তুমি বললে আজ পর্ব-২+৩

0
547

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০২.

.
মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত কারোর দেখা পেলে যেমন খুশির সীমা থাকে না, তেমনি অনেক সময় বিরক্তির কারণও হয়। এই মুহুর্তে আমারও ঠিক তেমনি হলো। খুশি নয়, প্রচন্ড বিরক্ত এসে ধরা দিলো সামনের মানুষটাকে দেখে। আমার তো আগেই বোঝা উচিত ছিলো, এই ছেলেটা ছাড়া আমাকে এভাবে মা/র/বেই না কে? কপাল কুঁচকে প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে বলে উঠলাম,
“এই শয়*তান তুই এখানে কি করছিস? আমাকে না মা*রলে তোর কি শান্তি হয় না হা*রামি?”

“না…. তোকে না মারলে শান্তি কেন? পেটের ভাতও হজম হয় না।”

বলেই আবারও আমার মাথায় আস্তে করে মা*রলো রাহাত। না লাগলেও রেগে গেলাম আমি, কটমটে চোখে তাকিয়ে বেশ জোরে করেই মে/রে দিলাম পর বাহুতে। বললাম,
“আবার মা/র/লি শয়*তান? কেন এসেছিস এখানে, কে ঢুকতে দিয়েছে তোকে বাসায়?

সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে তড়িৎগতিতে আবারও বলতে লাগলাম,
“সেদিন কত করে বললাম আসলি না, তবে আজকে কেন এসেছিস? এক্ষুনি বেরিয়ে যাবি বাসা থেকে। শয়*তান কোথাকার!”

“আমার মামার বাসায় আমি আসবো, তাতে তোর কি রে পেতনী? সর সামনে থেকে। স*ঙ্গের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

বলেই আবারও মা/র/লো রাহাত। এবার বেশ জোরেই লাগলো। রেগে উঠে ওকে মা/রা/র জন্য এগিয়ে যেতেই ছুটে গেল সেখানে। দুই সেকেন্ডের মতো সময় যেতেই যখন বুঝতে পারলাম রাহাত পালাচ্ছে তখন সাথে সাথে আমিও দৌড়ে গেলাম ওর পিছনে। কিন্তু ধরতে পারলাম না, তার আগেই রুমে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলো। আমি দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিতে রাহাত বলে উঠলো,
“দরজা ধাক্কা দিয়ে কোন লাভ নাই, এত তাড়াতাড়ি আর দরজা খুলছি না।”

রাহাত, আমার ফুপাতো ভাই। আব্বুর চাচাতো বোনের ছেলে। চাচাতো বোনের চেয়ে নিজের বোন বললেও ভুল হবে না। গ্রামে আমাদের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর পরিবার রয়েছে। যদিও এখন আর তেমন একটা যাওয়া হয় না সেখানে। রাহাতের মা রামিসা ফুপি এবং সামিরা ফুপি বড় দাদুর মেয়ে। ফুপিরা ছোট থাকতেই নাকি বড় দাদু মা/রা যান, বড় দাদুর কোন ছেলে না থাকায় কেউ দেখতে পারতো না তাদের। তখন থেকেই নাকি বড় চাচা এবং আব্বু মিলে চাচাতো বোন কম নিজের বোনের মতো করেই দেখাশোনা করে চলেছে। ফুপির সাথে সাথে রামিসা ফুপি এবং সামিরা ফুপিরও আসা যাওয়া লেগেই থাকে। সেই সাথে সামিরা ফুপির দুই ছেলে সাহিল ভাইয়া, সাগর ভাইয়া এবং রামিসা ফুপির দুই ছেলে মেয়ে রাহাত ও রিমারও যাওয়া আসা লেগেই থাকে বাসায়।
রিফাপুর পরেই রাহাতের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ সরল সহজ। তবে একে অপরেকে খোঁচা দেওয়া, মা/রা/মা/রি যেন লেগেই থাকে সবসময়।

রাহাতের দরজা আঁটকে দেওয়ায় বেশ রাগ হলো আমার। জোরে করে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলে উঠলাম,
“তুই খালি একবার বের হু শয়*তান, তারপর দেখ তোর কি হাল করি আমি?”

