তীব্রস্রোত পর্ব-০৯

0
83

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#তীব্রস্রোত
#পর্ব ৯
.
.
সুপ্তি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে সেই ফেলে আসা দিন গুলোর কথা, যা খুব একটা সুন্দর ছিলনা তাদের জন্য। সেই সুপ্রিয়ার পালিয়ে যাওয়া, তার বাবা মায়ের কান্না, তার বাবার সেই তার মায়ের সাথে বলা কথা গুলো সব এক এক করে সুপ্তি ভাবতে রইল, এর মধ্যে কেউ রুমে এসে সুপ্তি কে ডাকতে রইল। যা শুনে সুপ্তি চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখল সুপ্রিয়া ছিলো। সুপ্তি এগিয়ে এসে বলে উঠল।

…..আরে তুই কেনো আসতে গেলি আমাকে ডাকলেই তো পারতি?

…..আরে আমাকে তোরা আরও রুগী বানিয়ে দিচ্ছিস, এতটা অসুস্থ আমি নই।

….হুম ঠিক আছে, এখন বল কিছু বলবি?

…..হ্যা আসলে আম্মু তোকে তখন নিশ্চয়ই খুব বকে ছিলো?

…..না আপু তেমন কিছু না। আম্মু কথা বলতে আসছিল, কথা বলে চলে গেছে।

…..মিথ্যে বলছিস তাই-না?

….মিথ্যে কেনো বলব? আম্মু আমাকে তেমন কিছু বলেনি।

…..সত্যি তো?

…..হ্যা বাবা সত্যি।

…..আচ্ছা শোন একটা সত্যি কথা বলবি?

…..হ্যা বল?

…..তুই স্রোত বা তীব্র কাউকে পছন্দ করিস? তবে আমাকে বল আমি সবাইকে রাজি করিয়ে নেবো। খুব ভালো হবে কিন্তু দু-বোন সারাজীবন একই বাড়িতে থাকবো।

সুপ্তি তার বোনের কথা শুনে কিছুটা নয় অনেকটা অবাক হলো, কারণ সে নিজে তো মা বাবার কথা না ভেবেই এই পথ বেছে নিয়েছে এখন সুপ্তি কেও আহবান জানাচ্ছে? সুপ্তি সুপ্রিয়ার কথায় কিছুক্ষণের জন্য বোবা-ই হয়ে গেল।

……কী রে কিছু বলছিস না যে?

…..কী বলব আপু আমি বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা বলি শোন, আমি তোর দেবর দের এমন নজরে দেখিনি কখনো, তাদের বন্ধু ভেবেছি, শুধু ভালো দুটো বন্ধু, এর বেশি কিছু নয়। আর আমি চাইনা তুই যে ভুল করেছিস তা পুনরাবৃত্তি ঘটাতে। তাই এই কথা আর কখনো মাথায় ও আনিস না, কেউ শুনলে জিনিসটা তেমন একটা ভালো হবে না।

…..ওরা দুজনেই খুব ভালো, ছেলে হিসেবে।

…..আমি তা তোর থেকে খুব ভালো করেই জানি, সত্যি ওরা ছেলে হিসেবে খুব ভালো, বাট আমি ওদের সেই চোখে দেখিনি কখনো।

…..(সুপ্তি হেটে যাচ্ছিল) যদি আব্বু বা আম্মু স্রোত বা তীব্রর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে?

…..(সুপ্তি মুচকি হেঁসে) এটা এই জনমে সম্ভব নয়।

…..তুই গ্রান্টি দিয়ে কীভাবে বলছিস?

…..কারণ আমি সুপ্তি। আর তুই আমার বিষয় কথা বলছিস।

এই বলে সুপ্তি ওয়াশ রুমে চলে গেল। আর সুপ্রিয়া সুপ্তির চলে যাওয়া দেখে সেখান থেকে চলে এলো।

সুপ্রিয়া রুমে গিয়ে মুখ ভাড় করে বসে রইল, যা দেখে ফারাবী বলে উঠল।

……তোমার আবার কী হয়েছে?

…..কিছু না।

…..তবে এভাবে বসে আছো যে?

…..আচ্ছা শোনো না। সুপ্তিকে যদি একেবারের জন্য এখানে রেখে দেই তবে কেমন হয়?

