তুমি আমারই রবে পর্ব-১২

0
670

#তুমি_আমারই_রবে
#পর্ব_১২
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

রাত যতো বাড়তে লাগলো বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো৷ সারা রাত সজাগ ছিলাম আমি। অপেক্ষা করছিলাম কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। যখন বুঝতে পারলাম বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ঠিক তখনই তাড়াহুড়ো করে শোয়া থেকে উঠে আমি ড্রিম লাইটের হালকা আলোতে কাবার্ড থেকে আমার কয়েকটা ব্যবহারিক শাড়ি নিয়ে ল্যাকেজে গুছালাম।

সাথে আমার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির সমস্ত সার্টিফিকেট এবং এন.আই.ডি কার্ড থেকে শুরু করে জন্ম নিবন্ধন কার্ড সব নিলাম! ভাগ্যিস ঢাকায় আসার সময় বাপের বাড়ি থেকে দরকারি ডকুমেন্ট গুলো সব সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। না হয় খুব বিপদে পড়ে যেতাম। ভেবে রেখেছি, বাপের বাড়িতে ও যাবো না আমি। ঐ বাড়িতে যাওয়ার মুখ নেই আমার। বাবা-মায়ের এতো পছন্দ করা বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে পারলাম না আমি। না, সুখে সংসার করতে পারলাম। এই পোঁড়া মুখ নিয়ে কিভাবে আমি তাদের মুখোমুখি হবো? কিভাবে বলব হিমু দ্বিতীয় বিযে করবে? আমার মুখ থেকে এসব কথা বের হবে না। মরে গেলে ও না। তবে, আমাকে এই অবস্থায় দেখলে বাবা-মা অনেক ভেঙ্গে পড়বেন। আমাকে আবার হিমুর কাছে ফিরে যেতে বলবেন। হিমুর সাথে সব মিটিয়ে নিতে বলবেন। তবে, যে আমি আর হিমুর কাছে ফিরে আসতে চাই না। হিমুর সাথে কিছু মিটিয়ে নিতে চাই না! দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তাদের আকাশ জোড়া স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে চাই না!

হিমু নিজের অজান্তেই আমার মনকে খুব আঘাত করেছে৷ আমি প্রকাশ না করলে ও হিমুর অন্তত এটা বুঝার উচিত ছিলো। অন্তত একজন বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে! কিন্তু না হিমু বুঝে নি। বুঝার চেষ্টা ও করে নি। যে মানুষটা আমি কাছে থাকতেই আমার মর্ম বুঝে নি, দূরে গেলে যে সে আমায় ঠিক কতোটা মনে রাখবে তা আমার ভালো করে বুঝা হয়ে গেছে। আমি চলে গেলে উল্টো উনার পথের কাঁটা দূর হবে! নাবিলাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারবেন।

যাই হোক, আমার জন্য আমার মা-বাবার কষ্ট টা চোখের সামনে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারব না। এরচে ভালো আমি দূর থেকে তাদের খবর নিবো। সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকব! যেনো চাইলে ও কেউ আমার খোঁজ নিতে না পারে!

ল্যাকেজটা গুছিয়ে আমি শেষ বারের মতো হিমুর দিকে তাকালাম। নাক টেনে ঘুমুচ্ছেন উনি। দিন দুনিয়ার খবর নেই উনার। সম্পূর্ণ দুঃশ্চিন্তামুক্ত। আজকের পর থেকে এই লোকটাকে আর দেখা হবে না। খুব দূরে হারিয়ে যাবো আমি। যেখানে হারালে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। হিমু ও আমাকে খুঁজে পাবে না। তবে হিমু আমাকে খুঁজবে কেনো? হিমুর তো নাবিলা আছে। নাবিলা চলে যাওয়ার পরে ও নাবিলার অসংখ্য স্মৃতি থাকবে। সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই হিমু বাঁচবে। আর আমি বাঁচব হিমুর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। চিঠিতে অনেক কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেশি কিছু লিখা হয় নি। লিখলে ও উনি বুঝবেন না। উনার মন তো এখন নাবিলাতে বন্দী। আমার অনুভূতি গুলো উনার কাছে হেলা ফেলা মনে হবে। আমি অন্তত আমার অনুভূতি গুলোকে কারো কাছে ছোট করতে পারব না। তাই চিঠিতে শুধু এটুকুই লিখেছি,,,

