তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব-৯+১০

0
279

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

অনুভূতিশূণ্যের মতো নিজের রুমের ফ্লোরে বসে আছি। হাতে এখনো তীব্রর ব্রেসলেট। নিজের অজান্তেই যে তীব্রকে নির্দোষ ভেবে বসেছিলাম তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি৷ সে আমাকে এতো এতো টপিক দিয়ে বুঝালো অথচ আজও তার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ রয়েই গেলো। ব্রেসলেটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়। একটা সময় হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢোকে তীব্র। দরজার আওয়াজে সেদিকে তাকাতেই তার চিন্তিত মুখটা চোখে পড়লো। উনি ছুটে আসলেন আমার কাছে। হাটু মুড়ে বসে দুহাতে মুখ আগলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুধালেন,

‘কি হয়েছে প্রাণ? তোমার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা কেনো? তিহা বললো তুমি নাকি কান্না করতে করতে বাড়ি এসেছো! কি হয়েছে তোমার?’

আমি শুধু উনার চোখের দিকে তাকালাম। মানুষ চোখের ভাষা নাকি খুব বোঝে অথচ আমি এই মানুষটা চোখের ভাষা বুঝলাম না। বিভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো সে দৃষ্টি। তীব্র আমার ভাবনার মাঝে হয়তো আরো একবার প্রশ্ন করলেন কিন্তু আমার কানে সে প্রশ্ন আসলেনও না। আমি ঠোঁট এলিয়ে হাসলাম। হাতের ব্রেসলেট টা তীব্রর সামনে ধরলাম। তীব্র চুপ করে একবার ব্রেসলেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর ব্রেসলেটটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,

‘এটা কোথায় পেলে? আমি তো কাল থেকে খুঁজছি কোথাও পেলাম না।’

আমি শব্দ করে হেঁসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। পাগলের মতো শুধু হাসতেই থাকলাম। একদিকে হাসলেও আরেকদিকে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শাড়ি এলোমেলো হয়ে গেছে। চুল গুলো শুধু খোপা করে রেখেছিলাম তাও খুলে গেছে। একদম বিধ্বস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। তীব্র কিছু না বুঝে আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

‘কি হয়ছে? পাগলের মতো হাসছো কেনো?’

সে নিজেই চোখের পানিটুকু মুছে দিলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। তীব্র চমকালো। আমি চোখ পিটপিট করে ভীষণ শীতল গলায় বললাম,

‘আপনি না কাল বললেন আপনি জানেন না আন্টিরা কোথায়! তাহলে আপনার শখের ব্রেসলেট কিভাবে আন্টির বাসায় পেলাম?’

চমকে যায় তীব্র। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় আমার মুখের দিকে। আমিও তার দিকে তাকিয়েই ফের বললাম, ‘জবাব দিন!’

তীব্র কোনো উত্তর দিলেন না। তড়তড় করে রাগ বেড়ে গেলো আমার। উনার ওপরের রাগটা আমি পুরো রুমের ওপর ঝাড়লাম। পুরো রুমের জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে, ভেঙে ক্ষ্যান্ত হলাম। উন্মাদের মতো যা তা বলে চেচাতে চেচাতে সব এলোমেলো করে ফেললাম। এতোটাই উন্মাদ হয়ে গেলাম যে কখন পায়ে কাঁচ ঢুকে র’ক্তাক্ত হয়ে গেছে সেটুকুও খেয়াল করিনি৷ তীব্র আটকালেন আমায়। শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। আমি ছোটার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। কিন্তু তার শক্তির সাথে পেড়ে উঠলাম না। ক্লান্ত হয়ে তার বুকের সাথে মিশে রইলাম। একটু শান্ত হতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,

