তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-২১

0
1777

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২১

ইমা নিজেকে ইয়াদের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভেঙে ভেঙে বলে, আ,,,আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।

ইয়াদ উত্তেজিত হয়ে বললো, মানে ?

ইমা ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, মা এখানে আছে, মাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না, আপনি চলে যান।

ইয়াদ বুঝিয়ে বললো, আবার আসবে মায়ের কাছে এখন অনেক রাত হয়ে গেছে আমাদের ঢাকা পৌঁছাতে হবে।

ইমাকে অনেক বুঝিয়ে ইয়াদ সাথে নিয়ে গেলো। ইয়াদ, ইমা, ইয়ানা আর ইশান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। বাকি সবাই আগামীকাল যাবে।

২৪.
গতকাল রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অবিরাম। প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠেছে চারদিকে। বৃষ্টির পর প্রকৃতি হয়ে উঠে সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। আজ পনেরো দিন হলো ইমার মা আর নানুর মৃত্যুর। বাড়ি ফেরার পর এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি সে। একদম চুপ হয়ে গেছে সারাদিন উদাস হয়ে বসে থাকে। কারো সাথে কথাও বলে না আর ভার্সিটিও যায় না। ইয়াদের ভালো লাগছে না ইমার এই গম্ভীরতা। মিস করছে ইমার বিরক্ত করা তবে ইয়াদ মুখ ফোটে কিছু বলেও না ইমাকে। নিজের মতো অফিস, জিম আর বাকি দুজন মানুষের সন্ধান করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে একবার বাইরের দিকে তাকালো। বৃষ্টি ইয়াদের একদমই পছন্দ না। ঢাকা শহরে বৃষ্টি মানেই রাস্তায় হাটু সমান নোংরা পানি জমা, বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পরে ভিজে গেলে কেমন খুঁতখুঁত করে ইয়াদ। পছন্দ না করার আরো বড় একটা কারণ হলো পাঁচ মিনিট বৃষ্টিতে ভিজলে ইয়াদের জ্বর আসে শরীর কাপিয়ে। তাই অপছন্দের তালিকায় রেখেছে সে বৃষ্টিকে তবে সেটা শুধু ঢাকা শহরের জন্য আর ভেজার জন্য। অন্য কোথাও অবস্থান কালে বৃষ্টির দিন তার খুব একটা মন্দ লাগে না, যদি কাঁচের জানালার এপার থেকে দেখে বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতি। তবে আজ বৃষ্টি দেখার সময় নেই তার আর তাই ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। কে জানে আজ রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে নাকি শিপের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে ইমা জানালা দিয়ে মিনি ছাঁদটার এরিকা পাম গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ফোটা পরতেই গাছের সরু পাতাগুলো কেমন নেচে নেচে উঠছে। সকাল আটটার বেশি বাজে হয়তো কিন্তু বাইরের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন অন্ধকার চারদিকে।

ইমা আগের মতো ইয়াদকে বিরক্ত করলে হয়তো এখন বলতো আজ অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেখুন বাইরে কী সুন্দর বৃষ্টি, চলুন দুজনে একসাথে ভিজি এই বৃষ্টিতে।

ইয়াদ ইমার উদ্দেশ্যে বললো, নিচে চলো ব্রেকফাস্ট করে তারপর আবার এভাবে বসে থেকো সারাদিন।

