তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব-৭+৮

0
310

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সকালে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র আমার হাতের ওপর ঘুমিয়ে আছে। উনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার ঘুম ছুটে গেলো। পিটপিট করে চেয়ে রইলাম উনার দিকে। বেড সাইড টেবিলের ওপর বাটি ভর্তি পানি আর কাপড় দেখে বুঝলাম রাতে উনি আমার জ্বরের জন্য জেগে ছিলেন। চোখ দুটো আরো ছোট ছোট হয়ে গেলো। সারাদিনই যাকে যা তা বলি সে সারারাত জেগে আমার সেবা করলো! আমি হাতটা একটু নাড়াতেই উনি লাফিয়ে উঠলেন। আমার কাছে এগিয়ে কপাল চেইক করে৷ বিড়বিড় করে বললেন,

‘যাক! জ্বরটা কমে গেছে।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম, ‘আপনি সারারাত ঘুমাননি?’

উনি খানিকক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘুরে এসে আমার পাশটাই শুয়ে পড়লেন। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে নিতে বললেন, ‘চুপচাপ শুয়ে থাকো। উঠবে না। সারারাত ঘুমাইনি এখন ঘুমাবো। যদি তোমার জন্য আমার ঘুমের ১২ টা বাজে তাহলে তোমার খবর আছে। তাই চুপচাপ এখানে শুয়ে থাকো!’

আমি উনার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো! উনার কথা মতো চুপচাপ শুয়েই থাকলাম। জ্বরটা কমলেও শরীরটা এখনো দুর্বল লাগছে। তাই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। মাথার মধ্যে এতো এতো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। উনার দিকে ফিরে শুয়ে ছিলাম। হুট করেই উনি আমার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ তখনো। আমি তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। সারা রাত না ঘুমানোর জন্য চোখ মুখ কেমন হয়ে আছে। চুল গুলোও উস্কোখুস্কো। কতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। ওভাবে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দরজার নক শুনে ধ্যান ভাঙে। বাইরে থেকে তিহা ডাকছে। আমি গলার স্বরটা উচু করে বললাম,

‘তুমি যাও। আমি আসছি!’

তিহা ‘আচ্ছা’ বলেই চলে যায়। আমি কোনোরকমে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর নিচে আসলাম। আমাকে দেখে আন্টি কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

‘অন্যদিন তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠো আজ উঠতে পারো নাই?’

‘আসলে আন্টি… ‘

আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে তানহা বললো, ‘ফুপি সব কাজ কি তুমিই করো! তোমার যা বউমা তাতে তো সে কোনো কাজ করে বলে মনে হয় না!’

পাশ থেকে নানু চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘তুমি তোমার চড়কায় তেল দাও। ওর সংসার ‘ও’ কেমনে করবে সেইটা ‘ও’ বুঝুক। নাতবউ তীব্র কোথায় রে?’

‘জ্বি উনি ঘুমাচ্ছে নানু।’

‘এতো বেলা করে ঘুমায়!’

তিহা বললো, ‘নাহ নানু। ভাইয়া তো সকাল সকাল উঠে পড়ে। কাল রাতে ভাবির অনেক জ্বর ছিলো তাই ভাইয়া রাতে ঘুমায় নাই। এজন্যই এতক্ষণ ঘুমাচ্ছে।’

আড়চোখে মামি আর তানহার দিকে তাকালাম। তারা যেনো রীতিমতো ফুঁসে উঠলেন। সারা রাত তীব্র আমার জন্য জেগে ছিলো এটা মোটেও তাদের পছন্দ হলো না। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। নানু কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললেন,

‘এখন কেমন আছো নাতবউ? জ্বর নিয়া উঠতে গেলা কেন?’

‘নাহ নানু। ঠিক আছি এখন।’

আমার বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে, ‘তুমি ঠিক আছো কি নেই তা কি তোমাকে দেখতে বলছি? পাকনামি করে রুম থেকে বের হয়ছো কেন?’

আমি ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম। তীব্রর চোখ মুখ দেখে ফাঁকা ঢোক গিললাম। উনার গম্ভীর কন্ঠ শুনে নানু মুচকি হেঁসে বললেন, ‘এদিকে আসো নানুভাই।’

তীব্র এসে নানুর পাশে বসলেন। আমার দিকে তখনও তিনি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। উনার এমন ভ’য়ং’কর দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলাম। নানুভাই বললেন,

‘বউয়ের দেখি খুব খেয়াল রাখো!’

