তৃ-তনয়া পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
778

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
একটা পরটা খাওয়ার পর নাহিদা উঠে পড়লো। মেহেদী বললো,
– এগুলো তুলে রাখো। দুপুরে খাবে।
– দুপুরেও পরটা!
– হ্যাঁ। রাতের জন্য অন্যকিছু নিয়ে আসবো।
নাহিদা পরটা প্যাকেটে তুলে রেখে কিচেনে এলো। মেহেরুন বললো,
– রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম পরটা খাচ্ছিস! এতো সকালে পরটা খাওয়ালো কেন!
– কি জানি, মা! ভাত খেতেও নিষেধ করে দিয়েছে আমাকে।
– কেন!
– জানি না তো! বুঝতে পারছি না কিছুই! শুধু বললো, আপনার কাজে হেল্প করতে কিন্তু কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। দুটো পরটা আছে, দুপুরে যেন সেগুলো খেয়েই থাকি আর রাতের জন্য অন্যকিছু নিয়ে আসবে! তিনি উপার্জন করবেন তারপরই আমার খাওয়া হবে!
– বাব্বাহ! এতো কঠোর নীতিমালা!
– পাগলের নীতিমালা! কি রান্না করবো, রাতের খাবার দেখছি সবই আছে!
– থাকবে না! তোর বাবা অল্প খেয়েছে ছেলেটা তো না খেয়েই চলে গেলো। তুইও খাসনি, আমিও খাইনি!
– কেন!
– আত্মা টানে না! এগুলোই গরম করে দেই। তারা খেয়ে নিলে রান্না বসিয়ে দিবো।
নাহিদা খাবার গরম করে নিলে মেহেদীর ডাক পড়লো। সে রুমে এসে দেখলো মেহেদী গোসল করে বেরিয়েছে।
– কি হয়েছে?
– শার্ট আয়রন করো।
– ওয়ারড্রবে আয়রন করে রাখা আছে দুইটা। একটা পড়ে নিন।
– বের করো।
নাহিদা ওড়নায় হাত মুছে একটা শার্ট বের করে দিতেই মেহেদী ইশারা করলো পড়িয়ে দিতে! নাহিদার গতকালের ঘটনা মনে হতেই সে তার হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– আমি কিচেনে কাজ করছি, আপনি পড়ে নিন!
মেহেদী তার হাত ধরে বললো,
– আজ দায়িত্বের কথা মনে পড়ে না! আমাকে রেডি করে তারপর যাও কিচেনে।
শার্ট আবার তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে দাড়িয়ে রইলো। নাহিদা দ্রুত শার্টের বোতাম লাগাতে গিয়ে উল্টাপাল্টা লাগিয়ে ফেলেছে! তা দেখে মেহেদী বললো,
– কি করছো এসব?
– শার্টের বোতাম লাগাচ্ছি!
– আমার তো মনে হচ্ছে শার্টে গিট্টু লাগাচ্ছো! এক ঘর ছেড়েই বোতাম লাগায়! এটা আবার কোন স্টাইল!
নাহিদা আবার বোতাম খুলে ঠিক করে লাগিয়ে বললো,
– শেষ। এবার আমি যাই।
– ঘড়ি পড়াও।
নাহিদা ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়িয়ে দিলো। মেহেদী আবার বললো, “জুতা বের করো”। জুতা বের করে দিলে বললো, “ব্লু ব্লেজারটা বের করো।” নাহিদা সেটাও বের করে পড়িয়ে দিলো এরপর দুজন একসাথে বের হলো রুম থেকে। তার মা বাবাকে শুনিয়ে মেহেদী নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো, “আবারও বলছি, এক বেলাও কিছু খাবে না! মনে থাকে যেন!”
নাহিদা শুধু তাকিয়ে রইলো। মেহেদী বেরিয়ে গেলে জহিরুল ইসলাম মেহেরুনকে জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার! তখন মেহেরুন ইসলাম জানিয়ে দিলো ব্যাপারস্যাপার!
.
নাফিসা ফোনে তার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে বলতে ভার্সিটির গেইট দিয়ে প্রবেশ করছিলো। হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো আর ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো! তাকিয়ে দেখলো আশিক ও সাথে আরেকটা ছেলে। ধাক্কা খেয়েছে সাথের ছেলেটার সাথে। ছেলেটা সরি বলে ফোনটা তুলে দিলো। নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে রেগে বললো,
– এই মিয়া! চোখ কি মাথায় তুলে হাটেন!
– আপনি যদি মাথায় তুলে হাটতে পারেন তাহলে আমি কেন নয়!
– আমি মাথায় তুলে হাটতে যাবো কোন দুঃখে!
– তাহলে কোথায় থাকে আপনার চোখ?
– আমার চোখ মাথার পেছনে থাকে!
– অহ আচ্ছা! আমারটাও মনে হয় তাহলে পেছনেই থাকে।
– একে তো স্বেচ্ছায় ধাক্কা দিয়ে আমার ফোন ফেলে দিলেন তার উপর মজা নিচ্ছেন!
– সরি খেয়াল করিনি!
– কপালের নিচে চোখ থাকতেও অন্ধের মতো চলাফেরা করে!
– এক্সিউজমি, চোখ তো আপনারও ছিলো। আমার দোষ হলে তো আপনারও দোষ আছে! আপনি যেমন ফোনে কথা বলছিলেন আমিও তেমন ওর সাথে কথা বলতে বলতেই হাটছিলাম।তাহলে আপনিও আমার মতোই অন্ধ!
– আমার দোষ কিভাবে ছিলো! আমি গেইট দিয়ে আগে ঢুকছিলাম! সেটা দেখা সত্ত্বেও কেন আপনি এগিয়ে এলেন! আমি এলে আপনি যেতে পারতেন না!
