তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৩১+৩২

0
1862

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩১

মনে হচ্ছে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিয়েছে চারপাশ। দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না। ইমা মিনি ছাঁদে বসে গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। চিন্তা আর বিষন্নতা ইমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। ঘড়িতে রাত দুটো বেজে বিশ মিনিট ইয়াদের এখনো কোনো খবর নেই। ইয়াদ রাত করে বাসায় ফিরলেও কখনো এতো রাত করে না। ইমা অনেকবার ইয়াদের নাম্বারে ট্রাই করেছে কিন্তু সুইচ অফ বলছে। আজ ইয়ানাকেও কিছু জানাতে পারেনি কারণ ইয়ানা ভার্সিটি থেকে এসে আর রুম থেকেই বের হয়নি কী হয়েছে তাও বলেনি। ইমার চোখ লেগে এসেছিলো ডাইনিং টেবিলে বসে থেকে। রাত একটায় ঘড়ির টুং শব্দে ঘুম ছুটে যায়, তখন খেয়াল করে দেখে ইয়াদ আসেনি। আবার কল দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু বারবার ওপাশ থেকে একজন ভদ্র মহিলার বলা দুঃখীত আওয়াজটাই কানে আসে। ইমা ডাইনিং টেবিল থেকে রুমের মিনি ছাঁদে এসে বসেছে তাও এক ঘন্টার অধিক সময় চলে গেছে। ইয়াদ সকালে বের হয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ নেই। রনিত জানিয়েছে ইয়াদ রাত নয়টার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে গেছে। ইমার অজান্তে চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, হে খোদা তুমি কী আমার ভাগ্যে একটু সুখ লিখতে পারতে না ? আমার ভাগ্যে তিক্ততা ছাড়া আর কিছু কী দেওয়ার মতো ছিলো না ?

ইমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো। অন্যদিকে ইয়ানার চোখ মুখ ফোলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরমান আর তার কলিগ মিস নিরার সেই দৃশ্য। ম্যাথ প্রবলেমের বাহানা বানিয়ে আরমানের কাছে যাওয়ার জন্য কেবিনের সামনে গেলে ভেতর থেকে মিস নিরার আওয়াজ পেয়ে ইয়ানার পা থমকে যায়। ইয়ানা দরজা নক না করে ধীর পায়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানলাটা খোলাই ছিলো তাই ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে অসুবিধা হয়নি ইয়ানার। মিস নিরা ভার্সিটিতে নতুন জয়েন করেছে টিচার হিসাবে, মাত্র কয়মাস আগেই। আরমানের সামনে হাটু মুড়ে বসে আছে আর হাতে এক গুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে। ইয়ানা চমকে উঠলো ভেতরের দৃশ্য দেখে। ইয়ানার মনে আরমানের প্রতি ভালো লাগাটা ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে অনেক আগেই সেটা ইয়ানা ঠিক বুঝতে পেরেছে। তাই তো নানা অজুহাতে চেষ্টা করেছে আরমানের কাছে যাওয়ার, তার সাথে কথা বলার। ইয়ানা নিজেকে সামলে নিলো এই দৃশ্য দেখেও কারণ তার বিশ্বাস আরমান কখনো একসেপ্ট করবে না। কিন্তু পরক্ষণে ইয়ানার প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে আরমান নিরার হাতের ফুলগুলো নিজের হাতে নিলো আর ফুলগুলোর ঘ্রাণ নিয়ে মুচকি হাঁসলো। ইয়ানার অজান্তে দুচোখ ভড়ে উঠলো নোনা জলে। আরমান কিছু বলার আগেই নিরা উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আরমানকে। ইয়ানার পক্ষে এর থেকে বেশি দেখা সম্ভব হলো না। ঘুরে দাঁড়ালো উল্টো দিকে আর হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে বের হয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে। বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে আর বের হয়নি। ইমা অনেকবার নক করেছে কিন্তু ইয়ানা দরজা খুলেনি। ইমা ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে। বাকি দিনটা কেঁদে কাটিয়েছে, রাত গভীর হওয়ার সাথে ইয়ানার বুকের ভেতরটা আরো ভারী হয়ে আসছে।

