তুমি বললে আজ পর্ব-১০+১১

0
404

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১০.

.
ব/জ্জা/ত লোক একটা। আমি নাকি বেয়াদব, সারাদিন নাকি নেচে নেচে বেড়ায়, পেঙ্গুইনের মতো লাফালাফি করি? আর নিজে…. নিজে কি? হুট করে ভুতের মতো সামনে চলে আসলে, ঠাস করে ধাক্কা তো খাবোই? তবে কোলে ওঠার কথাটা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলাম। ইস্! বলে কি, কোলে ওঠার জন্য নাকি হাত পা ভাঙার প্ল্যান করছি? ইচ্ছে করেও তো একটু কোলে নিতে পারে? হু! হাত পা ভাঙ্গার কি দরকার? মনের কথাটা কখন মুখ ফুটে বেরিয়েও গেল বুঝতেও পারলাম না।

“আপনার কোলে ওঠার জন্য হাত পা ভাঙ্গতে হবে কেন শুনি? একটু আদর করে কোলে নিয়ে ঘুরলেও তো পারেন। আমি কিন্তু কিছু মনে করবো না।”

কথাটা শেষ হতেই সাথে সাথে দু’হাতে নিজের মুখ চে*পে ধরলাম। ইস্! কি বলে ফেললাম এটা আমি? এখন এঔ ব/জ্জা/ত লোকের ধমক থেকে কে বাঁচাবে আমাকে? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ধমক দিলেন না তাসফি ভাই। বরং শান্ত সুরে বলে উঠলেন,
“ওওও আচ্ছা… কোলে উঠবি, আদর খাবি? তাহলে দাঁড়িয়ে আসিস কেন? আয়….”

ওনার কথাতে যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। আমাকে যে কোলে তুলে আছাড় দিবেন, সেটা সহসায় বুঝে গেলাম। তাসফি ভাই কোলে তোলার জন্য একটু ঝুঁকে আসতেই দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিলাম, মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে অকপটে বলে উঠলাম,
“না…. না, আমি তো এমনি এমনি বললাম। আপনি আবার সত্যি সত্যি মনে করলেন নাকি? আমার কি কোলে ওঠার বয়স আছে নাকি? হা হা!”

বলেই দাঁত কেলিয়ে হেঁসে উঠলাম। কিন্তু কাজ হলো না তাতে, তাসফি ভাই আবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলেন,
“আরে রুপু ভয় পাচ্ছিস কেন তুই? কিছু তো করবো না, শুধু কোলে নিয়ে আদর করে টপাটপ কয়েকটা চুমু খাবো। আর কিচ্ছু করবো না, প্রমিজ!”

খুকখুক করে কেশে উঠলাম আমি, কি বলে এই ব/জ্জা/ত লোকটা? কোলে নিয়ে চুমু খাবেন মানে? আমি কি সরকারি যে, টপাটপ চুমু খাবে? বাচ্চাদের মতো আদর করবে?

“দেখেন তাসফি ভাইয়া, আমি কিন্তু বাচ্চা নয় যে কোলে নিয়ে চুমু খাবেন, যথেষ্ট বড় হয়েছি। বড় হলে তো সবাই বরের কোলে ওঠে, বরের চুমু খায়। তাহলে আপনি কেন আমাকে চুমু খানের?”

ওনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করতেই উনি কপাল কুঁচকে ফেললেন। বললেন,
“মামাতো বউ বানিয়ে চুমু খাবো, হবে?”

“না…. হবে না। সত্যি সত্যি বউ বানালে তবেই চুমুু খেতে পারবেন, মামাতো বউ বানালে নয়।”

তাসফি ভাইয়া একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“আচ্ছা, তুই আমার কি হোস?”

“কেন? মামাতো বোন।”

“তোকে যদি বিয়ে করি তাহলে কি হবি? আমার বউ, তাই তো?”

মাথা ঝাঁকালাম আমি। হ্যাঁ, আমাকে বিয়ে করলে তো বউ-ই হবো। আবারও বললেন,
“মামাতো বোন কে বিয়ে করে বউ বানালে কি হবে? মামাতো বউ! তাই তো?”

আমি আবারও মাথা ঝাঁকালাম। আমার জবাবে হেঁসে উঠলেন তাসফি ভাই। বলে উঠলেন,
“তাহলে তুই আমার সত্যি সত্যি কি হলি?”

