তুমি যে আমার পর্ব-৪৮+৪৯

0
647

#তুমি_যে_আমার🥀
#Writer_Nondini_Nila
#Part_48

তূর্যর হসপিটাল কডিটরে বসে আছে চিন্তিত মুখে। হঠাৎ করেই আব্রাহাম হোসেন এর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় আর তখন হসপিটালে না এনে উপায় থাকে না। নিদ্রা আর অভ্র সেই মুহূর্তে খবর পেয়ে র‌ওনা হয়েছে। তূর্য বর্ষাকে বাসায় রেখে এসেছে বর্ষা চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তূর্য নিয়ে যায় নি ওকে। এক ধমক দিয়ে রেখে গেছে। না নেওয়ায় ও কারন আছে তূর্য এর শত্রুর অভাব নাই। তাই নিয়ে গিয়ে আর চিন্তা করতে চায়নি। শান্তা বর্ষার কাছেই আছে। শান্তা ও চিন্তিত খুব। আল্লাহ কে ডেকে তার সুস্থ কামনা করতে ব্যস্ত সে। বর্ষা তূর্য তাই করছে। নিদ্রা এসেই ভাইকে ঝরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। অভ্র ভেতরে চলে গেল। নিদ্রা যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তবুও নিজেকে শান্ত করে ভেতরে যায় কিন্তু বাবার এই অবস্থা ও সহ্য করতে পারেনা বেরিয়ে আসে।
তাই বাইরেই রয়ে গেল। শাওন এসেও উপস্থিত হয়েছে। ডাক্তার বের হয়ে যা জানালো তা শুনে তূর্য থপ করে পরে যেতে নেয় শাওন তাকে জাপটে ধরে। নিদ্রা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এতো গুলো বছর পর বাবাকে ফিরে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললো। চিরদিন এর জন্য না ফেরার দেশে চলে গেল। ও মানতে পারলো না। নিদ্রাকেও ভর্তি করি হলো। তূর্য নিজেকে সব সময় শক্ত রাখলেও এখন পারছে না‌। মায়ের মতো বাবা ও তাদের এক করে দিয়ে চলে গেলো। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। কিন্তু ও কষ্ট টা প্রকাশ করতে পারছে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না। বাবা নামক ছায়াটা মাথার উপর থেকে হারিয়ে গেলো সারা জীবন এর জন্য। বর্ষা ওকে মেনে নেওয়ার ও নিজেকে সব থেকে হ্যাপি মানুষ ভেবেছিলো। সুখ আসতেই কেন আবার দুঃখ চলে আসে জীবনে। আমি কি একটু সুখী হতে পারবো না। এই ভাবেই সবাই আমাকে ছেড়ে হারিয়ে যাবে।

‘ ব্রো তুমি ঠিক আছো তো কিছু অন্তত বলো। এভাবে পাথরের মত বসে থেকো না।’

