তুমি আমি দুজনে পর্ব-৪৫+৪৬

0
470

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৪৫

ভার্সিটির ক্লাস শেষে বেরোলো তুরা, ফারিহা আর সাদমান বরাবরের মতো বিপরীত পথে গেলে তুরাও হাঁটা ধরলো, সামনে এগোতেই দেখলো মাহিদ গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে, তুরা এগিয়ে গেলে কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল

-বুড়ি গাড়িতে উঠে বস,তোকে রেখে আবারও বেরোতে হবে কাজ আছে আমার

তুরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে হাত বাড়ালেই পেছন থেকে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে দাঁড়ায়

-দাঁড়াও

ঘুরে দাঁড়িয়ে আহানকে দেখে ভ্রু কুচকালো। সে যতদূর যানে আহানের ছুটি পনেরো দিনের ছিলো। আজকে চৌদ্দতম দিন। আজ তো আহানের ভার্সিটিতে আসার কথা না, পরনে আসমানী রঙের একটা শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। কালো রঙের চশমায় গভীর চোখ জোড়া ঢাকা।
তুরার বিরতিহীন অপলক চেয়ে থাকা অবস্থায় আহান এগিয়ে এলো। তুরাকে পাশ কাটিয়ে মাহিদের সামনে দাঁড়ালে মাহিদ বেশ বিস্মিত হয়ে বলল

-আরে স্যার আপনি

আহান চোখের চশমা টা খুলে লেকচার দেওয়ার মতো বাচনভঙ্গিতে বলল

-ফার্স্ট অফ অল ভার্সিটির বাইরে কলিগ টাইপ সম্পর্ক বাদ। আর সেকেন্ডলি তুমি তুরার বড় ভাই, প্রায় আমারই সমবয়সী সেক্ষেত্রে আমাকে তুমি করে নাম ধরে ডাকলেই খুশি হবো

মাহিদ হাসলো বিস্তর। সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়ে আবারও বলল

-পনেরো দিন বাদে তো ফেরার কথা ছিলো তাই না?

-হ্যাঁ বাট রিসার্চ টা আগেই শেষ হয়ে গেছে তাই আর দেরি করলাম নাহ। কাল রাতেই ফিরেছি

বলে আবারও বলল

-তুরাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, মা আর দিদুন ওকে আজই ফিরিয়ে নিতে বলেছে। আশা করছি তোমাদের আপত্তি হবে নাহ?

-আরে না না, এটা তো ভালো কথা। তোমার বউকে তুমি নিয়ে যাও এই কয়দিনে আমাকে পাগল করে রেখেছে একটার পর একটা বাহানা করে।

রসিকতার ছলে বলল মাহিদ। তুরা ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল

-ইয়াজ ভাই! তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমাকে এভাবে বললে,আমি এক্ষুনি মামনীকে বলবো।

-ভাই এইটারে নিয়ে যাও প্লিজ,একটা টোকা না দিতেই ম্যা ম্যা করে সব বলে দেই

-ভাইয়ায়া!

বলেই এগিয়ে গিয়ে দুম করে দুটো কিল বসিয়ে দিলো মাহিদের পিঠে। আহান তুরার হাত ধরে সরিয়ে এনে বলল

-সব জাগায় দস্যু পানা শুরু করেছো,এটা যে ভার্সিটির এরিয়া সে খেয়াল আছে? মাঝ রাস্তায় টিচারকে আঘাত করছে স্টুডেন্টস এমন নিউজ ছাপবে

তুরা মুখ ভেংচে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিদ আহানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই আহান গলায় ঝুলানো চশমা টা চোখে পরে পকেট থেকে চাবি বের করতে করতে বলল

-ফটাফট গাড়িতে ওঠো

বলেই এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলেও তুরা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মুখ ফুলিয়ে। আহান ভেতর থেকেই চোখ গরম করে তাকালে থপ থপ করে হেঁটে এসে বসলো, ধুপ করে কাঁধের ব্যাগটা পেছনের সিটে রাখলো। আহান চশমার ফাঁকে আড়চোখে সবটা খেয়াল করলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
তুরা চুপচাপ বসে থেকে কিয়ৎক্ষণ পার হলে আড়চোখে তাকালো আহানের দিকে।
লোকটা দিনদিন আরও সুন্দর হচ্ছে যেনো, দেখে তো মনে হবে সবে ভার্সিটিতে পড়া কোনো ফার্স্ট/ সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তুরার চোখে আহানকে একটু বেশিরকমই সুন্দর লাগছে,ফারিহার ভাষায় ক্রাশ করার মতো। আকাশী রঙের শার্ট টার হাতা কনুই পর্যন্ত পরিপাটি করে ভাঁজ করে রাখা,বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা রাখায় শুভ্র বুকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিচের ঠোঁট দুটো কামড়ে রেখে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আহান, দৃষ্টি স্থির সামনের দিকে যেনো দুনিয়াতে সে গাড়ি আর রাস্তা ছাড়া কিছুই নেই!
তুরা অপলক চেয়ে থাকতেই মনে হলো এতো সুন্দর তার স্বামীটা, না জানি কতো মেয়েরা নজর দেয়, ভার্সিটির মেয়েরাই তো চোখ দিয়ে গিলে খায় আহানকে দেখলেই হা করে তাকিয়ে থাকে। হুট করেই খুব রাগ হলো তুরার,এখানে যখন মেয়েগুলো এভাবে তাকিয়ে থাকে তাহলে বিদেশে গিয়েও নিশ্চয় মেয়েরা তাকিয়ে ছিলো। আর বিদেশে মেয়েগুলো তো ছ্যাছড়া স্বভাবেরও হয়,কিসব ছোট ছোট জামাকাপড় পরে থাকে,পুরুষ মানুষের গায়ে ঢলে ঢলে পরে ন্যাকা করে। ভাবতেই রাগে মাথাটা দপদপ করে উঠলো তুরার, মেজাজ টা তুঙ্গে চড়ে গেলো। আহান ঘাড় কাত করে তুরার দিকে তাকিয়ে আবারও গাড়ি চালাতে চালাতে বলল

