তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-১১+১২

0
197

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১১

” ভাইয়া তোমার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে দুয়া মা’কে আমি আমার জাবির এর জন্য নিতে চাই। ”

ছোটখাটো বি’স্ফোরণ হলো লিভিং রুমে! উপস্থিত বাকি দু’জনে হকচকিয়ে! সাজ্জাদ সাহেব বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

” তুই এসব কি বলছিস সাজেদা? ”

সাজেদা মুচকি হেসে বললেন,

” খুব কঠিন কিছু বলেছি কি? ”
.

ব্যস্ত জীবন। সময়ের পরিক্রমায় পেরিয়ে গেছে কয়েক মাস। দুয়া’র অনার্স প্রথম বর্ষ শেষের পথে। ছুটির দিন আজ। হঠাৎ করেই কাউকে না জানিয়ে দুপুরবেলা উপস্থিত হলেন সাজেদা। সাথে ছোট মেয়ে তানমি। সাজ্জাদ সাহেব এবং তাহমিদা তো অবাক সাথে বেশ খুশি! কতদিন পর সাজেদা এলেন! খুশি খুশি অতিথি আপ্যায়ন করলেন তাহমিদা। দুপুরটা ভালোই কাটলো। শেষ বিকেলে চা নাস্তা করার ফাঁকে হালকা উশখুশ করছিলেন সাজেদা। তা খেয়াল করে বড় ভাই বললেন,

” কি হয়েছে সাজেদা? এমন উশখুশ করছিস কেন? কিছু বলতে চাস? ”

” হাঁ ভাইয়া। ”

” হুঁ বল। ”

সাজেদা মৃদু স্বরে বললেন,

” আসলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই। আশা করি তাতে তুমি আপত্তি করবে না। ”

পাশ থেকে তাহমিদা মুচকি হেসে প্রশ্ন করলেন,

” কি প্রস্তাব আপা? বলো। ”

সাজেদা দম ফেলে বলেই ফেললেন,

” ভাইয়া তোমার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে দুয়া মা’কে আমি আমার জাবির এর জন্য নিতে চাই। ”

ছোটখাটো বি’স্ফোরণ হলো লিভিং রুমে! উপস্থিত বাকি দু’জনে হকচকিয়ে! সাজ্জাদ সাহেব বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

” তুই এসব কি বলছিস সাজেদা? ”

সাজেদা মুচকি হেসে বললেন,

” খুব কঠিন কিছু বলেছি কি? দুয়া মা’কে আমি কতটা ভালোবাসি তোমরা তো জানোই। আমার বহু পুরনো ইচ্ছে। ওকে আমার পুত্রবধূ করে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়া। তোমরা চিন্তা করো না। দুয়া মা আমার কাছে অনেক যত্নে থাকবে। ওকে এতদিন ভাতিজি হিসেবে ভালোবেসেছি। এখন থেকে মেয়ের মতো করে ভালোবাসবো। দুয়া আমার পুত্রবধূ না। মেয়ে হয়েই থাকবে। ”

সাজ্জাদ সাহেব বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হলেন। তখনই ওনার মোবাইলে কল এলো। উনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলেন ইম্পর্ট্যান্ট কল।

” ইম্পর্ট্যান্ট কল এসেছে। এ বিষয়ে পড়ে কথা বলছি। ”

সোফা থেকে উঠে পড়লেন সাজ্জাদ সাহেব। কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। সাজেদা হাসি হাসি মুখ করে ভাবিকে প্রশ্ন করলেন,

” ভাইয়া নিশ্চয়ই আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানাবে, তাই না ভাবি? ”

তাহমিদা কি বলবেন ভাষা খুঁজে পেলেন না। নির্বাক তাকিয়ে রইলেন সাজেদার পানে।

ছুটির দিনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশ আলাদা। সারাটা দিন বন্ধুবান্ধব কখনোবা পরিবারের সাথে এনজয় করে থাকে জাহিরাহ্ দুয়া। আজকের দিনটা বন্ধুদের তরে! দিনভর এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি। মজাদার খাবার ট্রিট। বেশ ভালো সময় কেটেছে। দুয়া এখনো জানে না ফুপু আর ফুফাতো বোন তানু এসেছে। সাজেদা ই নিষেধ করেছে তাহমিদাকে। সারপ্রাইজ দিতে চায় কিনা! ঘোরাঘুরি শেষে ক্লান্ত দুয়া খালামণির বাসায় এলো। খালামণি খুব করে বলেছে। সে না এসে পারলো না।

তৃষার সাথে সোফায় বসে বেশ কিছুক্ষণ খুনসুটি করলো দুয়া। একপর্যায়ে তৃষা বললো,

” তুই একটু বস। আমি আসছি। ”

” আচ্ছা। ”

