তুমি বললে আজ পর্ব-১৪+১৫

0
412

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৪.

.
অনেক সময় দীর্ঘ সময়ের দহন থেকে খুব অল্প সময়ের দহনেই মানুষের মন পুড়ে বেশি। আমার সাথেও ঠিক এমনটায় হচ্ছে। গত চার বছরেও সেই মানুষটাকে যতটা না মনে পড়েছে, এই চার দিনে তার চেয়েও শত শত বার মনে পরেছে। এক নজর দেখার জন্য আকুপাকু করেছে মন। কিন্তু পাই নি,সেদিন সকালে চলে যাবার পর আর এই বাসাতেও আসেন নি উনি, এই চার দিনেও একটাবার দেখার সুযোগ হয় নি ওনাকে। কয়েক দিন নিজের মাঝে মগ্ন থাকলেও তাসফি ভাইয়ের মাঝে গিয়েই তার সমাপ্তি ঘটেছে। বারংবার ভুলে যেতে যেন আরও বেশি করে মনোযোগ পরে গেছে তার প্রতি। কলেজে গিয়ে বন্ধু মহলে আড্ডায় মেতে উঠলেও এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারি নি।

রাতের খাবার সময় সবাই চুপ হয়ে খেয়ে চলেছে। রিমি আপু ও ফুপিরা সেদিনই চলে গেছেন। হঠাৎ রিফাপুর কথা উঠে এলো। বড় বাবা জানিয়ে দিলো পরশু দিন সাদিক ভাইয়ার বাসা থেকে তার পরিবার আসবে। এই কয়েকদিনে সাদিক ভাইয়ার ব্যাপারে যতটুকু খোঁজ নেওয়া দরকার নিয়েছে। ছেলে ডাক্তার শুনেই বড়মা আর কোন কথা বলেন নি, মেয়ে তো আর খারাপ ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় নি? বড়মার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো পরিবারের একজন ডাক্তার হবে, কিন্তু সবাই বড়মার ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে নিজেদের পছন্দটা বেছে নেয়। তাসফি ভাইকেও হাজার বলে কয়ে ডাক্তারি পড়তে পারে নি কেউ, ওনার নাকি হসপিটালে গেলে মাথা ভনভন করে, আর সেখানে ডাক্তার হবে, কিছুতেই নয়। পরিবারে একটা ডাক্তার জামাই আসবে এতে বড়মা যে মনে মনে ভীষণ খুশি, সেটা বড়মাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

সকলের কথা বার্তা শুনে যতদূর বুঝতে পারলাম, সাদিক ভাইয়ার পরিবারের সাথে কথা বলে আজকেই হয়তো বিয়ের কথাবার্তা বলবে। একরাশ মন খারাপের মাঝেও একটু ভালো লাগায় ছেয়ে গেল মন। অবশেষে রিফাপু তার ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে, ভেবেই শান্তি লাগছে। ইস্! সবাই যদি সবার ভালোবাসার মানুষকে পেতো, কতই না ভালো হতো।
.
তাসফি ভাইয়ের দেখা পেলাম দু’দিন পর, যেদিন সাদিক ভাইয়ার পরিবার বাসায় আসলো সেদিন। তবুও যেন সেটা ছিলো আমাবস্যার রাতে চাঁদের দেখা পাওয়ার মতো। সাদিক ভাইয়ার পরিবার যতক্ষণ পর্যন্ত ছিলেন উনিও ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই ছিলেন। এর মাঝে একটিবারের জন্যও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন নি, আর না আমার দিকে তাকিয়েছেন। এক প্রকার এভয়েড করে গেছেন আমাকে। কেন জানি ওনার এই ইগনোর করাটা মানতে পারছি না। আসার পর তো দুই দিন খুব করে আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলেন, অভিমানকে দূরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করে গেলেন। তাহলে আজ? আজকে তো ফিরেও তাকালেন না আমার দিকে। তাহলে কি সেগুলো নিতান্তই ওনার করা অভিনয় ছিলো? হ্যাঁ! তা নয়তো কি? ওনার জীবনে তো আমার কোন জায়গা নেই, ওনার সবটা জুড়েই তো কিয়ানা আপুর বসবাস। কথাটা ভাবতেই টিপটিপ শব্দের সৃষ্টি হলো বুকের বা পাশে।

