তুই আমার কাব্য পর্ব-২১+২২

0
1940

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 21
.
🍁
.

মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেগুলো খালি চোখে যেমন দেখা যায় তেমনটা একদমই না। ওটার পেছনেও অন্য এক কারণ লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় তাকে প্রতিশোধ বলা হয় আবাে অনেক সময় বলা হয় শিক্ষা দেওয়া। মেঘলাও এমন কিছুর শিকার। এইতো কিছুক্ষণ আগেও কি হাসিখুশি ছিলো। আর এখনি কি না রোদে পুরছে।

কিছুক্ষণ আগেই ক্লাসে ডুকেছে মেঘলা। রমরমা পরিবেশ। গমগম আওয়াজ হচ্ছে সবার উপস্থিতিতে। কেউ কেউ আড্ডায় মসগুল আর কিছু মাল্টি ট্যলেন্ট স্টুডেন্ট পড়াশোনায় মসগুল। এদের দেখে মনে হয় এরা এখনো নাইন টেনে পড়ে। সামনে এসএসসি এক্সাম যার জন্য এতো মনোযোগ দিয়ে সারাক্ষণ পড়ছে। ভার্সিটি ওঠে এরকম পড়াশোনা কেমন একটা বেমানান লাগে। মনে হয় পড়াশোনা কলেজ পর্যন্তই। এরপর থেকে লাইফে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার কোনো প্রয়োজন নেই। সকলকে এড়িয়ে মেঘলার চোখ পড়লো তনুর দিকে। পাশে গিয়ে বসতেই তনু তো মহা খুশি। এবার পালা গল্পের ঝুড়ি থেকে গল্পের ফুল নিয়ে গল্পের মালা গাথা। ইতিমধ্যে স্যার প্রবেশ করলো। মেঘলা তনু গল্পের মধ্যে থাকায় স্যারকে প্রথমে খেয়াল করে নি। ইমতিয়াজ স্যার। ভীষণ কড়া। স্যারকে দেখে মেঘলা তনু চুপ হয়ে যায়। স্যার মেঘলা তনুকে ডুকার পরই খেয়াল করেছে। তখন কিছু বলে নি। কিন্তু ওদের বারবার ধমক দিয়ে থামাতে হচ্ছে। কারণ দুজনে গল্পের কারণে তাদের হাসি কন্ট্রোল রাখতে পারছে না। মেঘলা তনু জানালার কাছে বসেছে। হঠাৎ করেই কিছু একটা মেঘলার শরীরে এসে পড়ে। আকস্মিক এমন হওয়ায় মেঘলা চিৎকার করে ওঠে। মেঘলার চিৎকারে পুরো ক্লাসে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মেঘলা খেয়াল করলো কিছুই নেই। কিন্তু কিছু একটা তো অবশ্যই ছিলো। তবে গেলো কই? মেঘলার চিৎকার শুনে স্যার রেগে যায়। রেগে গিয়ে মেঘলার উদ্দেশ্য বলে,

– ইউ! স্ট্যান্ড আপ

– স্যার আই এম সরি।

– আউট ফ্রম মাই ক্লাস

– স্যার সরি। স্যার কিছু ছিলো এখানে। তাই ভয়ে চিৎকার করে ফেলেছি।

– ওহ্ রিয়েলি? কি ছিলো? সো মি।

– স্যার কি ছিলো জানি না বাট ছিলো। বিলিভ মি স্যার।

– তোমারা দুজন ফার্ষ্ট থেকে খুবই বিরক্ত করছো। কিছু বলে নি। এখন আর টলারেট করা সম্ভব নয়। তুমি একা একটা সুস্থ ক্লাসকে অসুস্থ করে দিয়েছো। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে তোমার জন্য। বাইরে গিয়ে রোদে দাড়িয়ে থাকবে। এক চুলও নড়বে না।