তূর্য তাকালো ওর দিকে। ছেলেটা এতো ভালোবাসে কেন ওকে? কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে যেন ওর থেকেও ওর কষ্ট বেশি হয়েছে। তূর্য শাওনকে জরিয়ে ধরলো। কাদলো না কিন্তু চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। ডাক্তার জানালো স্টক করেছে বাবা। তিনি নাকী খুব টেনশনে থাকতেন সব সময়। তূর্য কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবছে কি জন্য এতো টেনশন করতেন বাবা? কি নিয়ে?
বারোটায় বাসায় নিয়ে আসা হয় তাকে। নিদ্রার জ্ঞান ফেরার পর থেকে চিৎকার করে কাঁদছে বর্ষার বাবা-মা খবরটা শুনে ছুটে চলে এসেছে। শাওন এর বাবা মা বোন ও চলে এসেছে।
দূর সম্পর্কের অনেক আত্মীয় স্বজন এসে বাসা ভর্তি করে ফেলেছে। বর্ষা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার শশুর মশায়ের দিকে। মানুষ টা যে আর নেই বিশ্বাসই করতে পারছে না। এই বাসায় থাকা কালীন প্রতিদিন একবার এই রুমে এসে মানুষটাকে দেখতো। খুব মায়া জন্মে গেছিলো। তূর্যকে ঘৃণা করলেও এই মানুষটাকে নিজের বাবা মত ভালবাসতো। সে মানুষটা যে হুট করে এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারছে না। তূর্যর কি অবস্থা ভেবে কষ্ট হচ্ছে খুব। মানুষটাকে কোথা ও দেখছে না। জোহরের নামাজের পর জানাজা পড়াবে। বর্ষা তূর্যকে খুঁজে যাচ্ছে কিন্তু তার দেখা নাই। নিদ্রার চিৎকার এ বাসা কাঁপছে। তার কাছে কিছুক্ষণ বসে রইলাম জোর করে কিন্তু জুস খাইয়ে দিয়েছি। নামাজ পরে যখন লাশ নিতে এলো সেই মুহূর্তে আমি তূর্য কে এক নজর দেখতে পেলাম শুভ্র পাঞ্জাবি গাঁয়ে মাথায় টুপি দেওয়া। মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যার আগে আব্বু আম্মু চলে গেল। এরমধ্যে তূর্য আর বাসায় ফেরেনি। আস্তে আস্তে বাসা ফাকা হয়ে গেল এখন বাসায় আছি আমি নিদ্রা আপু অভ্র ভাইয়া শান্তা। সবাইকে খাওয়াই দিয়েছি। নিদ্রা আপুকে অনেক বলে কয়ে খাবার খাওয়ানো হয়েছে তার চোখ মুখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। আমি সোফায় বসে তূর্য এর অপেক্ষায় আছি। লোকটা সারাদিন বাড়ি এলো না কোথায় আছে সেই চিন্তায় আমি চিন্তিত। ফোন দিলে ও ফোন রিসিভ করেনা। তূর্য কিছু খায়নি তাই বর্ষা ও সারাদিন না খেয়ে আছে। তূর্য আটটায় বাসায় আসে। চোখ মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে আছে। মুখ দেখে বোঝা যায় অনেক কান্না করেছে কিন্তু সবার আড়ালে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারেনি বলে এতক্ষণ বাসায় আসেনি‌।

তূর্য রুমে চলে যায়। বর্ষা খাবারের প্লেট হাতে রুমে আসে।‌ দেখে তূর্য বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর বিষন্ন মুখে গিরিলের বাইরে তাকিয়ে আছে। বর্ষা খাবার ছোট টেবিলের উপর রেখে তূর্য এর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

সিগারেটের গন্ধে নাক চেপে ধরে বলল, ‘ প্লিজ ভেতরে এসে কিছু খেয়ে নিন।’

তূর্য কিছু বললো না। বর্ষা আবার ও মৃদু স্বরে ডাকল। কিন্তু কাজ হলো না। তাই তাকে স্পর্শ করে বললো,

‘ প্লিজ আসুন। এভাবেই না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবেন। বেশি খেতে হবে না একটুখানি খাবেন।’

‘ আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না বর্ষা তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো‌!’

‘ আপনি না খেলে আমি ও কিছু খাবো না।’

‘ আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো।’

‘আমি জানি আপনার এখন বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় হচ্ছে। কতটা কষ্টে আপনি আছেন। একজন সন্তানের কাছে তার বাবা-মার চেয়ে আর আপন পৃথিবীতে কেউ নাই। তাদের না থাকাটা কতটা যন্ত্রনা তা হয়তো আমি বুঝতে পারবো না। কারণে এমন পরিস্থিতিতে আমি পড়িনি কিন্তু আমি আপনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি। আমি খুব বেশি খাবার খাওয়াবো না শুধু একটু আপনার শরীরটা সুস্থ রাখার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু।’

