তুমি আমারই রবে পর্ব-০৫

0
629

#তুমি_আমারই_রবে
#পর্ব_৫
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

—“হুম। ঐ তো সামনের হসপিটালটায়। আপনি গেলেই পেয়ে যাবেন।”

—“থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া। আসছি আমি।”

আর এক মুহূর্ত ও দাঁড়ালাম না আমি। তাড়াহুড়ো করে অফিসের গেইট ক্রস করে আরেকটা সি.এন.জি নিয়ে সামনের হসপিটালটায় চলে এলাম। ভাড়া মিটিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আমি হসপিটালের ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ এক এক করে আমি হসপিটালের ১ম তলায় যতোটা কেবিন আছে সবগুলো কেবিনে হিমুকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও হিমুর ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। এই অবস্থায় আমি সাহস করে রিসিপশানে যেতে ও পারছি না। নাবিলা কোন কেবিনে আছে তা ও জানতে পারছি না। নাবিলা কে, দেখতে কেমন, ওর পুরো নাম কি কিছুই তো আমি জানি না। প্রথম তলায় ঘুড়তে ঘুড়তে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে দুতলার দিকে রওনা দিলাম। দুতলায় উঠতেই পশ্চিম দিকের কেবিন থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হচ্ছে কেউ খুব জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে আমার৷ দেরি না করে আমি দৌঁড়ে পশ্চিম দিকের কেবিনের কাছটায় ছুটে এলাম। কেবিনের কাছে এসেই আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হিমু কেবিনটার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। খুব জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে। হসপিটালের কয়েক জন ওয়ার্ড বয় হিমুকে টেনে কেবিন থেকে বের করছে। হিমু উনাদের সাথে খুব জোরাজোরি করছে আর চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,,,

—“প্লিজ নাবিলা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি বিয়েটা ইচ্ছে করে করি নি। মা আমাকে জোর করে বিয়েটা করিয়েছে। বিভিন্ন ভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। বলেছে, আমি যদি বিয়েটা না করি তাহলে মা তোমার চিকিৎসার খরচ দিবে না। বিনা চিকিৎসায় তোমাকে মরতে হবে। আর আমি বেঁচে থাকতে আমার নাবিলা কখনো বিনা চিকিৎসায় মরতে পারে না। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমি বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিলাম নাবিলা। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো। দয়া করে এক্টি বার তোমার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দাও।”

তখনই কেবিনের ভেতর থেকে কেউ হিমুর মুখের উপর কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমি নিবার্ক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছি। ঘাঁড়ের রগ গুলো হিমুর টান টান হয়ে আছে। গলা ফাঁটিয়ে কাঁদছে উনি। দু পা দিয়ে উনি কেবিনের দরজা ধাকাচ্ছে আর বলছে,,,

—“প্লিজ নাবিলা এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তোমার এতো অবহেলা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। তোমার এই মর্মান্তিক অবস্থা ও আমি সহ্য করতে পারছি না। একবার তোমাকে ছোঁয়ে দেখতে চাই নাবিলা। যে কয়েকটা দিন তুমি বেঁচে থাকবে শুধু সেই কয়েকটা দিনই আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমাকে বুকে নিয়ে কয়েকটা দিন মুক্ত ভাবে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। দয়া করে কয়েকটা দিন ভিক্ষা দাও আমায়। তুমি যদি চাও আমি এক্ষনি এই মুহূর্তে তোমাকে বিয়ে করব নাবিলা। ভুলে যাবো আমি বিবাহিত।”

উনার এই করুন আত্নচিৎকারে ও নাবিলার মন গলছে না। কেবিনের দরজা খুলে সে একবারের জন্য ও বের হয়ে আসছে না। কিন্তু আমার মনটা যে মানছে না। চোখের সামনে নিজের স্বামীর এতো নিদারুন কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না। মুখে আঁচল চেঁপে কাঁদছি আমি। উনার মুখোমুখি যাওয়ার সাহসটা ও যোগাতে পারছি না। আমাকে দেখলে উনি নির্ঘাত আরো বেশি রেগে যাবে। উনি যে আমাকে অপছন্দ করে। পৃথিবীতে সবচে অপছন্দের ব্যক্তিটা আমি।

এর মাঝেই হসপিটালের সব ডক্টর, নার্সরা একএ হয়ে হিমুকে টেনে হেছড়ে হসপিটাল থেকে বের করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। হিমু সবার সাথে জোরাজোরি করছে আর নাবিলা নাবিলা বলে চিৎকার করছে। আমি এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। না পারছি হসপিটালের লোকজনদের আটকাতে, না পারছি নাবিলার সাথে দেখা করতে যেতে। আমি জানতে চাই নাবিলার কি হয়েছে। হিমু এতক্ষন নাবিলার কোন রোগের কথা চিল্লিয়ে বলছিলো। কোন রোগের জন্য নাবিলার জীবন সংশয় হতে পারে। আমাকে জানতেই হবে নাবিলার কি এমন রোগ হয়েছে যে রোগের চিকিৎসার খরচ আমার শ্বাশুড়ী মা বহন করছে? সাথে এটা ও জানতে হবে নাবিলা কেনো হিমুর মুখোমুখি হচ্ছে না!

