তুই_আমার_কাব্য 🍂
#Writer: Anha Ahmed
#Part: 35+36
.
🍁
.
গুমোট পরিবেশ। একটা মশা উড়ে গেলেও সকলের ধ্যান কনভার্ট হবে সেদিকে। পাশের মানুষের হৃদযন্ত্রের শব্দ অনুভব করা যাবে। প্রতিটা মুখ থমথমে। কারো রাগে, কারো টেনশনে আর কারো কারো শুধুমাত্র নামে। মানে সবাই করে আছে তাই আমিও মুখটা ওরকম করে রাখবো এমন টাইপ। পরিস্থিতির সাথে তাল মেলানো যাকে বলে। এই রকম তাল মেলানোর দলের অর্ন্তভুক্ত শুভ, কাব্য ও মোহনা। বসেও আছে তিনটে একসাথে। সিঁড়ির শেষ দুটোতে সিঁড়িতে তাদের বর্তমান অবস্থান। প্রথমে শুভ, যিনি বুড়ি আঙ্গুল দিয়ে থুতনির একসাইড স্লাইড করছেন। দ্বিতীয়তত দা গ্রেট কাব্য, শুভর এক সিঁড়ি নিচে বসে পেছনে শুভকে সম্বল করে আরামে বসে আছে আর তৃতীয় অকাল পক্ক মোহনা শুভর পাশে বসে দুই গালে দুই হাত রেখে বসে আছে। এদের অবস্থানটা দৃশ্যমান হলেই একমাত্র বোঝা যেতো এরা কি পরিমাণের স্বাভাবিক মুডে আছে। বিনে পয়সায় সিনেমা উপভোগ করছে পেছনে বসে অথচ যেখানে তারাই সবকিছুর মূলে। কিন্তু আপাতত দৃষ্টিতে তারা নিষ্পাপ শিশুমাত্র। তাদের ভুল তারা ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জানালার কাঁচটা ভেঙ্গে দিয়েছে, এইটুকুই। অদ্ভুত পাবলিক!
সকলের নিরবতা ভেঙ্গে উকিল এবার কথা বলে উঠলেন,
– দেখুন চুপ করে থেকে তো আর সমাধান হবে না। এবার একটা ডিসিশন আপনাদের নিতে হবে। আমি আন সময় দিতে পারবো না। আমার তো আরো ক্লাইন্ট আছে।
আবির প্রথমে রেগে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে কন্ট্রোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
– ডিসিশনের কিছুই নেই। এইটা একটা এক্সিডেন্ট। বিয়ে টিয়ে কিছু হয় নি। আপনি কাগজটা দিন আমাকে। আমরা কেউই মানি না এ বিয়ে।
– মানি না বললেই তো হয় না। আমি একজন আইনের লোক। আমার সামনে আইন অনুসারে বিয়ে হয়েছে। এটাকে চাইলেই অস্বীকার করতে পারেন না। এক্সিডেন্টলি হলেও ওনি সাইন করেছেন। স্বামী হিসেবে এই পেপারসে ওনার সাইন আছে।
– একটা সাইনেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। আকদ হয় নি এখনো। ধর্মীয় মতে তো হয় নি।
– দুটোর গুরুত্ব দু রকম। ধর্মীয়ভাবে বিয়ের যেমন গুরুত্ব তেমন আইনিভাবেও এর গুরুত্ব একই, আবার বেশিও বলতে পারেন। কারণ শুধুমাত্র আকদ করে হলে প্রমানের অভাবে সেই বিয়ে নাও মেনে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে কিন্তু একদমই তা হবে না। আমি কনের বাবার কাছে জানতে চাই। আপনার মত জানাবেন দয়া করে। আপনি কি চান এই পেপারস আমি বাতিল করে দেই? এক্ষেত্রে প্রমাণ নাও থাকলেও আইনগতভাবে বিয়ে হয়েছে তা কি অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখেন? আপনি মেয়ের বাবা, সবদিক থেকে ভেবে তবেই বলুন। ওনি মেয়েকে বিয়ে করতে চান তাই ওনি সবদিক বিবেচনায় আনবেন না আর এটাই স্বাভাবিক।