তূর্য কে টেনে নিয়ে আসলো বর্ষা। দুই লোকমার বেশি দেওয়া গেলো না‌। তূর্য পানি দিয়ে তা গিলেছে জাস্ট। আমি বাকি খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে এসে দেখি ব্যালকনিতে বসে আছে তূর্য এখনো সিগারেট খাচ্ছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার দিকে তাকিয়ে র‌ইলাম। এত কষ্ট মানুষটা সহ্য করে কিভাবে থাকলে তো মরেই যেতাম। মাকে তো সেই ছোটকালে হারিয়েছে বাবাকেও ঠিকমতো কাছে পেল না সেও এভাবে চলে গেল। এই মানুষটাকে আমি জেনে বুঝে কখনো কষ্ট দেবো না। আমি বেলকনির দরজায় দাঁড়িয়ে দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তূর্য এর দিকে।

সিগারেট শেষ করে আরেকটা বের করে আগুন দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলো বর্ষাকে তূর্য। বর্ষার গায়ে শাড়ি ও শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তূর্য চোখ সরিয়ে বললো,

‘ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। ‘

তূর্য এর কথা শুনে বর্ষা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তূর্য এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত থেকে সিগারেট নিয়ে তা ফেলে দিলো।

তূর্য রেগে কিছু বলতে যাবে বর্ষা তূর্য এর হাত নিজের কোমরের দুপাশে নিয়ে নিজের দুহাত দিয়ে মাথা জাপ্টে ধরলো।

‘ আপনার চোখ লাল হয়ে আছে। আপনাকে এমন বিষন্ন মুখে দেখতে পারছি না আমি। আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘ আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। আর বাবাকে দেখতে পারবো না।এতো দিন তাও যেভাবেই থাক আমার চোখের সামনে ছিলো। বেঁচে ছিলো। কিন্তু আজ থেকে তিনিও আর নাই। প্রথমে মা তারপর আহান এখন বাবা সবাই কেন এইভাবে আমাকে একা করে চলে যায় বর্ষা। আমি তো আর নিজেকে সামলাতে পারছি না। একে একে সবাই আমাকে নিঃস্ব করে চলে যাচ্ছে।’

বলেই তূর্য ডুকরে কেঁদে উঠলো। বর্ষার চোখেও পানি। কি বলে এই মানুষটাকে শান্তনা দেবে ওর জানা নাই। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে তূর্য। এতোক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলেও এখন পারছে না। বর্ষার পেটের কাছের শাড়ি ভিজে যাচ্ছে তূর্য এর চোখের পানিতে। বর্ষা নিরবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর চোখেও পানি। তূর্য কে কাঁদতে দিয়েছে বর্ষা। কাদুক কাঁদলে কষ্টটা একটু কমবে।

বর্ষার দোলনায় বসে পরেছে। বুকের উপর থেকে তূর্য এর মাথাটা ধরে উঁচু করে চোখ মুখে দিলো বর্ষা। নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো তূর্য চোখের পাতায়।

‘ প্লিজ আর কাঁদবেন না। আপনাকে এমন ভেঙে পরতে দেখতে পারছি না আমি।’

তূর্য নেতিয়ে পড়ছে বর্ষা তূর্য এর অধর চেপে ধরলো। মানুষটাকে সামলানোর চেষ্টা। এই কি সেই মানুষটি যার ভয়ে তটস্থ থাকতো সব সময়। সেই ব্যক্তিটার আজ কি অবস্থা আপন মানুষ হারিয়ে।
কখনো কি বর্ষা ভেবেছিল এই মানুষটাকে জান প্রান দিয়ে ভালবাসবে তার কষ্টে নিজে কাঁদবে। তূর্য কে একটু শান্ত করে রুমে এনে শুইয়ে ছিলো। ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে নিজেও তূর্যর পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত কষ্টে যেন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা হয়ে গেছে। কী ভয়ঙ্করী সাহসী মানুষের এই রুপ দেখে বর্ষার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
শুয়াতে পারলেও তার কষ্ট দূর করার ক্ষমতা বর্ষা নাই। অনেকক্ষণ হয়ে গেল তবু তূর্য ফুপানি কমলো না। তাই এই কষ্ট কমাতে ভালোবাসাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলো। প্রথমে তূর্য রেসপন্স না করলেও আস্তে আস্তে বর্ষার ডাকে সাড়া দিলো। সাড়া না দিয়ে তূর্য পারতো ও না। এই মেয়েটাকেও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তাকে নিজের করে টাবার জন্যে আপন করার জন্য কতইনা চেষ্টা করেছে আজ সেই মেয়েটা ওকে ডাকছে ও সারা না দিয়ে থাকতে পারলো না।
আজ দুটি ভালোবাসার মানুষ কাছাকাছি এলো। দুটি হৃদয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। একজনের আপন কাউকে হারানোর কষ্ট আরেক জনের সেই কষ্ট থেকে দূর করা আপ্রাণ চেষ্টা।
পরদিন আরেক ধামাকা তাদের জন্য বাকি ছিলো। আলাদা করে দিবে না তো আবার এই দুটি ভালোবাসার মানুষকে। এতকিছুর পর যারা নিজেদের ভালবাসায় সিক্ত হতে পেরেছে। এই নতুন ঝড়ে তূর্য তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের কাছে রাখতে পারবে তো!