“সত্যি সত্যি মামাতো বউ?”

“তাহলে মামাতো বউ বানিয়ে চুমু খেলে হবে না কেন?”

আবারও মাথা ঝাঁকালাম আমি, তার মানে হবে তো। উনি ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ করে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলেন,
“তাহলে এখন তোকে কোলে নিয়ে চুমু খাবো, এদিকে আয়।”

আবারও ওনার চুমু খাওয়ার কথা শুনতেই চমকে উঠলাম। কত্ত বড় ব/জ্জা/ত মানুষ, ঘুরেফিরে একই কথা বলে। আমি আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
“লা..লাগবে না। আ…আমি বরং ফুপির সাথে দেখা করে আসি।”

বলেই ওনাকে পাশ কে*টে চলে আসতে নিলাম, তখনই তাসফি ভাইয়া বলে উঠলেন,
“মাথামোটা গাধী কোথাকার।”

ওনার কথাটা শুনে একটি জোরেই ‘ব/জ্জা/ত বদ*মাইশ শয়*তান লোক কোথাকার’ বলে উঠলাম। তাসফি ভাই কথাটা শুনেই সাথে সাথে ধমকে উঠলেন,
“কি বললি তুই…. ”

“আহ্…. আম্মু….”

চিৎকার করে উঠেই দৌড়ে চলে আসলাম সেখান থেকে। ধরতে পারলে যে, আমার গাল দু’টো থাপ্পড় দিয়ে একেবারে লাল বানায় দিবে, সেটা আমার খুব ভাবেই জানি।

.
“আরে আরে, আমার ছোট বউয়ের কি হয়েছে? এমন কে দৌড়াচ্ছে কেন?”

এক দৌড়ে বসার রুমে এসে হাঁপাতে লাগলাম। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলাম, তাসফি ভাই আসছেন নাকি। না…. আসছেন না। জোরে একটা শ্বাস টেনে নিলাম। উফ্! এতক্ষণে মনে হয় জানটা বেরিয়ে গেছে একেবারে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে বসে পরলাম ভালোবাসার তালিকায় থাকা আরও একটা মানুষের পাশে। অকপটে বলে উঠলাম,
“কি আর হবে বুড়ো বর, তোমার ওই ব/জ্জা/ত নাতিটা আমাকে মা/রা/র জন্য তাড়া করেছে।”

“তো আমার ছোট বউকে কি জন্য মা/র/তে চাইছে ওই ব*জ্জা*তটা? আমিও একটু শুনি।”

একমাত্র এই মানুষটাই আমার কথাগুলো বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই। তাসফি ভাইয়ার দাদু হলেও মাঝে মাঝে মনে হয়, এই মানুষটা আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আমাকে কিছু বলতে চাইলে তাসফি ভাইকে বকেও দেন। দাদু আদর করে আমাকে ছোট বউ বলে ডাকেন, আর আমিও বুড়ো বর বলে ডাকি। দাদুর কথায় চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠলো আমার। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলাম,
“তোমার ওই ব/জ্জা/ত নাতিটা আমাকে নাকি মামাতো বউ বানাবে, কোলে নিয়ে আদর করে টপাটপ চুমু খা….”

আমার কথাটা শেষ করার আগেই দাদু খুকখুক করে কেঁশে উঠলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে ট্রি টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে দাদুর মুখের দিকে বাড়িয়ে দিলাম, এক নিশ্বাসে গ্লাসের পুরো পানিটা শেষ করলেন। আমি এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি আব্বু, বড় বাবা, ফুপা ফুপিরা তাকিয়ে আছেন আমার দিয়ে। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না কি হয়েছে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দরজার কাছে তাসফি ভাইয়া কে দেখতে পেলাম। দুই ধাপ সোফার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি ‘আহ্’ চেঁচিয়ে উঠলাম। মৃদু স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“আহ….. বুড়ো বর, ওই দেখো, মা/র/তে আসছেন উনি। বাঁচাও আমাকে।”

“ওকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছিস কেন? যা ওই দিকে।”