– আচ্ছা! সরি।
ছেলেটি বলার সাথে সাথে আশিকও বললো,
– নাফিসা, সরি বলেছে তো।
নাফিসা তেজে আশিককে জবাব দিলো,
– রাখেন আপনার সরি! পেয়েছে এক সরি! বনবাদাড়ে যেমন কচু মিলে মুখে এখন সরি সরি! সরি বললেই কি সব মীমাংসা হয়ে গেলো! আমি আপনার পায়ে কুড়াল মেরে সরি বলে চলে যাই আপনি মানবেন!
– এখানে আবার কুড়াল টানছো কেন। এমন কিছু তো হয়নি!
– ফোন ফেলে দিয়েছে সেটা কি আপনার চোখে পড়েনি!
– এটা নিয়ে এখন কি কথা বাড়িয়েই যাবে!
– কোনো ইচ্ছে নেই আপনাদের সাথে কথা বাড়ানোর! আপনাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতেও রুচিতে বাধে আমার।
নাফিসা হনহন করে চলে গেলো। আশিক কিছু বললো না কিন্তু সেই ছেলেটা অল্পতে এতো চাপা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! আশিক বললো,
– চলো।
– বাব্বাহ! কি চাপারে!
– একটু চঞ্চল তবে যেমন দেখছো তেমন না।
– মানে!
– মানে আমি এখানে বলে এমন ভাবে বলে গেলো। অন্যথায় খুব ভালো।
– কানেকশন কি? হু?
– উল্টাপাল্টা যা ভাবছো তা মোটেও না। ঘৃণার পাত্র! শুধু আমিই না, আমার পরিবারই তার কাছে ঘৃণিত। তার কারণও আছে বটে!
– আশিক, একে না মনে হচ্ছে আমি দেখেছি কোথাও!
– আরাফ ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছো হয়তো। ভাবির বোন।
– অহ!
.
মেহেরুন ভাত খাওয়ার পরও নাহিদা খেলো না। মেহেদীর কথা রাখতে পরটাই নিলো খাওয়ার জন্য। পরটা লাঞ্চ করে নাহিদা কল করলো নাজিয়ার কাছে।
– আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো আপু?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?
– আলহামদুলিল্লাহ। কি করছিলে?
– তেমন কিছু না। খেয়ে রুমে এলাম এইমাত্র। খেয়েছিস?
– হুম। ভাইয়া স্কুলে?
– হ্যাঁ।
– আয়াতের নাকি বিয়ে ঠিক?
– হ্যাঁ। তুই জানলি কার কাছে? তোর ভাইয়া বলেছে?
– না, ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি। যার সাথে বিয়ে ঠিক সে-ই বললো।
– তুর্যকে চিনিস তুই?
– তুর্য! তুর্য কে?
– তুর্যের সাথেই তো আয়াতের বিয়ে।
– কি বলো! ওর নাম তো রায়ান! মেহেদীর ফ্রেন্ড।
– আরে না। ভুল জেনেছিস হয়তো। তুর্যের সাথে আয়াতের বিয়ে।
– না, রায়ান নিজে আমাকে বলেছে আয়াতের কথা! তাছাড়া তাকে বিয়ের আগে থেকেই চিনি। আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে।
– আয়াত তো বললো তার নাম তুর্য! তাহলে একাধিক নাম হবে হয়তো।
– হতে পারে। তা জানা নেই! বিয়ের দিন কি পাকাপাকি হয়ে গেছে?
– না, শুক্রবার আসবে তারা। কথাবার্তা বলে তারপর ঠিক করবে।
– অহ!
– কেমন কাটছে তোর দিন? ভালো লাগে সেখানে থাকতে?
– দিন কাটছে ভালোই, কিন্তু মন টানে বাবার বাড়িতে!
– তা টানবেই। তবে সেখানেও টিকতে পারবি না। মন টানবে আবার সে বাড়িতে!
– হয়তোবা।
– ভালো আছে তো বাড়ির সবাই?
– আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
– নাহিদা, বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। পরে কথা বলি। কাপড়চোপড় বাইরে।
– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
বিকেলের শুরুতেই বৃষ্টি নামলো। নাজিয়া বাইরে থেকে কাপড়চোপড় এনে ভাজ করছে। আরাফ দৌড়ে ঘরে ঢুকলো!
– ধ্যাৎ! ভিজেই গেছি!
নাজিয়া আরাফের দিকে এগিয়ে এসে ফোন, ওয়ালেট নিতে নিতে বললো,
– ভিজে আসার কি প্রয়োজন ছিলো! কোথাও দাড়াতে পারতে!
– বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি তাই ভাবলাম দৌড়ে চলে যাই!
– এখন যে ভিজে গেলে!
আরাফ নাজিয়ার ওড়নার আঁচল টেনে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– তোমার আঁচল খানি আছে তো আমাকে শুকানোর জন্য।
নাজিয়া মুচকি হেসে আরাফের আধভেজা শার্ট খুলতে লাগলো। আরাফ মাথা মুছে নাজিয়ার পেছনে দুহাত রেখে দাড়িয়ে রইলো। শার্ট খোলা শেষ হতেই নাজিয়া বললো,
– শার্ট পড়বে নাকি টিশার্ট?
– টিশার্ট।
– দেখি ছাড়ো।
আরাফ তাকে ছেড়ে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
– এইদিনে বৃষ্টি, দেখো শীত নামিয়ে ছাড়বে।
– তা তো নামবেই। ধরো।
আরাফ টিশার্ট পড়তে পড়তে বললো,
– বউ, বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি পাকানোর ব্যবস্থা আছে নাকি?
– বললে হয়ে যাবে।
– রান্না বসিয়েছো?
– না।
– কোথায় যাচ্ছো এখন?
– কিচেনে।
– এখনই রান্না বসাবে! বৃষ্টি কমলে পরে যাও।
– মুরগীর মাংস ভিজিয়ে রেখে আসি।
– পরে যাও। আয়াত বাসায় নেই?
– হ্যাঁ, আছে।
– তুর্জের বাসা থেকে লোকজন এসেছিলো?