৩১.
গেইটে গাড়ির আলো পড়তেই ইমা চোখ মুছে নিলো আর ভালো করে লক্ষ্য করলো ইয়াদের গাড়ি ঢুকছে। ইমা দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াদের কাছে চাবি থাকে সবসময় তাই নক না করে দরজা খোলে ভেতরে ঢুকলো। ইমা ড্রয়িংরুমে পা ফেলতেই চমকে উঠলো। ইয়াদ এলোমেলো পা ফেলে রুমের দিকেই আসছে। ইয়াদকে দেখে যে কেউ বলতে পারবে সে ড্রিংক করেছে। ইমার পা যেনো জমে গেছে নাড়াতে পারছে না জায়গা থেকে। বিয়ের এতোদিনে ইমা একটা সিগারেট খেতে দেখেনি ইয়াদকে। প্রচন্ড রেগে গেলে মিনি ছাঁদে ঝুলানো পাঞ্চিং ব্যাগে পাগলের মতো পাঞ্চ করতে দেখেছে। তবে আজ ইয়াদ ড্রিংক করেছে সেটা কীভাবে স্বাভাবিক ভাবে নিবে ইমা ? কী হয়েছে ইয়াদের কোনো এমন করেছে তার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ইমা। ইয়াদকে হোচট খেয়ে পরে যেতে দেখে ইমা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দ্রুত গিয়ে ধরে ফেললো, ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট একটা হাসি দিলো। মদের বিশ্রি গন্ধে ইমার পেটের সব বের হয়ে আসার উপক্রম তবু ধরে রইলো ইয়াদকে। কখনো ড্রিংক না করার কারণে একটুতেই নেশা হয়ে গেছে পুরো। অন্যসময় হলে ইমা হয়তো মন্ত্র মুগ্ধের মতো ইয়াদের হাসিটা উপভোগ করতো কারণ ইয়াদকে এই প্রথম হাসতে দেখলো ইমা তবু এই অবস্থায়। ইমা চোখ সরিয়ে নিলো ইয়াদের থেকে। ইয়াদকে ধরে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে নিয়ে বেডে কাছে যেতেই ইয়াদ বেডের কার্নিশে ধাক্কা খেয়ে ইমাকে নিয়ে বেডে পড়ে গেলো। ইয়াদ নিচে পড়লো আর ইমা ইয়াদের উপরে। ইমার মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে অনেক আগেই, চুলগুলোতে মুখ ঢেকে গেছে, ইয়াদ নিজের হাতে চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো।

নেশাগ্রস্ত গলায় বললো, তুমি না অনেক সুন্দর, একদম সদ্য ফোঁটা নীল পদ্মের মতো। ইচ্ছে করে দুচোখ ভরে দেখতে থাকি।

ইয়াদের গলায় এমন কথা শুনে ইমার কান গরম হয়ে উঠলো। ইমা যদিও জানে ইয়াদ এসব নিজের সজ্ঞানে বলছে না আর কোনোদিন বলবে কিনা তাও জানা নেই। তবু ইমাকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিচ্ছে ইয়াদের কথাগুলো। ইমা বুঝে উঠতে পারছে না তার কী করা উচিত। ইয়াদ দু’হাতে ইমার কোমর জড়িয়ে ধরলো ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের স্পর্শে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এটা ঠিক হচ্ছে না ইয়াদ এখন নিজের মধ্যে নেই। ইমা ইয়াদের হাত ছাড়িয়ে উঠতে গেলে ইয়াদ ইমার হাত টেনে আবার নিজের উপর ফেলে দেয়।

ইয়াদ কাঁপা গলায় বললো, আমার মাও খুব সুন্দর আর সেই সৌন্দর্যের মায়াজালে আঁটকে গিয়েছিলো আমার বাবা। কিন্তু আমি সেই ভুল কখনো করবো না। এই পৃথিবীতে আবার আমার মতো নতুন কোনো ইয়াদের আগমন হতে দিবো না। তুমিও আমার মায়ের মতো ধোঁকা দিবে তাই না ইমা, বলো না ?

ইমা চমকে উঠলো ইয়াদের কথায়, কী বলছে এসব ইয়াদ ? ইমা কিছুই বুঝতে পারছে না।

ইমা কাঁপা গলায় বললো, কী বলছেন আপনি এসব ?

ইয়াদ অসহায় গলায় বললো, বলো না ইমা তুমিও আমার মায়ের মতো ধোঁকা দিবে ? ধ্বংস করে দিবে আমার সাজানো পৃথিবীটা। যেমনটা আমার মা করেছে তুমিও করবে ?

ইমা স্তব্ধ হয়ে গেছে ইয়াদের কথা শুনে। ইমা জানে ইয়াদের মা কতটা জঘন্য একজন মানুষ আর সেই ছবিগুলো তার প্রমাণ কিন্তু ইয়াদ কীভাবে ভাবলো ইমাও তার মায়ের মতো হতে পারে। ইমা নিজের বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

ইমার উত্তর না পেয়ে ইয়াদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ইমাকে নিজের উপর থেকে বিছানায় ফেলে ইমার গলা চেপে ধরলো ইমা কিছু বুঝে উঠার আগেই।

ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, কথা বলছিস না কেনো তুই ? আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর কেনো দিচ্ছিস না ? আমার কথা কানে যাচ্ছে না তোর ? তুইও করবি ঐ জঘন্য মহিলার মতো ? তুইও তো ঐ মহিলার মতো মায়াবী আর না চাইতেও আমি আমার বাবার মতো একই ভুল করে ফেলেছি। আমিও আটকা পড়ে গেছি তোর ঐ মায়াবী চোখের মায়াজালে।

ইমার দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে চোখদুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। কিছু বলার মতো শক্তিও পাচ্ছে না ইয়াদ এতো জোরে চেপে ধরেছে। ইমা কিছু বলার আগেই ইয়াদ নিজেই ইমার গলা ছেড়ে ইমার গালে হাত রাখলো। ইমা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো আর হাসফাস করতে লাগলো।