তাসফি ভাইয়া একটু এগিয়ে আসতেই ধমকে উঠলেন ফুপি। তবে ফুপির কথায় পাত্তা দিলেন না তাসফি ভাইয়া। সাথে সাথেই বলে উঠলেন,
“তোমার ভাতিজি যে দিন দিন চরম লেভেলের বেয়া*দব হয়ে যাচ্ছে সেটা চোখে পরে না, তোমার? কত কি ইচ্ছে হয় তার, আদর খেতে ইচ্ছে করে, কোলে উঠে ঘুরতে ইচ্ছে জাগে। আজকে ওর সবগুলো ইচ্ছে পূরণ করবো। আয় এদিকে…. ”

“আহ্! দাদুভাই, আর ভয় দেখাতে হবে না আমার ছোট বউকে। আর একটু বড় হতে দাও, তারপর মামাতো বউ বানিয়ে সবগুলো ইচ্ছেই একসাথে পূরণ করে ফেলো।”

দাদুর কথা শেষ হতেই আমি হালকা চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে বলে উঠলাম,
“না…. মামাতো বউ হবো না আমি ওনার, সত্যি সত্যি বউ না বানানোর আগে কিছুতেই মামাতো বউ হবো না।”

হো হো করে হেঁসে উঠলো আমার কথা শুনে সবাই, সাথে তাসফি ভাইও দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, কি এমন বললাম যে সবাই এমন হাসতে শুরু করে দিলো?

.
.
অজান্তেই বেশ শব্দ করে হেঁসে উঠলাম আমি। অতীতের মিষ্টি কিছু স্মৃতি দৃশ্যপট হতেই ঘুমের রেশটাও আর ধরা দেয় নি। হারিয়ে গেছিলাম সেই পাঁচ বছর আগের দিনগুলোতে। ইস্! তখন অবুঝের মতো কতকিছুই না বলে ফেলেছিলাম সবার সামনে। সেদিনের সবার হাসির কারণটা না জানলেও এখন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি। লজ্জার মাথা খেয়ে কতকিছুই না বলেছিলাম সেদিন। তাসফি ভাইয়াও টানা সাতদিন কোলে নেওয়া ও চুমু খাওয়ার ভয় দেখিয়ে গেছিলেন।

কত কিছুই না পাল্টে গেছে, হারিয়ে গেছে অনেকে, সময়ের সাথে সাথে মানুষ গুলোরও তুমুল পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ বদলায় না, সময় ও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমি, আমিও তো চলমান এই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। সেই মানিয়ে নেওয়াটা কে-ই বদলে যাওয়া ভেবে মানুষ ভুল করে। তাহলে কি তাসফি ভাইও বদলায় নি? ঠিক আগের মতোই আছেন কি, শুধু পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে? হ্যাঁ…. ওনার বলা প্রতিটি কথা, আমার প্রতি ওনার এতটা উদগ্রীব হওয়া, আমাকে কাছে টানা, আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেওয়া, ঠিক আগের মতোই তো আছে সবকিছু। কিন্তু….. কিন্তু পরিস্থিতি তো ঠিক পুরোটাই উল্টো।

চোখের কোণে ঘুমটা ধরা না দিলেও কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল ঠিক বুঝতেই পারলাম না। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। একবার রিফাপুর কাছে প্রয়োজন। না জানি রিফাপুর মনের অবস্থাটা এখন ঠিক কেমন। সাদিক ভাইয়ার জায়গায় যে অন্য কাউকে কখনোই মানতে পারবে না সেটা খুব ভালো ভাবেই জানি আমি। তাদের প্রতিটি ভালোবাসার, মান অভিমান, ঝগড়ার একমাত্র স্বাক্ষী আমি। তাসফি ভাইয়ের মতো তাদের বিচ্ছেদটা যে আমিও মানতে পারবে না কিছুতেই। তবে তাসফি ভাইয়ের প্রতি পুরোটা বিশ্বাস আছে, উনি কিন্তু একটা করবেনই। কিছুতেই সাদিক ভাইয়া ও রিফাপুর বিচ্ছেদটা হতে দিবেন না।

গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে সোজা রিফাপুর রুমে চলে আসলাম। বিছানায় বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রিফাপু। ঘুমাই নি, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি বিছানায় গিয়ে পাশ ঘেঁষে বসতেই রিফাপু চোখ খুলে তাকালো। রিফাপুর মনটা ভালো করার জন্য আমি হালকা হেঁসে বলে উঠলাম,
“এভাবে বসে আছো কেন? ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়ছে নাকি? দেখি ফোনটা দাও তো, এখনি বলছি রিফাপু মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। দেখবা সাথে সাথে তোমার সাথে কথা বলবে।”