– স্যার সত্যি কিছু ছিলো। স্যার সরি।

– নো মোর এক্সকিউজ। যাষ্ট গেট আউট।

মেঘলা কাঁদো কাঁদো করে কথাগুলো বলে। স্যারের ধমকে আর কিছু বলতে না পেরে বাহিরে চলে আসে। স্যার প্রচন্ড রেগে আছেন। যার ফলস্বরূপ ওরা দুজন এখন শাস্তি ভোগ করছে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মেঘলার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। গরমে কপালের কাছে চুল বরাবর ঘাম জমে গেছে। মাথাটাও গরম হয়ে গেছে। মাথাটা উচু করলেই মনে হয়ে পড়ে যাবে। চুপচাপ কোনোমতে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলার কেনো যেনো মনে হচ্ছে পাশে কেউ আছে। মাথা নিচু করেই পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে কাব্য ও তার ফ্রেন্ড অনি আসছে হেটে। কাব্যর মুখ লাল বর্ণ হয়ে আছে। চোখে গরম। তাপমাত্রা মাপলে চল্লিশ পার হয়ে যাবে এমন। কাব্যর মেঘলার দিকে এমন লুক নিয়ে তাকিয়ে থাকার কারণ কিঞ্চিৎ বোধগম্য হলো না মেঘলার।
মেঘলা মনে মনে ভাবে,

– এই ব্যাটার আবার কি হইছে? চোখ মুখ এমন করে তাকিয়ে এদিকে আসছে কেনো? আমি কি কিছু করছি? নাহ্! আমি তো ওনার ধারের কাছেও যাই নি। তবে? দেখে তো মনে হচ্ছে কাচ্চা চিবিয়ে না না গ্রিল করে তন্দুরির সাথে খেয়ে নেবে।

মেঘলা কাব্যর দিকে তাকিয়ে আছে। কাব্যও মেঘলার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এসে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে জরুরি কাজের জন্য স্যারকে নিয়ে গেলো। স্যার যাওয়াতে মেঘলারা শাস্তি থেকে মুক্তি পেলো। কাব্য যাওয়ার আগে মেঘলার উদ্দেশ্য বলে গেলো,

– শাস্তিটা হিসেবে খুবই কম হয়েছে । আরো বড় কিছু ডিজার্ভ করো তুমি। আমার জিনিস আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার দুঃসাহস একদম করবে না।

বলেই কাব্য চলে গেলো। মেঘলা আগা গোড়া কিছুই বোঝতে পারলো না। নির্বাক দৃষ্টিতে কাব্যর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিসের শাস্তির কথা বলে গেলো? আর ওনার কি নিতে চেয়েছে মেঘলা? আশ্চর্য! বেশ অদ্ভুত মানুষ। কি বলে কেনো বলে তার কোনো আগাগোড়াই নেই।

🍁

প্রত্যেক পরিবারেরই একজন এমন সদস্য থাকে যে কি না কাজও কম করবে কিন্তু কাজের ভুল ধরবে ষোলআনা। মেঘলাও সেই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। ফ্যামিলি ট্যুরের আয়োজন করেছে মেহেরের শ্বশুর ওরফে কাব্যর বাবা। কোনো উৎসব নয়, কোনো কারণও নেই। মন চেয়েছে তাই নাকি ঘুরতে যাবে। একা একা ঘুরে মজা নেই তাই মেঘলাদেরও স্ব পরিবারে যাওয়া আবশ্যক। সবাই বেশ খুশি শুধু মেঘলা ছাড়া। তার একমাত্র কারণ অবশ্যই কাব্য। তারমধ্যে মেঘলা অবগত যে কাব্য কোনো এক কারণে ভীষণ রেগে আছে কিন্তু কারণ সেইটা অজানা। এই অজানা রাগের জন্য মেঘলা বেশ আতংকিত। তার ধারণা কাব্য রাগে তাকে রাস্তায় ফেলে দেবে, নয়তো ধাক্কা দিয়ে মেরে দিবে। অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা। এতো চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে নিজের প্যাকেজিং ও অন্যান্য কাজ করতে পারছে না। মোহনা করে দিচ্ছে তাতেও স্যাটিসফাইড হচ্ছে না। বরং আরো ভুল ধরে উল্টা পাল্টা করে দিচ্ছে।

