তুমি আমারই রবে পর্ব-১৩ + বোনাস পর্ব

0
706

#তুমি_আমারই_রবে
#পর্ব_১৩
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

দীর্ঘ দুই বছর পর,,,

লামিয়ার জন্মদিন আজ। আমি আর নীলা ভেবে রেখেছি রাত ১২ টা বাজার সাথে সাথেই লামিয়াকে খুব বড় সড় একটা সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দিবো। তাই সারা রাত ধরেই দুজন জেগে আছি। লামিয়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাত দশটার মধ্যেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। বেচারী লামিয়া হয়তো ভুলেই গেছে আজ তার জন্মদিন!

এক বছর হলো হল ছেড়ে আমরা দুই কামড়ার ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। ড্রইং রুম, কিচেন রুম, ওয়াশরুম এডজাস্ট করা। ফ্ল্যাটের বাহিরটা কিছুটা নড়বড়ে আর ভাঙ্গা চূড়া হলে ও ভেতরটা বেশ পাকাপোক্ত আর রঙ্গচঙ্গা৷ তবে বৃষ্টি এলে মাঝে মধ্যে দেয়াল বেয়ে পানি পড়ে। মাঝে মাঝে রুমে ও পানি ঢুকে যায়৷ রাস্তা থেকে আমাদের ফ্ল্যাটটা খুব নিঁচু তো তাই। তবু ও আমরা মানিয়ে নিচ্ছি। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকছি। এখানে আমরা তিনজনই অসহায়। এর চেয়ে উন্নতমানের ফ্ল্যাট নিতে গেলে এই ব্যয়বহুল শহরে আমাদের থাকা হবে না। নিজেদের রোজগারের টাকা দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাট ভাড়া, মুদি খরচ, বাজার খরচ, বিদ্যুৎ বিল, আনুসাঙ্গিক খরচ সব চলে। তবে নীলা আর লামিয়ার তো এ টাকা থেকেই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। নীলা তার বাবা-মায়ের একমাএ মেয়ে। বাবা রোজগার করেন না। মেয়ের চাকরীর টাকায় ই তাদের সংসার চলে। লামিয়ার অবশ্য একজন বড় ভাই আছেন। তবে উনি অকর্মঠ। কাজ করতে পারেন না। হয়তো শারীরিক কোনো সমস্যা আছে। লামিয়ার বাবা যা রোজগাড় করেন তা দিয়ে শুধু উনার ঔষুধ খরচ ই চলে। চাকরীর অর্ধেক টাকা দিয়ে লামিয়াকে সংসারের যোগান দিতে হয়। তবে এদিক থেকে আমি মুক্ত! আমার কোনো পরিবার নেই। কোনো সংসার ও নেই! কারো জন্য আমাকে মাস শেষে টাকা পাঠাতে হয় না! তবে মাস শেষে যে টাকাটা আমার হাতে থাকে সে টাকাটা আমি এতিমখানায় দিয়ে আসি। এতে অন্তত একজন এতিম বাচ্চার পড়ার খরচ তো চলবেই।

দীর্ঘ এক বছর ধরে আমরা এই বাড়িটাতে থাকছি। বাড়িটা থাকার অনুপযোগী হলে ও বাড়িটার প্রতি এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে। বিশেষ করে আন্টি আঙ্কেলের উপর। বাড়ির মালিক আমাদের কখনো ভাড়াটিয়ার চোখে দেখেন নি। নিজেদের মেয়ের চোখে দেখেছেন। মাস শেষে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে একটু দেরি হয়ে গেলে উনারা মানিয়ে নিয়েছেন। মাস শেষ হওয়ার আগে বাজার ফুরিয়ে এলে উনারা নিজের তরফ থেকে আমাদের বাজার করে দিয়েছেন। প্রতি অফ ডে তে আন্টি বিকেলে আমাদের সাথে বসে আড্ডা দিতেন আর চা খেতেন। উনার ছেলের নানা গল্প শুনাতেন। আন্টির কোনো মেয়ে নেই। শুধু একটা ছেলেই আছেন। তাও আবার আমেরিকায় থাকেন। পড়াশোনার খাতিরে একমাএ ছেলেকে আমেরিকায় পাঠানো। উনার ছেলেকে এই পর্যন্ত আমরা কেউ দেখে নি। শুধু মুখে মুখে উনার ছেলের বর্ণনা শুনেছি। বর্ণনা শুনেই বুঝে গেছি উনি কতোটা রাগী আর বদমেজাজি।

আমাদের ফ্ল্যাটের পাশের পাঁচ তলা বাড়িটা উনাদের। উনারা এই পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের তিন তলায় থাকেন। বাকি তালা গুলো ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আর ভাঙ্গা চূড়া ফ্ল্যাটটা আমাদের ভাড়া দিয়েছেন। মাএ এক বছরে আমরা উনাদের খুব বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছি। তাই উনারা বিশ্বাস করে বাড়ির সব দায়িত্ব আমাদের হাতে দিয়ে আমেরিকা বেড়াতে গেছেন৷ ফেরার সময় সাথে করে উনাদের একমাএ ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন! হয়তো উনাদের ফেরার দিন ঘনিয়ে এসেছে। দু মাস অলরেডি হয়ে গেছে।