রুমের ভেতর থেকে হেঁসে উঠলো রাহাত। বলতে লাগলো,
“ওই বে*হাল শরীর নিয়ে আমার কি হাল করবি তুই? নিজে আগে ৪০ থেকে ৪১ হয়ে দেখা তারপর আমার সাথে লাগতে আসিস।”

হো হো করে হাসতে হাসতে আবারও বলে উঠলো,
“যার টেনশনে দিন দিন এমন পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছিস, তার টেনশন এবার ছেড়ে দে। সে বউ নিতেই দেশে ফিরবে, দেখিস।”

রাহাতের শেষ কথাটা কানে আসতেই চমকে উঠলাম যেন, একদম স্থির হয়ে গেলাম সাথে সাথে। ও যে তাসফি ভাইয়ার কথায় বললো, সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগলো না আমার। কিন্তু বউ নিয়েই দেশে ফিরবে মানে? কাথাটা ঠিক মাথায় ক্যাচ করতে পারলাম না যেন। ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। তার মানে কি ওনার সেই বান্ধবীকেই বিয়ে…
না… আর ভাবতে পারলাম না কিছু, আর না পারলাম সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। এতক্ষণ মনটা একটু ডাইভার্ড হলেও এখন আবারও তাসফি নামক মানুষটা বাসা বাঁধলো মনে এবং মস্তিষ্ক জুড়ে।

.
ঘুম প্রিয় মানুষের একটু বিছানা পেলেই রাজ্যের ঘুম এসে ধরা দেয়। আমিও সেই একই পথের পথিক। ঘুম প্রিয় একজন মানুষ। গোছল সেরে বিছানায় এসে একটু গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে ধরা দেয় চোখে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারি নি। ১২ টার সময় খাবার খেয়েছিলাম, তাই হয়তো এতক্ষণে কেউ ডাকও দেয় নি।
ঘুমটা আরও একটু আলগা হতেই বুঝতে পারলাম মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। টিপটিপ করে চোখ মেলে তাকাতেই হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে।

“কখন আসছো?”

ঘুম ঘুম গলায় বলেই মাথাটা উঠিয়ে ফুপির কোলে রাখলাম। আমার কান্ডে হালকা হাসলো ফুপি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বললো,
“উঠবি কখন? একটু পরেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে, দুপুরে কিছু খাস নি বলে? না খেয়ে শরীরটার কি অবস্থা করছিস? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”

“উহুম! ভালো লাগে না। তুমি কখন আসছো? আমাকে ডাকো নি কেন?”

“তুই যখন ঘুমিয়ে পড়িস, তাই আর ডাকা হয় নি। এখন উঠ, ফ্রেশ হয়ে নে।”

“আর একটু থাকি না, এভাবে…. ”

“ফুপি আম্মু ডাকছে তোমায়, পায়েস রান্না করবা বলল্….”

রিফাপু রুমে এসে কথারা বলতে বলতে থেমে গেল। আমি একটু নড়েচড়ে রিফাপুর দিকে তাকালাম। বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম কিশোর পায়েস রান্নার কথা বলতে বলতে থেমে গেল। রিফাপুর দিকে তাকিয়ে বলেই ফেললাম,
“কি হয়েছে রিফাপু?”

রিফাপু কিছু বলার আগেই ফুপি বলে উঠলো,
“সামিরা আপা আর রামিসা আপাও আসতে, তাই টুকটাক রান্না করছি, তুই ফ্রেশ হয়ে বাইরে আয়।”

বলেই আর বসে থাকলো না ফুপি, আমার মাথাটা কোল থেকে উঠিয়ে দূত পায়ে রুম ছেড়ে চলে গেল।রেহেনা ফুপি, আমার সব থেকে কাছের একজন মানুষ। আমাকে যেন একটু বেশিই ভালোবাসে ফুপি, আর আমিও ফুপিকে যেমন ভালোবাসি তেমনি শ্রদ্ধা ও সম্মানটাও করি। আমাকে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করে ফুপি, বিশেষ করে তাসফি ভাইয়ার ধমক থেকে সবসময় আগলে রাখতো। গত চার বছর ধরে অবশ্য তার প্রয়োজন পরে না, বরং ফুপিই আফসোস করে তাসফি ভাইয়ের জন্য।

ফুপি রুম ছেড়ে যেতেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। রিফাপু কে উদ্দেশ্য করে বললাম,
“হঠাৎ ফুপিরা দলবল বেঁধে চলে আসলো কেন রিফাপু? বাসায় কিছু হচ্ছে নাকি?”

কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল রিফাপু, আমি কপাল কুঁচকে তাকাতেই আবার বললো,
“সারাদিন ম/রা/র মতো না ঘুমিয়ে বাইরে আয়, তাহলেই বুঝতে পারবি।”

অবাক হয়ে গেলাম কিছুটা। কি এমন হলো যে, সবাই একসাথে চলে আসলো? অবশ্য একসাথেই আসা হয় সবার, কিন্তু হঠাৎ আজকে? রিফাপু কে আর কিছু বলেও জানতে পারলাম না, আমাকে সেই সুযোগটা না দিয়েই রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। চটপট ফ্রেশ হয়ে নিলাম বাইরে যাবার জন্য।

.
চুপচাপ স্থির হয়ে বসে আছি সোফার এক কোণায়৷ এই মুহুর্তে যেন কোন রিয়াকশন দিতেই ভুলে গেছি আমি। সকালে দেখা স্বপ্নটা যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে, সেটা আমার সকালের পর আর মাথাতেই আনি নি। সকালের স্বপ্নটাই শেষমেশ সত্যি হলো। কিন্তু এখন কি করবো আমি? ওনার থেকে পালিয়েই বা থাকবো কি করে?

তখন রুম ছেড়ে বেড়িয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে চলে আসি, ফুপিদের সাথে কথা বলে রিফাপু ও রিমার সাথে আড্ডা দিতে শুরু করি। তিন জনের আড্ডার মাঝে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গিয়েছে, বুঝতেই পারি নি। আম্মু বড়মা ও ফুপির রান্না তবুও শেষ না হওয়ায় হঠাৎ কি জানি মনে করে, একটু রান্না ঘরে উকি দিয়েছিলাম। এতএত রান্না দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম, জিজ্ঞেস করলেই বড়মা বলে উঠে, ফুপিরা আসছে জন্য এত রান্না হচ্ছে। কিন্তু তবুও যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারি নি বড়মার কথাটা। আবারও ড্রয়িং রুমে ফিরে এসে, এত এত রান্না কেন হচ্ছে বাসায়? বলতেই রিমা ফট করে বলে উঠলো,
“কেন রূপা, তুই কি জানিস না, আজকে তাসফি ভাইয়া আসবেন। সেজন্যই তো আমরা সকলে মিলে চলে আসলাম। ইস্ কতদিন পর ভাইয়া আসছে।”

রিমার কথাগুলো শুনে আমি নিরুত্তর হয়ে গেলাম। রিফাপুর দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুঝতে আর এতটুকুও সময় নষ্ট হলো না যে সত্যিই আজকে তাসফি ভাইয়া আসছেন।
সকলের মাঝে আর বসেও থাকতে পারছিলাম না। উঠে চলে আসতেই ফুপি বাধা দিলো। হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিলো। এক প্লেট খাবার সামনে দিয়ে বকতে শুরু করলো আমাকে। ঠিক ভাবে খাই না কেন, বাড়তি বয়সে না খেয়ে না খেয়ে এমন শুখিয়ে যাচ্ছি কেন? সবগুলো খাবার যেন শেষ করি। ফুপির সাথে সাথে আম্মুরও বকাঝকা শুরু হয়ে গেল, আর সেটা ফুপির থেকেও দ্বিগুণ ভাবে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও এক ভাবে খাবারগুলো গি*লতে শুরু করলাম। তা না হলে আম্মুর বকাটায় হয়তো হজম হয়ে যাবে। আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসতে হাসতে রিফাপু ও রিমাও এসে বসলো ডাইনিং টেবিলে। ওদের হাসিতে ভীষণ রাগ হলো আমার, তবুও কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। আপাতত এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচি আমি। কোন ইচ্ছে নেই ওনাদের আদরের ছেলে আসার পর সবার আদিক্ষেতা দেখার।
খাওয়া শেষ করে, উঠে রুমে আসার জন্য পা বাড়াতেই আম্মু বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“কোথায় যাবো আবার? রুমে যাচ্ছি।”

“এখনি যাচ্ছিস কেন? এতদিন পর ছেলেটা আস….”

কথার মাঝেই থেমে দিলাম আম্মুকে, বেশ করেই বুঝতে পারলাম ঠিক কি বলতে চায় আম্মু। বলে উঠলাম,
“তো? আমার তো এখানে কোন কাজ নেই। তোমাদের আদরের ছেলে আসছে, এতএত রান্না করছে খাওয়াও তাকে, মাথায় তুলে রাখো। আমি কি করবো তাতে?”