‘আমি কাল রাত থেকে আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম তীব্র। আমি ভেবেছিলাম আপনি নির্দোষ। আপনাকে বিশ্বাস করে আমি পুরো সত্য জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করার ফলটা আমি আজই পেয়ে যাবো তা ভাবতেই পারিনি। আপনি যদি আন্টিদের বিষয়ে কিছু না-ই জানেন তাহলে কেনো আপনার শখের ব্রেসলেট আমি ওখানে পেলাম? কেনো জিনিয়ার ওই অবস্থার জন্য মৃ’ত্যুর আগে সে আপনাকে দায়ী করলো? কেনো আপনাকে ভালোবেসে জিনিয়া ঠকে গেলো? কেনো আপনি জুথি আপুর হাজবেন্ডকে মা’রলেন? কেনোই বা জুথি আপুকে বার বার মা’রার চেষ্টা করলেন? আপনি এতোটা জ’ঘন্য কেনো তীব্র?’

তীব্রর হাত আলগা হয়ে গেলো। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীব্রর দিকে তাকালাম। তীব্রর দৃষ্টি তখনো আমার চোখের দিকে। আমি ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়লাম তার দিকে। চোখ থেকে টপটপ করে তখনো জল পড়ছে। আমি সরে আসলাম দু’পা। রাগে চেঁচিয়ে বললাম,

‘আপনি একটা ধ’র্ষ’ক। একজন খু’নী। নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না আপনি। প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করি আমি আপনাকে। আপনি আমার হাজবেন্ড ভাবলেই আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। আপনার একেকটা স্পর্শ আমার কাছে বি’ষাক্ত মনে হয়। আপনাকে দেখলেই আমার ঘৃণা লাগে। আপনি একটা বি’ষাক্ত কীট। আমি আপানকে ভীষণ রকমের ঘৃণা করি তাশজিদ শেখ তীব্র। আই জাস্ট হেইট ইউ।’

বলতে বলতেই ধপ করে বসে পড়লাম মেঝেতে। তখনো আমার চোখের জল থামেনি। কান্না করতে করতে হিচকি উঠে গেছে। তীব্র কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি নিজের মতো বসে রইলাম। তীব্র হুট করেই আমার সামনে এসে বসলো। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম উনি ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে বসেছেন। আমার পায়ে হাত দিতেই আমি যখন ছাড়িয়ে নিতে গেলাম তখন উনি শক্ত করে ধরলেন। চুপচাপ কাঁচটা বের করলেন। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উনার শার্ট চেপে ধরলাম। উনি কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। চুপচাপ পায়ে ওষুধ লাগিয়ে পা ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পুরোটা সময় দুজনই নির্বাক ছিলাম। উনি চুপচাপ নিজের কাজ করলেন আর আমি শুধু দেখলাম। এরপর ফাস্ট এইড বক্সটা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। এক হাত ঘাড়ের পেছনে নিয়ে তার দিকে টেনে আনলেন। চুলগুলো কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিয়ে ঠোঁট ছোয়ালেন কপালে। তার গভীর চুম্বনে আমি কেঁপে উঠলাম। উনি আমাকে ছেড়ে চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে যেনো নীল হয়ে গেছে। ব্যাথায় যেমন মানুষের চোখ মুখ হয় ঠিক তারও তেমন হয়েছে। চোখে মুখে যেনো বি’ষাদের হাসি। আস্তে করে আমাকে ছেড়ে শুধু দুটো কথায় বললেন,

‘থ্যাঙ্কস। আর ক’টা দিন সহ্য করে নাও প্রানেশা।’

এরপর উনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। সে তো একা থাকা কালীন আমাকে বেশির ভাগ প্রাণ-ই বলেন তাহলে আজ হঠাৎ করে প্রানেশা কেনো বললেন! আর ক’টা দিন পর কি হবে! তার কথার মানে বুঝে উঠতে না পারলেও নিজের এতো চিন্তায় আমি ক্লান্ত। ফ্লোরে বসে মাথা হেলিয়ে দিলাম বেডের সাথে। কান্না করায় চোখ মুখ ফুলে গেছে। চোখ জ্বালা করছে খুব। চোখ বন্ধ করে ওভাবেই পড়ে রইলাম অনেকটা সময়। নিজের হাতে নিজের মাথা চেপে ধরলাম। আরো একবার দরজার খোলার শব্দে পিটপিট করে তাকালাম। চোখে পড়লো তানহাকে। সে অদ্ভুত ভাবে হেঁসে আমার পাশে এসে বসলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে আফসোসের সুরে বললো,