লামিয়াকে রুমে আটকে রেখে আমি আর নীলা বসার ঘরের ডান পাশের দেয়ালটাকে বিভিন্ন রঙ্গের বেলুন, সাদা গোলাপ আর ক্যান্ডেল দিয়ে সাজাচ্ছি। ছোট একটা টি টেবিল এনে টেবিলটার চারপাশে সাদা গোলাপের পাঁপড়ী ছিটিয়ে দিয়েছি। মাঝখানটা ফাঁকা রেখেছি। বার্থডে কেকটা মাঝখানে রাখব বলে। ঘড়িতে অলরেডি রাত এগারোটা বাজছে৷ যা করতে হবে আমাদের ঊনষাট মিনিটের মধ্যেই করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে আমি আর নীলা যতোটুকু পেরেছি বসার রুমটা সাজিয়েছি। দুজন যে কতো অসংখ্যবার একসাথে ধাক্কা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বেলুন ফুলাতে গিয়ে বেশিরভাগ বেলুন ই ফাটিয়ে ফেলেছি। কখনো আবার হাসতে হাসতে দুজন দুজনের গাঁয়ে এসে পড়েছি। অনেক খাটাখাটনির পর আমরা ক্লান্ত হয়ে দুজনই কোমড়ে হাত দিয়ে রুমটার দিকে চোখ বুলালাম। কিছুক্ষণ রুমটা খুঁটিয়ে দেখে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে বললাম,,,

“ইট’স পার্ফেক্ট।”

দুজনই হাই ফাইভ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়িতে ১১ঃ৪৫ বাজছে। আমি জিভ কেটে নীলাকে বললাম,,,

“ইসসস। বারোটা বেজে যাচ্ছে। চল চল তাড়াতাড়ি কেকটা এনে সাজাই। লামিয়াকে ডেকে দেই।”

“হুম হুম জলদি কর।”

দুইজনই দৌঁড়ে ফ্রিজ থেকে কেকটা বের করলাম। আমি নিজে হাতে আজ লামিয়ার জন্য কেক বানিয়েছি। সম্পূর্ণ দোকানের মতো ডেকোরেট করে। লামিয়ার চকলেট ফ্লেভারের কেক খুব পছন্দ৷ তাই কেকটা আমি চকলেট ফ্লেভারের বানিয়েছি। ফ্রিজ থেকে কেকটা বের করে আমি আর নীলা কেকেটা সুন্দর করে টি টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। ঘড়িতে ১১ঃ৫৫ বাজতেই আমি আর নীলা হাতে দুটো স্প্রে নিয়ে লামিয়ার রুমের দরজা খুলে লামিয়ার বেডের পাশে এসে দাঁড়ালাম। দুজনই স্প্রে হাতে নিয়ে মুখ চেঁপে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ সময়ের আগে না আমাদের মুখ দিয়ে কোনো সাউন্ড বের হয়ে যায় তাই যথেষ্ট সাবধানে থাকছি। ঘড়িতে ১১ঃ৫৯ বাজতেই আমরা লামিয়ার দুহাতে খুব জোরে চিমটি বসিয়ে দিলাম। অমনি লামিয়া আর্তনাদ করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। তখনই আমরা লামিয়ার চোখে, মুখে ইচ্ছে মতো স্প্রে মেরে চেঁচিয়ে বললাম,,,

“হ্যাপি বার্থডে লামিয়া।”

লামিয়া মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে চেঁচাচ্ছে আর বলছে,,,

“প্লিজ তোরা থাম। আমার চোখে, মুখে স্প্রে ঢুকে যাচ্ছে।”

“আজ আমরা কিছুতেই থামব না। যতক্ষণ না স্প্রে শেষ হবে।”

স্প্রে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আর নীলা লামিয়ার পুরো শরীরে স্প্রে করে গেছি। একদম সাদা ভূত বানিয়ে ছেড়েছি। স্প্রেটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই লামিয়া আমাদের ঝাপটে ধরে চোখে জল নিয়ে ও হাসতে হাসতে বলল,,,

“থ্যাংকস রূপা। থ্যাংকস নীলা। তোরা প্রতিবার আমাকে এমন হুটহাট সারপ্রাইজ দিয়ে খুব সাংঘাতিকভাবে চমকে দিস। তোদের মতো ফ্রেন্ড পেয়ে আমি ধন্য রে। উপর ওয়ালার কাছে একটাই প্রার্থণা আমাদের এই ফ্রেন্ডশীপটা যেনো আজীবন এমনই থাকে।”