বলেই জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম। তারপর ফুপির দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি রুমে যাচ্ছি ফুপি। সবাইকে বলে দিবা, কেউ যেন না ডাকে আমাকে।”

আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে চলে আসলাম সেখান থেকে। রুমে এসে দরজা ভালোভাবে লক করে বার কয়েক নিশ্বাস নিলাম জোরে জোরে। কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো, সেই সাথে বুকের টিপটিপ শব্দটা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকলাম কয়েক মিনিট, তবু্ও যেন কোন কাজে দিলো না। ভেতর থেকে কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো, কিন্তু চেষ্টা করেও চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়াতে পারলাম না।
ফ্লোরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। কিছু একটা মনে করে মোবাইল নিয়ে অনলাইনে ঢুকলাম। ফেসবুকের সেভ অপশনে গিয়ে কয়েকটা ছবি বের করতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। টপটপ করে চোখের অবাধ্য অশ্রুগুলো পড়তে লাগলো অনায়াসেই।

চার পাঁচ বছর আগের তাসফি ভাইয়ের কিছু ছবি জ্বলজ্বল করছে মোবাইলের স্ক্রিনে। হাসি মুখে বিভিন্ন স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছেন সবার সাথে, কোন কোন ছবিতে নিজেই সেলফি উঠিয়েছেন। ছবিগুলো রিফাপু এবং রাহাতের আইডি থেকে পোস্ট করা। হুটহাট করেই যখন ওনাকে দেখতে ইচ্ছে হয়, তখনই অবাধ্য মনটাকে বাঁধা না দিয়ে ছবি গুলো দেখতে থাকি। কেন দেখি সেটা নিজেও জানি না। হয়তো পুরানো কিছু স্মৃতিতেই একটু তৃপ্তি খুঁজে পাই, অবাধ্য মনটা একটু শান্তনা খুঁজে পায়।

.
সকালে ঘুম থেকে উঠে, নিজেকে বিছানায় পেয়ে বেশ অবাকই হলাম। বুঝতে পারলাম না বিছানায় কখন আসলাম। যতদূর মনে আছে, কাল রাতে তো আমি ফ্লোরে-ই বসে ছিলাম। তাসফি ভাইয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভেবে চলেছিলাম, সদ্য কিশোরী বয়সের প্রথম ভালোলাগা আর আবেগের কথাগুলো। কখন যে রাতের দুইটা বেজে গেছিলো নিজেই বুঝতে পারি নি। হঠাৎ পানির তেষ্টা পেয়েছিলো, রুমে পানি না থাকায় বেড়িয়েও এসেছিলাম বাইরে। বোতল ভর্তি করে পানি নিয়ে সাথে সাথেই চলে এসেছিলাম রুমে। আবারও ফ্লোরে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে দেখে চলেছিলাম তাসফি ভাইয়ের সেই পুরোনো ছবি গুলো। তারপর? তারপর…. কখন যেন ঘুমিয়ে গেছিলাম নিজেরই মনে পড়ছে না। কিন্তু বিছানায় আসলাম কিভাবে, সেইাই বুঝতে পারছি না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দরজাটাও লাগানো আছে। হয়তো ঘুমের মাঝেই বিছানায় এসেছিলাম। এই ছোট বিষয়টা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। মোবাইলে সময়টা দেখে বেশ অবাকই হলাম। সাড়ে নয়টা বাজে। বেশি রাত জাগার ফলে অনেকটা দেরিতেই ঘুমটা ভেঙেছে, ভাগ্যিস আজকে কলেজ নেই। তবুও নিজের অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে আসতেই, অনুভব করলাম প্রচন্ড খুদায় পেটের মাঝে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে।

ডাইনিং রুমে আসতেই সবার আগে ফুপিকে নজরে এলো। ফুপিকে দেখেই বলে উঠলাম,
“তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দাও ফুপি, প্রচন্ড খুদা লাগছে।”

