তুই আমার কাব্য পর্ব-৩৭

0
1349

তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 37
.
🍁
.

মানব জীবনে মানুষ যা যা চায় তার সবটাই পাওয়া হওয়া না তা সবাই জানি। অনেক ছোট ছোট আশাগুলো পূরণ হয়ে যায় আর কিছু মূল্যবান, দীর্ঘদিন ধরে মনের মাঝে চাষ করা আকাঙ্খাগুলো অপূর্ণ থেকে যায়। তাই বলে কি আমরা আশা করা ছেড়ে দেই? পূনরায় কি এরকম মূল্যবান আশার চাষ করি না? অবশ্যই করি। আশার উপর নির্ভর করেই তো বেঁচে থাকা। তবে এর মধ্যে একটা কিন্তু থেকে যায়। যা হারিয়ে ফেলি, যা পাওয়া অপূর্ণ থাকে তার প্রতি এক তীব্র আফসোস জীবন ভর থেকে যায়। তার পরিবর্তে যা পাই তা নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করা হয় তবে পুরোপুরি খুশি শতকরায় একজন হয়। কারণ মানব জাতির ধর্মই এইটা। যা অপ্রাপ্তি থাকে, তার সমতুল্য আর কিছুই থাকে না। ওটাই শ্রেষ্ঠ আর ওটাই সবচেয়ে দামী।
গাড়ীর বেগ তুলনামূলক আজ একটু বেশিই আবিরের। চোখের কোণে বিন্দু জল জমে আছে। গাল গড়িয়ে পড়লো বলে। কিন্তু পড়তে পারলো না। মুছে ফেলা হলো দ্রুত। নিরব, নিস্তব্ধ এক জায়গায় এসে থামলো গাড়িটা। একজন মানুষের আনাগোনা তো দূর পাখি পর্যন্ত নেই। দুই পাশে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠে গেছে বিশাল চা বাগান। বাগানের মাঝখানের একটা রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের চূড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে রাস্তাটা ধরলো আবির। আস্তে আস্তে পায়ের গতি বাড়ছে। এক পর্যায়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়ে পাহাড়ে ওঠছে। বাতাসের ঝটকায় এবার চোখের পানি মুক্তভাবে গাল বেয়ে ঝড়ে পড়লো। গলার রগগুলো ফুলে ওঠেছে। দৌড়ে ওঠছে এখনো। খাড়া পাহাড়। বেখায়ালি ভাবে ওঠতে গিয়ে স্লিপ কেটে পড়ে গিয়েও পড়লো না। দুই হাত দিয়ে ভর করে কন্ট্রোল করে নিলো। পাশেই এক অর্ধ কাটা গাছ । ওঠে দাড়িয়ে শেকড়ের কাছে গিয়ে তাকে সম্বল করে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে। দৃষ্টি আকাশে। মেঘের অবান্তর ছুটে বেড়ানো মেঘলার মুখ স্মরণ করাচ্ছে। কিভাবে পারবে সে? আদৌও কি পারবে? পারা যাবে না যে।

গতকালকের শাড়িটাই এখনো গায়ে জড়ানো। বারান্দায় ঝুলানো দোলনাটায় মেঘলার অবস্থান। মুখে বেদনার ছাপটা পুরোপুরি দৃষ্টিকটু। সময়ের ব্যবধানে আবিরের কথা বেশ কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। খুবই স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে ওরা। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বার্থপর না হলে যে চলে না। ভালোবাসা আর যুদ্ধে সব জায়েজ।

ঘুমন্ত নয়, জেগেই আছে মেঘলা। শুধুমাত্র চোখটা বন্ধ। কেনো যেনো মনে হচ্ছে তার আশেপাশে কেউ আছে। দেখা উচিৎ কেউ আছে কিনা। কিন্তু কেনো যেনো ইচ্ছে করছে না। খুবই অনিহা কাজ করছে। কিছুক্ষণ ওভাবেই সময় চলে গেলো। এবার চোখটা খুলে সামনে তাকাতেই চমকিয়ে ওঠলো। ভ্রু কুচকে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে থেকে তেমন কোনো রিয়েকশন নেই। সে খেতে ব্যস্ত। দেখে মনে হচ্ছে বেশ অনেকদিনের ক্ষুধিত প্রাণী। খেতেই খেতেই মেঘলাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

– চোখ লাগানোর চেষ্টায় থাকলে তা এখনি বন্ধ করো। ব্যর্থ চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। তোমার জন্যই আনা হয়েছিলো তবে তুমি তো মনে হয় ভাবনার জগতে এন্ট্রির ফ্রি টিকেট পেয়ে ওখানেই চলে গিয়েছিলে তাই আর বিরক্ত করলাম না। নিজেই খেয়ে নিচ্ছি। বাই দা ওয়ে, রান্নাটা দারুণ হয়েছে। আহা! প্রিয় চিংড়ি মাছের ঝোল। মিস করলে গো।

চিংড়ি মাছের কথা শুনেই গতকাল আর আজকের না খেয়ে থাকার ফলে পেটে যে যুদ্ধ হয়েছে তা আরো তীব্র আকার ধারণ করলো। মেঘলা সাথে সাথে ওঠে দাড়িয়ে গিয়ে বললো,

– কালকে থেকে না খেয়ে আছি আমি। তার মধ্যে অসুস্থ। নিয়েই যখন এসেছিলেন দুটো প্লেট আনলে কি অ্যমাজন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতো?