ইয়াদ ইমার চোখ নিজের হাতে মুছে দিয়ে বললো, কষ্ট হচ্ছে, এই তোমার কষ্ট হচ্ছে ? জানো আমারও কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, আমার জীবনটা এমন কেনো হলো জানতে ইচ্ছে করে। কেনো আমার মা আর পাঁচটা মায়ের মতো হলো না ? চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে আমার বাবা আমাকে বলছে ইয়াদ তোর মা খুনি, আমাকে আর আমার পুরো পরিবারটাকে খুন করেছে তোর মা।

ইমা অসহায় চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে আর তা দেখে ইমার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। ইমার হয়তো রাগ করা উচিত ইয়াদের ব্যবহারে কিন্তু ইমার রাগ হচ্ছে না বরং ইয়াদের জন্য কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই পাথরের মতো মানুষটার ভেতরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে ইমা। ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে উঠে বেড ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুহাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইমা দ্রুত উঠে এসে ইয়াদের সামনে বসলো।

ইয়াদের মুখটা নিজের হাতের আঁজলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, কী হয়েছে আপনার, আপনি এমন করছেন কেনো ? আমাকে বলুন কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার ?

ইয়াদ আবার ইমার দুগাল ধরে বললো, তুমি আমাকে কখনো ধোঁকা দিও না প্লিজ। আমি আর নিতে পারছি না মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

“মরে যেতে ইচ্ছে করছে” কথা শুনে ইমার বুকটা ধক করে উঠলো। ইয়াদকে কাঁদতে দেখে এমনিতেই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে ইমার। একটু কষ্টে এমন করে কাঁদার মতো মানুষ ইয়াদ নয় সেটা ইমা ভালো করেই জানে। ইমা একটু উঁচু হয়ে ইয়াদের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।

কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি কখনো আপনাকে ধোঁকা দেবো না, আপনি শান্ত হন দয়া করে।

ইমা ফ্লোরে বসে আছে আর ইয়াদ ইমার বুকে মাথা রেখে ফ্লোরে শুয়ে আছে শান্ত হয়ে। ইমা এতোক্ষণে খেয়াল করলো ইয়ারে হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে আবার রক্ত জমাটও বেঁধে আছে অনেকটা জায়গায়, পুরো হাতে রক্ত শুকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছুতে পাঞ্চ করার জন্য হাত কেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে থেমে গিয়েছিলো এখন আবার কোনো আঘাত লেগে বের হচ্ছে। ইমা ইয়াদের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আবার কেঁদে দিলো। ইয়াদ ইমার বুকে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে তাই ইমা সরতেও পারছে না ব্যান্ডেজ আনার জন্য। আশেপাশে তাকিয়ে বেড়ে নিজের একটা ওড়না দেখতে পেলো, সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পেঁচিয়ে দিলো ইয়াদের হাতে তারপর ওড়নার ওপর দিয়ে কিস করে আবার কাঁদতে লাগলো। ইয়াদ ঘুমিয়ে পড়েছে ইমার বুকে আর ইমা ইয়াদের মাথাটা দু-হাতে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। ইয়াদের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না ইমার আর নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেছে ইয়াদকে দেখে।

সারাদিন অফিসে ছটফট করেছে ইয়াদ, নিজেকে আটকাতে পারেনি তখন। অফিস থেকে বের হয়ে আবার ছুটে গিয়েছিলো আতিকের কাছে বাকিটা শুনতে। পুরোটা শুনে ইয়াদের বুকটা জ্বলতে শুরু করে। কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারে না। আতিকের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গাড়ির কাঁচে সজোরে পাঞ্চ করে। কাঁচ ভাঙার সাথে হাত কেটে রক্ত বের হতে থাকে সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে হাই স্প্রিডে ড্রাইভ করতে শুরু করে। ফাঁকা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদে কিছুটা সময়। কিন্তু কিছুতেই বুকের ভারী ভাবটা কমে না। ছুটে যায় নাইট ক্লাবের দিকে যেখানে সে আগে কখনো পা রাখেনি আর ভবিষ্যতে রাখবে কিনা তাও জানে না। অনেক সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করে গলায় ঢেলে দেয় এলকোহল নামক তিক্ত পানীয়। বুকের কষ্টটা কমলো কিনা ইয়াদ বুঝতে পারলো না তবে খেয়ে নিলো আরো কিছুটা। একসময় বের হয়ে আসে ক্লাব থেকে এলোমেলো পায় গাড়ির কাছে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পরেও যায় দুবার। এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে বাসায় পৌঁছায় কোনো মতে।

৩২.
ভোরের আলো ফোটতে শুরু করেছে বাইরে, পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। ইমা এখনো ফ্লোরে বসে আছে সেভাবেই। ইয়াদ ইমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে৷ ইমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটার দিকে। বাকি রাতটা ইমা এভাবেই পার করেছে। ইমা ভাবছে ইয়াদ কী কখনো সজ্ঞানে এভাবে তার কোলে মাথা রাখবে ? পরক্ষণে ভাবলো ইয়াদের দোষ কোথায় যদি সে মেয়েদের সহ্য করতে না পারে ? একটা ছেলে মেয়েদের সম্মান করতে শেখে তার মায়ের থেকে। মেয়ের বিশ্বাস করতে শেখে তার মাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার পর। একটা ছেলে নিজের মাকে দিয়ে সমস্ত মেয়ে জাতিকে চিনতে, জানতে শিখবে সেটাই স্বাভাবিক। একজন সন্তানের প্রথম শিক্ষক তার মা। তাহলে ইয়াদের দোষ কোথায় যদি মেয়েদের বিশ্বাস না করে। কারণ ইয়াদ জেনেছে যার চোখ দিয়ে তার দুনিয়া চেনার কথা সেই মানুষটাই জঘণ্য। তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করবে বাকি মানুষগুলোকে ? ইমা ইয়াদের কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।