রিফাপুর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার এখনো ছয় মাসের মতো বাকি আছে। তার আগেই বিয়েটা দিতে চায় সবাই। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু গুছিয়ে দুই মাস পরেই রিফাপু ও সাদিক ভাইয়ার বিয়ে হয়ে। সবার মুখেই যেন খুশির রেশ লেগে আছে। আমি খুশি থাকার চেষ্টা করলেও পারলাম না, তাসফি ভাইয়ের আজকের করা ইগনোরটা কেমন জানি চাপা কষ্টের সৃষ্টি হলো।

.
বুকের চাপা এক কষ্ট নিয়েই কেটে গেল আরও কয়েটা দিন। সময়ের সাথে সেই কষ্টটা একটুও কমলো না বরং বেড়েই গেল যেন। অনাকাঙ্ক্ষিত একটা চেহারা অপ্রত্যাশিত ভাবে একটুখানি দেখার আসায় ছটফট করতে লাগলো অবাধ্য মন। কিন্তু দেখা পেলাম না তাসফি ভাইয়ের। সময়ের সাথে আরও অভিমান এসে জমা হলো ওনার প্রতি, সাথে জমা হলো রাগের মাত্রা। কি দরকার সেই মানুষটার কথা ভেবে, যে মানুষটার ভাবনার এক বিন্দুতেও আমি নেই। না…. আর ওনার কথা ভাববো না আমি, আর না ওনার সামনে যাবো, কিছুতেই না। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু আমার করা প্রতিজ্ঞা কে ভঙ্গ করে দিয়ে আম্মু আগমন ঘটলো। রুমে এসেই বলে উঠলো,
“তোর ফুপি ভীষণ অসুস্থ রে রূপা, বাসায় তো কেউ নাই। তুই একটু যা তো মা, কয়েক দিন থেকে আয়। না জানি কি করছে ওরা।”

“কেন আম্মু, ফুপির হঠাৎ কি হয়েছে?”

“ওর নাকি ভীষণ জ্বর আসছে হঠাৎ করেই। বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না, তোর ফুপাও নাকি ফেনী তে গেছে কয়েক দিনের জন্য। তাসফি আর তোর ফুপি একা একা বাসায়, এখন তোর ফুপির পাশে একজন মেয়ে মানুষ থাকা খুব প্রয়োজন।”

“কিন্তু আম্মু আমি….”

“তোর বড়মা বাসায় থাকলে তো আমিই যেতাম, রিফাও নাই। এখন তুই ছাড়া কে যাবে বল মা? একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যা না, কয়েকদিন থেকে আয়। না জানি একা একা কি করছে ছেলেটা?”

বারণ করলেও কোন কথায় শুনলো না আম্মু। এক প্রকার জোর করেই রেডি হতে পাঠিয়ে দিলো, সেই সাথে কাপড় সহ বইও গুছিয়ে দিলো। যেন সেখান থেকেই কলেজে যেতে পারি। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে রেডি হয়ে নিলাম যাবার জন্য।

.
ফুপির বাসায় এসে কলিং বেল দিতেই তাসফি ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিলেন। ওনাকে দেখে ভেতরে না ঢুকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। এ কি অবস্থা ওনার?
আমাকে হঠাৎ এমন ব্যাগ সহ দেখে হয়তো উনি অবাক হলেন কিছুটা, কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলেন, ধমকে উঠে বললেন,
“হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেয়াদব! তোর জন্য কি কাজ ফেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি?”

প্রতিবারের মতো ওনার ধমকে আজকে আর কাজ হলো না। প্রতিত্তোরে কিছু না বলে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই শব্দ করে হেঁসে উঠলাম। শুধু হাসিতেই থেমে থাকলাম না, হাতের ব্যাগটা মাটিতে ফেলে দরজা ধরে হাসতে লাগলাম। ওনার পুরো শরীরে আটা লেগে আছে, চুলের অর্ধেক অংশ জুড়েও ভর্তি হয়ে আছে আটা দিয়ে। মুখে এমন ভাবে লেগে আছে যে, যে কেউ দেখলেই পেট ফেটে হাসি আসবে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো, কিছুতেই যেন নিজের হাসিটা কন্ট্রোল করতে পারছি না। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে আবারও ধমকে উঠলেন উনি,
“বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে এভাবে হাসছিস কেন? বেয়াদব! আমাকে দেখে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে?”

