তুমি বললে আজ পর্ব-৪+৫

0
501

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৪.

.
অতি কষ্টে এতক্ষণ পুরো মনোযোগ খাওয়ার প্রতি আনলেও আবারও সেটা হারিয়ে গেছে হঠাৎই। চাইলেও আর খাওয়ার প্রতি মন দিতে পারছি না। ভাত একটু মাখাইতে হাতের ব্যাথায় চিনচিন করে উঠছে। তখন তাসফি ভাইয়া এতোটাই জোরে হাতটা চেপে ধরেছিলেন যে, সেই ব্যাথার রেশ এখনো রয়েই গেছে। রয়ে গেছে বললে ভুল হবে, বরং আরও বেশিই বেড়ে গেছে। ভাত একটু মুখে দিতেই প্রচন্ড জ্বালা করছে হাতটা। তবুও কাউকে সেটা বুঝতে না দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল আসার পর হাতের ব্যাথা মনের ব্যাথা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
সামনের প্লেটে হাত দিয়ে সমানে নাড়াচাড়া করছি। দুই একটা ভাত মুখে দিচ্ছি আর একটু পর পর তাকাচ্ছি ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইয়ার দিকে। বিগত পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলেই চলেছে মোবাইলের অপর পাশের মানবীর সাথে। বেশ হেঁসে হেঁসেই কথা বলছেন উনি। ওনার এমন হেঁসে হেঁসে কথা বলায় আমার রাগ হচ্ছে না একটুও, এটা তো হওয়ারই ছিলো। ওনার ভালোবাসার মানুষের সাথেই তো কথা বলছেন, এতে তো আমার রাগ হওয়ার কথা নয়। তবে মিশ্র একটা শুন্য অনুভূতিতে ভরে উঠেছে আমার মন। অদ্ভুত একটা ব্যাথা হচ্ছে বুকের বা পাশে। চাইলেও খাওয়ায় মনোযোগী হতে পারছি না।

“কে ফোন করেছিলো তাসফি? খাবার ছেড়ে উঠেছিলি কেন?”

বড়মার কথায় ভাবনা গুলোর ছুটি দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। পাশে তাকাতেই দেখলাম তাসফি ভাইয়া চেয়ারে বসছেন। ওনার ফোন বাজতেই সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে যান ড্রয়িং রুমে।

বড়মার কথায় উনি সময় না নিয়ে সাথে সাথেই বলে উঠলেন,
“কিয়ানার ফোন ছিলো মামী। কালকে আসার পর আর কথা হয় নি, তাই ফোন দিয়েছিলো।”

তাসফি ভাইয়া আমার দিকে তাকাতেই চট করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। বড়মা একটু সময় বললেন,
“তোর সাথেই ফিরলো কালকে?”

“হ্যাঁ”

“একদিন আসতে বল মেয়েটাকে, ঘুরে যাক। আগে তো কতো আসতো তোর সাথে।”

“হ্যাঁ… বললো।”

ছোট করে জবাব দিয়েই চুপ হয়ে গেলেন। তাসফি ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম আমার দিকেই হয়তো তাকিয়ে আছেন উনি। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টুকরো টুকরো ভাবে খাবারগুলো মুখে দিয়ে গি*লতে লাগলাম। বড়মা হঠাৎ আমাকে বললেন,
“তাড়াতাড়ি খাওয়া বাদ দিয়ে এমন থম মে*রে বসে আছিস কেন? তোর ফুপিরা কখন খাবে? তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।”

আর এক টুকরো খাবারও মুখে পু*ড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না, আর না এখানে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। বড়মার কথায় তবুও একটা কারণ খুঁজে পেলাম। গ্লাস বাড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে বড়মা দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বলে উঠলেন,
“উঠে গেলি কেনো? খাওয়া শেষ কর।”

“আর খাবো না বড়মা, একদম পেট ভরে গেছে।”

“যেমন খাবার তেমনি তো পড়ে আছে প্লেটে, কি এমন খেলি যে পেট ভরে গেছে?”