তীব্রর নানুর সামনে একদম অন্যরুপের মানুষ হয়ে গেলেন। হেঁসে বললেন, ‘একটু বেশিই ভালোবাসি তো তাই। তবে তোমার চেয়ে বেশি না।’

নানু শব্দ করে হাসলেন। আমি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললাম, ‘আসছে রে! ভালোবাসা আর সে! হু ফানি।’

এরমধ্যেই তানহা উঠে গটগট করে চলে গেলেন। তানহা উঠে যাওয়ায় মামি একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিজেও পেছন পেছন গেলেন। আন্টি একবার শুধু সেদিকে তাকালেন কিন্তু গেলেন না। নানু বা তীব্র কারোরই ভ্রুক্ষেপ হলো না। দুজন দুজনের মতো কথা বলা শেষ করলেন। তারপর তীব্র আমার কাছে এসে বললেন,

‘রুমে আসো।’

আমি মাথা নাড়িয়ে উনার পিছু হাটলাম। রুমে আসতেই উনি ক্ষেপে গেলেন। আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘বের হতে নিষেধ করছিলাম না? বের হলে কেন?’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললে বললাম, ‘তিহা তো ডাকছিলো তাই গেছিলাম।’

‘তো? ডাকলেই যেতে হবে? বলতে পারলে না আমি নিষেধ করছি নিচে যেতে!’

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘হাতটা ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।’

উনি ছেড়ে দিলেন। খুব জোড়ে না ধরলেও শরীর ব্যাথার জন্য ব্যাথাা পেয়েছি৷ উনি ছেড়ে দিয়েই গটগট করে ওয়াশরুমে ঢুকলেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশের ব্যালকনিতে তখন তানহা দাঁড়িয়ে ছিলো। সাথে মিলিও ছিলো। তানহাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলাম। তানহা আমাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,

‘তাহলে তোমার জন্যই তীব্র আমাকে ছেড়েছে!’

‘জ্বি? বুঝলাম না!’

তানহা হেঁসে বলে, ‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নাই। তীব্র আমারে ভালোবাসে আর বিয়েও আমারেই করবে। তোমার সাথে ওর বিয়েটা জাস্ট একটা সাময়িক ডিল।’

কিছুই মাথায় গেলো না। পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তবে একটা কথায় থমকালাম ভীষণ। আমাকে বিয়ে করাটা ডিল মানে! কিসের ডিল! কার সাথে এই ডিল! তানহা বাকা হেঁসে ব্যালকনি থেকে চলে যায়। পেছন পেছন মিলিও যায়। আমি ওভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কতটা সময় পর তীব্র এলো। পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘এখানে কি করো? নাস্তা করবে না? শরীর খারাপ লাগছে বেশি!’

আমি উনার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘আমাকে বিয়ে করাটা আপনার ডিল ছিলো?’

তীব্র যেনো আকাশ থেকে পড়লো। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো মুখপানে। আমি তখনো জবাবের আশায় তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে অবাক কন্ঠে বলে, ‘কি বললেন?’

আমি ফের বললাম, ‘আমাকে বিয়ে করাটা আপনার ডিল ছিলো?’

তীব্র মুহুর্তেই ঘামতে শুরু করে। নিজেকে স্বাভাবিক করার যথেষ্ট চেষ্টা করলেন। বড় বড় শ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘এসব উল্টা পাল্টা কথা কে বলেছে?’

আমি হাসলাম। শাড়ির আঁচল টেনে উনার কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা মুছিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আজকাল আমার লাইফটাই তবে ডিল হয়ে গেছে! আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় কোথাও না কোথাও একটু না একটু ভালোবাসেন বা আমার প্রতি আপনার সফ্ট কর্ণার আছে এজন্যই বিয়েটা করেছেন। কিন্তু!’