‘আপনাকে তার থেকেও বড় কিছু মনে হচ্ছে, তাসফি ভাইয়া।’ কাথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলার সাহস পেলাম না, কিন্তু ওনার কথা শুনে আমি আবারও হেঁসে উঠলাম আমি। এবার বেশ বড়সড় করেই ধমকে উঠলেন উনি। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলাম, হাসি পেলেও কোন ভাবে চেপে রাখলাম নিজের মাঝে। ব্যাগটা উঠিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমি ভেতরে ঢুকতেই তাসফি ভাই দরজাটা আঁটকে দিয়ে দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। ওনার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে সময় লাগলো না, রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছেন উনি। যদিও এর আগে কখনো ভুলেও রান্নাঘরের দিকে পা দেন নি। ওনার অবস্থা দেখে ধারণা করে নিলাম, রান্নাঘরের অবস্থা চোখে দেখার মতো নয়।

রান্নাঘরে না গিয়ে ব্যাগটা গেস্ট রুমে রেখে সোজা ফুপির রুমে গেলাম। বিছানায় শুয়ে আছে ফুপি, একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম ঘুমিয়ে আছে। মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম যেন। এতটা জ্বর? হঠাৎ এতটা জ্বর আসলো কিভাবে? না জানি এতক্ষণে কিছু খেয়েছে কি না? ওষুধটাও হয়তো খায় নি। তাড়াতাড়ি কিছু একটা বানিয়ে খাওয়াতে হবে ফুপি কে, তারপর ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে।
ভেবেই আর রুমে থাকলাম না। ফুপির রুম ছেড়ে বেড়িয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে আসলাম। রান্নাঘরে ঢুকেই আরেক দফা চমকে উঠলাম আমি।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৫.

.
“এসব…. এসব কি করেছেন আপনি, তাসফি ভাইয়া?”

ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে একবার দেখে নিলেন, কোন কথা না বলে বিরক্তি মুখে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। অবশ্য কাজ বললে ভুল হবে, কাজের চাইতে অকাজটাই বেশি করছেন উনি। রান্না ঘরের পুরো ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাঁড়ি পাতিল, ময়দার প্রলেপ সাথে সবজির কা*টা কা*টা অংশ। কেবিনেটের পুরোটা জুড়ে ছোপ ছোপ ময়দা ছিটিয়ে সাদা হয়ে আছে, সাথে সবজি দিয়ে বিছিয়ে আছে পুরোটা। একটুও জায়গা ফাঁকা নেই বললেই চলে। উনি কোন দিকে পাত্তা না দিয়ে এক মনে রুটি বেলে চলেছেন। একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম রুটি নয়, উনি তো বাংলাদেশের মানচিত্র বানাতে ব্যাস্ত। শুধু বাংলাদেশের মানচিত্র বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হন নি, বাকিগুলো ভারত পাকিস্তানের মানচিত্রও বানিয়েছেন। সেগুলো কয়েকটা ভেজেও ফেলেছেন, কালো কালো আধ পোড়া রুটির মাঝে আবার ফুটোও হয়ে আছে। তাতে যেন স্পষ্ট ভাবে মানচিত্রের রুপ ধারণ করেছে। ওনার বানানো রুটির নামে মানচিত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে আবারও শব্দ করে হেঁসে উঠলাম। হাসতে হাসতে রুটির দিকে দেখিয়ে ওনাকে বলে উঠলাম,
“এগুলো কি তাসফি ভাইয়া? কি বানিয়েছেন এগুলো?”

আমার কথার কোন জবাব দিলেন না উনি, আর না তাকালেন। আমি হাসতে হাসতে মানচিত্রের মতো রুটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সাথে সাথে আমার হাত ধরে আঁটকে ফেললেন উনি। গম্ভীর গলার বলে উঠলেন,
“খবরদার হাত দিবি না, তোকে এখানে কে আসতে বলছে? যা এখান থেকে।”

“কিন্তু আপনি এগুলো কি বানাচ্ছেন তাসফি ভাইয়া? কোন দেশের মানচিত্র এগুলো?”

