তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-২৩

0
1772

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৩

ইমা রঙিন কাগজে মোড়ানো বাক্সটা একটু একটু করে খুললো। প্রথমেই নিজের ছোটবেলার পছন্দের কিছু খেলনা আর জামাকাপড় পেলো। সেগুলো দেখে মুচকি হাঁসলো তবে চোখের কোণে পানিও জমা হলো। সেগুলো আলতো করে ছুঁয়ে ভেতরে আরো একটা বাক্স পেলো। সেটা খুলতেই একটা খাম পেলো এটা দেখে ইমার বেশ কৌতূহল হলো। অনেকটা কৌতূহল নিয়ে খামটা খুললো দুই পৃষ্ঠার একটা চিঠি কিন্তু প্রথম লাইন পড়ে কৌতুহলের বদলে এক ঝাঁক কষ্টরা ইমার মনকে ঘিরে ধরলো।

আমার কলিজার টুকরা ইমা পরী
আজ আমার ছোট ইমা পরীকে বধূ সাজে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে রে মা। আজ আমার শেষ স্বপ্নটাও পূরণ হলো।

ইমা বুঝতে পারলো তার মা তার বিয়ের দিন লিখেছে এই চিঠিটা। সেটা চিন্তা করে আবার পড়তে শুরু করলো সে।

যখন তুই চিঠিটা পড়ছিস হয়তো তোর কপালের ভাজে বিরক্তি ফুটে উঠেছে কিন্তু যখন শেষ করবি তখন হয়তো চোখের কোণে পানি জমে যাবে। আজ তোকে একটা মায়ের গল্প বলবো, একটা অসহায় মায়ের গল্প। তোর বাবাকে তোর নানাভাই মেনে নেয়নি বলে তার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তোর দাদা দাদী অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন তাই তোর বাবা অনেক কষ্টে নিজের পড়াশোনা শেষ করেছে। আমি যখন তোর বাবার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তখন তার কোনো চাকরি ছিলো না। ইমরুল ঢাকায় এসে ছোট একটা টিনের ঘর ভাড়া নেয়। এক বন্ধুর সাহায্যে চারটা টিউশনি জোগাড় করে। তা দিয়ে চলতে শুরু করে আমাদের ছোট একটা সংসার। এক বেলা খেলে আর এক বেলা উপোস থাকতে হয়। ভাতের অভাব হলেও ভালোবাসার অভাব পড়েনি কখনো। এভাবে কোনো মতে এক মাস পার হয়ে গেলো, তোর বাবা ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলো তখন আমাদের দিন বদলাতে শুরু করলো। তোর বাবার বসটা খুব ভালো ছিলো। বেশ সুখে কাটছে আমাদের দিন মাঝে মাঝে তোর বাবা আমাকে ঘুরতেও নিয়ে যেতো নানা উপহার দিতো। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সইলো না। চাকরির এক বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন হন্তদন্ত হয়ে তোর বাবা বাসায় ফিরলো। দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছে আমি তার দিকে পানি এগিয়ে দিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে সে উত্তরে কিছু না বলে আমাকে জানালো তার চাকরি চলে গেছে আর একটা সমস্যা হয়েছে এই শহরে আর থাকা যাবে না, তাড়াতাড়ি সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাতেই আমাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেলো। তারপর থেকে সে অনেক ভয় পেয়ে থাকতো। এক গ্রামে থেকেও তোর নানাভাই আমাদের সাথে অপরিচিতর মতো আচরণ করতো। গ্রামে ফিরে আসার পর আবার সংসারে অভাব দেখা দিলো। গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি হলো তার, তবে যে বেতন হয় তাতে সংসার চালানো কষ্ট। এদিকে বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলো আমার বাচ্চা হয় না সে নিয়ে গ্রামের মানুষ নানা কথা বলতে লাগলো। রাত হলে আমি ডুকরে কেঁদে উঠতাম তোর বাবা আমাকে সান্তনা দিতো৷ মানুষটা সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে থাকতো। এদিকে তেমন টাকাও নেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। হঠাৎ একদিন জানতে পারতাম আমার ভেতর আরো একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। সেই অনুভূতি হয়তো তুইও একদিন অনুভব করতে পারবি৷ মা হওয়ার অনুভূতির সাথে পৃথিবীর কোনো অনুভূতির তুলনা হয় না। আর সেখানে তুই তো ছিলি আমার বহু প্রতিক্ষার ফল। যেখানে সারারাত চোখের পানি ফেলতাম সেখানে তখন সারারাত জেগে তোকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতাম। মেয়েরা প্রথম মা হলে চায় তাদের যেনো ছেলে হয় কিন্তু আমি চাইতাম আমার যেনো একটা মিষ্টি মেয়ে হয়। যাকে সবসময় আমি পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো। তোর বাবা আমার অনেক খেয়াল রাখতো কোনো কাজ করতে দিতো না। নিজেই সব করত একা একা। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করলো। একদিন নতুন ভোরের আলোর সাথে তোর আগমন হলো। সেদিন তোকে কোলে নিয়ে খুশিতেই আমি আর তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছিলাম।