-কি সমস্যা, মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছো কেনো

তুরা কটমট চোখে তাকালো। রাশভারী গলায় বলল

-হ্যাঁ আমি তো পেঁচাই, বিদেশের ধলা চামড়া গুলোকে দেখে এসে আমাকে তো পেঁচাই লাগবে।

-হোয়াট ননসেন্স, কি যা তা বলছো

-যা তা নয় ঠিক ই বলছি। তাই তো দশদিনের জাগায় তেরো দিন থেকেছেন

আহান চোখ বাকিয়ে তুরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল

-তোমাকে কে বলল দশদিন থাকার কথা ছিলো, আন্দাজে পকপক করা বন্ধ করো

তুরার রাগ তিরতির করে বেড়ে গেলো। শুধু শুধুই এখন তার মেজাজ খারাপ আরও বেশি হচ্ছে। আহানের দিকে আঙুল উচিয়ে বলল

-একদম মিথ্যা বলবেন না,আপনি বলেছিলেন না দশ থেকে পনেরো দিন লাগতে পারে!

-তো আমি কি বলেছি দশদিনেই হয়ে যাবে, ওটার ডিউরেশন দশ থেকে পনেরো দিন ছিলো৷ এর মাঝে যেকোনো দিনেই শেষ হতে পারতো। না বুঝে যা নয় তা বলছো ষ্টুপিড!

গমগমে গলায় বলল আহান। তুরা খানিক থ মেরে তাকিয়ে থাকলো, তারপর বলল

-হ্যাঁ হ্যাঁ আমিতো ষ্টুপিড, গাধা আরও কতো কিছু। তাই তো আমাকে পছন্দ হয়না। হওয়া লাগবেও না। ওই পেত্নী গুলোকেই পছন্দ করুন গিয়ে

আহান বিরক্তিকর চোখে তাকালো। এই মেয়ের মাথার তার কি সবগুলোই গেছে?কিসব বলছে। এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে আরেক হাতে তুরার ফুলিয়ে রাখা মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ব্যস্ত স্বরে আহান বলল

-কি হয়েছে বলো তো, শুধু শুধু এমন ঝগড়া কেনো করছো

ঝামটা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো আহানের, ছলছল নয়নে বলল

-আমিতো শুধু শুধুই ঝগড়া করি। আমি তো ভালই না। তাই তো আমাকে কারো সহ্য হয়না,আমার কথা মনেও হয়না,ভালোও বাসেনা

বলতে বলতে চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পরলো, আহান হতভম্ব হয়ে গাড়ি ব্রেক কষে থামালো। যদিও বাড়ি এসে গেছে, কিন্তু সে থামিয়েছে তুরার কান্না দেখে, সিট বেল্ট খুলে দুহাতে তুরার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল

-কি হয়েছে তুরা,এমন কেনো করছো?

আবারও হাত ছাড়িয়ে নিলো তুরা, কাঁদো কাঁদো চোখেই বলল

-ঠিকই তো বলেছি। আমার যাই হোক শুনতে হবে না আপনার। যে আমাকে এ্যাটেনশন দেয়না,ভালোবাসে না তার কোনো লোক দেখানো দয়া মায়া লাগবে নাহ

বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। তুরার যাওয়ার পানে আহান নিষ্পলক তাকিয়ে ফোস করে শ্বাস ফেলল। এই মেয়ের হুটহাট কি হয় কে জানে, যা নয় তাই বলে দেয়,একবার ও ভাবে না আহানের কেমন লাগে। এই যে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো, ও কি একটুও
বুঝতে পারলো ওর চোখে পানি দেখে আহানের ঠিক কোন জাগায় আঘাত টা লাগে। চোখ টিপে বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো আহান,বিড়বিড় করে বলল

-তুমি কবে বুঝবে তুরা রাণী, আর কতো যন্ত্রণা দেবে!

••••

অপরাহ্নের শেষ সময়, দিনের এই আলসেমি ভরা সময়টাতে সকলের ভাতঘুম দেওয়ার কথা, নিস্তব্ধতায় পরিবেশ থমথমে থাকার কথা। কিন্তু তার বদলে বিরাজ করছে প্রাণোচ্ছল শোরগোল,গল্পগুজব। আশেপাশে নানন মানুষের হাস্যজ্বল চেহারা তাদের জমজমাট আসরে তুরা চুপচাপ অস্বস্তিকর চেহারায় বসে আছে। গরম না থাকা সত্ত্বেও গলা বয়ে ঘাম টপকে পরল এক ফোঁটা। সন্তপর্ণে হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো।
ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি কুণ্ঠা কাজ করলেও মেকি হাস্যজ্বল চেহারা করে রেখেছে।
তুরার অস্বস্তিকে আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে তার পাশে এসে বসলো বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রমহিলা, তুরা তাকিয়ে ধীমি গলায় সালাম দিলো, বৃদ্ধা জহুরি দৃষ্টিতে তুরার দিকে তাকালে রাইমা পাশ থেকে চশমা টা তার দিকে এগিয়ে ধরে বলল

-এটা তুরা,আহানের বউ। তুমি না ওকে দেখতে চেয়েছিলে দাদীজান

রাইমার পানে এক পলক তাকিয়ে চশমা টা চোখে পরলো। অবশেষে সালামের উত্তর পেলো তুরা, পৌঢ় কণ্ঠে শান্তভাবে উত্তর দিয়ে ভ্রু জড়ো করে খানিক তাকিয়ে থাকলো তুরার মুখের দিকে। কয়েকবার চোখে মুখে হাত বুলিয়ে ক্ষান্ত হলেন। ললাটের বলিরেখার ভাঁজ প্রসারিত করে বলল

-বাহ্ মাশাল্লাহ! একদম নায়িকার মতো বউ পাইছে তোমার ভাই রাইমা। একেবারে ফুলের মতো টুসটুসে!