ইয়াদ বের হয়ে গেলো রুম থেকে আর ইমা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তবে নিচের যাওয়ার দিকে না গিয়ে মিনি ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। বৃষ্টি স্নান করার ইচ্ছে করছে ইমার। বৃষ্টির ফোঁটার সাথে নিজের ভেতরের কষ্টগুলোকে ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে খুব। ইমা ধীর পায়ে ছাঁদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাত দু’দিকে মেলে দিলো। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিলো। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ইমার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। গায়ের সাদা সুতি শাড়ীটা একটু একটু করে ভিজে ইমার গায়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বেশি থাকায় মাত্র কয়েক মুহূর্তে ইমার সারা শরীর ভিজে এককার হয়ে গেলো। সাদা শাড়ীটা দেহের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে, প্রত্যেকটা ভাজ ফুটে উঠছে। ইয়াদের বাড়ির পাশের বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে মাঝে ইয়াদদের ফলের বাগান, ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়ানোর জন্য নিচ থেকেও দেখা যাচ্ছে না আর ইয়াদ চলে গেছে আর আসবে না। তাই ইমা নিশ্চিন্তে ভিজচ্ছে বৃষ্টিতে। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনা পানিগুলো বৃষ্টির পানি গ্রাস করে নিচ্ছে। ইমার মনে হচ্ছে চোখের পানির সাথে মনের কোণে জমা কষ্টগুলো এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা শুষে নিচ্ছে।