এতোটুকু পরে ইমা থামলো। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে কিছু পড়তে পারছে না। তার মায়ের এতো ভালোবাসা সে এভাবে অপমান করেছে ভাবতেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চিঠির প্রতিটা শব্দ পড়ে ইমা যেনো অনুভব করতে পারছে তার মায়ের অনুভূতিগুলো। ইমা দু’হাতে চোখের পানি গুলো মুছে আবার পড়তে শুরু করলো।

তুই যখন ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে আমার আঙুল আঁকড়ে ধরতি খুশিতে আমার মন নেচে উঠতো। তুই ছিলি তোর বাবার কলিজা তোর জন্য কী করবে না করবে ভেবে পেতো না সে। তোর জন্য আরো দুটো টিউশনি জোগাড় করলো। নতুন নতুন জামা, খেলনা আরো কত কী কিনে আনতো। তোর কথা শুনেও তোর নানার রাগ একটুও কমেনি। তোর মুখের প্রথম মা ডাক আমার দুনিয়া পাল্টে দিয়েছিলো। তোর জন্মের পর দুটো বছর আমার কাছে আমার টানাপোড়েনের সংসার টাকেও একটা জান্নাতের টুকরো মনে হয়েছে। তবে কথায় আছে সবার কাপলে সুখ সয় না। তোর আর আমার কপালও ছিলো তেমনই। এক মুহুর্তে আমার জান্নাতের টুকরো সংসারটা মরুভূমি হয়ে গেলো। তোর বাবা ঢাকা গিয়েছিলো কোনো এক কাজে কিন্তু সন্ধ্যায় তার লাশ ফিরে এলো উঠানে। আমি সেদিন কাঁদতে পারিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবার হাতের আঙুল টেনে তুই কেঁদেছিলি চিৎকার করে। এক মুহুর্তে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। সেদিন তোর নানাভাই উপস্থিত হলো আমার বাড়িতে উঠোনে তখনও তোর বাবার লাশ। দাফন শেষে সাথে নিয়ে গেলো আমাকে। দুদিন শুধু তোকে জড়িয়ে রুমের কোণে বসে ছিলাম। তুই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তি উঠে আবার কাঁদতি। আমি তাকিয়ে দেখতাম তোকে, ভাবতাম দু বছরের মেয়েটা কীভাবে বুঝে বাবা হারানোর কষ্ট।

ইমা পড়া বন্ধ করে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বাবা হারানোর কষ্ট তখন না বুঝে কাঁদলেও জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে না কেঁদেও সেই কষ্ট ভোগ করেছে ইমা। বেশ কিছু সময় কেঁদে মনটা একটু হালকা করে আবার পড়তে লাগলো তার মায়ের লেখা। চিঠিটার অনেক জায়গা দেখে মনে হচ্ছে পানি পড়ে শুকিয়ে গেছে। হয়তো মায়ের চোখের পানি।

