তার শহরের মায়া ২ পর্ব-২২

0
461

#তার_শহরের_মায়া ২
#পার্ট_২২
#Writer_Liza_moni

মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে অনু।মা মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। হসপিটাল থেকে আর ম্যাসে ফিরেনি অনু।মা বাবার সাথে ফুপুদের বাড়িতে এসেছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে।মা মেয়ের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করার পর মিসেস আফরোজা বলে উঠলেন,
আচ্ছা অনু তোর মনে আছে আমি তোকে একদিন একটা কথা বলে ছিলাম।

অনু চোখ মেলে মাথা উপর করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
কী কথা? তুমি তো প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু বলে থাকো আমাকে।
এত কথা মনে রাখা যায় নাকি?

ওহ আচ্ছা। তোর কথা টা অবশ্য ঠিক।যাই হোক,তোকে বলে ছিলাম না আমার লাইফের একটা ঘটনা বলবো।আজ তাহলে সেই কাহিনী টা শোন তুই।

হুম বলো।শুনি,,,

মিসেস আফরোজা নড়েচড়ে বসলেন।অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে শুরু করলেন,,

“আমি তখন মাত্র ক্লাস টেনে পড়ি। সামনে এস এস সি পরীক্ষা ছিল। চার মাস বাকি তখন পরীক্ষার।অথচ আমার বইয়ের বেশ অর্ধেক পড়া বাকি ছিল।যেখানে সবাই পুরো বই রিভিশন করতে ব্যাস্ত সেখানে আমি মাত্র নতুন নতুন অংক, ইংরেজি বই খুলে দেখছিলাম কী আছে ঐ বই গুলোর মধ্যে।পড়া লেখায় বেশ ফাঁকি বাজ ছিলাম। বাবার আদরের ছোট মেয়ে।যখন যা দরকার পড়েছে মুখ ফুটে বলার আগেই পেয়ে গেছি। পরিবারের সবার ছোট সদস্য হওয়ায় বেশ আরামেই দিন কাটছিল।বড় ভাইয়া,মেজো ভাইয়া,বড় আপু আমাকে এক নজর না দেখলে ওদের যেনো দিনটাই ভালো কাটতো না। বেশ আদরের ছিলাম।এখনো আছি।
সামনে যেহেতু পরীক্ষা আমার কোনো পড়াই হয়নি ঠিক মতো তাই সবাই মিলে একজন ভালো মেধাবী মানুষ খুঁজছে।যে আমাকে এই চার মাসে পাস করার মতো মার্ক উঠানোর জন্য সাহায্য করতে পারবে।”

অনু শোয়া থেকে উঠে বসলো।
দুই হাত দিয়ে খোলা চুল গুলো খোঁপা করতে করতে বললো,
আর আমি একদিন পড়তে না বসলে কী বকা দাও তুমি।আর নিজে কী সুন্দর টই টই করে ঘুরে বেড়িয়েছো।

চুপ মেয়ে। আমার মতো তোদের জীবন হোক এটা আমি চাই না বুঝলি?

আচ্ছা বুঝলাম।এর পর কী হয়েছিল? তোমরা কি সেই মানুষটি কে পেয়ে ছিলে যাকে খুঁজছিলে?

হুম পেয়ে ছিলাম।
আমাকে পড়ানোর জন্য অর্নাসে পড়ে এমন একজন কে ঠিক করা হয়েছিল।প্রত্যেক দিন বিকেলে তিনি চলে আসতেন আমাকে পড়ানোর জন্য। আমি নারাজ ছিলাম পড়তে।যে দিন প্রথম তাকে দেখে ছিলাম বুকের মাঝে কেমন যেনো ভয় কাজ করছিল। এক দেখাতেই মন যেনো চিৎকার করে বল ছিল,
“এই মানুষটার জন্য আমি পাস মার্ক কেন? বই গুলো পুরো মুখস্থ করে এ+ নিয়ে আসতে পারবো।”
সে ছিল আমার প্রথম অনুভূতি। প্রথম দেখায় কাউকে ভালো লাগলে তোদের ভাষায় বলে না,,
Love at first said
আমার ক্ষেত্রে ও সেই কাহিনী ঘটে।

অনু নড়ে চড়ে বসলো। বেশ কৌতূহল নিয়ে বললো,
আম্মু তুমি তোমার লাভ স্টোরি শুনাচ্ছো?বাহ বাহ,,এর পর কী হয়েছিল তাড়াতাড়ি বলো,,