আমার কোথায় কোন ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো না রিফাপুর। বুঝতে পারলাম এসবে কোন কাজ হবে না, সরাসরি কথা বলাটাই ভালো। রিফাপুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলাম,
“তুমি এভাবে মন খারাপ করে থাকলে, আমার কি ভালো লাগে না-কি? তাসফি ভাইয়া থাকতে তোমার এত চিন্তা কেন? উনি ঠিক একটা সমাধান করে ফেলবে, দেখো।”

“আমি ওকে ছাড়া একদম থাকতে পারবো না রে বনু, সাদিকও আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না। ছেলেটা আমায় একটু বেশিই ভালোবাসে। ওকে ছাড়া অন্য একটা ছেলের সাথে আমি…..”

কথাটা শেষ না হতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রিফাপু। কি বলে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছি না। ভালোবাসা হারানোর য*ন্ত্রণাটা যে ঠিক কি, সেটা খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। তবুও রিফাপু কে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে গেলাম।

“অযথা কান্না করছো কেন তুমি? তোমার ওই ব/জ্জা/ত ভাই থাকতে এতটা চিন্তা করতে হয় বুঝি? তবে তোমরা কিন্তু আমার সাথে বেই*মানি করেছো?”

এবার চুপ করে গিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রিফাপু। কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম,
“সাদিক ভাইয়া যে ওই ব/জ্জা/ত লোকের বেস্টফ্রেন্ড হয়, সেটা কিন্তু আমার থেকে লুকিয়ে ঠিক করো নি তোমরা।”

“আসলে তাসফি ভাই বারণ করে দিয়েছিলো, তোকে না বলতে।”

রিফাপু স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠলো কথাটা। আমি কিছুটা রাগ নিয়ে বলে উঠলাম,
“বাহ্ রে, তোমার ওই ব/জ্জা/ত ভাইটা বললো আর তোমরা লুকিয়ে গেলে ব্যাপারটা আমার থেকে? এরা কিন্তু মোটেও ঠিক করো নি।”

“তাসফি ভাই আমার ব/জ্জা/ত ভাই হলে তোর কি হয়? সারাদিন তোমার ব/জ্জা/ত ভাই না করে, একটু তো বলতে পারিস আমার ব/জ্জা/ত ব….”

“রিফাপু….. এসব কি বলছো? যেটা বলতে চাইছো, সেটা কিন্তু মোটেও না।”

“হু! তুই বললেই তো আর হলো না, সেটা তুইও খুব ভালো ভাবেই জানিস।”

একটু থামালো রিফাপু। তারপর আবারও বলে উঠলো,
“অনেক তো হলো, এবার তো সবকিছু ঠিক করে নে। এভাবে দু’জনে আর কত কষ্ট পাবি তোরা?”

“যে ভুলের কোন ক্ষমা হয় না, সেটাই উনি করেছেন রিফাপু। কখনোই ভুলতে পারবো না আমি, কিছুতেই না। সেই কথাগুলো ভাবতেই আমার শরীরটা শিরশির করে উঠে। তাহলে কি ভাবে আমি ওনাকে ক্ষমা করবো, বলো তুমি?”

রিফাপু অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কি বোঝাতে চাইছি আমি। বলে উঠলো,
“কি করেছিলো তাসফি ভাই? আমার জানার বাহিরে কি এমন কিছু আছে, যেটা আমি বা অন্য কেউ জানে না?”

