তৃ-তনয়া পর্ব-১০৫+১০৬+১০৭

0
714

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৫
(নূর নাফিসা)
.
.
কিছুদিন পর,
অফিস থেকে ইমরান তিনটার দিকে বাসায় এসেছে। নাফিসা তখন ঘুমাচ্ছিলো। দরজায় নক করলে সে দরজা খুলে দিলো। ইমরান মলিন মুখে ঘরে প্রবেশ করলো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– আজ এতো তারাতাড়ি ফিরে এলে যে?
ইমরান কোনো জবাব না দিয়ে জুতা খুলে র‍্যাকের মধ্যে রেখে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখলো। অত:পর বাথরুমে চলে গেলো! নাফিসা ঘুমঘুম চোখে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলো শুধু! দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সময় তিনটা চার মিনিট! এ কোন সময়ে এলো সে! অফিস হাফ টাইম হলে দুইটার আগেই এসে পড়ে, আর ফুল টাইম হলে চারটা-পাঁচটা বেজে যায়! কিছু জিজ্ঞেস করলো তারও জবাব পেল না! হয়েছে টা কি তার!
নাফিসা হাই তুলতে তুলতে বিছানা গুছিয়ে ঘড়িটা জায়গা মতো গুছিয়ে রাখলো। অত:পর আবার হাই তুলতে তুলতে হাতমুখ ধোয়ার জন্য বেরিয়ে এলো রুম থেকে। দেখলো ইমরান হাতমুখ ধুয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বড় ঘরের দিকে যাচ্ছে! তোয়ালে রেখে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছে, আবার রুমে এসে চেঞ্জও করলো না সে! ব্যাপারটা নাফিসার কাছে রহস্যজনক লাগছে! সে নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে! কিন্তু কি!
নাফিসা ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছে, পানি পান করে, ফোনটা চার্জে দিলো। অত:পর নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে নিশাতের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো নিশাত ঘুমাচ্ছে! সে গেইট লাগিয়ে বড় ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎই তাদের ঘরের চালায় শব্দ হলো। টিনের চালায় গড়গড় শব্দ করে একটা আম গড়িয়ে পড়ে উঠুনের মাঝামাঝিতে এসে গেছে। নাফিসা হাতে নিয়ে দেখলো পাকা আম। কিন্তু খোসায় রঙ না ধরায় বাইরে থেকে বুঝা যায় না পাকা না কাঁচা। আরও দু সপ্তাহ আগে শিপন লিচু, আম, আর দুইটা কাঁঠাল পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আর তাদের গাছের আম সবেমাত্র পাকতে শুরু করেছে। নাফিসা আম নিয়ে জিহানকে ডাকতে ডাকতে ঘরে এলো। গতকাল আবিদা বেগম আয়েশা বেগমের কাছে গেছে। আজ বিকেলে ফিরবেন। এঘরে শুধু বড়মা ও জেরিন আছে। নাফিসার ডাকে সাড়া দিয়ে জিহান ড্রয়িং রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। এদিকে নিজের রুমে থেকে জেরিনও বলছিলো, “জিহান ড্রয়িং রুমে টিভি দেখে।”
নাফিসা টেবিল থেকে ছুরি নিয়ে ড্রয়িংরুমেই এলো। আমটিকে তিন টুকরো করে জিহানের হাতে এক টুকরো দিয়ে ভাবলো ইমরানকে আরেক টুকরো দেওয়া যাক। কিন্তু সে কোথায়! বেরিয়ে গেছে নাকি! জিহানকে জিজ্ঞেস করলো,
– জিহান, চাচ্চু কোথায়?
– বড় দাদুর সাতে।
নাফিসা বড়মার রুমের দরজার সামনে এসে থেমে গেছে! বড়মার কোলে মাথা রেখে ইমরান কান্না করছে আর কিছু বলছে! তার কথাবার্তা শুনে নাফিসা বুঝে গেলো ইমরান যে বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলো তাতে টিকেনি! আর এজন্যই ইমরান কান্না করছে আর বড়মা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন! নাফিসারও মনটা খারাপ হয়ে গেলো! সে আম নিয়ে আবার ড্রয়িং রুমে এসে পড়লো। ছেলেদের কান্না মোটেও ভালো লাগে না নাফিসার! কিন্তু কান্না করবেই না কেন! কম কষ্টে কি আর কাঁদছে সে! এতোগুলো দিন পড়াশোনা করলো, দিন নেই, রাত নেই বই নিয়ে বসে থাকতো! তার রেজাল্ট কি এমন হওয়ার কথা ছিলো! ভাবতে ভাবতে নাফিসার চোখেই পানি এসে গেছে! কার্টুন দেখে জিহান হেসে খাটে লাফাতে লাগলে নাফিসার ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সে চোখ মুছে এক টুকরো আম খেয়ে আরেক টুকরো জিহানকেই খায়িয়ে দিলো। অত:পর কিচেনে এলো। ইমরানের জন্য খাবার দিবে কি দিবে না তা ভেবে কিচেনেই কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলো। এই মুড নিয়ে সে এখন খাবে না ভেবে আর খাবার নিলো না প্লেটে। রাতের রান্নার ব্যবস্থা করতে লাগলো সে। জেরিন রান্নার ধারে না এলেও বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে, আসবাবপত্র মুছে পরিষ্কার রাখে। এ অবস্থায় ঘর মুছতে দেয় না তাকে। ওইঘরের কাজ তো নাফিসাই করে সব, তাই নিশাতই মুছে দেয় এইঘর।
আসরের আযান দিলে বড় মা নামাজ পড়ে বেরিয়ে এসেছে রুম থেকে। নাফিসাকে রান্না করতে দেখে বললো,
– ওমা! রাধুনি সবজি কেটে রান্না বসিয়েও দিছে দেখছি!
নাফিসা ঠোঁটের এক কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– নামাজ পড়েছেন?
– হ্যাঁ। যা তুই গিয়ে নামাজ পড়। নিশাত মনে হয় ঘুম থেকে উঠেনি। ডেকে দিস।
– ছোট সাহেব নামাজে গেছে?
– হুম। ছোট সাহেবের মনটা খুব খারাপ। আল্লাহ ছেলেটার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন।
– দুপুরে খেয়েছে কিছু?
– বাসায় ফিরে তোর সাথে দেখা হয়নি?