“আমি রূপা বলছি হিমু। ভেবেছিলাম আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে আপনার লাইফ থেকে সরে যাবো। কিন্তু পারলাম না। স্বামী, স্ত্রীর পবিএ সম্পর্কটাকে এভাবে ভেঙ্গে দিতে পারলাম না। তাই আমি অজানায় হারিয়ে যাচ্ছি হিমু। খুব দূরে কোথাও। যেখানে হারালে কেউ আমায় খুঁজে পাবে না। চিন্তা করবেন না হিমু, আমি কখনো স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আপনার জীবনে আসব না। সারা জীবনের জন্য সরে গেছি আমি। নিজের খেয়াল রাখবেন হিমু। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবেন। আর পারলে স্মোকিং করাটা কমিয়ে দিবেন। স্বাস্থ্যের জন্য খুব মারাত্নক তো তাই। আমি চাই আপনি সুস্থভাবে অনেক অনেক বছর বেঁচে থাকুন। মন থেকে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আর শুনুন, যদি কখনো আমার কথা মনে পড়ে ডায়েরীতে আমাকে নিয়ে দু, এক লাইন লিখে রাখবেন। পৃথিবীটা তো খুব ছোট। হয়তো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের দেখা হয়ে যেতে পারে। ঐ দিন হুট করেই আপনার কাছ থেকে ডায়েরীটা চেয়ে নিবো। আর আপনার সমস্ত মনের কথা পড়ে নিবো! নাবিলাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে থাকুন হিমু। নাবিলা আর আপনার জন্য এক আকাশ শুভ কামনা রইল।”

ব্যাস এটুকুই লিখেছি। হিমুর থেকে চোখ সরিয়ে আমি টাকার পার্সটা হাতে নিলাম। পার্সে মাএ পাঁচ হাজার টাকা আছে। এই টাকাটা আমার আব্বু ঈদের সালামি হিসেবে আমাকে দিয়েছিলো। যত্ন করে টাকাটা পার্সে রেখে দিয়েছিলাম। ভাবতেই পারি নি আজ এভাবে টাকাটা কাজে লেগে যাবে! পুরো রুম টায় শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে আমি ধীর পায়ে হেঁটে ল্যাকেজটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। শ্বাশুড়ী মায়ের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমি। উনাকে একবার মা বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করছে। উনার মুখ থেকে রূপা ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে। এই পাঁচ মাসে মা কে খুব আপন করে নিয়েছি আমি। কখনো শ্বাশুড়ী মা ভাবি নি। আমার নিজের মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। মা ও আমাকে কখনো পুএ বধূ হিসেবে দেখে নি। নিজের মেয়ে হিসেবে দেখেছে। মাঝে মাঝে আদর করে খাইয়ে ও দিয়েছে। চুল বেঁধে দিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এই মা কে ভুলতে আমার খুব কষ্ট হবে।

খেয়াল করে দেখলাম আজ আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ও বের হচ্ছে না। আমি চাইছি অনেক কাঁদতে। কিন্তু কিছুতেই আমার চোখে জল আসছে না। হয়তো জল গুলো শুকিয়ে গেছে। পা টিপে টিপে হেঁটে আমি সদর দরজাটা খুলে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে পুরো বাড়িটা দেখছি। এক ধরনের মায়া কাজ করছে বাড়িটার উপর। এই বাড়িতে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিয়ে হওয়ার পর পরই তো এই বাড়িতে আসা। তাই অদ্ভুত একটা টান কাজ করছে।

বাড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাস্তায় উঠে এলাম। রাস্তাটা পুরো ফাঁকা৷ কাক, পক্ষী ও রাস্তায় নেই। নিস্তব্ধতায় খাঁ খাঁ করছে সর্বএ। কেবলই রাস্তার চারপাশে সোডিয়ামের আলো জ্বলছে। সোডিয়ামের আলোকে কেন্দ্র করে অসংখ্য ছোট ছোট পোকা মাকড় রা ভোঁ ভোঁ করছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলছি আমি। মৃদ্যু, মসৃণ বাতাসে আমার খোলা চুল গুলো উড়ছে। একটা বৈরাগ্য ভাব কাজ করছে আমার মধ্যে। আশে পাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনো হেলদুল নেই আমার৷ তবে মাঝে মাঝে ভয়ে আতকে উঠছি। নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। কোথা থেকে না আবার কুকুররা এসে আমাকে আহত করে দেয়।