মেয়ের কথা শুনে মিসেস আফরোজা মুচকি হেসে আবারও বলতে শুরু করলেন,
যে আমি পড়তে বসতেই চাইতাম না সেই আমি উনি আসার আগে থেকেই পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে থাকতাম। আমার এই সব পরিবর্তন দেখে সবাই বেশ অবাক হতো। উনি আসলে আমি পড়া বাদ দিয়ে উনার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকার সুযোগ একদম পাই নি। বেশ রাগি মানুষ ছিলেন তিনি।দেখতে কিন্তু এতো টা ও সুন্দর ছিলেন না।সব মেয়ে কিন্তু উনাকে দেখে পছন্দ করতো না। আমার কী হয়েছিল কী জানি? প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায়।রাত দিন এক করে বইয়ের মাঝে ডুবে ডুবে পড়তে থাকি আমি। টেস্ট পরীক্ষায় প্রথমে টেনে টুনে পাস করলেও পড়ে বেশ ভালো নাম্বার পেয়েই পাস করি। আমার এত উন্নতি দেখে আমার বাবা ভাইয়েরা তো বেশ খুশি।সব ক্রেডিট নিয়ে গেলো সোহেল স্যার।এত কষ্ট করে পড়লাম কিন্তু আমি।যাক তাতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। আমি বরং চাইতাম আমার ফ্যামেলির কাছে লোকটা ভালো একজন মানুষ হিসেবে পরিচিতি পাক।
দিন যত যাচ্ছিল আমি সেই মানুষটাকে ভালো বাসতে শুরু করি। মাঝে মাঝে তার কথার ধরন তাকানো দেখে মনে হতো উনি ও আমাকে ভালো বাসেন। সাহসের অভাবে বলতে পারছেন না। আমি বুঝতাম।আর উনাকে দেখলেই মিটি মিটি হাসতাম। উনি না বুঝে আমার হাঁসির সাথে তাল মেলাতেন।এই ভাবেই কেটে গিয়েছিল চারটা মাস। দুজন দুজনকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সাহস করে কখনো কেউ কাউকে বলিনি। আমার পরীক্ষা শেষ হলো। তার সাথে আর দেখা হলো না আমার। রেজাল্ট দিলো। বেশ ভালো নাম্বার পেয়েই পাস করলাম। বাড়ির সবাই তো অনেক খুশি। অথচ আমি, আমার কোনো হেলদোল নেই। আমি চুপ করেই রইলাম। ভালো রেজাল্ট করার খুশিতে একদিন উনাকে আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন আমার বাবা।তা আমি জানতাম না। আমি তখন সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।মন বলছিল খুব আপন কেউ আসবে আজ।মন যা বললো তাই ঘটলো। তিনি আসলেন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
কী রোজ এত ভালো রেজাল্ট করলে আমাকে জানালে ও না একবার? তার মুখে রোজ নামটা শুনলে আমার দুনিয়া থমকে যেতো।বেহায়া মন শুধু চাইতো উনার মুখ থেকে শুধু সেই নামটা শুনতে। সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তিনি চলে যাওয়ার সময় সবার চোখের আড়ালে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে যান। তার সেই চিঠি দেখে ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। বাড়ির কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার বাবা কখনো প্রেম ভালোবাসা নামক সম্পর্ক টাকে ঠিক মতো হজম করতে পারতেন না।
ওড়ানার বাজে চিঠি নিয়ে আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে কাঁপা হাতে খুলে দেখি এত বড় একটা কাগজে ছোট করে লেখা,
পরিবার কে মানিয়ে আমার জীবন সাথী হতে পারবে রোজ?

“ভালোবাসে কথাটা না বলেই ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছিল?বাহ,,”

হুম।এর পর কী হয়েছিল শুন,
আমি কাউকে কিছু বলিনি। একদিন বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা বলে তার ভার্সিটিতে চলে যাই। অসময়ে আমাকে দেখে তিনি যেমন অবাক হয়ে ছিলেন তার চেয়ে ও বেশি খুশি হয়ে ছিলেন। আমাদের দেখা এবং কথা খুব কমই হতো। কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা ছিল অনেক বেশি। একদিন তিনি আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন।বাবা কড়া গলায় না করে দিয়ে ছিলেন।কারন তিনি এতিম ছিলেন। তার পরিবার ছিল না। আমার সেকি কান্না। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে ছিলাম। আমাদের মাঝে কিছু একটা চলছে তা ততদিনে বাড়ির সবাই বুঝতে পেরে যায়। দুই সপ্তাহ পর আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে তোর বাবার সাথে।মুর্তির মতো ছিলাম আমি। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলি। খাগড়াছড়ি তে যাওয়া হয়েছিল আমার কিন্তু এখানে আর দশ বছরে ও পা রাখিনি।

হঠাৎ এই সব বলছো কেন আম্মু?

মিসেস আফরোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আজ হসপিটালে উনার সাথে দেখা হয়েছে। দীর্ঘ ২৯ বছর পর।

কিহ? সত্যি?এত গুলো দিন পর,,,,

জানিস উনার এই পৃথিবীতে আজ ও কেউ নেই।

মানে?

উনি আজ ও বিয়ে করেননি। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার।

কী বলছো এই সব?কি হয়েছে উনার?

অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধুমপান করার ফলে উনার ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে গেছে।একটা মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারে দেখ।

অনু আফসোস এর স্বরে বললো,
ইশশ একটা মানুষ কতটা ভালোবেসে ছিল তোমায়।এত ভালোবাসা থাকে কয়জনের ভাগ্যে?নানার প্রতি আমার এখন অনেক রাগ হচ্ছে। কেন যে এমন করলো?
লোকটার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে আম্মু।

তাহলে ভাব আমার কেমন লাগছে?

অনু চুপ করে শান্ত চোখে বেশ কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।দেখে বুঝার সাধ্য নেই যে মায়ের মনের ভেতরে কী বিষাদের অনল প্রবাহ হচ্ছে।

সময় দেখার জন্য মোবাইল হাতে নিলো অনু।স্ক্রিনে আননোন নাম্বার থেকে আসা একটা মেসেজ ভাসছে।

“তৃষ্ণার্ত প্রেমিক চাতক পাখির মতো প্রেমিকার আসার পথ চেয়ে বসে আছে মাঝারি এক বেলকনিতে।সে খবর কী সেই মায়া মোহিনী জানে,,?”

চলবে,,,