– হয়েছে, কিন্তু কথা বলার মুডে ছিলো না।
– খায়নি কিছু। খেতে বললাম, বললো এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। রাতে খাবে।
– আমি নামাজ পড়ে আসি।
– যা।
নাফিসা চলে এলো। নিশাতকে ডেকে তুলে দিলো। আর ওযু করে রুমে এসে দেখলো ইমরান চোখ বন্ধ রেখে শুয়ে আছে। মসজিদ থেকে মাত্রই এসেছে বোধহয়। জানে তার মনটা ভালো নেই তাই নাফিসা কোনো কথা বললো না। চুপচাপ নামাজ পড়ে নিলো। অত:পর দরজা চাপিয়ে বড় ঘরে চলে এলো। বড়মার সাথে রান্নাবান্না শেষ করলো। আরমান বাসায় এসে কল করেছিলো আবিদা বেগমকে আনতে যাবে কি-না। আয়েশা বেগম বললো, আরও দুদিন রেখে দিবে। আয়াতও বললো এখন আসতে দিবে না। অন্যদিকে আবিদা বেগম বললেন কাল এসে পড়বে। তাই আজ আর গেলো না আরমান। ইমরানের ব্যাপার জেনে সে ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করলো নাফিসার কাছে। নাফিসা জানালো সে ঘুমাচ্ছে। তাই আর আরমান এলো না দেখা করতে।
মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। নাফিসা রুমে এসে দেখলো ইমরান এখনো ঘুমাচ্ছে। বিষন্নতা ছেয়ে যাওয়া ঘুমন্ত মুখখানা দেখে সে তার পাশে বসে চুলের ফাঁকে আঙুল দিয়ে চিরুনী করলো এবং কপালে একটা পরশ দিলো। অত:পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলো। ইমরান চোখ মেলে তাকাতেই সে বললো,
– মাগরিবের আজান পড়ছে তো। ওঠো..
ইমরান উঠে বসে ঘুম কাটাতে সমস্ত মুখমন্ডলে হাত বুলিয়ে কয়েকবার পলক ফেললো। নাফিসা বললো,
– সকালে খেয়ে গেছো, সারাদিনে আর খাওয়ার খবর নেই। ক্ষুধা লাগেনি?
– নাহ।
বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে কথাটা বললো। নাফিসার দিকে না তাকানোর কারণে নাফিসা কিছুটা রেগে গেলো! যার ফলে আর ইমরানের বিছানা ছেড়ে নামা সম্ভব হলো না। কেননা তার আগেই নাফিসা এক হাতে তার শার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,
– আমার সাথে এমন করছো কেন?
কিছু না বুঝতে পেরে ইমরান ব্রু কুচকে তার দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো! নাফিসা আবার বললো,
– আমার এতে কি দোষ? আমি তোমার বিসিএস পরীক্ষা নিয়েছি? আর আমি ইচ্ছে করে তোমাকে ফেইল করিয়ে দিয়েছি? আমাকে এমন ইগনোর করছো কেন?
ইমরান কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,
– কি আশ্চর্য! আমি তোমাকে কখন ইগনোর করলাম!
– ইগনোর করোনি? বাসায় ফিরেছো পরেও কিছু জিজ্ঞেস করলাম অথচ জবাব পেলাম না! এখনও কিছু জিজ্ঞেস করলাম যেন আমার দিকে তোমার তাকাতেই মানা! কেন? আমার কি দোষ এতে?
ইমরান বিরক্তি নিয়ে তার হাতটা ঝাড়ি দিয়ে ছুটিয়ে নামতে নামতে বললো,
– তোমার চেহারা দেখে দেখে আমাকে কথা বলতে হবে? সবসময় এমন ঢং ভালো লাগে না।
নাফিসার ভেজা চোখ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমরানের যাওয়ার দিকে! দৃষ্টি যে খুব ব্যাথা প্রকাশ করছে তা কি লোকটা পেছনে ফিরে একবার দেখবে না! নাহ! দেখলোই না! চলে গেলো দৃষ্টির আড়ালে! নাফিসা চোখের ধার মুছে মনে মনে নিজের ভালোবাসার প্রতি নিন্দা প্রকাশ করলো,
“এজন্যই কাউকে বেশি ভালোবাসতে নেই! বেশি ভালোবাসলে না পারা যায় কোনো কারণে তার অবহেলা সহ্য করতে আর না পারা যায় তাকে কিছু বলতে! ভালোবাসা যত গভীর হয়, তত অভিমান বৃদ্ধি পায়! আর কারো মাঝে বিন্দু পরিমাণ ধৈর্যের অভাব থাকলে ক্ষুদ্র কারণ বা বিনা কারণেই মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি হয়ে ধ্বংসলীলা বয়ে যায়! লোকে যা বলে ঠিকই বলে। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না! ভালোবাসাটাও ভালো না! অতিরিক্ত ভালোবাসা অতিরিক্তই কাঁদিয়ে যায়! সব কিছুতে স্বল্পতা ই ভালো!”
বেশ কয়েকবার নিরবে চোখ মুছে গেলো নাফিসা। সে চাইছে না এক ফোঁটাও পানি গড়িয়ে পড়ুক! তবুও ভেতরটা কেমন যেন চেপে আছে আর চোখে অশ্রুধারা বইছে! ইমরান মসজিদে গেলে সে ওযু করে নামাজ আদায় করে নিলো। পরক্ষণে আবার ইমরান ঘরে এলে সে বড় ঘরে ড্রয়িং রুমে এসে টিভি অন করে বসলো। কার্টুন চলছে। সে কিছুক্ষণ একের পর এক চ্যানেল পাল্টালো। ভালো লাগছে না কিছু। তাই পরে আবার কার্টুনের চ্যানেলে দিয়েই সে চলে এলো নিশাতের রুমে। ইউটিউবে কিছুক্ষণ হিজাব স্টাইল দেখলো, কিছুক্ষণ শোপিচ তৈরি দেখলো আবার কিছুক্ষণ রান্নাবান্না দেখলো। নিশাত আশিকের সাথে কিছুক্ষণ চ্যাট করে পরে আবার বাংলা নাটক দেখছে। ইমরান এসে দরজা ঠেলে একবার উঁকি দিয়েছিলো। নাফিসা সেদিকে তাকায়নি। ইমরান নিশাতকে ডেকে বললো সে গেইটে তালা লাগিয়ে মসজিদে যাচ্ছে। তারা যেন নামাজ পড়ে নেয় এ ঘরে। সে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর উভয়েই নামাজ পড়ে নিলো। নাফিসা এবার টিংকারবেল কার্টুন দেখছে। ইমরান তাদের খাওয়ার জন্য ডাকলো। নিশাত বেরিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নাফিসাকে বের হতে না দেখে ইমরান আবার এলো। সামান্য বিরক্তির সাথেই বললো,
– কথা কানে যায়নি? সবাই বড় ঘরে চলে যাচ্ছি আর তুমি একা একা থাকবে এখানে?