সেথা হতে প্রস্থান করলো তৃষা। দুয়া মনোযোগ দিলো হাতে থাকা মোবাইলে। একের পর এক লাইকি ভিডিও দেখছে এবং হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। মোবাইলে মগ্ন মেয়েটা টেরও পায়নি কখন তার ডান পাশের জায়গাটি কেউ দখল করে নিয়েছে। হাসতে হাসতে দুয়া’র পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। হঠাৎ কর্ণ কুহরে পৌঁছালো পুরুষালি কণ্ঠস্বর,

” আর কত হি হি করবি? এবার তো থাম। ”

চমকালো দুয়া! ডান পাশে তাকিয়ে দেখলো তূর্ণ বসে। দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলে। সেভাবেই বলে উঠলো,

” সোফার ওপর যেভাবে লাফালাফি ফালাফালি করছিস বেচারা সোফা অক্কা পেলো বলে। ”

” ফালাফালি? এটা আবার কোন দেশীয় শব্দ? ”

দুয়া খানিকটা বিস্মিত! তূর্ণ এবার মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর দিকে তাকালো।

” ছিঃ ছিঃ! বাঙালী হিসেবে তোর তো লজ্জায় ছেঁড়া গামছা দিয়ে মুখ লুকানো উচিত। তোদের মতো নতুন প্রজন্মের জন্য কিনা ভাষা শহীদরা আত্মত্যাগ করলো? তোরা তো উঠতে বসতে তাদের লজ্জিত করছিস। ”

দুয়া সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

” আচ্ছা? আর তোমার মতো বুড়ো প্রজন্ম বুঝি দেশের মানসম্মান এভারেস্ট অবধি নিয়ে যাচ্ছে? ”

তূর্ণ এমনভাবে তাকালো যেন তার মাথায় সপ্ত আসমান ভেঙে পড়েছে। চক্ষু বড় বড় করে শুধালো,

” আমি বুড়ো? বুড়ো চিনিস তুই? ”

” আলবাত চিনি। বুড়ো তো তোমার মতোই হয়। মেহেদী রাঙা লালচে চুল। চোখে চশমা। একদম খাঁটি বুড়ো। ”

তূর্ণ সোফায় আয়েশ করে বসলো। ওকে বললো,

” আমাকে যে বুড়ো বলেছিস। তোর কোনো ধারণা আছে আমার লেডিস ফ্যানরা এই খবর জানতে পারলে কি করবে? ”

” কি করবে? ” ভ্রুক্ষেপহীন প্রশ্ন।

” তোর কুদ্দুস বয়াতির মতো স্পেশাল চুলগুলো কেটেকুটে কেজি দরে বিক্রি করে দেবে। ”

হতবিহ্বল মেয়েটা কিছু বলতেই ভুলে গেল। আনমনে হাত পৌঁছে গেল নিজ কেশে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে শুধালো,

” আমার চুল কুদ্দুস বয়াতির মতো? এত বড় কথাটা তুমি বলতে পারলে? ”

” অফকোর্স পারলাম। আর ভুল কিছু বলেছি কি? ”

” তুমি তুমি আস্ত এক খা টা শ! দেখে নিয়ো তোমার বউয়ের চুল হবে সবচেয়ে বি শ্রী। একদম ফুলঝাড়ুর মতো। ”

এবার ক্ষে পে গেল মশাই।

” খবরদার পুতলা। আমার আদুরে পেয়ারি বিবিকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবি না। ”

” বলবো। একশো বার বলবো। হাজার বার বলবো। কি করবে তুমি? ”

তূর্ণ পকেটে মোবাইল রাখতে রাখতে বললো,

” কি করবো দেখতে চাস? ওয়েট। ”

ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না। তূর্ণ উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই উধাও দুয়া। সোফায় মোবাইল রেখে মেয়েটা দিয়েছে উসাইন বোল্ট মার্কা দৌড়। পিছু নিয়েছে তূর্ণ।

” পুতলা আজ তোকে হাতের কাছে পেয়ে নিই।‌ দাঁড়া বলছি। দাঁড়া। ”

” নো নেভার। পারলে ধরে দেখাও। হা হা হা। ”

হাসতে হাসতে লিভিং রুম জুড়ে চক্রাকারে ছুটে বেড়াচ্ছে দুয়া। পিছু পিছু ছুটছে তূর্ণ। দুই দিকে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষ এই দৃশ্য দেখে স্তব্ধ! এসব কি দেখছে তারা? সবুজাভ টি শার্ট এবং থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তূর্ণ। সামনে দৌড়াচ্ছে দুয়া। পড়নে তার নীল রঙা চুড়িদার জামা। দু হাতে পোশাক সামলিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে চলেছে মেয়েটা। তৃষা সিঁড়ির উপরিভাগে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস ফেললো। এ আর নতুন কি? পুরনো দৃশ্য। সে ওখান থেকে হাসিমুখে চলে গেল। ওদিকে তূর্ণ’র বন্ধুরা? তারা তো হতবিহ্বল! বন্ধুর নতুন রূপ দেখে কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে বুঝতেই পারছে না।