মেকি হাসলো তুরা,রাইমার দাদী শাশুড়ীর কথায় লজ্জা পেলেও প্রকাশ করলো নাহ। মাথার ঘোমটা টা আরও সামনে টেনে নিলো। বসে থেকে থেকে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো তার,একে তো এতগুলো লোকজন থাকায় বিব্রত তুরা, তার উপর পরনে শাড়ি, না যানি কখন উস্টা খেয়ে পরবে। ঘরভর্তি মানুষ গুলোর সামনে মান ইজ্জতের দফারফা হবে! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সামনের দিকে, দিদুন আর মা তো গল্প করায় ব্যস্ত, এদিকে তুরার অবস্থা নাজেহাল।
আজ দুপুরের দিকেই এসেছে ধানমন্ডিতে। রাইমার শ্বশুরবাড়ি। এ বাড়ির লোকজন আর ইনসাফ মাহবুবের বাড়ির সকলকে দাওয়াত করে এনেছে। কারণ টা এমনি আত্মীয়তার খাতিরে হলেও এখানে এসে দারুণ একটা সুসংবাদ ও পেয়েছে। রাইমা সন্তানসম্ভবা, বাড়ির বড় বউমার এমন সুসংবাদে আনন্দিত হয়ে তাতে এ বাড়ির লোক গুলোকেও সামিল করতেই এতসব আয়োজন।
উনাদের অনুরোধ সকলকে অন্তত দুদিন এ বাড়িতে থাকতে হবে, রাইমার বিয়ের কতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো অথচ পরম আত্মীয়রা তাদের বাসায় একটা দিন ও থাকেনি বলে তারা ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করেছে। সহবত, সহমর্মিতার আর স্বজনপ্রীতির কারণে রুবি বা আমেনা খাতুন ও দ্বিরুক্তি না করে থাকার জন্যে রাজি হয়েছে। কিন্তু তুরা এই কয় ঘন্টাতেই যেরকম বিড়ম্বনায় পরেছে তাতে দুটো দিন কিভাবে থাকবে ভেবেই তো জান যাচ্ছে।

তুরার ভাবনার মাঝেই গাল টিপে ধরলো রাইমার দাদী শাশুড়ী, টুসকি মেরে বলল

-এতো কি ভাবছো ফুলটুসি। বরের কথা মনে পরে নাকি?

তুরা বিব্রত বোধ করলেও গাল টিপে ধরায় ভীষণ ব্যথা পেলো। মৃদু স্বরে আহ্ করে উঠলো। ধরা গলায় বলল

-ব্যাথা লাগছে দাদীজান

বৃদ্ধা যেনো তুরার কথা শুনে বেশ মজা পেলো। প্রেক্ষিতে তুরার আরও কাছে সরে এসে বলল

-এটুকু তেই লাগে কেনো। বর আদর সোহাগ করে না?

হিচকি উঠে গেলো তুরার এহেন লজ্জাজড়িত কথাবার্তা শুনে। এ ধরনের কথাটা তুরার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। তুরার হিচকি উঠা দেখে দাদী ব্যস্ত হয়ে রাইমাকে পানি দিতে বললে তুরা উঠে দাঁড়ালো, নাকচ করে বলল

-না না থাক, আমি একটু ঘরে যেতে চাই। মাথাটা ধরেছে

রাইমা তুরাকে ঘর দেখিয়ে দিলো। উপর তালার একেবারে কর্ণারের ঘরটাতে তার থাকার ব্যবস্থা করা আছে। তুরা ধন্যবাদ জানিয়ে অন্য সকলের সাথে টুকটাক কথা বলে উঠে আসলো।
ডুপ্লেক্স বাড়িটা বেশ সুন্দর। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলো তুরা, হুট করেই রাইমার ঘরটার সামনে আহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সামনেই একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, মেয়েটা ইমানের বোন অর্থাৎ ফারিনের ননদ। বয়সে তুরার চেয়ে একটু বড়। তবে সেটা বিষয় নয়। মেয়েটার সাথেই আহান দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা কম মেয়েটা হাসছে বেশি, হাসতে হাসতে একদম গায়ে হেলে পরবে যেনো। আহানের অধরেও ছড়ানো হাসি। এক ভ্রু উচিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো তুরা, এমনিতেই আহানের উপর ভীষণ রাগ, তার উপর বউয়ের রাগ না ভাঙিয়ে মেয়েটার সাথে নিকনিক করা হচ্ছে! গটগট করে হেঁটে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তুরা,সূক্ষ্ম গলায় বলল

-এখানে কি হচ্ছে?

মেয়েটা আবারও হাসলো। খুব সম্ভবত নিশি মেয়েটার নাম। হাসিমুখেই উত্তর দিলো

-আরে তুরা ভাবি যে,এইতো গল্প করছিলাম আমরা। আহান ভাইয়া ভীষণ মজার মানুষ উনার সাথে কথা বলে আমার ভীষণ ভালো লাগছে,তুমিও আসো না?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাল বাকিয়ে হাসলো তুরা। নিশির মতো করেই বলল

-থাক,তোমার মজার মানুষের সাথে তুমিই কথা বলো। তোমার ভালো লাগলেও আমার একদম ই লাগছে না।