এতো রাতে কার কাছে যাবো আমি, কোথায় থাকব তার কোনো সঠিক জবাব আমার কাছে নেই। তবে এটা জানি সঠিক ঠিকানায যেতে হলে আমাকে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঢাকার রাস্তাঘাট খুব খারাপ৷ বিশেষ করে গভীর রাতের৷ কোথায় কোন হায়েনা রা উৎ পেতে বসে আছে বলা যায় না। আমাকে পাওয়া মাএই হয়তো খাবলে খুবলে খেয়ে নিবে। এসব ভাবছি আর যতদূর পারছি হেঁটে চলছি। আজ রাতটা কোনো রকমে কাভার হলেই কাল সকালে চট্টগ্রামের ট্রেন ধরে লামিয়ার কাছে চলে যেতে হবে।

লামিয়া আমার খুব কাছের বান্ধুবি৷ ভার্সিটিতে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। ওর সাথে খুব সখ্যতা ও গড়ে উঠেছিলো। তবে অনার্স পরীক্ষার পর লামিয়ার সাথে তেমন যোগাযোগ হয় নি আমার। আজ বিকেলেই ওর সাথে যোগাযোগ হলো৷ আমি নিজে থেকেই ওর সাথে যোগাযোগ করেছি। চট্টগ্রামে লামিয়া একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। খুব ভালো টাকার স্যালারি। চট্টগ্রাম গেলে সে আর যাই করুক আমাকে ফেলে দিবে না। উল্টো যতোদিন চাইব ওর কাছে থাকতে পারব। প্রয়োজনে সে আমাকে কম টাকার মধ্যে ভালো একটা চাকরী ও খুঁজে দিবে। চাকরীটা করে কোনো রকমে যেনো আমি আমার জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারি। থেকে, খেযে বেঁচে থাকতে পারি। লামিয়ার কাছে যাওয়ার একটা প্লাস পয়েন্ট হলো: লামিয়াকে আমার মা, বাবা, বোন তেমন চিনে না। কারণ, লামিয়া কখনো আমাদের বাড়ি আসে নি। কখনো আমার পরিবারের সাথে ওর কথা ও হয় নি। শুধু মুখে মুখে কয়েকবার লামিয়ার নাম উনারা শুনেছে। আশা করি এতোদিনে উনারা লামিয়ার নামটা ও ভুলে গেছে। চাইলে ও উনারা লামিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না! আমার খবর ও নিতে পারবেন না।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে এলাম। পা গুলো ধরে আসছিলো আমার। রাস্তার ফুটপাতে দু পা মেলে বসলাম আমি৷ চোখ বুজে নিজেকে একটু শান্ত করছিলাম। হঠাৎ নাবিলার মায়া ভরা চোহারাটা আমার চোখে ভাসল৷ তাড়াহুড়ো করে চোখ খুলে আমি ল্যাকেজ পএ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নাবিলাকে একটা নজর দেখে আসতে হবে আমার। হেঁটে চললাম হসপিটালের রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে এতো দূর যাওয়া সম্ভব না। তাছাড়া হসপিটালের রাস্তাটা আমি এতক্ষনে ভুলে ও গেছি। এর মাঝেই একটা রিকশার বেল বাজানোর আওয়াজ হলো। তাড়াহুড়ো করে আমি রাস্তায় তাকালাম। একটা ষোলো থেকে সতেরো বছরের ছেলে রিকশা চালাচ্ছে। আমাকে দেখে সে মলিন হেসে বলল,,,

–“আপা যাবেন?”

–“হুম। যাবো। গোমতী হসপিটাল।”

–“উঠে পড়ুন আপা।”

উঠে পড়লাম আমি রিকশায়। ছেলেটা খুব জোরে রিকশাটা ছেড়ে দিলো। কৌতুহলী হয়ে আমি ছেলেটাকে বললাম,,,

–“এতো গভীর রাতে তুমি রিকশা চালাতে বের হয়েছ?

–“হুম আপা। পেটের দায়ে।”

–“তাই বলে এই গভীর রাতে?”

–“দিনের বেলায় রিকশা নিয়ে বের হতে পারি না আপা। পাড়ার লোকজন হাসি, তামাশা করে। বন্ধুরা ও খুব ক্ষেপায়। তাই রাতের আঁধারে রিকশা নিয়ে বের হই৷ মাঝে মাঝে আপনাদের মতো প্যাসেন্জ্ঞারদের পেয়ে যাই। মাসে অন্তত এক হাজার টাকা তো আসেই। সে টাকা দিয়ে চাউলের যোগান হয়।”

–“বাবা নেই তোমার?”

