তুমি বললে আজ পর্ব-১৬+১৭

0
445

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৬.

.
ভালোবাসার মানুষ গুলোর সাথে কা*টানো সময়গুলো খুব তারাতাড়িই যেন চলে যায়। সময়গুলো ঠিক কিভাবে চলে যা, বোঝা যায় না। এখানে এসে দু’টো দিন যে ঠিক কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না যেন। ফুপির সাথে আড্ডা দেওয়া, তাসফি ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করা, ওনার আনলিমিটেড আমাকে খোঁচা দেওয়া, সাথে ওনার অ*সভ্য মার্কা কথাগুলো শুনেই দিন গুলো কে*টে গেছে। তবে এই দু’টো দিন তাসফি ভাই প্রয়োজন ছাড়া আমার আসে পাশে আসেন নি, তবে যতটুকু সময় ছিলেন তাতেই যেন জ্বালিয়ে মে*রেছেন আমায়। ফুপিও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। সকাল থেকেই একটু সুস্থ হয়ে, দুপুর থেকে আমাকে সাইডে রেখে নিজেই সব কাজ করে যাচ্ছে। রাতের রান্নার সময় আমি কিছু করার জন্য যেতেই ধমকে উঠে ফুপি। বলে উঠলো,
“দুই দিনে অনেক কাজ করেছিস, আর করতে হবে না। ফুপির বাড়ি আসছিস খাবি -দাবি আর ঘুরবি, কাজ করতে হবে কেন?”

ফুপির কথা শেষ হতে আমি বলে উঠলাম,
“তুমি অসুস্থ না, মাত্র জ্বর ছাড়লো। তোমার এগুলো না করলেই নয়, আমি করছি তুমি যাও এখান থেকে।”

এর মাঝেই তাসফি ভাইয়া রান্না ঘরে চলে আসেন। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে খেতে লাগলেন। ফুপি কিছু বলার আগেই উনি অকপটে বলে উঠেন,
“উফ্! আম্মু…. তুমি ওকে বাঁধা দিচ্ছে কেন? দেখছো না মেয়ে বড় হয়ে গেছে, বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। সংসারের দ্বায়িত্ব নিয়ে সেটাই তো বোঝাতে চাইছে।”

একটু থেমে আমার দিকে তাকালেন। বললেন,
“তুই তোর কাজ কর রুপু, খুব তারাতাড়ি শ্বশুর বাড়িতে নিজের সংসার সামলাতে হবে তো নাকি? সাথে এটাও শিখে নে, কিভাবে বরকে আদর করে চুমু দিয়ে খাওয়াতে হয়।”

ওনার কথায় রাগ হলো অনেক। চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম,
“আমার বরকে কিভাবে খাওয়াবো, না খাওয়াবো সেটা আমার ব্যাপার, আপনার কেন বলতে হবে? বজ্জাত লোক একটা।”

“গাধী কোথাকার! সেটা তো, তোর এই মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় ঢুকবে না। আমাকেই তো ভাবতে হবে, বেয়াদব! তোর মতো গাধার বর তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, শেষমেষ তো আমার গলায় তোকে ঝুলিয়ে দিবে, তোর বাপ চাচারা।”

“দরকার নাই আপনার মতো বজ্জাত লোকের গলায় ঝোলার। আমি কি লাফাচ্ছি নাকি আপনার গলায় ঝোলার জন্য?”

“লাফাবি কেন? রীতিমতো ঘাড়ে চড়ে আছিস তো।”

“দেখেন তাসফি ভা….”

“থামবি তোরা…. কি বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস তখন থেকে।”

আমার কথা শেষ না হতেই ধমকে উঠলো ফুপি। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলাম দু’জনে। ফুপি একটু থেমে তাসফি ভাইকে বলে উঠলো,
“তাসফি…. তুই যাবি এখান থেকে? সারাদিন ওর পিছনে না লাগলে তোর হয় না?”

“আমি আবার ওর পিছনে লাগতে গেলাম কখন? দেখছো না ও বড় হয়ে গেছে, সংসারের দ্বায়িত্ব নিচ্ছে, বরের আদর খেতে চাচ্ছে, শুধু তোমরাই বুঝলে না।”

প্রচন্ড রাগে ওনার দিকে তাকালাম আমি। কিছু বলার আগেই ফুপি বলে উঠলো,
“বয়স হয়ছে ওর? যখন বিয়ের বয়স হবে তখন ঠিকই দিবো।”

“ওর হয়নি তো কি হয়েছে? আমার তো হয়েছে, আমাকে বিয়ে দিতে পারছো না? কতদিন আর বউ ছাড়া একা একা ঘুমাবো?”

“তুই যাবি এখান থেকে? ফাজিল ছেলে! সারাক্ষণ বউ বউ ছাড়া আর কোন কথা নাই?”

“তোমরা আসলেই মীরজাফরের বংশধর। তোমার দুই ভাই যেমন মীরজাফর, তেমনি তোমরা দুই ফুপি ভাস্তিও মীরজাফর। শুধু নিজেরটা তে ষোলো আনা। আমার কষ্টটা তো তোমাদের চোখে পড়ছে না?”