#চলবে…..

#তুমি_যে_আমার🥀
#Writer_Nondini_Nila
#Part_49

সুখ যেন দুজনের জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে আসতেই পারে না। সব সময় কিপটামু করতে থাকে। এক ধাক্কায় বাবা কে হারিয়ে তূর্য এমনিতে ই ভেঙে পরেছে তার উপর এই সময় আবার বর্ষার বাবা মায়ের সব সত্যি জানতে পারা। এসবে এক দিশেহারা হয়ে পড়েছে‌।

এক সপ্তাহ পর হঠাৎ বর্ষার বাবা মা আসে আর চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগে। তূর্য রুম থেকে বের হতেই নিবিড় চৌধুরী তূর্য এর কলার চেপে ধরে চিৎকার করতে লাগে। বর্ষা রান্নাঘরে ছিলো চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে বাবার এমন রুপ দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পরে‌। বর্ষার বাবা তূর্য কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। বাপির কথা শুনে বর্ষা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।

‘ তুই সেই রাস্কেল তুই আমার কলিজার টুকরো কে কিডন্যাপ করে ছিলি প্রতিশোধ নিতে। আবার ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছিস নির্যাতন করতে। তোকে আমি খুন করে ফেলবো। তোর জন্য আমার মেয়ের চোখে খালি আমি পানি দেখেছি। বেঁচে থেকে ও মেয়েটা আমার মরে গেছিলো ভেতরে ভেতরে। এইভাবে আমাকে বোকা বানালি কতো ভরসা করেছিলাম। তার এই প্রতিধান দিলি‌।’

বলেই নিবিড় চৌধুরী আবার তেরে যেতে নেয় বর্ষা দৌড়ে নিজের বাপিকে ধরে।

‘ এসব কি করছো বাপি উনাকে মারছো কেন? সরে আসো। এমন করো না। এমনিতেই উনি খুব যন্ত্রণায় আছেন তুমি আর এমন করো না।’

‘ ছাড় আমাকে আজ ওকে বুঝিয়ে দিবো আমার মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার ফল হতে পারে।’

‘ না তুমি এমন কিছু করবে না।’

বলেই বর্ষা টেনে নিয়ে আসলো। নিবিড় চৌধুরী হাপাচ্ছেন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে বুকে হাত দিয়ে বর্ষা চেঁচিয়ে শান্তা কে পানি আনতে বললো,

‘ বাপি এমন করছো কেন তুমি ঠিক আছো তো? প্লিজ শান্ত হ‌ও। ‘

বলতে বলতে বর্ষা কেঁদে দিলো। তূর্য নিজেও একটু আগের কথা বাদ দিয়ে কাছে এসেছে। বর্ষার মা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করছে। পানি খেয়ে একটু চোখ বন্ধ করে থেকে শান্ত হলেন তিনি।

আস্তে আস্তে চোখ মেলে অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আমার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো তাই না’

‘ এসব কি বলছো বাপি!’

