“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩০
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী বিষন্নতার সাথে বললো,
– আব্বু, এটা ঠিক না। এটা চিটিং! আমার ক্যাশ লাগবে।
– ক্যাশ তো আর বাতাসে উড়ে না! চাকরি করো, তবেই না ক্যাশ আসবে!
– লাগবে না আমার এই চাকরি।
– মানুষ জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলে একটা চাকরির জন্য আর তুমি ফ্রী তে পেয়ে তার মূল্য দিচ্ছো না!
– ধ্যাৎ!
মেহেদী উঠে চলে গেলো। মেহেরুন ডেকে বললো,
– ভাত খাবি না!
– না!
জহিরুল ইসলাম বললো,
– ওকে খাবার না ই দেওয়ার প্রয়োজন। আল্লাহর কাজ করে না, আল্লাহর দান কেন গিলবে! নামাজ পড়ে সারাদিনে এক ওয়াক্ত!
মেহেদী রুমে এসে আবার বেরিয়ে টেবিলে চলে এলো। হাত ধুয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। কেউ কিছু বললো না। মেহেদীর সীমিত রাগ দেখে নাহিদার অপ্রকাশ্যে হাসি পেল! খাওয়াদাওয়া শেষে নাহিদা রুমে এসে দেখলো মেহেদী তার পার্স সামনে নিয়ে টাকা গুনছে! সে দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– এসব কি করছেন?
মেহেদী তার জবাব না দিয়ে টাকা গণনা শেষ করে বললো,
– মাত্র পাঁচ হাজার তিনশো ষাট! সমস্যা নেই, আমার হলেই হলো।
– আপনার হলেই হলো মানে!
– নাও, তিনশো ষাট টাকা রেখে দিলাম, আর পাঁঁচ হাজার আমার পাওনা।
– আপনার পাওনা মানে!
– ওই, এতো মানে মানে খুজছো কেন! জানো না তুমি মানে! এই সেই কিনে তো আমার পকেট খরচ করে দিয়েছো! তারউপর যাতায়াত ভাড়া, রুম ভাড়া, খাওয়াদাওয়া এসব কি তোমার নানার হোটেলে ছিলো! সেগুলো আমার পাওনা না?
নাহিদা পার্সটা হাতে নিয়ে রেখে দিতে দিতে বললো,
– ঠিক আছে। নিয়ে যান।
– হুম, নিবই তো!
নাহিদা তার কাছে এসে কাগজটা হাতে দিয়ে বললো,
– এবার তো আপনার উদ্দেশ্য হাসিল হলো। সুতরাং, কাল থেকে অফিস জয়েন করবেন। এবং এক ওয়াক্ত নামাজও যেন কাযা না হয়!
মেহেদী উঠে আলমারির কাছে যেতে যেতে বললো,
– তুমি রুলস করার কে!
– আপনার বউ।
– হুহ্! বউ বউয়ের জায়গায়ই থাকো, গার্লফ্রেন্ড হতে এসো না!
– আমি বউয়ের জায়গায়ই আছি। গার্লফ্রেন্ড হতে যাবো কোন দুঃখে! আমি তো শরীয়ত মোতাবেক লাইসেন্স প্রাপ্ত অসীম মর্যাদার সসীম অধিকারী!
– তোমার এই লাইসেন্স এর দাম দুই আনাও না আমার কাছে!
– উহুম, ষোলো আনাই আছে! সময় হলে বুঝতে পারবেন।
কথা বলতে বলতে নাহিদা বিছানা ঠিক করে শুয়েও পড়লো। ফোনে এলার্ম দিয়ে ফোন পাশেই রেখেছে।
ভোরে এলার্ম বাজতেই নাহিদা উঠে পড়লো। আর মেহেদীকে ডাকতে লাগলো। মেহেদী ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বললো,
– হয়েছে টা কি তোমার!
– উঠুন, নামাজ পড়বেন।
– পড়বো না এখন।
নাহিদা কাথা টেনে সরিয়ে দিয়ে বললো,
– পড়তে হবে! উঠুন!
– যাবে এখান থেকে!
মেহেদী উপুড় হয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো! নাহিদা চুল খোপা করে নেম গেলো। ওদিক আজান পড়ছে। সে বাথরুমে এসে পানির মগ নিয়ে রুমে এলো। হাতে পানি নিয়ে মেহেদীর মুখে ছিটিয়ে দিলো। মেহেদী ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে! নাহিদা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– উঠে পড়ো সাহেব। না হলে বেগমের দ্বারা বিছানায় গোসল সাড়বে এখন!
মেহেদী কাথা এক টানে সরিয়ে নিয়ে উঠে পড়লো। বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে নাহিদার হাত থেকে পানির মগ নিয়ে মাথায় ঢেলে দিয়ে বললো,
– সকাল সকাল বেগমের এতো গোসলের তাড়া জেগেছে যখন, তাহলে সেড়ে নেক না গোসল!