– শুধু তুর্জের বাবা এসেছিলো। বাবা বললো, শুক্রবার নাকি আংটি পড়াতে ও বিয়ের দিন ঠিক করতে আসবে তারা।
– ওহ্। বাবা বাড়িতে আছে?
– না। বৃষ্টি নামার একটু আগে বেরিয়েছিলেন। টিফিনে খেয়েছো কিছু?
– হুম।
– তুমি বসো, আমি মুরগীর মাংস ভিজিয়ে রেখে মুড়ি মেখে নিয়ে আসি তোমার জন্য।
নাজিয়া আরাফের জন্য মুড়ি মেখে নিয়ে এসেছে। নিজ কক্ষে সুখী দম্পতি মুড়ি খাচ্ছে আর খুশগল্প করছে। বাইরে বাদল ধারা বইছে! ঘরের চালায় ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টির পানি পড়ছে। সারাদিন আবহাওয়া গুমোট থেকে দিনশেষে বৃষ্টি নেমে এলো ভুবনে। ঠান্ডা স্পর্শে শীতল করে দিলো পরিবেশ। সাথে নিয়ে এলো হিমেল হাওয়ার আগমনীবার্তা!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৪
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলে মেহেদী বাড়ি ফিরেছে জহিরুল ইসলামের পরে। জহিরুল ইসলাম ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। মেহেদী তাকে দেখেও না দেখার ভান করে এক্সট্রা ভাব নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। মেহেরুন ইসলাম চা নিয়ে এলে জহিরুল ইসলাম বললো,
– বজ্জাত কি একদিনে ভালো হয়ে যায় মেহেরুন?
মেহেরুন ইসলাম কিছু না বুঝতে পেরে অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে। তাই জহিরুল ইসলাম বললেন,
– যে কাল পর্যন্ত বজ্জাত ছিলো সে আজ সকালে নাস্তা করে নিজের পকেট খরচ করে! গাড়ি রেখে অফিস যায় রিকশা করে! অন্যান্য দিন যতক্ষণ সামনে থাকে আব্বু আব্বু করে পাগল করে ফেলে! আর আজ সারাদিন স্যার স্যার বলে মাথা গোলমাল করে দিয়েছে! অফিস টাইম তো দূরে থাক! আয়ারও আগে অফিস গিয়ে হাজির! কাজ জোর করেও চাপিয়ে দিতে পারি না আর আজ চেয়ে চেয়ে কাজ নিয়ে নিয়েছে! না বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ ম্যানেজারের পিছু পিছু ঘুরেছে কিছুক্ষণ শ্বশুরের সাথে পরামর্শ করেছে! যেই দেখেছে আমি গেলাম নিয়াজ ভাইয়ের কাছে সে আর সেখানে নেই। ঘন্টাখানেক পরপর ডেস্কে এসে কাজের হিসেব দিয়েছে! লাঞ্চ টাইম ক্যানটিন ছেড়ে রেস্টুরেন্ট গেছে। তাও একপয়সাও চায়নি! সারাদিন এতো মনযোগ দিয়ে কাজ করলো কিভাবে! আমি তো পরম থেকে চরম অবাক! দিনশেষে জানতে পারলাম যার ফোন ছাড়া এক মিনিট চলে না সে নাকি ফোন ম্যানেজারের কাছে জমা রেখেছে! আসার সময় বলে এলাম আমার সাথে গাড়িতে আসতে, কি সুন্দর বলে দিলো, “সরি, স্যার!” তারপর চলে গেলো রিকশা ডাকতে! তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে কিছু!
– চুপ থাকো! এতোদিন বজ্জাত বলতে বলতে ছেলেটার নামই ভুলে গেছো আর এখন ভালো কাজ করলেও শান্তি নেই, উপহাস করতে শুরু করেছো! কোন দিকে যাবে আমার ছেলে!
– আরে, তুমি এমন ক্ষেপে যাচ্ছো কেন!
– আবারও কথা বলো তুমি! ছেলেটা কাল থেকে না খেয়ে আছে! রাতে খাওয়ার মধ্য থেকে কিভাবে উঠিয়ে দিতে পারলে! আবার এখন রসিকতা করো! মেয়েটাও সারাদিন একটা ভাত মুখে তুলেনি! হাড়ি ভরা ভাত, এইবার তুমি খাও বেশি করে!
মেহেরুন হনহন করে চলে গেলো! কখনো নিজেই বলে আচ্ছা জব্দ করতে আর তেমন পদক্ষেপ নিতে গেলে আবার নিজেই বিপক্ষে চলে যায়! একেই বলে দরদী জননী! ভাবতে ভাবতে জহিরুল ইসলাম ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন! যেন মেহেরুনের কথায়ই চা ঠান্ডা হয়ে গেছে!
নাহিদা রুমেই ছিলো ।মেহেদী তার হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– তুমি খেয়েছো বুঝি?
– হ্যাঁ।
হাত থেকে প্যাকেট আবার নিয়ে বললো,
– নিষেধ করেছি না খেতে! এই মুহূর্তে তোমার আসবাবপত্র নিয়ে বের হও! আমার রুমের সীমানায়ও পা রাখবে না!
– আমার কি দোষ! আপনিই না বললেন, দুপুরে পরটা খেতে!
– অহ! তো সেটা তো বলবে পরটা খেয়েছো! আমি জিজ্ঞেস করেছি আম্মুর দেওয়া অন্যকোনো খাবার খেয়েছো কি-না!
– না।
– নাও, ধরো। এটাতে মোরগ পোলাও আছে। রাতের খাবার এটা।
– ক’দিন খাবেন এই মোরগ পোলাও? এতো টাকা আছে আপনার কাছে?
নাহিদার মাথায় ব্লেজারটা ঘোমটা ন্যায় ঝুলিয়ে দিয়ে মেহেদী বললো,
– পাচ হাজার নিয়েছি তো তোমার কাছ থেকে! আর তিনশো আছে না পার্সে, সেটাতেও এক বেলা খাওয়া যাবে। আরও থাকলে বের করো।
মেহেদীর কথা শুনে নাহিদার গা জ্বলে উঠেছে! তাই সে বললো,
– তিনশোর সাথে ষাট আছে। এতেও না হলে আমার মাথাটা দুভাগ করে মগজটা উঠিয়ে নিয়ে যান! এ-ই আছে আমার কাছে!