হিমুকে নিয়ে এতক্ষনে হসপিটালের সবাই দু তলা থেকে নেমে গেছে। নিজেকে কিছুটা সামলে আমি দৌঁড়ে নাবিলার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ অমনি একজন নার্স নাবিলার কেবিনের দরজা খুলে কেবিন থেকে বের হয়ে এলো৷ নার্সটা আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,,,

—“কে আপনি?”

আমি আমতা আমতা করে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“আআআমি নাবিলার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

—“আপনি কি হন নাবিলার?”

থতমত খেয়ে আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আমতা আমতা করে বললাম,,,

—“আআআমি নাবিলার ফ্রেন্ড। এক্টু দেখা করা যাবে ওর সাথে?”

—“স্যরি নাবিলা এখন ঘুমুচ্ছে। এতক্ষন অনেক ধকল গেছে ওর উপর। তাছাড়া ওর শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। আপনি পরে আসুন।”

কথাগুলো বলেই নার্সটা আমাকে ক্রস করে দু কদম সামনে বাড়াতেই আমি পেছন থেকে নার্সটাকে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,,,

—“নাবিলার কি হয়েছে নার্স? আমি কি জানতে পারি?”

নার্সটা পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“কেনো আপনি নাবিলার বন্ধু না? বন্ধু হলে তো অবশ্যই জানার কথা নাবিলার কি হয়েছে!”

আমি নার্সটার কাছাকাছি গিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,,,

—“আআআসলে আমি এতোদিন দেশের বাইরে ছিলাম তো, তাই নাবিলার কি হয়েছে আমি জানতে পারি নি। আজই আমার অন্য একজন ফ্রেন্ড বলল নাবিলা খুব অসুস্থ, হসপিটালে ভর্তি। তাকে অনেকবার জিগ্যেস করার পর ও সে বলে নি নাবিলার কি হয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো করে আমি হসপিটালে ছুটে এলাম নাবিলার কি হয়েছে জানতে। আপনি যদি কাইন্ডলি এক্টু বলেন নাবিলার কি হয়েছে!”

নার্সটার মুখ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার কথা বিশ্বাস করেছে। উনি এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,

—“নাবিলার ক্যান্সার হয়েছে। লাস্ট স্টেইজে আছে।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই আমার অন্তর আত্না কেঁপে উঠল। নাবিলা আমার প্রতিদ্বন্ধী জেনে ও আনমনেই আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। না চাইতে ও চোখ থেকে গড়গড়িয়ে জল পড়া শুরু হলো। তাকে ভালো করে না চিনে, না জেনে, না দেখে ও তার রোগের কথা শুনে আমার এতোটা কষ্ট হচ্ছে না জানি হিমুর কতোটা কষ্ট হচ্ছে। হিমু তো নাবিলাকে ভালোবাসে। মন থেকে ভালোবাসে। উনার ভিতরটা হয়তো প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে। আর তার জন্যই হিমু এতোটা পাগলামী করছে। নাবিলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এমনকি নাবিলার কাছে তার ভালোবাসা ও ভিক্ষা চাচ্ছে। কয়েকটা দিন নাবিলার সাথে মুক্তভাবে বাঁচতে চাইছে!

নাবিলাকে এক্টা বার দেখার আগ্রহটা যেনো আমার বেগতিক বাড়ছে। শুধু এক্টা বার আমি নাবিলাকে দেখতে চাই। অন্তত চোখের দেখা হলে ও দেখতে চাই। কাঁদতে কাঁদতে আমি নার্সটার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“আমি নাবিলাকে এক্টা বার দেখতে চাই নার্স। প্লিজ আমাকে এক্টা সুযোগ করে দিন।”

—“স্যরি এখন আমরা কাউকেই নাবিলার রুমে এলাউ করতে পারব না। তবে আপনি এক্টা কাজ করতে পারেন। চাইলে জানালা দিয়ে নাবিলাকে এক্টাবার দেখতে পারেন। আমি ভেতর থেকে জানালাটা খুলে দিচ্ছি। আপনি এখানেই দাঁড়ান।”