মাথায় পানি ঢেলে মগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেহেদী চলে গেলো বাথরুমে। নাহিদা প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেও এখন খুব হাসি পাচ্ছে! কেননা, সে এখন গোসল করেই নিতো! কিন্তু রুমে গোসল করিয়ে দিয়ে তো কাজটা বাড়িয়ে দিয়ে গেলো! ফ্লোর ভিজে গেছে! সে একটু ভয়ে ছিলো, না জানি মাইর দেওয়া শুরু করে! অন্যদিকে মেহেদীকে জানার সুত্রে এটাও বিশ্বাস ছিলো, সে তার গায়ে হাত তুলবে না। যদি গায়ে হাত তোলার অভ্যাস থাকতো তাহলে কক্সবাজারে অন্তত একটা লাগিয়ে দিতো সেদিন! ভাবতে ভাবতে নাহিদা ফ্লোর মুছে দিলো। এখন অপেক্ষা শুধু মেহেদী নামাজ পড়ে কি-না তা দেখার!
নাহিদা কাপড়চোপড় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মেহেদী ওযু করে এসে টুপিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদার খুব খুশি লাগছে! লোকটা তাহলে এতোটা বাকা না! তাকে পুরোপুরি সোজা করার চান্স আছে তাহলে! নাহিদা খুশিমনে বাথরুমে এসে যতদ্রুত সম্ভব গোসল সেড়ে নিলো। এবং নামাজ আদায় করে মেহেরুনের কাছে এসে কুরআন চাইলো। মেহেরুন জানালো মেহতাজের রুমে কুরআন শরীফ রাখা আছে। নাহিদা সেটা নিয়ে পড়তে লাগলো আর মেহেদী এতোক্ষণে মসজিদ থেকে ফিরে আবার ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত।
কুরআন পাঠ করে নাহিদা কিচেনে এলো। সে আসার পরপরই মেহেরুন এসেছে। দুজন কথাবার্তা বলতে বলতে রান্নার আয়োজন করে ফেললো। সকাল আটটা বাজলে জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে ডাকলো। মেহেদী চোখ ডলতে ডলতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
– কি হয়েছে, আব্বু?
– একসাথে অফিস যাবো। রেডি হয়ে এসো।
– সরি, আজকের জন্য মাফ করো৷ কালকে থেকে ভেবে দেখবো।
– ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই! বছর ফুরিয়ে যাবে কিন্তু তোমার ভাবনা ফুরাবে না। এখনই এসো।
মেহেদী এখনো একই কান্ড ঘটালো! কানে আঙুল দিয়ে চলে গেলো রুমে। নাহিদা টেবিলে খাবার রেখে রুমে এসে দেখলো মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। নাহিদা আস্তে আস্তে বাথরুমে এসে অতি দ্রুত ঝর্ণাটা ছেড়ে দিলো আর মেহেদী ভিজে চমকে উঠে একপাশে দাড়িয়ে গেলো! নাহিদা হাসতে হাসতে দ্রুত বেরিয়ে এসে বললো,
– সকাল সকাল তো বেগমের গোসল হয়েছে। এখন না হয় সাহেব গোসল সেড়ে নেক! অফিস যেতে হবে তো!
– তোমাকে তো এখন!
মেহেদী বের হতে গেলে নাহিদা এক প্রকার দৌড়ে রুমের বাইরে চলে এলো। মেহেদী ভেজা শরীরে নিশ্চয়ই বাইরে আসবে না! তবুও সে মেহতাজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। দুতিন মিনিট পার হতেই রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো বাথরুমের দরজা বন্ধ। তারমানে গোসল করছে! রুমটা আবার ওয়ারড্রব পর্যন্ত ভিজে গেছে মেহেদীর দেহের পানির ফোটা পড়ে। নাহিদা তা মুছে মেহেদীর একটা শার্ট আয়রন করে দিলো। মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে নাহিদা শার্ট নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– টিশার্ট খুলো।
মেহেদী অবাক হয়ে বললো!
– হু!
– টিশার্ট খুলতে বলেছি।
– আপনি থেকে আবার তুমি!
– হুম।
– লজ্জা করে না, অন্যের বডি দেখতে!
– না, করে না! টিশার্ট খুলো নয়তো!
– নয়তো কি?
– বমি করে দিবো!
– ছি! পিশাচ মেয়ে!
– ভালো। এবার টিশার্ট খুলে ভদ্র স্বামীর ন্যায় শার্ট পড়ে অফিস যাও। নয়তো আমিও অভদ্র হয়ে যাবো!
– যাবো না অফিস!
– একশো বার যাবে, হাজার বার যাবে।
– তুমি বলার কে!
– বউ।
নাহিদা এবার নিজেই মেহেদীর টিশার্ট খোলার জন্য টানতে লাগলো যদিও তার দ্বারা সম্ভব না! কেননা মেহেদী তার থেকে অনেকটা লম্বা! তবুও সে টানাটানি করতে লাগলো। মেহেদী বিরক্তি নিয়ে টিশার্ট খুলে বললো,
– আহ! হচ্ছে কি এসব!