তূর্ণ প্রায় খপ করে মেয়েটাকে ধরে ফেলবে ঠিক তখনই দৃষ্টি পড়লো বন্ধুদের দেখে। মুহুর্তের মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। টি শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বেশ ভাব নিয়ে সোফায় বসলো। পেছনে কারোর উপস্থিতি টের না পেয়ে দুয়া থেমে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে পিছু ঘুরে অবাক হলো! তূর্ণ ভাইয়া কোথায়? পাশে দৃষ্টি ফেরাতে লক্ষ্য করলো মশাই সোফায় বসে মোবাইল টিপছে।

” আশ্চর্য! আমাকে ইচ্ছামত দৌড়ানি দিয়ে সে এখন রেস্ট করছে! দেখাচ্ছি মজা। ”

দুয়া বেশ প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল হঠাৎ থমকে গেল। তূর্ণ ভাইয়ার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে! থতমত খেলো মেয়েটা। মেকি হেসে হাত নেড়ে হাই জানালো। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা এতক্ষণে হুঁশ এ ফিরলো। পাতলা দেহের অধিকারী লম্বা চওড়া টগর! সে-ও হাত নেড়ে হাই জানালো।

” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আপুরা। কেমন আছেন সবাই? ”

দুয়া’র প্রশ্নে মিষ্টি হেসে উঠলো দিবা এবং মনিকা।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমরা আলহামদুলিল্লাহ্ আছি। বিজি লাইফ। বুঝতেই পারছো। ”

মনিকার কথার রেশ ধরে দিবা প্রশ্ন করলো,

” তুমি কেমন আছো দুয়া? ”

দুয়া মিষ্টি হেসে বললো, ” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। ”

” গুড! ”

তূর্ণ এবার দুয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

” তুই ভেতরে যা। আম্মুকে বল ওরা এসেছে। ”

মাথা নাড়িয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো দুয়া। তৎক্ষণাৎ বন্ধুরা বাজ পাখির নজরে তাকালো আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ’র দিকে।

” কি? এভাবে কি দেখছিস? প্রথমবার দেখছিস মনে হয়? ”

নিশাদ সোফায় দেহ এলিয়ে দিলো। বললো,

” প্রথমবার তো বটেই। আমাদের গম্ভীর ভাবওয়ালা দোস্ত দাঁত কেলিয়ে হাসছে। কাজিনের পেছনে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি করছে। প্রথমবার ই তো দেখছি। ”

তূর্ণ মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গম্ভীর স্বরে বললো,

” যা দেখেছিস ভুলে যা। ওটা জাস্ট ফান ছিল। ”

রাজীব আপত্তি জানিয়ে বললো,

” উঁহু উঁহু। সবসময় সবকিছু চাইলেও ভোলা যায় না। বিশেষ করে এমন মিষ্টি মিষ্টি খুনসুটি তো আরো নয়। ”

মনিকা দুষ্টু হেসে বললো,

” দোস্ত কি চলছে? হুঁ হুঁ? কুচ কুচ হোতা হ্যায় কেয়া? ”

” দানিশ তোর বউ আজকাল পরপুরুষে বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে। সময় থাকতে সামলা। নইলে পেয়ারি বিবি হাতছাড়া। ”

দানিশ কিছু বলবার পূর্বেই মনিকা বললো,

” এহ্! এখন কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে। ”

টগর হাসি হাসি মুখ করে শুধালো,

” দোস্ত! ছোট বোনটাকে ভাবি ডাকা প্রাকটিস শুরু করবো কি? ”

তূর্ণ এমন চাহনিতে তাকালো যে টগর দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,

” ডাকবো? ”

তূর্ণ হাঁ বা না কিছুই বললো না। এতে লাই পেয়ে দানিশ স্ত্রীকে বললো,

” মনি! বিয়ের শপিং শুরু করে দাও। অবশেষে দোস্তের ব্যাচেলর লাইফের দ্যা এন্ড হতে চলেছে। ”

তূর্ণ ওদের সবার খুশি খুশি ভাব দেখে এক বালতি পানি ঢেলে দিলো।

” ইয়াহ। তোর দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ চলছে। শীঘ্রই পেয়ে যাবো। ”

হতবিহ্বল হলো দানিশ! মনিকা গাল ফুলিয়ে বললো,

” নিজে তো চিরকুমার। এখন আমার বরের দিকে কুনজর দিচ্ছিস? ”

টগর পাশ থেকে বলে উঠলো,

” আহা গো! টুরু লাভ! এই আনন্দে ট্রিট চাই। ”