–“আছে৷ আমার বাবা দিনের বেলায় রিকশা চালায়৷ আর আমি রাতের বেলায়।”

–“ভয় করে না এতো রাতে বের হতে? যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়ে যায়?”

–“আল্লাহ্ র উপর ভরসা রেখেই বের হই আপা। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

ছেলেটার উপর খুব মায়া পড়ে গেলো। আল্লাহ্ র দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষ ই অসহায়৷ আর্থিক হোক, পারিবারিক হোক বা মানসিক। অভাব তাদের থাকবেই। কিছুক্ষনের মধ্যে রিকশা এসে গোমতী হসপিটালের সামনে থেমে গেলো। ছেলেটার হাতে জোর করে একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম আমি। ছেলেটা খুব খুশি হয়ে চলে গেলো। ছেলেটার ঠোঁটে হাসি দেখে আমার ঠোঁটে ও এক চিলতে হাসি ফুটল। হসপিটালের ভেতরে ঢুকতেই একজন গার্ড এসে বেশ উদগ্রীব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

–“কি ম্যাডাম এতো রাতে হসপিটালে? কোনো পেশেন্ট নিয়ে এসেছেন?”

–“না৷ পেশেন্টকে দেখতে এসেছি।”

–“আগে থেকেই ভর্তি?”

–“হুম।”

–“ঠিক আছে যান।”

নাবিলার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কেবিনের দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। জানালা দিয়ে কেবিনের ভেতরে তাকাতেই আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। বেডের উপর নাবিলা নেই। একটা বৃদ্ধ মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। আমি চোখ কচলে আবার বেডের দিকে তাকাতেই ঐ দিনের নার্সটা আমাকে টেনে কেবিনের সামনে থেকে অনেকটা দূরে দাঁড় করিয়ে বললেন,,,

–“কি ব্যাপার? এতো রাতে আপনি এখানে কি করছেন?”

–“নাবিলাকে দেখতে এসেছি৷ কিন্তু নাবিলা তো ভেতরে নেই।”

–“ভেতরেই আছে৷ আপনি ভুল দেখেছেন।”

–“তাহলে একবার নাবিলার সাথে দেখা করতে দিন।”

–“দেখা হবে না এখন৷ সকালে এসে দেখে যাবেন।”

–“নাবিলার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো।”

–“বললাম তো কাল সকালে আসবেন। এখন পেশেন্টের সাথে দেখা করতে দেওয়া যাবে না।”

হতাশ হয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে এলাম। রাতটা হসপিটালের গেইটের সামনেই পাড় করে দিলাম। হসপিটালের দাড়োয়ানের সাথে অনেক কথা বললাম। ভোরের আলো ফুটতেই আমি বাস স্টপে চলে এলাম। চট্টগ্রামের টিকেট কেটে ভোর ছয়টার বাসে উঠে পড়লাম। বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ জোড়া বুজলাম। বাস আমায় নিয়ে ছুটে চলছে নতুন এক শহরে। আজ থেকে আমার চেনা পৃথিবীটা পাল্টে যাবে৷ কাছের মানুষ গুলো সব দূরে চলে যাবে। একদিন হয়তো সবাই আমাকে ভুলে ও যাবে। রূপাকে কেউ মনে রাখবে না। রূপার সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কেউ মনের টানে ও আমাকে খুঁজতে আসবে না। তবে আমার পরিবার আমার জন্য খুব কষ্ট পাবে, কাঁদবে৷ হয়তো শোকে শোকে পাথর ও হয়ে যাবে।

আমাকে ও নতুন নতুন মানুষদের নিয়ে বেঁচে থাকার অভ্যেস করে নিতে হবে। আজ থেকে আমার জীবনে নতুন একটা অধ্যায় শুরু হবে। যে অধ্যায়ে হিমু নামের কোনো পরিচ্ছেদ থাকবে না। থাকবে শুধু রূপা আর রূপা।