আমি লামিয়া আর নীলাকে আরো শক্ত করে ঝাপটে ধরে বললাম,,,

“উপর ওয়ালা কখনো আমাদের আলাদা করবেন না দেখিস। আমরা তিনজন সবসময় ঠিক এভাবেই থাকব। আমাদের মধ্যকার ফ্রেন্ডশীপের বন্ধনটা কখনো নড়বড়ে হবে না। উল্টে যতোদিন যাবে আরো শক্ত হবে।”

কয়েকটা দম নিয়ে আমি আবার বললাম,,,

“তোদের কাছে আমি খুব ঋণি রে। দুর্দিনে তোরা আমার পাশে ছিলি, আমাকে সর্ব অবস্থায় সাপোর্ট করেছিলি, মাথা গোজার একটা ঠাঁই দিয়েছিলি, জীবিকার্জনের জন্য একটা চাকরী খুঁজে দিয়েছিলি। শুধু তাই নয়, ভয়ঙ্কর একটা অতীতকে পিছনে ফেলে আসতে আমাকে সাহায্য করেছিলি। তোরা সবসময় আমার বুকের বাঁ পাশটাতে থাকবি। অতি প্রিয়জন আর আপনজন হয়ে।”

চোখে হঠাৎ জল জমে এলো আমার। ভাসা ভাসা জল গুলো চোখের মধ্যে পুড়ে আমি মৃদ্যু হেসে লামিয়া আর নীলাকে ছেড়ে বললাম,,

“চল কেকটা কেটে নেই। ফ্রিজ থেকে অনেকক্ষন হলো নামিয়েছি। এতোক্ষনে হয়তো গলে ও গেছে।”

তিনজনই হাত ধরাধরি করে বসার রুমে এলাম। লামিয়া আমাদের ডেকোরেশন দেখে চোখ দুটো বড় বড় করে মুখটা হা করে রেখেছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে খুব আশ্চর্যিত। বসার রুমটা লামিয়া ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছে আর বলছে,,,

“ওরেব্বাস। তোরা তো খুব সুন্দর ডেকোরেশন করতে পারিস।”

আমি এতক্ষনে কেকটা ফ্রিজ থেকে নামিয়ে টি টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছি। নীলা কেকের চারপাশে ক্যান্ডেল সাজিয়ে ক্যান্ডেল গুলো জ্বালাচ্ছে আর বলছে,,,

“আগের বার ও এতো সুন্দর করে ডেকোরেশন করেছিলাম। বিনিময়ে তুই আমাদের ট্রিট হিসেবে শুধু ঝালমুড়ি খাইয়েছিস। এবার কিন্তু আমরা বড় সড় কোনো ট্রিট বাদে তোকে ছাড়ব না।”

আমি লামিয়ার গাল দুটো টেনে বললাম,,,

“নীলা একদম ঠিক বলেছে জানু। এবার আমাদের খুব বড় সড় একটা ট্রিট দিতে হবে। শুকনো ঝাল মুড়িতে হবে না।”

“ওকে ফাইন। কাল শুক্রবার। মানে আমাদের অফ ডে। কাল তোদের রেস্টুরেন্ট নিয়ে খুব বড় একটা ট্রিট দিবো।”

নীলা লাফাতে লাফাতে বলল,,,

“সত্যি বলছিস তো লামিয়া?”

আমি ভাব নিয়ে লামিয়ার কাঁধে হাত রেখে নীলাকে বললাম,,,

“আমাদের লামিয়া কখনো মিথ্যা বলে না জানু। ঠিক আমাদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াবে।”

লামিয়া কেকের দিকে তাকিয়ে পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে বলল,,,

“উফফ। অসব পরের ব্যাপার ছাড় তো। আগে চল কেকটা কাটি। কেকটা কেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।”

লামিয়া কেকটা কাটল। আমাদের দুজনকে খাইয়ে দিলো। আমরা ও লামিয়াকে খাইয়ে দিলাম। কেক খেয়ে দুজনই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলো। কেকটা যেমন সফট ছিলো তেমন টেস্টি। কিছুক্ষন পর শুরু হলো কেক নিয়ে মাখামাখি। তিনজন তিনজনের মুখে ইচ্ছেমতো কেক মাখিয়েছি। বাকি কেকটা তিন পিস করে কেটে আমরা খেয়ে নিয়েছি। রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত আমরা হাসি তামাশা করে নিজেদের রুমে চলে এলাম। আমরা তিনজন একই রুমে একই বিছানায় ঘুমাই। এখানে আমরা তিনজনই ভীতু। এক আরেকজনকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।

লামিয়া আর নীলা নাক টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে আমার চোখে ঘুম নেই। পরিবার, সংসার দুটোকেই খুব মিস করি। দুই বছরে একবার ও মা, বাবা ছোট বোনটার সাথে যোগাযোগ করি নি। ওরা কেমন আছে, কিভাবে আছে কিছুই জানি না। মাঝে মাঝে ওদের খোঁজ নিতে খুব ইচ্ছে করে। তবে সাহস যোগাতে পারি না। দুই বছর কম সময় না। হয়তো আমার প্রতি ওদের অনেক চাঁপা অভিমান জমে আছে! ওরা আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন কিনা জানি না। আমি অজান্তেই ওদের মনকে খুব কষ্ট দিয়েছি। কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। ওদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অন্যায় হলে ও আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি একদম ঠিক করেছি!