আমি আরো এক দফা হেঁসে চলে আসলাম। যতক্ষণ ছিলাম তীব্র মুখের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিলো। তানহার শুধু কথা আমি বিশ্বাস করতাম না যদি তীব্র কনফিডেন্স রেখে আমাকে বলতো বিয়েটা কোনো ডিল না। কিন্তু তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম, তার ঘাবড়ে যাওয়া পুরোটাই আমাকে বুঝিয়ে দিলো তানহা কোথাও না কোথাও তো সত্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি একটা রে’পি’ষ্টের কাছে এতোকিছু আশা-ই বা করি কেনো? নিজেকে নিজে বকতে বকতে নিচে আসলাম। তিহা আর মিলি তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর তীব্রও আসলো। তীব্রর পাশের চেয়ারেই তানহা বসে পড়ে। আমি দেখেও কিছু বললাম না৷ খাওয়ার এক পর্যায়ে নানাভাই বললেন,

‘আজাদ আমরা কিন্তু তোমাদের একসাথে নিয়ে যাবো। ১০/১৫ দিন পরই শোভার বিয়ে।’

আজাদ আঙ্কেল খাওয়া রেখে তীব্রর দিকে তাকালেন। তীব্র তখনো খেয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। আঙ্কেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে নানাভাই তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘নানাভাই! তোমার কোনো সমস্যা আছে?’

তীব্র ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আব্বু, আম্মু, তিহাকে নিয়ে যাও নানাভাই। আমি আর প্রানেশা যেতে পারবো না।’

‘কেনো?’

তীব্র এবার খাওয়া অফ করলেন। আগের চেয়েও দ্বিগুণ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আমি গেলে তোমাদের বাড়ির কারোর সমস্যা না হলেও আমার বউ গেলে তোমার বাড়ির অনেকেরই সমস্যা হবে নানাভাই। তাছাড়া আমার বউয়ের কান ভাঙানোর জন্য মানুষের অভাব নাই দেখতেছি৷’

তানহা রাগী চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি পাত্তা দিলাম না। নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আজাদ আঙ্কেল পরিবেশ সামলানোর জন্য বললেন, ‘থাক না আব্বা! এমনিতেও তো ওদের কেবল বিয়ে হয়েছে। পরে না হয় যাবে!’

নানু বললেন, ‘নাহ। তা কেন হবে? তাছাড়া নানুভাই আর নাতবউ তো কোথাও যায়নি তাই না হয় গেলো! কয়দিন ঘুরে আসলে দুজনেরই ভাল্লাগবে।’

তিহা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘নানু কি বুঝাতে চাইছে বুঝছো ভাবি! তোমাদের হানিমুনের কাজটাও সেড়ে যাবে। ইনডিরেক্ট এটাই বুঝালো।’

আমি কিছু বললাম না। তীব্র এরপর আর কিছু বললেন না। আজাদ আঙ্কেল বললেন তিনি বুঝাবে তীব্রকে৷ খাওয়া শেষ করে তীব্র নিজের রুমে চলে গেলেও আমি গেলাম না৷ নিচেই নানুর সাথে বসে রইলাম। আড্ডায় মেতে থাকলাম। সারাদিনে প্রয়োজন ছাড়াা আর রুমে যাইনি। এরমধ্যে তীব্রও আর ডাকতে আসেনি।

রাতে তিহা জোড় করে আমাকে একদিকে টেনে আনে। চেপে ধরে বলে, ‘কি হয়েছে ভাবি? তুমি সারাদিন থেকে দেখছি রুমে যাচ্ছো না! ভাইয়ার সাথে কি কিছু হয়ছে?’

‘নাহ। এমনিতেই যাইনি। তোমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম তাই!’

তিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভাবি ভাইয়া আর তোমার বিয়েটা কোনো…’

এটুকু বলতেই তানহা এসে টেনে নিয়ে গেলো। আমি পিটপিট করে সেদিকে তাকালাম। তিহা একটুপর এসে বললো রুমে যেতে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। যদিও রুমে যেতে বিরক্ত লাগছে। রুমে ঢুকতেই দেখলাম তীব্র নেই। পুরো রুম ফাঁকা। উনি আবার কোথায় গেলো! ব্যালকনিতে উঁকি দিয়েও দেখলাম উনি নেই৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ফোন বেজে উঠে। ফোনে জ্বলজ্বল করে সামির নাম ভাসছে। হঠাৎ সামি কল দিলো কেনো! আমি দ্রুত কল রিসিভ করতেই সামি ব্যস্ত গলায় বললো,

‘প্রানেশা জুথি আপু, জুই বা আন্টি কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আজ ওদের বাড়ি গেছিলাম তখন দেখলাম পুরো বাড়ি ফাঁকা। আমার মাথা কাজ করছে না। তীব্র ভাই ওদের কোনো ক্ষ’তি করেনি তো!’

চলবে..