বলেই ঘরের ভেতর চলে গেলো। নিশি মেয়েটা তুরার কথার মানে না বুঝে হা করে তাকিয়ে রইলো। আহান ঠোঁট টিপে হাসলো শুধু।
ঘরে ঢুকেই হাতের ফোনটা ছুড়ে মারলো বিছানাতে, মাজায় হাত রেখে পায়চারি করতে করতে বলল ‘হুহ,ভীষণ মজার মানুষ,ভীষণ ভালো লেগেছে’ মানুষ না বনমানুষ। যে বউ রেখে অন্য মেয়েদের সাথে নিকনিক করে তাদের বনমানুষ ই বলে। পায়চারি করার মাঝেই দেখলো আহানকে ঘরের ভেতর ঢুকতে, রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল

-আপনি এই ঘরে কেনো এসেছেন৷ আপু আমাকে এই ঘরে থাকতে বলেছে। আপনি চলে যান। গিয়ে ওই নিশির সাথে নিকনিক করুন গিয়ে

বলে গজরাতে গজরাতে বিছানায় দুই পা তুলে বসলো। গায়ের শাড়ির এলোমেলো অবস্থা এক হাতে কোনো রকম আঁচল ঠিক করে মুখ ফুলিয়ে আরেক দিকে তাকিয়ে রইলো।
আহান হাসলো মৃদু এগিয়ে গিয়ে তুরার পাশে বসে ওর কোমরে হাত জড়িয়ে ধরলো,কানের কাছে মুখ এনে বলল

-তোমার সবকিছুই তো আমার তুরা রাণী। শুধু তোমার থাকার ঘর কেনো তুমি,তোমার ঠোঁট,গাল,গলা, বুক,পেট সব আমার।

বলে কথার সাথেই খামচে ধরলো আলতো স্পর্শে তুরার নরম পেটের চামড়া। চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিলো তুরা, হাতটা আহানের হাতের উপর রেখে খামচে ধরলো, জমে গেছে সারা শরীর, না চাইতেও হেসে ফেলল সামান্য। নাসারন্ধ্র টেনে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। আহান তুরাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে ওয়াশরুমে চলে যেতেই উঠে দাঁড়ালো তুরা, ঘাট হয়েছে ঘরে এসে। এর চেয়ে দাদীর ওসব টুসকি মারা কথাও ভালো ছিলো।

~

সন্ধ্যা পার হয়েছে, সময় প্রায় সাড়ে সাতটা। তুরা বসার ঘরে বসে সকলের সাথে। এর মাঝে হুট করেই আহান সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। রুবি খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল

-মা, আমাকে এখনই ফিরতে হবে।

ইমানের মা আজমেরি চৌধুরী চায়ের ট্রে রাখতে রাখতে বলল

-সেকি আহান, তোমরা না সকলে দুদিন থাকবে

-আজ সম্ভব নয় আন্টি, মা দিদুন থাকুক। আমাকে ফিরতে হবে। ভার্সিটির অথোরিটি থেকে ইমেইল এসেছে ইম্পর্ট্যান্ট কাজের,ওটা আমাকে শেষ করতে হবে। ল্যাপটপ টা বাড়িতেই রেখে এসেছি।

আহানের কথার দ্বিরুক্তি আর করলো নাহ কেও। কারণ আহানকে যে এখন আর রাখতে পারবে না সেটা সবাই জানে। সকলের সাথে কথা বলে আহান উপরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হলে তুরাকে উদ্দেশ্য করে বলল

-উপরে এসো তুরা

বলেই চলে গেলো। তুরা এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে,ওর থ মেরে বসে থাকার মাঝেই ইমানের দাদী আবারও বলল

-আহান তো দেখি বউ ছাড়া থাকতেই পারেনা, যাও গো ফুলটুসি। তোমার বর তোমাকে রেখে যাবে না

লজ্জায় কান গরম হয়ে এলো তুরার,সমস্ত রাগটা গিয়ে পরলো আহানের উপর। কি দরকার ছিলো এভাবে সবার সামনে ডাকার। ইদানীং লোকটা মাত্রাতিরিক্ত অসভ্য হয়ে গেছে। সব খানেই তুরা তুরা করা লাগে। কোনো রকমে রুবিকে বলেই উঠে এলো তুরা। ঘরে এসে দেখল আহান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে।

-আপনি আমাকে ওভাবে সবার সামনে ডাকলেন কেনো?

-রেডি হও, এক্ষুনি বেরোবো।

হাতা গোছাতে গোছাতে বলল আহান। তুরা ফট করে বলল

-আমি কেনো রেডি হবো,আপনার কাজ আছে আপনি যান। আমি মা আর দিদুনের সাথেই যাবো

-তোমার সবকিছু যেমন আমার,আমার সবকিছু ও তোমার, তাই আমি যেখানে তুমিও সেখানে।

বলেই ফোন আর মানিব্যাগ পকেটে ভরে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে আঙুল চালিয়ে ব্রাশ করে তুরার হাত ধরে হাঁটা ধরলো

-আরে কি করছেন,ছাড়ুন। আমাকে রেডি তো হতে দিন।

-লাগবে নাহ।

বলে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। তুরা মুখটা কাচুমাচু করে আহানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জা লাগছে এখন। কোন কুক্ষনে যে এই নির্লজ্জ উগান্ডা টাকে বিয়ে করতে গেছিলো সেইটা ভেবেই এখন নিজের মাথা নিজের ফা’টাতে মন চাচ্ছে। কিন্তু তাতে আহানের কি। সে স্বাভাবিক ভাবেই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে আবারও তুরার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। কাওকে কিছু বলতে অবদি পারলো না তুরা।নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা কর‍তে করতে বলল

-আপনার মতো ব’জ্জাত হনুমান আমি দুটো দেখিনি। ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন বলছি। এরকম নির্লজ্জ লোকের সাথে এক ছাদের নিচে আমি কিছুতেই থাকবো নাহ।

তবুও আহানের হাত এক চুল আলগা হলো নাহ। গাড়ির দরজা খুলে তুরাকে বসিয়ে নিজেও এসে বসলো। চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিতে লাগলে তুরা আগুনের মতো ঝলসে উঠে বলল

-কি করছেন টা কি আপনি,পাগল হয়েছেন?