বড়মার কথায় প্লেটের দিকে তাকালাম একবার। বললাম,
“সকালে তো অনেক দেরিতেই খেয়েছিলাম, এখন আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পরে খেয়ে নিবো।”

“ওর আবার খেতে হয় নাকি মামী? তার চেয়ে বরং এদিকে পাস করে দে দে রূপা। আমরা আছি কি করতে?”

বড়মার কথা শেষ হতেই রাহাত বলে উঠলো। কপাল কুঁচকে তাকালাম আমি ওর দিকে, রা*ক্ষ*সের মতো করে খাচ্ছে, তাতেও যেন হচ্ছে না তার। রাহাতের কথা শেষ হতেই সাগর ভাইয়া বলে উঠলো,
“বড় মামীর হাতের রান্না কি মিস করা যায় নাকি? রাহাত ঠিক বলছিস তুই, এই রূপা তোর প্লেটটা এদিকে দিয়ে দে, খেতে হবে না তোর।”

“চুপচাপ খা তো তোরা। ওর সাথে লাগলি কেন? তুই বস এখানে, খাওয়া শেষ করে উঠবি।”

শেষ কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন বড়মা। আমি আবারও বারণ করলাম খাবো না বলে। বড়মা আবারও ধমকে উঠে বসতে বললেন আমাকে, তার বকতে বকতে রান্না ঘরে চলে গেলেন। বড়মা যেতেই সাগর ভাইয়া বললেন,
“ফু*ট এখান থেকে, খেতে হবে না তোর। তাসফি ভাই, ওর প্লেটটা এদিকে দিয়ে দাও। আমি আর রাহাত রেডি, অবশ্য তুমি চাইলে আমার আর না করবো না।”

তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকালাম একবার। এতক্ষণে কোন কথা বলেন নি উনি, চুপচাপ বসে দুই একবার মুখে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। তাসফি ভাইয়ার কথা বলায় একটু রাগ হলো আমার। ফুঁ*সে উঠে বললাম,
“আমিই দিচ্ছি, অন্যকে কেন বলছেন ছাগল ভাইয়া।”

“এই তুই আবারও আমায় ছাগল বললি? তোর জন্য আমার বন্ধু বান্ধব এমনকি গার্লফ্রেন্ড পর্যন্ত ছাগল ছাগল বলে ডাকা শুরু করছে।”

সাগর ভাইয়ার ধমকে থতমত খেয়ে গেলাম। সাথে সাথে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলাম। বারবার বলার পরেও ভাইয়াকে ঠিকঠাক ভাবে ডাকতে পারি না। ছোট বেলা থেকেই ছাগল ভাইয়া বলে বলে এমন অভ্যসে পরিণত হয়েছে যে, এখন আর সাগর নামটা মুখেই আসে না। সাগর ভাইয়ার রাগী ফেস্ দেখে সবাই হেঁসে উঠলো, শুধু চুপ করে থাকলেন তাসফি ভাইয়া। বমি আস্তে করে বললাম,
“হয়ছে হয়ছে, নেন আর বলবো না।”

বলেই চলে আসতে নিলাম ওখান থেকে। এক পা বাড়াতেই খপ করে আমার ডান হাতটা ধরে ফেললেন তাসফি ভাইয়া।

“কোথায় যাচ্ছিস? খাবারটা শেষ করে তারপর যাবি।”

এমনিতেই হাতটা প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছিলো, তার মাঝে শক্ত করে চেপে ধরায় আরও ব্যাথা পেয়ে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। চোখের কোণে এক দল অশ্রুকণা এসে ভীর জমালো।

“আহ্ লাগছে আমার তাসফি ভাইয়া।”

আমার কথায় কিছুটা আলগা হয়ে এলো ওনার হাত। তবে ছেড়ে দিলেন না, আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো বোঝার চেষ্টা করলেন, সামান্য হাত ধরতেই এমন কুঁকড়ে উঠলাম কেন? হাতটা নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। সাথে সাথে বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে তোর হাতে হাতে, এমন লাল হয়ে আছে কেন?”