বিড়বিড় করে বললো, আমি কখনো পারবো না আপনার জীবনের অতীতের কষ্টগুলো মুছে দিতে। তবে এটুকু বিশ্বাস অবশ্যই অর্জন করবো সব মানুষ এক হয় না। কখনো ধোঁকা দেওয়া তো দূর হাজার কষ্ট দিলেও আপনার দিকে অভিযোগ নিয়ে তাকাবো না।

ইয়াদের ঘুম ভেঙে গেছে আগেই তবে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না, মাথাটা ভারী লাগছে। সে বুঝতেও পারেনি সে কোথায় শুয়ে আছে আর বোঝার চেষ্টাও করেনি৷ ইমা ইয়াদের কপালে কিস করতেই ইয়াদের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ইমা বিড়বিড় করে কথাগুলো বললেও ইয়াদের কথাগুলো শুনতে প্রবলেম হলো না ইমার এতো কাছে থাকার জন্য। চোখ বন্ধ অবস্থায় ইয়াদ অনুভব করতে পারলো সে কোথায় আছে। ইমার কথাগুলো শুনতেই চোখের কোণ বেয়ে পানির কণা গাড়িয়ে গেলো। সবটা মনে না পড়লেও রাতের অনেক কথা আবছা মনে পরে গেলো। ইমা ইয়াদের চোখের কোণের পানি ঠিকই খেয়াল করলো। হাতের আঁজল পেতে পানির কণাটা হাতের তালুতে নিলো।

মুচকি হেঁসে বললো, ছেলেদের চোখের পানি মুক্তার চেয়েও অনেক বেশি দামী হয়। মুক্তা তো গভীর সাগরের অতলে ঝিনুকের মাঝে লুকিয়ে থাকে আর ছেলের চোখের পানি মনের ঠিক কতটা গভীরে লুকানো থাকে সেটা হয়তো কেউ কখনো খুঁজে বের করতে পারবে না। মুক্তা তো খোঁজলেই পাওয়া যায়।

ইয়াদ মনে মনে বললো, তোমাকে আর প্রমাণ করতে হবে না সব মানুষ এক হয় না। তার প্রমাণ তুমি প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছো। গতরাতে তোমার সাথে যে বিহেভটা করেছি জানি না তার জন্য সরাসরি কখনো ক্ষমা চাইতে পারবো কিনা। তাই মনে মনে চেয়ে নিলাম। যে জঘন্য মানুষগুলোর জন্য তোমার মতো নিষ্পাপকে ভুল বুঝতে বাধ্য হয়েছিলাম তাদের শাস্তি দেওয়ার সময় হয়ে গেছে ইমা, কঠিন শাস্তি।

ইয়াদের ইচ্ছে করছে না ইমার কোল থেকে নিজের মাথা সরিয়ে নিতে। মনে হচ্ছে অনেক বছর পর একটা শান্তির জায়গা খুঁজে পেয়েছে। সেখানে থাকলে কোন কষ্ট তাকে ছুঁতে পারবে না। সারারাত বসে থাকার জন্য ইমার পিঠ ব্যাথা করছে। ইমা নড়াচড়া করতেই ইয়াদ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো, চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। ইয়াদ অপলক তাকিয়ে আছে ইমার চোখদুটোর দিকে। ইমাও থমকে গেছে ইয়াদের ঘুমঘুম চোখে তাকানো দেখে। তবে মনে মনে ভয় পাচ্ছে, ইয়াদ কী রিয়াকশন দেবে নিজেকে ইমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে দেখে ? ইয়াদের চোখ গেলো ইমার গলার দিকে, ফর্সা গলায় ইয়াদের হাতের ছাপের কালো দাগ পরে গেছে। ইয়াদের বুকটা কেঁপে উঠলো ইমার গলা দেখে, মেয়েটাকে কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবে নিজেও কষ্ট পেলো।

ইমা কাঁপা গলায় বললো, আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার জন্য লেবুর পানি নিয়ে আসছি, খেয়ে নিলে ভালো লাগবে।

ইয়াদ ইমার কথায় কর্ণপাত না করে আগের মতোই ইমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমা ইতস্তত বোধ করছে ইয়াদের এমন দৃষ্টি দেখে।

ইয়াদ আনমনে বললো, সামনে যে ঝড়টা আসছে, পারবে তো আমার হাতটা শক্ত করে ধরে পাশে থাকতে, নাকি ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে ?

ইমা ইয়াদের মুখে এমন কথা শুনে একটু বেশি অবাক হলো, কারণ এখন যে ইয়াদ নেশায় নেই সেটা বুঝাই যাচ্ছে। তাহলে এমন কথার মানে কী ?