হিমুর কথা না হয় বাদ ই দিলাম। উনি কখনো আমাকে মনে করেন নি, হয়তো একবারের জন্য আমার কথা ভাবেন ও নি। ভাববেই বা কেনো? উনার তো নাবিলা আছে। নাবিলাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে হয়তো উনি ভালোই আছেন। আদৌ জানি না নাবিলা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। তবে দূর থেকে দো’আ করি নাবিলা বেঁচে থাকুক৷ হিমুর সহধর্মিণী হয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকুক। শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় আব্বুকে ও খুব মনে পড়ে। জানি না উনারা আদৌ নাবিলাকে পুএ বধূ হিসেবে মেনেছেন কিনা। তবে মানতে উনারা বাধ্য। কারণ উনাদের ছেলে ঐ নাবিলাতেই আসক্ত।

এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। চোখে এখন খুব সহজে জল আসে না। জলে রা ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যদি ও কখনো চলে আসে গাল অব্দি গড়িয়ে পড়ে না। চোখের ভেতরেই মজে যায়। দুঃখ এখন সয়ে গেছে। কেউ এখন আমাকে কটু বললে ও গাঁয়ে লাগে না!

ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম ঘড়িতে ভোর ছয়টা বাজছে। বাড়ির সদর দরজাটা কেউ অনবরত ধাকাচ্ছে। দরজাটা এমনিতেই নড়বড়ে৷ কখন লোকজনের ধাক্কাধাক্কাতি ভেঙ্গে যায়। স্বয়ং আল্লাহ্ জানেন। আঙ্কেল, আন্টি বলেছেন আমেরিকা থেকে ফিরে এলেই আমাদের ফ্ল্যাটের কাজ ধরবে। দরজা, জানালা সব ঠিক করে দেবে, দরকার হলে রুম গুলো ও উঁচু করে দিবে।

আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে আমার পাশে থাকা লামিয়াকে বললাম,,,

“এই লামিয়া। দেখ না কে এসেছে। বাইরে থেকে সমানে দরজা ধাকাচ্ছে।”

লামিয়া ঘুম ঘুম কন্ঠে বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল,,,

“উফফফ তুই যা না। দেখ কে এসেছে। আমি পরাব না। আমার খুব ঘুম পেয়েছে।”

নীলাকে ডাকার পরে ও নীলা উঠল না। ভোর চারটার দিকে ঘুমিয়েছি আমি। কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে আমার। তবে চোখ টেনে মেলতে পারছি না। চোখে এখনো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে। মাথাটা ও প্রচন্ড ব্যাথা করছে। শেষ পর্যন্ত চোখে রাশি রাশি ঘুম নিয়ে আমি বাধ্য হয়ে উড়নাটা কোনো রকমে গলায় পেঁচিয়ে হেলতে দুলতে সদর দরজার কাছে এলাম। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজটা প্রবলভাবে বাড়ছে। চোখ বুজে বেশ বিরক্তি নিয়ে আমি দরজাটা খুলছি আর বলছি,,

“উফফ খুলছি তো। দরজাটা ভেঙ্গে ফেলবেন নাকি?”

দরজাটা খুলতেই আমি আধখোলা চোখে একজন টল, বডি বিল্ডার, হ্যান্ডসাম ছেলেকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যদি ও ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট দেখছি না। ঘুমের তান্ডবে চোখ খোলা সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। তা ও ঘোলা ঘোলা চোখে আমি ছেলেটাকে বললাম,,,

“এই কে আপনি? এভাবে দরজা ধাক্কাছেন কেনো?”

“এতক্ষন লাগছিলো কেনো দরজা খুলতে? রুমে পড়ে পড়ে কি করছিলেন?”