আহান ঘাড় কাত করে তাকালো। গভীর চোখ দু’টো তুরার দিকে স্থির রেখেই স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলল

-এ্যাটেনশন চাইছিলে নাহ? ওটাই দিচ্ছি
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️

#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব – ৪৬

মুখ ভেটকিয়ে গাড়ির মধ্যে বসে আছে তুরা, খানিক বাদে বাদে আহানের দিকে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকাচ্ছে। বাসায় ফেরার নূন্যতম ইচ্ছে ছিলো নাহ,তাও আবার এই উগান্ডার সাথে, তুরা তো রেগে আছে। এই লোকটার থেকে দূরে দূরে থাকতে চেয়েছিলো। এখন দূরে থাকা তো দূর এই কুম্ভকর্ণটার সাথেই থাকতে হবে। বাড়িতেও তো কেও নেই, অন্যঘরে গিয়ে যে থাকবে তুরার তো আবার ভুতের ভয়! উফ কি একটা জ্বালা…
কিন্তু আহান সম্পূর্ণ মনোযোগী গাড়ি চালানোতে,তুরা হাজার বার বলা সত্ত্বেও নিয়ে এসেছে নিজের সাথে,সে তার কথায় অনড়। তুরার মেজাজ তুঙ্গে চড়ে আছে,এই লোকটাকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত। ভালোবাসার বেলায় নেই তাহলে এমন হম্বিতম্বি করা লাগে কেনো সবসময়।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা প্রায়,তুরার মেজাজ তখনও আকাশচুম্বী। গাড়ি থেকে নেমে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেলো। আহান গ্যারাজে গাড়িটা রেখে বাড়ির দরজার সামনে আসলেই দেখলো তুরা মুখ লটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরে হাসলো আহান,পকেট থেকে চাবি বের করে তালা টা খুলে দিতেই তুরা আবারও হাঁটা ধরলো।
কেমন ভ্যাপসা গরম পরেছে, আবহাওয়া টাও থমথমে গাছ গুলো স্থির সটান দাঁড়িয়ে, পাতাগুলোর কোনো নড়চড় নেই। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো তুরা। ধীরে সুস্থে খানিক বসে থেকে উঠে গেলো সিড়ি বেয়ে। রাইমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই থ মেরে গেলো। একি ঘরটাতে তালা দেওয়া কেনো? গরমে ঘেমে সারা শরীর জবজবে হয়ে আছে, ভেবেছিলো লম্বা একটা শাওয়ার নিবে।মেজাজ টা আরও চড়াও হয়ে গেলো, রাগান্বিত হয়ে বড় বড় পা ফেলে আহানের ঘরে গেলো।
বিছানার উপর গায়ের শার্ট টা খুলে রাখা ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তুরা এগিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় ধুপধাপ ধাক্কাতে লাগলো

-হোয়াট রাবিশ,,দরজা ভেঙে ফেলবে নাকি ষ্টুপিড?

আহান চেঁচিয়ে বলল। তুরা মাজায় হাত দিয়ে কটমট করে বলল

-রাইমা আপুর ঘরে তালা লাগানো কেনো, যাওয়ার সময় ও তো ছিলো না এখন তালা লাগলো কিভাবে

-তো সেটা আমি কি করে বলবো,এখান থেকে সরো আমাকে গোসল করতে দাও

তুরা কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। আবারও ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি করে বলল

-আমাকে চাবি দিন,আমি ও ঘরেই থাকবো

কিন্তু ভেতর থেকে কোনো প্রত্যুত্তর এলো না,তুরা আহানের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে ভ্রু কুচকালো। ‘কি ব্যাপার,লোকটা লোকটার কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেনো? ফিট লেগে গেলো নাকি?’ কিছুক্ষণ ধরে কান পেতে থেকেও কোনো শব্দ শুনতে পেলো নাহ দেখে আবারও দরজায় কি’ল ঘু’ষি বসিয়ে বলল

-আপনি কথা বলছেন না কেনো? কি হয়েছে, পরে টরে গেলেন নাকি? তাহলে কিন্তু আমার কাছে সাহায্য চাইবেন নাহ,আপনার মতো সত্তর কেজিকে আমি তুলতে পারবো না বলে দিলাম। কি হলো কথা বলছেন না কেনো আজব,অকালে আমাকে বিধবা বানানোর ইচ্ছে আছে নাকি..

বাকিটা বলার আগেই ধড়াম করে দরজা টা খুলে গেলো। তুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে এক টানে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো আহান, সাবানের পানিতে পিছলে পরতে নিলে এক হাতে কোমর ঝাপটে ধরে আহান নিজের ভেজা গায়ের সাথে চেপে ধরলো তুরাকে।
আকস্মিক ঘটনায় তুরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থানটা উপলব্ধি করে ধাতস্থ হতে মিনিট খানেক লেগে গেলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হলো আহানকে এই অবস্থায় দেখে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল

-ইয়া খোদা,ছি ছি। এমন বেহায়া পুরুষ আমি জীবনে দুটো দেখিনি, এভাবে উদাম হয়ে আমার সামনে এসেছেন কেনো। ছাড়ুন আমাকে ভিজে যাচ্ছি আমি