বেশ উত্তে*জিত হয়ে কথাটা বললেন উনি। সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। আমি চট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
“কিছু হয় নি। খাবো না আমি।”

“কিছু হয় নি তাহলে খাবার ছেড়ে উঠছিস কেন? খাবারগুলো শেষ করে তবেই এখান থেকে উঠবি।”

বলেই আমাকে হাত ধরে বসিয়ে দিলেন তাসফি ভাইয়া। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার হাতের দিকে। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো আমার, হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হালকা চেঁচিয়ে ই বলে উঠলাম,
“বললাম তো খাবো না আমি, এতো জোর করার মানেটা কি তাসফি ভাই? নিজে খাচ্ছেন খান না, আমার হাত ধরে টানাটানি করছেন কেন? বলছি না, আমার হাত ধরে এমন টানাটানি করবেন না, আবারও এমন করলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।”

কথাগুলো বলেই আর দাঁড়ালাম না, বেসিনে এসে হাত ধুতে নিলাম। হাতে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেতেই জ্বলে উঠলো আবারও। ভেতরের কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। হাতের ব্যাথায় নাকি মনের ব্যাথায় সেইটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সামলে নিলাম নিজেকে। অনেক কষ্টে হাতটা ধুয়ে নিলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি আম্মু বড়মা ফুপিরা দাঁড়িয়ে আছেন। তাসফি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন উনি। হয়তো আমার ওমন রিয়াক্ট করাটা মেনে নিতে পারছেন না। যে মেয়েটা কি না আগে ওনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকতো, সেইই এমন জোরে জোরে কথা বলছে ওনার সাথে, এটা মেনে নিতেই হয়তো কষ্ট হচ্ছে ওনার।
তাসফি ভাইয়ার দিকে পাত্তা দিলাম না আমি। রুমে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই ফুপি বলে উঠলো,
“কি হয়েছে রূপা, ওখন চিৎকার করলি কেন?”

জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। জানি, বড়মা বা আম্মু কিছু বলবে না এখন, তাই হয়তো ফুপিকে বলতে বলছেন। আর যাই হোক, সবাই জানে ফুপির কথা ফেলতে পারবো না আমি।

“তোমার ছেলেকে বলে দিও ফুপি, আমার হাত ধরে যেন টানাটানি না করে, আর না কাছে আসার চেষ্টা করে। মামাতো বোনের হাত ধরে টানাটানি করা, কাছে আসা, এগুলো ভালো দেখায় না। আমি কিন্তু আর ছোট নেই, বারণ করে দিও ওনাকে।

ফুপির দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বললাম কথাটা, যেন ওনার কান পর্যন্ত পৌঁছায়। আমার কথায় একেবারে চুপ হয়ে গেল সবাই। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে আসলাম। ড্রয়িং রুমের দরজা পেরিয়ে আসতেই বড়মার কথা ভেসে আসতেই পা দু’টো এমনিতেই থেমে গেল।

“তুই আবার উঠলি কেন বাবা? খাবারটা শেষ কর।”

“খাবো না মামী।”

তাসফি ভাইয়ার কথা শেষ হতেই ফুপি বলে উঠলো,
“ও ছোট মানুষ, কি বলতে কি বলে ফেলেছে। তুই ওর কথায় কিছু মনে করিস না। খাবারটা শেষ কর আব্বু।”

“শুনলে না তুমি, কি বলে গেল? ও কিন্তু আর সত্যিই ছোট নেই, অনেক বড় হয়ে গেছে। শুধু তোমরাই বুঝতে চাইলে না।”

“খাবারটা শেষ করে যা বাবা, সকালেও কিছু মুখে দিলি না।”

“বললাম তো খাবো আমি।”

সব স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম তাসফি ভাইয়ার কথার উপর আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমি আর দাঁড়ালাম না। সোজা রুমে চলে এলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যতদিন উনি এই বাসায় আছেন ততদিন রুম ছেড়ে বের হবো না। আর কলেজে গেলে তো আর কথায় নেই, একটু হলেও শান্তি তে থাকতে পারবো।