আমার কথার ভঙ্গিতে হাসলো ফুপি। আমাকে বসতে বলে চলে গেল রান্নাঘরে। এবার বড়মা আর আম্মুরও দেখা পেলাম। আমাকে দেখেই আম্মুর সেই বিখ্যাত বকাগুলো শুরু হয়ে গেল। প্রতিত্তোরে কিছুই বললাম না আমি, কিছু বললেই আরও বেশি কিছু শুনতে হবে এটা নিশ্চিত আমি। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসে পড়লাম। সোফায় বসে মোবাইলটা হাতে নিতেই ফ্লোরে বিছিয়ে থাকা কিছু কাগজ এবং শপিং ব্যাগের দিকে চোখ পড়লো। কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম আসলে ব্যাগগুলো কীসের হতে পারে।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই তড়িৎগতিতে লাফিয়ে উঠলাম সোফা ছেড়ে। ধুকপুক করতে লাগলো বুকে। তার মানে ত..তাসফি ভাইয়া এসেছেন রাতে? হঠাৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে উনি আছেন কি না। বুকের ধুকপুক শব্দের সাথে সাথে নিশ্বাসের আনাগোনাও বাড়তে লাগলো। না…. আর এক সেকেন্ডও এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, কিছুতেই ওই মানুষটার সামনে পরা যাবে না আমার। নিজেকে ধরা দিতে চাই না আমি ওনার সামনে, আর না ওনাকে দেখতে চাই। এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে এক প্রকার ছুটতে লাগলাম নিজের রুমের দিকে।

বড় ড্রয়িং রুম পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই আচমকা সামনে থেকে ধাক্কা লাগলো কারোর সাথে। ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। বুকের টিপটিপ শব্দটা ভয়ের তাড়নায় দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আধা মিনিটের মতো সময় যেতেই যখন একটু একটু করে অনুভব করলাম, কারো উন্মুক্ত বুকের সাথে নিজের হাত দু’টো আঁটকে আছে, তখন চট করে চোখ দুটো খুলে ফেললাম। মাথা উঠিয়ে সেই মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠলাম। সেই সাথে হাত পায়ের শক্তিটাও যেন হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল।

.
.
চলবে……

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ০৩.

.
“বাহ্! চার বছরের অপেক্ষার ফল যে, সোজা বুকে আসার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিলো, ভাবতেই পারি নি।”

কথাটা কানে আসতেই তড়িৎগতিতে দু’হাতে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম তাসফি ভাইকে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে ছাড়লাম বার কয়েক। এতক্ষণ মনে হয় কোন একটা ঘোরের মধ্যে গভীরভাবে পড়ে গেছিলাম। এতদিনের ধমিয়ে রাখা আবেগটা সহসায় বেড়িয়ে আসতে চাইছিলো যেন। নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলাম। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে আবারও সামনের মানুষটার দিকেই স্থির হয়ে গেল। পুরনো সেই মানুষটিকে নতুন ভাবে তুমুল পরিবর্তনে আবারও তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ… চার বছর আগের সেই তাসফি ভাইয়ার সাথে কোনই মিল নেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই তাসফি ভাইয়ার। আগের গায়ের রংটাও নেই। চার বছর আগে ওনার গায়ের রং ফর্সা হলেও এখন যেন ধপধপে ফর্সা হয়ে গেছেন। ফর্সা বুকে ও হাতের কালো লোমগুলো যেন আর গাড়ো কালো তে পরিণত হয়েছে। আগের সেই ছোট বড় চুলগুলোও নেই, সমান তালে বেড়ে কিছুটা কপাল সহ এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়িটা আগের চেয়েও অনেক বেশি গালে জায়গা করে নিয়েছে। পুরোনো কিছু খোঁজার আসায় খুঁটিয়ে দেখেও কিছুই খুঁজে পেলাম না পুরনো তাসফি ভাইয়ার মাঝে। মোটেও হতাশ হলাম না। চার বছর আগে পুরনো সেই মানুষটায় যখন হারিয়ে গেছে, তখন তার এই পরিবর্তন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস টেনে ছাড়ালাম। তাসফি ভাইয়ার দিকে আবারও একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। ওনাকে পাশ কেটে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই আবারও ভেসে আসলো সেই চেনা অচেনা গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

“চোখ দিয়ে খাওয়া শেষ, আমাকে? নাকি আরও বাকি আছে?”

বলেই অদ্ভুত একটা হাসি দিলেন উনি। কয়েক সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“তাইলে রুমে যাওয়া যাক? একাকী বন্ধ রুমে শুধু চোখ দিয়ে নয়, ওই কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দিয়েও টেস্ট করা যাবে।”