দানিশ বললো,

” চিকনা থেকে মোটকা হ। দেবো নে। ”

” হুহ্! লাগবে না তোর ট্রিট। তূর্ণ দেবে নে। ”

রাজীব হেসে বললো,

” হাঁ। তূর্ণ তো তোর জন্য ভার্সিটিতে ক্যান্টিন খুলছে। যখন তখন খাদ্য সাপ্লাই। ”

মৃদু হাসলো তূর্ণ। তখন অতিথিদের জন্য নাস্তা নিয়ে হাজির হলেন তাসলিমা। সাথে হেল্পিং হ্যান্ড। কুশলাদি বিনিময় হলো। কয়েক সপ্তাহ বাদে বন্ধুরা বন্ধুরা দারুণ সময় কাটালো।

তমসায় আবৃত বসুন্ধরা। এতদিন বাদে ফুপুকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা দুয়া। ফুফাতো বোন তানুর সাথে দুর্দান্ত সময় কাটছে। তানজিনা সে-ও শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলো। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর তিন বোনের মধ্যে কয়েক ঘন্টাব্যাপী আড্ডা চললো। এসবের ভিড়ে সাজেদা আর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। নির্বিঘ্নে অতিবাহিত হলো রাত্রি। তবে পরেরদিন হলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড।

দুপুরের ভোজন সম্পন্ন করে লিভিং রুমে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন সাজ্জাদ সাহেব। তখন সেখানে উপস্থিত হলেন সাজেদা। তাহমিদা এবং তানজিনা টেবিল গুছগাছ করছে। দুয়া ভার্সিটি থেকে এখনো ফেরেনি। জাহিন ও তানু রুমে কম্পিউটারে গেমস খেলছে। সাজেদা উশখুশ করে প্রশ্ন করলো,

” ভাইয়া কিছু তো বললে না। ”

পত্রিকায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সাজ্জাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

” কোন বিষয়ে? ”

” ওই যে। দুয়া মা আর জাবিরের বিষয়ে। ”

তাহমিদা এবং তানজিনা কাজের ফাঁকে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। দু’জনের কান ই সজাগ। সবটা শুনছে। সাজ্জাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে পত্রিকা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। নরম স্বরে বললেন,

” দেখ সাজেদা। তুই যে প্রস্তাব দিয়েছিস তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে মেয়ে বড় হলে এমন প্রস্তাব অহরহ আসে। স্বাভাবিক। ”

” হুম। ”

” তবে আমি এই মূহুর্তে দুয়া’র বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না। মেয়েটার বয়স কম। পড়ালেখা করছে। করুক। বিয়েশাদী নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। ”

” হাঁ ঠিক আছে। এখুনি বিয়েশাদীর মধ্যে জড়াতে হবে না। আমি চাইছিলাম ওদের সম্পর্কের একটা নিশ্চয়তা। ধরো এনগেজমেন্ট কিংবা আকদ করিয়ে রাখা হলো। সময় হলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা হবে। ”

তাহমিদা এবং তানজিনা কাজকর্ম সেরে এখানে উপস্থিত হলো।

” এনগেজমেন্ট কিংবা আকদ! এসব কি বলছিস? ছেলেমেয়ে রাজি কিনা জানি না। অভিভাবকের সম্মতি আছে কি নেই। তুই এতদূর অবধি ভেবে ফেলেছিস! ”

সাজ্জাদ সাহেবের কণ্ঠে বিস্ময়!

” কেন ভাইয়া? ভাবতে কোনো অসুবিধা আছে কি? একদিন না একদিন তো হবেই। ক’দিন আগে হলে কি এমন সমস্যা? ”

সাজ্জাদ সাহেব মৃদু স্বরে বললেন,

” আগেভাগেই এত ভাবিস না বোন। ভাবনা বাস্তবে রূপান্তরিত নাও হতে পারে। তখন খারাপ লাগবে। ”

” ভাইয়া তুমি এসব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি এই প্রস্তাবে রাজি নও? ”

তাহমিদা এবং তানজিনা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সাজ্জাদ সাহেব এর পানে। সাজ্জাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

” তোর প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে বোন। মন খারাপ করিস না। ”

হতভম্ব হলেন সাজেদা!

” কেন? ”

” কারণ আমি ইতিমধ্যে কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলেন সাজেদা এবং তানজিনা! সাজেদা বুঝতেই পারছেন না ওনার কিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত। তার এতদিনের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে!

চলবে.

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১২

” তোর প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে বোন। মন খারাপ করিস না। ”

হতভম্ব হলেন সাজেদা! মলিন কণ্ঠে শুধোলেন,

” কেন? ”

” কারণ আমি ইতিমধ্যে কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলেন সাজেদা এবং তানজিনা! সাজেদা বুঝতেই পারছেন না ওনার কিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত। তার এতদিনের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে!