……তোমার আম্মু আব্বু রাজি হবে না, কারণ মাত্র কয়েক দিনের জন্য আনতে গিয়েছিলাম তখনই কত কিছু বলে বুঝিয়ে সুপ্তিকে নিয়ে আসতে হয়েছিল, বারবার বলেছিল তারাতাড়ি সুপ্তিকে দিয়ে যেও, আর এখন সব সময়ের জন্য এখানে কিছুতেই রাখবে না। এই দু-দিনই আব্বু কত রিকোয়েস্ট করে রাখছে তা শুধু আব্বুই জানে।

…..আরে আমি সেই রাখার কথা বলছি না।

…..তবে?

…..আমরা যদি সবাইকে সুপ্তির আর তীব্র বা স্রোতের বিয়ের কথা বলি, সুপ্তি যদি এই বাড়ির বউ হয়ে আসে?

…..হুম খারাপ হয় না। বাট আমার মনে হয়না কেউ রাজি হবে।

…..রাজি কেনো হবে না?

…..তুমি সুপ্তিকে জিজ্ঞেস করেছ আগে?

…..হ্যা ওর কাছ থেকেই তো আসলাম।

…..কী বলেছে সে?

…..তেমন কিছু না। ও বলল, ও নাকি সেই চোখে দেখিনি কখনো ওদের। আর আব্বু আম্মু কখনো মানবে না এই সম্পর্ক।

……তবে আমার মনে হচ্ছে, না এগোলেই ভালো হবে। কারণ সুপ্তি খুব ভালো করে জানে আম্মু আব্বুর বিষয়।

…..তুমিও সুপ্তির মতই কথা বলছ?

…..হ্যা বলছি, তুমি শুধু শুধু এসব কথা নিয়ে বারাবাড়ি করো না, শেষে সুপ্তির এখানে আসা জেনো বন্ধ না হয়ে যায়?

…..হবে না, তুমি দেখো আমি সবাইকে রাজি করিয়েই ছাড়বো।

…..হুম তোমার ইচ্ছে।

এই বলে ফারাবী ও রুম থেকে চলে গেল।

পরদিন সুপ্তি ইউনিভার্সিটির জন্য বের হচ্ছিল, ঠিক তখনই ফারাবী এসে বলে উঠল।

….চলো আমি এগিয়ে দিয়ে আশি।

…..প্রয়োজন নেই দুলাভাই আমি চলে যাবো।

……ভাই তোর টেনশন করতে হবে না তোর শালিকাকে আমরা তার ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

…..না থাক বেয়াই আমি চলে যেতে পারব।

…..না না তা কী করে হয় বেয়াইন আমরা এত্তগুলা মানুষ থাকতে আপনি একা একা যাবেন?

…..ঠিক আছে দুলাভাই আমি আপনার সাথেই আসছি।

…..আরে বেয়াইন এটা কেমন কথা আমরা এত আশা বাদী হয়ে আসছি আর আপনি ভাইয়ার সাথে যাবেন?

…..স্যরি বেয়াই আমি ঘুরতে যাচ্ছি না ভার্সিটিতে যাচ্ছি। দুলাভাই চলেন।

সুপ্তি এই কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, সুপ্তির পিছু পিছু ওরা ৩ ভাই ও বের হয়ে গেল। সুপ্তি গিয়ে ফারাবীর বাইকের কাছে দাঁড়িয়ে গেল। ফারাবী বাইকে উঠে বসতেই সুপ্তিও উঠে বসে পড়ল।

বাইক এসে ভার্সিটির গেইটে থামতেই সুপ্তি নেমে দাঁড়ায়, এর মধ্যে পাশ থেকে কেউ বলে উঠল।

…..সুপ্তি।

…..(ঘুরে তাকিয়ে) স্যার আসসালামু আলাইকুম।

……ওয়ালাইকুম আসসালাম।

……স্যার ইনি আমার দুলাভাই।

…..আসসালামু আলাইকুম স্যার।

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ তোমার আব্বুর সাথে কথা হয়েছিল, বলল তোমার বোনের নাকি বেবি হয়েছে তাই তুমি একটু ব্যস্ত ছিলে?

…..জ্বি স্যার।

…..এখন সে কেমন আছে?

…..জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার।

…..ওহ আচ্ছা তবে চলো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

…..জ্বি স্যার, আচ্ছা দুলাভাই আমি এখন তবে আশি?