ইমা চিন্তিত হয়ে বললো, কী হয়েছে আপনার, কী বলছেন এসব ?

ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, হয়নি তবে হবে।

চলবে,,,,,,

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩২

ইমা বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বললো, কী হবে ?

ইয়াদ আর কিছু না বলে উঠে বসলো তারপর ইমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেঁসে বললো, সেটা খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে। তবে যাই হবে তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখো।

ইয়াদ ইমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ইমা সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। কেনো যেনো ইমার ভয় করতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে যেটা হতে চলেছে সেটা ভালো কিছু হবে না বরং খুব খারাপ হবে। ইয়াদের হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে যাওয়া বিশাল কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে। ইমা আর ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে না থেকে উঠে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তবে মাথা থেকে চিন্তাটা কিছুতেই গেলো না। ইয়াদ শাওয়ার ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যা করার আজই করতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে। ইয়াদ শাওয়ার নিয়ে বের হলো টাওয়েল পড়ে, কিছু নিয়ে যায়নি ওয়াশরুম যাওয়ার সময় তাই বাঁধ্য হয়ে টাওয়েল পড়ে বের হতে হলো। ইয়াদ বিষন্ন মন নিয়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে। ইমা লেবুর পানি নিয়ে রুমে এসে দেখে ইয়াদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে, কোমরে একটা টাওয়েল জড়ানো। ইয়াদের দিকে তাকিয়ে সেদিনের মতো ইমার হাতে থাকা গ্লাসটা কাঁপতে লাগলো, এতে উপরে ঢেকে দেওয়া ঢাকনা আর গ্লাসে ঠকঠক শব্দ তৈরী হতে লাগলো। ইয়াদ অদ্ভুত শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইমা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। ইয়াদ ধীর পায়ে ইমার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো আর তাতে ইমার কাঁপা-কাঁপি অনেক বেড়ে গেলো। ইয়াদ ইমার হাত থেকে লেবুর পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ইমার দৃষ্টি ইয়াদের মসৃণ বুকে বিন্দু বিন্দু পানির দিকে। ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাঁসলো।

আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ইয়ানা কী উঠেছে ?

ইয়াদের মুখে ইয়ানার কথা শুনে ইমার বুকটা ধক করে উঠলো। ইয়াদের চিন্তায় ইয়ানার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। এখন ইয়াদকে যদি বলে ইয়ানা গতকাল দুপুর থেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে নিজেকে, তাহলে ইয়াদ তাকে কী করবে কে জানে ?

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কী হলো কথা বলছো না কেনো ?

ইমা আমতা আমতা করে বললো, ইয়ে মানে ?

ইয়াদ সিরিয়াস হয়ে বললো, ইমা কী হয়েছে স্পষ্ট করে বলো ?

ইমা কাঁপা গলায় বললো, ইয়ানা আপু গতকাল দুপুরে ভার্সিটি থেকে এসে রুমে গেছে আর বের হয়নি। আমি অনেক ডেকেছি দরজাও খুলেনি।

ইয়াদ চমকে উঠে বললো, হোয়াট,,,,? ইয়ানা গতকাল দুপুর থেকে রুমে বসে আছে আর তুমি এখন আমাকে জানাচ্ছো ?

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আপনার ফোন অফ ছিলো আমি কীভাবে জানাতাম ?

ইয়াদ রেগে বললো, আমার ফোন রাতে অফ ছিলো দুপুরে নয় ইডিয়ট। তুমি তখনই আমাকে জানাওনি কেনো ?

ইমা ভয় পেয়ে গেলো ইয়াদের রাগ দেখে তবু ধীর গলায় বললো, আপু দুপুরে বলেছিলো ক্লান্ত লাগছে ঘুমাবো, ডিস্টার্ব করো না। কিন্তু আর খুলবে না সেটা আমি জানবো কীভাবে ? আর যখন আপনাকে জানাতে যাবো তখন আপনার ফোন অফ হয়ে গিয়েছিলো।

ইয়াদ ইমাকে আর কিছু না বলে দ্রুত চেঞ্জ করে ইয়ানার রুমের দিকে দৌড় লাগালো। দরজায় জোরে জোরে নক করে ইয়ানাকে ডাকতে লাগলো। অনেক সময় ডাকার পরও যখন সাড়া পেলো না, ইয়াদের ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। বোনটার কিছু হলে ইয়াদ বাঁচতে পারবে না। দরজা ভাঙার সীদ্ধান্ত নিতেই ইয়ানা দরজা খোলে দিলো।

ইয়াদ ইয়ানার দু’কাধ ধরে রাগী গলায় বললো, কী হয়েছে দরজা খুলছিলি না কেনো ? জানিস কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ? কী হয়েছে তোর ?

ইয়াদ এতগুলো প্রশ্ন শেষে ইয়ানার দিকে খেয়াল করলো। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়াদের কলিজা কেঁপে উঠলো। চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে ফোলে আছে।

ইয়াদ ইয়ানার মুখটা দু’হাতে ধরে বললো, কী অবস্থা করেছিস নিজের ? কী হয়েছে বোন, আমাকেও বলবি না ?