বাহুডোর আলগা হওয়ার বদলে আরও দৃঢ় হলো। শক্তপোক্ত হাতের বন্ধন তুরাকে ধরেই এক পা এক পা করে এগিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করালো।
এক হাতে কোমর ঝাপটে অন্যহাতে শাওয়ার টা অন করে দিতেই ঝুমঝুমিয়ে পানির প্রবাহে ভিজে গেলো তুরার সারা শরীর নিমিষেই,,ধাক্কা দিয়ে সরে আসতে নিলে আহান দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো তুরাকে। পানির বিন্দুকণা মাথার চুল থেকে টপকে মুখে এবং অধর ছুঁয়ে গড়িয়ে পরছে। অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো আহান তুরার কম্পমান অধর যুগলের দিকে,ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে ঘষে দিলো তুরার নরম পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট দুটো। বিদ্যুতের ঝলকানির মতো কেঁপে উঠলো তুরা,এতক্ষণের ভ্যাপসা গরম কর্পুড়ের মতো উবে গেছে, তার বদলে একরাশ হীম শীতল হাওয়া স্থান করে নিয়েছে, যা আহানের স্পর্শকে সঙ্গ দিয়ে ঝক্কি দিয়ে কাঁপিয়ে তুলছে তুরার সারা শরীর।
এক হাত তুলে আহানের বুকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিতে গেলো তুরা, বিনিময়ে আহান ওর ওই হাতটাও চেপে ধরলো, এখন তুরা অসহায়। দু’হাত দুটো বলিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ। এক চুল নড়ার শক্তিরাও অপারগ।
কোনো রকম কণ্ঠনালী ঠেলে এলোমেলো শব্দগুচ্ছে বলল

-সরে যান প্লিজ

-আমার এতটুকু স্পর্শ সামলাতে পারো নাহ, অথচ আমাকেই বিরক্ত করতে আসো

তুরা এদিক ওদিক অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আমতা-আমতা করে বলল

-আমি রাইমা আপুর ঘরে যাবো।

-একদম নাহ, একচুল অবাধ্য হলে আমি কিন্তু সীমালঙ্ঘন করে ফেলবো

বলেই টাওয়াল টা হাতে নিয়ে চুল মুছতে মুছতে ভেজা গায়েই বেরিয়ে গেলো আহান। আহান বেরতেই ধপ করে দরজা টা লাগিয়ে দিলো তুরা। বুকের বা পাশে হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো।
কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। আহানের প্রতিটি স্পর্শ আগুন জ্বা’লিয়ে দেয় তুরার সমস্ত বদনে। ওমন দৃঢ় পুরুষালি স্পর্শের প্রখরতা একদম সইতে পারেনা তুরা একেবারেই নাহ।
আরও কিছুক্ষণ পানিতে ভিজে শাওয়ার টা অফ করলো। কিন্তু বিপত্তি তো এখানে ঘটলো!
পরনের শাড়ি তো পুরোপুরি ভিজে গেছে৷ আর আসার সময় জামাকাপড় ও তো আনেনি। এখন সে পরবে কি? এ অবস্থায় বাইরেও তো যাওয়া যাবে না! দ্বিধাদ্বন্দ্বিত হতে কিছুক্ষণ থ দাঁড়িয়ে থেকে চোখ গেলো পাশেই হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখা আহানের কালো রঙের শার্টটার দিকে।
সকালে তো আহান ভার্সিটি থেকে সোজা এখানে এনেছে, জামা কাপড় গুলো তো মামনীর বাড়িতেই রয়েছে এখনো, আর বাকি কিছু যা জামা ছিলো তাও রাইমার ঘরে এখন সে কি পরবে? সারা দিন দুনিয়া ভেবেও তুরা কোনো সমাধান না পেলে শেষ রক্ষা হিসেবে আহানের কালো রঙের শার্ট টাই পরে নিলো উপয়ান্তর হীন হয়ে।
পঁচিশ মিনিট পর তুরা বের হলো। দরজা টা খুলে ঘাড় বের করে দেখলো আহান ঘরে নেই, এই সুযোগে বেরিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। শার্টটা যে এতো ঢিলা হবে সে আগে বুঝেনি,
কাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে গলাটা, দৈর্ঘ্যেও হাটুর উপর পর্যন্ত। ‘ইস লোকটা মানুষ নাকি তালগাছ’ একা একাই বিড়বিড়ালো তুরা। এখন তার কোনো উপায়ও নেই। একেই বলে কপাল যখন খারাপ হয়,সব দিক দিয়েই হয়। কই ভেবেছিলো আহানকে এড়িয়ে চলবে,ওর থেকে দূরে থাকবে। তা না এখন ওর সাথে ওর ঘরে ওর ই জামাকাপড় পরে থাকতে হচ্ছে।
দু’হাতে পরনের শার্ট টা আঁকড়ে ধরলো। ধপ করে বিছানায় উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে আহান ঘরে ঢুকলো তুরা তখন স্থির খাটে বসে, আহানকে ঢুকতে দেখেই হুড়মুড়িয়ে কাথাটা টেনে ধরলো গায়ে। তুরাকে ভীষণ অপ্রস্তুত চেহারাতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো, তুরা বারবার এক হাত দিয়ে শার্টের গলা টা টেনে তুলছে। আহান তুরার লজ্জা অস্থিরতা আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো বুকে হাত গুঁজে। তুরা আবারও চাদর টেনে তাকালো আহানের দিকে,মিনমিনিয়ে বলল

-ওই ঘরের দরজা টা খুলে দিন না

-নেভার এভার

মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দিলো আহান৷ এখনো ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে। অবাধ্য চোখের বিচরণ তুরার সারা শরীরে। তুরা আরও জড়সড় হয়ে বসলো। আহান বুক থেকে হাত নামিয়ে দরজার দিকে গেলো, তুরার চোখে মুখে খুশিক ঝিলিক দেখা গেলো,নিশ্চয় রাইমার ঘর খুলে দেবে?
কিন্তু তুরার সমস্ত চিন্তা ভাবনায় জল ঢেলে আহান দরজা লাগিয়ে এসে বসলো তুরার পাশে। বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ফোন হাতে নিলো। তুরা গুটিসুটি মেরে বসে আছে আহানের দিকে না তাকিয়েই,খানিক বাদে আড়চোখে আহানের ফোনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো কয়েকজনের হাস্যজ্বল চেহারার ছবি। আহান সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে দিয়ে আবারও কিছু একটা টাইপিং করতে ব্যস্ত হলেই তুরা খপ করে আহানের হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দেখতে গেলো কিন্তু হাতের চাপে ফোনটা আবারও লক হয়ে গেছে,
আহান বিস্মিত হয়ে কপাল কুচকে তুরার দিকে তাকালেই দেখলো ও ফুসতে ফুসতে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে,তুরার এহেন অভিব্যক্তি দেখে আহান ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো

-কি হলো ফোনটা ছিনিয়ে নিলে কেনো?