ওনার কথায় আমি আবারও কেঁপে উঠলাম। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাঁ/ম/ড়ে ধরলাম সাথে সাথে। চোখ তুলে ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম বাঁকা হেঁসে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। সাথে সাথে আবারও চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালাম। ব*জ্জা*ত লোকের অ*সভ্য কথা বলার স্বভাবটা এখনো যায় নি। না…. এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকায় যাবে না। কিছুতেই ওনার এই হাসির মায়ায় দ্বিতীয় বার পরা যাবে না, কিছুতেই না। ওনার কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে চলে আসতে লাগলাম, বড় বড় ধাপে পা ফেলে ওনাকে বেরিয়ে চলতে আসতেই খপ করে আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললেন। হঠাৎ করে হাত ধরায় আমি আবারও প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠলাম, বুকের বা পাশের টিপটিপ শব্দটা আবারও বাড়তে লাগলো।

উনি হাত ধরে টেনে ওনার সামনে নিয়ে আসলেন আমাকে। আমি কোন কথা না বলে শুধু হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমার ছটফট করতে দেখে ধমকে উঠলেন তাসফি ভাইয়া।
“এখনো লাফালাফির স্বভাবটা যায় নি? কথা বলছিস না কেন? বেয়াদব!”

প্রচন্ড শক্ত করে হাতটা চেপে ধরায় অনেক ব্যাথা পেলাম। ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। ওনার কথার কোন জবার না দিলেও অজান্তেই মুখ ফুটে অস্পষ্ট সুরে বেরিয়ে আসলো,
“আহ! লাগছে আমার।”

কিছুটা নরম হয়ে এলো ওনার হাতের বাঁধন। হাতটা আলগা করে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামিয়ে নিলেন, আলতো করে পাঁচ আঙ্গুলে পুরে নিলেন আমার হাতটা। আমাকে আরও একটু টেনে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলেন। আস্তে করে বললেন,
“আমারও লেগেছে…. অনেক বেশিই লেগেছে, কিন্তু কাউকে দেখাতে পারি নি।”

ওনার দিকে তাকিয়েই ফট করে চোখ দু’টো নামিয়ে নিলাম। কেন জানি তাকাতে পারছি না ওনার দিকে, মনে হচ্ছে এখনি হয়তো ডুবে যাবো ওনার চোখের গহীনে। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলাম,
“এভাবে অ*সভ্যের হাত ধরার মানে কি? ছাড়েন আমাকে। মামাতো বোনের হাত ধরাধরি করে কি বোঝাতে চাইছেন?”

আমার কথায় উনি দ্বিগুণ শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন। এবার হাতের আঙুলে চা*প পরায় ব্যাথায় কুকিয়ে গেলাম। আবারও আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। ছলছল চোখে বলে উঠলাম,
“লাগছে আমার। ব্যাথা লাগছে আমার।”

“ব্যাথা লাগছে? কিন্তু কষ্ট…. কষ্ট তো পাচ্ছিস না।”

“হ্যাঁ…. পাচ্ছি। অনেক কষ্ট পাচ্ছি আমি। কেন এভাবে হাত ধরে টানাটানি করছেন ভাইয়া? এগুলো আমার একদম পছন্দ নয়, ছাড়েন বলছি।”

শক্ত কণ্ঠে কথাটা বলেই অন্য হাত দিয়ে অনেকটা জোরেই ধাক্কা দিলাম ওনাকে। কিছুটা পিছিয়ে যেতেই হাতটা আলগা হয়ে গেল, সাথে সাথে ছুটিয়ে নিলাম ওনার হাত থেকে। অনেকটা অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি পাত্তা দিলাম না, দিতে চাইও না, আর না আবারও ওনার মায়ায় পড়তে চাই। ওনাকে সাইড কে/টে দুই পা এগিয়ে আসলাম। হঠাৎ থেমে গিয়ে ওনার দিকে ঘুড়ে তাকালাম, উনিও তাকালেন। আমি আগের চেয়েও দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“মামার বাড়ি ঘুড়তে আসছেন, ঘুড়েন। মামীদের আদর যত্নের সাথে ভালো মন্দ খান। একদম আমার কাছে আসবেন না, হাত ধরাধরির চেষ্টা করবেন না। তাইলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।”

“তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস রুপু, এখন আর আমার কোন বাধা নেই।”

কথাটা বলেই চলে আসতে নিলে ওনার কথায় থেমে গেল আমার পা দু’টো। তবে এবার আর পিছন ফিরে তাকালাম না। প্রতিত্তোরে কিছু বললামও না।
কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সোজা চলে আসলাম রুমে। দরজা আঁটকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। না চাইলেও বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো এক নতুন তাসফি ভাইয়ার চেহারা।
মিনিট বিশেকের মতো সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম। নিজেকে ওনার প্রতি দূর্বল বানিয়ে কোন লাভ নেই, যে মানুষটা আমার নয় তাকে নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। ওনাকে নিয়ে ভাবার অনেক মানুষ আছে, আমার থেকেও অনেক কাছের মানুষ, ওনাকে ভালোবাসার মানুষ।