হাতের ব্যাথাটা মাথা চারা দিয়ে উঠতেই হাতটা সামনে আনলাম। একদম লাল হয়ে গেছে পুরো হাত সহ আঙুল গুলো। চোখটা আবারও ভিজে উঠলো। এবার আর কোন বাধ মানলো না, টপটপ করে বেরিয়ে আসলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু কণা। তবে কান্নাটা হয়তো হাতের ব্যাথার চেয়ে মনের ব্যাথা র কারণ হয়েই দাঁড়ালো। অপর হাতে চোখ দুটো মুছতেই আবারও গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই যেন পারছি না। হঠাৎ জোরে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলাম কিছুটা। চোখটা ভালোভাবে মোছার চেষ্টা করে পিছন ফিরে তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠলাম।

.
.
চলবে……

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৫.

.
“আ..আপনি…. এখানে কেক্..কেন?”

আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ঠাস করে দরজাটা আঁটকে দিলেন তাসফি ভাইয়া। দরজা লক করে দিয়ে পিছন ফিরে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। শুঁকনো একটা ঢোক গিললাম, হঠাৎই যেন গলাটা শুকিয়ে গেছে ওনাকে দেখার পর, প্রচন্ড ভীতি এসে জমা হয়েছে মনে। অদ্ভুত এক মুখভঙ্গিতে এগিয়ে এসে আমার কিছুটা সামনে দাঁড়ালেন। কিছুটা সাহস জোগাড় করে মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই উনি চট করে আমার হাতটা টেনে নিলেন। হঠাৎ করে হাতটা টেনে ধরায় হালকা ব্যাথায় মুখ চে*পে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। ওনার শক্ত হাতের মুঠোয় আমার হাতটা নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে তুললেন। কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলেও মুখ ফুটে কোন শব্দ করলাম না। চোখ খিঁচে বন্ধ করে সহ্য করতে লাগলাম। হালকা চে*পে ধরলেন আমার হাতটা, ব্যাথা পেয়ে ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করতেই হঠাৎ ওনার শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম হাতে। চমকে উঠলাম আমি, কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। চট করে চোখ খুলে তাকালাম ওনার দিকে। পুরো হাতটা ওনার হাতে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। গাড়ো কালো চোখের মনি স্থির হয়ে আছে আমার দৃষ্টিতে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে টু*করো টু*করো ভাবে চুমু দিতে লাগলেন পুরো হাতে। নিশ্বাসের আনাগোনা যেন হঠাৎই বেড়ে গেল আমার। আধা মিনিটের মতো সময় নিয়ে ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম ওনার থেকে, অপর হাতে ওনাকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। তবে সামান্য পরিমাণও হয়তো নড়াতে পারলাম না। আমিই দুই ধাপ পিছিয়ে এলাম। বললাম,
“অ*সভ্যের মতো রুমে ঢুকে এসব কি শুধু করেছেন আপনি? কেন এসেছেন আমার রুমে? বেরিয়ে যান বলছি।”

আমার কথা যেন ওনার কানেই গেল না, এমন একটা ভান করে সরে গেলেন সামনে থেকে। সোজা ওয়ারড্রব খুলে খুঁজতে লাগলেন কিছু একটা। কাপড়গুলো টেনে টেনে বের করে ভেতরে দেখতে লাগলেন। ওনার এহেন কাজে বিরক্তির সাথে প্রচন্ড রাগও হলো।

“এগুলো কি করছেন তাসফি ভাইয়া? পা*গল হয়ে গেছেন আপনি? গোছানো কাপড়গুলো এভাবে এলোমেলো করছেন কেন? কি….. ”

কথাটা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেলাম আমি। তাসফি ভাইয়ের হাতের জিনিসটা দেখে লজ্জায় মাথা কাঁ*টা যাচ্ছে আমার। উনিও গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হয়তো বুঝতে পারেন নি এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ওনার হাতে চলে আসবে। ওনাকে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখেই ওনার হাতের জিনিস গুলো দ্রুত নিয়ে নিলাম। ড্রয়ারে রেখে আটকে দিতেই কিঞ্চিৎ ব্যাথা লাগলো হাতে। হঠাৎ ব্যাথায় অজান্তেই আহ্ করে উঠলাম। ধমকে উঠলেন তাসফি ভাই।

“পেঙ্গুইনের মতো এতো লাফালাফি করছিস কেন? বেয়াদব! চুপচাপ বসে থাকতে পারছিস না?”