মেহেদী ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওয়ারড্রবের কাছে এসে বললো,
– এতো কষ্ট আমার দ্বারা সম্ভব না। মাথা ফাক করে তুমিই উঠিয়ে দাও মগজটা।
– আপনি কি অফিস যাননি?
মেহেদী পড়নের শার্ট খাটে ফেলে বললো,
– তোমার শ্বশুর মশাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। মানুষ একদিনে যা করে আমি তিন-চার দিনে তা করে এসেছি। অহ না, মানুষ তিন চার দিনে যা করে আমি একদিনে তা করে এসেছি।
মেহেদীর কথা শুনে নাহিদা মুচকি হেসে মাথা থেকে ব্লেজার সরিয়ে খাবারের প্যাকেট রাখতে রাখতে বললো,
– প্রথমটাই তো বিশ্বাস করার মতো ছিলো।
– হ্যাঁ, থাকবেই তো! উল্টো দুনিয়ার উল্টো নীতি আর সেই দুনিয়ায় বসবাসরত মানুষগুলোর উল্টো ভাবনা!
– বুলি উল্টো হলে ভাবনা তো উল্টো হবেই।
মেহেদী বাথরুমে চলে গেলো। নাহিদা শার্ট নিয়ে রেখে দিতে গিয়েও রাখলো না, ঘামের গন্ধ লেগে আছে কিছুটা। ধুয়ে দেওয়া উচিত। তাই শার্ট রেখে ব্লেজার তুলে রাখলো। মেহেরুন রুমে এসে বললো,
– মেহেদী কোথায়?
নাহিদা জবাব দেওয়ার আগেই মেহেদী বেরিয়ে এলো। মেহেরুন বললো,
– হাতমুখ ধুয়েছিস? চল ভাত খাবি।
– খাবো না ভাত। উপার্জন করে খেতে বলেছো না, উপার্জন করেই তারপর খাবো।
– না খেয়ে উপার্জন করবি কিভাবে! উপার্জন করতেও তো শক্তির প্রয়োজন আছে।
– খাচ্ছি তো। বাইরে থেকে কিনে খাচ্ছি না!
– বাইরের খাবার আর ঘরের খাবার কি এক!
মেহেদী কিছু বললো না। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে মাথা আঁচড়ে নিলো। মেহেরুন কাছে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
– জেদ করিস না বাবা। আয়নায় দেখ, মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।
– আমার দেখতে হবে না। তুমিই দেখো বেশি করে।
– তোর আব্বু তো রেগে গিয়ে বলেছিলো। এখন তো আর রেগে নেই। সেই জেদ নিয়ে বসে থাকলে কি চলবে! নাহিদাও খায়নি তোর কথায়। চল, খেয়ে নিবি।
– আর কখনো খাবো না ওই স্যারের উপার্জন! নিজে নিজেই চলতে পারি, দেখো শুধু তোমরা। ক্ষমতা আমারও আছে। কারো উপর নির্ভর করে নেই আমি। হুহ!
মেহেদীর চাপায় নাহিদার হাসি পাচ্ছে খুব! মেহেরুন ইসলাম চলে গেলো জহিরুল ইসলামকে পাঠানোর জন্য যাতে এই ঘাড় ত্যাড়া ছেলেকে ডেকে নিয়ে যায় খাওয়ার জন্য। মেহেরুন যেতেই নাহিদা বললো,
– আপনি কি সত্যিই কখনো খাবেন না স্যারের উপার্জন!
– বিশ্বাস হচ্ছে না?
নাহিদা মাথা নেড়ে “না” বললো।
– আজ নিজের পকেট খরচ করে রিকশা করে অফিস গিয়েছি আবার এসেছি। এবার বিশ্বাস হয়েছে?
– অহ,তাই?
– জ্বি।
– তা আপনার পকেটে রিকশার ভাড়া আসলো কোথা থেকে?
– এতো তারাতাড়ি ভুলে যাও তুমি! বউয়ের পার্স থেকে নিয়েছি।
– একটা কথা বলবো?
– ঢং পেয়েছো! এতো কথা বলে এখন পারমিশন নিতে আসছো!
– না মানে এটা ভিন্ন কথা।
– কি কথা?
– আপনার বউয়ের পার্সের টাকাটা না, আপনার স্যারই দিয়েছিলো।
– কিহ!
– জ্বি, আমি তো আর চাকরি করি না। তাহলে আমার টাকা আসবে কোথা থেকে! বাবা এটা দিয়েছিলো কক্সবাজার যাওয়ার সময়।
– হোক, তাতে কি! দেওয়ার পর তো তোমারই ছিলো। তাই না! তাছাড়া আমি কিন্তু তোমার কাছ থেকে পাচ হাজার নেইনি। আড়াই হাজার নিয়েছি।
– মানে! আপনি আমার সামনে গুনে গুনে পাচ হাজার নিয়ে এখন বলছেন আড়াই হাজার নিয়েছেন!
– সকালে তোমার জন্য পরটা কিনে দিয়ে গেলাম, এখন মোরগ পোলাও নিয়ে এলাম। এগুলো কি আকাশ থেকে পড়েছে? এগুলো কিনতেও খরচ হয়েছে আমার। সুতরাং এর দায় অর্ধেক তোমার আর অর্ধেক আমার। আর তাই আমি আড়াই হাজার নিয়েছি। মাস শেষে বেতন পেয়ে পরিশোধ করে দিবো তোমার এই আড়াই হাজার টাকা।
– হুহ! অর্ধপাক্কা হিসাবী! লাগবে না আমার এই টাকা। যেখানে আপনার ত্রিশ হাজার লেগে যায় সাতদিনে সেখানে এই স্বল্প টাকায় আপনি মাস পার করবেন কিভাবে সেটা ভাবুন।
এমনি হাক পড়লো জহিরুল ইসলামের। রুমের দিকে আসতে আসতে মেহেদী ও নাহিদার নাম ধরে ডাকলো কিন্তু মেহেদী সাড়া দিলো না। নাহিদা মাথায় ওড়না দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– বাবা, কোন প্রয়োজন?