‘ আমি এই প্রতারকে চিনতে পারিনি‌ রে মা। জানতে পারলে কোনদিন আমি তোকে ওর সাথে বিয়ে দিতাম না মা‌। এজন্যই তো বিয়ের পর তুই আরো বেশি উদাশ থাকতি আমি বাবা হয়ে মেয়ের মন বুঝতে পারিনি। নিজের হাতে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম কেমন বাবা আমি মেয়েকে সুরক্ষিত রাখতে পারিনা‌। আমাকে ক্ষমা করে দেন মা। আমি তোর কাজি অপরাধী‌। এই ছেলেটাকে আমি খুব ভরসা করেছিলাম ও এইভাবে আমার ভরসা বিশ্বাস ভঙ্গ করবে বুঝতে পারিনি‌।’

‘ বাপি তুমি শান্ত হ‌ও এমন করো না। অসুস্থ হয়ে পরবে তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করো আমি তোমাকে সব বলবো।’

‘ আমি কিছু জানতে চাইনা আজ ই তুই আমার সাথে ফিরে যাবি। তোকে এই নরকে আমি ঠেলে দিয়েছিলাম আমি‌ই মুক্ত করবো। খুব তাড়াতাড়ি ডিবোর্স করিয়ে দিবো। তুই রেডি হয়ে নে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবো না আমরা।’

এতোক্ষণ তূর্য চুপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারলো না।

‘ স্যার এসব কি বলছেন? বর্ষাকে আপনি এভাবে নিয়ে যেতে পারেন না শি ইজ মাই ওয়াইফ।’

নিবিড় চৌধুরী তূর্যর কথায় তোয়াক্কা করলো না। বর্ষাকে বললো,

‘ এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন তারাতাড়ি তৈরি হ।’

‘ আমি যাব না বাপি‌। উনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না‌!’

‘ তুই আমার কথার অমান্য করছিস?’

‘ না কিন্তু বাপি…

বাপি এমন একটা কথা বললো যে আমি থমকে উপরে চলে এলাম। এখনো বাপিকে কেমন অসুস্থ লাগছে বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দিকে তাকালে রাজি হতে বলেন। বর্ষা নিরুপায় হয়ে উপরে আসতে নেয় তূর্য ও ওর পেছনে এসে হাত চেপে ধরে বলে,

‘ কোথায় যাচ্ছ তুমি?’

‘ আমাকে বাপির সাথে এখন যেতেই হবে আপনি কথা বাড়িয়েন না আমি এখন না গেলে বাপি অসুস্থ হয়ে পরবে। আমি তারাতাড়ি বাপিকে সব বুঝিয়ে চলে আসবো।’

‘ তুমি এখন চলে যাওয়ার কথা ভাবছো আমি এটা কিছুতেই মানতে পারছি না বর্ষা। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না যা বলার এখানেই এখনি বলবো আসো।’

‘ না আমি বাপিকে উত্তেজিত করতে পারবো না। বাপির উত্তেজিত হ‌ওয়া বারণ আছে। আপনি কি একটু সময় দিবেন না আমাকে। আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না খুব শিগগিরই আসবো। বাপি এসব কি করে জানলো আমাকে জানতে হবে একটু ধৈর্য ধরুন। এখন বাপিকে কিছু বুঝাতে গেলেও বাপি মানবে না। উত্তেজিত হবে আর অসুস্থ হবে।’

‘এক মুহূর্তের তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। স্যার তোমাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। আমি তার পা ধরে ক্ষমা চাইবো বর্ষা। এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে চলে যেও না। সব হারিয়ে আমি তোমার মাঝে সুখ খোঁজে পেয়েছি তুমি চলে গেলো আমি ধ্বংস হয়ে যাব।’

‘ এমন পাগলামী করছেন কেন বলছি তো আমি আপনার থেকে দূরে যাব না। এটা আমার পক্ষে সম্ভব ই না আপনি আমার আত্মার সাথে মিশে আছেন‌। আমাকে এখন যেতে দিন বাপি কেমন করছে দেখেছেন তো। ‘