বলেই হো হো করে হেঁসে উঠলাম। আমাকে দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখে আবারও ধমকে উঠলেন উনি।
“দেখতে পারছিস না, রুটিগুলো দেখে তোর মানচিত্র মনে হচ্ছে? বেয়াদব! আমার কাজের মধ্যে এসে বা হাত ঢুকাচ্ছিস কেন? যা এখান থেকে।”

“আপনি তো আর কাজের কাজ করছেন না, অ-কাজটাই বেশি করছেন। ছাড়েন এগুলো, সড়েন এখান থেকে।”

“গাধার মতো এমন ডিস্টার্ব করছিস কেন? বেয়াদব! তুই যা এখান থেকে। কাজ করতে দে আমাকে।”

এবার হাসিটাকে দমিয়ে রেখে সিরিয়াস হলাম। পুরো রান্নাঘরের অবস্থা চোখে দেখার মতো নয়, ফুপিও অসুস্থ, এগুলো ঠিক করতেই যে আমার বারোটা বেজে যাবে। তাসফি ভাইয়ের চেহারার কথা আর নাই বলি, ওনার দিকে তাকানোই দায় হয়ে উঠেছে যেন। দেখে প্রচন্ড হাসিও পাচ্ছে আবার মায়াও হচ্ছে। কখনো একটা প্লেট ধুয়েও খান নি, অথচ উনি কি না রান্না করছেন? ভাবা যায় এগুলো? সকাল থেকে হয়তো ফুপির সাথে সাথে উনিও কিছু খান নি। ওনার ধমক কে পাত্তা দিলাম না। বলে উঠলাম,
“আমি মোটেও ডিস্টার্ব করছি না, দেখি ছাড়েন এগুলো আর যান এখান থেকে। আপনার কাজে সারাদিনও কিছু হবে না, আর না ফুপিকে কিছু খাওয়ানে যাবে।”

“আমার থেকে কি তুই বেশি পারিস? রান্নাঘরে গেছিস কখনো? আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে, হু!”

“না গেলেও আপনার মতো এতো অ-কাজ করি না, পুরো রান্না ঘরের অবস্থা কি করছেন এগুলো? একবার তাকিয়ে দেখুন। আর আপনাকে…. আর আপনার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না, কি অবস্থা করেছেন নিজের? দেখি ছাড়েন তো এগুলো। ফুপিকে কি এসব আধ পোড়া রুটি খাওয়াবেন নাকি?”

এবার পুরো রান্নাঘরের দিকে তাকালেন উনি, তারপর নিজের শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এতক্ষণে ওনার বিশ্বাস হলো হয়তো, করুন চোখে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“কি করবো? আম্মুকে তোর আর বাইরের খাবার খাওয়াতে পারবো না।”

বলেই একটু থামলেন, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“আচ্ছা তুই যা, আমি এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করছি। লেগে যাবে তোর।”

বলেই উনি গোছানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। মানুষটা এমন কেন? নিজের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, অথচ উনি আমাকে যেতে বলছেন, লেগে যাবে বলে। ইস্! মাঝে মাঝে এত কিউট করে কথা বলেন, কি আর বলি। তাসফি ভাইয়ের অবস্থা দেখে মায়াও হতে লাগলো অনেক, ওনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে হাত দু’টো টেনে ধরলাম। বাঁধা দিয়ে বলে উঠলাম,
“উফ্! বললাম তো ছাড়েন এগুলো, আমি গুছিয়ে নিচ্ছি, তারপর রান্না বসাবো।”

“তোর মতো পুঁচকে মেয়ে কি রান্না করবি? গেছিস কখনো রান্নাঘরে, করেছিস রান্না? খালি তো বসে বসে মামার টাকা ধ্বংস করা শিখেছিস।”

“আমাকে দেখে কি আপনার পুঁচকে মনে হচ্ছে তাসফি ভাই? আর কে বলেছে আপনাকে, আমি রান্না পারি না? দেখি যান তো এখান থেকে, আমাকে এগুলো ঠিক করতে দেন।”

আবারও হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলাম। এই চার বছরে যে কতকিছু শিখে গেছি সেটা তো আর ওনার জানার কথা নয়। রান্নাটাও যে মোটামুটি অনেকটাই পারি সেটাও উনি জানেন না। উনি আবারও আমাকে ধমকে উঠলেন, পাত্তা দিলাম না সেদিকে। অনেকটা জোর করেই ওনাকে যাবার জন্য বলে গেলাম। কিন্তু উনি তো উনিই, মি. বজ্জাত খ/চ্চ/র। আমার কথা কিছুতেই কানে নিলেন না। হাল ছেড়ে ওনাকে বললাম, আমি যা যা বলি সেটা করেন, এগুলো গোছাতে হবে আগে। উনিও আর না করলেন না। আমার কথার সায় দিয়ে যা যা করতে বললাম সেটাই করতে লাগলেন। কেবিনেটের সবকিছু গুছিয়ে আস্তে আস্তে বাকিটাও গুছিয়ে নিলাম তাসফি ভাইয়ের সাহায্যে। বেশ কিছু সময় নিয়ে গোছানোর পর উনিও যেন হাফ বাঁচলেন, মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। যেন কোন অসাধ্য সাধন করেছেন। ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“এবার আপনি যান, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন। আমি রান্নাটা করে নিচ্ছি।”