– হয়তো বা

– খাটাইস লোক। আনতে হবে না। আমার বাড়ি আমি নিজেই গিয়ে আনতে পারবো।

– কিভাবে আনবে? সবাই বলবে কি রাক্ষসী রে বাবা।

– কেনো কেনো? রাক্ষসীর কি আছে?

– অনেক কিছু। এই প্লেটটা তোমার জন্য পাঠিয়েছে। সবাই ভাবছে তুমি খেয়েছো। এখন আবার গিয়ে যদি তুমি খাও তাহলে তো রাক্ষসীই ভাববে তাই না?

– আমি বলবো আপনি খেয়েছেন।

– কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি কেবল খেয়ে এসেছি। তবে বেশ অনেকটা কম। সবার সামনে তো খাওয়া যায় না তার উপর নতুন জামাই।

– তারমানে কি আমি এখন না খেয়ে থাকবো?

– এছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না। তবে হ্যা যদি চাও তাহলে আমার থেকে শেয়ার করতে পারি।

– না

– ওকে। খেয়ে নিচ্ছি সব।

– আব বব আচ্ছা ঠিক আছে।

মেঘলা আবার গিয়ে সোফায় বসলো। কাব্য একটা চেয়ার ওর সামনে এনে বসে পড়ে। খাবার মুখের সামনে ধরে হা করতে বলে। মেঘলা অবাকের ওপরও অবাক। চোখ বড়বড় করে তাকায়ে আছে। মেঘলার তাকিয়ে থাকা দেখে কাব্য বলে,

– চোখ দিয়ে না খেয়ে মুখ দিয়ে খেলে উপকৃত হতাম। চোখটা ছোট করে মুখটা বড় করে হা করো।

– আআমি হাত দিয়ে খেতে পারবো

– হা করো

– আমি হাত দিয়ে….

কাব্য চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বন্ধ করে মুখ খুলে হা করলো। কাব্য বুঝতে পারছে মেঘলা খাবারের স্বাদ বুঝতে পারছে না কাব্যর ভয়ে। তাই কাব্য ওর ফোনটা বের করে মেঘলাকে দিলো। এটা এই জেনারেশনের একটা অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। খাবার সময় চোখের সামনে টিভি অথবা মোবাইল দুটোর একটা না থাকলে খুব অসুবিধা হয় যদি একা খাওয়া দাওয়া হয় তবে। সকলের সাথে খেতে বসলে ভার্চুয়াল এন্টারটেইন্টমেন্টের প্রয়োজন পড়ে না। বাস্তবই যথেষ্ট। মেঘলা বেশ খুশিই হলো। ভিডিও দেখতে দেখতে একসময় হাসির এক ভিডিও দেখে হাসতে গিয়ে গলায় খাবার ঠেকে গেলো। বিষম খেয়েছে খুবই। কাব্য দ্রুত পানি খাইয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। মেঘলার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছে। কাব্যর ধমকে চোখ মুছে কাব্যর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। টেবিলের দিকে চোখ পড়লো তখন। দুটো প্লেট। একটা সম্পূর্ণ খালি আরেকটা খালি হলো বলে। সাথে সাথে কাব্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– প্লেট দুটো হলো কি করে?

– আমি যাদুগর জানো না? যাদু করে এনেছি।

– ধুর! সোজাভাবে উত্তর দিন না।

– হাত দিয়ে এনেছি।

– খেলো কে?

– আমার সদ্য বিবাহিত বউ।

– আমি?? অসম্ভব!

– তুমি সেইটা কখন বললাম? বললাম আমা বউ। তুমি কি আমার বউ?

– অবশ্যই আমি আপনার বউ। এতো কাহিনী করে বিয়ে করে এখন বলছেন বউ কি না আমি?

– ধর্মীয় মতে কাবিন হয়েছে তোমার?

– না তো! ভালো কথা মনে করিয়েছেন তো। ধর্মীয় মতে তো হয় নি। তাহলে তো আপনার সাথে থাকতে পারবো না। পাপ হবে পাপ।

তখনই পাশ একজন বলে ওঠে,

– হলেও আপনারা একসাথে থাকতে পারবেন না।

মেঘলা কাব্য দুজনেই পাশ ফিরে তাকিয়ে শুভকে আবিষ্কার করলো। শুভ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মেঘলার কাছে এসে বলে,

– ব্যপার কি বলো তো মেঝো গিন্নি? আমার ভাইকে তো সহ্যই করতে পারো না। তবে একসাথে থাকার কথা বলছো। হঠাৎ এতো টান কোথা থেকে আসছে?

