তুমিময় অসুখ ২ পর্ব-০৯

0
3228

#তুমিময়_অসুখ ২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

২৩.
পাহাড় চূড়ায় বেজে চলেছে ম্রো’দের শেষ বাঁশির সুর। পাহাড় থেকে পাহাড়ে সেই সুর প্রতিধ্বনিত হয়! হতে হতে উড়ে চলে বহুদূর। বহুকাল ধরে আদিবাসীদের এই রেওয়াজ চলে আসছে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে!

আজ আনিশা আপুর গায়ে হলুদ, সেজন্য চেনাজানা আদিবাসীরা প্রায় সবাই-ই এসেছে। বাড়ির লনে ছোটখাটো আয়োজন। সেখানে আগুন জ্বালিয়ে গান-বাজনা করা হচ্ছে পাহাড়ি রীতিনীতি মেনে। অন্যদিকে আপুর গায়ে হলুদের আয়োজন।

আপুকে একটা সবুজ শাড়ি পড়ানো হয়েছে, সাথে কাঁচা ফুলের গয়না। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ইলহাম আর আমি হলুদ শাড়ি। সবাই সাজগোজ,ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। বাড়ি ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। আমি অনুষ্ঠানে এটেন্ড করে এক কোণায় বসে বসে আদিবাসীদের নাচগান দেখছি। আম্মুকে বললাম, ঘরে গিয়ে ঘুমাবো। আমাকে যাতে কেউ ডিস্টার্ব না করে। আর ডিস্টার্ব করবেই বা কে? সবাই তো বিজি এখানে, অনেকরাত পর্যন্ত এসব চলবে।

আম্মুকে বলে আসার সময় ভাবলাম একটু দেখে আসি আনিশা আপুকে। বারান্দা পেরিয়ে পাশের জঙ্গলটা পার করে ওখানে যেতে হয়। বড় একটা জলপাই গাছের নিচে আসতেই হঠাৎ কে যেন আমার চোখ বেঁধে দিলো। হাত দিয়ে চেপে ধরলো মুখ। আমি ভয়ে চিৎকার কর‍তে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। আমাকে কোলে তুলে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি হাত-পা ছুড়ছি, কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা।

অনেকক্ষণ পর ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগতেই আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। কত শুনেছি পাহাড়ে ডাকাত টাকাত থাকে। মেয়ে দেখলেই নাকি তুলে নিয়ে যায়, তাহলে কি আমিও ডাকাতদের শিকার? ইয়া খোদা!! রক্ষা করুন আপনার অধম বান্দীকে। অভ্র ভাই কোথায় আপনি? আপনার ইরু বিপদে পড়েছে। প্লিজ বাঁচান। মনেমনে দোয়া করছিলাম।

অনেকক্ষণ পর কে যেনো আমাকে নরম কোথাও বসালো। চোখমুখ খুলে দিলো। আমি আধোআধো চোখ খোলার চেষ্টা করে সামনে তাকাতেই দেখি অভ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা, কি সুন্দর দেখাচ্ছে লোকটাকে। আর আমি আনিশা আপুর রুমে, যেখানে আসবো বলে রওয়ানা দিয়েছিলাম। জানালা দিয়েই ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে আমার গায়ে। আমি ওনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে? আপনি এখানে কেন? আমার ক্ষতি করার জন্য পিছুপিছু এসেই পড়লেন?’

‘ না!’

‘ তাহলে চলে যান। আপনাকে আমার সহ্য হয়না, যান প্লিজ!’

বলে কেঁদে দিলাম। অভ্র ভাই হাঁটু গেড়ে বসলেন আমার সামনে। আমার গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘ এরকম করিস না প্লিজ। তুই এরকম করলে আমি কোথায় যাবো বল।’

‘ যেখানে ইচ্ছে!’

‘ আমার শুধু তোকে দেখতেই ইচ্ছে হয়, তোর পাশে থাকতে ইচ্ছে হয়।’

‘ এসব আপনার কিছুই হয়না। মিথ্যা বলছেন। আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে এসেছেন। দূরে যান আপনি…! ‘

অভ্র ভাই অসহায় গলায় বললেন, ‘এরকম কিছুনা ইরু। আমাকে ভয় পেয়ে দূরে থাকিস না। আমি তোদের কিছু করবোনা। আমার আমার তো বাচ্চাটাকে চাই! তোকে সারাজীবন আমার কাছে তো ও-ই রাখবে তাইনা!’

‘ সব আপনার চাল। আমার ক্ষতি করার।এসব বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে বোকা বানাতে চান আপনি। আমি কিন্তু আগের সেই বোকা নই!’