আমি বড় করে একটা হামি তুলে অস্পষ্ট স্বরে বললাম,,,

“ঘুমাচ্ছিলাম। সকাল সকাল আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে আমার সাথেই রাগ দেখাচ্ছে? আজব লোক তো।”

ছেলেটা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,,,

“ফ্ল্যাটের চাবিটা দিন।”

আমি ছেলেটার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঘুমে বিড়বিড়িয়ে বললাম,,

“প্রতি সপ্তাহে যা ও একটা অফ ডে পাই তা ও আবার কোত্থেকে লোকজন এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। প্রতিটা অফ ডে তে কিছু না কিছু তো হবেই। ঐ দুজন পড়ে পড়ে ঘুমুবে আর মাঝখান থেকে আমার ঘুমের বারোটা বাজবে। কপালে সুখ নেই আমার।”

ছেলেটা হঠাৎ দ্বিগুন রেগে বললেন,,,

“ফ্ল্যাটের চাবিটা দিতে বলেছি। এখানে আমি আপনার ঘ্যান ঘ্যান শুনতে আসি নি।”

মুহূর্তের মধ্যে ঘুম উবে গেলো আমার। ভয়ে কিছুটা থতমত খেয়ে আমি বুকে থু থু ছিটিয়ে ছেলেটাকে বললাম,,,

“এই আপনি এভাবে সাত সকালে এসে আমার সাথে চেঁচাচ্ছেন কেনো? আবার ফ্ল্যাটের চাবি ও চাইছেন। আমি জানি না আপনার ফ্ল্যাটের চাবি কোথায়। কোথায় হারিয়ে এসেছেন, নিজ দায়িত্বে খুঁজে দেখুন।”

উনি এবার চোয়াল শক্ত করে বললেন,,,

“উফফফ আমি আপনার মালিকের ফ্ল্যাটের চাবি চাইছি।”

“আমার মালিকের ফ্ল্যাটের চাবি আপনি কেনো চাইছেন? আর চাইলেই বা আমি আপনাকে চাবিটা দিবো কেনো?”

ছেলেটা উনার সামনের চুল গুলো টানতে টানতে ভীষণ রেগে নাক টেনে বললেন,,,

“আমি বলছি তাই দিবেন। কথা না বাড়িয়ে ফ্ল্যাটের চাবিটা দিন।”

“আপনি কে হ্যাঁ? বললেই চাবি দিয়ে দিতে হবে। আচ্ছা আপনি চোর, ডাকাত নন তো?”

“ইউ ইডিয়ট গার্ল।”

“ইডিয়ট বলুন আর যাই বলুন। চাবি আমি দিচ্ছি না। আপনার সাহস দেখে তো আমি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি। প্রকাশ্যে আমার থেকে ফ্ল্যাটের চাবি চাইছেন! এখন দেখছি চোর, ডাকাতরা ও খুব আপডেট হয়ে যাচ্ছে।”

লোকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। আর বিড়বিড়িয়ে বললাম,,,

“কোথা এসব চলে আসে আল্লাহ্ জানে।”

কথাটা বলে সদর দরজা থেকে সরে সোফার কাছে আসতেই নড়বড়ে সদর দরজাটা ভেঙ্গে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল৷ মুখে হাত দিয়ে আমি পিছু ঘুড়ে তাকাতেই তাজ্জব হয়ে গেলাম। লোকটা শার্টের হাতা ফোল্ড করে ভেঙ্গে যাওয়া দরজাটাকে দু পা দিয়ে লাথ মারছে আর বলছে,,,

“আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া না? ইউ ইডিয়ট গার্ল।”

আমি এখনো একই জায়গায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বিশ্বাস ই হচ্ছে না লোকটা আমাদের সদর দরজা ভেঙ্গে দিয়েছে। দরজা ভাঙ্গার আওয়াজে লামিয়া আর নীলা ঘুম থেকে উঠে দৌঁড়ে বসার রুমে চলে এলো। দুজনই মুখে হাত দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

“এ ছেলেটা কে রূপা? আর দরজাটাই বা কিভাবে ভাঙ্গল?”

প্রতিউত্তরে লামিয়া আর নীলাকে কিছু না বলে আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে তেঁড়ে গিয়ে ছেলেটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঝাঝাঁলো কন্ঠে বললাম,,,

“আপনি কি পাগল? কোন সাহসে আপনি আমাদের রুমের দরজা ভাঙ্গলেন?”

“আপনার সাহস হয় কিভাবে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া? শুধু তাই নয়। এখন আবার আমাকে পাগল ও বললেন?”

“চিনা না জানি না, অপরিচিত একটা লোকের মুখের উপর দরজা বন্ধ করব না তো তাকে সাদরে আমন্ত্রণ কর ঘরে তুলব? এই শুনুন আপনি শুধু পাগল না চূড়ান্ত অসভ্য লোক ও।”

“চুপ একদম চুপ। আর একটা কথা ও বলবেন না। আম্মু, আব্বুকে বলে আজই আমি আপনাদের এই ফ্ল্যাট ছাড়া করব।”

“আপনি কে হ্যাঁ? আপনার কথায় আঙ্কেল, আন্টি আমাদের ফ্ল্যাট ছাড়া করবে? কে আপনি বলুন।”

“আমি এই বাড়ির মালিক। আপনার আঙ্কেল, আন্টির ছেলে।”