“রুমে ঢুকে তা*ন্ডব শুরু করছেন, আর আমাকে বলছেন চুপ করে থাকতে? অ*সভ্য বখাটের মতো এগুলো কি শুরু করেছেন তাসফি ভাইয়া?”

আমার কথাটা আবারও উপেক্ষা করে পাশ কে*টে চলে গেলেন উনি। টেবিলের কাছে গিয়ে আবারও একই ভাবে খুঁজতে শুরু করলেন কিছু একটা। বই গুলো এলোমেলো করে ড্রয়ার খুললেন। এবার প্রচন্ড রাগে এক প্রকার চিৎকার করে উঠলাম।

“ভর দুপুরে কি নাটক শুরু করলেন আপনি? এক্ষুনি বেরিয়ে যান বলছি, নয়লে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম। আম্মু…. ফুপি বড়মা…. দেখো তোমাদের ছেলে…..”

“চুপ…. কানের কাছে এমন চেঁচাচ্ছিস কেন? বেয়াদব! তোকে কি আমি রে*প করছি, নাকি জামা কাপড় টেনে*টুনে খুলছি?”

ওনার এক ধমকে চুপ হয়ে গেলাম। মানুষটার চেহারায় পরিবর্তন হলেও ওনার সেই বিশাল বিশাল ধমকগুলো এখনো আগের মতোই রয়েছে যেন। আর ওনার এই বিখ্যাত ধমকে যে আমি ভয় পাবো না, এমনটা কখনোই হবে না, কদাপি নেহি! মনে মনে সাহস জাগিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই উনি শব্দ করে ড্রয়ারটা লাগিয়ে দিলেন। দূরত্ব ঘুচিয়ে একদম আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি সরে আসতে চাইলেই খপ করে হাতটা ধরে ফেললেন উনি। চাইলেও আর নিজেকে ছুটিতে আনতে পারলাম না। উনি সময় না নিয়ে হাতে থাকা মুভটা খুলে আমার হাতে লাগিয়ে দিতে শুরু করলেন। আমি বিরক্ত হলে বলে উঠলাম,
“এত আদিখ্যেতা দেখাতে কে বলেছে আপনাকে। ছাড়েন বলছি, বলছি না আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। এখনি আ…..”

“একদম চুপ করে থাকবি। আমি যে, নয়লে আমি যে ঠিক কি করতে পারি, সেটার এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু তোর খুব ভালো ভাবেই আছে।”

তাসফি ভাইয়ার কথায় চুপ হয়ে গেলাম আবারও। উনি যে ঠিক কি উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন, বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। আমি শান্ত হাতে উনি আলতে করে মুভটা লাগিয়ে দিচ্ছেন হাতে। চিনচিন করে উঠলো ঠান্ডা ছোঁয়ায়, হাতের কব্জি থেকে আঙুল পর্যন্ত লাল হয়ে হয়ে জায়গায় জায়গায়।
তাসফি বেশ মনোযোগ নিজের কাজ করে চলেছেন, হাত একটু কেঁপে উঠতেই মাঝে মাঝে ফুঁ দিচ্ছেন। এতদিন পর চিরচেনা এই চেহারাটা দেখে মনের মাঝে নানার কিছু উঁকি দিচ্ছে বারংবার। ওনাকে যে এভাবে আবারও এতটা কাছে থেকে দেখবো, সেটা কালকেও ভাবতে পারি নি। ওনার প্রতি তো আমার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু তার এক বিন্দুও রাগ নেই ওনার প্রতি। কিন্তু বিশাল পরিমাণের পাহাড় সমান অভিমান জমা হয়ে আছে।