ওনি রেগে বললেন, ‘চুপ কর ইরু। বলছি তো আমি তোদের দুজনকেই চাই। তাহলে বিশ্বাস করছিস না কেন? আমাকে কি একবার সুযোগ দেওয়া যায়না? আমি কি এতোই খারাপ লোক? তুই যদি আমাকে বিশ্বাস না করিস তাহলে কি করলে বিশ্বাস করবি বল? পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরলে?’

আমি চুপ।

ওনি আরও রেগে গেলেন। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওকে আমি যাচ্ছি। তারপর ঠিক বিশ্বাস করবি। গুড বাই!’

পা বাড়ালেন দরজার দিকে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সত্যিই আবার পাহাড় থেকে ঝাঁপটাপ দিয়ে মরে যাবেনা তো? হতেও পারে, যা রাগী ছেলে। একে থামাতেই হবে।

আমি একপ্রকার দৌড়ে ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম, ‘না না কোথাও যেতে হবেনা। বাচ্চাটা কি বাবা ছাড়া বড় হবে নাকি! আপনি কোথাও যাবেন না।’

ওনি আমাকে ঠেলে সরিয়ে চলে যেতে চাইলেন। বেশ রেগে আছেন বুঝতে পারছি। ওনার রাগ ভাঙাতে আমি ওনার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম। ওনি চুপ হয়ে গেলেন।

ওনাকে ছেড়ে দিয়ে লজ্জ্বামিশ্রিত কন্ঠে বললাম, ‘ পাহাড়ে যেতে চাইলে আমাকেও নিয়ে যাবেন কাল, ওকে? আপনার কোলে উঠে আমি আর আমার বেবি ঘুরবো, নৌকায় উঠবো। নিয়ে যাবেন তো?’

অভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘তোর একার না, আমার বাচ্চাকে আর বউকে নিয়ে যাবো।’

২৪.
পরদিন সকালে সবাই অভ্র ভাইকে দেখে অবাক। সবকিছু মেনে যে ওনি আসলেন, এটাই ভালো। আনিশা আপু আর ইলহাম তো মুচকি মুচকি হাসছে। কানাকানি করছে! আনিশা আপুকে খুব আবেদনময়ী লাগছে। একটু পর বিয়ে বলে কথা! সোনালী জড়ির লেহেঙ্গা আর ম্যাচিং অর্ণামেন্ট’স। সবকিছু সুন্দর। আমরা সবাই-ই রেডি হলাম সুন্দর করে। বরপক্ষ ঢাকার, সেজন্য তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে এবং একটার দিকে রওয়ানা দিয়ে দেবে। বারোটার দিকে বিয়ে হয়ে গেলো। সবাই খুব আনন্দ করলাম, খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসে বসতেই আমার ওনি এলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘চল তো। ঘুরতে যাই।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখন?’

‘ হুম।’

‘ আপু তো চলে যাবে একটু পর। দেখা করবোনা?’

‘ এখন করে নে না। ঢাকায় গিয়ে তো সবসময়ই দেখা কর‍তে পারবি। আয় তুই।’

আমি ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে সবকিছু ভুলে আম্মু, আপু সবাইকে বলে এলাম যে ওনার সাথে ঘুর‍তে যাচ্ছি। ইলহাম যেতে চাইলে আমি সাথে নিলাম না। বর আমার, ঘুরবো আমি। ওকে নেবো কেন? হুহ!! বুদ্ধি করে যে পাগল লোকের মাথা থেকে ভূতটা নামিয়েছে এর জন্য অন্যকিছু ট্রিট দেবো। বাট ঘুরতে নিবোনা।

২৫.
গাড়িতে করে আমার যাচ্ছি! আশেপাশে অনেক পাহাড়, গাছপালা! এসব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা দুপুরের দিকে থানচি পৌঁছাই।

থানচি বান্দরবানের একটি উপজেলা। পাহাড়বেষ্টিত নদীর কলকাকলিতে মুখরিত ছোট্ট একটি শহর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা সাঙ্গু নদ, এর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে দিলো আমায়। একপাশে থানচি অন্যদিকে পাহাড়, মাঝখানে বয়ে চলেছে নদ। আমরা যাবো রেমাক্রি। নদীপথে যেতে লাগে চার ঘণ্টা। একটা রিজার্ভকৃত নৌকায় আমরা দুজন উঠলাম। অভ্র ভাই সাবধানে উঠালেন আমাকে। ইঞ্জিনচালিত লম্বা আকৃতির চিকন নৌকা। চলতে শুরু করল নৌকা।