মেঘলার বাবা সোফায় টানটান করে বসে আছেন। কপালে গভীর চিন্তার ভাজে হাত রেখে বসে আছেন। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার চলবে না। একবার ভুল করেছেন দ্বিতীয়বার করলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় ভেবে তবেই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। একা ভেবে ওনি কূল কিনারাও পাচ্ছেন না। অবশেষে ঠিক করলেন যাদের ঘিরে এ ঘটনা তাদের বক্তব্য নেবেন। জীবন তাদের, তাই তাদের মত জানানোরও অধিকার আছে। মেঘলা সবার মাঝখানে একটা মুর্তির মতো বসে আছে। প্রাণহীন একটা পাপেট মাত্র। চুপসে আছে একদম। চোখে মুখে অতিরিক্ত চিন্তার ছাপ। ফুসফুটে মুখটা এমনিতেই মলিন হয়ে ছিলো এখন যেনো একদমই শুকিয়ে উঠেছে। মাথা নিচু করে যে বসে আছে সে বসেই আছে। হাত দিয়ে হাটুর কাছের খানিটা কাপড় খামছে ধরে আছে। মারাত্মক মাত্রায় তার হাত পা কাপছে।
মেঘলার বাবা কাব্যকে দিলেন। কাব্যকে ডাক দিলেও উত্তেজিত হয়ে পড়ে মোহনা ও শুভ। কাব্যকে সোজা করে বসিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো দুজনেই। কাব্য ওদের উত্তেজনার স্বীকার হয়ে হতমত খেয়ে গেলো। ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজেকে প্রস্তুত করে মেঘলার বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পেছনে পেছনে দুই সেনা তো আছেই।
মেঘলার বাবা খুবই নরম সুরে কাব্যকে ইন্টারোগেট করতে শুরু করেন। শুরুতেই বললেন,
– আমি তোমার কাছে বেশি কিছু জানতে চাইবো না। খুবই সীমিত কিছু প্রশ্ন করবো। সুন্দর করে সততার সাথে বলবে। কোনো কিছু নিজের মতের বিপক্ষে গিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা নেই।……… তুমি কি মনে করছো এইটা দুর্ঘটনা?
কাব্য সাথে সাথে উত্তর দিলো,
– ভুল বসত হয়েছে তবে দুর্ঘটনা নয়। দুর্ঘটনা বলা হয় যে ঘটনা খারাপ হয়। এক্ষেত্রে খারাপ কিছু দেখছি না।
– মানে এইটার কোনো খারাপ দিক তোমার কাছে নেই?
– জ্বি না।
– এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তুমি ইচ্ছুক?
– ভুল বসত হলেও বিয়ে হয়েছে। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয়। হয়েছে যখন তখন একে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমি রাখি না।
– আমার মেয়েকে তুমি তোমার যোগ্য মনে কর?
– যোগ্য বলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। কারো যোগ্যতা বিচার করার মতো যোগ্যতা আমার হয় নি এখনো।
– এইটা কি সত্যিই ভুল বসত নাকি এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে?
মেঘলার বাবার এমন প্রশ্ন সকলেই অবাক হয়ে যায়। কাব্য শুভর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে। কাব্য কন্ঠ হালকা নিচু করে বলে,
– সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই আঙ্কেল। আমি শুধুমাত্র সাক্ষী হওয়াতে আগ্রহী ছিলাম। হঠাৎ এমন হবে জানলে হয়তো অনেকটা সাবধানতা অবলম্বন করতাম।
কাব্য তার কথা শেষ করতে না করতেই আবির সোজা দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
– মিথ্যে বলছিস তুই সব তুই জেনে শুনেই করেছিস। সব ইচ্ছাকৃত। তুই ইচ্ছেকৃত ভাবে বিয়ে করেছিস।