“প্লিজ রিফাপু, ওই কথাগুলো জানতে চাও না, বলতে পারবো না আমি, কিছুতেই বলতে পারবো না।”

একটু থামলাম, জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও বলে উঠলাম,
“শুধু এতটুকু জেনে রাখো, উনি আমাকে ঠকিয়েছেন, কিশোরী বয়সের আবেগ নিয়ে খেলেছেন আমার সাথে, ভালোবাসার স্বপ্ন বুনাতে শিখিয়ে সেগুলো উপড়ে ফেলেছেন।”

একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়িতে সাথে সাথে মুছে ফেললাম। কি হবে তার জন্য মুল্যবান অশ্রুগুলো বিসর্জন দিয়ে? যে মানুষটা এর মূল্যই দিতে পারে নি। রিফাপু আগের থেকেও বেশি অবাক হয়ে গেছে। তিনটে বছরেও যে এগুলো কারোর সাথে শেয়ার করি নি, সবকিছু নিজের মাঝেই লুকিয়ে রেখেছিলাম।

“তুমি সাদিক ভাইয়ার ব্যাপারটা নিয়ে একদম টেনশন করো না রিফাপু, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। না হলেও তাসফি ভাইয়া সবকিছু ঠিক করে দিবেন, তুমি চিন্তা করো না। আমি রুমে গেলাম।”

কথাটা বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। রিফাপুর সামনে আর থাকা সম্ভব নয়। তিন বছর ধরে রিফাপুর সামনে নিজেকে স্ট্রং রাখার চেষ্টাটা কিছুতেই খোয়াতে চাই না। আর না দাঁড়িয়ে রিফাপুর রুমে ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

.
.
চলবে……

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১১.

.
একটা বেলা বড্ড আলসেমি তে কা*টাতে ইচ্ছে করে, নিজের ভাবনার জগতে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে, কাউকে নিয়ে ছোট ছোট কল্পনায় হারিয়ে যেতে মন চায়, সদ্য কিশোরী বয়সে পা দেওয়া খামখেয়ালী স্বভাবগুলো হঠাৎ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে বেড়িয়ে আনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু…. কিন্তু আমার সবকিছুর সমাপ্তি যেন এক জনেতেই আঁটকে গেছে, এক জনেতেই আবদ্ধ হয়ে গেছে আমার অবাধ্য মন। চাইলেও সেই তাসফি নামক মানুষটার মায়ার বাঁধন থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছি না, কিছুতেই না। গত সাড়ে তিন বছর ধরে, হাজারো চেষ্টা করেও পারি নি তাসফি ভাইয়ের প্রতি থেকে নিজের অনুভূতি গুলো ফিরিয়ে আনতে। বরং কিশোরী বয়সের ঠুনকো অনুভূতি গুলো ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল আকারে রুপ নিয়েছে।
দূরত্ব নাকি আবেগ টাকে কমিয়ে দেয়, ভুলে যেতে সাহায্য করে আবেগে বশীভূত হওয়া মানুষটাকে। কিন্তু আমি তো ক্ষণে ক্ষণে তাকে মনে করি, প্রতিনিয়ত, প্রতিটি মুহুর্ত তাকে মনে করি। তাহলে এটাকে কি বলে? শুধুই ভালোলাগা? নাকি ভালোবাসা? আমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসি? নাকি তার অজস্র মায়ায় ডুবে গেছি?

চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ডায়েরির পাতায়। চোখটা মুুছে বন্ধ করে ফেললাম। অনেক দিন পর আজ তাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো, তাকে নিয়ে ভাবনাগুলো সৃষ্টিবন্ধী করতে ইচ্ছে হলো। হোক না সে অন্য করোর, থাক না তাকে ছোঁয়ার অধিকার অন্য কারোর। আমি না হয় দূর থেকেই নিজের অনুভূতি গুলো সাজিয়ে যাবো।

মোবাইলে সময়টা দেখতেই দেখলাম, প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসে ডায়েরিটা নিয়ে লিখতে বসেছিলাম, এতটা সময় কেটে যাবে বুঝতেই পারি নি।
ভালোলাগা খারাপ লাগা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে হলে, বড় বাবা তাসফি ভাইয়াকে হঠাৎ বলে উঠেন, সাদিক ভাইয়ার পারিবারের সাথে কথা বলতে। তাদেরকে দুই এক দিনের মাঝেই বাসায় আসতে বলতে বলেছেন। দুই পরিবার একসাথে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। বড় বাবার কথা শোনার পর পরিবারের সকলের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলোও তাসফি ভাইয়ার ভাবভঙ্গি বোঝা যায় নি। একইভাবে গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে থেকেছেন। অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়েছেন আমার দিকে, সেই চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতাটা আমার ছিলো না, সাথে সাথে সরিয়ে নিয়েছিলাম।