” ত্ তুমি এসব কি বলছো ভাইয়া? তুমি কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! কার কাছে? ”

” তাসলিমা আপার কাছে‌। ”

সাজ্জাদ সাহেবের সরল জবাব। দ্বিতীয় দফায় হতভম্ব হলেন সাজেদা এবং তানজিনা! তাহমিদা অবশ্য চুপটি করে দাঁড়িয়ে। সাজেদা কোনোমতে নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলেন,

” প্রতিশ্রুতি দিয়েছো! কবে? আমাদের তো বিন্দুমাত্র জানালে না। নাকি ফুপু হিসেবে আমার জানার অধিকার নেই? ”

সাজ্জাদ সাহেব না বোধক উত্তর দিলেন।

” এমন কিছুই নয়। মাস তিনেক আগে আপার সাথে কথা হয়েছে। প্রস্তাব আমার মনমতো ছিল। তাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কয়েক বছর পর দুয়া মা’কে তূর্ণ’র হাতে তুলে দেবো। আপাতত ও পড়ালেখা করছে। করুক। ”

সাজেদা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন।

” বাহ্! আবারো পক্ষপাতীত্ব? তুমি বরাবরই বাপের বাড়ির থেকে শ্বশুরবাড়িকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছো ভাইয়া। আদরের মেয়ের বিয়ের বেলাতেও তাই করছো? ”

অবাক হলেন সাজ্জাদ সাহেব! তাহমিদা মন খারাপ করে দৃষ্টি নত করে নিলেন। সাজ্জাদ সাহেব বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,

” তুই এসব কি বলছিস? আমি পক্ষপাতীত্ব করি? ”

” হাঁ করোই তো। আফটার অল তারা সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোক। তোমার সুখদুঃখের সাথী। মানি প্লান্ট। তাদের তোষামোদ করতে হবে না? ”

সাজ্জাদ সাহেব খানিকটা রাগত সুরে বললেন,

” সাজেদা! মুখ সামলে কথা বল। ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই। ”

” আমি মুখ সামলেই কথা বলছি ভাইয়া। আর তুমি আমার বড় ভাই সেটাও ভুলিনি। মনে আছে। তবে তুমি ভুল করছো। ছোট বোন হিসেবে সেই ভুলটা আমি শুধরে দেয়ার চেষ্টা করছি মাত্র। ”

” আমি ভুল করছি? কেমন ভুল? ” সাজ্জাদ সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোনের পানে।

” ভুল ই তো। ও ই তূর্ণ না তূর্য কি যেন নাম! ও মানুষ হিসেবে দুয়া’র যোগ্য নাকি? সবসময় ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে। বড়ছোট কিছুই মান্য করে না। এর উপর দুয়া সর্বদা ওর যন্ত্রণায় তটস্থ। এরা জুটি হিসেবে একদম বেমানান। ওদের বিয়ে হলে সংসারে অশান্তি ছাড়া কিছুই থাকবে না। ক’দিনের মধ্যেই হয়তো ডিভোর্স হয়ে যাবে। ফুপু হিসেবে আমি এটা হতে দিতে পারি না। ”

প্রিয় ভাগ্নেকে নিয়ে এমন কটূক্তি মানতে পারলেন না তাহমিদা। উনি নরম কণ্ঠে বলে উঠলেন,

” আপা তোমাদের মধ্যে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। কিছু মনে করো না। তূর্ণ কিন্তু ছেলে হিসেবে মোটেও খারাপ না। ওর বিরুদ্ধে তোমরা একটাও অভিযোগ পাবে না। সবাই ওকে ভালো জানে‌। আর ভালোবাসেও। আমার বোনের ছেলে বলে বলছি না। তূর্ণ খাঁটি হীরা। সব বাবা মা ই ওর মতো জামাতা চাইবে। ”

সাজেদা বিদ্রুপ করে বললেন,

” হুঁ! খাঁটি হীরা। তুমি তো বলবেই ভাবি। তোমার সম্মানীয় বড় বোনের ছেলে কিনা! ”

তাহমিদা কিছু বলতে উদ্যত হতেই সাজ্জাদ সাহেব হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,

” সাজেদা তুই তূর্ণ’কে কেন অপছন্দ করিস জানি না। তবে শুধু আমরা নই। আশপাশের সবাই জানে তূর্ণ কেমন ছেলে। মেয়ে জামাই হিসেবে আমাদের দুয়া’র জন্য ওর মতো ছেলে পাওয়া দুষ্কর বটে। ”