– বউয়ের দায়িত্ব পালন হচ্ছে।
নাহিদা শার্ট নিয়ে মেহেদীকে পড়িয়ে দিতে লাগলো। মেহেদী বারবার হাত সরিয়ে দিচ্ছে নাহিদা বারবারই চেষ্টা করছে। হাল ছাড়ছে না সে। অবশেষে মেহেদীই হাল ছেড়ে শার্ট নিয়ে পড়তে পড়তে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো। অত:পর বডি স্প্রে করতে লাগলো। নাহিদা ফোন, ওয়ালেট এনে মেহেদীর সামনে রাখতেই মেহেদী নাহিদার মুখে স্প্রে করলো! নাহিদা দু তিন কদম পিছিয়ে এসে বললো,
– ওয়াক থু! এসব কি হচ্ছে!
– বউ বারাবাড়ি করায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে!
দুষ্টু হেসে কথাটা বলে ফোন ওয়ালেট নিয়ে মেহেদী বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! নাহিদা বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
– খাটাশ একটা! যেন উনার ক্ষতি করছি আমি!
জহিরুল ইসলামের খাওয়া শেষ। তিনি বসে আছেন মেহেদীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। খাওয়াদাওয়া শেষ করে চুক্তি সম্পাদনাসহ তার পাওনাদির নানান কথা বলতে বলতে অবশেষে মেহেদী অফিস গেলো বাবার সাথে! তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর মেহেরুন ও নাহিদা বড়সড় নিশ্বাস ছেড়ে একে অপরকে দেখে হেসে উঠলো! মেহেরুন বললো,
– নাহিদা, আমাদের সাথে তুইও তোর মতো করে আরেকটু টাইট দে। আমার বিশ্বাস এর মেরুদণ্ড সোজা হতে বেশি সময় লাগবে না! আপাতত অফিসে ঠিকমতো কাজকর্ম করলেই হয়।
– মা, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
– আচ্ছা, চল। খেয়ে নে এবার।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে নাহিদা লেগে পড়লো ঘরোয়া কাজে। আজ ওয়ারড্রব আলমারি সব গুছিয়ে ফেলেছে। দুপুরের শেষ দিকে নাফিসা এসেছে নাহিদার কাছে! কলিং বেল বাজায় মেহেরুন দরজা খুললো। নাফিসা সালাম দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– ভেতরে এসো। ইশ! চেহারাটা এমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?
– ভার্সিটি থেকে এসেছি।
– খুব চাপ পড়াশোনার?
– এতোটা না। আংকেল বাসায় নেই?
– না। অফিসে গেছে।
– আপু কোথায়?
– রুমেই আছে। যাও।
নাফিসাকে রুমে ঢুকতে দেখে নাহিদা অবাক হলো! নাফিসা দাত চেপে হেসে নাহিদাকে জড়িয়ে ধরলো।
– নাফিসা! তুই আসবি, মা তো কিছু বললো না!
– মা জানলে তো বলবে! ভার্সিটি থেকে এসেছি আমি।
– তাহলে এতো লেট হলো কেন!
– একটা ট্রেইনিং করছি। ভার্সিটির ক্লাসের পর ট্রেইনিং ক্লাস করে তারপর এলাম।
– কিসের ট্রেইনিং?
– সেল্ফ-এমপ্লয়মেন্টের ফ্রী ট্রেনিং এসেছে ভার্সিটির অপজিটে সানফ্লাওয়ার সেন্টার আছে না, সেখানে।
– সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট! কি কোর্সে?
– কয়েকটা কোর্সই আছে। আমি পোল্ট্রি ফার্মেরটা করছি।
– পোল্ট্রি ফার্ম! এটা দিয়ে তুই কি করবি শুধু শুধু! অন্য কিছু নিতে পারতি।
– শুধু শুধু না, কাজে লাগাবো। দেখো তুমি।
– বাবা মা জানে?
– হুম। বাবা প্রথম দিতে চায়নি। আমার জোরাজুরিতে যখন দেখলো মাত্র বারো দিনের কোর্স তখন রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করেছে।
– কবে থেকে শুরু হলো?
– অলরেডি পাচ ক্লাস শেষ।
– তোর ফ্রেন্ডরাও করে?
– হুম। তারা সুয়িং এ গেছে। আমার তো ওটার প্রয়োজন নেই। ওটা আমার জানাই। তাই এটাতে গেলাম। ভাইয়া কোথায়?
– অফিসে গেছে।
– চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তোমাদের কাপল পিক দেখলাম! অসম্ভব সুন্দর হয়েছে!
– তুই কোথায় দেখলি!
– তোমরা সীতাকুণ্ড থাকাকালীন ভাইয়ার সাথে কথা বলে পিক পাঠাতে বলেছিলাম। তারপর পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ ভাবলাম দেখাও করে যাই, বাকি পিকও দেখে যাই! তোমার ফোন কোথায়?
– ছবি তুলিনি। দেখবি কিভাবে! যা দেখেছিস শুধু তা-ই তুলেছি।
– এটা কেমন কথা! এতো জায়গা ঘুরে এলে অথচ ছবি তোলো নি!
– কেমন কথা আবার! ছবি তুলতে গিয়েছি নাকি! উদ্দেশ্য ছিলো ঘুরবো তাই ঘুরে এসেছি।
– ধুর! নিরামিষ জার্নি!