“তুই কি রান্না করবি? করলেও সেটা খেতে পারবো? যা এখান থেকে।”

“আপনি যান এখান থেকে। পারি কি না, সেটা করলেই বুঝতে পারবেন। এই অবস্থায় এখানে থেকে আবারও নোংরা করতে চাচ্ছেন? যান বলছি।”

রেগে উঠে কথাটা বলেই ওড়নাটা কোমরে বেঁধে নিলাম। রান্নার জন্য হাত লাগাতেই তাসফি ভাইয়া বলে উঠলেন,
“তুই তো দেখি চরম লেভেলের বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস রুপু। আমাকে ধমকাস, কত্তো বড় সাহস হয়েছে তোর?”

“যাবেন আপনি এখান থেকে? যান বলছি, ছি! কতটা নোংরা লাগছে আপনাকে দেখতে, তাকানো যাচ্ছে না পর্যন্ত।”

এবার যেন কাজ হলো আমার কথায়। নিজের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্বে ছেয়ে গেল ওনার মুখটা। ওনার ভাবভঙ্গি দেখে প্রচন্ড হাসি পেলেও তা প্রকাশ করলাম না, কোন ভাবে হাসিটা কন্ট্রোল করে রাখলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“আচ্ছা… আচ্ছা যাচ্ছি আমি। কিন্তু একদম কোন কাজে হাত দিবি না, আমি ফ্রেশ হয়ে এসে করবো।”

ওনার কথায় সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকালাম। যে করেই হোক এই বজ্জাত লোকটাকে এখান থেকে পাঠাতে পারলেই বেঁচে যাই। আমি সায় জানাতেই উনি আর কিছু বললেন না। নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রান্নাঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। উনি যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। হেঁসে উঠলাম আপন মনেই। তারপর চুলগুলো ভালোভাবে খোঁপা বেধে লেগে গেলাম রান্নার কাজে।

.
প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে রান্না করে চলেছি। ফুপির কথা ভেবে ভুনা খিচুড়ি এবং ভুনা মাংস রান্না করছি। জ্বরের কারণে নরম কিছু খেতেই সুবিধা হবে ফুপির। খিচুড়িটা হয়ে এসেছে, মাংস রান্নটাও প্রায় শেষের দিকে। রান্নায় মনোযোগের সাথে টুকটাক কাজ করতেই, হঠাৎ আমার মনোযোগটা নষ্ট করে কেউ খোঁপা করা চুলগুলো খুলে দিলো। ঝরঝর করে লম্বা চুলগুলো খুলে পিঠে, পিঠ থেকে কোমরে, কোমর থেকে হাঁটুর একটু উপরে গিয়ে পড়লো। মানুষটা কে, সেটা দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকানোর আগেই শক্তপোক্ত হাত দু’টো পিছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলো। একটানে বুকের সাথে মিশে নিয়ে চুলের ভাঁজে মুখ ডুবে দিলো। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠলাম আমি, হাতে থাকা খু*ন্তিটা ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা গলায় অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলাম,
“ক্.. কে আ…”

“একদম আমার বউ বউ লাগছে রুপুসোনা।”

তাসফি ভাইয়ের কণ্ঠ কানে আসতেই আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। নড়াচড়া বন্ধ করে স্থির হয়ে গেলাম মুহুর্তেই। বুকের টিপটিপ শব্দের ধ্বনি দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেল সহসায়। মানুষটা এমন কেন? হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরার মানেই বা কি? সেই সাথে ওনার বলা কথাটা… পা দু’টোয় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন দায় হয়ে উঠেছে আমার জন্য। তবুও কাঁপা কাঁপা গলায় অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলাম,
“কক্… কি করছে, ছা..ছাড়েন….”