-ওটা কিসের ছবি ছিলো হ্যাঁ?কি মনে করেন আমি কিচ্ছু দেখিনি? আমি স্পষ্ট দেখেছি আপনি দুটো ধিঙ্গি মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলেছেন,আমি দেখতে গেলেই সরিয়ে দিলেন

আহান ললাটে ভাঁজ ফেলে তুরার দিকে তাকালো। ফোনে ইমেইল গুলো চেক করছিলো। হুট করে টাচ লেগে গ্যালারি অন হলেই ওদের ফ্রেন্ডস দের একটা গ্রুপ ফটো সামনে এসেছিলো। সেটা সরিয়েই আবারও ইমেইল গুলোর রিপ্লাই দিচ্ছিলো আহান। এতে এতো ক্ষেপে গেলো কেনো।

-তুরা তুমি ভুল বুঝছো? ব্যাপার টা তেমন না

-তেমন না তো কি হ্যাঁ, আপনি কেনো মেয়েদের সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন,ঘরে বউ রেখে আপনি এসবই করে বেড়ান তাই তো? তাই তো আমাকে ভালোবাসেন না,এ্যটেনশন ও দেন না। আপনি সত্যিই একটা চরিত্র হীন,অসভ্য,বেহায়া লোক

তুরা হটকারিতায় চাদর সরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আহানের সামনে। আহান তুরার পুরো কথাটা নিঃশব্দে শুনে ওর হাত থেকে এক টানে ফোন কেড়ে নিলো। ফোনটা আনলক করে ছবিটা বের করে ধরলো তুরার সামনে। তুরা ছবিটার কিছুক্ষণ তাকিয়ে হুট করে চুপসে গেলো।
ছবিটা নিউইয়র্কের সেই ভার্সিটি থেকে তোলা,সকলের পরনে একই রকম এপ্রোন টাইপ পোশাক। আর মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা আহান নয়,ভুল দেখেছিলো সে।
ছবিটার থেকে চোখ তুলে আহানের দিকে তাকালো তুরা,
তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম চোখের তেজী চাহনিতে তাকিয়ে আছে আহান। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অত্যাধিক রুষ্ঠ তুরার এহেন আচারণে।
তুরা এবার নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে মিইয়ে গেলো। কিন্তু আহানের রাশভারি চাহনি অবস্থানান্তরিত হয়ে কেমন একটা স্থির, নিষ্পলক ঘোর লাগা মতো লাগছে।
ভ্রুকুটি করে তুরা আহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালে থ হয়ে গেলো, সমস্ত বদন শরমে রক্তাভ হয়ে গেলো। মুহুর্তেই লালের প্রলেপ পরলো ফর্সা গালে। চাদর টা হুড়মুড়িয়ে টেনে গায়ে জড়ালো।
রেগে গিয়ে ওঠে ঝগড়া করতে গিয়ে কখন গলা বেয়ে শার্টের হাতা টা নেমে গেছে খেয়ালই করেনি। আহান ফোনটা সাইডে রেখে একটানে কাঁথা টা সরিয়ে দিলো কোমরে হাত চেপে টান দিয়ে তুরাকে কোলের উপর বসালো, তুরা চিকচিক গলা চোখে মুখে আহানের দিকে তাকিয়ে আবারও ঘাড় নামিয়ে নিলে আহান বলল

-কি হয়েছে তোমার, এমন কেনো করছো?

শান্ত নির্মল কন্ঠস্বর আহানের। তুরার হৃদপিণ্ডটা থেকে থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না আমতাআমতা করে কিছু বলবে তার আগেই আহান ভরাট উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল

-তুরা? আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরি?

নিরুত্তর হতবাক তুরা,আহান তুরার জবাবের অপেক্ষা না করেই দুহাতের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে নিলো, মুখটা এগিয়ে নিলো তুরার গালের দিকে।
খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শ ছুঁয়ে গেলো তুরার নরম পেলব গাল দুটোই, তাৎক্ষণিক তুরার চিকন আঙুল গুলো খামচে ধরলো আহানের পরনের টি-শার্ট।, আহান মৃদু হাসলো। কোমরের বাধন কঠিন হতে কঠিনতর করে মিশিয়ে নিলো চিকন দেহখানি। তুরার কাঁধ বেয়ে নেমে পরা শার্টের ফাঁকে মুখ ডুবালো। ঝক্কি দিয়ে কাঁপিয়ে তুললো তুরার সারা কায়া! অত্যাধিক মাত্রার কম্পনে মৃদু আওয়াজ করলো। মুখ তুলে তাকায় আহান, নেত্রে ভাসে রক্তাভ চেহারা,নীমিলিত আঁখিপল্লব। কোমর থেকে মন্থর গতিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে দিলো তুরার চিকন,সরু, নরম ওষ্ঠাধর।
তুরা সামলে উঠতে পারেনা, কি ভয়ংকর অনুভূতি!কতখানি গভীর, নির্মল। অন্তঃস্থলে ঝড় উঠেছে, প্রবল ঝড়ে চুরমার হচ্ছে সকল সংযম আত্মগড়িমা। হেসে উঠলো আহান,পুরু অধর ছড়িয়ে বলল