‘তীব্রর ওমন রাগী ফেইস দেখেই বুঝলাম কিছু একটা হযছে। ভাগ্যিস লিভিং রুমে কেউ ছিলো না! তা তোমার এমন অবস্থা কেন গো? তীব্র বুঝি কিছু বলেছে!’

ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ আমাদের মধ্যে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা আমাদেরই বুঝতে দাও। আর তীব্র তোমার বড় ভাই হয় তাই ভালো করে বলো ‘তীব্র ভাই’ আর আমাকে ‘ভাবী’ বলবে! এখন বের হও আমার রুম থেকে।’

তানহা ফুঁসে ওঠে। রেগে আমার দিকে এগোতে নিয়েও এগোয় না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর বাঁকা হেঁসে বলে, ‘দেখি আর কয়দিন তুমি তীব্রর বউ হয়ে থাকো প্রানেশা! উফস সরি ভাবী।’

নিজের মতো বের হয়ে যায় তানহা। আমি ধীরে ধীরে উঠে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। এতো রহস্যের মধ্যে যেনো আমি ডুবে গেছি। যত রহস্য থেকে বের হতে চাই ততটাই ডুবে যাই রহস্যের অতল গভীরে। তীব্রকে যতবার বিশ্বাস করতে চাই ততবারই তার বিরুদ্ধে কিছু না কিছু প্রমাণ পেয়ে যাই। সত্যি মিথ্যার জালে আমি এতোটাই বাজে ভাবে ফেসে গেছি যে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা জাজ করতেও আমার বেগ পেতে হচ্ছে! জিনিয়া, আমাকে বিয়েটা তীব্রর একটা ডিল, আন্টিরা নিখোজ, ফারদিন ভাই আর তীব্রর শ’ত্রুতা সবকিছুর মধ্যে আমি ফেসে গেছি৷ চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। চোখ জ্বালা করার কারণে এই অবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
_________

ঘুম থেকে উঠতে উঠতে ২ টা বেজে গেছে। এরমধ্যে কেউ বোধহয় আমাকে ডাকেওনি। পুরো রুম পরিষ্কার করা। হয়তো তিহা বা কোনো মেইড এসে করেছে। ধীরে ধীরে উঠতেই বুঝলাম দুদিনের জ্বরটা আজ মাত্রা ছাড়িয়েছে। পা ব্যাথাতে নাড়াতে পারছি না। মাথা ভার হয়ে আছে। তবুও কোনোমতে উঠে বসলাম। মাথা ঘুরিয়ে আসলো। চুপচাপ ওভাবেই শুয়ে পড়লাম আবার। কতক্ষণ পরই তিহা রুমে আসলো। আমার পাশে বসে বললো,

‘ভাবী এখনো উঠোনি যে! শরীর কি খুব খারাপ?’

কথা শেষ করে কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলো। দ্রুত কাছে এসে বললো, ‘তোমার এতো জ্বর কেমনে হলো! দাঁড়াও ভাইয়াকে বলি।’

আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। ধীর স্বরে বললাম, ‘প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু এমনিতেই একটু ওষুধ দিয়ে যাও।’

‘খালি পেটে ওষুধ কেনো খাবা? দাঁড়াও আমি আসি!’

তিহা দৌড়ে চলে যায়। মিলি, বিপ্লব, মুন্না একসাথে রুমে আসে। ৩ জন মিলে বিছানা দখল করে বসে বলে, ‘ভাবী আপনার নাকি অনেক জ্বর!’

আমি হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ালাম। ওরা ৩ জন বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। তিহা খাবার নিয়ে এসে একটু খাইয়ে দেয়। এরপর ওষুধ খাইয়ে মিলি, বিপ্লব, মুন্নাকে বের করে দেয়। আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

‘তোমাকে একটা কথা বলি ভাবী?’