আটটা বিশ মিনিটে বাস।
সবার সব কিছু গোছানো শেষ। মেঘলা খুব ঝামেলার মধ্যে দিয়ে হলেও শেষ করতে পেরেছে। একে একে বের হয়ে যাচ্ছে সব। সবাই বাস স্টপে ওয়েট করছে। মেঘলার মনে এক বিশাল প্রশ্ন। নিজেদের ঘাড়ি থাকতেও বাস কেনো? এমন উদ্ভট আইডিয়া কার মাথা দিয়ে বের হয়? গাড়ি বাস স্টপে এসে পৌঁছালো। মেহেররা সবাই আগে থেকে অপেক্ষা করছে। সবাই বসে আছে সিটে। মেহের ওর মেয়েকে শাশুড়ীর কাছে দিয়ে চলে এলো মেঘলাদের কাছে। সবাই খুবই এক্সাইটেড। একসাথে এই প্রথম ট্যুরে। কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মেঘলার বাবা ও মেহেরের শ্বশুর ছাড়া কেউই জানে না তারা যাচ্ছে কোথায়।
বাস এসে পড়েছে একে একে সবাই ওঠে সিটে বসে পরার পর মেঘলা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে কারণ সে সিট পায় নি। অবশেষে দেখা গেলো তার জন্য সিট রয়েছে একদম পেছনে যেটা মূলত কেটেছিল কাব্যর জন্য। কেননা সে নাকি সবার থেকে আলাদা বসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এখন মত ঘুরে গিয়েছে আর তার এই মত বদলের স্বীকার হতে হলো মেঘলাকে। মেঘলা পাড়ে তো চিৎকার করে বসে এক দফা কেঁদে নেয় নয়তো গাড়ির সব কটা কাঁচ ভেঙে সেগুলো কাব্যর মাথায় গুড়ি গুড়ি করে ছিটিয়ে দেয়। মেহের মেঘলার কাছে বসতে চাইলে মেঘলা না করে কেননা তার মেয়েকে নিয়ে শেষে বসা ঠিক হবে না। শেষে সম্পূর্ণ সিটটাই খালি। একজনও নেই। মনে হচ্ছে যেনো সবগুলোই কেটে রাখা হয়েছে। একদিকে ভালোই হয়েছে ভেবে মেঘলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে একটা বই নিয়ে বসে পড়ে। গানে ইয়ারফোন গুজে বই পড়তে থাকে।
রাত দশটা বাজে প্রায়। ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ। চোখ কোনো বাঁধ মানছে না। মেঘলা সম্পূর্ণ ডুকে গেছে গল্পটায়। না শেষ করে ঘুমোতে চাচ্ছে না। ঘুমের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করছে । যুদ্ধ জয়ী ঘুমই হলো। চোখের পাপড়ি গুলো নেমে এলো। আনুমানিক বেশ অনেকক্ষণ পর মেঘলার মনে হলো কেউ তার কানের ইয়ারফোন খুলে রাখছে সাথে হাত থেকে বইটাও রেখে দিচ্ছে। মাথার নিচে বালিশ জাতীয় কিছু একটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মেঘলা কেউ তার পা দুটো তুলে শুয়ে দিচ্ছে। বাসের ঝাকির কারণে ঘুমটা অতটা গভীর না হওয়ায় সবকিছু আবছা বুঝতে পারছে কিন্তু এতোটাই ঘুম পাচ্ছে যে চোখ মেলে তাকাতেও পাচ্ছে না। কারো একজনের যত্নের হাত মাথায় টের পেতেই ঘুম যেনো আরো পাকাপোক্ত ভাবে ঝেকে বসলো।