বলেই একটু থামলেন উনি। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“দিন দিন যে আমার বউটার জন্য হতাশয় শুকিয়ে যাচ্ছি, সেটা তোমার আর তোমার ভাইদের চোখে পড়ছে না? দেখেছো চেহারার কি অবস্থা? মানুষ না খেয়ে থাকলেও তো এতটা শুকিয়ে যায় না।”

ওনার সিরিয়াস ভঙ্গিতে আফসোসের সুরে কথা বলতে দেখে আমি আর ফুপি একে অপরের দিকে তাকালাম। ফুপিকে বলতে চাইলাম, ‘তোমার এই বজ্জাত ছেলেটা এতো অ*সভ্য কেন? এভাবে বলতে পারে? এই বজ্জাতটাকে এক্ষুনি চুপ করতে বলো।’ ফুপিও হয়তো বুঝতে পারলো আমার কথা। হতাশার একটা নিশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে নিতেই তাসফি ভাইয়া বলে উঠলেন,
“শুধু একবার আমার বউকে কাছে আসতে দাও, তারপর দেখো, তোমাদের থেকেও বড়সড় একটা বংশ তৈরি করবো, আমার বাচ্চা-কাচ্চা গুলো দিয়ে। তখন দেখবো কিভাবে আমাকে টেক্কা দেয় তোমার? হু!”

“তাসফি…. যাবি তুই? ফাজিল ছেলে… তো….”

“আচ্ছা…. আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আবার ভালো মানুষ, তাই কিছু মনে করলাম না। যাচ্ছি যাচ্ছি… ”

বলেই আর দাঁড়ালেন না উনি, যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই বেড়িয়ে গেলেন রান্নাঘর ছেড়ে। উনি যেতেই যেন হাজারো বেগে নিশ্বাস বেড়িয়ে আসলো ভেতর থেকে। একটা মানুষ ঠিক কতটা বজ্জাত আর অ*সভ্য হলে এগুলো কথা করতে পারে? হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে ফুপির দিকে তাকালাম। বিরক্ত গলায় বলে উঠলাম,
“তোমার এই ছেলেকে কি খাইয়ে বড় করছো ফুপি? একটা মানুষ এতটা বজ্জাত কি করে হতে পারে? কিভাবে সহ্য করো ওনাকে?”

“কিভাবে যে করছি, একমাত্র উপর আল্লাহ্-ই জানেন। ত্রিশ বছর ধরে বুড়োটাকে সহ্য করছি, আর আটাশ বছর ধরে এটাকে। বাপের থেকে ছেলেটা আরও একশো তে একশো। সব-ই আমার কপাল।”

বলেই হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো ফুপি। একটু থেমে আবারও বলে উঠলো,
“আমার বাবা বয়স হয়ে যাচ্ছে এত শত আর ভাবতে পারবো না। ছাড়া হাত পায় শুধু দেখে যাবো, নাতি নাতনি নিয়ে খেলবো। আমি তোর ছেলে-মেয়েকে সামলাবো, আর তুই আমার ছেলেকে। ব্যাস! হয়ে গেল।”

ফুপির কথাটা বুঝে উঠতে সেকেন্ডের মতো সময় লাগলো। বিস্মিত হয়ে ফুপির দিকে তাকাতেই ঠোঁট চেপে হেঁসে উঠলো ফুপি। মা ছেলে যে দু’টোই এক, সেটা বোঝার আর বাকি রইলো না আমার। উফ্! ফুপির সামনেও আর থাকা যাবে না।

“অসম্ভব….. পারবো না আমি, তোমার আদরের বজ্জাত ছেলেকে সামলাতে…”

অনেকটা জোরে কথাটা বলেই বেরিয়ে আসলাম রান্নাঘর ছেড়ে। আসার সময় ফুপির উচ্চ স্বরে হাসির আওয়াজ ঠিকই কানে আসলো। রাগের সাথে সাথে লজ্জাটাও এসে ঘিরে ধরলো।

.
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই চিন্তা করলাম এই বজ্জাত মা ছেলের সাথে আর থাকবো না, আজকেই বাসায় চলে যাবো। মনে মনে কথাটা ভেবে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম ফুপিকে বলার জন্য। কিন্তু আমার ভাবনার মাঝে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে ফুপি বলে উঠলো,
“আসার পর দু’টো দিন তো শুধু কাজ করেই কাটিয়ে দিলি, আরও দু’টো দিন থেকে ফুপির হাতের ভালোমন্দ রান্না খেয়ে তবেই তোর যাওয়া।”

কিছু বললেও ধমকে ধামকে একেবারে চুপ করে দিলো ফুপি। শেষমেশ কোন উপায় না পেয়ে ফুপির কথাতেই রাজি হতে হলো।
এবার ভাবলাম থাকতেই যখন হবে, তাহলে এখান থেকে কলেজে গিয়ে ঘুরে আসায় যায়। এমনিতেও এই দু’টো দিন কলেজে যেতে পারি নি। ফুপিকে বলতেই বাঁধা দিলো না আমায়। খাওয়া দাওয়া করে রেডি হয়ে যেতে বললো কলেজে। আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসায় থেকে মি. বজ্জাত তাসফির বজ্জাত মার্কা কথা না শুনে কলেজে গিয়ে কিছুটা সময় কটিয়ে দেওয়ায় ভালো হবে।

.
ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে এসে বসে পড়লাম। ডিপার্টমেন্টে আলাদা হওয়ায় ফ্রেন্ডদের এখন ক্লাস আছে, তাদের জন্যই ক্যাম্পাসে বসে বসে ওয়েট করা। না জানি তাদের ক্লাস ঠিক কতটা সময় পর শেষ হবে।
মিনিট পাঁচেক সময় কাটতেই হঠাৎ কেউ একজন পাশে এসে বসলো। পাশে তাকাতেই চোখ মুখে বিরক্তিতে ছুয়ে গেল আমার। পাশের এই মানুষটাকে যেমন ভালো লাগে ঠিক তেমনি বিরক্তিটাও লাগে। পাশে বসেই বলে উঠলো,
“এখানে একা একা বসে আছো যে, বাসায় যাবা না?”