.
রুমের ছোট বারান্দায় বসে আকাশ কুসুম ভেবে চলেছি। ভাবনার পুরোটা জুড়েই শুধু একটা মানুষেরই বিচরণ, আর সেই মানুষটা অবশ্যই তাসফি ভাইয়া। মানুষটাকে যতই মন মস্তিষ্ক থেকে বের করতে চাই, ততই যেন আরও বেশি জেঁকে বসে। ওনাকে দেখার পর যেন একটু একটু করে জমিয়ে রাখা ওনার প্রতি খোপ, অভিমান সবকিছুই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। নতুন তাসফি ভাইয়ে দেখে, আবারও যেন কিশোরী বয়সের সেই আবেগ গুলো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। না…. ওনার কথা কেন এতটা ভাবছি আমি? অন্য কিছুতে মন দিতে হবে। আপাতত মোবাইলে ডুবে থাকলে ওনার থেকে মু*ক্তি পাবো হয়তো।
ভেবেই মোবাইল নেবার জন্য রুমে আসলাম। বিছানায়, টেবিলে, ড্রেসিং টেবিলে খুঁজেও পেলাম না। গেল কোথায় মোবাইলটা? সকালে তাসফি ভাইয়ার সাথে দেখা হওয়ার পর আর রুম ছেড়ে বেরোয় নি। প্রাণ প্রিয় একাকী মন খারাপের সঙ্গী ডায়েরিটা নিয়ে বসেছিলাম। নিজের অবাধ্য কিছু না বলা কথা গুলো কলমের কালে কালি দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলাম ডায়েরির পাতায়। কখন যে দুপুর হয়েছিলো বুঝতেই পারি নি, জোহরের আজান কানে আসতেই খেয়াল হয়। চটপট গোছলটা সেরে নামাজ পড়ে বারান্দায় চলে আসি। এতক্ষণে ফোনের কথাটা মাথাতেই ছিলো না। হঠাৎ মনে পরলো সকালে তো খাওয়ার সময় হাতে দিয়ে বাইরে গেছিলাম। সোফায় বসে ফোন টিপতেই হঠাৎ তাসফি ভাইয়ার কথা মনে পড়ে। তারপর তো সেভাবেই ফোনটা ওখানে রেখে চলে আসছিলাম, তার মাঝ পথে তাসফি ভাইয়ার সাথে হঠাৎই ধাক্কা লাগলো।

তখনকার কথা মনে হতেই জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম। মোবাইলের কথা ভেবেই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দরজা খুলে বেরিয়ে আসলাম। বাইরে আসতেই রিফাপুর সাথে দেখা হয়ে গেল, হয়তো আমার রুমেই আসছিলো। আমি কিছু বলার আগেই বলে উঠলো,
” সারাদিন রুমের মধ্যে কি করিস তুই? খাবি কখন? আম্মু ডাকছে, তুই না গেলে আমার পাতেও ভাত দিবে না।”

বলেই হাসলো রিফাপু। আমিও হালকা হেঁসে বললাম,
“দিবে না, তো খাবে না। এক বেলা না খেলে কি এমন হবে বলো?

“তোর খাওয়া লাগে না জন্য, আমারও কি খাওয়া নাই? আমি তোর মতো ওমন না খাওয়া পাটি না বাবা, আজকে তো আরও না। স্পেশাল ভাবে রান্না হয়েছে কি না।”

“সেগুলো তো আর তোমার জন্য হয় নি, যার জন্য হয়েছে তাকেই বেশি বেশি গি*লতে বলো। হু!”

