আমার চাঁদ পর্ব-০১

0
327

__আমার চাঁদ

______ সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান

__________পর্ব:- ০১

রেস্টুরেন্টের এক কোণে বসে মোবাইলে ডুবে আছে মেহরা। আশেপাশের দিকে খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। বেশ কয়েকবার ওয়েটার এসে অর্ডার নিবে কীনা জিজ্ঞেস করে গিয়েছে। তবে মেহরার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে চলে গিয়েছে। চতুর্থবার ওয়েটার এসে টেবিলে চাপড় দিলো। বললো,

– ম্যাম আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?

মেহরা বিরক্তিকর চোখে ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে বললো,

– একটা কফি দিয়ে যান।

ওয়েটার হাফ ছেড়ে বলে ওঠে,

– যাক্ আপনি কানেও শোনেন, কথাও বলতে পারেন, আমি ভেবেছিলাম কোনোটাই পারেন না।

ওয়েটারের কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে মোবাইল টিপতে থাকে মেহরা।

——

– স্যরি বউ, দেরী হয়ে গেল।

– সে তোমার আজীবনের অভ্যাস। দীর্ঘ তিন বছরে আমার মনে পরে না কোনোদিন কোথাও তুমি আমার আগে এসেছো।

– বললাম তো স্যরি।

– স্যরি তোমার পকেটে রাখো।

– না, না৷ পকেটে তো তোমার প্রিয় বেলীফুলের মালা আছে।

মেহরা হেসে ফেলে। এই লোকটার সামনে কখনোই রাগ দেখাতে পারে নি। রেগে থাকতে দেয়ই না এই লোক!

মেহরার হাসি দেখে তাহমিদও হাসে। বলে,

– যাক্ রাগ ভেঙেছে।

মেহরা আলতো চিমটি কেটে বলে,

– রাগ ভাঙেনি, আজ বাসায় যেতে হবে তাহলেই রাগ ভাঙবে।

– হুম, তোমার বাসায় যাই, আর আমার হিটলার শশুড় আমার ঠ্যাং ভেঙে দিক।

– ভালোই হবে, বিছানায় পরে থাকবে।

কথার মাঝেই ওয়েটার আসে। মেহরার দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বলে,

– আর কিছু লাগবে?

তাহমিদ প্রয়োজন মতো অর্ডার দিয়ে ওয়েটারকে বিদায় দেয়।

খাওয়া শেষে রিকশা ডাকে তাহমিদ। মেহরাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে হোস্টেলর দিকে। আজ একটা টিউশনির বেতন দিয়েছিলো। রেস্টুরেন্টের বিল দিয়েই বেতন প্রায় শেষ। এ দিয়ে অন্যান্য বেতন না পাওয়া অবধি চলতে হবে।

মেহরা’কে বিয়ে করেছে প্রায় তিন বছর। মেহরার বাবা বিয়েতে রাজি ছিলেন না তাহমিদের পড়াশোনা শেষ না হওয়ার কারণে। তবে তাহমিদের বাবার অনুরোধে শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখেন। তাহমিদের বাবা মেহরার বাবার গ্রাম্যবন্ধু। তাহমিদের বাবা গ্রামের চেয়ারম্যান। সেজন্যই হয়তো রাজি হয়েছিলেন তাহমিদের সাথে বিয়ে দিতে। নয়তো যেই হিটলার কখনোই রাজি হতেন না। তাহমিদ মুচকি হেসে ফোনটা হাতে নেয়। বাবাকে ফোন করে।

– বাবা, কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছি? বউমা কেমন আছে?

– আলহামদুলিল্লাহ।

– টাকা-পয়সা কিছু লাগবে?

– নাহ, লাগবে না। তবে শশুড় বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো তো, তার শর্তের মধ্যে কি আমি শশুড়বাড়িও যেতে পারবো না?