– হ্যাঁ, ভাত খাওনি কেন। খেতে যাও।
– বাবা, পরটা খেয়েছি তো দুপুরে।
– ঘরের খাবার বাদ দিয়ে বাইরের খাবার কেন খাবে। ভাত খাও গিয়ে।
মেহেদী জবাব দিলো,
– কেন খাবে স্যার! আমার উপার্জন নেই তো! যখন উপার্জন হবে তখন খাবে।
– কথাটাও তখনই বলো। এখন খেতে যাও।
– খাবো না আমি। মেহেদী যা বলে তা বলেই! কারো উপর আর নির্ভর হচ্ছি না! কাজ করতে জানি আমিও!
– একদিন কাজ করেই নিজের উপর নির্ভরতা এসে গেছে! কালই দেখবো আবার ফুড়ুৎ!
– মনীষীদের কথা, “অন্যের কথায় কান দিতে নেই বাপু! নিজের মনমতো চলো! পাছে থেকে থেকে বেকার লোকে কিছু না কিছু বলবেই!” তা এখন একদম হাড়ে হাড়ে প্রমাণ পাচ্ছি আমি।
– ওরে বাবা! কবি মনীষীদের আবার কবে থেকে স্মরণ করতে শুরু করেছো! তাছাড়া কোন মনীষী বলেছে এটা?
– তারা এটাও বলেছে মানুষ বেকার থেকে থেকে অন্যের কথায় প্যাঁচ ধরবেই! যা এখন কেউ ধরে যাচ্ছে আমার কথায়!
কথাটা বলে মেহেদী মাথায় টুপি দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাবার সামনে দিয়েই! জহিরুল ইসলাম নাহিদাকে খেতে যাওয়ার জন্য বললো। নাহিদা বললো পরে খাবে। মাগরিবের আজান পড়ছে। নাহিদা শার্ট ধুয়ে দিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। কিচেনে এসে দেখলো মেহেরুন রুটি তৈরির ব্যবস্থা করছে। সে হাত লাগাতে চাইলো। মেহেরুন তাকে নিষেধ করে নিজ হাতে ভাত বেড়ে প্লেট হাতে ধরিয়ে বললো,
– খেয়ে নে। ওই পাগলের কথা শুনিস না। মরবি ওর কথা শুনলে। তোকে পরটা দিয়ে গেলেও সে কিন্তু ঠিকই পেট ভরে নিয়েছে রেস্টুরেন্টে। নে ধর। সে আসার আগে আগে খেয়ে নে।
নাহিদা আর উপেক্ষা করতে পারলো না মেহেরুনকে! সে খেয়ে নিলো কিচেনে বসেই। যত তারাতাড়ি সম্ভব খাওয়া শেষ করে চুলায় আগুন ধরালো। মেহেরুন রুটি বেলছে আর সে তায়ে রুটি ছেকে নিচ্ছে। মেহেদী সিটি বাজাতে বাজাতে কিচেনে এসেছে। “রুটি বানাচ্ছো! ভাজি করোনি?” বলতে বলতে একটা রুটি পেচিয়ে নিয়ে এক কামড় বসিয়ে দিলো। নাহিদা তার দিকে তাকাতেই মেহেদীর মুখ নড়াচড়া থেমে গেলো! সে ভুলেই গিয়েছিলো সে যে রেগে আছে! মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখে চাপা হাসি! নাহিদার দিকে আবার তাকিয়ে দেখলো তার মুখেও চাপা হাসি! সে রুটি আবার প্লেটে রেখে দিতে গেলে মেহেরুন তার হাত ধরে বললো,
– খা।
– উহুম। খাবো না। নাহিদা, তুমিও খাবে না।
মেহেদী সেটা প্লেটে রেখে মুখের টুকু চিবাতে চিবাতে বেরিয়ে গেলো। মেহেরুনের মুখটা মলিন হয়ে গেলো! নাহিদার খুব রাগ হচ্ছে তার উপর! এভাবে মাকে উপেক্ষা করে গেলো কেন! এক কামড় তো খেয়েই গেছে বেয়াদবটা! পুরোটা খেয়ে নিলে কি হতো! ঢং!
মেহেদী ইশার নামাজ পড়ে এসে দেখলো নাহিদা নামাজ পড়ছে। নাহিদার নামাজ শেষ হতেই সে খাবারের প্যাকেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। নাহিদাকেও বসতে বললো কিন্তু নাহিদা বললো খাবে না। তাই মেহেদীর উক্তি,
– খেয়েছো বুঝি তুমি!
এখন যদি বলে খেয়েছে তাহলে সে নিশ্চিত রুম থেকে বের করে দিবে! তাই মিথ্যে বললো, সে খায়নি! আর পড়ে গেলো মহা বিপদে! মেহেদী তাকে খেতে বাধ্য করলো মোরগ পোলাও! একটু আগে ভাত খেয়ে এখন আবার মোরগ পোলাও! পেটের ভেতর মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় বইছে! খুব অসস্তি লাগছে নাহিদার! রুমের ভেতর পায়চারি করছে অসস্তি কমানোর জন্য! শুয়ে পড়তে যাবে এমন সময় একশন! সে এক দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলো! অসস্তি এবার বদহজম হয়ে বেরিয়ে এসেছে! বমি করে নাহিদা বেরিয়ে আসতেই মেহেদী বিস্ময়ের সাথে বললো,
– কি হয়েছে তোমার?
– মনে হয়..
– কি?
নাহিদা দৌড়ে আবার বাথরুমে চলে গেলো। আবারও বমি করছে সে! মেহেদী দরজা খুলে জোর গলায় ডাকলো,
– আম্মু????