…..হ্যা সাবধানে বাসায় চলে যেও।

…..জ্বি ইন’শা’আল্লাহ।

সুপ্তির তার স্যারের পেছন পেছন ক্লাসে চলে গেল। সুপ্তি এক বাঁচা বেঁচে গেল আজ, আজ যদি সে #তীব্রস্রোত এর সাথে আসতো তবে হয়েছিল, স্যার নিশ্চয়ই সুপ্তির আব্বুকে ফোন দিয়ে বলে দিতেন? তারপর আরও কত সমস্যা ওহ গড সুপ্তি আজ এক বাঁচা বেঁচে গেল। সুপ্তি চটজলদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের ক্লাস রুমে চলে গেল। স্যার সুপ্তির আব্বুর ফ্রেন্ড যার জন্য মাঝেমধ্যে সুপ্তি যা যা করে সবই সে ফোন দিয়ে সুপ্তির আব্বু কে জানিয়ে দেয়, যার জন্য সুপ্তির ভয় করছিল

ক্লাস শেষে সুপ্তি ভার্সিটির গেইটে আসতেই দেখল #তীব্রস্রোত দাঁড়িয়ে আছে যা দেখে সুপ্তির একটু রাগ হলো। সুপ্তি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।

…..আপনারা এখানে কেনো?

…..ভাবী ফোন দিয়ে বলল আপনাকে জানো নিয়ে যাই।

…..এই আপু ও না। ঠিক আছে চলেন,

ওরা একটা অটোতে উঠে বসে পড়তেই সুপ্তিও উঠে বসল।

বাড়িতে এসে সুপ্তি সোজা গেস্ট রুমে চলে এলো। শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে সুপ্তি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে দেখল তীব্র দাঁড়িয়ে আছে, সুপ্তি ওড়না বিছানার উপরে রেখে গিয়েছিল। যার জন্য সুপ্তি তীব্র দুজনেই সাথে সাথে ঘুরে গেল, সুপ্তি তার হাতের টাওয়াল-টা দিয়ে নিজেকে ডেকে নিয়ে ঘুরে বলে উঠল।

…..এটা কেমন অসভ্যতা বেয়াই? কারো রুমে আসার আগে তার পারমিশন নিতে হয় এটাও কী আপনার জানা নেই?

……স্যরি বেয়াইন আসলে দরজা ভেজানো ছিলো, তাই নক করেই চলে এলাম। আমি ভাবছি আপনি হয়ত শুনেছেন।

…..জ্বি ঠিক আছে বলেন কিছু বলার ছিলো?

…..হ্যা আসলে ভাবী ডেকেছিল আপনাকে।

….. জ্বি আপনি যান আমি আসছি।

তীব্র চলে যেতেই সুপ্তি গিয়ে দরজা বন্ধ করে নিলো, সুপ্তি রুমে ঢুকে যে দরজা লক করেনি তা সে ভুলেই গিয়েছিল। কারণ তাদের বাড়িতে তো দরজা লক করার প্রয়োজনই হয়না।

সুপ্তি ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে চুল গুলো ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেল তার বোনের রুমে।

…… হ্যা আপু কীরে কী হয়েছে তোর?

…..আমার আবার কী হবে?

…..কেনো এই তো তোর দেবর বলে আসলো তুই ডেকেছিস?

…..হ্যা তা তো ডেকেছি। আমি একটু শাওয়ার নেবো ভাবছিলাম, তুই একটু সাহায্য করবি?

….হুম চল।

বিকেল দিকে সুপ্তি নিজের রুমেই চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো, তখনই দরজায় খটখট শব্দ হলো, সুপ্তি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, #তীব্রস্রোত দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।

……আপনারা এখানে?

…..হ্যা আজকাল আপনি তো ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তাই ভাবলাম আমরাই চা নিয়ে চলে আশি।

…..হুম ঠিক আছে ভেতরে আসেন।

ওরা দু’জন ভেতরে এসে বসে পড়ল সুপ্তিও বসলো, তিন জন চা পান করতে করতে অনেক কথা বলল।

…..বেয়াইন আপনার পছন্দের খাবার কী?

…..কেনো বেয়াই?

…..না এমনিতেই জানার ইচ্ছে হলো।

…..আইসক্রিম, চকলেট।

…..ওহ খুব ভালো।

…..তবে বেয়াইন আপনার পছন্দের ফুলের নাম কী?

…..এতো খোঁজ নিয়ে কী হবে বেয়াই?