আহাদ খান হাসেন। তাহমিদকে আশ্বস্ত করে বলেন,

– ওকে তুই যতটা কঠিন ভাবিস ততটা নয়। তোর ইচ্ছে হলে যেতে পারিস, তুই যে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই গভির রাতে ওর বাসায় যাস সেসব ও জানে।

তাহমিদ জিহ্বায় কামড় দেয়। বাবা-ছেলে কথা বলে ফোন কেটে দেয়। তাহমিদ এবার বাবার কাছে কিছু টাকা চেয়েছে। খুব দরকার না পরলে বাবার কাছে টাকা চায় না তাহমিদ। কেমন যেন লজ্জা লাগে!

টিউশনি শেষ হতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছে। টিউশন থেকে বের হয়ে শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য কিছু শপিং করে রিকশা নেয়। এর আগেও গিয়েছে তবে লুকিয়ে। ফজরের আজান হওয়ার পরই চলে এসেছে। ভেবেছিল সেসব বুঝতে পারেনি মেহরার বাবা, তবে ভুলে গিয়েছিলো এক সময় এই লোক মেজর ছিলেন।

—–

কলিংবেলের শব্দে দরজা খোলেন মমতা বেগম। মেয়ে জামাইকে দেখে খুশিতে আটখান সে। দ্রুত ভিতরে এনে বসায়। মাহির খানের নিকট যেয়ে জানান মেয়ে জামাই এসেছে। মাহির খান মুখাবয়ব গম্ভীর করে রাখলেও মনে মনে সেও খুশি। তাহমিদ

মেহরার রুমে এসে মেহরাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তাহমিদের মুখে দুষ্ট বুদ্ধি উদয় হয়। কানের লতিতে কামড় বসায়। হঠাৎ ব্যথায় চোখ খুলে তাকায় মেহরা। সামনে তাহমিদকে দেখে চমকে ওঠে। চোখ কচলে বোঝার চেষ্টা করে আসলেই তাহমিদ সামনে কীনা। দরজার দিকে চোখ যেতে দরজা খোলা দেখে দৌড়ে দরজা আটকায়। তাহমিদ বিছানায় হেলান দিয়ে প্রেয়সীর ছোটাছুটি দেখে। মেহরার হাত ধরে টেনে সামনে বসায়। বলে,

– আজ সবার সামনে থেকে এসেছি। তোমার হিটলার বাবাও এতক্ষণে জেনে গিয়েছেন।

মেহরা হকচকিয়ে তাকায়। এই ছেলের মাথায় কখন কি চলে বোঝা মুশকিল। সকালে যখন আসতে বললো তখন আসবে না বললো, অথচ এখন এসে হাজির। কপট রাগ দেখিয়ে মেহরা বলে,

– সকালে বললে না কেন?

– বললে কি আর এমন চমকাতে পারতাম? তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখতে পারতাম?

– এহহহ! ঢং।

– ঢং বউয়ের সামনে দেখাবো না তো কার সামনে দেখাবো?

তাহমিদ মেহরাকে টেনে নেয় বাহুডোরে। কপালে চুম্বন করে বলে,

– আমার একটা মাত্র বউ। এর সামনে আমি খোলা ডায়েরীর মতো,খোলা বইয়ের মতো।

মেহরা মাথা নিচে করে চুমু খায় তাহমিদের বুকে। তাহমিদ মেহরাকে বলে,

– অনেক ঘাম কিন্তু!

– সমস্যা কি?

——-

– এই আপু আমি কি আসতে পারি?

হঠাৎ মিয়ানের ডাক শুনে সরে আসে দু’জন। মিয়ানকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাহমিদ গল্প জুড়ে দেয়। মেহরা বের হয়ে যায় রুম থেকে। কিচেনে পা বাড়ায়।

মেয়েকে কিচেনে দেখে মমতা বেগম বলেন,

– ওখানে নাস্তা রেডি করে রেখেছি, জামাইকে নিয়ে দে মা।

– দিচ্ছি। কোন হেল্প লাগবে?

– তুই একটু খালাকে ফোন করে বল আসতে, এক্সট্রা টাকা দিবো।

মেহরা নাস্তা নিয়ে রুমে আসে। ফোন করে খালাকে আসত বলে নিজেও যায় মমতা বেগমকে হেল্প করতে।

তাহমিদ, মিয়ান গল্প করছিলো আর নাস্তা খাচ্ছিলো। হঠাৎ মাহির খান রুমে আসেন। তাহমিদের পাশে বসে বলেন,

– চলো জামাই, দেখি বাজারে এতটুকু পাকা। আমার মেয়েকে বাজার করে খাওয়াতে পারবে কীনা দেখতে হবে না!

