#তার_শহরের_মায়া ২
পার্ট_২১
#Writer_Liza_moni
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে অনু।ডান হাতে তার ক্যানেলার লাগানো। বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে ঘুমিয়ে আছে সে।এক ব্যাগ রক্ত নিতে সময়ের প্রয়োজন। চাইলে ম্যাসে ও রক্ত নিতে পারতো। কিন্তু অনুর আব্বু আম্মু হসপিটালেই রাখলেন।অনুর বেডের পাশে বসে আছেন মিসেস আফরোজা।অনুর আব্বু হসপিটাল থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে গেছেন। খাবার নিয়ে আসার জন্য।
ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুঁয়ে গেছে।
মিসেস আফরোজা বসা থেকে উঠে অনুর কেবিন থেকে বের হলেন।ওয়াস রুমে যাবেন বলে। কিছুক্ষণ পর তিনি ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে আবার অনুর কেবিনে আসার সময় কিছু একটা দেখে তিনি হাঁটা থামিয়ে দাড়িয়ে যান।আজ আবার সেই পুরনো কিছু সময়ের কথা মনে পড়ে গেল।
একটা মানুষের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি থেকে থাকে যা অন্য একটা মানুষের সাথে জড়িত থাকে। মূলত সেই অন্য মানুষ কে নিয়েই কিছু স্মৃতি থেকে থাকে।আজ প্রায় ২৯ বছর পর সেই চেনা মুখ দেখে মনের ভেতর কেমন যেনো ভয় কাজ করছে। আবার এই ভয়ের সাথে এক পাহাড় সমান আনন্দ ও বয়ে যায় মনের ভেতর।
পৃথিবীটা ছোট।এর চেয়ে ও বেশি ছোট আমাদের দেশ। আমাদের দেশ থেকে ও বেশি ছোট একটা শহর।আর এই ছোট্ট শহরে একটা মানুষের সাথে দেখা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মিসেস আফরোজা মুচকি হেসে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।যেখানে এক জন পাঞ্জাবী পড়া লোক বসে আছেন। তিনি এখনো মিসেস আফরোজা কে দেখতে পাননি। মিসেস আফরোজা উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেশ নিচু এবং কাঁপা কাঁপা গলায় নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন,
“কেমন আছেন স্যার?”
২যুগ পাঁচ বছর পর পরিচিত সেই কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে গেলেন লোক টা। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে রিতীমত চমকে উঠলেন তিনি।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,
“তুমি?”
মিসেস আফরোজা কে চিনতে যেনো একটু ও কষ্ট হয় নি সোহেল সাহেব এর।এত গুলো দিন না দেখার পরেও। মিসেস আফরোজা মুচকি হাসলেন।
“বলে ছিলাম না সে দিন যে একদিন আমাদের আবার দেখা হবে। আজকের দিনটাই হয় তো সেই একদিন।”
সোহেল সাহেব হাসলেন।তো কি খবর তোমার? কেমন আছো? স্বামী সংসার নিয়ে?
আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন?আর আপনার জীবনের সাথী টা?
আমি তো আগের মতই আছি। অবশ্য আগের মতো ইয়াং নেই।বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। চুল দাড়ি পাঁক ধরেছে।টাটকা শরীরের চামড়া গুটানো শুরু হয়ে যাচ্ছে। শরীরে হাজারো রোগ বাসা বেঁধেছে।
আর আমার জীবনের সাথী?
সোহেল সাহেব হাসলেন। বেশ শব্দ করেই হাসলেন।যেনো মিসেস আফরোজা কোনো মজার কথা বলেছে।
মিসেস আফরোজা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন সোহেল সাহেব এর মুখের দিকে। সেই মন মাতানো হাঁসি।
সোহেল সাহেব হাসি থামিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“আমি আজ ও বিয়ে করিনি রোজ।”
সোহেল সাহেব এর কথা টা যেনো তীরের মত গেঁথে গেল মিসেস আফরোজার মনে।
তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
“কেন আজ ও আপনি একা রয়ে গেলেন?”
দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসাতে পারিনি।আর ভালোই যদি বাসতে না পারি তাহলে শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে যাবো কেন? বিয়ের পর একটা মেয়ে তো তার স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসাটাই চায় তাই না?
তাই বলে আপনি,,,
সোহেল সাহেব মিসেস আফরোজা কে কথার মাঝে থামিয়ে দিলেন।বাদ দাও সেই সব অতীত এর কথা। তুমি হসপিটালে কী করো?