“সুপ্তিদের জন্য ওয়েট করছি।”

বলতে না চাইলেও বাধ্য হয়েই বলতে হলো। জয়, আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। সেই কলেজ থেকেই একসাথে আছি। প্রথম প্রথম ওকে, ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগলেও ইদানীং খুব বিরক্ত লাগে। আমাকে যে পছন্দ করে, রিলেশনে যেতে চায়, ওর কথার মাঝেই সেটা বুঝতে পারি। যদিও মুখ ফুটে কখনো কিছু বলে নি।

প্রায় পনের মিনিট ধরে জয় আমার সাথে কথা বললেও শুধু হুম, হ্যাঁ তেই জবাব দিয়ে যাচ্ছি। তবুও কেন জানি প্রচুর বিরক্ত লাগছে ওকে। এর চেয়ে তাসফি ভাইয়ের বজ্জাত মার্কা কথাগুলো বেশ ভালো ছিলো। মনে মনে ভেবে নিলাম জয়ের কথা শোনার চেয়ে বাসায় চলে যাওয়াটাই ভালো। ওদের বরং মেসেজ করে জানিয়ে দিবো, আমি বাসায় চলে আসছি। ভেবেই উঠে দাঁড়িয়ে জয়কে বললাম,
“ওদের ক্লাস অনেক দেরিতে শেষ হবে জয়। আমি বরং চলে যাই, তুমি থাকো।”

দুই পা এগিয়ে আসতে জয় ও উঠে দৌড়ে আসলো আমার কাছে। বলে উঠলো,
“চলো একসাথে যাই, আমিও তোমার বাসার ওইদিকে যাবো।”

“না… আসলে আমি তো ফুপির বাসায় যাবো।”

আমার কথা শুনে মনে হয় একটু মন খারাপ হয়ে গেল জয়ের। হোক, তাতে আমার কি? আপতত একে পিছন ছাড়তে পারলেই আমার জন্য ভালো। কথাটা বলেই, চলে আসতে নিতেই হঠাৎ আমার হাত ধরে ফেললো জয়। চমকে উঠলাম আমি। চোখে মুখে হাজারো বিষ্ময় নিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম ওর দিকে। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শক্ত করে চেপে ধরায় ছাড়িয়েও নিতে পারলাম না। হালকা রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম,
“কি করছো জয়? এভাবে হাত ধরেছো কেন?”

“তোমার সাথে আমার কথা আছে রামিয়াত।”

“কথা বলবা ভালো কথা, এভাবে হাত ধরেছো কেন? হাত ছাড়ো জয়।”

একটু জোরে করে বলতেই হাতটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে আসলো আমার দিকে। রাগের মাত্রাটা যেন আরও বেরেই গেল আমার। নিজেকে কোন রকম নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। জয় বলে উঠলো,
“সরি, কিছু মনে করো না।”

“কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো, আমি বাসায় যাবো।”

“একটু ওদিকে চলো প্লিজ। এখানে এভাবে…. ”

“যা বলার এখানেই বলো, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে আমার।”

আমার কথা শুনে এদিক ওদিক একবার তাকালো জয়। বেশ কিছু সময় নিয়ে আরও একটু এগিয়ে এলো আমার দিকে। আস্তে করে বলে উঠলো,
“কথাটা আমি অনেক দিন থেকেই তোমাকে বলতে চাচ্ছি রামিয়াত, কিন্তু কেন জানি সাহস করে উঠতে পারি নি। এখন না বলেও থাকতে পারছি না।”

বলেই থামলো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না ঠিক কি বলতে চায় জয়। তবুও শোনার অপেক্ষায় রইলাম। ওর কথার জবাবটাও মনে মনে ভেবে নিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,
“এতদিন বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে বলে তোমাকে বলার সাহস পাই নি, কিন্তু ইদানীং কেন জানি মনে হয়ে তোমাকে হারিয়ে ফেলবো আমি। তোমাকে সেই কলেজ থেকেই ভালোবেসে ফেলেছি রামিয়াত। অনেক চেষ্টা করেও তোমার কথা মাথা থেকে ফেলতে পারি নি।”

জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। জয়ের থেকে যে এই কথাটা শুনতে হবে সেই অনেক আগে থেকেই জানি। জয় আবারও বলে উঠলো,
“আমি জানি, তোমার ফ্যামেলি তোমার পড়াশোনা শেষ না হলে কখনো বিয়ে দিবে না। আমিও খুব তারাতাড়ি নিজের ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করবো। ততদিন আমরা এভাবেই থাকবো।”

“দেখো জয়, তুমি যেটা বলছে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি না তোমার সাথে রিলেশনে জড়াতে পারবো, আর না তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো। আমার মাঝে শুধু ফ্রেন্ডশীপের সম্পর্ক থাকাটায় বেটার।”

“কেন সম্ভব নয়? আমি তো বললাম, খুব তারাতাড়ি তোমার যোগ্য করে নিবো। এখনো তো তোমার কাছে তিন চার বছর সময় আছে।”

“বললাম তো সম্ভব নয়, আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতেও পারবো না।”

“প্লিজ! রামিয়াত এভাবে বলো না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। প্রয়োজনে চার বছর আগেই তোমার বাসায়….”