মেহেরুন এসে বললো,
– তাহলে চলো এবার আমিষ দিয়ে ভাত খাই।
নাহিদা হেসে উঠলো। নাফিসা স্টুডেন্টদের কথা বলে চলে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছিলো কিন্তু মেহেরুন খায়িয়ে তারপর ছাড়লেন। সাথে নাহিদা তার জন্য আনা শামুক ও ঝিনুকের গহনাদিও দিয়ে দিলো।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩১
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলে জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফিরেই বললো “মেহেদী আসেনি?”
মেহেরুন ইসলাম বললো,
– না, তো। তোমার সাথেই তো ফেরার কথা!
– আমার সাথে! আমি কি স্টেডিয়ামে বসে বসে খেলা দেখি!
– মানে!
– তোমার বজ্জাত ছেলের জন্য অফিস গেলাম আধঘন্টা লেট করে। প্রথম ঘন্টায় তাকে কাজ দেখিয়ে তার হাতে ফাইল ধরিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় ঘন্টায় কোম্পানি জুড়ে তাকে আর পাওয়া যায়নি!ম্যানেজারের পকেটে একশো টাকা ও হাতে ফাইল দিয়ে সে উধাও! কল করে দেখি ফোন সুইচ অফ! তৃতীয় ঘন্টায় আমার ফোনে কল আসে, “আব্বু, আমি মিরপুর স্টেডিয়ামে আছি। দারুণ খেলা চলছে। দেখতে ইচ্ছে হলে চলে এসো!” শুনেছো তোমার বজ্জাত ছেলের কথা! কাজ ফেলে রেখে আমাকে দাওয়াত করে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম!
– ছেলে বজ্জাত হওয়ায় এখন আমার হয়ে গেছে, তাই না! আর ভালো হলে তোমার সুনাম! কাকে কি বলবো! পুরুষ লোকের স্বভাবই ভালো না! আমিও বলতে পারি, যেমন বাপ তেমন ছেলে!
– আরে আরে, রেগে যাচ্ছো কেন! আচ্ছা, যাও! আমার বজ্জাত ছেলে তোমার ভালো ছেলে। হয়েছে এবার?
– বজ্জাত আবার ভালো হলো কবে!
– না, মানে… হয়নি এখনো, হবে একদিন।
– বসে থাকো তুমি তোমার হবে নিয়ে! সব নষ্টের মূল তুমি! বাড়ি থেকে রেডি করে পাঠিয়ে দিলাম অফিসে ধরে রাখতে পারলে না! সেখানেও কি এখন আমাকে যেতে হবে!
– আরে, আমি দেখিনি তো কখন বেরিয়ে গেছে!
– সে কি পিপড়া সমান যে তোমার চোখে পড়েনি! নাকি তোমার চেয়ে গঠন লম্বা দেখে নাগাল পাওনি!
– হবে হয়তো!
মেহেরুন বাপ-বেটা দুজনকেই ফুসতে ফুসতে কিচেনে চলে গেলো। নাহিদা কিচেনে থেকেই তাদের কথপোকথন শুনে মিটিমিটি হাসছিলো। বজ্জাত ছেলে নিয়ে ছোটখাটো একটা মিষ্টি ঝগড়া হয়ে গেলো স্বামী-স্ত্রীর মাঝে! যা দেখলে ভয়ের পরিবর্তে হাসি পায়! বাবামায়ের মধ্যেও এমন মিষ্টি ঝগড়া গুলো দেখে খুব মজা পেতো! আর তারা বোনেরা এক একজন এক দুপক্ষের মজাদার সাপোর্টার হয়ে যেতো! খুব মিস করছে সেই মুহুর্তগুলো। দুই বোন শ্বশুর বাড়ি এসে আলাদা হয়ে গেছে, ওদিকে নাফিসাটাও একা হয়ে গেছে! আর জমে না, আড্ডা! আর না জমে মজার আসর! এখন শুধু তা টুকটাক ফোনালাপ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ!
সেই সকালে বেরিয়েছে আর এখন ইশার আযানের পর বাড়িতে ফিরলো মেহেদী। তার মা বকাঝকা করলো যা তার কান দিয়ে প্রবেশই করলো না! বাইরে থেকে ডিনার সেড়ে এসেছে তাই আর বাসায় খায়নি। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সকালে নাহিদা ধাক্কাসহিত ডেকে তুলে নামাজ পড়তে বাধ্য করলো। আজ আর ঘুমায়নি। কিছুটা সময় বাইরে কাটিয়ে এসেছে। নাহিদা রান্নাবান্না শেষ করে রুমে এসে দেখলো মেহেদী বাথরুমে গোসল করছে। নাহিদা গুনগুন করতে করতে রুম গুছিয়ে মেহেদীর শার্ট আয়রন করে দিলো। মেহেদী আজ টিশার্ট পড়েনি। খালি গায়েই বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। মাথা মুছে তোয়াল রাখতেই নাহিদা শার্ট এনে তাকে পড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধরলো। মেহেদী হাত থেকে নিতে নিলো কিন্তু সে দিলো না! মেহেদী কিছু না বলে তার হাতেই পড়ে নিলো। শার্টের বোতাম লাগাবে নাহিদা সেটাও করতে দিলো না। মেহেদীর হাত সরিয়ে দিয়ে গুনগুন করতে করতে নাহিদা শার্টের কলার ঠিক করে একে একে বোতাম লাগিয়ে দিতে লাগলে মেহেদী বললো,
– আমি কি ছোট বাচ্চা, যে আমি স্কুলে যাবো আর আমাকে এভাবে রেডি করে দিতে হবে!
