকে দরজার সামনে দেখে পেছনে ফিরে তাকায় তনু। মুচকি হেসে বোনের দিকে এগিয়ে যায়।অনু ও মুচকি হেসে বোন কে জড়িয়ে ধরলো।

তুই অনেক লাকি রে আপু। মাহির ভাইয়া তোকে অনেক হ্যাপি রাখবে দেখিস।
.
হুম জানি রে অনু।মাহিরের মতো ছেলে আজ কাল পাওয়াই যায় না। ভীষণ ভালো ছেলে।
.
তোরা দুই বোন কী এই ভাবেই কথা বলে যাবি নাকি তনু কে নিয়ে স্টেজে যাবি? কাজী সাহেব ঐ দিকে তারা দিচ্ছেন।আর তোরা এখনো বসে আছিস?(মামি)

অনু বোন কে ছেড়ে দিয়ে থুতনি তে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে তুলে বললো মাশাআল্লাহ।
আমার আপুনি কে অনেক সুন্দর লাগছে।অনু তনুর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো চল আমার দুলাভাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে তো।

অনু তনু কে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।বরের জন্য যে মালাটা রাখা আছে ফ্রিজে তুই সেটা নিয়ে আয়।

মুচকি হেসে অনু মালাটা নেওয়ার জন্য চলে গেল।
মামিরা তনু কে মাহিরের কাছে নিয়ে গেলো।

অনু ফ্রিজ থেকে রজনীগন্ধা ফুলের মালা টা বের করে মালাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।তার মন বিষাদে ভরে গেছে।মালাটা নিয়ে অনু স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল। মাহির এখন ও অনুকে দেখেনি।সে তার বন্ধুদের সাথে হাসতেছে।

মামিরা তনু কে নিয়ে গিয়ে মাহিরের পাশে বসিয়ে দিল। মাহির তনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সাথে তনু ও।

দূর থেকেই সব দেখছে অনু। বুকের মাঝে কী যে এক না পাওয়ার যন্ত্রনায় খাঁ খাঁ করছে তা শুধু অনুই জানে।

আজ তোর কি হয়েছে বল তো অনু?সব কাজ এতো ধিরে ধিরে করছিস কেন?

পেছন ফিরে তাকিয়ে মাকে দেখে জোর করে হাসলো অনু। তারপর মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো
আজ তো আপু চলে যাবে তাই কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।

অনুর মা অনুর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলেন।মেয়ে হয়ে জন্মালে সবাই কেই একদিন পরের বাড়ীতে যেতে হয়।
যা মা তোর দুলাভাই কে মালাটা পরিয়ে দিয়ে আয়। একমাত্র শালি বলে কথা যা।

অনু মালাটা নিয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। মাহির তখন নিচু হয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে ছিল।

অনু কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো
দু-লা-ভা-ই

মাহির মুচকি হেসে মাথা তুলে অনুর দিকে তাকাতেই থমকে যায়।তার মুখের হাসিটা উধাও হয়ে যায়।বিষ্মিত কন্ঠে বলে উঠলো
অনু তুমি এখানে?

অনুর চোখের জল বাঁধ মানছে না।অনু মাহির কে কিছু না বলে মালাটা কোনো রকম গলায় পড়িয়ে দিয়ে ছুটে তার রুমে চলে গেল।
মাহির স্তব্দ হয়ে বসে রইলো।
বোনের এমন রিয়েকশনে ভ্রু কুঁচকে গেল তনুর।
সে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে অনুর কিছু একটা হয়েছে।

রুমে এসে অনু দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে গেল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর সময় তনু মাকে বলে
অনু যদি আমার এই বিশেষ মুহূর্তে রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তাহলে আমি এই বিয়ে করবো না।

তনুর কথায় বাবা অনুর রুমে গেলেন অনুকে ডাকতে। দরজায় টোকা পড়তেই অনু চোখ মুছে নিল।

অনু মা দরজা খোল।
বোনের বিয়ের দিন এই ভাবে দরজা বন্ধ করে রাখলে মানুষে কী ভাববে বলতো?

বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দিল অনু। কোনো রকম হাসার চেষ্টা করে বললো আপু তো আজ চলে যাবে তাই কষ্ট হচ্ছে।

কষ্ট কি তোর একার হচ্ছে মা ? আমাদের ও তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

অনু বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদিস না মা।এটাই দুনিয়ার নিয়ম।তনু কী বলেছে জানিস?

কী বলেছে?

তুই যদি ওর এই বিশেষ মুহূর্তে ওর পাশে না থাকিস তাহলে ও কবুল বলবে না। এখন চল তো আমার সাথে।

বাবা অনুকে নিয়ে তনুর কাছে গেলো।

মাহির অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যে খুব কান্না করেছে তা ভালোই বুঝতে পারছে মাহির।

অনু মাহিরের দিকে না তাকিয়ে তনু কে জড়িয়ে ধরে বললো
আজকের দিনেও তুই জেদ ধরে বসে আছিস আপু?

তো কি করবো? তুই আমার সাথে না থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে ছিলি কেন?

আমার বোনটা আজ অন্যের বাড়িতে চলে যাবে তাই কষ্ট হচ্ছে।

তোর তো খুব খুশি হবার কথা অনু।

আমি কি স্বার্থপর নাকি?

আমার বোন অনেক ভালো।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলেন।নীতুর মনে হচ্ছে এই সব কিছু স্বপ্ন। খারাপ স্বপ্ন খুব খারাপ।এখনই ঘুম ভেঙ্গে যাবে আর প্রতিদিন কার মতো দরজার সামনে এক গুচ্ছ কাঠ গোলাপ ফুল পাবে।যা মাহির রেখে যেতো।

তনু কবুল বলার সময় অনুর হাত খামচে ধরে।অনু মুচকি হেসে বোনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো কোনো ভয় নেই আপু।

মাহির যখন কবুল বলবে তখন অনু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাহিরের দিকে।কী করে পারলো একটা মানুষ এই ভাবে বেইমানি করতে?
মাহির অনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে তিন বার কবুল বলে দিলো।
সবাই এক সাথে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ।
তার পর রেজিস্ট্রেশন ও হয়ে গেলো তাদের।

অনু শুধু স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু হজম করে নিলো। তনুর বিদায় এর সময় সবাই কান্না করলেও তখন কেন জানি অনুর চোখে পানি ছিল না।মাহিরের মা অনেক করে বলেছেন তনুর সাথে অনুকে যেতে।সবার জোড়া জুড়িতে অনু গিয়ে তনুর পাশে বসলো।আর তনুর পাশেই মাহির মুখ মলিন করে বসে আছে।

মাহিরের ফুফুর বাড়ি খাগড়াছড়িতে।তাই মাহির আর তনুর বিয়ের সব আয়োজন এখানেই হয়।ঢাকায় যাওয়া সম্ভব না বলে তনু কে ফুফুর বাড়িতে নিয়ে যায় তারা।

রাত ১০টার দিকে পৌঁছায় মাহিররা।তনু কে মাহিরের সব বোনেরা ঘিরে রেখেছে। মাহির মাথার পাগড়ি টা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে বাহিরে চলে যায়। দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে থাকে।
অনু কে সে ও সত্যি অনেক ভালোবাসে। কিন্তু এই বিয়েটা না করে তার উপায় ছিল না।সে জানতো না যে তনু অনুর বড় বোন।

এক কোনায় দাঁড়িয়ে অনু তনুর দিকে তাকিয়ে আছে।আজ এই জায়গায় তার থাকার কথা ছিল।অথচ সেই জায়গায় আজ তার বড় বোন।

মাহিরের ফুফাতো ভাই বোন মিলে বাসর ঘর সাজাচ্ছে। একটা মেয়ে এসে অনুর হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বললো
চলো আপু তোমার বোনের জন্য বাসর ঘর সাজাবে।কয় জনের ভাগ্যে জুটে বলো তো?

অনু কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটা অনুর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেল।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তো কম পরেনি তার পর ও কি এদের একটু ও মায়া হচ্ছে না?

রজনীগন্ধা ফুল,লাল গোলাপ দিয়ে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস করে সাজানো হয়েছে রুমটা। এই রুমে দাড়িয়ে থাকতে অনুর দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।এর চেয়ে বুঝি মরন ভালো?

চলবে,,,, 🍁