– কোনো প্রমাণ আছে তোর কাছে? আমার মনে হয় না অন্য কোনো কিছুর ক্ষোভ এক্ষেত্রে প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। যেটা যেখানকার সেইটা সেখানেই প্রয়োগ করা উত্তম।
– ইউ যাষ্ট শাট আপ। ইউ ডু অল ডেলিবারেটলি। অল ওয়াজ ইউর প্ল্যান।
– তোর যা ভাবার তুই ভাবতে পারিস। আই টোটালি ডোন্ট কেয়ার।
– আমি এ বিয়ে মানি না।
– আমি মানি। যেভাবেই যে পরিস্থিতিতেই হোক, মেঘলা বর্তমানে আমার স্ত্রী।
স্ত্রী শব্দটা শুনে মেঘলার শরীরে রক্ত শীতল হয়ে বয়ে যেতে লাগলো। মুখটা উঁচু করে কাব্যর দিকে তাকালো। কাব্য শীর দাঁড় সোজা করে আবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আসার পর থেকে একটা বারের জন্যও কাব্যর দিকে তাকায় নি সে। কাব্যর চোখে মুখে অসম্ভব রকমের শীতল তেজ ফুটে ওঠে ওঠেছে। অদ্ভুদ রকমের সুন্দর লাগছে। কাব্যর দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে একটা কথা মাথায় আসে, ‘ ওনি আমার স্বামী ‘।
আবির দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে চোয়ালে শক্ত করে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলে। টেবিলেই পেপারস রাখা ছিলো। আবির পেপারসগুলো হাতে নিয়ে কাব্যর সামনে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
– এগুলে সব ধোঁকা। সব মিথ্যে। এগুলোর উপর ভিত্তি করে করে বলছিস তো মেঘলা তোর স্ত্রী। এগুলো না থাকলে তখন কি করবি? আমি এগুলো রাখবোই না।
– না রাখলেও এখানে উপস্থিত সকলেই জানে বিয়ে তো হয়ে গেছে।
– আমি মানি নাআআাা এই বিয়ে।
আবির পেপারসগুলো ছিড়তে যাবে তখনই এক চিৎকারের শব্দে থেমে যায়। হঠাৎ এমন চিৎকারে পুরো পরিবেশ আবারো চুপ হয়ে যায়। সবার দৃষ্টি মেঘলার দিকে স্থির। তীব্র লাল চোখ নিয়ে কাব্য আর আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত পা কাপছে। মেঘলার বাবা মেঘলার কাছে এসে দাঁড়ায়। মেঘলা ওর বাবার সামনে গিয়ে দুি হাতে বাহুতে ধরে আধ ভেজা গলায় বলে,
– আব্বু! আপনি সবার সাথে আলোচনা করলে কোথায় আমাকে তো একবারো জিজ্ঞাসা করলেন না। বিয়েটা তো আমার তাই না? তাহলে কেনো আমার বিয়ে সম্পর্কে আমার কোনো মতামতের প্রয়োজন মনে করছেন না। আমি মেয়ে বলে কি কোনো মতামতের অধিকার নেই? আপনি সেদিন কিছু না শুনে আংশিক কিছু দেখে ভুল বুঝে বিয়ে ঠিক করে নিলেন। আজ যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা তার সাথে না হয়ে অন্যের সাথে হলো। এক্ষেত্রে একজন বলছেন সে বিয়ে মানেন আরেকজন বলছেন মানেন না। সবাই সবার মত দিচ্ছেন। এই সবকিছুর মধ্যে আমি কোথায়? আমার অস্তিত্বই তো খুঁজে পাচ্ছি না। একবার তো জিজ্ঞাসা করতেন আমার কি মত এ বিয়ে নিয়ে। আমি মানি কি মানি না। আমি মানলে তো ওনাদের মানা না মানার ব্যপারটা আসে। সংসার তো আমি করবো। তাই নয় কি?
কাব্য এতক্ষণ খুবই স্ট্রোং ছিলো। মেঘলার শেষোক্ত লাইনগুলো মনে শংকার সৃষ্টি করে দিলো। কেনো হঠাৎ এ কথা? মেঘলা কি তবে অস্বীকার করবে? কাব্যর সব পরিশ্রম কি তবে এবার বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাবে?
তুই_আমার_কাব্য 🍂
#Part: 36
.
🍁
.