তোর বাবা মারা যাওয়ার প্রায় মাস পর রুম থেকে বের হলাম। রুমে বসে সারাদিন চোখের পানি ফেলতাম। কখনো মা জোর করে খাওয়াতে পারতো আবার কখনো ব্যর্থ হতো। এর মধ্যে তোর মণি একবার এসেছিলো তবে আমার সাথে দেখা করেনি। সেদিন বাইরের আলো গায়ে লাগালাম চোখ খুলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছিলো। এক চাচাতো বোন জোর করে নিয়ে গেলো গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে। দেখা হলো যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার সাথে। সরকারি চাকরি করতো ছুটিতে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে থমকে গিয়েছিলেন তিনি তবে আমি তার দিকে তাকায়নি। সে আমার কোলে থাকা তোর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলো পরে আমাকে সেটা জানায়, সাথে থাকা আমার চাচাতো বোন। তার দুদিন পর বাবার কাছে আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। দুদিন সময় লেগেছিলো তার নিজের বাবা মাকে রাজি করাতে। তাদের এতো ভালো ছেলের সাথে, কোনো এক বাচ্চার বিধবা মাকে মেনে নিবে না। সে নাকি তার বাবা-মাকে বলেছিলো রাজি না হলে সে কোনোদিন বিয়েই করবে না। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয় কিন্তু আমি রাজি হতে পারিনি। ইমরুলের মৃত্যুর মাত্র এক মাসের মাথায় বিয়ের কথা শুনে পাগলের মতো আচরণ করেছিলাম। বাবাও জোর করে নি আর, কিন্তু তার মাস খানেক পর বড় আপু আবার আসলো বাড়িতে। জানি না বাবাকে কী বুঝিয়ে ছিলো বাবা প্রায় উঠে পড়ে লাগলো বিয়ে দিতে। প্রতিটা দিন আমাকে যুদ্ধ করে হতো বিয়ে না করার জন্য। আমি তোকে আর ইমরুলের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। একটা বছর পার হলো তোর বয়স তখন তিন বছরে পরেছে অনেক কথা বলিস কিন্তু বুঝতে পারি হাতে গোনা কয়েকটা। সেদিন হঠাৎ বাবা আমার রুমে এসে তোকে কোলে নিয়ে বলে আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে তোকে এমন জায়গায় পাঠাবে যেখান থেকে আমি তোকে কখনো খুঁজে পাবো না। ভয়ে সেদিন আমার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিলো, তুই ছিলি আমার প্রাণ তোকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভুলে যেতাম। তখন আর কিছু মাথায় আসেনি শুধু মনে হয়েছে তোকে বাঁচাতে হবে বাবার হাতে থেকে। ইমরুল চলে যাওয়ার পর একমাত্র তুই ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই। তোর জন্য যেখানে নিজের জীবন দিতে পারবো সেখানে বিয়ে কথাটাও খুব সহজ মনে হয়েছে তোর জীবনের কাছে। তোকে বাঁচাতে ভয়ে সেদিন রাজি হয়ে যায় বাবার কথায়। সারাটা রাত তোকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে পার করেছি। পরদিন বিয়ে হয়ে যায় তৌহিদুরের সাথে, পারি দিলাম আবার সেই ঢাকা শহরে সাথে তৌহিদুরের বাবা-মা। যে শহরে প্রথম পা রেখেছিলাম তোর বাবার সাথে। যেখানে তোর বাবার সাথে হাতে হাত রেখে হেঁটেছি অনেক পথ। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু কেউ মনে হচ্ছিলো গলা চেপে ধরে আছে। তৌহিদুর আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু আমি তাকে কোনোদিন মন থেকে মানতে পারিনি। তৌহিদুর আমাকে ভালোবাসলেও তার মা আমাকে দেখতে পারতো না, আমার থেকে বেশি তোকে সহ্য করতে পারতো না। আড়ালে মারতো তোকে, এক বছরের মাথায় তাহেরের জন্ম হয়ে তৌহিদুরের ইচ্ছায়। তাকে তুই সহ্য করতে পারতি না, মারতি আর তাতে রেগে তোকে মারতো তৌহিদুরের মা। এসব আমি সহ্য করতে পারছিলাম না তাই মায়ের কাছে রেখে আসি তোকে। তৌহিদুর রাজি ছিলো না তোকে মায়ের কাছে দিতে কিন্তু আমি জোর করি কারণ সে আসল সত্যিটা জানতো না। কেনো তোকে মায়ের কাছে দিতে চাইছি। দিন, মাস, বছর পার হতে লাগলো তুই বড় হতে লাগলি তোর নানু কাছে আর তাহের আমার কাছে। আমি মাঝে মাঝেই যেতাম তোকে দেখতে কিন্তু তুই যত বড় হচ্ছিলি তত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিলি। একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়ের ভালো করতে গিয়ে আমি আমার মেয়েটাকেই হারিয়ে ফেলেছি। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি আমি তোকে আর তোর বাবাকে ভালোবাসি না বলেই আরেক লোককে বিয়ে করেছি নিজের সুখের জন্য। আমি তোর মা হওয়ার যোগ্য না।