বলতে বলতে আবারও হাত টেনে ধরলো আমার। সাথে সাথে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম। এবার যেন নিজের রাগটাকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। বেশ জোরেই বলে উঠলাম,
“কেন বোঝার চেষ্টা করছো না জয়? বললাম তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও কেন বারবার অ*সভ্যের মতো হাত ধরে টানাটানি করছো।”

একটু থেমে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিলাম। মিনিট দুয়েকের মতো সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। আস্তে করে বললাম,
“দেখো জয়, তুমি যেটা বলছো সেটা এখন বা চার বছর পরেও সম্ভব নয়। আমার অনেক আগে থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটাও আমার ফ্যামেলির মধ্যে, ফ্যামেলির মতামতে। এবার হয়তো বুঝতে পারছে তোমার সাথে কোন সম্পর্কে জড়ানো কেন সময় নয়?”

একটু থেমে জয়ের দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমার কথারা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললাম,
“তাসফি ভাইয়া কিছুদিন আগেই পিএইচডি শেষ করে দেশে এসেছেন, কিছুদিন পর ভার্সিটিতেও জয়েন করবে। তাহলে বুঝতেই পারছো, কেন বলছি।”

আমার কথা একেবারে চুপ হয়ে গেল জয়। এবার হয়তো কিছুটা হলেও আমার কথাটা বিশ্বাস হয়েছে। একটু চুপ থেকে আস্তে করে বলে উঠলো,
“সকালে যে তোমাকে কলেজে রেখে গেলো, উনি?”

জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। সকালে যে তাসফি ভাইয়া আমাকে কলেজে রেখে গেছেন সেটা জয় দেখেছে তাহলে। সকালে বের হবার সময় ফুপির জোরাজুরিতে তাসফি ভাইয়ার সাথেই আসতে হয়েছিলো আমার। জয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ! উনিই তাসফি ভাইয়া। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব রুপেই থাক জয়। ভালো থেকে।”

কথাটা বলেই আর দাঁড়ালাম না। সোজা হেঁটে চলে আসতে লাগলাম। জয়কে যে ভালোভাবে কথাটা বোঝাতে পেরেছি এটাই অনেক।

.
গরমের উত্তাপে ঘেমে একাকার অবস্থা। বগুড়া শহরেও ঢাকার মতোই জ্যাম শুরু হয়েছে। বাইরে বের হলেই জ্যামের কবলে পরতেই হবে। স্কুল, কলেজ ও আফিস টাইমে যেন কথায় নেয়। বিশ মিনিটের রাস্তায় আধা ঘন্টার মতো জ্যামের কবলে আটকে থাকতে হয়েছে আজ। মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে হয়ে ছিলো, তার উপর আবার আধা ঘন্টার জ্যাম।

প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে কলিং বেল দিতেই তাসফি ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিলেন। ওনার দিকে তাকিয়ে কিছুটা আবাক হয়ে গেলাম। চোখ মুখের অবস্থা এতটা লাল কেন হয়ে আছে? কি হয়েছে ওনার? কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। ভেতরে ঢুকে রুমে আসতেই বাঁধা দিলেন উনি। গম্ভীর গলার বলে উঠলেন,
“এত দেরি হলো কেন? কোথায় গেছিলি?”

দাঁড়িয়ে পরলাম ওনার কথায়। কোথায় গেছিলাম মানে? কেথায় গেছিলাম উনি কি জানেন না? অযথা প্রশ্ন করছেন কেন?

“কোথায় গেছিলাম জানেন না? আপনিই তো রেখে এলেন, আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

“কলেজ টাইম তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তাহলে এত দেরি হলো কেন?”

ওনার কথায় আবারও একরাশ বিরক্তিতে ঘিরে ধরলো। দেরি তো হতেই পারে, এভাবে প্রশ্ন করার কি আছে? আশ্চর্য! বেশ জোরেই বলে উঠলাম,
“দেরি তো হতেই পারে, এভাবে বলার কি আছে?”

“কেন লেট হলো সেটা জানতে চাইছি, কথা কি কানে যাচ্ছে না? বেয়াদব!”

ধমকে উঠলেন উনি। এমনিতেই মেজাজটা খিঁচে ছিলো, তার উপর ওনার এমন ধমক দেওয়াটা যেন সহ্য হলো না আমার। বেশ জোরে করেই বলে উঠলাম,
“আশ্চর্য! এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন তাসফি ভাইয়া? দেরি তো হতেই পারে, কাজ থাকতে পারে না আমার?”

“কি কাজ থাকে তোর? বেয়াদব!”