দম ফেলে উনি পুনরায় বলতে লাগলেন,

” আর কি যেন বলছিলি? তূর্ণ সবসময় ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে, বড়ছোট কিছুই মান্য করে না? কথাটায় একটু ভুল আছে। ও কিন্তু সবার সাথে এমন আচরণ করে না। শুধুমাত্র ফ্যামিলির লোকেদের কাছেই তূর্ণ ঠোঁটকাটা, দুষ্টু ছেলে। বাইরের দুনিয়ায় আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ একজন গম্ভীর মানুষ। ও একটা ভার্সিটির লেকচারার। খুব ভালো করেই জানে কোথায় কেমন আচরণ করতে হবে। কোন জায়গায় কোন আচরণ মানানসই। তূর্ণ ছেলেটা ফ্যামিলি ম্যান। তাই ফ্যামিলিতে একজন মাটির মানুষের মতো মিশে থাকে। ও নিজে নামকরা একটা ভার্সিটির লেকচারার। বাবার এত ধনসম্পদ। পূর্বপুরুষ সূত্রেও বেশকিছু সম্পদ পেয়েছে। তবুও ছেলেটার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। ও যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারে। এই যে আমরা তো মধ্যবিত্ত। ওদের ক্লাসের নই। তবুও ওই পরিবারের সাথে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক। কখনো মনেই হয় না তারা আমাদের উঁচু শ্রেণীর। আমাদের নিচু দৃষ্টিতে দেখছে। ”

বাবার কথার রেশ ধরে তানজিনা বললো,

” আর ফুপি। তুমি বললে না? দুয়া তূর্ণ’র যন্ত্রণায় তটস্থ, এটা সম্পূর্ণ ভুল। ওদের মধ্যে সম্পর্কটা খুব স্নিগ্ধ, সরল। কোনো প্যাঁচ নেই। খুনসুটিতে ভরপুর। ছোটবেলা থেকেই দু’জনে পাশাপাশি বড় হয়েছে। আমরা সবাই জানি এমনকি দেখেছি। দুয়া তূর্ণ বলতেই পা’গল। ছোটো থেকেই আমার বোনটার বেশীরভাগ আবদার ছিল ওর তূর্ণ ভাইয়ার কাছে‌। দু’জনের বয়সের পার্থক্য নয় বছর। তবুও ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। একে অপরকে বুঝতে পারে। সুখদুঃখে সঙ্গ দেয়। দুয়ার কোনো বিপদ হলেই নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসে তূর্ণ। আবার তূর্ণ’র সামান্য কিছু হলেই আমার বোনটা কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলে। এসব আজো চলমান। ওদের সম্পর্কটা দিনকে দিন গ্ৰো করেছে। আরো মজবুত হয়েছে। ওরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ। ”

সাজেদা ব্যঙ্গ করে বললেন,

” বাহ্! বড়লোক বাড়ির সম্বন্ধ পেয়ে সবাই তো ঠিকভুল গণ্য করতেই ভুলে গেছে। সমানে গুণগান গেয়ে যাচ্ছে। চমৎকার তো! ”

সাজ্জাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,

” তুই যে প্রস্তাব দিলি তা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল। এর উপর আমি কারো কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই জাবির এর সাথে দুয়া মায়ের সম্বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য তুই এভাবে কটূক্তি করে বলতে পারিস না। এটা বাজে শোনায়। ”

” তোমরা বাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারো। অথচ আমি বললেই দোষ? ”

” সাজেদা! ” গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলেন সাজ্জাদ সাহেব।

” হাঁ সাজেদা। সাজেদা ভুল কিছু বলছে না। এখনো সময় আছে ভাইয়া। বড়লোকের ছেলে। এর উপর কারোর ধার ধারে না। বেপরোয়া স্বভাবের। ওখানে মেয়ে দিয়ো না। পরে পস্তাবে। ”

” পরেরটা না হয় পরেই দেখা যাবে। আপাতত এসব কথা বন্ধ কর। আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। ”

উঠে দাঁড়ালেন সাজ্জাদ সাহেব। বোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,

” দুয়া’র কানে যেন এসব কথাবার্তা না যায়। ”

ওখান থেকে প্রস্থান করলেন সাজ্জাদ সাহেব। পিছুপিছু তাহমিদা এবং তানজিনা। রাগে ক্ষো’ভে দু হাতে সোফা খামচে ধরলেন সাজেদা। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা তার। সবটা শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। আর কত চলবে এসব? আর কত?

