#তুমি_শুধু_আমারই_হবে
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৪ (অন্তিমপর্ব)
কলিংবেল বাজতেই ছয় বছরের পিচ্চি মেয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে একজন রোগা করে মহিলা দাঁড়ানো। বয়েসের তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে।
” কে এসেছে আরু মা?”
কথাটি বলতে বলতে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসা থেকে উঠে আসে অনামিকা। মুহিব বসে বসে কিছু একটার হিসেব করছিল তখন।
অনামিকার আর মুহিব সাত বছর আগে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তার কয়েকমাস পরেই আরিশাকে তারা দত্তক নেয়। আরিশা তখন দুই মাসের বাচ্চা মেয়ে, কত কষ্ট করেই যে অনামিকা তাকে বড় করেছে!
অনামিকা গিয়ে আরশির পিছনে দাঁড়ায়। কোন কারণে দরজা খোলাই ছিল আরশি গিয়ে শুধু দরজার পাল্লা টেনে ভেতরে নিয়ে এসেছিল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা মুখ। দুজন দুজনকে দেখে কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু দরজার ওপাশের মহিলাটির চোখ ছলছল করছে।
” আসুন ভেতরে আসুন।”
কথাটি বলেই বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মহিলাটি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
মুহিব ফোন থেকে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই সাত বছর আগে ছেড়ে আসা মাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়। এই কয়েক বছরে সে বেশ কয়েকবার সে বাসায় গিয়েছে কিন্তু মেরিনা বেগম তার সাথে দেখা করে নি, দরজা বন্ধ করে থেকেছে।
” মা তুমি!”
মেরিনা বেগম দ্রুত এসে মুহিবের পা ধরবে ঠিক তখনই মুহিব সোফায় পা তুলে বসে পড়ে।
” কি করছো মা? এতদিন পর কি আমাকে অপরাধী বানাতে এসেছো নাকি? ”
মেরিনা বেগম মেঝেতেই বসে হু হু করে কেঁদে দেয়। অনামিকা গিয়ে মেরিনা বেগমকে মেঝে থেকে উঠিয়ে মুহিবের পাশেই সোফায় বসান। সে আরিশাকে মিসেস মেরিনার কাছে বসিয়ে দেয়।
” মা, এটা আপনার নাতনি। সন্তান জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। শুধু নিজের মধ্যে মাতৃত্বটা ধারণ করতে হয়। ”
মেরিনা বেগম চোখের পানি মুছেই যাচ্ছেন। অনামিকা আরিশাকে শিখিয়ে দেয় সে যেন তার দাদিমার চোখের পানি মুছে দেয়। আরিশা সোফার ওপর হাটু ভেঙে বসে নিজের ছোট হাতজোড়া দিয়ে মেরিনা বেগমের চোখের পানি মুছে দেয় আর বলে,
” তুমি কেঁদো না দাদিমা। তুমি কি বাচ্চা মানুষ যে এভাবে কাঁদবে? ”
এবার যেন মেরিনা বেগমের কান্নার বাধ আরও ভেঙে গেল। আরিশাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না জুড়ে দিলেন। আরিশার চোখে,মুখে, গালে চুমু খেতে লাগলেন।
অনামিকা আর মুহিব দুজন মিলে মেরিনা বেগমের কান্ড দেখছেন আর একে অপরের দিকে একবার করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।
কিছুক্ষণ পর মেরিনা বেগম একটু শান্ত হন। অনামিকা রান্নাঘরে গিয়ে একটু শরবত বানিয়ে নিয়ে আসেন। মেরিনা বেগমের দিকে এগিয়ে দিতেই বলেন,
” পানি হবে? শরবত খাব না।”
অনামিকা শরবতটা উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” এটা খেয়ে দেখুন মা, ভালো লাগবে। এটা খাওয়ার পর পানি লাগলে পানিও দিচ্ছি সমস্যা নেই। দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি অনেক ক্লান্ত,এটা খেলে অনেকটা সুস্থবোধ করবেন।”
মেরিনা বেগম শরবতটা খেয়ে শরীরটা একটু জিরিয়ে নেন।
মুহিব এবার নিম্নস্বরে বলে,
” কি হয়েছে মা হঠাৎ এখানে কি মনে করে আর আমরা এখানে আছি জানলে কি করে?”
মেরিনা বেগম এবার ভাঙা গলায় বলে, ” আমাকে তোদের সাথে রাখবি মুহিব? আমি তোর বাড়ির সব কাজ করে দেব তার পরিবর্তে শুধু আমাকে তিনবেলা একমুঠো করে খাবার খেতে দিবি।”
অনামিকা এবার মেরিনা বেগমের পাশে গিয়ে বসে।
” ছি মা, এসব কি বলছেন? আপনি আপনার ছেলের সাথে থাকবেন এজন্য আবার কাজ করতে হবে কেন? আপনি এখানে থাকুন, নাতনির সাথে খেলবেন আর কখন কি লাগবে বলবেন।”
মেরিনা বেগম অনামিকার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে থাকে, ” আমাকে ক্ষমা করে দিও অনু, কত খারাপ করেছি আমি তোমার সাথে। হয়তো ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতাও আমার এখন নেই কম বাজে ব্যবহার তো আমি করি নি তোমার সাথে। তখন যদি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো আজ আমারও এমন পরিস্থিতি হতো না।”
মুহিব চুপচাপ দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে। তার মা এত খারাপ করেও আজ অনামিকার কাছে ক্ষমা চাইছে। অথচ কয়েক বছর আগেই মেয়েটা সব হারাতে বসেছিল তার মায়ের জন্য। এতকিছুর পরও কি আসলেই ক্ষমা করা সম্ভব! মুহিব অপেক্ষা করে অনামিকার উত্তরের জন্য।
অনামিকা মুখে হাসির রেখা টেনে বলে, ” মা আমরা মানুষ, কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই। আমাদের মধ্যে যেমন ভালোর উপস্থিতি আছে ঠিক তেমনই খারাপের উপস্থিতিও আছে। আমদের র*ক্ত গরম থাকলে আমরা যা ইচ্ছে করতে পারি, অন্যা*য় করতেও পিছপা হই না কিন্তু বয়সটা একটু বাড়লে বুদ্ধি ভাড় হলে তখন ঠিকই বুঝতে পারি নিজের করা কাজগুলো সঠিক কি না! তেমন আপনিও বুঝতে পেরেছেন মা। আমার কোন অভিযোগ নেই কারো প্রতি। আমার মা নেই…..