আমি ছোট্ট করে ‘হু’ বললাম। তিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি জানি না আজ তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছে কিন্তু এটা জানি তোমরা দুজনেই অনেক কষ্ট পাচ্ছো। সবার কথা, সব দেখা, সব শোনা সত্যি হয় না ভাবী। আমরা চোখের সামনে এমন অনেক কিছু দেখি যা আদৌও হয়ইনি বা নেই। আমাদের চোখের সামনে থাকা সব আপন মানুষরা কিন্তু আদৌও আপন হয় না। সব কিছুর পিছনেই কিছু সত্য থাকে যা সবার আড়ালে থাকে। এগুলো সত্য খুঁজে বের করতে হয়। তুমি কারোর কথায় এসে ভাইয়াকে ভুল বুঝো না। তুমি আমার ভাইয়াকে আসলে যেমন ভাবো সে তেমন না। তোমাকে এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারবো না আমি তবে এটুকু বলতে পারি ‘তুমি ভুল। ভাইয়া জিনিয়াকে কিছুই করেনি। বরং ভাইয়া সেদিন জিনিয়ার জন্যই ওখানে গেছিলো। জিনিয়াই যেতে বলেছিলো। পরে কি হয়েছে তা আমাকে ভাইয়া আজও বলেনি কিন্তু তুমি পরের যতটুকু জানো তা সম্পূর্ণ ভুল। খুব বেশি দেড়ি হওয়ার আগেই নিজের ভুল ভেঙে ফেলো ভাবী। ভাইয়াকে একবার হারিয়ে ফেললে আর ফিরে পাবে না।’

চলবে..

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

কেটেছে প্রায় ১ সপ্তাহের মতো। আজ তীব্রর নানুরা সবাই চলে যাবে। আমরাও যেতাম কিন্তু তীব্র কাল রাতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে না যাওয়ার জন্য। নানুরা কেউই এতোদিন থাকতে চাননি শুধুমাত্র আমার অসুস্থতার জন্যই থেকে গেছেন। এই ক’দিনেই মোটামুটি অসুস্থ ছিলাম। অদ্ভুত ভাবে সেদিনের পর তীব্র আর আমার সাথে কথা বলেননি। সকালে বের হতেন আর আসতেন গভীর রাতে। একই বিছানায় ঘুমালেও দুজনের দূরত্ব ছিলো অনেকটা। আমাকে ছুঁয়ে দেখা তো দুর আমার দিকেও তাকান না ঠিকমতো। সেদিন তীব্রর সাথে খারাপ বিহেভের পর যখন তিহার কথাগুলো শুনলাম তখন থেকেই আমার মাথা যেনো ফাঁকা হয়ে আছে৷ মাথার মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল করছে। যতবারই তীব্রর সাথে কথা বলতে গেছি ততবারই সে আমাকে সন্তর্পণে ইগনোর করে চলে গেছে। সবসময় হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়-ই পাই না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিহার কাপড় গোছানো শুরু করলাম৷ তিহা মন খারাপ করে বলে,

‘ভাবী চলো না! তোমরা না গেলে আমার একা ভালো লাগবে না।’

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘তুমি যাও না! মিলি, তানহা, বিপ্লব, মুন্না সবাই তো আছে। আর কোন আপুর যেনো বিয়ে উনিও তো আছে! সবাই অনেক ইনজয় করো।’

মুন্না ‘চ’ এর মতো করে শব্দ করে। এরপর আফসোসের সুরে বলে, ‘মিস করলেন ভাবী। অনেক কিছু মিস করলেন।’

ওর কথার ধরনে আমি হেঁসে ফেললাম। বিপ্লব খুবই শান্ত স্বভাবের। এতোগুলো দিনে ছেলেটাকে খুব কম কথা বলতে দেখেছি। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি খুব একটা কথা বলো না বিপ্লব! সবসময় চুপ করেই থাকো?’