ইয়াদ ফাইল রেখে চলে গিয়েছিলো। ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে এলো ফাইল নিতে। ইমাকে রুমে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো কারণ ইমা নীচে যায়নি। সাইড টেবিল থেকে ফাইলটা হাতে নিয়ে আবার ইমাকে খুজার জন্য ওয়াশরুমের দিকে তাকালো না পেয়ে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই ইয়াদের হাত থেকে ফাইলটা নিচে পরে গেলো। ইয়াদ একবার ফাইলের দিকে তাকিয়ে আবার ইমার দিকে তাকালো। দুহাত দু’দিকে মেলে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ইমার চোখের ঘন কালো পাপড়িগুলো নড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত, সারা মুখে পানির বড় বড় ফোটা, গোলাপি ঠোঁটের কোণে পানি। বৃষ্টির ফোঁটা কপালে পরে গাল, চিবুক তারপর গলা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। ইয়াদ আজ নিজের মধ্যে নেই সে হারিয়ে গেছে ইমার মাঝে। কখন রুম থেকে ধীর পায়ে ছাদে পা রেখেছে ইয়াদ নিজেই জানে না। মুহুর্তে ইয়াদের সাদা শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো, মাথার চুল বেয়ে পানিগুলো গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলো। ইয়াদ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একদম ইমার সামনে দাঁড়ালো। ইয়াদ ইমার থেকে অনেক লম্বা তাই সামনে দাঁড়িয়ে ইয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে ইমার মুখ দেখছে। ইয়াদের চুল বেয়ে পরা পানিগুলো ইমার চোখে মুখে পরছে। ইমা বৃষ্টিতে ভেজায় এতোটাই ব্যস্ত তার এতো কাছে এসে কেউ দাড়িয়েছে ইমার হুঁশ নেই। বৃষ্টির ঠান্ডা পানিতে ইমার সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হঠাৎ মুখে গরম নিশ্বাস পড়তেই ইমা চোখ পিটপিট করে তাকায়। ইমা আর ইয়াদের মাঝে হয়তো এক ইঞ্চিরও কম দূরত্ব আছে৷ ইমা চোখ খুলে ইয়াদকে দেখে চমকে গেলো, এক পা পিছিয়ে যেতেই ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ভেজা গায়ে ইয়াদের ভেজা হাতের স্পর্শ যেনো ইমার গায়ের প্রতিটি লোমকূপে পৌঁছে গেলো। একে অপরের মাঝে আর সুতো পরিমাণ জায়গাও ফাকা নেই। এবার ইমাও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াদের ভেজা মুখের দিকে। ইমা চোখ দুটো মিটমিট করছে কারণ একটু পরপরই ইয়াদের চুল বেয়ে পানিগুলো ইমার চোখে মুখে গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে কতটা সময় পার হয়ে গেলো কারো জানা নেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বিলাস করছে। হারিয়ে গেছে অন্য এক জগতে, বৃষ্টির বেগ যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো, চারপাশটা আরো ঘন কালো অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। ইমার শীত লাগতে শুরু করেছে, ভেজা গোলাপি ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। ইয়াদের দৃষ্টি আটকে গেছে সেই ভেজা ঠোঁটে। নিজের অজান্তেই ইয়াদ একটু একটু করে আগাতে লাগলো ইমার ঠোঁটের দিকে। ইয়াদের দু’হাত ইমার কোমরে আর ইমা নিজের দু’হাতে ইয়াদের কাঁধের শার্ট খামচে ধরে আছে। বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে দুজনের হুঁশ ফিরে। ইয়াদ তৎক্ষনাৎ ইমাকে ছেড়ে দেয় ইমা ছিটকে দূরে সরে যায়। ইমা কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে রুমে চলে যায়। ইয়াদ পাশের চেয়ারে বসে পরে, কাঁচের টেবিলটাতে টপটপ বৃষ্টির ফোঁটা পরছে সেগুলো দেখতে লাগলো। কী হয়েছিলো তার এসব কী করছিলো ? এটা কী কেবলই আকর্ষণ ছিলো নাকি অন্যকিছু ? ইয়াদ কিছু ভাবতে পারছে না এখনো চোখে লেগে আছে ইমার ভেজা মুখটা যা খুব করে কাছে টানছিলো ইয়াদকে। গলার বিন্দু বিন্দু পানিগুলো শুষে নিতে ইচ্ছে করছিলো। ইয়াদ দু’হাতে নিজের ভেজা চুলগুলো পেছনের দিকে দিলো। তবে কী সেটাই ঠিক যেটা ইয়াদের মন বলছে কিন্তু ইয়াদ তো তার মনের কথা মানতে নারাজ। ইয়াদ চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিলো, উপভোগ করতে লাগলো বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা। খুঁতখুঁতে লাগা বৃষ্টির স্বাদটা আজ ইয়াদের কাছে অন্যরকম লাগছে, এক নাম না জানা অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে মনে। ইমা ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইয়াদকে এতো কাছে দেখে ইমার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গিয়েছিলো। যখন কাছে টেনে নিলো তখন মনে হয়েছে হার্টবিট থেমে গিয়েছিলো আর যখন ঠোঁটের দিকে,,,,, ইমা আর ভাবতে পারলো না দু’হাতে মুখ ঢেকে নিলো লজ্জায়। তখন হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো বলে ইমা লজ্জা পেতেও ভুলে গিয়েছিলো। এখন ইমার মনে হচ্ছে ইয়াদের সামনে গেলেও লজ্জায় মরে যাবে সে। ইমার শীত বাড়তে লাগলো তাই তাড়াতাড়ি শাওয়ার শেষ করে ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখে সে কোনো কাপড় আনেনি। এখন বাইরে যাবে কী করে সেটা ভেবে ইমার মাথায় হাত। ওয়াশরুমের দরজা একটু ফাঁকা করে দেখে ইয়াদ রুমে আসেনি এখনো। ভেজা কাপড়ে দৌড়ে কাবার্ডের সামনে চলে গেলো একটা ধূসর রঙের শাড়ী নিয়ে ঘুরতেই ইয়াদকে দেখতে পেলো রুমে আসছে। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলে ইমা চোখ নামিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায় আর ইয়াদ রুমেই ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। এই প্রথম হয়তো ইয়াদের অফিসের জন্য লেট হলো। দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ইমা শাড়ী পরে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদের সামনে পরতে হবে ভেবে লজ্জা লাগছে, বের হতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ মনে হলো ইয়াদ ভেজা কাপড়ে আছে তাই তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো ওয়াশরুম থেকে। কিন্তু ইয়াদকে দেখতে পেলো না রুমে। কাপড় রাখার ঝুঁড়িতে ইয়াদের ভেজা কাপড় দেখে বুঝতে পারলো ইয়াদ চেঞ্জ করে চলে গেছে অফিসে। এক মুহুর্তের জন্য ইমার উদাসীনতা কেটে চঞ্চলতা ভড় করেছিলো আবার একা হয়ে যেতেই উদাসীনতা তাকে গ্রাস করতে লাগলো।

আসবো ম্যাম ?

