তুই আমার কাব্য পর্ব-২০

0
1506

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 20
.
🍁
.

মেঘলা খাটের উপর দুই পা তুলে বসে আছে। ডান হাত দিয়ে জামা চিমটচ্ছে আর ডান হাতের নখ দাঁত দিয়ে কাটছে। এক দৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া কুচকে বিশাল চিন্তায় মগ্ন। কিছুক্ষণ আগে কাব্যর টেবিলের উপরে একটা রঙ্গিন ঘুড়ি এবং কিছু রঙ্গিন কাগজ দেখেছে। ঘুড়িটা একদম সেই ঘুড়িরগুলোর মতো যেগুলো মেঘলাকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কলমও ছিলো। মেঘলা যেনো গোলকধাঁধায় আছে। ব্রেন বলছে এক কথা মন বলছে আরেক কথা। একদিকে যেমন প্রথম দেখাতেই মেঘলার মনে হলো অজানা ব্যক্তিটি কাব্য ঠিক তার সাথে সাথে মন বলছে একদমই না। এই খারুসটার দ্বারা ওসব সম্ভব না। যে কিনা মেঘলাকে পেরেসান, ছোটো ছোটে ভুলে শাস্তি দেওয়া আর হুটহাট অপমান করতে এক চুল ছাড়ে না সে মেঘলাকে ভালোবাসে? এইটা বিশ্বাস তো দুর মেঘলার ভাবতেই অসম্ভব বস্তু মনে হচ্ছে। মেঘলার মতে এ ছেলে যে কাউকে ভালোবাসতে পারে কিন্তু মেঘলাকে কখনোই না। ভাবতে ভাবতে মেঘলা সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। শুধু শুয়ে পড়াতেই থেমে নেই। ভাবনা এখনো অটুট, সে আপন গতিতে চলছে।

বিরক্তিকর কিছু চিল্লানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো মেঘলার। ঘুমটা যদি অস্বাভাবিকভাবে ভাঙ্গে তাহলে বিরক্তিটা বোধহয় একটু বেশিই হয়। বিরক্ত হয়ে মুখ কুচোমুচো করে ওঠে বসে আসে। শব্দের উৎস ও কারণ জানার বিন্দু মাত্র আগ্রহ মেঘলার মুখে নেই। ঘুমটা ভেঙ্গে দিয়েছে সেটার সম্পূর্ণ রাগ ও অসহ্যকর মনোভাব মুখের ওপর প্রতিফলিত হয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই আশ্চর্য। সাড়ে বারো টা বাজে! এমন অসময়ে সে এতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো। কেনো? সকালে ঘুম থেকে ওঠে আবারো ঘুমানো ব্যপারটা বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকার পর শব্দের উৎপত্তি স্থান এর উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। হইচই গুলো ছাদ থেকে আসছে। মেঘলা ঘুম ঘুম চোখে গুটি গুটি করে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেল। ছাদে ওঠতে ওঠতে মোহনার গলার আওয়াজও পাচ্ছে। মোহনা কি তবে এ বাড়িতে এসেছে? একাই এসেছে নাকি সবাই এসেছে। প্রশ্নগুলো মনে মনে করতে করতেই ছাদের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিশাল হৈ-হুল্লোড়ে ব্যাপার। এরকম দৃশ্য মেঘলার এই বিশ বছরের জীবনে একদিনও দেখে নি। তাই কিঞ্চিত অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু বেশ ভালো লাগছিলো। মেঘলার বাবা ও কাব্যর বাবা দুজনে ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভর দুপুরে ঘুড়ি প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত তাই না? সূর্য যখন মাথার ঠিক উপরে তখন কেউ ঘুড়ি ওড়ায়? বাসার সবার অবস্থান ছাদেই। শুভ তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে চিয়ার আপ করছে। এদিকে মেহের ও মোহনা তাদের বাবার পাশে দাড়িয়ে চিয়ার আপ করছে। আর কাব্য একপাশে পা ক্রস করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের ঘুড়ি পর্যবেক্ষণ করছে। কানে বিশাল আকারের হেডফোন। রোদের প্রভাব খুব একটা পড়ে নি তার উপর কেননা সে নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো দিনের আলোর ঝলকে হালকা বাদামি রঙের হয়ে আছে। তার মুখে চোখে এমন কি শরীরের কোনো অঙ্গেই সামান্য আনন্দের রেশটুকু দেখা যাচ্ছে না। সকলে যেখানে আমেজে আটখানা সেখানে এই এক প্রাণী ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর ন্যায় দন্ডায়মান। কাব্যর এমন ভাব ভঙ্গি দেখে মেঘলার অসহ্য লাগছে নাকি বিরক্ত লাগছে তা নিয়ে সামান্য কনফিউজড সে। পাশে তাকিয়ে দেখে মেঘলার মা এবং মেহের শ্বাশুড়ি একটা ছাতার নিচে বসে আছে। মেহের শ্বাশুড়ি যিনি কাব্যর মা তিনি বেশ হাসিখুশি এবং খুবই মিশুকে একজন নারী। এ কয়দিনের পর্যবেক্ষনে মেঘলা এইটুকু রায় দিতে পেরেছে। বাকি কিছু থাকলে এই মূহুর্তে তার পক্ষে জানা সম্ভব না। মেঘলাকে দেখে মেহেরের শ্বাশুড়ি হেসে তাকে তার দিকে আসার ইশারা করে। মেঘলা বাধ্য মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসে। মেঘলার ঘুমের ভাবটা এখনো পুরোপুরি কাটে নি। আর অসময়ের ঘুমের প্রভাবটা সহজে কাটতেও চায় না। মেঘলার খুব ইচ্ছে করছে মেহের আর মোহনার সাথে গিয়ে দাড়াতে। কিন্তু অলসতায় ডুবে সে আর হলো না। টান টান উত্তেজনায় খেলা হচ্ছে। কারো একজনের ঘুড়ি কাটা পড়বেই এবার। বলতে বলতেই কাব্যর বাবা ঘুড়ি কেটে গেলো। সাথে সাথে মেহের ও মোহনা চিল্লিয়ে বলে ওঠলো