পানি খাবার জন্য বোতলটা হাতে নিয়ে দেখলাম ফাঁকা হয়ে আছে। উফ্! আবারও এত রাতে বাইরে যেতে হবে, তাছাড়া তো আর উপায়ও নাই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রুম ছেড়ে বের হলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, সবাই হয়তো ঘমিয়ে পড়ছে। রাত তো আর কম হয় নি।
ছোট ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বড় বসার রুমে চলে আসলাম। যদিও আমাদের রুমের সামনের টুকুকে ড্রয়িং রুম বলা যায় না, একদমই ফাঁকা থাকে।
রান্না ঘরে গিয়ে বোতলটা ভরে নিলাম। সোজা বড় ড্রয়িং রুম পেরিয়ে এপাশে আসতেই টুংটাং আওয়াজ কানে এলো, সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। মধ্য রাতের শুনশান নীরবতায় যেন আওয়াজটা বেশ স্পষ্টই ভেসে আসছে। একটু দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, ঠিক কিশোর আওয়াজ।

মিনিট দুয়েক সময় অতিক্রম হতেই বুঝতে পারলাম গিটারের টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে তাসফি ভাইয়ার রুম থেকে। এত রাতে গিটার বাজাচ্ছেন উনি? অবশ্য এটা আর নতুন কি, চার বছর আগে তো, প্রায় প্রতি রাতেই আমার বায়না কে প্রশ্রয় দিয়ে গিটারের টুংটাং আওয়াজ তুলতেন, গেয়ে শোনাতেন আমার পছন্দের গান গুলো।
হাজারো কৌতুহল নিয়ে তাসফি ভাইয়ার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই আরও স্পষ্ট ভাবে ধরা দিতে লাগলো সুরটা। আমাকে টানতে লাগলো যেন, ওনার তোলা সুরের ধ্বনি। অজান্তেই ভিরিয়ে দেওয়া হালকা ফাঁক করে দরজাটা ঠেলে ভেরতে এক পা রাখলাম। সাথে সাথে গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে সাথে ভেসে আসলো আমার অতি পছন্দের একটা গানের সুর।

একা.. একা.. বেঁচে থাকা…
তোকে ছাড়া চলে না জীবন…
লাগে যেন… সবি ফাঁকা,
বুকের ভেতর একি দহন….
চেনা… চেনা. একি পথে,
তোরি আসায় এখনো বসে, পাশাপাশি হাটবো সাথে… আবারও খুব ভালোবেসে,…
জ্বলছে হৃদয়… উড়ছে সময়, তুই কেন থাকিস বল তবু দূরে… সবি ভুলে আয় না চলে,
বাঁধবো… প্রেমেরি বাহুডোরে…
এলোমেলো ইচ্ছে যত, ভালোবেসেছি তারি মতো, ডুবে আছি আজও তোরি প্রেমে জীবন সঁপেছি তোরি নামে.….

তাসফি ভাই গানটা থামিয়ে দিতেই চমকে উঠলাম আমি। কখন যে ওনার এতটা কাছে চলে এসেছি, বুঝতেই পারি নি। ইস্! এটা কি করলাম আমি? তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই ফট করে আমার হাতটা টেনে ধরলেন তাসফি ভাইয়া। আগের চেয়েও দ্বিগুণ চমকে উঠলাম যে, সাথে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো পুরো শরীর। চুপিসারে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ওনার নজরে পরে গেলাম কিভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। তাসফি ভাইয়া হাত ধরে টেনে আমাকে ওনার দিকে ফিরিয়ে নিয়েই বলে উঠলেন,
“অভ্যাস তো সেই আগের মতোই আছে, শুধু আমার কাছে বায়না করাটা হারিয়ে গেছে।”

হাত ধরে আরও টেনে এনে মাঝের দুরত্বও ঘুচিয়ে দিলেন। আলগোছে এক হাত কোমরে রেখে কাছে টেনে নিলেন। ওনার টুকরো টুকরো আলতো ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে নিলাম,
“কক্..কি করছেন ভাইয়া, ছ্ছ…ছাড়েন আমায়….”