তাসফি ভাই হঠাৎ আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম আমি, হাতের দিকে তাকিয়ে টেনে নিলাম ওনার থেকে। ওনার থেকে একটু দূরে গিয়ে বলে উঠলাম,
“অনেক হয়েছে আপনার নাটক, এবার বেড়িয়ে যান। অনেক করেছেন আপনি।”

“দেখ, বেশি লাফালাফি করিস না। আবার কিন্তু হাতে ব্যাথা পাবি।”

“আপনার দেওয়া ব্যাথা থেকে সেগুলো অনেক সহ্যশীল আমার জন্য। এতো দরদ দেখাতে হবে না আমাকে। এখন যান এখান থেকে, অ*সহ্য লাগছে আপনাকে আমার। আমাকে একটু আমার মতো করে থাকতে দিন। বেরিয়ে যান বলছি আমার রুম থেকে।”

শেষের কথাগুলো বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠলাম। আমার কথায় চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তাসফি ভাইয়া। কয়েক সেকেন্ডের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক ধাপে দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিলেন আমাদের মাঝের। হুট করে পিছন থেকে আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তোর এই অ*সহ্য কে সহ্য বানিয়ে দিতে, আমার কিন্তু খুব একটা সময় লাগবে না।”

ছটফট করতে লাগলাম আমি, ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য। কিন্তু একটুকুুও সরাতে পারলাম না ওনাকে। তবুও থেমে না থেকে হাত পা ছোটাছুটি করতেই লাগলাম। উনি গভীর ভাবে আমাকে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে, গালে হাত দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“রুপু…..”

চমকে উঠলাম আমি। এতদিন পর ওনার কণ্ঠে ‘রুপু’ ডাকটা শুনে শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর, কেঁপে উঠলাম কিছুটা। সহসায় একদম স্থির হয়ে গেলাম। শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা বেড়ে গেল মুহুর্তেই। গালে ওনার শক্তপোক্ত হাতটা আলতো করে স্লাইড করতে লাগলেন। মৃদু স্বরে সুর মিলিয়ে বলে উঠলেন।

“আমি ছুঁয়ে দিলে পরে,
অকালেই যাবে ঝড়ে….
গলে যাবে, যে বরফ… গলে না।”

দূরত্বটা আরও কিছুটা ঘুচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন একেবারে। মাথা নিচু করে আমার দিকে ঝুকে থাকায় ওনার নিশ্বাস আছড়ে পরতে লাগলো আমার চোখে মুখে। ওনার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, আর একটু তাকিয়ে থাকলেই যেন এতদিনের সবকিছু ভুলে হারিয়ে যাবো ওনার মাঝে, জড়িয়ে নিবো নিজের সাথে। কিন্তু আমি তো সেটা চাই না, কিছুতেই না….
তাসফি ভাইয়া আর একটু ঝুকে আসতেই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলাম ওনাকে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“লজ্জা করে না আপনার, অ*সভ্য লোক কোথাকার। এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন আমার রুম ছেড়ে। মামাতো বোনের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে এসব কি অ*সভ্যতামী শুরু করছেন? নুন্যতম লজ্জাটুকুও কি নেই আপনার মাঝে, তাসফি ভাইয়া?”

একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলাম আমি, রাগে পুরো মাথা ফে*টে যাচ্ছে আমার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইয়াকে এই মুহুর্তে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না আমার। ওনার দিকে তাকিয়ে আবারও চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কি হলো, কথা কানে যাচ্ছে না আপনার? বেরিয়ে যান বলছি। এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে।”

“তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস রুপু।”

এতটুকু বলেই থেমে গেলেন উনি, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“রেডি থাক, চার বছর অনেক বেশি-ই সময়। অনেকটা সময় দিয়ে ফেলেছি, আর নয়। এরপর যা হবে শুধু নিজ দ্বায়িত্বে সামলে নিস।”