মুখে হাত দিয়ে আমি শুকনো ঢোক গিলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার অবস্থা এখন মূর্তি প্রায়। না চিনেই উনাকে কতো ছোট বড় কথা বলে ফেলেছি। আল্লাহ্ জানে এই ছেলে এখন আমার কি অবস্থা করে। এর মাঝেই লামিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আঙ্কেল, আন্টির ফ্ল্যাটের চাবিটা উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,,

“এএএই নিন আপনার ফ্ল্যাটের চাবি। আআআসলে আমরা আপনাকে চিনতে পারি নি। প্লিজ আমাদের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না।”

ছেলেটা লামিয়ার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে শকুনের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“আমি আপনাকে দেখে নিবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

#চলবে❤️

#তুমি_আমারই_রবে
#বোনাস_পর্ব
#Nishat_Jahan_Raat

“আমি আপনাকে দেখে নেবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

ভয়ে এক প্রকার আমি সিঁধিয়ে গেছি। ছেলেটা যেভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো মনে হচ্ছে নেক্সট টাইম আমাকে সামনে পেলেই আস্ত চাবিয়ে খাবে। এতো রাগী আর বদমেজাজি ছেলে জীবনে আমি দ্বিতীয় বার দেখলাম! এই ছেলেটা হিমুর চেয়ে কম না। মনে হচ্ছে হিমুর চেয়ে দুকদম বেশি হবে। মুখে এক আঙ্গুল পুড়ে আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে লামিয়াকে বললাম,,,

“এখন কি হবে রে লামু? ছেলেটার ভুলভাল কথায় যদি আঙ্কেল, আন্টি আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেন?”

লামিয়া আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,,,

“কি দরকার ছিলো ছেলেটাকে এতো ঘাটানোর? এর ফল কি হলো দেখলি তো? এখন আমাদের ফ্ল্যাট ছাড়া ও করবে। এতো কম দামে আমরা ভালো আর নিরাপদ ফ্ল্যাট কোথাও পাবো?”

“সাবধানে কথা বল লামু। আমি ছেলেটাকে ঘাটাই নি। ছেলেটা যদি প্রথমেই উনার পরিচয় দিতেন তাহলে কথা এতোদূর বাড়ত না। উনি প্রথমেই এসে পরিচয় না দিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি চেয়ে নিলেন। আর আমি ও উনার পরিচয় না জেনে ফ্ল্যাটের চাবিটা উনার হাতে তুলে দিবো?”

নীলা দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল,,,

“আচ্ছা তোরা থাম তো। ঐ বদরাগী ছেলের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ নেই। আমার মনে হয় না, আঙ্কেল আন্টি পুরো ঘটনা না জেনে আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বের দিবে।”

এর মাঝেই হুট করে ছেলেটা আবার আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। ফ্ল্যাটের চাবিটা উনি ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে একনাগাড়ে ঘুড়াচ্ছেন আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ভয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে লামিয়া আর নীলার মাঝখানে ঢুকে পড়লাম। ছেলেটা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে এখনই ছেলেটা আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিবেন। লামিয়া আমতা আমতা করে ছেলেটাকে কিছু বলতে নিলেই ছেলেটা হঠাৎ হু হা করে হেসে দিলেন। আমি, লামিয়া আর নীলা বেকুব হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“ওহ্ মাই গড। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা হয়ে গেলো। আপনারা মেয়েরা কত্তো ভীতু। একটু কি না কি বলেছি ভয়ে আপনারা সিঁধিয়ে গেছেন। আরে আমি আপনাদের সাথে মজা করছিলাম। আপনাদের ভয় দেখানোর কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না আমার। আর দরজাটা আমি ইচ্ছে করে ভাঙ্গি নি। ভাবতে পারি নি এক লাথে দরজাটা এভাবে ভেঙ্গে পড়বে।”

আমি, লামিয়া আর নীলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকালাম। তিনজনই মলিন হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। লামিয়া আমতা আমতা করে ছেলেটাকে বলল,,,

“আসলে আমরা বুঝতে পারি নি। একা তিনজন মেয়ে এই বাড়িতে থাকি তো। তাই অল্পতেই ভয় পেয়ে যাই। তাছাড়া এই বাড়িটা আমাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। আপনি যখন এ বাড়ি থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন তখনই আমাদের ভয়টা আরো বেড়ে গেলো।”

আমি আর নীলা লামিয়ার কথায় মাথা নাড়ালাম। ছেলেটা খুব স্বাভাবিক কন্ঠে আমাদের বললেন,,,

“ভয় নেই। আপনারা যতোদিন চান এই বাড়িতে থাকতে পারবেন। কেউ আপনাদের এই বাড়ি থেকে তাড়াবে না।”

আমি বুকে হাত দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“উফফফ বাঁচালেন আমাদের।”