বর্ষা কোন রকম ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। তূর্য হঠাৎ এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তূর্য কে রেখে যেতে বর্ষার ও ভালো লাগছে না বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু বাপির ক্ষতি হোক এমন কিছু ও করতে পারবে না‌। বাপি এসব কিভাবে জানলো কে জানালো ওর তো জানতে হবে‌ আর বাপিকে সব বুঝাতে হবে তূর্য আর আগের মতো নেই সে এখন আর প্রতিশোধ চায় না‌। তাকে খুব ভালোবাসে আর ও ও ভালোবাসে। সব জানাতে হবে ঠান্ডা মাথায়। তার জন্য ওকে এখন বাপির কথা শুনতে হবে।
তূর্য কে অনেক কষ্টে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো বর্ষা। লোকটার ফর্সা মুখ মন্ডল লাল টকটকে হয়ে গেছে। চোখ দুটো রক্ত বর্ণ। একটু হলেই যেন কেঁদে উঠবে এমন ফ্রেস করে তাকিয়ে আছে। তাও কি কিউট লাগছে বর্ষা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ফট করেই বর্ষা তূর্য এর পায়ের উপর পা রেখে উঁচু হয়ে তূর্যর কপালে চুমু খেলো। লোভটা সামলাতে পারলো না। লোকটাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে ও।
মন খারাপ করে সরে আসতে যাবে তূর্যর জন্য পারলো না। তূর্য বর্ষার কোমর চেপে ধরেছে। তূর্য এর স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো বর্ষা। কিছু বলতে যাবে কিন্তু বলার জন্য মুখটা খোলা পেলো না। তূর্য বর্ষার অধর চেপে ধরেছে।

তূর্য আর বের হয়নি। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বর্ষা ল্যাকেজ নিয়ে বের হয়েছে। একটু পর পর পেছনে তাকিয়েছে। শান্তা কে ডেকে তূর্যর খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে এলো।
তৃষ্ণার্ত দুটি চোখ বেলকনি থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।
বুক জ্বালা করছে যেনো তূর্যর সব শান্তি কেড়ে নিয়ে গেলো কেউ। হারিয়ে ফেলবো না তো আমি আমার প্রেয়সীকে?

বাপির সাথে কথা বলতে চাইলেও বাপি কথা শুনছে না। তাই রাগে দুঃখে দরজা আটকে বসে আছে বর্ষা। মায়ের ডাকেও সারা দিলো না। সন্ধ্যা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মাথা ঠান্ডা করে মায়ের সাথে আগে কথা বলবো।

কিন্তু হায় কপাল আমার মা ও আমার কথাও কান দিচ্ছে না। কিছু বলতে গেলেই তাদের ফোন আসছে আর তারা ফোন নিয়ে গায়েব। তূর্য এর জন্য একদিকে বর্ষা কাতরাচ্ছে আরেকদিকে কাউকে এখনো সব বুঝাতেই পারলো না। তূর্য কে কল করে কথা বলছে শুধু। খাবার টেবিলে বর্ষা অনেক কষ্টে বললো,

‘ বাপি তোমার এতো সব কিছু কিকরে জানলে? আমি তো কিছু বলিনি তোমাদের এতো সব কথা কে জানালো?’

বাপি বললো,’ জানিয়েছে একজন। খুব ভালো ছেলেটা কিন্তু কি স্বার্থে আমাকে এসব জানালো বুঝতে পারছি না। তাকেও আমি বিশ্বাস করিনি কিন্তু তার কথা গুলো বিশ্বাস করেছি প্রমাণ স্বরূপ। ওই আদিল এতো বড় প্রতারক আমি আগে কেন বুঝতে পারলাম না।ওর চাকরি আমি শেষ করবো আর ওর মুখোশ সবার সামনে খুলে দেবো। গুন্ডা মাস্তান একটা।আমার ভেতরের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ফল ও পাবে। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না মা বাপি তো আবার একটা সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দিবে। ওই রাস্কেলকে আমি তোর জীবন থেকে সরিয়ে দেবো চিন্তা করিস না।’

আমি চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে বললাম, ‘ তাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিলেই কি এই মন থেকে সরাতে পারবে? তাকে সরিয়ে আমায় তুমি কেমন সুন্দর জীবন দিতে যাও। যে জীবনে উনি নেই সেখানে আমি খুশি কি করছ থাকবে। উনি তো আমার একমাত্র সুখ শান্তি ভালো…