– না গো! তুমি তো বড় বাচ্চা! এজন্য অফিস যাওয়ার জন্য রেডি করিয়ে দিতে হচ্ছে। স্কুলের জন্য না। গতকালের মতো ফাকি না দিয়ে ঠিকমতো কাজ করবে। এতে তোমার মঙ্গল হবে বুঝতে পেরেছো!
নাহিদার এমন দুষ্টু আচরণ ও বাচ্চাদের মতো পরামর্শ দিতে দেখে মেহেদীর মাথায়ও দুষ্টুমি চাপলো! সে নাহিদার পেছনে এক হাত রেখে এক টানে নিজের সাথে চেপে ধরলো! যা দেখে নাহিদার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! এদিকে মেহেদীর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দুষ্টুমির হাসি! সে আরেক হাতে নাহিদার গাল স্পর্শ করে ছোট ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বললো,
– আচ্ছা! আর কি কি করবো গো। বলো তো একটু শুনি?
নাহিদা তাকে ছাড়ানোর জন্য ঠেলতে ঠেলতে জোরপূর্বক হেসে বললো,
– আর! আর কিছু করতে হবে না তো!
মেহেদী কানের লতি থেকে হাত সরিয়ে সেই হাতও কামিজের ভেতর দিয়ে নাহিদার পেছনে নিয়ে গেলো! এবং বললো,
– আর কিছু না করলে সারাদিন কাটবে কিভাবে আমার! বলো না, আরও কি করতে হবে? বউ তো তুমি! বউয়ের দায়িত্বই তো প্রতিদিন স্বামীকে এভাবে রেডি করিয়ে দিবে, ভালো ভালো উপদেশ প্রদান করবে। বলো বলো?
নাহিদা খুব কঠিন ঢোক গিললো! মেহেদীর স্পর্শে সে শিউরে উঠছে কিন্তু চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে ছাড়া পাচ্ছে না! মেহেদীর সাথে দুষ্টুমি করতে গিয়ে এ কোন বিপদে আটকে গেল সে! না পারছে ছাড়াতে আর না পারছে হজম করতে! বড্ড অসস্তি লাগছে তাঁর! সে আমতা আমতা করে বললো,
– অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে তো!
– বউকে আদর করার পরে না আসবে অফিস টাইম!
– এ!
– হ্যাঁ।
– আপনার শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি তো!
– তুমি থেকে আবার আপনি হয়ে গেলাম কিভাবে!
– কি..কিভাবে আবার! এমনি! দেখি, ছাড়ুন! মা, টেবিলে খাবার দিতে বলেছিলো!
– মা তার আগে আমাকে রেডি করতে বলেছিলো!
– আপনি তো ছোট বাচ্চা না!
– আরে, আমি তো বড় বাচ্চা। অফিস যাবো। রেডি করবে না আমাকে!
নাহিদার অসস্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যাচ্ছে! মেহেদী তাকে দু’হাতে একদম কাছে টেনে নিয়েছে! যতই সাহসী গিরি দেখাক না কেন, এখন যে ফাদে পা দিয়ে নাহিদার কান্না করতে ইচ্ছে করছে! সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
– রেডি তো হয়েছেনই! এবার আমাকে ছাড়ুন!
– কি যেন গুনগুন করছিলে, গানটা গেয়ে শুনাও তো?
– গান! গানতো আমি গাইতে পারি না!
– না পারলে গুনগুন আসলো কোথা থেকে!
– ওইযে পারি না তাই গুনগুন এসেছে! আমার না..
– কি?
– রান্না করতে করতে খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমি যাই?
– কোথায় ক্ষুধা লেগেছে, দেখি?
মেহেদী তাকে পেছন দিক থেকে ছেড়ে পেটের দিকে এক হাত আনতেই সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে এক দৌড় দিলো! মেহেদী বললো,
– আরে! আমার শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি তো! বাকি আছে আরও!
– আপনি লাগিয়ে নিন!
নাহিদা ছুটে চলে গেলো আর মেহেদী তাকে বিব্রত করতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে মেহেদী আজ তার বাবার সাথে অফিসে গেলো। বিকেলে জহিরুল ইসলাম একা বাড়ি ফিরেছেন। তিনি জানিয়েছেন যা-ই মেহেদীকে চোখে চোখে রেখেছিলো কিছু সময়। জয়েনিংয়ের দুদিন না হতেই গিয়ে বলে “বেতন দাও!” জহিরুল ইসলাম বেতন না দেয়ায় লাঞ্চ টাইমেই সে ফুড়ুৎ!