চিৎকার করে কথাটা বলেই ঠাস করে থাপ্পড় দিলেন আমার গালে। চমকে উঠলাম আমি, কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। এক মুহুর্তের জন্য যেন এই আমি কেই ভুলে গেছি।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৭. (প্রথমাংশ)

.
আধা মিনিট সময় অতিক্রম হবার পর যখন পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো, তখন শরীর কাঁপুনিতে চিনচিনিয়ে ব্যথা অনুভব হলে ডান গালে।আস্তে করে একহাত গালে দিতেই আবারও কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। দু’ চোখে একদল অশ্রুকণা ভীড় জমিয়ে ছলছল করে উঠলো চোখ দু’টো। ছলছল চোখেই হাজারো বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি তাসফি ভাইয়ের দিকে। এখনো যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না উনি আমাকে থাপ্পড় মে*রেছেন। বড় হবার পর কখনোই কেউ গায়ে হাত তুলে কি। তাসফি ভাইয়াও তো কখনো মা*রেন নি, তাহলে আজকে হঠাৎ কেন এভাবে মা*রলেন? আলতো করে গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কান্নাগুলো যেন অতি কষ্টে আটকে আছে গলায়।
তাসফি ভাইয়ার রাগে র*ক্ত চোখ নিয়ে একটু এগিয়ে আসতেই যেন আমার ঘোর কাটলো। প্রচন্ড ভয় পেয়ে দূর্বল পায়ে সামান্য পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম, হঠাৎ কেউ এসে ধরে ফেললো আমায়। একটু মাথা ঘুড়িয়ে পিছনে তাকাতেই ফুপির চেহারা ভেসে উঠলো। তাসফি ভাইয়ের চিৎকারেই হয়তো ছুটে এসেছে ফুপি। ফুপিকে দেখে আর যেন সামলাতে পারলাম না নিজেকে, একহাতে ফুপিকে জড়িয়ে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আমাকে কাঁদতে দেখে ফুপি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে? কিন্তু জবাব দিতে পারলাম না আমি। আমাকে সেভাবেই ধরে সোফায় বসাতে বসাতে ফুপি বলে উঠলো,
“কি হয়েছে মা, এভাবে কান্না করছিস কেন? বল আমাকে, কি হয়েছে?”

নিরুত্তর হয়ে সেভাবেই কান্না করতে গেলাম আমি। আমার উত্তর না পেয়ে তাসফি ভাইকে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে ওর? কি বলেছিস ওকে তুই? এভাবে কান্না করছে কেন?”

“ও কি করেছে সেটা আগে জানতে চাও। কোথায় ছিলো ও এতক্ষণ? কার সাথে ছিলো?”

প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলেন উনি। ওনার চিৎকারে কেঁপে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ফুপিকে। এই মুহুর্তে প্রচন্ড রকমের ভয় লাগছে ওনাকে। ওনার এই চেহারার সাথে আমার একদমই পরিচয় নেই, এমতবস্থায় কখনোই দেখি নি ওনাকে। সবসময় তো আমাকে আগলে রাখতেই দেখেছি, শাসন করে দু’ একটা ধমকও খেয়েছি, ওনার শক্ত হাতের আলতো করে মা*ইরও খেয়েছি, কিন্তু এই মুহুর্তে পুরোই অন্য এক তাসফি ভাইকে দেখছি যেন।
ফুপি দু’ হাতে আমাকে আগলে নিয়ে, ওনাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কোথায় ছিলে মানে? জানিস না কোথায় ছিলো ও? সকালে রেখে আসলি না ওকে কলেজে?”

“সকালে তো কলেজেই রেখে এসেছিলাম। তারপর? তারপর কোথায় ছিলো ও? এত দেরি হলো কেন ফিরতে? কার সাথে কোথায় গিয়েছিলো? জিজ্ঞেস করো ওকে।”

“আশ্চর্য! তাসফি, এসব কি ধরনের কথাবার্তা? কার সাথে কোথায় গিয়েছিলো মানে কি? দু’ একদিন দেরি হতেই পারে, বন্ধুদের সাথে ঘুরতেই পারে….”

“আর সেটা যদি হয় ছেলে বন্ধু, তাহলে তো কথায় নেই, তাই না আম্মু?”

বলেই একটু থামলেন, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও জোরে করে বলে উঠলেন,
“একা একা হাত ধরাধরি করে কি গল্প থাকতে পারে ওদের? কলেজে কি এসব করার জন্যই যায় ও? ছেলেদের সাথে হাত ধরাধরি করে ঘোরার জন্য?”

তাসফি ভাইয়ার চিৎকার আবারও কেঁপে উঠলাম। সহসায় ওনার ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ জয়ের কথা মনে হতেই চমকে উঠলাম। তার মানে উনি কি জয়ের কথা বোঝাতে চাইছেন? কলেজে তো একমাত্র ওই আমার হাত ধরেছিলো আজ। তাহলে কি উনি সেটায় কোন ভাবে দেখেছেন? কিন্তু কিভাবে?
আস্তে করে মাথা উঠিয়ে তাকালাম ওনার দিকে, সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ওনার র*ক্ত লাল চোখে তাকানোর সাহসটা ঠিক পেলাম না। ফুপি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ওনাকে বলে উঠলো,
“এগুলো কি ধরনের কথাবার্তা তাসফি? কি বলছিস তুই?”

“কি বলছি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? বলো ওকে। চুপ করে আছিস কেন? বেয়াদব! বল বলছি…. ”

শেষ কথাটা চিৎকার করে আমাকে বলে উঠলেন। ওনার চিৎকার কাঁপুনির মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে গেল। এই তাসফি ভাইয়াকে প্রচন্ড ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে আমার। ভয়ের তাড়নায় ফুপিকে দু’ হাতে খামচে ধরলাম যেন। এতক্ষণে বেঁধে রাখা হিজাবও এলোমেলো হয়ে খুলে গেছে। বাকি পিনগুলোও খুলে দিলো ফুপি। হিজাবটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে আমাকে আগলে নিয়ে গালে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ডান গালে হাত রাখতেই ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। কান্নার মাঝেই ‘আহ্’ করে আত্মদান করে গালে হাত দিলাম। ফুপি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে মা? বল আমাকে….”