বেশ গরম অনুভব করে ঘুম ছুটতে লাগলো মেঘলার। চোখটা খুলেই আবিস্কার করলো সে শুয়ে আছে সিটে। দুই পা ভাজ করে পাশফিরে সুয়ে আছে। ওঠে বসতেই আবছা খেয়াল আসলো তখনকার কথা। কেউ কি সত্যি ছিলো? আমি কি একাই সুয়ে পড়েছি নাকি সত্যিই কেউ শুয়ে দিয়েছিলো? তাহলে তো মাথার নিচে কিছু থাকার কথা। এখানে তো কিছুই নেই। তবে কি ভ্রম ছিলো? মেঘলা চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবে,

– যা ভ্রম হওয়া উচিৎ তাই আসলে ঘটে আর যা চাই জীবনে ঘটুক সেটাই স্বপ্ন হয়, সেটাই কল্পনায় মিশে থাকে।

জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখে বাস জ্যামে আটকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে লম্বা জ্যাম। গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মেঘলা। তার মধ্যে পেছনে সিট। খুব খারাপ লাগছে। গা গুলাচ্ছে। কাউকে ডাকবে ভেবে ডাকছে না। যদি সবাই ওঠে যায়। ওরা খুব একটা দুরে না, দুই সিট আগে। ওর মা বাবার সিট আর ওনারাই শেষে। বাকিরা ওনাদের আগে হয়তো পাশে। মাঝখানে অন্যান্য যাত্রীরা। মেঘলা ডাক দিতে গিয়েও ডাক না দিয়ে চুপ করে রইলো। ভীষণ খারাপ লাগছে। আশে পাশের গাড়ির গন্ধে বমি বমি লাগছে। এক পর্যায়ে বমি করেই দিলো। সচরাচর মেঘলার বমি হয় না। কিন্তু আজকে তুলনামূলক গরম বেশি আর শেষে বসাতেই গরমটা অতিরিক্ত লাগছে৷ যার জন্য শরীর খারাপ করছে। বমি করছে তখনই পিঠে কারোর হাতের অস্তিত্ব পেলো মেঘলা। ঘুরে যাকে দেখলো তাকে একদমই আশা করে নি। অন্ধকারেও চিন্তিত চোখ দুটো মেঘলার চোখ এড়ালো না। মেঘলাকে সোজা করিয়ে বসিয়ে জানালা দিয়ে মুখে পানি দিয়ো মাথাটা সিটে রেখে পানি খাইয়ে দিলো কাব্য। মেঘলার খুবই ক্লান্ত আর দুর্বল লাগছে। তাই কোনোরকম কথা অথবা রিয়েকশন না দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো মেঘলার। কাব্য এক হাত দিয়ে মেঘলার চোখের পানি মুছে দিয়ে মেঘলার পাশে বসে ধীর সুরে বলে,

– খুব খারাপ লাগছে?

মেঘলা চোখ বন্ধ করে রেখেই নিস্তেজ শরীরে বলে,

– হুম

– ঠান্ডা পানি খাবে?

– হুম

– আচ্ছা বসো। আমি আসছি। ওঠবে না একদম। আমি যাবো আর আসবো।

– হুম

কাব্য ওঠে চলে গেলো। মেঘলা জানালার দিকে মুখ ঘুরে তাকাতেই দেখে কাব্য দোকানে। কাব্য দোকানে? এখন এই সময়ে? সে তো কেবলই ছিলো এখানে? তবে কি তার জন্য ঠান্ডা পানি কিনতেই এর মধ্যে দোকানে গেলো? কাব্য এক হাতে একটা আইসক্রিম, একটা ঠান্ডা পানির বোতল আর আরকেটা জুস নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে আসছে। মেঘলা ক্লান্ত চোখে কাব্যর দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা একটা শার্ট, কালো প্যান্ট পায়ে ক্যজুয়াল লোফার সু। হাতা ফোল্ড করা। চুলগুলো বরাবরের মতো কপালে পড়ে আছে। বরাবরের মতো হ্যন্ডস্যাম লাগলেও কিছু একটা অন্যরকম লাগছে। হ্যা! মুখটা বিষন্ন। চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কি নিয়ে এতো চিন্তিত? তার চিন্তার কারণ কি মেঘলা? এই কাব্যকে তো মেঘলা চেনে না। অন্যরকম ভালোলাগার কাব্য এ। কাব্য সবর্দা এমন ভালোবাসায় পূর্ণ থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো? হয়তো হতো। ডুবে যেতো মেঘলা। সাঁতার না জানার অভাবে ডুবে মারাই যেতো হয়তো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মেঘলার মলিন মুখে ঠোঁটের কোণে হাসির ছোট্ট রেখা ফুটে ওঠলো।

চলবে….. ❤

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 22
.
🍁
.