মিনিটের মধ্যেই মেহেরুন দৌড়ে এলো।
– কি হয়েছে?
– দেখো, নাহিদা যেন কেমন করছে!
মেহেরুন ভয় পেয়ে গেছে! সে দ্রুত বাথরুমে এলো নাহিদার কাছে। জহিরুল ইসলামও ছুটে এসেছে রুমের দিকে। নাহিদার চোখেমুখে পানি ছিটকে, মাথায় পানি দিয়ে মেহেরুন তাকে ধরে এনে বিছানায় বসিয়ে বললো,
– ঠিক আছিস তুই?
– হ্যাঁ, মা।
– পেট ব্যাথা করছে?
– একটু একটু।
মেহেদী বললো,
– কেন, কি হয়েছে আম্মু?
– রাখ আরও না খায়িয়ে! সারাদিন খেয়েছে কিছু! নিজে তো খায়ই না মেয়েটাকেও খেতে দিলো না! উপার্জন করবে বেতন পাবে তারপর ভাত খাওয়াবে! আসছে আমার উপার্জন ওয়ালা!
জহিরুল ইসলাম বললো,
– ডাক্তারকে কল করবো?
মেহেরুন ইসলাম বললো,
– না, গ্যাস্ট্রিকের একটা ক্যাপসুল খায়িয়ে দিলেই হবে।
মেহেদী ছোটখাটো এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
– অহ, গ্যাস্ট্রিক! আমি ভাবলাম বাবু হবে!
এমন একটা পজিশনে তার মুখে এমন কথা শুনে সবাই হা হয়ে গেছে! জহিরুল ইসলাম আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো! মেহেরুনের খুব হাসি পেলো আর নাহিদার ইচ্ছে করছে মেহেদীর মাথা ফাটিয়ে দিতে! কিভাবে বাবামায়ের সামনে এভাবে তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো! বিয়ের দু সপ্তাহ না যেতেই বাবু!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৫
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেরুন বুঝতে পেরেছে লজ্জা নামক শব্দটা তার ছেলের গায়ে চামড়া পর্যন্ত স্পর্শ না করতে পারলেও নাহিদা লজ্জায় পড়ে গেছে। তাই তিনি হাসি পাওয়া সত্ত্বেও মেহেদীকে ধমকের সুরে বললো,
– আবার কথা বলছিস তুই! আমার ড্রয়ারে গিয়ে দেখ গ্যাস্ট্রিকের ক্যাপসুল আছে। নিয়ে আয়।
মেহেদী গ্যাস্ট্রিকের ক্যাপসুল এনে দিলে নাহিদা খেয়ে নিলো। মেহেরুন দু মুঠো পরিমাণে ভাত এনে নাহিদাকে খেতে দিলো। একটুও ইচ্ছে করছে না খেতে, তবুও জোরপূর্বক খেতে বললো মেহেরুন। অত:পর মেহেদীকে বললো,
– তুই কিছু খেয়েছিস?
– হুম। মোরগ পোলাও।
– যা তা খেয়েই থাক সারাদিন। কিছু বলবো না! অসুস্থ হলে আবার আম্মুকে ডাকবি! আম্মু এসে উঁকিও দিবো না! নাহিদা কাল থেকে, এক বেলাও খাবার মিস করবি না। তোর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে আমি ঘরে তুলে এনেছি তোকে। সুতরাং আমি যা বলবো তা-ই! এই পাগলের কথায় কান দিয়ে মরিস না!
নাহিদা কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে সে। মেহেদী বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। খাওয়া শেষ হতেই নাহিদা প্লেট হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নামলে মেহেরুন তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে চলে গেলো। আর নাহিদাকে বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে ঘুমিয়ে থাকতে বললো। মেহেদী এসে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা হাত ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লে বিপরীত দিকে ফিরেই মেহেদী বললো,
– আজ ঘুমাও, কিছু বললাম না। কাল থেকে সব আসবাব নিয়ে রুম ছাড়বে। কাউকে আমার কথা শুনতেও হবে না, আমি কাউকে নিয়ে আসিনি, কারো ভারও বহন করতে পারবো না! সুতরাং কারো সাথে রুম শেয়ারও করতে পারবো না!
নাহিদা মনে মনে বললো, “হুহ্! উল্টাইছে ভার বহন করে! বউয়ের পার্স খালি করে ফুটান্টি করে সেই খেয়াল কি আছে! একদিন অফিসে গিয়েই যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলছে! সারাদিন এটা নিয়েই গর্ব করে যাচ্ছে! আযব মানুষ!” মনে মনে তিরস্কার করে ভাবতে লাগলো রুম থেকে না যাওয়ার জন্য এবং তার বাকা ঘাড় সোজা করার জন্য কি করা যায়!
নাহিদা বালিশটা টেনে মেহেদীর বালিশের সাথে লাগিয়ে আরও চেপে গেলো। মেহেদী ফোন টিপছে আর নাহিদা তার পিঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
– এসেছি তো আপনার হাত ধরেই।
– এই! আমি তোমার হাত ধরলাম কখন!
– ওইযে, বিয়ে পড়ানোর পর বাবা কন্যা দান করলো! তখন!
– ওইতো, আম্মুর ইচ্ছাতেই হয়েছে! আমার কথা শুনবে না ব্যাস!
– যাইহোক, আপনি বিয়ে করেছেন বলেই তো আমি এসেছি। এমনিতে কি আসতাম নাকি! একটা প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়।
– তোমার প্ল্যান তোমার কাছেই রাখো। ছাড়ো আমাকে!
নাহিদা তার টিশার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,
– উহু, শুনতে হবে। প্ল্যান টা হলো এই,
– কিছু শুনবো না!
– আরে! শুনুন চুপ করে। আপনি এই টাকাতে কতদিন মোরগ পোলাও খাবেন! তারচেয়ে বলি কি, বাসায় হোটেল ন্যায় বাকিতে খাওয়া যাক। মাস শেষে বেতন পেয়ে বিল পরিশোধ করে দিবেন। এতে তো আপনার এই টাকাগুলো বেচে যাবে। এখন আর না খেয়ে থাকতে হবে না। কাউকে অসুস্থও হতে হবে না।
মেহেদী শুধু ঘাড়টা ঘুড়িয়ে নাহিদার দিকে তাকাতে চাইলো। তা দেখে নাহিদা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– দারুন না, আইডিয়া টা?