নৌকা চলছে। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি! চালক তাড়াহুড়ো করে বড় একটা পলিথিন দিলো আমাদের। অভ্র ভাই পলিথিন দিয়ে আমাকে ঢেকে নিলো নিজের সাথে। রাগী গলায় বললো, ‘হলো তো? যত্তসব ন্যাকামু করিস। আমার বেবির শরীর খারাপ হলে তোকেই মেরে ফেলবো। বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন। পাহাড়ি বুনো বৃষ্টিতে পলিথিন আমাকে পুরোপুরি প্রটেক্ট করতে পারছেনা। শরীর ভিজছে কিন্তু আমার ভালোই লাগছে। অভ্র ভাইয়ের কথা শুনে মনেমনে হাসছি। আনিশা আপু কি প্ল্যান করলো যে ব্যাটা বাচ্চাএ জন্য এতো দরদ দেখাচ্ছে। গ্রেট আনিশা আপু। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। নীল রঙের পলিথিনে আমরা দুই কপোত-কপোতী কি রোমাঞ্চকর অনুভূতি! অভ্র ভাই হঠাৎ আমার ঠোঁট দখল করে নিলেন। আমি ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বললাম, ‘এসব কি হুম? নোংরামি যত্তসব!’

‘এভাবে বলছিস কেন?’ অসহায় চোখে তাকালো ওনি।

‘ তো কিভাবে বলবো? পাবলিক প্লেসে এসব কি?’

‘ এখানে কেউ নেই। নৌকার মাঝি দেখ উল্টোদিকে ঘুরে নৌকা চালাচ্ছে।’

আমি রেগে বললাম, ‘ছি! বৃষ্টি পড়ছে আর আপনি হলিউডের শুটিং শুরু করেছেন।’

অভ্র ভাই বললো, ‘এরকম করছিস কেন? আমাকে কি আর ভালো লাগেনা?’

‘ এই ফ্যাচফ্যাচ বন্ধ করেন তো। আপনার কথা আমার অসহ্য লাগছে।’

‘ জানি।’

‘ কি জানেন?’

‘ এসময় মুড সুইং হয়। হাজব্যান্ডকে বিরক্তিকর প্রাণী মনে হয়, মাঝেমাঝে আবার ভীষণ আদরও করে। তবে তুই আমাকে আদর করবি কিনা এ বিষয়ে আমি সন্দিহান। কাছেই আসতে দিস না, আবার আদর! তুই আসলে একটা জল্লাদ!’

এই বেহায়া লোকের মুখে এসব কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। বৃষ্টি হচ্ছেই!

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেল। পাহাড়ে আবহাওয়া দ্রুত বদলায়। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। কোথাও কোথাও দুই পাহাড়ের মাঝখানে সরু নদী। কোনোভাবে নৌকা যেতে পারবে। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পানিতে থাকতে থাকতে শেওলা জমে গেছে। বড় পাথরগুলোর পাশ কাটিয়ে আঁকাবাঁকা করে নৌকা চলছে। পাহাড়ে দ্রুত সন্ধ্যা নামে।

মুহূর্তের মধ্য অন্ধকার হয়ে গেল। নিঝুম অন্ধকারে আমরা পাথুরে খরস্রোতা নদীতে। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম! ক্লান্ত শরীরে কখন অভ্র ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখলাম আমি অভ্র ভাইয়ের গাড়িতে, পাশে ওনি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমার নড়াচড়া টের পাননি বোধহয়। লোকটাকে দেখতে এই মুহূর্তে আহামরি সুন্দর লাগছে। ওনার সাথে একসাথে ঘুরার স্বপ্নটা, লালিত ইচ্ছেটা আজ ওনি পূরণ করে দিলেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওনি যে আমার কাছে ছুটে এসেছেন সেটা কি ভালোবাসা না থাকলে হতো?

নদে’র পাথুরে বন্যতা, আকাশের উপর দিয়ে বয়ে চলা মেঘের ভেলা, বুনো পাখির কুজন সবকিছুতে আমি আমার ভালোবাসার এক টুকরো সাক্ষী রেখে এসেছি! ভাবলাম, ওনি আমার জীবনকে আজ কিছু দিলেন! এটা এক অদ্ভুত পূর্ণতা! অসীমান্ত ভালোবাসা ওনার প্রতি।

👉”আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

জাহান্নামবাসী দু’প্রকার মানুষ, আমি যাদের (এ পর্যন্ত) দেখিনি। একদল মানুষ, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা লোকজনকে মারবে এবং
একদল স্ত্রী লোক, যারা কাপড় পরিহিত উলঙ্গ, যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা, তাদের মাথার চুলের অবস্থা #উটের_হেলে_পড়া_কুঁজের_মতো। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবেনা অথচ এত এত দূর হতে তার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। (ই.ফা. ৫৩৯৭, ই.সে. ৫৪১৯)।”

~ সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৪৭৫

চলবে….ইনশাআল্লাহ!