– আ আরে জিজু কককি যে বলো। টান ফান কিছু না। বিয়ের পর তো একসাথেই থাকে তাই আরকি বলছিলাম। আআর ওনার সাথে থাকতে আমার বয়েই গেছে।

– আচ্ছা তাই নাকি?

– হ্যা তাইই।

– তাহলে তো ভালই হলো। আমি ভাবলাম তোমাদের কষ্ট হবে।

– কষ্ট কেনো হবে? প্রেম করে বিয়ে থরি করেছি। আনফরচুনেন্টলি বিয়ে হয়ে হয়ে গিয়েছে। না হলে তোমার ভাইয়ের মতো খাটাইসকে বিয়ে করতে বয়েই গেছে।

কাব্য মেঘলার কথা নিরবে শুনছে। হাতটা ধুয়ে শুভকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– ভাইয়া! তুই বস আমি আসছি। তারপর দেখি কার কার দুভার্গ্য। গননা করবো।

– তুই এগুলো নিয়ে গিঢময়ে কি কেস খাওয়াবি?

– কেনো?

– ভাই আমার বিয়ে করে কি সব বুদ্ধি জলে গেছে। নিয়ে এলো মোহনা আর তুই গিয়ে যদি দিয়ে আসিস তাহলে বাসার সবাই তো বুঝবেই তুই খাওয়াইছিস। এক্সিডেন্টলি বিয়ে করা বউয়ের প্রতি এতো যত্ন কেউ কি সহজে হজম করতে পারবে?

– বিয়ে করা বউকে নিয়েও লুকোচুরি। হায় খোদা ! মোহনা কোথায়?

– রাখ তুই। মোহনা আসবে।

কিছুক্ষণ পর মোহনা চলে আসে। মোহনা প্লেট নিয়ে বেড়িয়ে যাবে তখনই আবার রুমে ডুকে পড়ে।

অনেকক্ষণ যাবৎ শুভ কাব্যকে দেখতে না পেয়ে মেহের খুঁজতে খুঁজতে মেঘলার রুমে চলে এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সকলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। সবকটা এক ঘরেই। তবে একটু আলাদা। মানে ওদের জন্য আলাদা মেহরের জন্য পারফেক্ট। কাব্য সোফায় পা তুলে ফোন ঘাটছে। নাম মাত্র উপস্থিত, যেনো কারো প্রেসারে। বিয়ে হয়েছে বউয়ের সাথে মিলামিশা দরকার এমন টাইপ মোহনা মেঘলার সামনে বসে কালি প্লেট নিয়ে বসে আছে। ভাব এমন যেনো কেবল মেঘলা মোহনার খাওয়া শেষ হলো আর শুভ মেঘলার সাথে কথা বলছে। মেহেরে দিকে তাকিয়ে শুভ বিশাল এক হাসি দিয়ে বলে ওঠে,

– আরে গিন্নি যে! আসো আসো। তোমাকেই মিস করছিলাম। তুমিই এখন কোনো ব্যবস্থা করো।

– আমি আবার কি করবো?

– তোমার দেবর তো আমার কথা শুনেই না। তোমার কথা যদি একটু শুনে। দেখো তো বিয়ে করেছে কোথায় বউয়ের সাথে কথা বলবে তা না ফোন টিপসে। একটু বোঝাও। এখন কি মেঘলা আর শুধু মেঘলা? ওর বউ হয়। বউয়ের সাথে কথা বলতে হয়, কথা বিনিময় করতে হয় শুরু শুরুতে। কিছ্ছু বোঝে না।

– বোঝার পরিস্থিতি এইটা? তোমার ভাই তোমার মতো এতো শেয়ানা না। বুঝচ্ছো?

– হুম। আমার মতো না, আমার থেকে দুই ডিগ্রি উপরে। ( বিরবির করে)

– বদনাম শেষ হলে নিচে চলো সবাই। মেঘলা কাব্য নিচে চলো তোমরা।

মেঘলা মেহেরের দিকে তাকিয়ে কৌতুহল দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করে,

– কেনো আপু?

– তোদের কাবির করা হবে। হুজুর এসেছেন। তাড়াতাড়ি চল। খুঁজে খুঁজে জীবন শেষ। সব কটা এখানে এসে বুড়ো হয়েছে।

মেঘলা ফ্রেস হয়ে ওই শাড়ি পড়েই নিচে নেমে এলো মেহেরের সাথে। হুজুর বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। সকলেই মিষ্টি মুখ করে নিলো। সকলেই বেশ খুশি মাত্র মেঘলা বাদে। কারণ সে শ্বশুর বাড়ি আপাতত যেতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কাব্যর পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দুজনোই আলাদা থাকবে এবং যার যার বাড়িতে। কোথায় ভেবেছিলো একসাথে থাকবে, শ্বশুড় বাড়ি যাবে। সব ছাই হয়ে গেলো।

চলবে……,❤