ইমা সেদিনটার কথা মনে করে আবার চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো। আর মা তার জন্য এতোকিছু সহ্য করেছে আর সে নিজের মাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছে। কীভাবে পেরেছিলো এতো ছোট বয়সে মাকে এতো বাজে কথা বলতে। সবকিছুর জন্য দায়ী মণি নামক অমানুষটা। মা হয়ে সে কীভাবে পারলো আরেক মায়ের থেকে তার সন্তানকে, না না শুধু সন্তান নয় কলিজার টুকরাকে আলাদা করতে। কাঁদতে কাঁদতে ইমার চোখ মুখ ফোলে গেছে। তবু চিঠি শেষ করার জন্য আবার পড়তে লাগলো।

আজ হয়তো তোর অযোগ্য মাকে মাফ করবি, জমিয়ে রাখা অভিমানগুলো মুছে ফেলবি। মায়ের কথা মনে পরলে চলে আসিস। তুই অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলেও এই মায়ের মনে তোর জন্য ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। আর তৌহিদুরের বাড়ির দরজা তোর জন্য চিরকাল খোলা থাকবে। মানুষটাকে তুই বা আমি মেনে না নিলেও আমরাই তার জীবনের অ-মূল্য রত্ন। সেদিন এই মানুষটাও কেঁদেছিলো তোর অপমানে, পারলে মাফ চেয়ে নিস একবার। বাক্সে কিছু গহনা আছে তোর বাবা আমাকে দিয়েছিলো যখন ঢাকায় ভালো চাকরি করতো তখন৷ হাজার কষ্টেও কখনো এই জিনিসগুলোর দিকে হাত দিতে দেয়নি। আজ থেকে এই সবকিছু তোর। মাকে মাফ করলে মায়ের কাছে চলে আসিস মন চাইলে।
ইতি
তোর অভাগী অযোগ্য মা

ইমা ফ্লোরে বসে চিঠিটা বুকে আঁকড়ে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, একবার কেনো বললে না মা, একবার কেনো সব বললে না। আমি দিনের পর দিন তোমাকে কষ্ট দিয়ে গিয়েছি তুমি সহ্য করে গেছো, কেনো মা কেনো ? তুমি আমার জন্য এতো কষ্ট সহ্য করেছো আমি কখনো বুঝতে চেষ্টা করিনি। সবসময় নিজের কষ্টটাকে বড় করে দেখেছি। আমার কষ্টগুলো আমি নিজের হাতে আমার জীবনে টেনে এনেছি। তোমাদের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের জন্য বেছে নিয়েছি #তিক্ততার_সম্পর্ক। সেদিন তোমার সাথে ফিরে গেলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা পেয়ে জীবনটা তিক্ততার নয় মধুর হতো। তোমার কাছে একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ তুমি দিলে না মা, কেনো ? একবার তোমার বুকে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে মা।