সেই প্রাচীন কাল থেকেই মেয়েদের অভিমতের গুরুত্ব খুবই কম। অতীতে ছিলোই না। বর্তমানে তার বেশ উন্নতি ঘটেছে তবে সব জায়গা না আবার সব জায়গাই এর কিছু কিছু উদাহরণ থাকেই। বিয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা ছেলেপক্ষ কিংবা ছেলের মতামতকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মেয়ের উপর শুধু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতা বর্তমানে মেয়েরা বলে থাকে ‘ আপনারা যা বলবেন তাতেই আমি রাজি ‘। একথা মানে মেয়ে আমার খুবই ভালো, খুবই বাধ্য, খুবই ভদ্র। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অনেক মেয়েই এই কথা বলে কারণ তারা জানে শুধু শুধু কিছু বলে কথা বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। সেই সাত পাঁচ বুঝিয়ে রাজি করিয়ে নেবে। শুধু সময়ের ব্যয়। তাই প্রথমেই রাজি হলে নিজেকে বোঝানোর সময়টা পাওয়া যায়। তবে সব ক্ষেত্রেই কি সব মেয়েরা এইটা মেনে নেবে? অধিকার সবার সমান না হলেও ত্রিশ শতাংশ তো হওয়া উচিৎ? সেই ত্রিশ শতাংশ অধিকারের জোড়েই মেঘলার এ প্রতিবাদ। মেঘলা কাব্য ও আবিরে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাব্যর দিকে চোখ পড়তেই মেঘলা বুঝতে পারছে কাব্যর শংকায় কৌতুহলি চোখ তার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল মেটানোর চেষ্টায় অবিরাম যুদ্ধ করছে। চোখ ফিরিয়ে আবিরের দিকে ঘুরে তাকালো মেঘলা। কাব্যর বুকটা ধুক করে উঠলো।
মেঘলার আবিরের দিকে ঘুরতেই চোখে চোখ পড়লো। আবিরের চোখ অসংখ্য মিনতি করে যাচ্ছে নিরবে। মেঘলার গাল বেয়ে একফোঁটা পানি বেড়িয়ে এলো। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললো মেঘলা। সাহস হচ্ছে না এই চোখে তাকানোর। পরিস্থিতির কি নির্মম পরিহাস! কেউ কেউ ভালোবাসার ভিক্ষারি হয়ে ঘুরছে আর কেউ কেউ ভালোবাসা এতো পাচ্ছে যে একটা নিতে গিয়ে আরেকটা ফেলে যাচ্ছে।
আবিরের হাতের কাগজটা নিয়ে মেঘলা ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাগজটা দেখিয়ে বলে,
– এইটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে কাব্য ভাইয়া আমার স্বামী আর আমি ওনার স্ত্রী। কিভাবে হয়েছে, কেনো হয়েছে তা কি উল্লেখ করা আছে? নেই তো! তবে সেইটা নিয়ে কেনো এতো কথা হচ্ছে? বিয়েটা আমাদের মধ্যে হয়েছে। ওনি বলেছেন ওনি রাজি। আমিও বলছি আমি সম্পূর্ণ ভাবে এই বিয়েকে মানি। এক জীবনে একাধিকবার বিয়ে করা তো সম্ভব না আমার পক্ষে আব্বু। তুমিও কি চাও তোমার মেয়ে একাধিক বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ পরুক তাও আবার একাধিক পুরুষের সাথে?
মেঘলার বাবার চোখ ছলছল করছ পানিতে। মেয়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস তার নেই। মেয়েটা সত্যিই বড় হয় গেছে। ডিসিশন নেওয়ার অধিকার তারও সম্পূর্ণ আছে। নিরব থেকে শুধু মেঘলার মাথায় হাত রাখলেন। মেঘলার চোখ নিয়েও নিরবে নোনা পানি বেড়িয়ে গেলো।
হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে মেঘলা পাশ ফিরে তাকালো। আবির বিধস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দু হাত দিয়ে দু বাহু চেপে ধরে সরল কন্ঠে বলে ওঠে,
– তোমার এক সিদ্ধান্ত কয়েকটা জীবন পাল্টে দিতে পারে মেঘলা। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারপাশের মানুষের কথা ভেবে দেখো। আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি মেঘলা। তোমাকে হারাতে পারবো না। হেরে যাবো জীবনের কাছে।
মেঘলা মাথা নিচু করে হাত ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বললো,
– জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই পূর্ব নির্ধারিত। শুনেছি আমরা ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই এসব ঠিক করা হয়। আপনার সাথে আমার বিয়ে ভাগ্যে নেই। থাকলে কারো ক্ষমতা ছিলো না তা আটকায়। বলছেন না কাব্য ভাইয়া ইচ্ছাকৃত করেছেন সব। যদি মেনেও নেই তা, তাহলেও এইটা তকদিরের লিখন অনুসারেই হয়েছে। না হলে ওনার হাজার চেষ্টাও কিছুই হতো না। কোন না কোনো ভাবে বিয়েটা হতোই। কিছু জিনিস সম্পূর্ণ বর্তায় তকদিরে। যার উপরে মানুষের হাত একদমই যায় না।
আবির নিরব থেকে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেললো। ক্লান্ত দৃষ্টিতে মেঘলার দিকে তাকিয়ে মেঘলার কাছে গিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠেই বললো,
– সব মেনে নিলাম। শুধু একটা কথার উত্তর দেবে? তুমিও কাব্যকে ভালোবাসো তাই না?