নাফিসা এবার রেগেমেগে বেরিয়ে এলো। কারো জন্য আর অপেক্ষা না করে একাই বড় ঘরে চলে এসেছে। খেয়েছে একসাথেই, কিন্তু নাফিসা একটা কথাও বলেনি। কাজকর্ম চলেছে তার নিরবে। খাওয়া শেষ হতেই নিশাতকে ডাকলো ওই ঘরে যাওয়ার জন্য। নিশাত এবং সে চলে এলো আর ইমরানের সাথে আরমান কিছুক্ষণ কথা বললো। ইমরানের মন খারাপ, সেই বিষয়েই। ইমরান রুমে এসে দেখলো নাফিসা মশারী টানিয়ে শুয়ে আছে। সে-ও নিজের মতো এসে শুয়ে পড়লো। দুজন দ্বিমুখী হয়ে দু প্রান্তে আর মাঝখানে ফাঁকা!
কারোই ভালো লাগছে এমন রেগে থাকতে! ইমরান ভাবছে, ” তখন এমনটা না বললেই পারতো। তার মন খারাপ কিন্তু নাফিসার তো কোনো দোষ নেই! সে কেন তার মন খারাপের কারণ সাফার করবে! কিন্তু তারই বা কি করার ছিলো! মেজাজ ভালো ছিলো না তাই হয়ে গেছে এমনটা! নাহ, মানিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।”
আর এদিকে নাফিসা ভাবছে, “সে তো জানতো তার মন খারাপ। মেজাজ ভালো ছিলো না তাই হয়তো এমনটা করেছে। কোনো প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলে কার মন খারাপ না হয়! এতো প্রচেষ্টার বিপরীতে উদ্দেশ্য অর্জন না হলে সবারই কষ্ট হয়। এমন সময় এতো অভিমান করা ঠিক হবে না। যদিও তখন খুব কষ্ট লেগেছিলো। কিন্তু এখন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রেগে থাকলে চলবে না। বরং একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে তার পাশে থাকাটা প্রয়োজন। তার ব্যথিত মনটাকে একটু শক্ত করার প্রচেষ্টা করতে হবে। অভিমান ভেঙে তার মন ভালো করার চেষ্টা করতে হবে।”
ভেবে ভেবে দুজনেই একইসাথে পাশ ফিরলো। ইমরানের দৃষ্টি দেখে নাফিসা হয়তো বুঝে গেছে তার অভিমান ভাঙাতে আসছে! তখন নিজের অজান্তেই অভিমানটা আবার বেড়ে গেলো! তাই আবার অন্যপাশ ফিরে যাচ্ছিলো! ইমরান হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে বললো,
– এতো মান কেন তোর! জানিস না আমার মনটা ভালো নেই? বুঝতে পারছিস না একটুও?
– কি বুঝবো? বলেছো আমার কাছে? আমাকে জানতেও দিবে না আবার অন্যত্র জেনে আমি তোমার মন ভালো করার চেষ্টা করবো সেই সুযোগও দিবে না! পেয়েছোটা কি? আমি দায়ী ছিলাম তোমার মন খারাপ হওয়ার জন্য? যা কারণে আমাকে এতো মেজাজ দেখাও!
নাফিসার কথায় অভিমান স্পষ্ট! অতি অভিমানে চোখ ভেজা হয়ে গেছে ও কথার সাথে সাথে ঠোঁটও কাপছে তার! ইমরান কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বললো,
– সরি।
এবার নাফিসা অভিমানহীন বললো,
– যা হওয়ার হয়ে গেছে। তা নিয়ে এখন শুধু শুধু মন খারাপ করার কি আছে! দ্বিতীয়বার ভেবো না পরাজয়কে। নতুন প্রচেষ্টায় উন্মোচিত হও।
– কোনো প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলে কি ব্যাথা লাগে না? সেই ব্যাথাটা কি সহজেই বিলীন হয়ে যায়?
নাফিসা মাথা দু’দিকে নাড়লো। ইমরান তার চোখের ধার মুছে দিয়ে বললো,
– মুখে বলা যতটা সহজ তা বাস্তবায়ন করাটা ততটা সহজ না৷ সময় লাগবে আমারও।
নাফিসা উঠে লাইট অফ করে আবার ইমরানের সাথে জড়ো হয়ে বললো,
– আল্লাহ তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এভাবে ব্যথিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করো। ধৈর্য ব্যক্তির মহৎ গুণ। সব যন্ত্রণা গুলো ছুড়ে ফেলে ঘুমাও চুপচাপ।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৬
(নূর নাফিসা)
.
.
গতদুদিন ধরে ইমরানের মন খারাপ। তার মন ভালো রাখতে নাফিসাও একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ইমরান নিজেও ভালো থাকতে চেষ্টা করছে। অফিস হাফ টাইম হওয়ায় আজ তারাতাড়িই ফিরেছে। জিহানের গাড়ির লাইট নষ্ট হয়ে গেছে, ইমরান ফেরার পরই সেটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য ইমরানের পিছু পিছু ঘুরছে। ইমরান বলেছে পরে ঠিক করে দিবে আর জিহান সেই পরেটা কখন আসবে সেই অপেক্ষায়ই আছে! ইমরান রুমে যায় তো পিছু পিছু রুমেই যায়, বাথরুমে যায় তো পিছু পিছু গিয়ে দরজার সামনেই দাড়িয়ে থাকে! লাঞ্চ করতে বড়ঘরে গেছে তো সেখানে পিছু পিছু সে। নাফিসা হাসছিলো তার কান্ড দেখে। অত:পর লাঞ্চ করেই ইমরান নিজের রুমে এসে ফ্লোরে বসে গাড়ি ঠিক করছে। নাফিসা কিচেনে এসে দেখলো বড়মা পায়েস রান্না করছে। সে বললো,
– আহ! মিষ্টি গন্ধে পুরো বাড়ি ভরপুর! তা এমন সময় পায়েস কি উপলক্ষে বড়মা?
– তুই জানিস না কি উপলক্ষে?
– না তো!
– সত্যিই জানিস না? নাকি মস্করা করছিস?
– আরে! সত্যিই কোনো উপলক্ষ আছে নাকি! আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম!
– আজ ইমরানের জন্মদিন, সেটা তুই জানিস না?
নাফিসা পুরোপুরিভাবে বোকা বনে গেলো! সে তো সত্যিই জানে না ইমরানের বার্থডে কবে! সে কোনোভাবে কাটিয়ে গেলো বড়মার কাছ থেকে! সে চরম লজ্জাবোধ করছে! স্টুপিড লোকটাও তো একবার তাকে জানালো না! ধুর! বড়মার কাছে উপলক্ষ শব্দটা না তুললেই পারতো! দিনের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে গেছে! যাক, এখনই উইশ করে দেয়া যাক! কি দিয়ে উইশ করা যায়! ভাবতে ভাবতে নাফিসা নিশাতের রুমে চলে এলো। নিশাত ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। নাফিসা বললো,
– তোমার কাছে না বেলুন আছে? জিহানের জন্য যে প্যাকেট এনেছিলে। সেটা শেষ?