ফুপিকে বলতে চেয়েও কিছুই বলতে পারলাম না, গলা দিয়ে কোনই কথা বের হলো না আমার। কিন্তু গালে হাত রেখে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। রাগী চোখে তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জোরে করে বলে উঠলো,
“তুই ওকে মে*রেছিস তাসফি? কথা বলছিস না কেন?”

“হ্যাঁ! মে*রেছি। কলেজ ক্যাম্পাসে ছেলেদের হাত ধরে গল্প করবে, আর দেখেও আমি চুপ করে থাকবো, সেটা ভাবলে কি করে তুমি?”

“তাই বলে ওর গায়ে হাত তুলবি? এতটুকু মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হলো তোর?”

“কোনদিক থেকে ছোট মনে হয় ওকে? এই চার বছরে অনেক বড় হয়ে গেছে ও, তোমার কিভাবে ওকে বলো ছোট আছে?”

“তাসফি…. অনেক হয়েছে, আর না? তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? এক্ষুনি সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে।”

সাথে সাথে কিছু বললেন না উনি। আমি হালকা করে তাকাতেই যেন ওনার রাগটা বেড়ে গেল। জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“তোমার ভাইদের মেয়ে তাদের ঠিক কতটা বড় হয়ে গেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করা শিখেছে, হাত ধরে ঘুরতে শিখিছে।”

বলেই একটু থামলেন, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“সাথে এটাও বলে দিয়ো ওকে আর এখানে রাখবো না আমি, ঢাকায় নিয়ে যাবো আমার সাথে। দরকার নেই ওর আর কলেজে যাবার। আর তুই…. তোকে চার মাস সময় দিয়েছিলাম না? সেটাও আর পাবি না, ঢাকায় যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নে।”

শেষ কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেই আর দাঁড়ালেন না উনি। নিজের রুমে গিয়ে জোরে শব্দ করে দরজা আঁটকে দিলেন। উনি যেতেই অস্পষ্ট সুরে ফুপিকে বলে উঠলাম,
“বব্..বাসায় যাবো…. আ..আমি..”

“একটু শান্ত হু মা… খুব লেগেছে না? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমাকে?”

ফুপির কথা শুনে এখন আরও কান্না পাচ্ছে। ফুপির কথার জবাব না দিয়ে শুধু বলতে লাগলাম বাসায় যাবার কথা। অনেক কিছু বুঝিয়ে আমাকে শান্ত করে রুমে নিয়ে আসলো ফুপি। রুমে এসে ফুপির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলাম। গালের ব্যাথাটা যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। ফোপাঁতে ফোপাঁতে সেভাবেই শুয়ে থাকলাম ফুপিকে আঁকড়ে ধরে।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১৭. ( শেষাংশ )

.
মিটমিট করে চোখ একটু খুলতেই নিজেকে আলো আঁধারে রুমে আবিষ্কার করলাম, সাথে সাথে আবারও চোখ বন্ধ করে কাথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরতে নিলাম। হঠাৎ ডান গালে চাপ পড়তেই কেঁপে উঠলাম যেন। ঘুমটা ছুটে গিয়ে ঝাঁকি দিয়ে উঠলো পুরো শরীর। মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল দুপুরের পরের ঘটনাগুলো। রুমে এসে ফুপির কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম, ফুপিয়ে কেঁদে গেছিলাম অনায়াসেই। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, ঠিক বুঝতেই পারি নি। বিছানায় তাকিয়ে ফুপিকে নজরে এলো না। হয়তো আমি ঘুমিয়ে যাবার পরেই চলে গেছে। বুঝতে পারলাম না ঠিক কতটা রাত হয়ে গেছে।
অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। বিছানা ছেড়ে নামতেই পুরো শরীর কেমন জানি হয়ে উঠলো। সকালের পর পেটে কেন খাবার পরে নি, তাই হয়তো এতটা দূর্বল লাগছে শরীরটা। সময় দেখার জন্য মোবাইলটা বিছানায় খুঁজলেও পেলাম না। হয়তো ব্যাগেই আছে, ব্যাগটাও হয়তো ড্রয়িং রুমের কোথায় পড়ে আছে। সমস্ত চিন্তা ভাবনা আপাতত মাথা থেকে ফেলে দিয়ে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে গেলাম।

ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে রুমে আসতেই দেখি ফুপি বসে আছে বিছানায়। আমাকে দেখেই বলে উঠলো,
“উঠে গেছিস…. শরীর কেমন লাগছে?”

মাথা ঝাঁকালাম আমি। বোঝাতে চাইলাম ভালো লাগছে। কিন্তু আমার কথাটা হয়তো ফুপির ঠিক পছন্দ হলো না। বলে উঠলো,
“কিভাবে শরীর ঠিক থাকে তোর? সকালের পর পেটে কিছু পরেছে? তবুও বলছিস ঠিক আছিস?”