গোধূলি লগ্ন। রিকশা থেকে নামলো দুই ললনা। দুয়া ভাড়া পরিশোধ করতে করতে হাসিমুখে বললো,

” বিশাল আস্ত এক ড্রামাবাজ। দেখলি ওর কাণ্ড? অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারবে না বলে শেষমেষ হাড়কাঁপানো জ্বরের নাটক? ”

তৃষা চোখমুখ কুঁচকে বললো,

” শা লা আস্ত এক ব দ। এমন ড্রামা করলো! আমি তো ভাবলাম আজরাইল দেখা দিয়ে ফেললো কিনা! ”

রিকশাওয়ালা প্রস্থান করতেই দুয়া হাসতে হাসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। হাসতে হাসতে বললো,

” আমিও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো ভার্সিটি শেষে তোকে নিয়ে ওর বাড়ি ছুটলাম। আর গিয়ে দেখি কি? ”

” মিচকা শ*তান একটা! ওর ভালো হবে না বলে রাখলাম। ফাইনালে ফেল করে পরেরবার ইমপ্রুভমেন্ট দেবে। ”

” হোয়াট অ্যা অভিশাপ! ”

দুয়াকে হাসতে দেখে তৃষা নিজেও হেসে উঠলো। বললো,

” যাই বলিস না কেন। এসবের ভিড়ে ভালোমন্দ নাস্তা তো খাওয়া হলো। ছানা মিষ্টিটা কিন্তু অসাম ছিল! এখনো মুখে স্বাদ লেগে আছে। ”

” একদম। আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তাহলে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আম্মু চিন্তা করবে। আল্লাহ্ হাফিজ। আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আল্লাহ্ হাফিজ। ”

বিদায় নিলো দু’জনে। দুয়া প্রবেশ করলো তাদের অ্যাপার্টমেন্টে। আর তৃষা হাঁটতে লাগলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যা কিনা মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত।

বাড়ি ফিরে খুশিতে বাকবাকুম জাহিরাহ্ দুয়া! ফুপু এসেছে। এখন আবার খালামণিও চলে এসেছে। সাথে নানুমনি ফ্রি। দুর্দান্ত! অসাধারণ! দুয়া কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে ছুটে এলো লিভিং রুমে। নানুমনির পাশে বসে তাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো। ডান কপোলে চুমু এঁকে বললো,

” নানুমনি! আমার কিউটি! কবে এলে তুমি? ”

আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে নাতনিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললেন,

” এই তো নানুভাই আজ সকালে এসেছি। ”

দুয়া গাল ফুলালো। অভিমানী স্বরে বললো,

” একে তো সে-ই সকালবেলা এসেছো। আবার আমাদের বাসায় না এসে বড় মেয়ের বাসায় উঠেছো। এমনটা করতে পারলে তুমি? হুঁ? একটুও খারাপ লাগলো না? ”

আনোয়ারা বেগম মুচকি হেসে নাতনির গাল টিপে দিলেন।

” আমার কিউটি! গাল ফুলাতে হবে না। আমি আসতে একটু দেরি করেছি তাতে কি হয়েছে? কয়েকদিন তো তোমাদের কাছেই থাকবো। ”

” সত্যি? ” খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রশ্ন করলো দুয়া।

” হুম। সত্যি। ”

ওদের হাসিখুশি মুহূর্ত সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন সাজেদা। রাগে গজগজ করতে করতে পা বাড়ালেন ভাইয়ের কক্ষের দিকে।
.

কক্ষে সাজ্জাদ সাহেব এবং তাহমিদা কিছু বিষয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। বিনা অনুমতিতে সেখানে প্রবেশ করলেন সাজেদা। যা দেখে দু’জনেই কিছুটা বিব্রত বোধ করলো।

” তুই? কিছু বলবি? ”

ভাইয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে ভাবিকে উদ্দেশ্য করে সাজেদা বললেন,

” ভাবি তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে আমি ভাইয়ার সাথে একাকী কথা বলতে চাই।‌ অবশ্য তুমি থাকলেও অসুবিধা নেই। ”

ভাবিকে সম্পূর্ণ রূপে অবজ্ঞা করে সাজেদা ভাইকে বলে উঠলেন,

” ভাইয়া! এসব কি শুনছি? তোমার শাশুড়িও এখানে থাকবে? ওনার কি কমনসেন্স বলে কিছু নেই? বাসায় অলরেডি মেহমান আছে। আমি আছি, আমার মেয়ে আছে। আমাদের মিনিমাম স্পেস দরকার। এরমধ্যে উনি ড্যাং ড্যাং করতে করতে চলে এলেন? কেন? ধনী মেয়ের বাড়িতে জায়গা হয়নি? তাড়িয়ে দিয়েছে? ”

” সাজেদা! ”

ধমকে উঠলেন সাজ্জাদ সাহেব। তাহমিদা মলিন মুখে তাকিয়ে।

” মুখ সামলে কথা বল। উনি আমাদের মায়ের বয়সী। তোর ভাবির মা হয়। ভুলে গেছিস? ”

” না ভুলিনি। তবে উনি বোধহয় ভুলে গেছেন এটা ওনার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। যখন তখন আসাযাওয়া উচিত নয়।”