“আর কত অপেক্ষা করাবে? একেবারে চলে আসলেই তো পারো? আমার কাছে, আমার হয়ে, আমার বউয়ের অধিকারে।”

ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলাম না আমি, কথাগুলো যেন গলায় এসে আঁটকে গেছে। কি করছেন উনি? এভাবেই বা কেন বলেন? মানুষটার প্রতিটা কথায় যেন টানতে থাকে আমাকে, না রাগ করে থাকা যায় আর না অভিমান করে।
মিনিট পাঁচেক সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম স্থির হয়ে, ওনার বুকের সাথে হেলান দিয়ে। তারপর কোন ভাবে নিজেকে সামলে নিলাম। জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলে উঠলাম,
“ছা..ছাড়েন না, ক্..কি করছেন….”

“তোমাকে দেখলেই ছাড়তে নয়, শুধু বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করে, তোমার কাছে গচ্ছিত রাখা আমার জিনিসগুলো কে একটুখানি ছুঁয়ে দেবার বাসনা জাগে, তোমার পুরোটা জুড়ে শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে।”

ওনার কথাগুলো শুনে আবারও কেঁপে উঠলাম আমি, কি বলছেন উনি? হুটহাট এমন কথাগুলো কেন বলেন উনি? এমনিতেই ওনার ছোঁয়াগুলোর সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না আমার, সাথে ওনার বলা কথাগুলো। ইস্! এমন কেন এই বজ্জাত লোকটা? এমনভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন নড়াচড়াও করতে পারছি না, আর না নিতে পারছি ঠিকভাবে নিশ্বাসটা।

“প্লিজ! ত..তাসফি ভাইয়া, ছাড়েন আমাকে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”

“অভ্যাস করে নাও, রুপুসোনা। খুব তারাতাড়ি এই আমিই তোমার নিশ্বাসে পরিণত হবো।”

বলেই হাত দু’টো আলগা করে দিলেন, আলতো করে ছেড়ে দিয়ে আমাকে ঘুড়িয়ে সামনের দিকে নিয়ে এলেন। আলগোছে দু’ গালে হাত রেখে কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুয়ে দিলেন। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“এভাবে বউ বউ রুপে একদম আমার সামনে আর আসবা না, কন্ট্রোল করতে পারবো না নিজেকে। অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।”

বলেই থামলেন উনি। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“হুটহাট ভুল কিছু করে ফেললে সেই আমাকেই আগের মতো শাস্তি পেতে হবে, তোমার বাপ চাচা এবং একমাত্র ফুপার থেকে। তাই একটু সাবধানে থাকবা।”

বলেই ছেড়ে দিলেন উনি। ওনার শেষ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিশোর আগের মতো শাস্তির কথা বলছেন উনি? কিশোর শাস্তি পেয়েছিলেন?
আমার ভাবনার মাঝেই তাসফি ভাই চোখে মুখে বিস্ময় প্রকাশ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“রুপু, এগুলো কে রান্না করলো? কে এসেছিলো বাসায়?”

ওনার কথায় বিরক্ত হলাম আমি। কে এসেছিলো মানেটা কি? আমাকে কি চোখে পড়ছে না? চোখের সামনে জলজ্যান্ত আমি রান্না করছি, তবুও এই কথাটা কিভাবে বলেন? আমার ভাবনার মাঝেই উনি একটুখানি খিচুড়ি নিয়ে মুখে দিলেন। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“সত্যি করে বল রুপু, কে রান্নাগুলো করে দিয়ে গেল? এটা বলিস না যে, তুই করেছিস।”

“তো আবার? বলতে হবে কেন আমি করেছি? দেখে পারছেন না আপনি?”

আমার কথাটা শুনে বিস্মিত হয়ে অদ্ভুত চোখে তাকালেন আমার দিকে। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই তাকিয়ে থেকে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। একহাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে অপর হাত গালে রাখলেন। আমি কিছু বোঝার আগেই টুপ করে গালে চুমু দিয়ে বলে উঠলেন,
“আমার রুপুসোনা এই চার বছরে সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক বেশিই বড় হয়ে গেছে, সাথে অনেক কিছু শিখেও গেছে।”