এবার আর কিছু বললাম না আমি। আসলেই শরীরটা কেমন জানি লাগছে। রাতের ঠিক কতটা বাজে সেটাও জানা নেই। ফুপি আবারও বলে উঠলো,
“থাক তুই, আমি খাবার আনছি তোর জন্য। রাত তো আর কম হলো না, বারোটা বাজবে এখন। দূর্বল শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলি বলে উঠায় নি।”

অবাক হলাম প্রচন্ড। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম? হয়তো কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলাম জন্য এতক্ষণ ঘুমিয়েছি। ফুপি খাবার আনার জন্য রুম ছেড়ে যেতেই আমি আস্তে করে বলে উঠলাম,
“না… ফুপি, তোমার আর কষ্ট করে আনতে হবে না। ডাইনিং রুমে গিয়েই খাচ্ছি।”

“আচ্ছা চল তাহলে।”

.
রুম থেকে বেরিয়ে অজান্তেই এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিক মাথায় আনতে পেলাম না কাকে খুঁজছি। তাহলে কি তাসফি ভাইকে খেখার আশা করেছিলাম? না… না, ওই বজ্জাত বদ*মাইশ লেকটাকে কিছুতেই দেখতে চাই না আমি। কালকেই চলে যাবো বাসায়।

ফুপি আমাকে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরলো। অবাক হলাম অনেকটা। ফুপিও না খেয়ে ছিলো এতক্ষণ? ফুপির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,
“তুমিও এতক্ষণ না খেয়ে ছিলে ফুপি?”

“কি করবো বল? আমার কি আর শান্তি আছে? ছেলেটা কি শান্তি দিয়েছে আমায়? যখন যেটা মনে করে, তখন সেটাই করে বসে।”

“কি হয়েছে ফুপি? আবার কি করেছেন উনি?”

“পাগল হয়ে গেছে ও, ভুত চেপেছে ওর মাথায়। ওর জন্য ভাইদের সামনে দাঁড়াতেও পারছি না….”

বুঝতে পারলাম না আম্মু ও বড় বাবার কথায় ঠিক কি বোঝাতে চাইলো ফুপি। তবুও হতাশার নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো ভেতর থেকে। হয়তো দুপুরে ওনার বলা কথা গুলো আব্বু ও বড় বাবাকে বলতে দ্বিধা হচ্ছে ফুপির। আমিও চাই না, আমাকে মা*রার ব্যাপারটা বাসার কেউ জানুক।

“ফুপি, আমাকে মা*রার ব্যাপারটা তুমি কাউকে বলো না, প্লিজ! যা হয়েছে, হয়েছে।”

প্রতিত্তোরে আর কিছু বললো না ফুপি। আমিও খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। বেশ কিছু সময় পর ফুপি নিজ মনেই বলে উঠলো,
“ছেলেটা যে দিন দিন এত বেপরোয়া হচ্ছে কেন, সেটাই বুঝি না। যখন যেটা মনে করে সেটাই। আগে তবুও কথা শুনেছে, সবার কথা মেনে চলেও গেছিলো। এখন কিভাবে সামলাবো? উফ্! ভেবেই মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার ….”

ফুপির কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না যেন। কিছু না বলে তাসফি ভাইয়ার রুমের দিকে তাকালাম। রুমের দরজা খোলা। তার মানে রুমে নেই হয়তো, কোথায় গেছেন উনি? উফ্! যেখানে ইচ্ছে যাক না, তাতে আমার কি? তখন এত জোরে আমাকে মা*রলেন, সাথে ধমকে ধামকে ভয় দেখালেন, তবুও কেন ওনার কথা ভাবছি আমি? আর কিছুতেই ভাববো না আমি ওই বজ্জাত লোকটার কথা।
মনকে নানান ভাবে বুঝিয়েও যেন কাজ হলো না। ফুপির দিকে তাকিয়েই ফট করে বলে উঠলাম,
“উনি কোথায়? কিছু বলেছে তোমাকে?”

সময় নিলো না ফুপি, আমি দিকে তাকিয়েই বলতে লাগলো,
“রাগ… রাগ, নিজে ভুল করবে আর আমাদের রাগ দেখাবে। সে কি আর বাসায় আছে, রাতে ফিরবে কি না তাও সন্দেহ, আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে সেভাবেই চলে গেল…. ”

“তোমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল মানে? কোথাও গিয়েছিলে তোমরা?”

চট করে আমার দিকে তাকালো ফুপি। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
“না…. মানে.. কোথায় যাবো বল? কোথাও যাই নি, তুই খাওয়াটা শেষ কর তাড়াতাড়ি।”

অনেকটা অবাক হলাম আমি। ফুপি যে মিথ্যে কথা বলছে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না আমার। কিন্তু কোথায় গেছিলো তাসফি ভাইয়ার সাথে? আর কখন -ই বা গেল? কথাটা হয়তো আমাকে জানাতে চায় না ফুপি, তাই ব্যাপারটা লুকিয়ে গেল। কিন্তু মনের কৌতুহলটা কিছুতেই দমাতে পারলাম না যেন।

.
গভীর রাতে শুনশান নীরবতায় হুটহাট কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। অন্যদিন ভয় না পেলেও আজকে কেন জানি ভয়টা জেঁকে ধরেছে মনে। মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠেছে দুপুরের পর তাসফি ভাইয়ের সেই ভয়ংকরী চেহারাটা। ওনাকে এমন ভাবে দেখবে, সেটা কখনোই ভাবি নি আমি। কলেজে আমার সাথে জয় কে দেখেই যে এমন রিয়াক্ট করেছেন, সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কি দেখেছেন উনি? আর কখন-ই বা কলেজে গিয়েছিলোন? উফ্! সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো লাগছে আমার। শত চেষ্টা করেও তাসফি ভাইয়ার ভয়টা কাটাতে পারাছি না যেন। বারংবার মনে হচ্ছে আমাকে সামনে পেলে আবারও ওনার সেই রুপটা বেরিয়ে আসবে।