– ভৌকাট্টা

মেঘলারও বেশ খুশি খুশি লাগছে। কি মনে হতেই যেনো মেঘলা কাব্যর দিকে তাকালো। তাকানোর সাথে সাথে কাব্যের সাথে চোখাচোখি হলো। কাব্য দ্রুত চোখ সড়িয়ে নিল। কাব্য তার দিকে তাকিয়ে ছিলো নাকি কেবলই তাকিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মেঘলা খেয়াল করলো সে ইদানিং কাব্যর খুব ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়েই খুব ভাবছে। কিন্তু কেন? নিজের কাছেই নিজের বিশাল এক প্রশ্ন। সবাই নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘুড়িটা নামিয়ে ফেলছে ঠিক সেই সময়েই মেঘলার চোখ পড়লো ঘুড়ির ওপর। এ তো সেই ঘুড়ি যেটা সকালে কাব্যর রুমে দেখেছিলো। তার মানে কি এর জন্য কাব্য ঘুড়ি বানাচ্ছিলো? ইস্! আর মেঘলা কি না কি ভাবছিলো? তিল কে তাল ভেবেছিলো। নিজে নিজেই নিজের মাথায় হাল্কা হাত দিয়ে বারি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। সবাই চলে গেলো একে একে শুধুমাত্র কাব্য তার নিজের জায়গায় মোবাইল নিয়ে স্থির। মেঘলা নেমে যেতেই মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে মেঘলার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে ঘাড়ে নিয়ে নিচে চলে এলো।

🍁

মেঘলার রুমে লঙ্কা যুদ্ধের ভাষণ চলছে। বক্তা সে নিজেই। শ্রোতা হিসেবে আছে মোহনা ও মেঘলার মা। তার বিরুধী দল সকল সময়ের মতো মোহনা। মেঘলার রাজ্যের সকল কিছু নাকি মোহনা এতোদিন বেআইনিভাবে ভোগ করে গেছে এবং সাথে সাথে নষ্টও করেছে। যার জন্য সে ভার্সিটি যাওয়ার জন্যও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। মোহনা এক কোণায় চুপচাপ মুখ কালো করে বসে আছে। আর মেঘলার ভাষণ ট্রেনের গতিতে ছুটেই চলছে। এইটা খুঁজছে আর কথা শুনাচ্ছে। আয়নার সামনে বসে রেডি হওয়ার সময়টুকুও ছেড়ে দিচ্ছে না। নিজের জিনিস জায়গা মতো না পেলে রাগ না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। যেমটা কালকে ও বাড়িতে থেকে চলে আসার সময় মেঘলার মন হুট করেই খারাপ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। আর এই অস্বাভাবিকভাবে মন খারাপ হওয়াটা বুঝতে পেরে যেনো মেঘলা নিজের উপর চরম বিরক্ত। যার প্রতিচ্ছবি সে সব কিছুতেই প্রতিফলিত করছে। মেঘলা না খেয়েই বেড়িয়ে গেলো ভার্সিটির উদ্দেশ্য। ভার্সিটির গেটে ডুকতে ডুকতেই আবিরের সম্মুখীন মেঘলা। আবিরকে সামনে দেখে মেঘলার মুখোভাবের সামান্য পরিবর্তন হয় নি বরং আরো কুচকে যায়। আবির মেঘলার সামনে দুই পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। মেঘলা আবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– কি চাই?

– তোমাকে।

– কেনো চাই? আমি কি কোনো জিনিস যে আমাকে চাই?

– চলো ওদিকে আমার সাথে।

– যাবো না।

– তুমি যাবে না তোমার ঘাড় যাবে।

– ঘাড় নিয়ে যান তবুও আমি যাবো না।

– মেঘ বারাবাড়ি করো না। যেতে বলছি আসো না হলে জোড় করে নিয়ে যাবো। ভালো হবে কি ব্যাপারটা?