নার্সটা আমাকে ক্রস করে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলো। থাই গ্লাসটা খোলার সাথে সাথেই আমি দৌঁড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। বড় বড় শ্বাস ফেলে আমি কেবিনের বেডের দিকে তাকাতেই নাবিলাকে দেখতে পেলাম। চোখ বুজে নাবিলা সোজা হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় এক্টা চুল ও নেই তার। ফর্সা মুখটা বিবর্ণ হয়ে আছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে এক্টু হয়ে আছে। ঠোঁট গুলো ও কালো হয়ে আছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে তার। কিছুক্ষন পর পর সে শুকনো ঢোক গিলছে। নীরবে কাঁদছে সে। হয়তো হিমুর যাতনায় কাঁদছে।

এক দৃষ্টিতে আমি নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখ থেকে ও টলটলিয়ে পানি পড়ছে। মনটা হু হা করে কেঁদে উঠছে। এই বয়সে মেয়েটা এতো বড় ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়ে আছে তা আমি মেনে নিতে পারছি না। তার ও অধিকার ছিলো আট, পাঁচটা মেয়ের মতো সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করার। মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার। কেনো উপর ওয়ালা এমনটা করল? কেনো এতো বড় রোগ এই মেয়েটাকে দিলো? তার কি অধিকার ছিলো না জীবনের সমস্ত সুখ ভোগ করে মৃত্যুবরণ করার? জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার? উপর ওয়ালা কেনো মেয়েটার সাথে সাথে হিমুকে ও তিলে তিলে নিশ্বেস করে দিচ্ছে? কেনো???

এর মাঝেই নার্সটা আমার মুখের উপরে থাই গ্লাসটা লাগিয়ে দিলো। আমি এখনো একই জায়গায় থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি। হিমুর কষ্টটা এখন আমি আরো বেশি করে রিয়েলাইজ করতে পারছি৷ মায়ের উপর এখন আমার খুব বেশি অভিমান হচ্ছে। মায়ের জন্যই আজ হিমু আর নাবিলাকে আলাদা হতে হলো। তাদের মাঝখানে আমাকে এসে ঢুকতে হলো। হিমুর জায়গায় আমি থাকলে ও হয়তো ঠিক একই ভাবে আমার স্বামীর থেকে ডিভোর্স নিয়ে ভালোবাসার মানুষটার কাছে ছুটে আসতাম! তাকে নিয়ে মুক্তভাবে বাঁচার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করতাম।

আমাকে এক্ষনি বাড়ি যেতে হবে। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। মা কে আজ উত্তর দিতেই হবে মা কেনো দুটো ভালোবাসার মানুষকে এভাবে আলাদা করে দিলো? কেনো মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্পাপ মেয়েটাকে বেঁচে থাকতে ও তিলে তিলে মরে যেতে হচ্ছে? সে সব প্রশ্নের উত্তর আজ মাকে দিতেই হবে।

কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে আমি হসপিটালের বাইরে চলে এলাম। হিমুকে হসপিটালের কোথাও দেখতে পেলাম না। হয়তো উনি অফিসে ফিরে গেছে। নয়তো পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ছে। এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় পা রাখতেই কিছুটা দূরে দেখলাম লোকজন জট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদৃশ্য কোনো কারণেই বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল আমার। দ্রুত পায়ে হেঁটে আমি ভীড়ের মাঝে ঢুকতেই হিমুকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম। হাত, পা থেতলে রক্ত পড়ছে উনার। মাথা ফেটে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। এমন নির্মম অবস্থাতে ও উনি নাবিলা নাবিলা বলে চেঁচাচ্ছে। লোকজন উনাকে সাহায্য না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।

হিমু বলে বুক ফাঁটা এক্টা চিৎকার দিয়ে আমি দৌঁড়ে গিয়ে রাস্তায় বসে পড়লাম। উনাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। হিমু এখনো চোখ বুজে নাবিলা নাবিলা করছে। আমি উনার দু গালে চাপড় মারছি আর কেঁদে কেঁদে বলছি,,,

—“প্লিজ হিমু আপনি শান্ত হোন। আপনার অবস্থা খুব খারাপ। এভাবে চেঁচালে আপনার শরীর আরো খারাপের দিকে যাবে। আপনি থামুন প্লিজ। আপনাকে এক্ষনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”

হিমু মিটিমিটি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,,

—“আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই। প্লিজ মুক্তি দাও আমায়।”

নিবার্ক হয়ে আমি উনার দিকে তাকালাম। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল গুলো উনার চোখে এসে পড়ছে। কোনো কথা না বলে আমি লোকজনের থেকে হেল্প নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে হিমুকে নিয়ে আগের হসপিটালটায় চলে এলাম। যে হসপিটালটায় নাবিলা আছে।

#চলবে,,,,,?