মাগরিবের নামাজ পড়ে শুকনো কাপড়চোপড় ভাজ করে রেখছিলো নাহিদা। মেহেদী সিটি বাজাতে বাজাতে রুমে প্রবেশ করলো। নাহিদা তাকে দেখে বললো,
– এতোটা আশা নিয়ে আপনাকে অফিসে নিয়ে গেলো আর আপনি কাজে ফাকি দিলেন! এটা কি ঠিক হয়েছে?
– বাড়ির পাশাপাশি আবার অফিসেও চলে গেছো! সেখানেও তোমার রুলস মেনে চলতে হবে আমাকে!
– এতোটা অবুঝ সাজেন কেন! একটু বুঝদার হলে কি এমন ক্ষতি!
মেহেদী নাহিদার দিকে আসতে আসতে বললো,
– আচ্ছা! কেমন বুঝদার হতে হবে আমাকে, বলোতো?
সকালের ঘটনা মনে হতেই নাহিদা হাতের কাপড়চোপড় সব সামনে রেখে নিজেকে জড়িয়ে বললো,
– জানি না আমি!
– না, জানো তো। বলো?
– সত্যি, জানি না আমি!
তার ভয়ার্ত কান্ডে মেহেদী মৃদু হেসে ঘড়ি খুলতে খুলতে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চলে গেলো। নাহিদা জামাকাপড় ভাজ করতে করতে মৃদু স্বরে বললো,
– নামাজ পড়েননি নিশ্চয়ই!
মেহেদী আয়নাতেই তার দিকে তাকালো। নাহিদা মলিনতার সাথে আবার বললো,
– নামাজ না পড়লে আর অফিসে ঠিকঠাক মতো কাজ না করলে আজ থেকে আপনার খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বাবার আদেশ।
– ভালো।
– শুধু আপনার না, আমারও খাওয়াদাওয়া বন্ধ। স্বামী উপার্জন করলেই স্ত্রীর আহার জুটবে।
মেহেদী তার দিকে ফিরে বললো,
– আচ্ছা!
– হুম। দুপুরেও আমি খাইনি!
– তাই নাকি!
– হুম। খুব ক্ষুধা লেগেছে আমার। এখন আপনার তো উপার্জন নেই, আমি খাবো কিভাবে!
– আহারে! তাহলে এক কাজ করো।
– কি?
– না খেয়ে তো আর বাচা যাবে না, তাইনা?
– হুম।
– তাহলে তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। সেখানে তোমাকে না খায়িয়ে রাখবে না! আমি না হয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নেই।
– কিহ!
-জ্বি।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩২
(নূর নাফিসা)
.
.
– তাহলে তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। সেখানে তোমাকে না খায়িয়ে রাখবে না! আমি না হয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নেই।
– কিহ!
-জ্বি।
– তবুও আপনি শুধরাবেন না!
মেহেদী শার্ট চেঞ্জ করতে করতে বললো,
– যেমন আছি, বেশ আছি!
নাহিদা এবার সিরিয়াস মুডে বললো,
– এমন কেন আপনি! কোনো মানুষ বলে আপনাকে আখ্যায়িত করা যায়! দিনরাত প্রতিটি সময় আপনি বাবা মা কে অবহেলা করে, অমান্য করে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন। সেই খেয়াল কি আপনার আছে! কীজন্য দুনিয়াতে জন্ম নিয়েছেন আপনি? পিতামাতাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? আপনার পিতামাতা বলে তো এখনো আদরে রেখেছে। অন্যান্যদের মতো হলে পুত্রের আসন হতে ত্যাজ্য করে দিতো!
– দ্যাটস গুড, এজন্যই আমি ত্যাজ্য নই!
– সব কথাই তো মজা করে উড়িয়ে দেন! এমনটা কি ভেবেছেন কখনো যে পিতামাতা কি চায় একটু ভেবে দেখি! পিতামাতা আমাকে নিয়ে এতো টেনশন করে আমি একটু তাদের টেনশনমুক্ত করার চেষ্টা করি! তাদের একটু খুশি রাখার চেষ্টা করি! অহংকারের সন্তান হয়ে দেখাই, সকলের কাছে মর্যাদা সমেত পাত্র হয়ে দেখাই! মানুষ তো জন্ম লাভ করে সেই সুত্রেই! আর আপনি কি করছেন!
– বেশি কথা বলো না। মেয়ে মানুষ চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।
– রাখেন আপনার শ্রেয়! আপনি কি নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করেন নাকি! জন্মগত ভাবেই আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে অধিক শক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন। আর আপনি, মেয়েদের থেকেও নিকৃষ্ট! আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখুন মেয়েরাও নানান কাজে জড়িয়ে আছে পেটের দায়ে, সংসারের টানে! আপনার মতো ঘরের কোনে বসে নেই। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা কি জিনিস, পার্টি কাকে বলে তা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণই অজ্ঞাত! উচিৎ কথা বলতে গেলেই আমি বেশি বলে ফেলি! কেন বলি সেই মর্মটা কি একবার বুঝতে চেষ্টা করেছেন!