আপন গতিতে বাস ছুটে চলছে। বেশ দ্রুতই চলছে। ব্যপক সময় যাবৎ জ্যামে আটকে থাকার পর বাসের চাকা এবার বাঁধাহীনভাবে ছুটছে। জানালা দিয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। একটা মলিন গভীর ঘুমন্ত মুখ কাব্যর কাঁধকে আশ্রয় করে শুয়ে আছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়ানো মেঘলার। মাথাটায় কাব্যর এক হাত আলতো করে রাখা। ঘুম ঘুম ভাবে কাব্যর চোখজোড়াও বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু বেশ কষ্ট করে তাকিয়ে আছে। যেনো তার ঘুমানো মানা তাই ঘুমাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর মেঘলার দিকে চোখ যাচ্ছে কিন্তু স্থায়ী করতে পারছে না। চোখ যেনো ঝলছে যাচ্ছে। এতো সৌন্দর্যের তাপ তার ওই দুটো চোখ মনে হচ্ছে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। তাই ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে।
বেশ কয়েকটা ঝাকুনির প্রভাবে শান্তির ঘুম নষ্ট হয়ে গেলো মেঘলার। ঘুম থেকে ওঠে নিজেকে আবিষ্কার করলো আবারো সেই সিটে পা ওঠিয়ে শোয়া অবস্থায়। মেঘলার বারবার মনে হচ্ছে ও সারারাত এভাবে ছিলো না। ও কারো আশ্রয় ছিলো, কারো ছায়ায় ছিলো। আর বারবার কারো শব্দটা মাথায় আসতেই মনে একটাই ধ্বনি ওঠছিলো ” কাব্য “।

🍁

এতিম এতিম টাইপ নিয়ে সবাই একটা পাহাড়ি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। মেঘলা ক্লান্তির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে লাকেজের ওপরে বসে পড়ে। সকলের মুখে বিরক্তভাব কাব্য ব্যতীত। কেননা সকলের বিরক্তিভাবের কারণটা কাব্য নিজে। প্ল্যান ছিলো সেন্টমার্টিন দ্বীপ যা দুজন হেড ছাড়া কেউ জানতো না। চট্টগ্রাম এসে বাস পরিবর্তন করার সময় কাব্য জানতে পেরে বিশাল বাঁধ দ্বার করিয়ে রেখেছে। সে যাবে না এতো দূর। তার নাকি এতোদূর জার্নি করার এনার্জি নেই। খুবই দুর্বল লাগছে। কাব্যর এসব কথা শুনে মেঘলা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। যেখানে মেঘলার এইসব কথা বলাটা মানায় সেখানে দিব্যি সুস্থ মানুষ এমন কথা বলছে। মেঘলা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে না পেরে ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে। কাব্যর বাবা বিরক্ত হয়ে কাব্যকে বলে ওঠলেন,

– তুমি কি একটু বেশি ছেলেমানুষী করছো না?

– একদমই না বাবা। আমার খারাপ লাগছে আমি যেতে পারবো না এতোদূর। আমি আমার রায় জানিয়েছি। আমার মনে হয় আমার রায় সকলকে জানানোর মতো অধিকার আমার আছে। আর নিশ্চয় কেউ অসুস্থ অবস্থায় বেড়াতে চাইবে না।

– তোমাকে দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না কোথাও।

– জরুরি না যে অসুখ সবসময় চোখে ধরা পড়বে।

– তাহলে আমরা কি এইভাবেই বসে থাকবো?