– না। আছে কিছু।
– দাও তো আমাকে।
নিশাত ড্রয়ার থেকে প্যাকেট বের করতে করতে বললো,
– তুমি বেলুন দিয়ে কি করবে?
– কাজ আছে।
– ভাইয়ার বার্থডে সেলিব্রেট করবে না তো? ভাইয়া কিন্তু এসব পছন্দ করে না।
– হইছে, এখন আর মনে করতে হবে না। দিন ফুরিয়ে গেছে, এখন জানাতে আসছে ভাইয়ার বার্থডে!
নিশাত হেসে বললো,
– কেন তুমি জানো না? আমি তো সেই সকালেই উইশ করেছি ভাইয়াকে।
নাফিসা একটা বেলুন ফুলিয়ে তার রুমে এলো। জিহান দেখেই লাফানো শুরু করেছে,
– চাচী, দাও! চাচী, দাও!
– না, বাবা। এটা দেওয়া যাবে না। এটার কাজ আছে।
জিহান আর তার অপেক্ষায় না থেকে দৌড়ে চলে গেলো নিশাতের কাছে। আর নাফিসা ইমরানে সামনে বসে বেলুনটা মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বললো, “হ্যাপি বার্থডে,জানু!”
বেলুন এভাবে ধরায় ইমরানের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। তাই ইমরান হাতের পিনটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ফাটিয়ে বললো,
“থ্যাংকস, জানু।”
বেলুন হাতে না নিয়ে ফাটিয়ে দেওয়ায় নাফিসা বিরক্ত হলো। সে আবার বেলুন আনতে চলে গেলো। নিশাতের রুমে এসে দেখলো, নিশাত শুয়ে আছে আর জিহান তার গলা চেপে ধরে চিৎকার করছে বেলুন দেওয়ার জন্য! আর তার সাথে তাল মিলিয়ে নিশাত মরে যাওয়ার অভিনয় করছে! নাফিসা দ্রুত পায়ে এসে জিহানকে টেনে বললো,
– আরে! কি করছো! ফুপিকে কেউ মারে!
– চাচী, আমার বেলুন দেয় না!
ওদিকে নিশাত বললো,
– ভাবি, কি দেখালে তুমি! কান্না করলে আমি যা-ই মাঝে মাঝে দু একটা বের করে দেই। এখন প্যাকেট দেখলে সব শেষ করে ফেলবে!
নাফিসা জিহানকে বললো,
– জিহান, তুমি চাচ্চুর কাছে যাও। আমি খুঁজে খুঁজে তোমার জন্য বেলুন নিয়ে আসছি।
জিহান চলে গেলে নাফিসা পাঁচ-ছয়টা নিয়ে গেলো। একটা ফুলিয়ে জিহানের কাছে দিলো। সামনের দিকে জিহান বসে আছে বলে আরেকটা ফুলিয়ে নাফিসা পেছন থেকে ইমরানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! কত তম জন্মদিন তোমার?
ইমরান সেটিও ফাটিয়ে বললো,
– আশি তম।
বেলুন ফাটানোর কারনে বিরক্ত হলেও ইমরানের কথায় নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
– এল্লা! বুইড়া বেটার জন্মদিন!
এদিকে জিহান বুঝে আর না বুঝে হেসে উঠলো। হয়তো বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে বলেই! নাফিসা আরেকটা বেলুন ফুলিয়ে ইমরানের মাথায় ঠুসে ফাটানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
– হ্যাপি বার্থডে বুইড়া বেটা! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বুইড়া বেটা! ধুর! ফাটে না ক্যা!
দুইবার চেষ্টা করেও যখন ফাটেনি, এইবার একটু জোরে দেওয়ার চেষ্টা করতে যাবে তার আগেই ইমরান পিনের সাহায্যে ফাটিয়ে দিলো! জিহান এবারও হেসে উঠলো! এবার একটু দুষ্টুমি চাপলো নাফিসার মাথায়। নাফিসা পেছনের টেবিল থেকে পানির জগটা হাতে নিয়ে বেলুনের ভেতর পানি নিয়ে তারপর ফুলিয়ে ইমরানের মাথার উপর রাখলো। ইমরান এবারও একই কাজ করলো আর বেলুন ফেটে তার মাথা ভিজে গেলো! ইমরান পুরোপুরি শকড! নাফিসা পাশ কেটে এক দৌড়ে দরজার কাছে এসে থেমে হাসতে হাসতে বললো,
“ভেজা বার্থডে, বুইড়া বেটা!”
নাফিসা হেসে কুটিকুটি! আর ইমরান রেগে তাকালো তার দিকে! ইমরান যে-ই উঠতে যাবে নাফিসা দৌড়ে পালালো! সে ভেবছে ইমরান তাকে তাড়া করার জন্য উঠেছে! আর জিহান হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে! ইমরান তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছে নিলো। টিশার্টটাও কাধ ও পেছন দিকে ভিজে গেছে কিছুটা। তাই চেঞ্জ করে অত:পর গাড়ির কাজটা শেষ করে নিলো। পাঁচ মিনিটের কাজ নাফিসার দুষ্টুমির জন্য পনেরো-বিশ মিনিটের মতো লেগেছে তার!