উনি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“শুনুন। আপনাকে বলছি। প্রতিবাদ করতে শিখুন। যখন দেখবেন কেউ আপনাকে অকারণে মুখের উপর যা তা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে আর এসব কারণে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন তখনি তার বিরুদ্ধে আপনি রুখে দাঁড়াবেন। এতো সহজে অপরাধীদের ছেড়ে দিবেন না। এতে হারটা আপনারই হবে। লোকজন আপনাকেই ভীতু ভাববে। তখন আরো বেশি করে তারা আপনাকে ভয় দেখাবে, ইচ্ছে করে কষ্টের পাহাড় আপনার উপর চাঁপিয়ে দিবে।”

আমি চরম আশ্চর্য হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা এতো ভালো জ্ঞান দিতে পারে আমি ভাবতে পারি নি। আমি আসলেই প্রতিবাদ করতে শিখি নি। যদি শিখতাম তাহলে হয়তো আমি এখন সংসার জীবনেই থাকতাম। নিজের অধিকার বুঝে নিতাম। হিমু ইচ্ছে করে আমার উপর কষ্টের পাহাড় চাঁপিয়ে দিতে পারতেন না। আমাকে শহর ছাড়া, পরিবার ছাড়া করতে পারতেন না। ছেলেটা হঠাৎ আমার চোখের সামনে তুড়ি মেরে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“স্যরি ম্যাম। অকারণে আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য। শুধু তাই নয় সকালের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য।”

আমি মলিন হেসে বললাম,,,

“ইট’স ওকে। একটু আগে কি হয়েছে এতক্ষনে আমি সব ভুলে গেছি৷ আর আমার তরফ থেকে ও আমি দুঃখিত। না বুঝেই আপনাকে অনেক ছোট বড় কথা বলে ফেলেছি। আপনাকে চিনলে হয়তো এতো বড় ভুলটা হতো না। যাই হোক, আমাকে মাফ করবেন।”

“আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন? দোষ তো আমার। আমি যদি প্রথমেই আপনাকে আমার পরিচয় দিয়ে দিতাম তাহলে নিশ্চয়ই এতো কিছু হতো না। অযথা কারো কাছে মাথা নিচু করবেন না। যখন জানবেন ফল্ট টা আপনার না, অন্য কারোর।”

এতটুকু সময়েই ছেলেটাকে খুব আপন লাগছে আমার। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। উনার কথার একেকটা ভাঁজে কোথাও না কোথাও আমার হেরে অতীতটা প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাকে অনেককিছু শিক্ষা দিচ্ছে। ছেলেটা আসলেই খুব ভালো মনের মানুষ, আর খুব মিশুক প্রকৃতির ও। উনার বুঝানোর শক্তি খুব প্রখর। আন্টি উনার ছেলেকে যতোটা বদরাগী হিসেবে বর্ণনা দিয়েছেন ছেলেটা অতোটা বদরাগী নয়। উল্টো ছেলেটা স্বচ্ছ, শান্ত আর সরল মনের মানুষ। গলাটা ঝেড়ে আমি উনাকে বললাম,,

“অনেক তো বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হলো। প্লিজ এবার ভিতরে আসুন।”

“না না। আমাকে এক্ষনি ফ্ল্যাটে যেতে হবে। ফ্রেশ হতে হবে। খুব টায়ার্ড।”

“আঙ্কেল, আন্টি আসে নি?”

“না। উনারা কুমিল্লায় আছেন। একজন রিলেটিভসয়ের বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে।”

কুমিল্লা নামটা শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠল। পরিবার, সংসার দুটোর কথাই মনে পড়ে গেলো। বিশেষ করে মা, বাবা আর ছোট বোনটার কথা। চোখে জল নিয়ে আমি সবার সামনে থেকে সরে এসে এক দৌঁড়ে রুমে চলে এলাম। এরপর ওখানে আর কি কি হলো জানি না।

বেডের এক কোনায় বসে আমি চোখের জল ছাড়ছি। দুই বছর পর আজ খুব ঘটা করে কাঁদছি। কান্না যেনো আমার কিছুতেই থামছে না। ফেলে আসা অতীকটাকে দারুনভাবে মিস করছি। হিমুকে মিস না করলে ও মা, বাবা, বোন আর শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীকে খুব মিস করছি। জানি না উনারা আমায় একইভাবে মিস করছেন কিনা বা আমার জন্য এভাবে চোখের জল ফেলছেন কিনা। তবে একবার মা, বাবার কন্ঠটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার। কিন্তু সাহসের অভাবে তাদের সাথে কথা বলা হচ্ছে না। আমি মন থেকে চাই না আমার অতীত আমাকে খুঁজুক। আমার মা, বাবা ও আমাকে কখনো খুঁজে পাক। এমন পাষাণ আর অলক্ষী মেয়ের উনাদের দরকার নেই। ছোট বোন লোপাকে নিয়েই উনারা খুশি থাকুক।