…..আহ বলেন না বেয়াইন, যদি কখনো ইচ্ছে হয় দিতে?

…..সেই ইচ্ছেটা না হওয়াটাই ভালো হবে বেয়াই। তাই আপনাদের না জানাটাই ভালো।

…..প্লিজ বেয়াইন বলেন না?

….স্যরি বেয়াই সম্ভব নয়। আপনারা বলেন, পড়াশোনা কেমন চলছে আপনাদের?

…..জ্বি মোটামুটি ভালো। কিন্তু বেয়াইন বলেন না।

…..নাহ বেয়াই এত জেনে লাব নাই।

আরও কিছুক্ষণ ওরা কথা বলল, বাট সুপ্তি নিজের পছন্দ অপছন্দের কোনো কথাই আর ওদের সাথে শেয়ার করল না। সুপ্তির ও মনে হচ্ছে ওদের সাথে একটু বেশি মিশে যাচ্ছে সুপ্তি। সুপ্তি চাচ্ছে না সুপ্তির জন্য ওরা কোনো ভাবে কষ্ট পাক। বা সুপ্তিকে নিয়ে ওরা কোনো রকম কোনো কিছু ভাবুক। কারণ সুপ্তির আপু কাল যা বলল তা কোনও দিনও সম্ভব হবে না। এটা সুপ্তি খুব ভালো ভাবেই জানে, তাই সে নিজে থেকেই ওদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে।

পরদিন সকালে সুপ্তি ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতেই সুপ্তির নাকে সুপ্তির পছন্দের একটা ফুলের স্মেইল আসতে শুরু করল সুপ্তি চারিদিকে তাকিয়ে যখন কিছু দেখতে পেলো না তখন ফ্লোরে চোখ পড়ল, আর সেখানে রাখা ছিলো এক গুচ্ছ গন্ধরাজ ফুল সাথে একটা চকলেট বক্স যা দেখে সুপ্তি অবাক হলো কিন্তু বেশ ভালো লাগছে তার কাছে, সুপ্তি একটু ঝুকে ফুল গুলো হাতে নিয়ে দেখল, একটা চিরকুট ছিলো সাথে সুপ্তি চিরকুট খুলে দেখল, তাতে লেখা ছিলো।

পাশে এসে বসো বন্ধু,
ফুল গুলো ছুয়ে দেখো
তোমার স্পর্শ পেতে একটু অপেক্ষায় সে ব্যাকুল।

সুপ্তি বুঝতে পারছে এটা কবি বাবু ছাড়া আর কারো কাজ নয়। কিন্তু সে যতটুকু জানে, স্রোত বা তীব্র কেউই জানে না সুপ্তির গন্ধরাজ ফুল পছন্দ, তবে কীভাবে? সুপ্তি ফুল গুলো ভালো করে সাজিয়ে রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

ব্রেকফাস্ট করে সুপ্তি নিজের রুমে চলে এলো, তার ভার্সিটির জন্য বের হতে হবে এজন্য। রুমের দরজা খুলেই সে অবাক হলো কারণ বিছানার উপর একটা গিফট বক্স রাখা আছে, তাই সে পা বাড়িয়ে কাছে গিয়ে গিফট বক্সটা খুলে দেখল, একটা ব্লাক শাড়ি সাথে ম্যাচিং করা চুড়ি, টিপের পাতা কয়েকটা সাদা গোলাপ আরও অনেক কিছু তার মাঝে রাখা চিরকুট-টা হাতে নিয়ে দেখল তার মাঝে লেখা ছিলো।

“”আপনিময় আপনার জন্য ছোট্ট একটা গিফট””

সুপ্তির মাথায় আসছে না এত গিফটের কী হলো? আর তাও সব তার পছন্দ অনুযায়ী। সুপ্তি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে বুজতে পারল আজ তার বার্থডে ছিলো। এখন সে বুঝতে পারছে এত আয়োজন কী জন্য। আজ সকাল থেকেই সুপ্তি ফোন ধরার সময় পায়নি সব কিছু মিলিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলো যার জন্য ফোন হাতে নেওয়ার সময়ই পায়নি, এখন ফোন হাতে নিতেই দেখল ফোনে এত এত ম্যাসেজ জমা হয়ে আছে যা সে খেয়ালই করেনি। সুপ্তি হালকা হেঁসে ম্যাসেজের উত্তর দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।



চলবে………।