দুপুরের মধ্যে চট্টগ্রাম এসে বাস পৌঁছে গেলো। বাস থেকে নেমে আমি ফুটপাতের ফ্লেক্সিলোড দোকান থেকে একটা নুতন সিম কিনলাম। সিমটাতে লামিয়ার মুখস্ত করা নাম্বারটা সেইভ করে নিলাম৷ আগের সিমটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছি। যেনো কেউ চাইলে ও আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। সি.এন.জি নিয়ে আমি কিছুক্ষনের মধ্যে রাউজান এসে পৌঁছে গেলাম। লামিয়ার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী বিশাল এক হলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লামিয়াকে ফোন করে বলতেই লামিয়া দৌঁড়ে হলের সামনে চলে এলো। আমাকে দেখেই লামিয়া আমাকে ঝাপটে ধরে বলল,,

–“কতোদিন পর তোকে দেখলাম।”

–“হ্যাঁ রে৷ বছর তো হবেই।”

লামিয়া আমার ল্যাকেজটা হাতে নিয়ে বলল,,

–“চল চল রুমে চল।”

আমি লামিয়ার সাথে সামনে এগুচ্ছি আর বলছি,,,

–“আমি তো ভেবেছি তোকে কল করে পাবো না! হয়তো অফিসে থাকবি।”

–“তুই আসবি বলে আজ অফিস কামিয়েছি।”

কিছু বললাম না আমি। শুধু মৃদ্যু হেসে লামিয়ার দিকে তাকালাম। লামিয়ার রুমে আরো একজন রুম মেইট থাকে। সে ও লামিয়ার সাথে একই কোম্পানিতে জব করে। খুব তাড়াতাড়ি মেয়েটা আমার সাথে মিশে গেলো। আসলে ওরা দুজনি খুব বন্ধুসুলভ।

দুপুরের খাওয়া খেয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিলো। এতোক্ষনে হয়তো সবাই আমাকে খুঁজতে শুরু করেছে। আমার মা, বাবা, ছোট বোনটা পাগল হয়ে আমাকে খুঁজছে। শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় বাবা ও হয়তো হন্ন হয়ে রূপাকে খুঁজছে। তবে চিঠিটা পাওয়ার পর পরই সবাই আমাকে খুঁজা বন্ধ করে দিবে। কারন, আমি স্বইচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছি। হিমু হয়তো এতোক্ষনে চিঠিটা পেয়ে গেছে। চিঠিটা আমি বেডের কাছে ডেস্কের উপর রেখে এসেছি। সর্বপ্রথম চিঠিটা হিমুর হাতেই পড়বে। চিঠিটা পেয়েই হিমু খুব খুশি হয়ে যাবে। কারণ, উনার পথের কাঁটা আজীবনের জন্য সরে গেছে!

এর মাঝেই লামিয়া করিডর থেকে ফোন হাতে নিয়ে বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,,,

–“রূপা। তোর চাকরীর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পরই ইন্টারভিউ।”

–“এতো তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করে নিলি?”

–“আসলে বহুদিন ধরেই এই পোস্টটা খালি ছিলো। নতুন কোম্পানি বলে সঠিক প্রচারণার অভাবে এমপ্লয়ি পাওয়া যাচ্ছিলো না। কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে কথা বলতেই উনি ইন্টারভিউয়ের ডেইট ফিক্সড করে দিলেন!”

বড় করে একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম আমি। ভাবতে পারি নি এতো তাড়াতাড়ি চাকরীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। লামিয়া ছিলো বলেই সব সম্ভব হয়েছে। লামিয়ার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। কখনো না।

দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর ইন্টারভিউয়ের ডেইট চলে এলো। লামিয়ার কথা মতো খুব ভালোভাবেই প্রিপারেশান নিয়েছি আমি। দুই দিন পর অফিস থেকে আমার নাম্বারে কল এলো। চাকরীটা হয়ে গেছে আমার!!! আগামী এক তারিখ থেকেই জয়েনিং। হাতে আর মাএ কয়েকটা দিন সময় আছে। দুই দিন পরেই মাস ফুরিয়ে আসবে। বুকে পাথর চাঁপা দিয়ে ক্রমান্বয়ে দিন অতিক্রম হতে লাগল আমার। নতুন করে সব শুরু করলাম আমি। পেছনের সব কিছু ছেড়ে এসে। এক সাগর কষ্ট থাকার পরে ও চোখে আমার কখনো জল আসে নি। হয়তো দুঃখটা সয়ে গেছে!

,

,

দীর্ঘ দুই বছর পর,,,,,,

#চলবে,,,,?