এরপর নাফিসা আর তার সামনে আসেনি। ইমরান তখন রেগে গেছে তাই দূরে দূরে আছে। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে দূরে থাকা যায়! সন্ধ্যায় কাজকর্ম সেড়ে তার মাঝে সাহস উঁকি দিয়েছে। কি করবে ইমরান? মারবে তাকে? তো মারুক। ব্যাথা পেলে একটু নাহয় কান্না করবে, সেই প্রস্তুতি নিয়েই সে রুমে এলো। কিন্তু আবারও দেখতে পেল সেই বিষন্নতা! যেটা একদমই ভালো লাগে না নাফিসার! ইমরান কোলে বালিশ নিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে, খাটে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে! চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট! নাফিসা যে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ভেতরে এসেছে সেই খেয়ালেই নেই সে! নাফিসা দরজা লাগিয়ে তার কাছে এলো। ইমরান এবার তার দিকে তাকিয়েছে। নাফিসা কিছু না বলে বালিশটা টেনে সরিয়ে দিলো এবং ইমরানের পায়ের উপর তার সম্পূর্ণ ভার রেখে আরাম করে বসলো। ইমরান শুধু তাকিয়ে দেখছে তাকে। নাফিসা তার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
– হয়েছেটা কি তোমার? ভালো লাগে না তো এভাবে দেখতে। একটু বেশি চেষ্টা করো না ভালো থাকতে৷ খারাপ মুহূর্তগুলো টেনে টেনে কেন সবসময়েই বিষন্নতায় কাটাও? হাসিখুশি থাকবে, মন ভালো থাকবে, শরীর সুস্থ থাকবে, তুমি ভালো থাকবে, আমি ভালো থাকবো, আমরা ভালো থাকবো। তুমি এভাবে আছো আর তা দেখে দেখে তোমার পাশাপাশি আমরা কেউই ভালো নেই। স্বপ্ন যখন বেঁধেছ, একবার হেরে গিয়েছো তো কি হয়েছে? দ্বিতীয়বার আবার চেষ্টা করো। ভাগ্যে জয় থাকলে আসবেই, আর না এলেও ব্যর্থতা স্বীকার করবে না৷ বারবার চেষ্টা করেও যদি ব্যর্থ হও তো ভাগ্যকে মেনে নাও। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সেটাই দান করবেন যা তোমার জন্য মঙ্গলজনক। আর যা মঙ্গলজনক নয়, তাতে বারবার বাধা দিবেন।
ইমরান এতোক্ষণ যাবত নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। নাফিসা থামতেই সে দুহাত বাড়িয়ে নাফিসার মুখখানা কাছে টেনে নাকে নাক ঘেঁষে বললো,
– এইটা কি সেই পিচ্চি বউটা, যে কারণে অকারণে রেগে যেতো আর জেদ করতো! পিচ্চি বউটা তো বড় হয়ে গেছে! তাই তো আজ আমাকে বুঝাতে প্রস্তুত।
– শুনো, পেট ভরা থাকলেও যদি খাওয়া হয় তো বদহজম হয়। ফলশ্রুতিতে পেটে আর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। আর জ্ঞানী লোকের মাথাভর্তি জ্ঞান থাকে। তাই যদি আরও জ্ঞান নিতে চায় তো বদ হজম হয়ে সব উপচে পড়ে। যেটাকে আমরা বলে থাকি বেশি পড়াশোনা করে পাগল হয়ে গেছে অর্থাৎ, শিক্ষিত পাগল। তোমারও আস্তে আস্তে এই দশা হয়ে যাচ্ছে ধারণা করছি। তাই আমি স্বল্পশিক্ষিতা আসলাম একটু মগজ ঝালাই করে আগে থেকেই সাবধান করতে। এই এক্সাম একাধিকবার দেওয়া যায় না?
– হ্যাঁ, ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া যায়।
– তাহলে পরবর্তীতে আবার দিবে৷ তবুও যদি না হয় তবে মেনে নিবে আল্লাহ চান না তুমি ক্যাডার হও। কি, দিবে না?
– ইচ্ছে নেই।
– থাকতে হবে।
ইমরান কয়েক সেকেন্ড নাফিসার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বললো,
– তুমি দিবে বিসিএস।
– এ!
– হ্যাঁ। তুমি দিবে।
– আমি! আমি তো বিসিএস এর বি-ও জানি না! শুধু নামটাই জানি! আর জানি যে এটা সরকারি চাকরির অন্তর্ভুক্ত।
– জানতে হবে এবং জানবে।
ইমরান একটু নেড়েচেড়ে বসে সিরিয়াস মুডে বললো,
– শুনো, বিসিএস হচ্ছে “বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর আওতাভুক্ত ছাব্বিশটা ক্যাডার আছে। এডমিনিস্ট্রেশন, এগরিকালচার, পুলিশ, ইকোনমিক, কো-অপারেটিভ, অডিট এন্ড একাউন্ট, স্ট্যাটিস্টিক্স, ফুড, ফ্যামিলি প্লানিং, জেনারেল এডুকেশন সহ আরও কিছু ক্যাডার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তুমি যদি এক্সামে টিকে যাও তো নিজের ইচ্ছে মতো যেকোনো একটা বেছে নিতে পারবে।
– যদি না টিকতে পারি তো!
– এতোক্ষণ না আমাকে বুঝালে। এখন আবার তো আসলো কোথা থেকে! না টিকলে নেই।
– আচ্ছা, আমারটা পরে। এখন তোমার সময় আছে যেহেতু তুমি আবার দিবে।
– ইচ্ছে মরে গেছে।
– ইচ্ছে প্রাণ নয় যে মরে গেলে আর ফিরে আসবে না! তুমি মনটাকে একটু শক্ত করলেই ইচ্ছেটা জাগ্রত হবে। তুমি আবার চেষ্টা করবে। এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়, এটাই আমার শেষ কথা।
.
দিন যায় ধীরে ধীরে
চলে গেলে মনে হয়, এইতো সেদিন হলো রে!
প্রহর কাটে গনে গনে,
কেটে গেলে গেলে মনে হয়, এইতো তখন এলো রে!
একে একে পাল্লা ধরে,
দুঃখ সুখ গুলো জীবন ধেয়ে যায় ঘুরে ঘুরে!
ক্ষণে আসে, আবার চলে যায়,
আবারও আসে ফিরে!