সেকেন্ডের মধ্যে মেহেদী এপাশ ফিরে নাহিদার চুল ফাক করে, মাথা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। নাহিদা বিরক্তি নিয়ে বললো,
– আরে! কি করছেন!
– দেখছি ছিদ্র কোন দিকে!
– মানে!
– মানে, তোমার মাথায় আইডিয়াটা কোন দিক দিয়ে প্রবেশ করলো সেটাই দেখতে চাইছি!
– কি আশ্চর্য ধরনের কথাবার্তা! আইডিয়া মাথা ছিদ্র হয়ে প্রবেশ করে নাকি মগজ থেকে উৎপত্তি হয়!
মেহেদী হেসে এক হাতে নাহিদার দুই গাল চেপে ধরে বললো,
– মাথা নারিকেলের খোল না তাহলে! ভেতরে পূর্ণতা আছে একটু!
মেহেদীর পাগলের আচরণ দেখে নাহিদার মুখ গোমড়া মুখু হয়ে রইলো। মেহেদী তার মুখ ছেড়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
– রুম ত্যাগ না করার জন্য মগজ খেটেছে তাই না?
ধরা পড়ে নাহিদার মুখে চাপানো হাসির রেখা ফুটে উঠলো! হাসি চাপানো রেখেই দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
– যাবো কেন আমি রুম থেকে! স্ত্রীর অধিকার নিয়ে পদার্পণ করেছি আমি এখানে।
– আচ্ছা! তাহলে তো তুমি আমার কোলবালিশ।
– মানে!
– ফেসবুক দুনিয়ায় অগণিত স্ট্যাটাস, বিয়ের পর স্ত্রী নাকি কোলবালিশ হয়ে যায়! তাহলে তুমি আমার কোলবালিশ!
নাহিদা বিস্মিত ও পুলকিত মেহেদীর কথনে! সে নিশ্চিত এটা কোনো পাগল! তা না হলে তখন বাবা-মায়ের সামনে এমন সময় বাবুর কথা কিভাবে বললো! আর এখনই বা স্ত্রীকে কোল বালিশ কি করে বলে! নাহিদা মনে মনে “ছি! ছি!” মনোভাব ও চক্ষু লজ্জা নিয়ে চুপচাপ বালিশ বিপরীত দিকে টেনে বিপরীত মুখী হয়ে গেলো! কিন্তু মেহেদী তা হতে দিলো না! নাহিদার বালিশ টেনে আবার তার বালিশের সাথে লাগিয়ে দিলো। নাহিদাকেও টেনে তার কাছাকাছি এনে হাত পা সব তুলে দিয়ে বললো,
– এতোক্ষণ না অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলছিলে! এখন পালাচ্ছো কেন! আমার কোলবালিশ হওয়ার ভয়ে!
– আমি! কই, বড় কথা বলিনি তো! আমি ছোট মানুষ, ছোট ছোট কথা বলি।
– ও, তাই! তাহলে ছোট মানুষের মতো চুপটি করে শুয়ে থাকো! কোনো নড়াচড়া নেই! না, তোমার সাথে বিশ্বাস নেই! ওদিকে ঘুরো।
– কেন?
– ঘুরতে বলেছি, ঘুরো।
– পা সড়ান।
মেহেদী পা সড়িয়ে নিলে আবার নাহিদা বিপরীতে ফিরে গেলো। মেহেদী পেছন থেকেই কোলবালিশ ন্যায় জড়িয়ে ধরে মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে রেখে বললো,
– এই তোমার মাথায় উকুন আছে?
তার কর্মে ও কথোপকথনে নাহিদার রাগও হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে! সে বললো,
– হ্যাঁ, ইয়া বড় বড় এক উকুন আছে আমার মাথায়।
– ফাজলামো না, সিরিয়াস বলো। আমি দেখলাম সেদিন আম্মু তোমার মাথায় বিলি কাটছে!
– মা, তেল লাগিয়েছে। উকুন নেই।
– যাক, না থাকলেই ভালো। বমি টমি করলে ওদিকেই করো ভাই, আমার দিকে ঘুরো না।
– কি? আমি আপনার কি হই?
– বউ।
– তাহলে ভাই বললেন কাকে!
– আরে মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। তাই একটা বললেই হলো।
নাহিদা নিচু শব্দে হিহি করে হেসে উঠলো! আর মেহেদী কম্বল টেনে দুজনেরই মাথাসহ ঢেকে দিলো৷ নাহিদা মাথা ঢেকে ঘুমাতে পারে না তাই তার দিকটা একটু খোলা রাখলো।
জহিরুল ইসলাম সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। মেহেদী এলো হাতে একটা কাগজ নিয়ে। কাগজটা মেহেদী পত্রিকার উপর দিলো। জহিরুল ইসলাম পত্রিকা রেখে কাগজটা নিয়ে দেখলেন, পড়লেন গঅত:পর হাসলেন এবং মেহেরুনকে ডাকলেন। মেহেরুন এলে তিনি কাগজটা এগিয়ে দিলেন। মেহেরুন ইসলাম জানতে চাইলেন,
– এটা কি?
– পড়ে দেখো।
অত:পর তিনি দেখলেন আবেদন পত্র! মেহেদী পিতার কাছে আবেদন পত্র লিখেছে মাসব্যাপী সে ও তার বউ বাকিতে খাবে এবং মাস শেষে খাবার বাবদ পাচ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করবে৷ এতে কিন্তু এই প্রমাণ হয়না যে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল। বরং এটা প্রমাণ হয় সে স্বনির্ভর!