-কিসের ভালোবাসা চাও বলোতো? কোন অধিকারে তোমার মাঝে বারংবার বিলীন হয়ে যায় বোঝো না? অহর্নিশি তোমার নামের বাধ ভাঙা অনুভূতির প্রবলতা জোয়ারের স্রোতধ্বনি শুনতে পাওনা? তোমায় ঘিরে মাতাল করা ওঠাপড়া আবেগ,মায়া,তৎপরতা আমাকে বেহায়া অসভ্য উপাধি দেয় কেনো বোঝো না? কেনো বোঝো না নিঃসাড়কালের মতো তোমার নামের অনুভূতি আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে, আর কতভাবে বোঝাবো বলো তো,,

কথার মাঝে কিঞ্চিৎ তফাত টা হয়তো সইতে পারলো না আহান,তুরার হাতটা নিয়ে বুকের বা পাশে চেপে ধরলো, আবারও বলল

-এইখানটার ছন্দময় ক্রীয়াটা কার নামে এলোপাথাড়ি তোলপাড় তুলেছে বোঝো না?কেনো বুঝছো না তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও এইখানটাতে শান্তি মিলছে না,তুমি ছাড়া বেখাপ্পা, বেপরোয়া, অস্তিত্বহীন লাগে! এমন প্রেমে মাতাল করে কোথায় পালাতে চাও

তুরা থমকে গেলো,স্তব্ধ হলো। অনিয়ন্ত্রিত হলো হৃদস্পন্দন। আহানের বুকে উপস্থিত হাতটা বারবার কেঁপে উঠছে। হৃদয়জুড়ে কেমন খুশির জোয়ার বয়ে গেলো।
এটাই তো,এটাই তো শুনতে মরিয়া হয়েছিলো! আহানের মুখ থেকে ভালোবাসার দুটো কথা শোনার জন্যেই তো এতটা অস্থির হয়ে উঠেছিলো, লজ্জায় জবাব দিলো না তুরা। আহান আবারও ওর মুখটা এনে তুরার গলা ছুঁইয়ে দেয় অতীব নেশাক্ত প্রগাঢ় গলায় বলে

-তোমার সমস্ত অনুভূতি, প্রগাঢ়তা, ভালোবাসা স্পর্শ সবটুকু আমি চাই,তোমার মাঝে তুমি আমি দুজনে বিলীন হতে চাই, দেবে সেই অনুমতি? এক জীবনের জন্য আমার হবে তুরা?

কি নিঃসংকোচ মায়াময় আবেদন!এতো হৃদয় নিংড়ানো কেনো লাগছে কথাগুলো, কি করে জবাব দেবে তুরা? আহান প্রচন্ড গাঢ় স্পর্শে হাত গলিয়ে দিলো তুরার শার্টের ভেতর। বুকের মাঝখানটায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। পরপর তিনবার ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলল

-এতটা লজ্জা পেওনা লজ্জাবতী, মুখে বলতে না পারলে অন্যভাবে বুঝিয়ে দাও তোমারও সম্মতি,,অপেক্ষার প্রহর আর বাড়িও নাহ,এ যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে নাহ!

এই ঘোর ধরানো নেশাক্ত কণ্ঠস্বর আর শুনতে চাইনা তুরা। অধরযুগলের কম্পন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়, পায়ের তালুতে প্রচন্ড জ্বলন অনুভূত হচ্ছে। অসাড় হয়ে আসা তপ্ত হাতটার কম্পমান স্পর্শ রাখলো আহানের ঘাড়ের পেছনে। রক্তিম গালটা এগিয়ে নিয়ে উষ্ণ তপ্ত অধরযুগল ছোঁয়ালো আহানের গলার অ্যাডাম আপেল ঠিক উপরে,তার স্থায়িত্ব হলো কয়েক সেকেন্ড। সরে এলো তড়িৎ গতিতে।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেলো শিহরণ আর পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে প্রিয় মানুষটার হাতের বিচরণ। নিস্তব্ধতায় প্রেয়সীর ছোট্ট সাড়াতেই আহান খুঁজে পেলো সম্মতি।
এক ঝটকায় আহান তুরাকে শুইয়ে দিয়ে ওর উপরে উঠলো। এক হাত বাড়িয়ে লাইটটা বন্ধ করে তাকালো তুরার দিকে,অন্ধকারেই দেখে নিলো লালাভ প্রেলেপে রক্তিম প্রেয়সীর লজ্জায় কাবু হওয়া মুখ খানা। মুচকি হেসে তুরার শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিলো গলায় কাঁধে থুতনিতে বিরতিহীন ছোট ছোট অসংখ্য উষ্ণ চুম্বনে অস্থির করে তুললো তুরাকে। এক হাতে পিঠ আরেক হাতে আহানের চুল খামচে ধরলো তুরা, শুষ্ক গলায় অস্ফুটস্বরে বলল

-আ আহানন..

আহানের অবাধ্য স্পর্শের বিচরণ ছড়িয়ে পরলো তুরার সর্বাঙ্গে, প্রগাঢ় প্রচন্ড গভীর পুরুষালি স্পর্শ পেয়ে বেসামাল হয়ে গেলো সমস্ত কায়া,বদন! শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজে ভাঁজে খেলে গেলো আহানের উষ্ণ আদরমিশ্রিত স্পর্শ।
মা-দকতায় সিক্ত অনুভূতির জোয়ারে মিশে একাকার হয়ে গেলো দুটো মানব-মানবী। বাইরের দমকা হাওয়া থেকে সৃষ্ট তুমুল ঝড়, বর্ষনের চেয়েও বেশি তান্ডব তুললো বদ্ধ ঘরে ভালোবাসার উন্মাদনার তাড়নায় মত্ত হওয়া দুজনের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস!
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ

#Humu_♥️