এমন একটা পরিস্থিতে আবির এমন একটা প্রশ্ন করবে তা মেঘলার ধারণা ছিলো না। কোনো কথা গলা দিয়ে বেরোচ্ছে না। শুধুমাত্র চোখগুল ছলছল করছে। চোখ আবিরের চোখ পড়তেই আপনা আপনিই নিচে নেমে এলো।
আবির তার উত্তর পেয়ে গিয়েছে। বেদনা জড়িত ছোট্ট এক হাসি দিয়ে নিজেকে ঠিক করে পেছন ঘুরে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
– এ মহলে আমার আর কিছুই বলার নেই, কিছু করার নেই। হয়তো মেঘলা ঠিকই বলেছে। সত্যিই হয়তো আমার জন্য মেঘলাকে সৃষ্টি করা হয় নি। হলে অন্যকারো হতে পারতো না।
মেঘলার দিকে তাকিয়ে আবির কথাটা উৎসর্গ করলো মেঘলাকে।
অবিরাম চোখের পানি বাঁধ ছাড়া বয়ে যাচ্ছে। শরীর কাঁপছে আবারো। পায়ের নিচেরটুকু অবশ হয়ে আসছে। শক্তি বিহীন। দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে স্পষ্ট সব ঝাপসা দৃশ্যে পরিনত হচ্ছে। আবিরের মুখটা আস্তে আস্তে ধোলা হয়ে এক পর্যায়ে চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এলো। পুরো পুরি অন্ধকারে বিলিন হওয়ার আগে হাওয়ার আগে কারো অস্তিত্ব পেলো নিজের কাছে। ভেবেছিলো হয়তো মিলিয়ে যাবে মাটিতে কিন্তু কেউ হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখলো। আবছা কিছু উদ্বিগ্ন কন্ঠও কানে পৌঁছালো। সবথেকে দৃঢ় কন্ঠটা এ সময়ও বুঝতে একট সময়ও বেশি লাগলো না।
মানুষের দুর্বলতা প্রকাশ পায় তার প্রিয় মানুষটার অসুস্থতায়। যতই সে স্ট্রোং হোক, চোখের নিচের কালো দাগ ঠিকই চিন্তায় ফেলে দুর্বল করে। আর সেখানে এ তো পুরো নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শায়িত।
.
কেবল ভোর হচ্ছে। পূর্ব আকাশে কেবল সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পুরো আকাশটা লাল আর কমলার মিশ্রিত রঙে রঙ্গিন হয়ে আছে। নিস্তেজ শরীরে কেবল প্রাণ ফিরছে। নরম করে চোখের পাতাটা ধীরে ধীরে খুলছে। আশে পাশের পরিবেশটা বুঝতে কিছুক্ষণ নিরবে শুয়ে আছে। তুলোর মতো হালকা লাগছে শরীর। হালকা নড়ে বসার চেষ্টা করলে কয়েকটা চুলে হালকা টান অনুভব করে। ঘুরে তাকাতেই দেখে ঘুমন্ত এক মুখ। ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে গভীরে ঘুমে কাব্য। একহাত মুখের সামনে আর সেই হাতের নিচেই কিছু চুল। এই লোকটা এখন তার স্বামী, মুখটা দেখেই এইটা ভেবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠলো। হাত দিয়ো আস্তে করে কাব্যর চুলগুলো ছুয়ে দিলো। হালকা করে চুলটা ছাড়িয়ে ওঠে বসছে।
বাহিরে হালকা আলো ফুটেছে। জানালা ও বারান্দার দরজা দিয়ে আলো এসে রুমের অবস্থা দেখে সে হতবাক। পাশেই ওর মা খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, তার পাশে আবিরের মা ও হেলান দিয়ে বসেই শুয়ে আছে আর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আবির। সামনের সোফায় মাথায় হাত ভর করে ঘুমিয়ে আছে কাব্যর মা। রুমের সবাইকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মেঘলার অসহায় হয়ে সবার মুখ দেখতে থাকে। তার এই অবস্থার জন্য সবার এতো কষ্ট। কিন্তু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলো না। চুল বাঁধতে যাবে তখন হাতে কিঞ্চিৎ ব্যাথা অনুভব করলো। হাতটা কাছে ছোট একটা বেন্ডেজ আবিষ্কার করলো। ব্যান্ডেজটা খুলে হাতটা আরো কাছে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো হাতে ক্যানলা জাতীয় কিছু পুশ করা হয়েছিলো। খাটের পাশের টেবিলের উপর সেলাইনের খালি প্যাকেট দেখে সব ক্লিয়ার হয়ে গেলো। ব্যান্ডেজটা ভালো করে লাগাতে যাবে তখনই এক ধমকে চমকিয়ে উঠে। আবারো ধমকের সুরে কথা ভেসে আসে পাশ থেকে চির চেনা কন্ঠে,