কথা বলার পরই অনামিকা একটু থেমে যায়। চোখ টলমল করছে তার কথাও কেমন একটু জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সে আবার বলতে শুরু করে,
” আমার মা নেই, বাবা নেই। আমি বিয়ের পর থেকেই আপনাকে আর বাবাকে নিজের বাবা মা মনে করতাম। চাইতাম সবাই একসাথে থাকব সবসময় কিন্তু তা তখন হয়ে ওঠে নি। ও বাড়ি থেকে চলে আসার ছয় মাস পরই যখন বাবা মা*রা গেল তখন খুব খারাপ লেগেছিল। বাবার মুখটা দেখে কান্না আটকে রাখতে পারি নি৷ আপনার আশেপাশে থাকতেও যখন কথা বলেন নি তখন কষ্টটা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল ভেবেছিলাম কোনদিন হয়তো আর এক হতে পারব না কিন্তু সবকিছু মিথ্যে করে আল্লাহ ঠিক মিলিয়ে দিল৷ তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে, উনি কখন কি করবেন সেটা কেউ জানে না। মন থেকে কিছু চাইলে আর সেটা যদি আমাদের জন্য ভালো হয় তবে তা ঠিকই দেন আল্লাহ, আপনি তার প্রমাণ। আমি আপনাকে খুব করে চেয়েছিলাম মা। ”
অনামিকা এবার থামে। অনেকদিনের জমানো কথাগুলো বলে আজ নিজেকে কেমন হালকা লাগছে। এ কথাগুলো কখনো কাউকে বলে নি সে। মেরিনা বেগম তখনও চুপ। মুহিব এবার বলে ওঠে,
” ওয়াজিফার কি অবস্থা মা?”
মুহিবের প্রশ্নে যেন কষ্টটা আরেকবার বুকে হা*না দেয় মেরিনা বেগমের। তার নিজের পেটের মেয়েটা যে তার সাথে বেঈমানী করেছে এটা সে নিজের মুখে সৎছেলেকে আর ছেলের বউকে কীভাবে বলবে! তবুও নিজের জড়তা কাটিয়ে বলে,
” ভালোই আছে বোধ হয়। ”
” বোধ হয় মানে? কথা হয় না তোমার সাথে?”
” না।”
” কেন?”
” আমার সবকিছু দিয়ে তাকে বাহিরে পাঠালাম এখন আর সে আমাকে চিনে না। ওয়াজিফাই তো আমার চোখ খুলে দিয়েছে, সব আপনই আপন হয় না আর সব পর ও পর হয় না।”
মুহিব কিছু বলতে যাবে ঠিক অনামিকা ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করে। মুহিব ও আর ওসব নিয়ে কিছু বলে না, কি দরকার পুরোনো ক্ষ*ততে আবার আঘা*ত করা!
” মা তুমি তোমার নাতনির সাথে এখানেই থাকবে আজ থেকে। অনামিকা মায়ের খেয়াল রেখো, আজ থেকে তোমার দায়িত্ব মায়ের মেয়ে হয়ে ওঠা। আমি তোমাদের দুজনকেই একসাথে চাই। তোমরা বসে কথা বলো আমি বাজার থেকে আসি, আজকে ভালো ভালো খাবার খেতে হবে তো মা এসেছে বলে কথা।”
মুহিব সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। অনামিকা যেন এবার তৃপ্তির হাসি হাসে। তার এতদিনের চাওয়া আজ পূরণ হয়েছে। দেরিতে হলেও আজ থেকে সে একটু হলেও মায়ের আদর পাবে৷
” বুকে আসবি মা? এখানে খালি খালি লাগছে।”
মেরিনা বেগমের এমন কথায় বেশ অবাক হয় অনামিকা। আসলেই কি ভাগ্যে এত ভালো কিছু ছিল তার! সৃষ্টিকর্তা এত ভালো কিছু লিখে রেখেছিলেন!
অনামিকা এবার মেরিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। আরিশা এবার দুজনের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে বলে, ” মা আমাকেও নাও তোমাদের সাথে…..”
মেরিনা বেগম আর অনামিকা হেসে ফেলে। দুজনের দুই পায়ের ওপর আরিশাকে বসিয়ে নেয়। এটা যেন এক অন্যরকম ভালোবাসা, পৃথিবীতে এই ভালোবাসা খুব অল্পপরিমানে আছে। খুব কম মেয়ের ভাগ্যে শাশুড়ির ভালোবাসা ভাগ্যে জোটে। অনামিকা নিশ্চয়ই ভাগ্যবতী মেয়ে, মুহিবের মতো এমন স্বামী সবাই পায় না। এই মানুষটাকেও সে হারাতে হারাতে নিজের করেই রেখে দিতে পেরেছে। সে শুধুই অনামিকার হয়ে রয়ে গিয়েছে। এমন ভালোবাসার পরিসমাপ্তি অপ্রয়োজনীয়। চিরকাল অটুট থাকুক এমন ভালোবাসাগুলো।
**সমাপ্ত**