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সামির কথা শুনে ‘থ’ মে’রে গেলাম। তীব্র কিভাবে জানলো আন্টিদের ঠিকনা! ওপাশ থেকে সামি কয়েকবার হ্যালো বলতেই আমার হুশ আসে। ফাঁকা ঢোক গিলে বললাম, ‘তুই সিউর আন্টিরা ওখানে নেই!’

‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রানেশা? তীব্র ভাইকে বিয়ে করে কি সব বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেছে? আমি গেছিলাম নিজে।’

‘এখন কি হবে সামি?’

‘আমি দেখতেছি তুই চিন্তা করিস না।’

সামি কল কেটে দেয়। আমি বসে পড়লাম। সামির চিন্তিত কন্ঠ শুনে আমার নিজেরও চিন্তা বেড়ে গেলো। এটা কি আসলেই তীব্রর কাজ! কিন্তু তীব্র আন্টির বাসার ঠিকানা কোথায় পেলো? সেদিন যে আমি আন্টিদের বাসায় গেছিলাম কোনোভাবে কি উনি আমাকে ফলো করেছেন! মাথা হ্যাং মেরে গেলো। আমার লাইফ থেকে যেনো সমস্যার লাইন গুলো সরছেই না৷ আমি ওভাবেই বসে রইলাম। একটু পরই দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালাম। এতোরাতে তীব্র কোথায় গেছিলো! উনি নিজের মতো রুমে ঢুকে জ্যাকেট খুলে বসতেই আমি ধীর কন্ঠে বললাম,

‘এতো রাতে কোথায় গেছিলেন?’

তীব্র শান্ত গলায় বললেন, ‘কাজ ছিলো৷ তুমি জেগে আছো কেনো? ঘুমাওনি!’

আমি উত্তর দিলাম না৷ কাঁপা কাঁপা পায়ে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছু বলবে?’

শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘আন্টিরা কোথায়?’

তীব্র কপালে ভাজ ফেলে তাকালেন৷ না বুঝার মতো করে বললেন, ‘মানে? কোন আন্টি আর কোথায় মানে!’

রেগে গেলাম। রাগে চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। হিংস্র রুপ ধারণ করলাম মুহুর্তেই। তীব্রর শার্টের কলার চেপে ধরে রাগ নিয়ে বললাম, ‘এখন নাটক করছেন! কিছু বোঝেন না আপনি? কোন আন্টি জানেন না! জিনিয়াকে তো মে’রেই ফেলেছেন এখনও কেনো আন্টিদের পেছনে পড়ে আছেন! আপনার কি লজ্জা বলতে কিছু নাই? এবার অন্তত ওদের মুক্তি দেন। জুই একটা ছোট মেয়ে।’

রেগে গেলে আমার কান্না পেয়ে যাই। এটাই সমস্যা! যতটা না হিংস্র হয়ে উঠি তার চেয়েও বেশি আমার করুণ অবস্থা হয়। তীব্র কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে কলার থেকে হাত ছুটিয়ে দিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘আমি কাউকেই কিছু করিনি। আর জিনিয়ার ফ্যামিলি কোথায় এটাও আমি জানি না।’

উনার কথায় জ্বলে উঠলাম। চেঁচিয়ে বললাম, ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি যদি কিছু না করেন তাহলে কে করেছে!’

‘কান্না বন্ধ করো প্রাণ।’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে ওখানেই বসে পড়লাম। মাথা চেপে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। কেমন মানুষ এরা! জুই তো ভীষণ ছোট একটা মানুষ ওর সাথেও কেনো এমন করছে! তীব্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এরপর টেনে তুললেন আমাকে। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি দু’হাতে আগলে নিলেন। কন্ঠ নরম করে বললেন,

‘শান্ত হও প্লিজ! এমন পাগলামি করো না। আমি সত্যিই জানি না জিনিয়ার ফ্যামিলি কোথায়!’