ঘন্টা দুয়েক চোখ বন্ধ করে থেকেও ঘুমের রেশটা ধরা দিচ্ছে না দু’ চোখে। দিবেই বা কিভাবে? বিকেলে থেকে রাতের বারোটা পর্যন্ত তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। ঘুম না আসা টাই স্বাভাবিক। রুমে আসার পর তখন থেকেই আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি। ভাবনার পুরোটা জুড়ে শুধু তাসফি নামক বজ্জাত লোকটাই আছে। আজকের পর ওনার সামনে যাবার সাহসটায় হয়তো আর হবে না আমার।

গালের হালকা ব্যাথার কারণে এক পাশ হয়েই শুয়ে ছিলাম। কিছুর একটা স্পর্শ পেতেই হালকা চিনচিন করে উঠলো গালটা। ঘুমটাও হালকা হয়ে এলো। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম জানি না। আবারও গালে কিছু একটা অনুভব হতেই কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। গালের ব্যাথাটাও দ্বিগুণ অনুভব হলো। বজ্জাত লোকটা কতটা জোরে মে*রেছে, যে এতটা ব্যাথা হচ্ছে। এতটুকুও কি মায়া হলো না এভাবে মা*রার সময়? হবেই বা কেন, আমাকে তো একটুও ভালোবাসেন না, যে আমার প্রতি মায়া জন্ম হবে? ওনার সবকিছুতেই তো কিয়ানা আছে। ঘুমের রেশটা পুরোপুরি না কে*টেই হঠাৎই অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“আ..আপনি খুব খারাপ… খুব খারাপ আপনি তাসফি ভাই। ভয় লাগছে আমার, অনেক ভয় লাগছে আ..আপনাকে। যাবো না আপনার সামনে, আর আপনার সামনে আ..আসবো না, কখনোই না….”

আবারও গালে একই ভাবে স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলাম। প্রচন্ড ব্যাথার কারণে ঘুমের রেশটাও পুরোপুরি কেটে গেল। গালের স্পর্শটা একটু গভীর হতেই ‘আহ্!’ করে মৃদু আত্মদান করে উঠলাম। কারোর অস্তিত্ব বুঝতে পেরে চমকে উঠলাম। মনের ভয়টা হঠাৎই শতগুণে বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে চোখ দুটো খুলে সামনের পুরুষালীর অবয়ব ভেসে উঠলো চোখের সামনে। এক মুহুর্তের জন্য শরীরের দূর্বলতা ও ব্যাথাটা ভুলে গিয়ে ধরফর করে বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলাম,
“কেক্…কে আপনি… কি.. ক্..করছেন…”

“শান্ত হু! আমি….”

তাসফি ভাইয়ের গলা ভেসে আসতেই আরেক দফা অবাক হলাম যেন। আবছা আলোয় ওনার চেহারাটা দেখতে পেতেই বুঝতে পারলাম সত্যিই উনি। কিন্তু মনের ভয়টা কমার চেয়ে আরও বেড়েই গেল যেন, এতরাতে এখানে কি করছেন উনি? আবারও কি মা*রবেন আমাকে? এখন তো ফুপিও নেই, তাহলে কে বাচাবে আমায়? ভয়ে গুটিয়ে নিলাম যেন নিজেকে। ওনার ভয়টা কিছুতেই কা*টাতে পারছি না। কাঁপা কাঁপা গলায় অস্পষ্ট সুরে বলতে চেষ্টা করলাম,
“ক্যা…কেন এসেছেন? আ..আমি তো কিছু করি নি, ওর সাথে কথা বলতে চাই নি আমি… আ..আর যাবো না… যাবো না আমি কলেজে…”

আমার কথার মাঝেই এগিয়ে আসলেন উনি। ওনার এগিয়ে আসায় আরও ভয় পেলাম, সরে যেতেই দু’ হাতে বাহু চেপে আটকে নিলেন আমায়। ছটফটিয়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেও পেলাম না, তবুও ছাড়ানোর চেষ্টা করে গেলাম। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলতে লাগলেন,
“এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর? রুপু…. রুপু শান্ত হু, কিছু করবো না তো আমি।”

ওনার কথায় কাজ হলো না কোন। বারবার ওনার সেই ভয়ংকর চেহারা ভেসে উঠতে লাগলো চোখের সামনে। উনি আবারও আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলেন,
“এ্যাই রুপু শান্ত হু, দেখ আমাকে। কিছু করবো না তো, ভয় পাচ্ছিস কেন? তখনকার জন্য ভয় পাচ্ছিস না? কিছু করবো না তো, একদম ভয় পাবি না।”

নিজেকে কিছুটা হলেও শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কেন জানি মনে হলে সত্যিই এখন আর কিছু করবেন না। ছটফট করা থামিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে ওনার কথা শোনার চেষ্টা করলাম। উনিও কিছুটা শান্ত হয়ে চুপ করে গেলেন। বেশ কিছু সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমাকে ভয় পাচ্ছিস কেন? রুপুসোনা! সরি! তখন একদম উচিত হয় নি এভাবে গায়ে হাত তোলা। একদম ভয় পাবি না আমাকে….. সরি তো! রুপুসোনা, তাকা আমার দিকে, দেখ আমাকে।”

আস্তে করে মাথা উঠিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কেন জানি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসলো কান্নাগুলো। হঠাৎই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সাথে সাথে দু’ হাতে জড়িয়ে ওনার বুকের মাঝে আঁটকে নিলেন আমাকে।

.
.
চলবে……