.
ফুপির ঘুম ভাঙতেই বললাম ফুপিকে বললাম একটু খেয়ে নিতে, তারপর ওষুধটাও খেতে হবে। আমার কথায় রাজি হয়ে ডাইনিং রুমে আসতে চাইলে, বাঁধা দিয়ে রুমেই নিয়ে আসলাম খাবারটা। তাসফি ভাইয়াও বলে উঠলেন উনিও এখানেই খাবেন, একসাথে সবাই। আমাদের দুজনের খাবারও যেন রুমেই নিয়ে আসি। আমি বারণ করতেই যেন আরও পেয়ে বসলেন। একরোখা ভাবে বলতে লাগলে, এখানেই খাবেন, সবাই একসাথে। ওনার কথায় প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,
“আপনি কি বিছানা শয্যা হয়ে গেছেন তাসফি ভাই, যে খাবার এনে মুখে তুলে দিতে হবে আপনাকে? চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খেতে বসেন।”

শেষ কথাটা বেশ জোরেই বললাম যেন। আমার কথায় উনি কপাল কুঁচকে ফেললেন, ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
“তুই চরম লেভেলের বেয়াদব হয়ে গেছিস রুপু, মামার টাকা ধ্বংস করে এগুলো শিখছিস? বেয়াদব!”

একটু থেমে ফুপির দিকে তাকালেন, তারপর আবারও বলে উঠলেন,
“আম্মু…. তুমি তাড়াতাড়ি আমার বউকে আনার ব্যাবস্থা করো। আমার বউটা থাকলে ঠিকই চুমু দিয়ে, আদর করে খাইয়ে দিতো, এই মাথামোটা গাধীটার মতো নির্দয় হতো না। সামান্য খাবারটাও রুমে নিয়ে আসতে চাচ্ছে না।”

“দেখুন তাসফি ভা….”

“অনেক হয়েছে, এবার থাম তোরা। তাসফি তুই যা, রূপা যেটা বলছে সেটা কর। আসার পর থেকে মেয়েটা কাজ করে যাচ্ছে, ওকে আর জ্বালাস না।”

দূর্বল কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠলো ফুপি। ফুপির কথায় কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে, তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,
“আচ্ছা… আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আবার ভালো মানুষ, তাই এসব বাচ্চা কাচ্চার কথায় কান দিলাম না, যাচ্ছি।”

অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে, উনি নাকি ভালো মানুষ? কত গর্ব করে আবার বলেও যাচ্ছেন, কত্তবড় বজ্জাত লোক একটা। আর কোন কথা না বলে তাসফি ভাই বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। উনি যেতেই ফুপির দিকে তাকালাম। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“তোমার ছেলেটা এত বজ্জাত কেন ফুপি? ওনার মুখে কি কিছুই আঁটকায় না?”

“বজ্জাত হলেও সেই তোকেই তো সামলাতে হবে। আমি বাবা এতকিছু ভাবতে পারবো না।”

ফুপির কথায় চমকে উঠলাম, হঠাৎ এমন কথা বলবে ভাবতেই পারি নি। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলাম,
“পারবো না আমি, তোমার এই বজ্জাত ছেলেটাকে সামলাতে।”

বলেই একটু থামলাম। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলাম,
“তোমার ছেলের মনে বউয়ের খুব সখ জেগেছে ফুপি, তাড়াতাড়ি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে আসো। তারপর তোমার বজ্জাত ছেলেটা বউকে আদর করুক, কোলে নিয়ে ঘুরুক, চুমু খাক আমাকে তো ওনার কথা শুনতে হবে না? বেঁচে যাবো আমি।”

“তাহলে ভাইয়ের সাথে কথা বলি, কি বলিস? ছেলেটা আমার কতই আর বউ ছাড়া দিন কাটাবে?”

চমকে উঠলাম আমি। ইস! কি বলে ফেললাম এগুলো? কিভাবেই বা বললাম? কথাগুলোর মানে ঠিক কি, সেটা বুঝতেই হাজারো লজ্জায় ঘিরে ধরলো যেন। রূপা… তুই আসলেই গাধী, মাথামোটা একটা মেয়ে, ঠিকই বলেন উনি। লজ্জায় নিজেরই মাথা কা*টা যাচ্ছে এখন। ফুপিও ঠিক তাসফি ভাইয়ের মতোই, সুযোগ পেয়ে ঠিকই মজা নিচ্ছে। কোন রকম ভাবে ফুপিকে ওষুধটা খাইয়ে দিলাম। লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে দ্রুত হাতে প্লেট ও পানির গ্লাসটা নিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে আসতেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো ফুপি। ফুপির হাসির আওয়াজে লজ্জাটা যেন দ্বিগুণ হতে দ্বিগুণ হয়ে গেল আমার।

.
.
চলবে…..