– তোমার বুঝ তোমার কাছেই রাখো। আর ইচ্ছে হলে আশেপাশের মতো তুমিই জড়িয়ে পড়ো কাজে।
– আপনার যেই অবস্থা দেখছি এখন আমাকেই জড়াতে হবে কাজে! কি আর করার! আমার হাতে টান পড়লে তো আর এদিক সেদিক থেকে টাকা এসে পড়ে না! আমার পেটের দায়ে তো আর কারো কিছু আসে যায় না! তার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। বসে থাকুন আপনি ঘরের কোনে।
নাহিদা কাপড়চোপড় ওয়ারড্রবে রেখে ঠাস করে ড্রয়ার লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! মেহেদী ফ্রেশ হয়ে কিচেনে এসে দেখলো মেহেরুন ইসলাম রান্না করছে। মেহেদী পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
– আজ রান্না এতো দেড়ি কেন, আম্মু!
– ডাকবি না আমাকে আম্মু! আমি তোর কিছু হইনা! তোর মতো ছেলের আম্মু হয়ে থাকতেও চাই না! কতো শখ ছিলো, ছেলেকে সুন্দরভাবে মানুষ করবো। সকলের প্রিয় পাত্র থাকবে আমার ছেলে! সবার মুখে মুখে প্রশংসা থাকবে আমাদের ছেলের জন্য! ছেলে বড় হবে, উপার্জন করে মুখে দু মুঠো ভাত তুলে দিবে! ছেলের উপার্জনে পেট পুরে আহার করবো। ছেলে বিয়ে করবে, সংসার সাজাবে। সজ্জিত সংসার আলোকিত করতে একসময় নাতি নাতনি আসবে। আমি জীবনের বাকিটা সময় তাদের নিয়ে খেলা করে কাটিয়ে দিবো! সেই কপাল কি আমার আছে! ছেলেকে আজ পর্যন্ত যোগ্য মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলতে পারলাম না। শুধু শুধু এতো লম্বাটে স্বপ্ন দেখে কি হবে!
মেহেদী কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো কিচেন থেকে। মেহেরুনের বকবকানি চলছেই। নাহিদা তাকে বলছে, “থাক মা। ওসব বলে লাভ নেই। আপনার ছেলের কানের অগ্রভাগেও যায় না সেসব।”
ইশার নামাজ পড়ে জহিরুল ইসলাম বাড়িতে এসেছেন। তার পরপরই মেহেদী এসেছেন। নাহিদা চুপচাপ টেবিলে খাবার সাজাতে লাগলো। মেহেদী এসে চেয়ার টেনে বসলো। মেহেরুনও চুপচাপ খাবার প্লেটে দিতে লাগলো। নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা, বসে পর।
– না, মা। আপনারা খেয়ে নিন। আমার পেট ভরা।
– পেট ভরা মানে! দুপুরেও খাওয়া হয়নি তোর। কি খেয়েছিস পেট ভরা যে!
– কখনো কখনো মুখের কথাতেই পেট ভরে যায় মা। আমার ভালো লাগছে না। এখন খাবো না আমি। শুধু শুধু জোর করে ভাত নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
নাহিদা মেহেদীর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে না খেয়ে রুমে চলে গেলো। মেহেদী খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। জহিরুল ইসলাম এসে চেয়ারে বসে বললেন,
– ইশার নামাজ পড়েছো তুমি?
– না।
– তাহলে মুখে খাবার তুলছো কোন সাহসে? নামাজ থাকবে না, কাজকর্ম থাকবে না, অন্নও থাকবে না।
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী খাওয়া ছেড়ে প্লেট রেখে চলে গেলো। মেহেরুন বললো,
– এটা কি করলে! এখন যে না খেয়ে চলে গেলো! খাওয়ার মাঝে কথাটা না বললে হতো না!
– না, হতো না। এখনই বলা প্রয়োজন ছিলো। যাওয়ার হলে যাক চলে। যার কাজ নেই তার আহারও নেই।
মেহেদী কিচেনে হাত ধুতে ধুতে তার বাবামায়ের কথা শুনেছে। সে হাত ধুয়ে কিচেন থেকেই পানি পান করে সোজা রুমে চলে গেলো। নাহিদা বিছানা ঠিক করে শুয়ে আছে। মেহেদীকে রুমে ঢুকতে দেখে সে চোখ মুছে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললো। মেহেদী দরজা লাগিয়ে বিছানায় চলে এলো। ফোনে কল আসতেই সে রিসিভ করে বললো, “এখন আসতে পারবো না। তোরা যা। ঘুমাবো আমি।” এটুকু বলেই সে কল কেটে তার চাদরটাও ছড়িয়ে নাহিদার উপর দিলো। তারপর সে নাহিদার সাথে ডবল চাদরের নিচে চলে গেলো। নাহিদার বালিশে শুয়ে সে পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার উপর মেহেদীর হাত রাখায় নাহিদা চমকে উঠলো! সে চোখ খুলে দেখলো রুম অন্ধকার! ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরতে গেলে বুঝতে পারলো মেহেদীর মাথাটা তার মাথার সাথে লাগানো। সে এতো তারাতাড়ি চলে এলো কেন! এতো তারাতাড়ি তো খাওয়া শেষ হওয়ার কথা নয়! নিশ্চয়ই খায়নি কোনো কারনে! আবার এখানে এসে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো কেন! নাহিদার মনে নানান ভাবনা উঁকি দিচ্ছে! সে কি এখন স্বাভাবিক আছে নাকি মাতাল! সে ড্রিংকস করে আসেনি তো আবার!