ইয়াদের বাসার প্রত্যেকটা রুম সাউন্ড প্রুব তাই ইমার এই আর্তনাদ আর চিৎকার বাইরে যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে ইমার চোখ গেলো বাক্সের দিকে তাতে একটা ছবির এলবাম। খুলে দেখতে লাগলো তার বাবা-মায়ের অনেক ছবি। কতো সুন্দর লাগছে দুজনকে একসাথে। একেবারে পার্ফেক্ট কাপল ছিলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ইমার মায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ আর বাবার নাকি ধবধবে সাদা ছিলো। ছবিতে তেমন বুঝা যাচ্ছে না তবে নানুর কাছে শুনেছে ইমা। ইমার গায়ের রং আর মুখের আদল তার বাবার মতো হয়েছে সবসময় বলতো তার নানু। ইমা নিজের বাবা-মায়ের ছবির উপর আলতো করে হাত বুলাচ্ছে আর চোখের পানি ফেলছে। তার জীবনে এতো চোখের পানির কারণ হয়তো সে তার মায়ের চোখের পানি ঝড়িয়েছে বলে। ইমা একটা একটা পৃষ্ঠা উল্টে ছবি দেখতে লাগলো৷ অনেক সময় পর তার বাবা মায়ের ছবির বদলে শুধু তার ছোটবেলার ছবি বের হতে লাগলো। এরপর থেকে ইমাকে ছাড়া তার বাবা-মায়ের একটা ছবিও পেলো না। সব ছবিতে সে তার বাবা-মায়ের সাথে নাহলে তার একার ছবি। ইমা এলবামটা আঁকড়ে ধরে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো এবার। এই এলবামই হয়তো ইমার, তাহেরা আর ইমরুলের জীবন এলোমেলো করে দেওয়ার মূল। হয়তো এই এলবামে এমন কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে যাতে এলোমেলো হয়ে গেছে তাহেরার সাজানো জান্নাতের টুকরোর মতো ছোট সংসারটা৷ আবার এই এলবামই হয়তো একদিন ইমা, ইয়াদ, ইয়ানা, ইশান আরো অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ইমা চমকে উঠে সেদিকে তাকালো। ইয়াদকে ঢুকতে দেখে ইমা আরো অবাক হলো। কারণ এতো আগে ইয়াদ কখনো বাসায় আসে না। ইয়াদ রুমে এসে ব্লেজারটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে পায়ের শো খোলে স্লিপার পরে আর কোনোদিকে না তাকিয়ে কাবার্ড থেকে নিজের ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ইমার কেনো জানি ইয়াদকে স্বাভাবিক লাগছে না। ইমা দ্রুত সব সরিয়ে ফেললো তবে তাড়াহুড়াতে এলবামটা সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। হঠাৎ দরজায় কেউ নক করলে ইমা গিয়ে দরজা খোলে দেয় আর দেখে ইশান দাড়িয়ে আছে।

ইশান মুচকি হেঁসে বললো, কেমন আছো ভাবি ? তোমার সাথে তো আমার কথাই হয় না।

ইমা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, এই তো আলহামদুলিল্লাহ।

অতিরিক্ত কান্না করার জন্য ইমার গলা অনেকটা বসে গেছে আর চোখমুখ লাল হয়ে ফোলে গেছে। ইশান প্রথমে খেয়াল না করলেও ইমার গলার আওয়াজ শুনে ভালো করে খেয়াল করলো।

চিন্তিত গলায় বললো, ভাবি তোমার গলা এমন লাগছে কেনো ?

ইমা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, না এমনই আমি ঠিক আছি ? ভাইয়া তুমি কেনো এসেছো বললে না ?

ইমার কথা বিশ্বাস না করলেও ইশান ব্যাপারটা ঘাটালো না৷ অভিমান করার ভান করে বললো, কেনো ভাবি প্রয়োজন ছাড়া কী আমি তোমার সাথে কথা বলতে আসতে পারি না ?

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আরে তা কেনো হবে ? আসলে কখনো আসো না তো তুমি, তাই আর কী ?

ইশান চাপা কষ্ট নিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, ভাইয়া আমাকে তার আশেপাশে পছন্দ করে না তাই যতটা সম্ভব দূরেই থাকি।

ইমা বুঝতে পারলো ইশানের মুচকি হাসির পিছনের লুকানো কষ্টটা তবে সে কী করবে ইয়াদ তো তাকেও নিজের আশেপাশে সহ্য করতে পারে না।

ইশান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো, আসলে ভাইয়ার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো।

চলবে,,,,,