মিসেস আফরোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
আমার ছোট মেয়ের রক্ত শূন্যতা।তাই রক্ত নিতে হচ্ছে ও কে।এই হসপিটালেই আছে।
আজকের দিনটা বেশ শুভ মনে হচ্ছে। সময়ের সাথে সব বদলে গেছে দেখছি। তুমি ও বদলে গেছো আগের চেয়ে অনেক টা। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।চুল ও পাঁক ধরেছে। অনেক টা সময় পেরিয়ে গেছে। শুধু আজ ও আমার অসমাপ্ত ভালোবাসা টা রয়ে গেছে।
ঠিক আগেরি মতন।
এমন সময় এক নার্স এসে দাঁড়ায় তাদের মাঝখানে।নার্স কে দেখে সোহেল সাহেব মুচকি হেসে বললেন, আমি রিপোর্ট দিয়ে আসছি ডাক্তার কে।
হ্যাঁ তা জানি।ডাক্তার সাহেব আপনাকে ডাকছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
নার্স চলে গেলে মিসেস আফরোজা সোহেল সাহেব কে জিজ্ঞেস করলেন,
কিসের রিপোর্ট?কী হয়েছে আপনার?দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
পেছন থেকে ডাক্তার বলে উঠলেন,
অতিরিক্ত মদ্যপান এবং ধুম পান করার জন্য উনার ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে গেছে।
ডাক্তারের কথা শুনে মিসেস আফরোজা অসহায় দৃষ্টিতে সোহেল সাহেব এর দিকে তাকালেন। সোহেল সাহেব হাসছে।মন মাতানো হাঁসি। মৃত্যু কে আলিঙ্গন করতে চাচ্ছেন তিনি। জীবনের সকল প্রকার স্বাদ নেওয়া শেষ তার।
আমার সাথে আসুন।বলে ডাক্তার চলে গেল। সোহেল সাহেব এর ও আজ অনেক তাড়া।
আসি। ভালো থেকো বলে চলে গেলেন তিনি। মিসেস আফরোজা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সেদিন যদি জানতো লোক টা তাকে এত ভালোবাসে তাহলে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এই মানুষটাকে নিজের সারা জীবনের সঙ্গী করে নিতো।
এখন আফসোস ছাড়া কিছুই করার নেই। বহুদিন পেরিয়ে গেছে।চাইলে ও ফেরানো যাবে না আগের সময়।
এই দিকে অনুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। রক্তের বেগের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মিসেস আফরোজা অনুর কেবিনে আসলেন।অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।এমন সময় অনুর আব্বু হাতে খাবারের প্যাকেট নিয়ে আসলেন। মিসেস আফরোজার হাতে খাবারের প্যাকেট দিয়ে তিনি আবারও চলে গেলেন মসজিদের উদ্দেশ্যে।
মিসেস আফরোজা অনু কে খাবার খাইয়ে দিলেন নিজ হাতে। তিনি খেলেন না। মনটা কেমন বিষাদে ছেয়ে আছে।না হওয়া প্রিয় মানুষটার জন্য ভেতরটা কেমন জানি পুড়ছে।
ইশশ মায়া এত খারাপ কেন?
তূর্য আজ সকাল থেকে অনুর ম্যাসের সামনে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে।অনুর সাথে তার অনেক কথা আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুর কোনো দেখা পেল না সে।ম্যাসের রুমের জানলা থেকে তূর্য কে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিয়ানা ম্যাস থেকে বের হয়ে তূর্যর কাছে গেল। তূর্য তখন বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে।
Seene se tum mere aake
Laag jaao naa
Darte ho kyum
Zaara pass toh aao na
গুন গুন করে সে নিজে ও গানটা গাইতে থাকে।রিয়ানা তূর্যর সামনে এসে তুড়ি বাজিয়ে ডাকে।রিয়ানা কে তূর্য কান থেকে হেডফোন খুলে ফেলে।
যার জন্য এত লম্বা সময় ধরে এইখানে দাঁড়িয়ে আছেন সে কিন্তু এখানে নাই।
রিয়ানার কথা বুঝতে না পেরে তূর্য ভ্রু কুঁচকে বললো মানে?
কোথায় গেছে পরমানু?
হসপিটালে আছে এখন।
কেন?কি হয়েছে ওর?
ওর তো রক্ত শূন্যতা।তাই আন্টি আঙ্কেল আসছে। রক্ত নিতেই গেছেন।
ওহ আচ্ছা। আগে বলবেন না এই কথা। শুধু শুধু এত সময় ধরে অপেক্ষা করছি।
আচ্ছা একটা কথা বলি?
জী বলুন। পরমানুর ফোন নাম্বার টা একটু দিবেন প্লিজ? আমি ওকে বলবো না যে আপনি দিয়েছেন।
রিয়ানা মুচকি হেসে বললো,বললে ও সমস্যা নেই।নিন,,
01*********
ধন্যবাদ।বলে তূর্য বাইক স্টার্ট দিলো।রাতে না হয় অনু কে কল করে বলে দিবে দেখা করতে চায়।
এই দিকে তূর্যর মা মিসেস তৃনা উঠে পড়ে লেগেছে অনু কে নিজের বাড়ির বউ করতে।মেয়েটা তূর্য কে পছন্দ করে। কিন্তু তূর্য তো পছন্দ করে না।তিয়াসের সাথে বিয়েটা হলে সমস্যা কোথায় বুঝতে পারছি না আমি।
খাবার টেবিলে সবার উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন তিনি। তূর্য তখন বাড়িতে ঢুকলো। মায়ের কথা শুনে বললো,
সমস্যা কোথায় তুমি বুঝতে পারছ না? পরমানু আমাকে ভালোবাসে।ও ভাইয়া কে বিয়ে করতে রাজি হবে না কোনো দিন।
পরমানু কে আবার?
তূর্যর উদ্দেশ্যে বললো তিয়াস।
আরে ধেত আমি ও না,
পরমানু না,অনুমেঘা,,
ওহ আচ্ছা। তিয়াস প্লেটে তরকারি নিতে নিতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, আমি এই মেয়ে কে বিয়ে করতে চাই না। মেয়ে টা যেহেতু তূর্য কে পছন্দ করে ভালোবাসে, সেহেতু বিয়ে টা ওর সাথেই দাও।
তিয়াসের কথা শুনে তূর্য বেশ খুশি হয়ে তিয়াস কে ফ্লাইং কিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে রুমে চলে গেল।
তোমার ছেলে ও মেয়েটাকে পছন্দ করে। শিকার করে না যে।
প্রেম করার চেয়ে প্রেমে পড়ার অনুভূতি বেশ সুন্দর।প্রেমে পড়লেই যে তা ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবার কাছে প্রকাশ করতে হবে তা কিন্তু না।
চলবে,,,,,