সার্ভেন্টের ডাকে ইমা দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা তাই বাইরে সার্ভেন্টকে খাবার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে আসতে বললো।

সার্ভেন্ট ভেতরে এসে সাইড টেবিলে খাবারের ট্রে রেখে বললো, ম্যাম আপনার খাবার।

ইমা অবাক হয়ে বললো, আমি তো খাবার রুমে দিতে বলিনি।

সার্ভেন্ট ফ্লোরে দৃষ্টি রেখে বললো, স্যার যাওয়ার সময় আপনার খাবার রুমে দিয়ে যেতে বলেছে।

ইমা বেশ অবাক হলো আজ ইয়াদের আচরণে। বিয়ের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে ইয়াদ এখনো কোনোদিন ইমাকে জিজ্ঞেস করেনি সে খেয়েছে কিনা, বা কখনো বলেনি খেয়ে নাও। আজ ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার সময়েও সাথে যেতে বললো আর এখন আবার নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ইমার মা চলে যাওয়ার পর এই পনেরো দিন ইয়ানা সবসময় ইমার খেয়াল রেখেছে, হয়তো ইয়াদের কথাতেই করেছে হবে। ইমা ভেবে দেখলো ইয়ানা ভার্সিটি চলে গেছে তাই হয়তো বাধ্য হয়ে ইয়াদ নিজেই বলে গেছে।

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, ঠিক আছে তুমি যাও আমি খেয়ে নিচ্ছি।

সার্ভেন্ট ওকে ম্যাম বলে চলে গেলো। ইয়াদের এই আড়ালে থেকে খেয়াল রাখার কথা চিন্তা করে ইমা মুচকি হাঁসলো।

বিড়বিড় করে বললো, আপনি উপরে নিজেকে যেমন দেখান আসলে আপনি তেমন নন। আপনার কঠিন আবরণের আড়ালে একটা নরম মন আছে। যেটা আপনি সবসময় লুকিয়ে রাখতে চান। তবে মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদ ধরা পরে গেছে নিজের মিসেস এর কাছে।

ইমা মুচকি হেঁসে খাবার খেতে লাগলো। এদিকে ইয়াদের অফিসে আসতে অনুমানের থেকেও বেশি লেট হয়ে গেলো। মাথা ভারী হয়ে আসছে ইয়াদের, একের পর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজার ফল ভোগ করতে হবে হয়তো।

২৫.
ক্লাসের সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা, বাইরের বৃষ্টি দেখছে। আজ বৃষ্টির জন্য অনেকেই আসেনি তবে ইয়ানার ক্লাস মিস করা একদমই পছন্দ নয় তাই চলে এসেছে। আজ ইয়ানার একমাত্র ফ্রেন্ড রিকু (রোকেয়া) সেও আসনি। ইয়ানার এখন মনে হচ্ছে সে এসে ভুল করেছে। হাতে গোনা কিছু ছেলেমেয়ে এসেছে সবাই নিজেরদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। আজ স্যাররাও ক্লাস নিচ্ছে না খুব একটা। দুই এক ক্লাসে গুটি কয়েক স্টুডেন্টদের সাথে স্যার দেখা যাচ্ছে। তবে পড়াচ্ছে নাকি গল্প করছে বুঝা দায়। ইয়ানা বিরক্ত হয়ে ভাবলো বাসায় চলে যাবে, সেখানে অন্তত নিজের ভাবির সাথে গল্প করতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ, ক্লাস থেকে নিজের বইপত্র নিয়ে চলে আসলো। হলরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো।

ইয়ানা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো, কে ?