ইয়ানা শান্ত গলায় বললো, ভাইয়া গতকাল মাথা ব্যাথা করছিলো তাই ভার্সিটি থেকে এসে শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙে অনেক রাতে তারপরে আর ঘুমাতে পারিনি তাই এমন দেখাচ্ছে। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো তাই আর কী শুনতে পাইনি ডাকছিলে।

ইয়ানার কথার সাথে মুখের অবস্থার মিল পেলো না ইয়াদ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারা রাতে এক ফোঁটা ঘুমায়নি ইয়ানা।

তবু কথা বাড়ালো না ইয়াদ ইয়ানার মাথায় হাত রেখে বললো, ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে।

ইয়ানা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, কোথায় ?

ইয়াদ মলিন হেঁসে বললো, গেলেই দেখতে পাবি আর ইশানকেও বল ও আমাদের সাথে যাবে।

ইয়ানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইয়াদ চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। ইমা ইয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো সেও চলে গেলো ইয়াদের পিছু পিছু।

ইমা রুমে ঢুকে পেছন থেকে বললো, কোথায় যাবেন ?

ইয়াদ রেডি হতে হতে বললো, গেলেই দেখতে পাবে। আজ আমার জীবনের আরো একটা অধ্যায় তোমাদের সামনে আসবে। রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি করে।

৩২.
ইয়াদের কথায় সবাই ব্রেকফাস্ট করে নিলো তবে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ইয়াসির বা রুবিনার কোনো দেখা মিললো না। এটা নতুন কিছু নয় তাই কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। খাওয়া শেষে সবাই একসাথে বের হলো। ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর ইমা তার পাশে বসে আছে, পিছনের সীটে ইশান আর ইয়ানা।

আশেপাশে তাকিয়ে ইয়ানা বললো, ভাইয়া এটা কোথাকার রাস্তা ?

ইয়াদ উত্তরে কিছু বললো না চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো। উত্তর না পেয়ে ইয়ানাও চুপ করে গেলো। প্রায় জঙ্গলে ঘেরা একটা পুরানো বাড়ির সামনে ইয়াদ গাড়ি থামালো। আশেপাশে তাকিয়ে সবার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। সকাল বেলায় মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

ইয়ানা আর ইমা তো ভয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে।

ইয়ানা ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললো, ভাইয়া তুমি আমাদের ভূতের বাড়ি কেনো নিয়ে এসেছো ?

ইয়াদ কিছু না বলে সামনে আগাতে লাগলো আর তার পিছু পিছু সবাই। পায়ের নিচে শুঁকনো পাতার শব্দেও গা শিউরে উঠছে বারবার। ইশানের পায়ের নিচে একটা গাছের শুকনো ডাল পরলে মট করে ভেঙে গেলো। ইমা চিৎকার করে ইয়াদের হাত আঁকড়ে ধরে ফেললো আর ইয়ানা ভয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। ইয়াদ সেদিকে নজর না দিয়ে সামনের একটা গোডাউনের মতো জায়গার দিকে এগিয়ে গেলো। ইশান ইয়ানাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে যাওয়ার ইশারা করলো। ইয়াদ সামনে যেতেই ভেতর থেকে দরজা খোলে গেলো। ইয়াদের হাত ধরে ইমাও ভেতরে ঢুকে পড়লো আর পেছন পেছন ইশান আর ইয়ানা। ভেতরে গিয়ে অবাক হলো কারণ ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছে না এটা পুরনো গোডাউন তবে সামনে তাকিয়ে ইমা, ইয়ানা আর ইশানের পা থমকে গেলো ইয়াদ ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে পড়লো।

ইশান চমকে উঠে বললো, এসব কী ভাইয়া ? বাবা-মাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে কারা ?

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, আমি।

তিনজনই চমকে তাকালো ইয়াদের দিকে আর ইয়ানা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু কেনো ?

ইয়াদ আগের ভঙ্গিতে বললো, উনাদের পাপের হিসাব দেওয়ার সময় হয়েছে তাই।

ইশান এবার রেগে বললো, ভাইয়া এসব কী হচ্ছে ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

ইয়াদ ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু অপেক্ষা কর সব বুঝতে পারবি।

ইয়াদ ইশারা করতেই জাম্বী গিয়ে রুবিনা আর ডি কের মুখের টেপ খুলে দিলো।

ডি কে রেগে চিৎকার করে বললো, এসব কী ধরনের বেয়াদবি ইয়াদ ?

ইয়াদ দিগুণ তেজী গলায় বললো, গলা নামিয়ে কথা বলুন মিস্টার দিসার কবির ওরফে ডি কে।

ইয়াদের মুখে দিসার কবির নাম শুনে মনে হয় আকাশ থেকে পড়লো রুবিনা আর দিসার।

কাঁপা গলায় দিসার বললো, কীসের ডি কে আর কে দিসার ? ইয়াদ তোমার মাথা ঠিক আছে ? আমি তোমার বাবা ইয়াসির হামিদ।

ইয়াদ একটা চেয়ার টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো আর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, নিজের নামই ভুলো গেছেন মিস্টার দিসার কবির। তা অবশ্য ভুলবারই কথা, এতোগুলা বছর ধরে ইয়াসির হামিদের মুখোশ যে পরে আছেন। তবে মিস্টার দিসার আপনি ভুলে গেছেন সামান্য একটা প্লাস্টিক সার্জারি করে কারো মুখোশ লাগানো গেলেও কখনো সেই মানুষটা হয়ে উঠা যায় না।

ইশান অবাক হয়ে বললো, ভাইয়া তোমার মাথা ঠিক আছে তো নাকি ? কী সব বলে যাচ্ছো পাগলের মতো ?