ছেলেটা বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকালো। পিটপিট করে তাকিয়ে বললো, ‘আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না ভাবী।’

পাশ থেকে মিলি বললো, ‘ওটা পড়াকু ছেলে বুঝছো! ওর আম্মু কি যে জোড় করে পাঠিয়েছে তা যদি জানতে!’

মুন্না এ কথায় যেনো মজার কোনো টপিক পেলো। তাই সে আগ্রহ নিয়ে লাফিয়ে এসে বললো, ‘আসার দিন কি হয়ছে জানেন ভাবী! আম্মু ওরে…’

এটুকু বলতেই বিপ্লব ওর মুখ চেপে ধরে। রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু মুন্না ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে পুরো রুমে দৌড়াতে দৌড়াতে একদমে বললো, ‘ওরে আম্মু বলছে, ‘তোমার ফুপু বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।’ কিন্তু আমার ভাই তো আসতে নারাজ। সে আসবে না বলে সেই জিদ ধরে বসে আছে৷ আম্মুও তো ছাড়ার পাত্র না। শেষে যখন দেখে না তার আসতেই হবে তখন বাথরুমের দরজা আটকে বসে ছিলো। বলে, ‘সবাই ফুপু বাড়িতে চলে গেলে সে বের হবে নয়তো ওখানেই আজীবন থাকবে। সেখানেই নাকি সে সন্ন্যাস নিয়ে ধ্যানে বসবে।’

বিপ্লব বার বার নিষেধ করে দেওয়া স্বত্বেও যখন দেখলো মুন্না সব বলে দিয়েছে তখন সে গাল ফুলিয়ে বসলো। পুরো রুমে হাসাহাসির ঝংকার উঠে গেছে। আমাদের হাসাহাসির মধ্যেই দরজায় নক পড়লো। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত উনার কাছে আসতেই উনি অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,

‘নিজের লাগেজ গুছিয়ে নাও। আমরা যাচ্ছি সিলেট।’

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন। পেছন থেকে তিহা বললো, ‘ভাইয়া না কালই বললো তোমরা যাবে না ওখানে। তাহলে হঠাৎ?’

আমি জবাব দিলাম না। মুখভঙ্গিতেই বুঝালাম ‘জানি না’। এরপর রুম থেকে বের হয়ে আমাদের রুমে আসলাম। তীব্র নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। উনি নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। আমি কয়েকবার গলা পরিষ্কার করে আমতা আমতা করে বললাম,

‘আমি করে দেই?’

উনি জবাব দিলেন না। এমন ভাব ধরলেন যেনো শুনতেই পাননি। আমার ভীষণ রাগ হলো। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় করে শ্বাস নিলাম। উনাকে ফের প্রশ্ন করলাম,

‘কাল না বললেন যাবেন না! তাহলে আজ হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন যে?’

উনি নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েই দু শব্দে বললেন, ‘কাজ আছে।’

ব্যাস। আর কোনো কথা নেই। এরপর আমিও আর কথা বাড়ালাম না। যে কথা বলতে চায় না তার সাথে জোড় করে কিভাবে কথা বলবো! বুকের পাশে হালকা চিনচিনে অনুভূতি নিয়েই নিজের সব গুছিয়ে নিলাম। ট্রেন প্রায় রাত ১০ টায় তাই এখন আর রেডি হলাম না।
______

ঠান্ডা বাতাসে গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শা শা করে ছুটে চলেছে ট্রেন। গায়ের শালটা ভালোভাবে নিজের সাথে পেঁচিয়ে নিলাম। হিজাবের জন্য যদিও তেমন ঠান্ডা লাগছে না তবুও খানিক বাদে বাদেই কেঁপে উঠছি৷ পাশেই তীব্র চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে। সামনে তিহা আর তানহা বসেছে। তানহার দৃষ্টি তীব্রর দিকে । মেয়েটাকে দেখলেই কেমন জানি রাগে গা জ্বলে। অন্যের বরের দিকে এমন করে তাকানোর কোনো মানে আছে! আমি পাশ ফিরে তীব্রর দিকে তাকালাম। তীব্র তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তিহাও কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে আছে। আমি এই সুযোগে তীব্রর শার্টের এক কোণা চেপে ধরে টান দিলাম। তীব্র ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলে তাকায়। কপালের ভাজ দৃঢ় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললাম,