মিয়ান বলে ওঠে,

– ও বাবা, আমাকেও নিয়ে যাও, তোমার বউমা’কে বাজার করে খাওয়াতে হবে না?

– সে সেখানো তের শশুড়ের কাজ।

– তাহলে বিয়ে করিয়ে দাও না!

মিয়ানের কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলেন জামাই-শশুড়।

রুম থেকে দু’জনের হাসির শব্দ কিচেনে এসে পৌঁছায়। অবাকের শীর্ষে পৌছে যায় মা-মেয়ে। মাহির খান সহজে কারো সাথে মিশেন না।

তাহমিদ মেহরা’কে রুমে ডাকে। মেহরা রুমে আসতেই বলে,

– তোমার কাছে আমার একটা পাঞ্জাবি আছে না?

– হুম আছে তো।

– ওটা দাও

– এই সন্ধ্যায় পাঞ্জাবি দিয়ে কি করবে?

– বাবা বললো বাজারে নিয়ে যাবে, পাঞ্জাবি না পরলে কি জামাই জামাই লাগে বলো?

মেহরা হাসে। পাঞ্জাবি বের করে দিয়ে চলে যায় কিচেনে।

——–

বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা ডাকেন মাহির খান। যেতে যেতে বলে,

– বাবা, আমি চাইলেই তোমার কাছে মেশেটা দিতে পারি, তোমার বাবারও সামর্থ্য আছে আমার মেয়েকে খাওয়ানোর। তবে আমি চাই তুমি নিজে কিছু করো। তোমার অল্প ইনকামে হলেও আমার মেয়েটাকে তোমার কাছে দিতে পারি। আমার মেয়ের তেমন চাওয়া পাওয়া নেই। সে অল্পতেই খুশি। আমি চাইলে পারতাম তোমার সাথে বিয়ে না দিয়ে অপেক্ষা করতে। এতে তোমরা দু’জনেই গোপনে দেখা করে গুনাহগার হতে। এইযে, প্রায়ই তুমি বাসায় আসো আমি টের পাই কিছু বলি না। কারণ আমি এটাই চাইতাম।

মাহির খানের কথা শুনে তাহমিদ মুচকি হাসে, বলে,

– বাবা আপনি খামোখা চিন্তা করছেন। আমার অনার্স শেষ। মাস্টার্সও শেষ হবে আগামী বছর ইনশাআল্লাহ। চাকরীর চেষ্টায় আছি তবে সবাই ঘুষ চায়, দেই না দেখে চাকরীও হয় না। আমি চাই যাতে ঘুষ ছাড়া চাকরী হয়। যেটা হালাল উপার্জন হবে আমার। আমিও চাই না আমার স্ত্রী আমার বাবার উপার্জনের উপর নির্ভরশীল হোক,তাই আমিও জোর করি না।

কথা বলতে বলতে বাজার শেষ করে বাসায় চলে আসেন দু’জন।

——–

বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাহমিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পিছন থেকে মেহরা এসে ঝাপটে ধরে। বলে,

– মন খারাপ নাকি জামাইয়ের?

– মোটেই না। বউয়ের অপেক্ষায় ছিলাম।

– চন্দ্রবিলাশ করবেন নাকি?

– আমার সামনেই তো আস্ত চাঁদ। এ চাঁদ থাকলে দূরের ছোট চাঁদ দেখতে কে চায়? এই চাঁদের সাথে বিলাশ করতে রাজি।

মেহরা লজ্জামাখা মুখে কামড় বসায় তাহমিদের বুকে। তাহমিদ বুক চেপে বলে,

– তুমি তো আস্ত মাংসখোর।

মেহরা হাসে। তাহমিদ তাকিয়ে দেখে প্রেয়সীর হাসি। ঘরের চাঁদের হাসি চমকে যেন আকাশের চাঁদ হিংসেতে লুকিয়ে গিয়েছে।

চলবে,