– যাবো না কারো সাথেই কোথাও। আপনাকে আম্মু পাঠায়ঠে আমি জানি।

– জেনে আমায় উদ্ধার করেছো। এখন যদি না যাও তাহলে…

– কি তাহলে?

আবির মেঘলার দিকে ঝুকে কানে কানে বলে,

– আমার ফোনে না একটা বাচ্চার ছবি আছে। সাদা একটা ড্রেস পড়া। বাচ্চাটার উপরে ময়দা পড়ে পুরোটায় সাদা হয়ে আছে। রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

– হ্যা তো আমি…….. নাআআআ। আমি যাবো। কোথায় যেতে হবে? খাওয়াে জন্য তো? যা খেতে বলবেন, যতটুকু বলবেন সব খাবো।

– দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। শুধু শুধু নাটক করলে।

– আমি নাটক করেছি?

মেঘলা রাগি চোখে আবিরের দিকে তাকায়। আবির মেঘলার রাগি ফেস দিখে ফিক করে হেসে দেয়। আবিরের হাসি দেখে মেঘলার ঠোট উল্টিয়ে মনে মনে বলে,

– সব কটা ছেলেই বজ্জাতের লিডার। ভাবছিলাম আবির ভাইয়া মনে হয় একটু অন্য রকম। ইয়ে ভি বজ্জাত নিকলে। হু!

আবিরের মেঘলার ফেইস দেখে চরম হাসি পাচ্ছে। কিন্তু কোনো রকম আটকিয়ে রেখেছে। সকালে মেঘলার মা মেঘলাকে কিছু না বললেও আবিরকে ফোন করে সব বলে আর মেঘলা সেইটা শুনে ফেলে। সে জানতো আবিরের সাথে দেখা হবে আর আবির তার মায়ের অনুরোধ অবশ্যই রাখবে। তাই মেঘলারও পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো আবিরের সাথে জগড়া করার কিন্তু বেশিক্ষণ টিকলো না। আবির দূর্বলস্থানে আঘাত করে দিয়েছে। মেঘলা চামচ দিয়ে বিরিয়ানি খাচ্ছে। সামনে আবির বসে আছে। মেঘলার খাওয়া শেষে হাত বাড়িয়ে মুঠ খুলে মেঘলার সামনে কিছু মেডিসিন দিলো। মেঘলা ভদ্র মেয়ের মতো সেগুলোও খেয়ে নিলো। ওঠতে যাবো তখনই আবির বসতে বলে পুরো এক বক্স বাটার স্কচের আইসক্রিম এনে সামনে রাখলো। তার পাশেই বড় দুটো কিটকেট। মনুষ্য ক্রোধ দুর্বল হয়ে পড়ে পেটে খাবার পড়লে। মেঘলার রাগ কিছুটা কমে গিয়েছিলো সকালের খাবারটা খাওয়ার সময়ই। তারপর সামনে এতো পছন্দের খাবার দেখে রাগ গলে আইসক্রিম। মেঘলা খুশিতে চকলেটগুলো হাতে নিয়ে আবিরকে বলে,

– আপনি এটাও জানেন চকলেট খেলে যে আমার মিজাজ খিট খিট ঠিক হয়ে যায়?

– হবু বউয়ের সম্পর্কে এতোটুকু জানবো না?

– হবু বউ?

মেঘলা চোখ ছোট ছোট করে আবিরের দিকে তাকায়। আবির টেবিলের ওপর হাত রেখে মেঘলার দিকে এগিয়ে এসে বলে,

– হ্যা তো। তুমিই তো ঠিক করে রেখেছো। এতে কিন্তু আমার কোনো দোষ নেই। প্রথমে আমি রাজি ছিলাম না কিন্তু ভাবলাম ছোট মানুষ তুমি। না করলে আবার কান্না করতে পারো তাই রাজি হয়ে গেলাম। হা হা

আবিরের কথায় মেঘলা আবির দুজনেই হেসে আটখানা। আবির মেঘলার মুখে হাসি দেখে ছোট্ট এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

🍁

ক্লাসে ইকোনোমিকস ক্লাস হচ্ছে। স্যার লেকচার দিচ্ছেন। মেঘলা আর তনু ক্লাসের বাহিরে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ভার্সিটি পর্যায়ে এসেও ক্লাসের বাহিরে বের করে দেওয়ার মতো শাস্তি সত্যি ভীষণ অপমানজনক। অপমানে মেঘলা আর তনুর মাথা নিচু হয়ে আছে। মেঘলার তো ইচ্ছে করছে ফ্লোরটা জাদু করে ফাঁক করে এর ভিতরে চলে যেতে। কিন্তু আফসোস! সম্ভব নয়। মেঘলা তো এটা ভেবেই পাচ্ছে না কিছুক্ষণ আগে যা ঘটলো তা তো কিভাবে ঘটলো? কেউ নিশ্চয় ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটিয়েছে। কিন্তু কে এবং কেনো?

চলবে…… ❤