“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি রুপু। এভাবেই আগলে রাখতে চাই, বেঁধে রাখতে চাই ভালোবাসায়।”

“ছছ্…ছাড়েন আমায়…”

ওনাকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। ইস্! কেন যে আসতে গেলাম এই ব/জ্জা/ত লোকটার রুমে? এখন নিজের মাথা নিজেরই ফা/টা/তে ইচ্ছে হচ্ছে। তাসফি ভাই আমাকে ছাড়া বদলে অপর হাতেও শক্ত করে চেপে ধরলেন আমাকে, ছটফট করতেই টেনে আটকে নিলেন ওনার বুকের সাথে। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“ছেড়েই যদি দিতাম, তাহলে বেঁধে কেন নিলাম? শত চেষ্টা করেও এই বাঁধন ছিন্ন করার ক্ষমতা নেই তোর।”

একটু থামলেন উনি, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“এখন বল, লুকিয়ে লুকিয়ে আমার রুমে কি করছিলি? নিশ্চয়ই এতদিনের জমানো আদর খেতে এসেছিস?”

ওনার শেষ কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল আমার। আদর খেতে আসছি মানে? পাগল হয়ে গেলেন নাকি উনি? আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
“কি্ক…কি বলছেন আপনি? আদর খেতে এসেছি মানে, কিসের আদর? আমি তো পা….”

“কিসের আদর? সেটা না হয় সেটা না হয় প্যাক্টিক্যালি দেখায়। কি বলো?”

“দে..দেখুন ভাইয়া, আ..আপনি কিন্তু আমাকে….”

“চার বছর তো বহু মাইল দূরেই ছিলাম, দেখাও তো সুযোগ ছিলো না। তুমি বললে আজ পুরোটাই দেখতে পারি। অবশ্য আমার কিন্তু সেই অধিকারটা আছে।”

তাসফি ভাইয়ার কথা শুকনো ঢোক গিললাম, মুহুর্তেই গলাটা যেন শুখিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেছে। বার কয়েক ঢোক গিলেও গলাটা ভেজাতে পারলাম না। শুকনো গলায় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“কক্..কিসের অধিকারের কথা বলছেন?”

“কিসের অধিকার?”

পাল্টা প্রশ্ন করেই আমাকে একটু উঠিয়ে কোলে তুলে নিলেন। আবারও ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো পুরো শরীর। হাতে থাকা পানির বোতলটা ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাসফি ভাই আমাকে কোলে নিয়েই বিছানায় গিয়ে বসলেন। দু’হাতে আবারও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমার মামাতো বউ হবার অধিকার। মামাতো বউকে আদর করার অধিকার, তাকে আলতো করে ছোঁয়ার অধিকার, টপাটপ চুমু খাবার অধিকার, একটুখানি ভালোবাসার অধিকার।”

শিরশির করে উঠলো আমার পুরো শরীর, প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠলাম আমি। অজান্তেই আমার এক হাতে ওনার গলার কাছে টি-শার্ট খামচে ধরলাম। চোখে হাজারো বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এভাবেও কি ভালোবাসার জাহির করা যায়? আসলেই কি আমাকে ভালোবাসেন? নাকি আবারও অভিনয়ের সূত্রপাত? হাজারো দ্বিধা নিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই বলে উঠলাম,
“আদোও কি আপনার মামাতো বউ হতে পেরেছি? না-কি মামাতো বোনই রয়ে গেছি?”

“কেন…. জানো না তুমি? না-কি বুঝেও বোঝার চেষ্টাও করো না, কোনটা?”

“আপনাকে আমি বুঝতে পারি না তাসফি ভাইয়া, কিছুতেই বুঝতে পারি না। মেলাতে পারি না সেই আগের আপনিটার সাথে।”

জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন তাসফি ভাই। একহাতে আমার গালে ছুঁয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁটের পরশ শুয়ে দিলেন। আস্তে করে বলে উঠলেন,

“তোমাকে বলতে হবে কেন? ভালোবাসি আমি।
হাঁটু গেড়ে গোলাপ হাতে,
কেন-ই বা প্রেমের অনুনয় করতে হবে?
যে গলার স্বরে, তোমার নামের জ্বর নামে,
তোমার নিঃশ্বাসে, আমার আকাশে
স্বস্তির ছোঁয়া জাগে,
সেই কে কেন বলতে হবে, ভালোবাসি।
তুমি বুঝি ভালোবাসা বোঝ না? প্রেম তো বোঝো?
তবে আমায় কেন বোঝো না?”

.
.
চলবে…..