– আমি একবারো সেইটা বলি নি। চট্টগ্রামেও অনেক জায়গা আছে বেড়ানোর। সেখানে যাও। সেন্ট মার্টিন এখনো অনেক দুর আর তার মধ্যে লঞ্চ জার্নিও করতে হবে। এইটা সম্ভব না। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান সহ আরো কিছু জায়গা আছে যেগুলো আমাদের দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। কয়েকদিন সময় নিয়ে বিশ্রাম করে করে এসব জায়গায় বেড়াও।

কাব্যর কথা শুনেই মোহনা বলে,

– একদম। চলো না আমরা সাজেক যাই। অনেক পপুলার একটা স্পট।

আবির একটা পানির বোতল নিয়ে মুখ খোলতে খোলতে বলে,

– অতি সস্তা একটা জায়গায় পরিণত হয়েছে। যে জিনিসে বেশিরভাগ মানুষের আকর্ষণ বেশি তার দিকে আমার কোনো আর্কষণ নেই। একটা কথা মনে রাখবে, পচা খাবারে মাছি বেশি পড়ে।

কাব্যর এমন অদ্ভুত যুক্তির প্যচে সবাই নিবার্ক। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গন্তব্য বান্দরবন। তবে বাসে না আর। গাড়ি বুক করা হয়েছে গাড়ি আসছে। ততক্ষণে সবাই খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে নেবে। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই গাড়ির জন্য বসে গল্প করছে। মেঘলা সবার পেছনে বসে মাথায় হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে। কাব্য বসেছে। হাতে কিছু একটার প্যকেট, জুসের প্যাকেট টাইপ। খুলে মেঘলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

– এক মিনিটের মধ্যে শেষ করো।

মেঘলা কপাল কুচকে জিনিসটা কি বুঝার চেষ্টা করতেই দেখে ইন্সটেন্ড মিল্ক। চোখ কুচকে পাশ ফিরে বলে,

– খাবো না

– আমি তো জিজ্ঞাসা করি নি। দিয়েছি খাবে। কোনো অপশন নেই।

– আশ্চর্য! এরকম সিচুয়েশনে কে এইভাবে দুধ খায়? আর এতো মানুষের মাঝে আমি ভিন্ন খাবার খাই কি করে? আর এমনিতেই দুধ আমার ভালো লাগে না। আমি খাবো না।

– কসিয়ে একটা চড় গালে পড়লে সবই ভালো লাগবে।

– আশ্চর্য! আমাকে এইভাবে জোড় করছেন কেনো হ্যা? বলছি তো খাবো না।

কাব্য মেঘলার দিকে চোখ গরম করে তাকায়। কাব্যের চাহনি দিখে মেঘলার গলা শুকিয়ে আসে। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দুধটা নিয়ে খেয়ে নেয়। কাব্য সেখান থেকে ওঠে যেতেই মেঘলার ডিকশনারির সকল বকা কাব্যকে উৎসর্গ করে দিলো। একটু পরেই গাড়ি আসে। সকলে রওনা দেয়া বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। একটা হোটেলে ওঠে সকলে যে যার মতো চলে গেলো যার রুমে। মেঘলা ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে কিছু চিপস কিনতে নিচে নামতেই রিসিপশনের দিকে তাকাতেই হা। দৌড়ে গিয়ে একজন নারীকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– হোয়াট আ কো-এক্সিডেন্ট খালামনি। তোমরাও এখানে? কিভাবে? কেনো?

– আরে মেঘলা তুই এখানে? মানে তোদের তো সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা ছিলো। এখানে কি করে? তুই এখানে মানে সবাই এখানেই।

– হ্যা সবাই এখানেই। হঠাৎ করেই ডিসিশন চেন্জ করা হলো তো তাই।

– বাহ্! ভালোই হলো। সবাই একসাথে সময়টা আনন্দময় হবে।

– তুমই একাই?