ইয়াদ ইয়ানা আর ইশানের উদ্দেশ্য বললো, তোদের আজ এমন কিছু সত্যি জানাতে এখানে আনা হয়েছে যার কিছুটা আমি আজ থেকে বারো বছর আগেই জেনেছিলাম। পুরোটা আমাকে তখন জানানো হয়নি কারণ বয়স কম ছিলো সামলে উঠতে পারবো না। কিন্তু যতটুকু জেনেছিলাম সেটাও সামলে উঠতে পারিনি আর তার ফল স্বরুপ তোদের সামনের এই রোবটের মতো আচরণ করা আবরার হামিদ ইয়াদ। যে সেই বারো বছর আগে হাসতে ভুলে গেছে, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভুলে গেছে। তবে সব সত্যি জানার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর বাকিটাও জানা হয়ে গেছে আমার। এবার জানার পালা তোদের আর ইমা তোমারও আজ কিছু জানার আছে তাই কোনো প্রশ্ন না করে শুধু দেখতে থাকো। তো মিস্টার দিসার আমরা কোথায় ছিলাম ? আপনি নিজের নাম তো ভুলে গেছেন দেখুন তো এই মানুষটাকে চিনতে পারেন কি না ?

ইয়াদ ইশারা করতেই আতিক প্রবেশ করলো রুমে তাকে দেখে দিসারের ভ্রু কুঁচকে গেলো কারণ সে চিনতে পারছে না আতিককে।

দিসার বিরক্তি নিয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, কে এটা ?

ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, চিনতে পারলেন না তো, চেনার কথাও নয়। কারণ উনি ইয়াসির হামিদের প্রাণ প্রিয় বন্ধু, দিসার কবিরের নয়। উনার আরো একটা পরিচয় আছে, উনি ইয়াসির হামিদের আদরের বোনের হবু স্বামী ছিলেন। যে বোনকে মাথায় আঘাতের পর আঘাত দিয়ে আপনি নিজ হাতে খুন করেছেন। আর উনাকেও খুন করতে চেয়েছিলেন তবে সেটা না চিনেই।

দিসার এবার চমকে উঠলো ইয়াদের কথায়, কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়তে লাগলো। ইয়াদ তা দেখে মুচকি হাঁসলো আর বললো, কোনো ব্যাপার না পরের জনকে আপনি অবশ্যই চিনতে পারবেন।

ইয়াদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এক ভদ্রলোক রুমে প্রবেশ করলো তাকে দেখে দিসার আর রুবিনার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হলো।

দিসার উত্তেজিত গলায় বললো, কামরুল তুই ?

ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে নিজেদের পার্টনারকে।

রুবিনা কথা বলতে ভুলে গেছে। এতো বছর পর তাদের সত্যিটা এভাবে সামনে আসবে কখনো ভাবেনি তারা কেউ। দুজনের বুঝতে বাকি রইলো না আর কিছুই অজানা নেই ইয়াদের।

দিসার রেগে বললো, কামরুল তুই আমার থেকে এতগুলো টাকা নিয়ে বলেছিলি জীবনে আর কোনোদিন আমাদের সামনে আসবি না আর সত্যিটা কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না।

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না মিস্টার দিসার। আজ হোক বা কাল, সত্যিটা সামনে আসবেই।

দিসার এবার শয়তানি হেঁসে বললো, তো এতোকিছু জেনে গেছো আর এটা জানোনি আমি কে আর কী ?

ইয়াদ বাঁকা হেঁসে বললো, এতোটা সময় নিয়েছি কোনো কাঁচা কাজ করতে নয় মিস্টার দিসার কবির ওরফে ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া ডি কে। আচ্ছা আপনার কানে কী একবারও আঘাত করেনি আমি আপনাকে কতোবার ডি কে বলে ডেকেছি, তবু বুঝতে পারেননি আমি কোনো ডি কে বলছি আপনাকে। এই মাথা নিয়ে এতকিছু কীভাবে করলেন বলুন তো ?

ইয়াদের কথায় দিসারের মুখ হা হয়ে গেলো, সবসময় ডি কে নামে সবাইকে সাড়া দিতে দিতে তার খেয়ালই হয়নি ইয়াদ তাকে ডি কে ডেকেছে।

ইশান অবাক হয়ে বললো, মাফিয়া ?