আমি ছিটকে সরে আসলাম। ঘৃ’ণার দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম, ‘আপনাকে একটুও বিশ্বাস করি না আমি। আপনি একদম টাচ করবেন না আমাকে। সময় থাকতে ওদের ছেড়ে দিন। নয়তো ভালো হবে না তীব্র।’

তীব্র মুহুর্তেই রক্তিম চোখে তাকালেন। আমার কাছে এসে চেপে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি কাউকে কিছু করিনি মানে করিনি। তাশজিদ শেখ তীব্রর রে’প করার প্রয়োজন নেই। সে চাইলে এমনেই হাজারটা মেয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। আর যদি থাকে ওর ফ্যামিলির কথা! তাহলে শোনো তীব্র কাউকে খুঁজতে চাইলে তুমি তাকে পাতালে লুকিয়ে রাখলেও তাকে খুঁজে পাবেই। শুধু তুমি কেন তোমার চৌদ্দগুষ্টিও তাকে এতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। অযথা আমাকে ব্লেইম করা বন্ধ করো।’

আমি ‘থ’ মে’রে গেলাম। এতগুলো কথা কখনো আমি নিজের মাথাতেই আনিনি। তীব্র আমাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। তীব্রর কাছে কোনো মেয়েকে পাওয়াটা জাস্ট চুটকির মতো। সে যেমন আজাদ শেখের ছেলে হিসেবে পরিচিত তেমনই নিজেরও একটা পরিচয়ে সে পরিচিত। তাকে পাওয়ার জন্য যেকোনো মেয়ে রাজি হয়ে যাবে সহজেই সেখানে উনার কেনো প্রয়োজন পড়লো এতো জ’ঘ’ন্য এটা কাজ করার! কিন্তু আমি নিজে চোখেও তো জিনিয়াকে দেখেছি। জিনিয়া নিজে মুখে সবটা বলেছে আমাকে। তাহলে! এতো চাপ নিতে পারলাম না। অসুস্থ শরীরে এতো চিন্তা নিয়ে উঠতে না পেরে সেন্স হারিয়ে পড়ে রইলাম ফ্লোরে।
_________

নিজেকে কারো বাহুতে আবিষ্কার করে চমকে উঠলাম। সেন্স ফিরার সাথে সাথেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেলো। মাথাটা ওপরে তুলে তীব্রকে চোখে পড়লো। তীব্র গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। আরো একবার চমকালাম৷ উনার দৃষ্টিতে থমকে গেলাম। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই উনি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। মুখ গুজে দিলে চুলে। থতমত খেয়ে উনাার শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। উনি ভাঙা ভাঙা ভাবে কি যেনো বললেন বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার নিজেরও এতো ক্লান্তিতে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ পড়ে রইলাম উনার বুকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে তখনো। ওভাবে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে নিজের পাশটায় তীব্রকে দেখলাম না। উনাকে না দেখে ঘুম উধাও হয়ে গেলো। উনি কই গেলেন! আচ্ছা উনি কি রাাতে এসেছিলেন নাকি রাতের সবটাই আমার ভ্রম ছিলো! মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। এতো না ভেবে চুপচাপ উঠে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিলাম। এই ঠান্ডার মধ্যে শাওয়ার নিয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। কোনোমতে শাড়ি পড়ে নিচে নামতেই দেখলাম সবাই সেখানে হাজির। তাড়াহুড়োতে ঘড়ি না দেখলেও এখন টের পেলাম ভালোই সকাল হয়েছে। নানু আমাকে দেখে বললেন,

‘তোমার নাকি শরীর ভালো না তাই আর সকাল সকাল ডাকি নাই। তা এখন কেমন আছে?’

ধীর স্বরে বললাম, ‘জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।’

আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখংলাম তীব্র নেই। তানহা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালাম। ভেজা চুলগুলোর দিকে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিজের চুলের দিকে তাকিয়ে আরেকবার নানুর দিকে তাকালাম। নানু মুচকি মুচকি হাসছেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আসলে ওরা কি রেখে কি ভাবছে! নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালাম। তিহা আর মিলি দুজন আমার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বাদেই তীব্র আসে। টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে ঘুরছেন তিনি। নানাভাইয়ের সাথে গেছিলেন বোধহয় কোথাও। উনারা আসতেই সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসে গেলাম। তীব্র আমাকে টেনে ফিসফিস করে বললেন,

‘এই জ্বর নিয়ে এতো সকালে শাওয়ার নিছো কেন?’

আমি উত্তর না দিয়ে সরে আসলাম। খাওয়ার সময়ই আমতা আমতা করে নানাভাইকে বললাম, ‘নানাভাই আমি যদি আজ একটু ভার্সিটিতে যাই তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে!’

সবাই খাওয়া ছেড়ে ড্যাবড্যাব করে তাকালেন। শুধু তীব্র স্বাভাবিক চোখে তাকালেন। তিনি বোধহয় জানতেন এমন কিছুই হবে। যদি এমন না হতো তবেই বোধহয় তিনি অবাক হতেন! মামি কটুক্তি করে বললেন,

‘বাড়িতে নানাশ্বশুর সহ আরো আত্মীয় আসছে আর তিনি নাকি ভার্সিটিতে যাবেন!’