‘ আমি জানি তুই ওকে স্বামী মানতে চেয়েছিস তাই হয়তো কিছুটা অনুভূতি জন্ম নিয়েছে কিন্তু এটা সাময়িক। কিছুদিন ঘুরা ফেরা কর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দে সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস। ‘

‘ উনি এখন ভালো হয়ে গেছে বাপি এখন আর উনি আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চায় না। আমাকে ভালোবাসে আর আমিও। উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে আমার কাছে ক্ষমা ও চেয়েছে। প্লিজ বাপি উনাকে আমার থেকে আলাদা করো না। কেবল বাবাকে হারিয়ে উনি ভেঙে পরেছে এখন আবার আমি চলে এলাম উনি কিভাবে থাকবে বলো নিজের প্রতি এমনিতেই খুব উদাসিন আমাকে যেতে দাও।’

‘ আমি বেঁচে থাকতে আর তোমাকে নরকে ঠেলে দেবো না। তুমি এখানেই থাকবে। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘ বাপিইই

নিবিড় চৌধুরী খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেলেন। বর্ষা ওর মাকেও বুঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তিনি বুঝলেই কি আর না বুঝলেই কি বাপির অনুমতি ছাড়া ও তো তূর্য এর কাছে ফিরতে পারবে না।

রুমে এসে কান্না করলো কিছু সময়। তূর্য কে কি বলবে এখন। তূর্য কল করেই যাচ্ছে। বাপি কে মানাতে পারছি না কিভাবে বলবো?’

‘ হ্যালো’

‘ কথা বলছো? স্যারের রাগ করেছে? কি বলেছেন তিনি? তুমি কবে ফিরে আসছো?’

‘ আরে আসতে বলেন। আজ ই তো এলাম কয়েকদিন থাকি এক সপ্তাহের মধ্যে আমি চলে আসবো সব ম্যানেজ করে আপনি শান্ত থাকুন। রাতে খেয়েছেন?’

‘ কি বললে এক সপ্তাহ? কাল‌ই তুমি ফিরে আসবে আমি কিছু শুনতে চাই না বর্ষা। আই মিস ইউ সো মাচ। ‘

‘ আমিও তো আপনাকে মিস করছে কিন্তু এমন করলে হবে না। কাল আসাটা ইম্পসিবল। আমি এক সপ্তাহের মধ্যে আসবো বললাম তো আপনি কিন্তু ভুল করেও এর মধ্যে আসবেন না। আপনাকে দেখলেই বাপি রেগে যাবে। আমি বাপিকে সব বুঝিয়ে আপনাকে আসতে বলবো তখন আসবেন ওকে।’

‘ আমার ভালো লাগছে না। মনটা ভীষণ খারাপ মন বলছে তুমি হারিয়ে যাচ্ছ আমার থেকে। এমনটা হলে আমি কিন্তু মরে যাব ব‌উ। ‘

‘ আর একবার মরার কথা বললে আমি সত্যি আর আপনার কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবো না‌। আর না কল রিসিভ করবো।’

‘ আচ্ছা সরি আর বলবো না। কিন্তু আমি সত্যি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না‌। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে এতো দিন পর আমরা একে অপরের ভালোবাসা বুঝতে পারলাম আর এখন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমি কি করে ঠিক থাকবো বলো তুমি।’

‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি খেয়েছেন?’

‘ নাহহ’

‘ এসব কি খাননি কেন? তারাতাড়ি নিচে গিয়ে খেয়ে আসুন! না হলে কিন্তু কল কেটে দেবো।’

‘ তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। খেতে পারছি না ঘুমাতে পারছি না খুব একটা লাগছে আমার। খুব শাওন এসেছে ওকেও আমি বকাঝকা করেছি ও মন খারাপ করে বসে আছে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না বিলিভ মি!’

বর্ষার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। মানুষটার এমন কাতর কন্ঠ শুনে ও ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কে এমন শত্রুমি করলো ওদের সাথে। বাপি কে কে জানালো সব। ওর সুখের ঘরের কার নজর লাগলো?

#চলবে…..