ইয়ানা থম মেরে দাড়িয়ে আছে, কী হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমা কিছুটা জানতো বলে তেমন রিয়াকশন দিচ্ছে না বরং পুরোটা জানার চেষ্টা করছে। রুবিনা হা করে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে।

ইয়াদ ইশানের প্রশ্নে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ইয়েস মাফিয়া, ড্রাগস সাপ্লাই, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র পাচার এমন আরো অনেক মহান কাজের লিডার উনি। জানেন তো মিস্টার ডি কে, আমি চাইলে আরো বারো বছর আগেই প্রশ্ন তুলতে পারতাম আমার বাবার খুনের, যেদিন এই সত্যিটা জেনেছিলাম। কিন্তু তখন কিছুতেই পেরে উঠতাম না আপনার সাথে৷ আমি চাইলে ডিএনএ টেস্টের সাহায্যে প্রমাণ করতে পারতাম আপনি আপনার বাবা নন। তবে এতে আপনার লস হতো না বরং আমার লস হতো। টাকার জোরে প্রমাণ করে দিতেন আপনি ইয়াসির হামিদ আর আমি ইয়াসির হামিদের সন্তান আবরার হামিদ ইয়াদ নই। তাই ফিরে গিয়েছিলাম নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলতে আর আজ দেখুন আপনার ক্ষমতা আমার সামনে শূন্য।

ইয়ানা আর না পেরে ইয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ভাইয়া তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হচ্ছে এসব, উনি আমাদের বাবা।

ইয়াদ ইয়ানার দুগালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, ইয়ানা উনি আমাদের বাবা নন। আমাদের বাবা তো তোর জন্মের আগেই খুন হয়ে গেছে এই নরপশুদের হাতে।

ইয়াদ চোখ মুছে জাম্বীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই বড় পর্দায় একটার পর একটা সেই ছবিগুলো ভাসতে লাগলো। ইয়ানা দু কদম পিছিয়ে গেলো সাথে ইশান। ইয়ানা আর ইশান চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে রুবিনা আর দিসারের দিকে তাকালো। রুবিনা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেললেও অনুশোচনার কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না দিসারের চেহারায়।

ইয়ানা বললো, আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না ভাইয়া এই ছবিগুলো,,,,

ইয়াদ দিসারের দিকে তাকিয়ে বললো, তো মিস্টার ডি কে বুঝানোর দ্বায়িত্বটা আপনি নিবেন না কি আমাকেই বলতে হবে।

দিসার রেগে চিৎকার করে বললো, হ্যাঁ আমরা খুন করেছি ইয়াসির হামিদ আর তার পুরো পরিবারকে।

ইয়ানা পরে যেতে নিলে ইমা ইয়ানাকে সামলে নেয় আর ইয়াদ তাকিয়ে আছে তার মা নামক মানুষটার দিকে। আজ কেনো চোখ তুলে নিজের সন্তানদের দিকে তাকাতে পারছে না। এখনো তো পুরোটা জানে না ইয়ানা আর ইশান। পুরোটা জানলে মা নামক মানুষটার মুখ দেখবে তো আর কোনোদিন ? দিসারের পরিণতি ইয়াদের ঠিক করা হয়ে গেছে কিন্তু রুবিনার কী শাস্তি দেবে সেটা ঠিক করতে পারছে না। সৎ মা তো নয়, নিজের আপন মা, যার গর্ভে দশ মাস দশদিন আশ্রয় পেয়ে এই পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এ তো সেই মা যার এক ফোঁটা দুধের দাম দেওয়ার মতো সামর্থ্য আল্লাহ পৃথিবীর কোনো সন্তানকে দান করেনি। কথাগুলো ভাবতেই ইয়াদের চোখ ভড়ে উঠলো পানিতে। পরক্ষণে চোখের সামনে ভেসে উঠলো দম আটকে আসা বাবার একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করা সেই দৃশ্য।

ইয়াদ রুবিনার সামনে গিয়ে বললো, একটু মায়া হয়নি তার জন্য যার সাথে ছয়টা বছর সংসার করছেন ? একটু মায়া হয়নি যার সাথে ছয় ছয়টা বছর ভালোবাসার অভিনয় করে গেছেন, অভিনয় করতে করতে ভালো না বাসলেও, তার জন্য একটু মায়ারও জন্ম হয়নি আপনার মনে ? একটুও হাত কাঁপেনি যার সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করে পৃথিবী দেখিয়েছেন তার শ্বাসরুদ্ধ করতে।

কথাগুলো বলতে বলতে ইয়াদের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তবু ইয়াদ থামলো না। আবার বললো, একটু কষ্ট হয়নি যারা নিজের বাবা-মায়ের মতো আপনাকে আগলে নিয়েছিলো তাদের মৃত্যুর পরিকল্পনায় সামিল হতে। আপনার পরিবার তো আপনাকে আবর্জনা মনে করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো আর সেখানে ঐ মানুষগুলো আপনাকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছিলো। কষ্ট হয়নি তাদের ধোঁকা দিতে, একটু বিবেকও বাঁধেনি আপনার ?

রুবিনা কিছু বলছে না মাথা নিচু করে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে। ইয়ানা অপলক তাকিয়ে আছে মা আর ভাইয়ের দিকে। এখনো সে অনেক কিছুই বুঝতে পারেনি আর ইশানও। তাদের মনে অনেক অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছে ক্রমাগত।

ইশান ভাঙা গলায় বললো, ভাইয়া আমি,,,

ইয়াদ ইশানের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বললো, একটু অপেক্ষা কর একে একে সব প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবি।

চলবে,,,,