ঈদুল আযহা উপলক্ষে নাফিসা ও নাহিদা বেড়াতে এসেছে বাবার বাড়িতে। নয়দিন কাটিয়ে দশম দিনে যার যার নীড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। নাহিদা একটু পরেই যাবে, মেহেদী অফিস শেষে নিতে আসবে তাকে। আর নাফিসা রাতে যাবে ইমরান আসবে। নাজিয়া যায়নি, তার তেমন হাটাহাটি নিষিদ্ধ বলে। নাহিদাকেও যেতে দিতো না, কিন্তু প্রসব পরবর্তী সময়ে নাহিদাকে মেহেরুনের কাছে থাকতে হবে তাই একটু বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো। ডেলিভারি ডেট তার নিকটেই। সব রকম সতর্কতার মধ্যেই আছে তার পরিবার। রুমানা বেগম চেয়েছিলেন নাহিদাকে তার কাছেই নিয়ে আসবে। কিন্তু মেহেরুন নিজের কাছে রাখার ইচ্ছা পোষণ করলো। তাই রুমানা বেগমও জোর করলো না এই ভেবে, নাজিয়াকে তার কাছে নিয়ে আসবে। কেননা নাহিদার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকলেও নাজিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না। আরাফকে শুরুতেই বলেছিলো নাজিয়াকে তার কাছে দিয়ে আসতে। কিন্তু আয়েশা বেগম রাজি নন তাতে। তার ইচ্ছে বাড়ির বউ বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু রুমানা বেগম তাদের সাথে কথা বলে সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিলো যে নাজিয়াকে প্রেগ্ন্যাসির শেষ সময় তার কাছেই রাখবে। আলফাজ সাহেব প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। যদিও আয়েশা বেগম কিছুটা নারাজ হয়েছিলেন। কেননা তার মাঝে ছেলের বউয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট না থাকলেও নাতি নাতনির ব্যাপারে একটু দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পেয়েছে!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৭
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী অফিস শেষে বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়েই এসেছে নাহিদাকে নিয়ে যেতে। এখানে আসবে বলে আগেই অফিস ত্যাগ করেছে আজ। খাওয়াদাওয়ার পর আর অপেক্ষা করেনি। সন্ধ্যার আগেই রওনা দিয়েছে। মেহেদী ড্রাইভ করছে আর নাহিদা পাশের সিটে বসে আছে। দুজনের কেউই তেমন কথা বলছে না! কেননা নাহিদা একটু গোমড়া মুখু হয়ে আছে! মেহেদী টুকটাক জিজ্ঞাসা করলে গোমড়া মুখু হয়েই জবাব দেয়! আর বেশি কথা বলে না তাই মেহেদীও বেশি কিছু বলে না। কথা না বলার কারণ, মেহেদী তার পড়াশোনা এখন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। ভার্সিটি যাওয়া তো আরও কয়েক মাস আগেই বন্ধ করেছে! এরপর যা-ই মাঝে মাঝে কোচিং-এ যেতো, সেটাও কিছুদিন পর অফ করে দিয়েছে! তার যেন বাসা থেকে বের হওয়াটাই একেবারে নিষিদ্ধ! তবুও নাহিদা ঘরে বসে পড়াশোনা করতো। কিন্তু যে সময়ে তার এক্সাম, সে সময়ে তার অসুস্থতা ও ব্যস্ততার সময়! তাই মেহেদী বলেছে এ বছর এক্সাম না দেওয়ার জন্য। যদিও নাহিদা ইচ্ছা পোষণ করেছিলো। কিন্তু মেহেদী না তো না ই। বেশি প্রেশার পড়বে ভেবে তাকে আর বই ই পড়তে দিলো না! নাহিদাও তার অবাধ্য হলো না কিন্তু একটু গম্ভীর হয়ে আছে। আশায় আছে মেহেদী তাকে পড়ার জন্য বলে কি-না! কিন্তু না! একবারও বললো না পাষাণ ছেলেটা! নাহিদা রাগ করে থাকুক, তবুও বলবে না। যদিও মেহেরুন ভার্সিটি যাওয়া আসার ব্যাপারটা মেহেদীর সাথে একমত ছিলো কিন্তু বাসায় পড়তে নিষেধ করেনি। এক্সামের সময় যদি সে ফ্রী থাকে তো দিবে। কিন্তু হাসব্যান্ডের কথা যে সে অমান্য করতে পারছে না! এটা করতে গেলে অন্যায় হয়ে যাবে। তাই রাগ করেই বসে আছে মেহেদীর সিদ্ধান্ত বদলানোর প্রত্যাশায়।
বাবার বাসায় যাওয়ার দুদিন আগেই এমনটা ঘটেছে। সেখানে যাওয়ার পর প্রতিদিনই মেহেদী কল করে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতো, সে-ও একটু ভাব নিয়ে গম্ভীরমুখে স্বল্প জবাব দিতো।
বাসায় ফিরে এসেছে তারা। খুব সাবধানে সিড়ির ধাপগুলি অতিক্রম করতে হয়েছে নাহিদাকে! সে নিজে যতটা না ভয় পায়, তার চেয়েও বেশি ভয় পায় মেহেদী! নাহিদা ইজিলি হাটতে প্রস্তুত অথচ মেহেদী তাকে যেন পিপড়া গতিতে নিয়ে যাচ্ছে! মেহেদী তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বাড়িতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাই নাহিদা বললো,
– বাবা-মা বাড়িতে নেই?
– না।
– কোথায় গেছে?
মেহেদী ঠোঁটের এক কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– হানিমুনে গেছে। আর আমাদের হানিমুন করার সুযোগ দিয়ে বাসায় রেখে গেছে! কেননা আমরা তো আর অন্যত্র যেতে পারবো না এখন! বুঝোনি ব্যাপারটা?
মেহেদীর দুষ্টুমিতে নাহিদা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। বোরকা হিজাব খুলে হাত মুখ ধুয়ে এলো সে। মেহেদী তার অতি নিকটে এসে আহ্লাদী সুরে বললো,
– কেমন করে থাকো তুমি! একেবারে পঁচা পঁচা লাগে! এতো পড়াশোনা করে করবে টা কি শুনি? আর এখন এতো পড়তে হবে! এ অবস্থায় এতো পড়লে বাবু তো পেট থেকেই গ্রেজুয়েট হয়ে আসবে!
মাঝে মাঝে মেহেদীর কথা বলার ভঙ্গি চরম লজ্জায় ফেলে দেয় তাকে! নাহিদার লজ্জা এবং হাসি একসাথে উঁকি দিয়েছে মনে। কিন্তু গম্ভীরভাবটা ধরে রাখতে প্রকাশ করলো না সেটা। এমনি কলিং বেল বেজে উঠলো! মেহেদী গিয়ে দরজা খুলে দিলো। নাহিদাও এগিয়ে এলো দেখার জন্য। দরজা খুলতেই আয়াশ “ইয়ে…” শব্দে চিৎকার করে এক মুহুর্তের জন্য মেহেদীকে ঝাপটে ধরলো। মেহতাজ এসেছে তাহলে! আয়াশ পরক্ষণে দৌড়ে সেই ফাঁকা রুমে চলে গেলো। সেখানে তার সাইকেল রাখা আছে। মেহতাজকে দেখে মেহেদী বললো,
– ধুর! তোমার আবার আসতে হবে! আম্মুকে না নিষেধ করে দিলাম!
– আম্মুকে নিষেধ করে দিয়েছো? আম্মু কি তোমার উপর নির্ভর করে পুত্রবধূকে রেখে যাবে? রান্নাবান্না করে খাওয়াবে কে, শুনি?
– রেস্টুরেন্টের অভাব পড়েছিলো দুনিয়ায়!
– ওই, চুপ থাক। তোর এতো শত পন্ডিতি না করলেও চলবে। মায়ের বুঝেই মা বলেছে আর আমার বুঝেই আমি এসেছি। তোর বুঝ তোর কাছেই রাখ। হুহ্! এতোদিন ডাকতো, আপু এসো, আপু আয়াশ আরিশাকে নিয়ে এসে পড়! আমি নিয়ে যেতে আসি? আর এখন নিজের বাচ্চা আসছে তো আয়াশ আরিশা দূরে থাক, আমার যেন বাপের বাড়ি আসাটাই নিষিদ্ধ!
নাহিদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ভাইবোনের ঝগড়া দেখছে! মেহেদী চেহারায় বিরক্ত ভাব এনে আরিশাকে কোলে নিয়ে চলে গেলো আয়াশের কাছে। যদিও সে মোটেও বিরক্ত না, শুধু মেহতাজকে দেখানোর জন্যই তার এমন ভঙ্গি।
মেহেদী চলে গেলে এবার তারা দুজন কথা বলার সুযোগ পেল। মেহতাজের কাছে জানতে পারলো জহিরুল ইসলাম ও মেহেরুন মেহেদীর নানা বাড়ি গেছে জমিজমার ব্যাপারে। আজ তারা থাকবে সেখানেই। আর নাহিদা আজ চলে আসবে বলে মেহেরুন মেহতাজকে কল করে বলে দিয়েছে বাসায় আসতে। হঠাৎই তাদের ডাক পড়ায় নাহিদাকে আগে কিছু জানায়নি মেহেরুন। তবে সন্ধ্যায় কথা হয়েছে তার সাথে।
মেহতাজ আসায় নাহিদার জন্য ভালোই হয়েছে। নতুবা একা একা সময় কাটতো না। আর মেহেদীর ফাজলামো সহ্য করতে হতো শুধু! আর এখন তারা বাকিটা সময় কাজকর্ম ও গল্প করতে করতেই কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ। আরিশা সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলো৷ এখন মেহতাজ তাকে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে খাওয়াচ্ছে। নাহিদা ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে আছে। মেহেদী হাই তুলতে তুলতে এসে টেবিলের উপর বসে পড়লো এবং বললো,
– ঘুম পেয়েছে প্রচুর।
নাহিদা গম্ভীরমুখে জবাব দিলো,
– ঘুম পেলে ঘুমিয়ে থাকুক গিয়ে। না করেছে কে!
– তুমিই তো না করছো! এখনে বসে আছো কেন শুধু শুধু! ঘুমাবে না?
– আপুর সাথে ঘুমাবো।
– এমনিতেই আপু হানিমুনের বারোটা বাজিয়ে দিলো, তুমি আবার বলছো এখন আপুর সাথে ঘুমাবে!
– তো আমার ইচ্ছে করলে আমি ঘুমাবো না!
মেহেদী চুপ করে আছে। নাহিদা আড়চোখে এক পলক তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। আবার সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। মেহেদীর চেহারায় কেমন একটা বিষন্ন ভাব চলে এসেছে! যা দেখে নাহিদার কিছুটা হলেও খুশি লাগছে৷ হোক সে বিষন্ন, তাহলেই বুঝবে অন্যের বিষন্নতার মর্যাদা। সব বিষয়ে কেন তার এমন জেদ থাকবে! সব কেন তার কথামতো চলতে হবে! একটু বিষন্নতা অনুভব করা দরকার। যদি এতে একটু তার মাঝে পরিবর্তন আসে।
এদিকে মেহেদী পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার হনহন করে রুমে চলে গেলো। দরজাটা ঠাস করে চাপিয়ে দিলো! মেহতাজ বিপরীত পাশ থেকে কিচেনের দিকে আসতে আসতে বললো,
– কিরে, ভেঙে ফেলবি নাকি সব!
নাহিদা মৃদু হাসলো। মেহতাজ তার উদ্দেশ্যে বললো,
– বসে আছো কেন? ঘুমিয়ে থাকো গিয়ে।
মেহতাজ কিচেন থেকে আসা পর্যন্ত নাহিদা বসেই রইলো। পরক্ষণে মেহতাজ আয়াশ আরিশাকে ঘুমানোর জন্য নিজের রুমে পাঠাতে লাগলে নাহিদা উঠে চেয়ার ঠিক করে রেখে রুমে চলে গেলো। লাইট অফ করে মেহেদী খাটের মাঝামাঝি শুয়ে আছে। লাইট অন করে দেখলো মাথার নিচে একত্রে দুই বালিশ। নাহিদা দরজা লক করতে করতে বললো,
– এমন মাঝামাঝিতে শুয়ে থাকলে কোনো পাশেই আমার এটুকু জায়গাতে হবে না।
মেহেদী চোখ খুলে জবাব দিলো,
– এই খাটে আমি ছাড়া কারো জায়গাও হবে না। আপুর সাথে ঘুমাবে তো আপুর কাছেই যাক।
নাহিদা বেশ বুঝতে পারছে মেহেদী রাগ করেছে। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চুল খোপা করতে করতে বললো,
– আপুর রুমে আয়াশ আরিশা আছে। তাই আমার জায়গা হবে না। আপাতত আমার ডিসিশন চেঞ্জ আর এটাতেই আমি ফিক্সড।
– তবুও খাটে জায়গা হবে না।
– ওকে, তাহলে আর কি! মেঝেতেই থাকবো। আমার বালিশটা তো অন্য কারো দখলে আটকে গেছে! রিটার্ন করছে না কেন!
নাহিদার কথাবার্তায় যেন মেহেদীর আরও রাগ বেড়ে গেছে! সে একটা বালিশ সরিয়ে নাহিদার দিকে ছুড়ে মারলো। নাহিদা মাত্রই খাটের দিকে দুকদম এগিয়ে এসেছে! আর অসাবধানতা বশত বালিশ ছুড়ে মারায় তা এসে লেগেছে তার পেটে! ব্যাথা পেয়ে সাথে সাথেই নাহিদা ছোটখাটো চিৎকার করে উঠলো! মেহেদী চমকে তাকালো তার দিকে! নাহিদা পেটে হাত রেখে বসে পড়ছে! চেহারা তার বিকৃত আকার ধারণ করেছে! বালিশ তার কাছ ঘেঁষে পড়ে আছে! মেহেদী বুঝতে পারেনি বালিশটা তার গায়ে লাগবে! সে তো ফ্লোরে ছুড়ে ফেলেছিলো! নাহিদা যে এগিয়ে এসেছে তা সে লক্ষ্য করেনি! আর নাহিদাও ভাবতে পারেনি মেহেদী এখনই বালিশটা ছুড়ে মারবে!
বিছানা ছেড়ে মেহেদী দ্রুত নেমে এলো তার কাছে! নাহিদার পাশে বসে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
– কি হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছো? বালিশ কি তোমার পেটে লেগেছে?
একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে! কিন্তু নাহিদা কোনো জবাব দিচ্ছে না। সে কাঁঁদছে! চাপা কান্না চলছে তার মাঝে! কাঁদতেও যেন তার কষ্ট হচ্ছে! মিনিটের মধ্যেই যেন মেহেদীর শরীরে কম্পন ধরে গেছে! হাতপা কাপছে তার! এটা কি হয়ে গেলো তার দ্বারা! “আপু…” বলে মেহতাজের উদ্দেশ্যে সে খুব জোরে চিৎকার দিলো। এক বন্ধ রুমে থেকে কি অন্য বন্ধ রুমে শুনতে পাবে হাক! মেহেদী দ্রুত পায়ে দরজা খুলে এসে আবারও জোরে ডাকলো মেহতাজকে। মেহতাজ চমকে উঠে ছুটে এলো। নাহিদাকে ফ্লোরে বসে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
মেহেদী ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
– আমি বালিশ ছুড়ে ফ্লোরে ফেলেছিলাম। নাহিদার শরীরে লেগে গেছে!
মেহতাজ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে! পরক্ষণে নাহিদাকে উঠাতে চেষ্টা করলো। নড়াচড়ায় ব্যাথা যেন আরও বেশি লাগছে! তাই কান্নাও আরও বেড়ে গেছে! দুজন তাকে ধরে এনে খাটে বসালো। নাহিদার ব্যাথাও বাড়ছে কান্নাও বাড়ছে! নাহিদা কেবল কান্নার সাথে একটা কথা বলেছিলো, “আপু মরে যাচ্ছি আমি! আর পারছি না!”
মেহতাজ ও মেহেদী উভয়েরই ভেতরটা কাপছে! মেহতাজ মেহেদীকে এই মুহূর্তে হসপিটাল নিয়ে যেতে বললো। মেহেদী দ্রুত শার্ট পড়তে পড়তে আলমারি খুললো টাকা নেওয়ার জন্য। আর মেহতাজ তার রুমে এসে আয়াশ আরিশাকে তৈরি করে পার্সটা সাথে নিলো। মেহেদী ড্রাইভারকে কল করলো। কেননা তার মাঝে এখন ড্রাইভ করার এনার্জি নেই! ড্রাইভার নিচ তলায় থাকে, তারা ফ্ল্যাট ছেড়ে নিচে আসতে আসতে ড্রাইভার প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা নিকটবর্তী হসপিটালে চলে এসেছে। গাড়িতে থেকে মেহতাজ আসিফকে কল করে ডেকেছে। কেননা মেহেদীরই যেই অবস্থা দেখছে, মনে হচ্ছে না সে কোনো ব্যবস্থা ঠিকমতো করতে পারবে! আর মেহেদীর মাঝে এই অবস্থাটা দেখা যেতো না, যদি না তার হাতে এই অঘটনটা ঘটতো!তাছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে মেহতাজও কোনোদিক সামলে নিতে পারবে না!
ভাগ্যক্রমে হসপিটালে এসে ডা. ফারহানাকে পেয়েছে। আজ তার ডিউটি ছিলো। নাহিদাকে চেক-আপ এর জন্য তার কাছে নিয়ে আসতো। তবে কল করে সময় জেনে আসতে হতো। মেহতাজের সার্জারি হয়েছিলো তার হাতেই।
ডাক্তার চেক-আপ করছে। ব্যাথা যেন সেকেন্ডের কাটার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম যেমন ছিলো এখন তার চেয়েও বহুগুণ বেড়ে গেছে! অত:পর ডাক্তার মেহতাজকে বললো, “এই পেইন এখন ঠিক হওয়ার মতো না। সময় লাগবে কিন্তু পেশেন্ট পারবে না সাফার করতে। তাছাড়া বেবিরও ক্ষতি হতে পারে। সিজার করে ফেলুন।”
ডাক্তারের কথা শুনে মেহেদী বললো,
– আপু, কি করবে এখন?
মেহেতাজ চিন্তার মাঝেও বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তাকে কোনো জবাব না দিয়ে অত:পর মেহেরুনের কাছে কল করলো। ফোনে বিস্তারিত সম্পূর্ণ ঘটনা না জানিয়ে এতটুকু জানিয়েছে যে, নাহিদার পেটে ব্যাথা করছে তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার বলছে সিজার করতে। ওদিকে মেহেরুনও চিন্তিত হয়ে পড়লেন কেননা ডাক্তারের দেওয়া ডেট অনুযায়ী আরও তিন সপ্তাহের মতো বাকি আছে। জহিরুল ইসলাম বলে দিলো সিজার করতে, তারা শীঘ্রই হসপিটাল আসছে। বাবামায়ের সাথে কথা বলার পরপরই আসিফ হাজির হয়েছে। তারা অপারেশন করার জন্য ডাক্তারের কাছে মত পোষণ করলো। ব্যাবস্থা যা করার আসিফই করছে! আর মেহেদীর অবস্থা প্রায় এলোমেলো! নাহিদাকে যখন থিয়েটারে নেওয়া হলো, তখন মেহেদী প্রায় কান্নার সাথে মেহতাজের কাছে অনুরোধ করছিলো যেন উক্ত ঘটনা তার বাবা-মা কে না জানায়। এমনিতেই একবার তাকে পরিবার থেকে প্রায় ছাটাই করতে যাচ্ছিলো! এখন যদি আবার এমন কিছু হয় সেই দুশ্চিন্তায় সে অনুরোধ করলো। তাছাড়া বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে সে বুঝতে পারেনি এমন কিছু হয়ে যাবে! মেহতাজ তবুও তাকে বকেছে সবসময় সে এমন জেদ করে বলে! বাবা-মায়ের কাছে বিষয়টি গোপন রাখতে বলা হলে মেহতাজ তার সামনে এক শর্তমূলক প্রশ্ন ছুড়লো, “আমি না হয় চুপ করে থাকলাম৷ তাই বলে কি ঘটনা লুকিয়ে থাকবে? যদি নাহিদা বলে দেয়?”
মেহেদী উত্তরে বলেছিলো,
“নাহিদা চাইলে বলে দেক। তাতে আপত্তি নেই।”
জীবনে আজ দ্বিতীয়বারের মতো মেহেদী ভয়ঙ্কর ভয় পাচ্ছে! প্রথমবার ভয় পেয়েছিলো তার বাবা যখন স্ট্রোক করেন। আর আজ নাহিদার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভয়! নানান খারাপ মুহূর্তগুলোই যেন তার চোখে ভাসছে। বাবাকে নিয়ে যখন হসপিটালে থেকেছিলো, তখন দেখেছিলো এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে! আর তার হাসব্যান্ড পুরুষ মানুষ হয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো! আজ তারও মন কাঁদছে! বড্ড বেশি ভয় পাচ্ছে! বেঞ্চিতে বসে মনে মনে এতোবার আল্লাহকে ডাকছে মেহেদী, তবুও তার মনে সেই ঘটনাটাই হানা দিচ্ছে বারবার!

চলবে।