– না। সবাই আসছি। তোর খালু, বড় ভাই, আবির। আবির একটু বাহিরে আর ওরা দুজনে ওপরে ব্যাগ নিয়ে গেছে।

– আম্মু জানলে অনেক খুশি হবে খালামণি। চলো চলো ওপরে যাই। আম্মুর সাথে দেখা করবে চলো।

মেঘলার কথা শেষ হতে হতেই আবির এসে হাজির। মেঘলাকে এই সময় এখানে আবির দেখতে পাবে তা যেনো স্বপ্নেও কল্পনা করে নি। তাই বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– মেঘলা তুমি এখানে?

মেঘলা আবিরের কন্ঠ শুনে পাশ তাকিয়ে একট্ হাসি দিয়ে উত্তর দেয়,

– ইয়াহ্! ইটস মি। হঠাৎ প্ল্যান চেঞ্জ হওয়ায় এখানে। ভালোই হলো বলো। সব একসাথে মজা হবে তাই না?

সবাই একসাথে শুনে আবিরের মুখটা সামান্য ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। জোড় পূর্বক একটা হাসি দিয়ে বলে,

– হুম।

– আচ্ছা বললে না তো হঠাৎ তোমারা এখানে যে।

আবির ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে কথা ঘুড়ানোর জন্য বলে,

– মা! তুমি এখনো এখানে কি করো? তোমার বান্ধবী এখানে। দেখা করে এসো যাও।

– কিন্তু চাবি?

– আরে আমি নিয়ে আসছি। যাও। মেঘলা আর আমি আসছি।

আবিরের মা ওপরে চলে যেতেই আবির মেঘলার দিকে তাকাতেই দেখে মেঘলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলার এমন দৃষ্টির কারণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে,

– কি? তাকিয়ে আছো যে ওভাবে?

– কিছু হয়েছে কি?

– কি হবে?

– কিছু একটা তো অবশ্যই যা জানি না।

– কি দেখে মনে হচ্ছে?

– কেনো এসেছো কারণ জিজ্ঞাসা করলে খালামনি প্রথমে বললো না। আপনাকে জিজ্ঞাসা করতেই নার্ভাস হয়ে গেলেন আর খালামনির মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট কিছু একটা হয়েছে অবশ্যই।

– আরে না। খামোখা ভাবছে। কিছুই না।

– ওকে না বলতে চাইলে নাই। পর তো আমি বলবেনই বা কেনো? এমনি তো খুব বলেন পিচ্চি কালের বান্ধু কিন্তু আসলে তেমন কিছুই না।

– তুমি কি ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছো?

– নাহ্! বলুন না কি হয়েছে? খালামনির মুখটা না অন্যান্য দিনের চেয়ে শুকনো শুকনো লাগছে। বলুন না প্লিজ কি হয়েছে।

মেঘলার এতো রিকুয়েষ্ট করার পর আবির মাথা তুলে মেঘলার দিকে তাকালো। আবিরের চোখ লাল হয়ে আছে। আবিরের এমন চোখ দেখে মেঘলা বেশ অবাক হয়ে যায়। এরপর আবির চাবিটা হাতে নিয়ে নরম সুরে বলে,

– জানাবো সময় হলে।

– আজকেই জানাবেন।

– হুম। আসছি এখন।

– বলে গেলেন না?

– মেঘলা আমি যখন বলেছি জানাবো তখন জানাবো। কিন্তু এখন না। প্লিজ। ভালো লাগছে না। খুবই টার্য়াড।

আবির কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলো। মেঘলা আগের যায়গায়ই স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। আবিরকে আগে কখনো এমন বিহেভ করতে দেখে নি। তাই বেশ অবাক হলো আর এতোটুকু বুঝতে পারলো বিষয়টা খুবই সেনসেটিভ না হলে পুরো ফ্যামিলির এমন অবস্থা হতো না। কিন্তু কি সেইটা? এমন কিছু না তো যা পুরোনো কিন্তু নতুন সম্পর্কে ফাটল ধড়াবে? নাকি খামোখা এসব ভাবছে। এমন কিছুই না৷ অতি তুচ্ছ বিষয়।

চলবে….. ❤