সাথে সাথে হলরুমের সব লাইট জ্বলে উঠলো একে একে। সামনে তাকিয়ে ইয়ানার ভয় বেড়ে গেলো। তার সামনে পাঁচজন অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের আগে দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না।

ইয়ানা ভয়ে ঢোক গিলে বললো, আপনারা কারা, ভার্সিটিতে ঢুকলেন কী করে ? আর আমাকে এখানে কেনো এনেছেন ?

একটা ছেলে প্রচন্ড আক্রোশে বললো, আমার ভাই সামান্য তোর হাত ধরেছিলো বলে তোর ভাই তার হাতের হাড় এতোগুলা টুকরো করেছে যে কোনো দেশের ডক্টর সেটা জোড়া লাগাতে পারেনি। চোখ তুলে তাকিয়েছে বলে এসিড দিয়ে চোখদুটো ঝলছে দিয়েছে, তোকে কিছু কথা বলেছে বলে জিহ্বা কেটে দিয়েছে। আজ আমি তোর এমন হাল করবো তোর ভাই তোর দিকে তাকালে, তার রুহ কেঁপে উঠবে তোকে দেখে।

সামনের ছেলের বলা কথার কিছুই বুঝতে পারছে না ইয়ানা। কার কথা বলছে আর তার ভাইয়া এতো নির্মম হতে পারে না।

ইয়ানা রেগে বললো, কী সব আবোল তাবোল কথা বলছেন আপনি ? আর কে আপনার ভাই ?

সামনের ছেলেটা হেঁসে বললো, সামান্য অপরাধের জন্য যার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিস এখন তাকেই ভুলে গেছিস। জাহিদের কথা মনে আছে যে তোকে প্রপোজ করেছিলো ? আমি তার বড় ভাই শাহিদ।

জাহিদের কথা বলতেই ইয়ানার সেদিনের কথা মনে পরে যায় কিন্তু তবু এই লোকের কথা বুঝতে পারছে না। ইয়াদ তো শুধু তাদের বলেছিলো ইয়ানাকে বিরক্ত না করতে তাহলে এরা এসব কী বলছে ইয়ানা বুঝতে পারছে না।

ইয়ানা ব্যস্ত হয়ে বললো, দেখুন ভাইয়া আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। হ্যাঁ জাহিদকে আমি চিনি সে আমাকে বিরক্ত করতো কিন্তু ভাইয়া তাকে শুধু বুঝিয়েছিলো আমাকে বিরক্ত না করতে। তারপর আর তাকে আমি দেখিনি।

শাহিদ রেগে বললো, দেখবি কী করে, আমার ভাই আজ কয় মাস ধরে হসপিটালে পরে আছে। তোর ভাইয়া ওর এমন অবস্থা করেছে তার দিকে তাকাতে ভয় পায় মানুষ।

ইয়ানা এসব কী শুনছে তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাই ভাইয়া রাগী কিন্তু তাই বলে এমন কিছু করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

শাহিদ রেগে বললো, আজ তোর এমন হাল করবো তোর ভাইয়াও তোর দিকে তাকাতে ভয় পাবে।

ইয়ানা ভয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। একে তো হঠাৎ করে তার ভাইয়ার নামে এসব শুনে সে শকড তার ওপর সামনের পাঁচজনকে তার হিংস্র পশু মনে হচ্ছে। যারা তাকে এখনই টুকরো টুকরো করে ফেলবে মুহূর্তে। ইয়ানা ভয়ে পিছনে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঢেকে গেলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি এখন যদি সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তাহলেও হয়তো কেউ শুনতে পাবে না।

ইয়ানা হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়া প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে আমার ভাইয়া এমন কিছু করতে পারে না।

শাহিদ অট্টহাসি দিয়ে বললো, এই দেখ তোরা, দেশের নামকরা বিজনেসম্যান মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদের কলিজা এখন আমাদের হাতে। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি আমরা, তোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ?

শাহিদ ইয়ানার দিকে আগাতে শুরু করলে ইয়ানা দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।

চলবে,,,,,