বলেই আর দাঁড়ালেন না তাসফি ভাইয়া। দরজা খুলে সোজা বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। উনি যেতেই ধপ করে নিচে বসে পড়লাম আমি, এতক্ষণের আটকে রাখা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসলো। হু হু করে কেদে ফেললাম সহসায়। ওনাকে এতটা কাছে যেন সহ্য করতে পারছি না যেন, এতদিন পর এতটা কাছে পেয়েও একটু ছুঁতে পারলাম না ওনাকে।
ওনার বলা শেষ কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো শুধু, কি করতে চাইছেন উনি? কিসের জন্যই বা আমাকে রেডি থাকতে বলছেন? আর চার বছর আমাকে কিসের-ই বা সময় দিয়েছিলেন তাসফি ভাইয়া? উনিই তো ছেড়ে গিয়েছিলেন আমাকে, আমাদের সদ্য হওয়া প্রনয়নের সম্পর্কটা ছিন্ন করে কিয়ানার হাত ধরে পারি দিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে। দিনের পর দিন অবহেলা করে গেছেন আমাকে, কি করে ভুলে যাবো সেই দিনগুলোকে? ওনাকে মনে করার প্রতিটা মুহুর্তকে? না…. কিছুতেই ভুলতে পারবো না আমি, আর না ওনারকে জায়গা দিবো আমার জীবনে।

.
সন্ধ্যা নামার পর রাতের শহরটা এক ভিন্ন নগরীতে রুপ নেয়। সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় রাঙিয়ে উঠে শহরের আনাচে কানাচে। আস্তে আস্তে গভীর রাতের ব্যস্ত শহরটা হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, শান্ত শহরের ফাঁকা রাস্তায় প্রিয় মানুষটির হাত ধরে হাঁটা, এক অন্য রকম অনুভূতি। কোন এক পাগলাটে হিমুর সাথে শুধু মাত্র তার রূপা হয়ে, নীল শাড়ি এবং তার পড়নে কালো পাঞ্জাবি পড়ে রাতের নিস্তব্ধত শহরে হাঁটতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে। যদিও হিমুর পড়নে হলুদ পাঞ্জাবি ছিলো, কিন্তু আমার ব্যাক্তিগত হিমুর পড়নে শুধু আমার প্রিয় রঙটায় থাকবে।

“এই সময় এখানে বসে কি করছিস বোনু? ছাদে চল….”

হঠাৎ রিফাপুর কথায় নিজের ভাবনাগুলো থেকে বেরিয়ে আসলাম। আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“বললাম তো যাবো না, এতবার করে বলতে হবে কেন?”

“দেখ রূপা, অনেক হয়েছে তোর। এতদিন পর সবাই এক জায়গায় হয়েছে, একটু আড্ডা দিবো, তার তুই কি না ঘরকুনো হয়ে আছিস?”

বেশ ধমকেই উঠলো রিফাপু। আমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাকালাম রিফাপুর দিকে। কিছু বলতেই আপু আবারও বলে উঠলো,
“দেখ, একদম না করবি না আর, তাড়াতাড়ি চল। রিমি আপু আর ভাইয়া কিন্তু বারবার করে বলে দিয়েছে, যেন তোকে নিয়ে উপরে যাই। তাসফি ভাইয়ের জন্য এভাবে ঘরে বসে থাকবি, এটা কেমন কথা?”

“একদম ওনার নাম নিবা না রিফাপু।”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলবো না। এবার তো চল।”

রিফাপুর কথায় আর না করলাম না। ওই একটা মানুষের জন্য সবার মন তো আর খারাপ করে দিতে পারি না। ছাড়াও রিমি আপু আর ভাইয়াও অনেক দিন পর আসছে। রিফাপু কে চলো বলে উঠে দাড়ালাম। অনেকটা খুশি হয়ে গেল আপু, আমিও হালকা হাসলাম। রুম ছেড়ে বেরিয়ে ছাদে যেতে লাগলাম রিফাপুর সাথে।

.
.
চলবে…….

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।