– ঠাস করে এক থাপ্পড় লাগালে বাচ্চাদের মতো চিমটানোর অভ্যাস যাবে। ওইটা খুঁচানো কি খুব দরকার পড়েছে? খাবার চাচ্ছে তোমার কাছে? অদ্ভুদ মেয়ে।
হাতটা টান দিয়ে হাতের বেন্ডেজটা ঠিক করতে করতেই সবাই ওঠে গেলো। ওরকমভাবে ধমক দিলে কে ই বা ঘুমে থাকতে পারবে? সবার ওঠে পড়া দেখে কাব্য একটু বোকা বনে যায়। পরিস্থিতি সামলাতে ঝাঁঝাল কন্ঠে মেঘলার কথা বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। মেঘলা হতবাক হয়ে তাকিয়েই থাকে কাব্যর চলে যাওয়ার রাস্তার দিকে।
মেঘলা জেগে ওঠার পর সকলেই ওঠে ওর খোঁজ খবর নিয়ে একে একে বেড়িয়ে যায় ফ্রেস হতে। সূর্য প্রায় ওঠে গেছে। সবাই চলে যাওয়ার পর আবির একটা জোড় পূর্বক হাসি দিয়ে পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে,
– এখন বেটার লাগছে?
মেঘলাও একটু করে হেসে বলে,
– হুম। কিন্তু কি হয়েছে?
– অজ্ঞান হয়ে গেছিলে তো। বাড়ির সব মানুষকে চিন্তায় ফেলে ভালই রাত কাভার করে দিলে। হঠাৎ খুবই জর চলে আসছিলো। আর মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতা তুলনামূলক খুবই কম ছিলো। আবার নাকি তুমি লো প্রেশারের রোগী। তাও আব্র সাংঘাতিক লো। স্যালাইন দিতে হলো।
– এতো কিছু?
– হ্যা! এতো কিছু।
আবির থেমে আবার বলে ওঠে,
– হসপিটালে সেদিন রাতে তুমি কাব্যর সাথে বেড়িয়ে ছিলে, তাই না?
আবিরের কথা শুনেই অবাক হয়ে গেলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবির বুঝতে পেরে নিজেই বলে,
– কোথা থেকে জেনেছি তা অজানাই থাক। এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। তুমি ভালো থাকো এতটুকুতেই হবে আমার। আর তোমার মতো রোগীলাকে বিয়ে করলে বুঝছো আমার জীবন টিস্যু পেপার হয়ে যেতো তো। বাপরে বাপ খুব বেঁচেছি। হা হা। আচ্ছা থাক। আমাকে যেতে হবে এখন। আবার দেখা হবে ভাগ্যে থাকলে কেমন! টেক কেয়ার।
আবির যে কথাটা ভুলানোর জন্য বলে গেলো লুকানোর মতো নয়। মেঘলাও হালকা হাসি দিয়ে বিদায় জানিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ বসে থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে বারান্দায় হেটে চলে গেলো। নিচে তাকাতেই আবিরকে চোখে পড়লো। বের হলো মাত্র। উপর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। আবির একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে সোজা হাঁটতে শুরু করলো। দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে কিছু নিরব কান্না ও কষ্ট বেড়িয়ে বাতাসে মিশে গেলো মেঘলা ও আবিরের। আবিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো মেঘলা অপলক। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল।
মানুষের এ জীবনে দুজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়। একজন হৃদয়ের খুব কাছে থাকে আর আরেকজন হৃদয় থেকে দূরে বিচরণ করে।
চলবে…… ❤