ভাবতে ভাবতে নাহিদা হাতটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মেহেদী আরও জড়ো হয়ে বললো,
– সমস্যা কি! আমি তোমার হাসব্যান্ড না? ঘুমাও চুপচাপ।
মেহেদীর আচরণ নাহিদার মাথায় ধরছে না! এখন তার সাথে কথা বলারও কোনো ইচ্ছে নেই। তাই চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়েই রইলো সে। আর চোখের পাতার নিচে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান ভাবনা!
সকালে এলার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো নাহিদার! কিন্তু এটা তার ফোনের এলার্ম না! মেহেদীর ফোন বেজে চলেছে। নাহিদা চোখ খুলে অনুভব করতে পারলো সে মেহেদীর বুকের সাথে মিশে আছে! হাত পেছনের দিকে নিয়ে টাইম দেখার জন্য তার ফোন খুজতে লাগলে মেহেদী তার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সেও জেগে গেছে। লাইট অন করে সে এলার্ম বন্ধ করলো। এবং বাথরুমে চলে গেলো। মাত্রই নাহিদার এলার্ম বাজতে শুরু করলো। সে উঠে বসে এলার্ম বন্ধ করলো। মসজিদের আযান শোনা যাচ্ছে। আর নাহিদা বসে বসে হাই তুলছে! বেশ কিছুক্ষণ পর মেহেদী ওযু করে বেরিয়ে এলো। ওয়ারড্রবের উপর থেকে টুপিটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। যদিও মেহেদীর আচরণে সে অবাক তবুও নাহিদার ভালো লাগলো তা দেখে। কিন্তু সে তো সবসময় নামাজ পড়ে না! আনন্দ ও হতাশা মিশ্রিত এক নিশ্বাস ফেলে সে ওযু করতে চলে গেলো। নামাজ পড়ে কুরআন পাঠ করলো। অত:পর বিছানাপত্র গুছিয়ে রুম গুলো ঝাড়ু দিতে লাগলো। ঝাড়ু দেওয়ার শেষ পর্যায়ে মেহেদী বাড়িতে ফিরেছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। সে রুমের দিকে যেতে যেতে নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো,
“ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রুমে এসো।”
নাহিদা ঝাড়ু দেওয়া রেখে মেহেদীর যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো! মেহেরুন তখন পানির জগ নেওয়ার জন্য ড্রয়িং রুমেই ছিলো। তিনিও একটু অবাক হয়ে মেহেদীর হাতের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহেদী চলে যাওয়ার পর নাহিদাকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলো, “কি?” নাহিদাও ইশারায় মাথা নেড়ে জবাব দিলো, “জানি না!”। ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে নাহিদা রুমে এলো। মেহেদী তাকে বললো,
– হাত ধুয়ে এসো।
– কেন?
– কেন আবার! যেতে বলেছি যাবে!
নাহিদা বাথরুমে এসে হাত ধুয়ে রুমে এলো। মেহেদী ছোট টেবিলের উপর প্যাকেট খুলে বসেছে। নাহিদা এগিয়ে এসে দেখলো পরটা ভাজি নিয়ে এসেছে! সে মেহেদীর দিকে তাকাতেই মেহেদী বললো,
– দাড়িয়ে আছো কেন? বসো এখানে। পরটা ভাজি খাও। এটাই সকালের নাস্তা।
– সকাল সকাল পরটা ভাজি! আমি খাবো না। আমার গ্যাস্ট্রিকের প্রব্লেম আছে।
– প্রব্লেম থাকলেও এটাই খেতে হবে। নয়তো খাবার পাবে না। মাস শেষ হবে তারপর ভাত খেতে পাবে।
– মানে!
মেহেদী তার হাত টেনে বসিয়ে বললো,
– মানে পরে বুঝে যাবে। এখন চুপচাপ খাও। খাওয়ার পর বেশি করে পানি খাবে তাহলে আর প্রব্লেম হবে না। ধরো।
নাহিদা একটা পরটা হাতে নিলো। মেহেদী খেতে খেতে বললো,
– আম্মুর কাজে হেল্প করার হলে করবে কিন্তু কিছু খাবে না। মনে থাকবে?
– কেন?
– সব কথার এতো মানে আর কেন খুজো কেন! খাবে না বলেছি, তো খাবে না। আমি উপার্জন করবো, খাবার কিনে আনবো তারপর খাবে। মনে থাকবে তো?
নাহিদা চরম অবাক! সে খাবার মুখে রেখেই জবাব দিলো,
– হু।
চলবে।