“উফ্ রূপা, তুই না বড্ড বেশি কথা বলিস। এখন চল তো তাড়াতাড়ি।”

“উমহু্! ভালো কথা বললেই বেশি কথা বলি, না? চলো।”

বলেই আর দাঁড়ালাম না। রিফাপুর আগেই হাঁটতে লাগলাম। রিফাপুও আসতে লাগলো। ডাইনিং রুমে আসতেই নজরে এলো সবাইকে। বড় টেবিল টাকে বুক করে বসে গেছে যে যার মতো। সবার সাথে সাগর ভাইয়া, রাহাত কেও নজরে এলো, শুধু মাত্র বড় চাচা, আব্বু এবং ফুপারা ছাড়া। হয়তো ওনারা আগেই খাওয়া শেষ করেছে। ছয় জনের ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে তাসফি ভাইয়া, সাগর ভাইয়া, রাহাত, রিমি বসেছে। তাসফি ভাইয়ার পাশের চেয়ার সহ আরও একটা চেয়ার বাকি পড়ে আছে। বড়মা বসতে বললেই আমি এগিয়ে গেলাম চেয়ারের দিকে। আমি বসার আগেই হঠাৎ রিফাপু ছুটে গিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে। আমি আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হলো। এখানেই কেন বসে হলো? রিফাপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কি হলো? এখানে বসলে কেন, আমি কোথায় বসবো?”

“ওই চেয়ারে গিয়ে বস। বললাম আমার খুদা লাগছে। আর একটা তে বসলেই তো হলো।”

রিফাপুর দিকে করুন চোখে তাকালাম, বোঝাতে চাইলাম ‘তোমার ব*জ্জা*ত ভাইয়ের পাশে আমি কিছুতেই বসবো না। তাতেও যেন কোন মায়া হলো না তার। এর মাঝেই ধমকে উঠলো আম্মু। বললো,
“হা করে স*ঙ্গের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর জন্য কি পরে আবার নতুন করে খাবার বারবো? বস ওখানে।”

আম্মুর কথা শেষ হতেই তাসফি ভাইয়া বলতে লাগলেন,
“তোমার মেয়েকে একটু বেশি বেশি করে খাওয়াও মামী। যে পাটকাঠির শরীর বানাইছে, দু’দিন পর তো তোমার জামাই ওকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাবে না। তোমার নাতি নাতনির কথাগুলো তো বাদ-ই দিলাম।”

সবগুলো একসাথে হেঁসে উঠলো ওনার কথায়। আমি রাগী চোখে ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম বাঁকা হেঁসে একদিকেই তাকিয়ে আছেন। আম্মু আবারও আমায় ধমকে উঠে বসতে বললো। অগ্যতা তাসফি ভাইয়ের পাশের চেয়ারটাতে গিয়েই বসতে হলো। আমি বসতেই আম্মু আমার প্লেটে খাবার দিতে দিতে তাসফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
“সারাদিনে একবার খেলে খাওয়ার কথা আর মুখেই আনে না। এখন তুই আসছিস, দেখিস ধমকে ধামকে যদি একটু খাওয়া তে পারিস। মানুষের ওজন দিন দিন বাড়ে আর ওর ওজন নিচের দিকে নামে।”

“তোমার মেয়ে কিন্তু অনেক বড় হয়ে বড় হয়ে গেছে মামী।”

বলেই চুপ হয়ে গেলেন উনি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেই দেখলাম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হঠাৎ আমার আর তাসফি ভাইয়ার মাঝে দাঁড়ানো আম্মুর দিকে চোখ পড়লো। একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তাসফি ভাইয়া আমার দিকে থেকে চোখ সড়িয়ে আম্মু দিকে তাকালেন। হালকা হেঁসে বললেন,
“আমার ধমকে আর কাজ হবে না। তোমার মেয়ে তো আর ছোট নেই, যে আমার ধমকে কথা শুনবে।”

আম্মু কোন কথা বললো না। তাড়াহুড়ো করে প্লেটে খাবার দিয়ে দূত পায়ে চলে গেল। আম্মুর এমন ব্যাবহারে অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কি হলো। হয়তো কাজ আছে, তাই আর কথা বাড়ায় নি।
সাতপাঁচ চিন্তা করা বাদ দিয়ে খাওয়ায় মন দিলাম। সবাই তাসফি ভাইয়ার সাথে টুকটাক কথা বললেও আমি চুপ করেই রইলাম। হঠা মোবাইলে রিংটোনের শব্দে আমার মতো সবাই চুপ হয়ে গেল। আমি মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করলাম কার ফোন বাজে। তাসফি ভাইয়ার পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলাম ওনার মোবাইল বাজছে। হঠাৎ কি জানি মনে মনে করে মোবাইলের স্ক্রিনে নজর দিলাম। সহসায় কিছুটা চমকে উঠলাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। ওনার মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে তিন অক্ষরের ‘কিয়ানা’ নামটা। যেটা আমার কাছে প্রত্যাশিত হলেও হৃদয় পুড়ানোর একমাত্র কারণ।

.
.
চলবে…….

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