‘আমি ঘুমাবো।’

উনি গম্ভীর স্বরে আওড়ালেন, ‘ঘুমাও।’

আমি সাথে সাথে উনার বুকে মাথা গুজে দিলাম। লোকটা এতো লম্বা কেন! কাপলরা কি সুন্দর করে ঘাড়ে মাথা রাখে আর আমি তাকে নাগালেই পাই না। টানটান হয়ে বুক ফুলিয়ে থাকলে তাকে নাগালে কেমনে পাবো! বুকে মুখ গুঁজে দেওয়ায় আমার নিজেরই সর্বাঙ্গ যেনো কেঁপে উঠলো। তানহার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আমি ঠোঁট চেপে হেঁসে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আচ্ছা এখন কি তীব্রর মুখটাও তানহার মতো হা হয়ে গেছে! ভেবেই অনেক হাসি পেলো। তীব্র সরালেন না আমায়৷ হয়তো তানহা সামনে বসে আছে বলেই উনি আমাকে সরালেন না। আমাদের মধ্যে যায়-ই হোক তা তানহা অব্দি যেনো না পৌঁছে এজন্যই তিনিও সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরলেন। অজানা অনুভূতিতে কেঁপে উঠলাম। চোখ পিটপিট করে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম। হঠাৎ করেই মনে কড়া নাড়লো এক অদ্ভুত প্রশ্ন,

‘আমি কি তীব্রর প্রতি কোনো অনুভূতিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি? তীব্রর বলা সেই প্রথমদিনের বাক্যর মতো কি তাকে পু’ড়াতে এসে নিজে পু’ড়ে যাচ্ছি! তীব্রর প্রেমের নেশায় কি ডুবে যাচ্ছি? যদি এগুলোর উত্তর না হয় তবে কেনো এতো অদ্ভুত টান আমার? কেনো তার নীরবতায় আমি এতো অস্থির অনুভব করি? কেনো তানহা তার দিকে তাকালে আমার হিংসা হয়? কেনো এই মানুষটার বুকে মাথা রেখে এতো প্রশান্তি অনুভব করছি? কেনো রাতের পর রাত তার মুখ দেখতে আমার একটুও বিরক্ত লাগে না? কিন্তু সবশেষে যদি আমার সব প্রশ্নের উত্তর হয় ‘আমি তীব্রকে ভালোবাসি!’ তবে কি এটা আদৌও সম্ভব! যে মানুষটাকে আমি ঘৃ’ণা করে এসেছি এতগুলো দিন, যাকে আমি রে’পি’ষ্ট, খুনী বলে মেনেছি তাকে কি আদৌও আমার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব নাকি এগুলো সবই আমার সাময়িক মোহ!’

প্রশ্ন আছে তবে কোনো উত্তর পেলাম না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাপ্টে ধরে রইলাম তীব্রকে। আজ ভীষণ করে চাইলাম, ‘তীব্র যেনো একদম নির্দোষ হয়। জিনিয়ার সবগুলো কথা যেনো তীব্র আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। এই সত্য মিথ্যার খেলায় হয়তো হেরে যাবো তবুও তীব্র জিতুক। তীব্র সত্যি নির্দোষ প্রমাণ হোক।’

পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেলো। আমি পুরোটা রাস্তা তীব্রর বুকে মাথা রেখেই এসেছি। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি আর অদ্ভুত এক শান্তি! মনে হয়েছিলো রাস্তাটা যেনো কখনোই শেষ না হোক। কি বাচ্চামো ভাবনা আমার! নিজের ভাবনাতে নিজেই হেঁসে ফেললাম। নানুবাড়িটা দেখে বেশ অবাক হলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে বড় একটা বাড়ি। সামনে সরু রাস্তার দুপাশে বাগান করা। মুগ্ধ হয়ে চারপাশ টা দেখতে দেখতেই তীব্র কাছে চলে আসে৷ হাত ধরে গম্ভীর মুখে সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়। তীব্রর ছোট মামা, মামি, ২ খালামনি, ২ খালু, আরো ৪/৫ জন কাজিন মিলে আমাদের বাড়ির ভেতর এনে বসায়। সারারাত জার্নির ফলে যে যার রুমে চলে যায়। আমি রুমে এসেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারা রাস্তা তেমন একটা ঘুম হয়নি৷ এখন ভালোমতো একটা ঘুম দেওয়া যাবে। কিন্তু ঘুমে ছাই ফেলে দিয়ে তীব্র গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘নিজে থেকে একটা রে’পি’ষ্ট, খু’নী, স্বার্থপর লোকের বুকে মাথা রাখতে ঘৃ’ণা লাগেনি?’

আমি চমকে তাকালাম৷ চোখ পিটপিট করে তাকিয়েই রইলাম। সেদিন রাগের মাথায় যা তা বলেছি আমি উনাকে। অথচ বোকার মতো এটা একবারও ভাবিনি যে দো’ষী কখনো তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্লু চোখের সামনে রেখে যায় না৷ উনার দৃষ্টি তখনো আমাতে আবদ্ধ। আমি ঢোক গিলে মাথা নত করে নিলাম। বোকার মতো কত কি করে ফেলেছি এপর্যন্ত! আমি জানি এসবের পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে কিন্তু এই রহস্যর সমাধান যে নেই আমার কাছে। তীব্র বাঁকা হেঁসে বলে,

‘প্রেম প্রেম নেশা তবে লেগে গেছে প্রানেশা?’

উনার এই একটা কথাতেই থমকে গেলাম। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিললাম। তীব্র লাগেজ থেকে কাপড় বের করতে করতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

‘যতটুকু অনুভূতি, মোহ, মায়া আছে তা এখানেই শেষ করো। তীব্র প্রেমের নেশার মতো তীব্র প্রেমের বিরহও কিন্তু ভ’য়ং’কর প্রাণ। তাছাড়াও তোমার আর আমার বিয়েটা তো কেবলই একটা ডিল। এখান থেকে ফিরার পর তোমাকে তোমার জায়গায় ফিরিয়ে দিয়ে আমি ফুল্লি ফ্রি হয়ে যাবো।’

হার্টবিট থেমে গেলো উনার বাক্যগুলোতে। নিজের অজান্তেই ছোট্ট মনে দাগ কেটে গেলো ‘আমাদের বিয়েটা ডিল’ শুনে। শক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। চোখের পাতা ঝাপটালাম কয়েকবার। নিজেকে শক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা নাকি কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা তা টের পেলাম না। তীব্র তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আমার দিকে তার ফোন ছুঁড়ে মারলেন। একবার তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ফোন হাতে নিলাম। উনি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার পূর্বেই কু’টিল হাসি হেঁসে বললেন,

‘পিকগুলো দেখে আবার শ্বাস আটকে ম’রে যেও না যেনো! তোমার এখনো অনেক দেখা বাকি। তাই শ্বাসটুকু বাঁচিয়ে রাখো।’

উনার কথায় বেশ হলাম। কি এমন পিক যা দেখলে আমার শ্বাস আটকে যাবে! কৌতুহলে ফোনটা নিয়ে ভালোমতো পিকটা দেখতেই সত্যি মনে হলো আমার শ্বাস আটকে গেছে। জ্ঞানশূণ্যের মতো একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালাম। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়ালো আনমনেই। অস্পষ্ট স্বরে শুধু বেড়িয়ে আসলো,

‘জিনিয়া বেঁচে আছে!’

চলবে..