কিছুক্ষন পর লামিয়া আর নীলা এসে আমার দুপাশে বসল। দুজনই আমাকে টাইট করে ঝাপটে ধরল। লামিয়া শান্ত স্বরে আমাকে বলল,,,

“হয়েছ তো রূপা। আর কতো কাঁদবি? এবার একটু থাম না। পরিবারের কথা যেহেতু এতোই মনে পড়ে তাহলে উনাদের সাথে একটু কথা বলে নে না ফোনে।”

আমি হেচকি তুলে কেঁদে বললাম,,,

“মা-বাবা কখনো আমার সাথে কথা বলবেন না লামু। উনাদের অনেক অভিমান জমে আছে আমার উপর৷ এই অভিমানের মেঘ সরাতে হলে আমাকে কুমিল্লায় ফিরতে হবে। আমাকে সামনে পেলেই উনারা সব ভুলে যাবেন। কিন্তু আমি যে আর ঐ শহরটাতে ফিরে যেতে চাই না। ঐ শহরটা বড্ড পাষাণ।”

নীলা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,

“ফিরতে হবে না তোকে ঐ শহরে। তুই আমাদের কাছেই থাকবি৷ শুধু একটাই অনুরোধ৷ প্লিজ এভাবে কাঁদিস না। তোকে এই অবস্থায় দেখতে আমাদের ভালো লাগে না।”

ওদের দুজনকে ছেড়ে আমি চোখের জল গুলো মুছে নাক টেনে টেনে বললাম,,

“ঠিকাছে আমি আর কাঁদব না। সবসময় তোদের সাথে হাসি খুশি থাকব।”

লামিয়া মৃদ্যু হেসে আমার ডানটা চেঁপে ধরে বলল,,,

“রেডি হয়ে নে। আজ আমরা সারাদিন ঘুড়ব। বাইরে খাওয়া দাওয়া করব। একেবারে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরব।”

নীলা ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বলল,,,

“সমস্ত খরচ নিশ্চয়ই তুই দিবি?”

“হ্যাঁ আমিই দিবো। কারণ, বার্থডে তো আমার।”

আমি খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে লামিয়াকে বললাম,,,

“আচ্ছা অসব পড়ে হবে। আগে বল ছেলেটা কি চলে গেছে?”

“হুমম। উনো যাওয়ার পরই তো আমরা তোর কাছে এলাম।”

“দরজাটা যে ভেঙ্গে গেলো এখন কি হবে? আমরা বের হবো কিভাবে? তাও আবার বাড়ির মেইন দরজা। আমাদের এবসেন্সে যদি চুরি, ডাকাতি হয়?”

“ইসসস তা তো ভেবে দেখি নি। কি হবে এবার বল তো? ছেলেটা হয়তো এতক্ষনে উনার ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। উনাদের ফ্ল্যাটে তেমন যাই নি আমরা৷ তাছাড়া আঙ্কেল, আন্টি ও বাড়িতে নেই। হুট করে উনাদের ফ্ল্যাটে গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। হয়তো ছেলেটা অস্বস্তিতে ও পড়ে যাবে।”

“এক কাজ করি। বাড়ির গার্ড থেকে ছেলেটার নাম্বার নিয়ে ছেলেটাকে ফোন করে বলি কিছু একটা করতে। আজকের মধ্যেই দরজাটা ঠিক করতে হবে৷ এতো ইনসিকিউরিটির মধ্যে আমরা রাতে ঘুমুবো কিভাবে?”

নীলা বসা থেকে উঠে বলল,,,

“দাঁড়া৷ আমি বাড়ির গার্ড থেকে ছেলেটার ফোন নাম্বার নিয়ে আসছি।।”

এর মাঝেই সদর দরজার কাছে ছেলেটার গলার আওয়াজ শোনা গেলো। ছেলেটা চেঁচাচ্ছেন আর বলছেন,,,

“হ্যাঁলো। শুনছেন আপনারা?”

আমি, লামিয়া আর নীলা তাড়াহুড়ো করে সদর দরজার কাছে এলাম৷ ছেলেটা আমাদের দেখে মলিন হেসে বললেন,,,

“আপনাদের দরজাটা এক্ষনি ঠিক করে দেওয়া হবে৷ মিস্ত্রী একটু পরেই চলে আসবে।”

আমি মৃদ্যু হেসে উনাকে বললাম,,,

“আমরা এক্ষনি গার্ড থেকে আপনার ফোন নাম্বার নিয়ে আপনাকে কল করতাম। দেখুন কল করার আগেই আপনি চলে এলেন।”

ছেলেটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,,,

“হয়তো কোথাও মনের টান আছে।”

আমি অস্থির দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা একগালে হেসে বললেন,,,

“বাই দ্যা ওয়ে আমি মেহুল। আর আপনি?”

“রূপা।”

“হিমুর রূপা?”

#চলবে💖