আমি মাথা নত করে নিলাম। এখানে আমি চাইলেও জবাব দিতে পারি কিন্তু প্রথমত আমি নতুন বউ আর তাছাড়া বড়দের সাথে খারাপ ব্যবহারটা করতে চাচ্ছি না। নানাভাই গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘কেনো? কোনো কারণ আছে?’

‘জ্বি। আসলে…’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে তীব্র খাওয়ার মুখে দিতে দিতে বললেন, ‘নানাভাই প্রানেশার যাওয়াটা একটু জরুরী। তাছাড়া কাল উনার ফ্রেন্ডও কল করছিলো একটু প্রয়োজন আছে ওকে। আর ওর নোটও নিতে হবে। চিন্তা করো না আমি তাড়াতাড়ি উনাকে নিয়ে আসবো।’

আর কেউ কিছুই বললেন না। তানহা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নাই।’

এপর্যায়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি শান্ত থাকলেও তীব্র থাকলেন না। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, ‘আগে নিজের ভদ্রতা ঠিক কর এরপর অন্য কাউকে বলবি! প্রাণ খাওয়া শেষ হয়ে গেলে জলদি আসো।’

আমি মাথা নাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। উনার পিছু পিছু এসে চুপচাপ বোরকা পড়ে হিজাব করে নিলাম। ‘ও’ বাড়িতে থাকার সময় বোরকা পড়েই অভ্যাস হয়ে গেছিলো আর এখনো সে অভ্যাসটাই আছে। তীব্রও রেডি হয়ে নেয়। দুজন একসাথে বের হলাম। উনি ভার্সিটির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুধু এটুকুই বললেন,

‘যা করতে চাচ্ছো করে নাও। তবে নিজে বিপদে পড়বে এমন কিছু কখনোই করো না।’

ব্যাস এতটুকুই! আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলাম। এরপর চুপচাপ ভার্সিটিতে ঢুকলাম। যেখানে সব ফ্রেন্ডরা আড্ডা দেই সেখানেই দ্রুত গেলাম। সবাই কিছু বলার আগেই সামির হাত টেনে দুরে সরিয়ে আনলাম। ব্যস্ত গলায় বললাম,

‘কিছু জানতে পেরেছিস? আন্টিরা কোথায়?’

সামি মলিন মুখে বললো, ‘জানি না রে। অনেক খুঁজার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। তুই তীব্র ভাইকে কিছু বলেছিস?’

আমি রাতের কোনো কথায় সামিকে বললাম না। সামি সন্দেহের চোখে তাকালেও আমি তা ঘুরিয়ে দিলাম। ফাঁকা ঢোক গিলে বললাম, ‘একবার যাবি ওই বাড়িতে! যদি কোনো ক্লু পাই!’

সামি কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে যায়। আমি আর সামি দ্রুত বের হয়ে গেলাম ভার্সিটি থেকে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকে তানজিলা, সাবিহা। কিন্তু আমরা জবাব না দিয়েই ছুট লাগালাম। দুজনেই টেনশন করতে করতে ছুটলাম আন্টির বাড়ির দিকে। টেনশনে ফোনটাও অফ করতে ভুলে গেছি। অবশ্য এখন আর ফোনই বা অফ করে কি হবে! আন্টির বাড়ি আসতে আসতে প্রায় আধাঘন্টা লেগে গেলো। সামি নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। বাড়িতে ঢুকে ৩ রুম আগে ভালোমতো খুঁজে নিলাম কিন্তু কোথাও কারো টিকিটাও নেই। পুরো বাড়িতে কিছু না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে লিভিং রুমে এসে বসলাম তখনই হাতের সাথে বেঁধে গেলো কিছু একটা। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে হাতে নিতেই দেখলাম একটা ব্রেসলেট। এইরকমের একটা ব্রেসলেট তীব্রর কাছে দেখেছিলাম৷ ভালোমতো উল্টে পাল্টে দেখতেই অবাক হলাম। ব্রেসলেটে স্পষ্ট ভাবে একটা নাম খোদাই করা। চোখে থেকে মুহুর্তেই দু ফোঁটা জল গড়ালো। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,

‘তীব্র!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)