মেহেদীর লেখা পত্র পড়ে মেহেরুনেরও হাসি পেল! তাদের হাসতে দেখে মেহেদী বিরক্তি নিয়ে বললো,
– এতে হাসার কি আছে! সুমর্জি হলে সিগনেচার করো আর না হলে রিটার্ন করো!
– আবেদন করে আবার থ্রেড!
– এতো কিছু জানিনা আমি! কাজে আসছি, না হলে অন্য ব্যবস্থা করবো। তুমি কি করবে করো।
– কলম এনেছো?
মেহেদী পকেট খুঁজে বললো,
– নিয়ে আসছি।
জহিরুল ইসলাম পকেট থেকে কলম বের করতে করতে বললো,
– থাক। তার আর প্রয়োজন নেই। তোমার পকেটে কলম থাকবে নাকি! থাকবে শুধু হাত টান! নাও।
জহিরুল ইসলাম সিগনেচার করে দিলে মেহেদী তা নিয়ে রুমে চলে গেলো। রুম থেকে জোর গলায় নাহিদাকে ডাকলো। নাহিদা রুমে এলে বললো খাবার রুমে নিয়ে আসতে। নাহিদা রান্না শেষ করে খাবার রুমে নিয়ে এলো। মেহেদী এতোক্ষণে গোসল সেড়ে নিয়েছে। অন্যদিন মেহেদীকে দেখলেও আজ কেন জানি তাকে খালি গায়ে দেখে খুব লজ্জা লাগছে নাহিদার! মেহেদীর দৃষ্টিতেও তার লজ্জাময়ী দৃষ্টি আটকে গেছে। কেননা নাহিদা রুমে প্রবেশ করার পরপরই একে অপরে চোখাচোখি হয়ে গেছে! আর তখন থেকেই নাহিদার ভেতরটা লজ্জায় কাপছে! কি এমন ছিলো চোখাচোখিতে তার অজানা! সে চুপচাপ খাবারের বাটিগুলো গুছিয়ে রেখে দ্রুত চলে গেলো। খাওয়া শেষে মেহেদী আবার ডাকলো। নাহিদা খাবারের বাটিপ্লেট নিয়ে গেলো। প্লেট নিয়ে যাওয়ার সময় মেহেদী বলে দিলো রুমে এসে যেন তার শার্ট বের করে দেয়। তাই নাহিদা শার্ট বের করে খাটে রাখতেই মেহেদী বললো,
– শার্ট কি খাট পড়বে?
– না, আপনি।
– প্রতিদিন বলে দিতে হবে, পড়িয়ে দাও!
– প্রতিদিনই পড়িয়ে দিতে হবে! দু-একদিন নিজে পড়লে কি হয়!
– আচ্ছা! প্রতিদিনই অফিস যেতে হবে! দুএকদিন না গেলে কি হয়! আজ যাবো না। ওকে?
– এই, না না! আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।
নাহিদা দ্রুত শার্ট নিয়ে মেহেদীর কাছে এলো। মেহেদী তার হাতে শার্ট পড়তে পড়তে বললো,
– এই বয়সেই নানা হয়ে গেলাম! আমার চুল কি পেকে গেছে নাকি!
নাহিদার হাসি পাচ্ছে খুব কিন্তু এতোটা হাসছে না। মৃদু হেসেই বললো,
– জানি না আমি!
এতোটুকু সময়ে নাহিদা একবারও তাকায়নি মেহেদীর দিকে! শার্টের বোতাম লাগানো শেষ হতেই আলমারির দিকে যেতে যেতে বললো,
– ঠান্ডা লাগছে না? ব্লেজার দিবো?
মেহেদী অভিনয় ভঙ্গিতে বললো,
– হু হু হু! শীতে কাপাকাপি শুরু করেছি দেখো না তুমি!
নাহিদা ব্লেজার বের করে এনে তাকে পড়িয়ে দিলো। মেহেদী বাদ্য পিচ্চির ন্যায় এক জায়গায়ই দাড়িয়ে আছে! যেন তার এদিক সেদিক নড়াচড়া মানা! তাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিদা বেশ বুঝতে পারছে তাকে দিয়ে সব করিয়ে নেওয়ার জন্য এভাবে আছে সে। সে একে একে ফোন ওয়ালেট ঘড়ি এনে তার হাতে দিতে লাগলো। খারাপ লাগছে না তার কাজ করতে কিন্তু মেহেদীর দিকে তাকাতে পারছে না সে! ঘড়ি পড়িয়ে দিয়েছে তবুও মেহেদী এভাবেই দাড়িয়ে আছে। তাই নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– জুতা তো মেইন ডোরের সামনে। তাহলে আর কি বাকি?
– বউয়ের দায়িত্ব সব শেষ?
– হ্যাঁ।
– সেই কখন থেকে দেখছি, মুরগির মতো মাথা এমন নিচু করে রাখছো কেন!
নাহিদা এবার মাথা তুলে বললো,
– কিহ!
– হায় আল্লাহ! এ কোন কানে কালা বউ বিয়ে করলাম! এক কথা দুই-তিন বার বলতে হয়!
নাহিদা ব্রু কুচকে বললো,
– আমি কানে কালা!
– তাহলে কথায় কথায় “কিহ, কিহ” বলো কেন! দু তিনবার এক কথা বলতে আমার কষ্ট হয় না!
– তাহলে, আপনি আমাকে মুরগি বললেন কেন!
– মাথা নিচু করে ছিলে বলে।
– আমি…
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী হঠাৎ করেই নাহিদার গালে চুমু দিলো! ফলস্রুতিতে নাহিদা স্তব্ধ! কিছু বলতে গিয়েও এরপর আর বলতে পারলো না! শুধু গালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে! ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি ঝুলিয়ে মেহেদী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– এটাও তো মেবি, রুলসের মধ্যেই পড়ে! রেগুলার চলবে! রুলস অনুযায়ী “আপনি” উচ্চারণটাও বাদ পড়বে! অফিস জয়েন এর ফার্স্ট ডে’র রুলসটা ভালো ছিলো। আল্লাহ হাফেজ।

চলবে