” উনি তানজি, দুয়া ওদের নানুমনি। যখন খুশি তখন আসতে পারেন। আমরা বাঁধা দেয়ার কে? আর তুই বোধহয় শুনিসনি উনি আমাদের বাসায় এখুনি আসছেন না। কিছুদিন পর আসবেন। আপাতত বড় আপার বাসায় থাকবেন। ”

” হাঁ তাই তো করবেন। বড়লোক মেয়ের বাসা ছেড়ে ফকিরের বাসায় আসবেন কেন? ”

এতসব বাজে কথা শুনে ছলছল করছে তাহমিদা’র নয়ন জোড়া। সাজ্জাদ সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” বাসায় মেহমান। ফালতু কথা বাদ দিয়ে নিজের রুমে যা। এক বিষয়ের ক্ষো ভ অন্য বিষয়ে প্রকাশ করা ঠিক হচ্ছে না। রুমে যা। ”
.

বাবা-মায়ের রুম থেকে তর্কবিতর্কের শব্দ আসছে। কি হচ্ছে এসব? কৌতূহল বোধ করে উঠে দাঁড়ালো দুয়া। নানুমনিকে সোফায় বসিয়ে রেখে রুমের দিকে পা বাড়ালো। খানিক অগ্রসর হতেই লক্ষ্য করলো খালামণি পানির গ্লাস হাতে বাবা-মায়ের রুমের কাছাকাছি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে। কিছুটা অবাক হলো দুয়া!

” খালামণি! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো? নানুমনি তো পানি চেয়েছে। ”

হঠাৎ কারোর কণ্ঠে হকচকিয়ে গেলেন তাসলিমা! কোনমতে নিজেকে সামলিয়ে বললেন,

” এই তো যাচ্ছি। তুইও চল মা। ”

” তুমি যাও আমি আসছি। আব্বু আম্মুর রুমে কি নিয়ে যেন তর্ক হচ্ছে। আমি দেখে আসছি। তুমি যাও। ”

তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালেন তাসলিমা।

” বড়দের কথায় নাক গলাতে নেই। তুই চল আমার সাথে। ”

দুয়া খালামণির সাথে চলেই যাচ্ছিল হঠাৎ কর্ণ কুহরে পৌঁছালো ফুপুর কণ্ঠ। তৎক্ষণাৎ দু’জনেই দাঁড়িয়ে গেল।
.

” তুমি আমাকে এত বড় কথাটা বলতে পারলে ভাইয়া? তোমার কাছে এখন বাপের বাড়ির ঊর্ধ্বে শ্বশুরবাড়ি! বাহ্ ভাইয়া বাহ্! সব পুরুষ মানুষ ই বুঝি বিয়ের পর বউয়ের নেওটা হয়ে যায়? শাড়ির আঁচল ধরে ঘুরে? ”

চোখ রাঙানি দিলেন সাজ্জাদ সাহেব।

” মুখ সামলে কথা বল সাজেদা। তুই কিন্তু এবার অতিরিক্ত করছিস। আর গলার আওয়াজ নামিয়ে কথা বল। ওনারা বাসায়। ”

” হাঁ তো? আমি কি তাদের ভয় পাই? তোমার বোন হই আমি। আর ওনারা পরের বাড়ি। তোমার বউয়ের আপনজন। তোমার একমাত্র আপনজন আমি। তাই তোমার উচিত আমাকে প্রাধান্য দেয়া। তা না করে ওই বাড়ির লোকেদের তরফদারগিরি করছো? কি করে? সত্যি করে বলো তো তারা কি তোমায় কালোজা*দু করেছে? নাহলে কি করে এতটা বদলে গেলে তুমি? তুমি তো এমন ছিলে না। আমার সহজ-সরল ভাইটা এখন দিনরাত বউয়ের কথায় উঠছে। বসছে। এসব কোন ধরনের কাপুরুষত্ব? ”

আর সহ্য করতে পারলেন না সাজ্জাদ সাহেব। অজান্তেই ওনার হাত উঠে গেল। তৎক্ষণাৎ হাত ধরে বাঁধা প্রদান করলেন তাহমিদা। অবাক কণ্ঠে বললেন,

” তুমি এসব কি করতে যাচ্ছিলে? নিজেকে শান্ত করো।”
.

কক্ষের বাইরে থাকা দু’জন স্পষ্ট শুনতে পেল এসব। দুয়া ছলছল চোখে তাকালো খালামণির পানে। তাসলিমা চোখের পানি লুকিয়ে মেকি হেসে সেথা হতে সরে গেলেন। দুয়া বুঝতে পারছে না সে কি করবে। ভেতরে যাবে নাকি এখান থেকে চলে যাবে? মেয়েটা যখন মন খারাপ করে কঠিন ভাবনায় মশগুল হঠাৎ…

চলবে.