তৃ-তনয়া পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
760

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৫
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘুম ভাঙলে আরাফকে পাশে পায়নি নাজিয়া। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে! আসরের নামাজ পড়তেও ডাকলো না তাকে! এতো পাজি লোকটা, অসময়ে কি সুন্দর ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেছে সে! হাই তুলতে তুলতে নাজিয়া কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। চুল খোপা করে ঘর থেকে বের হতেই কিচেনে আরাফ ও আশিকের হাসাহাসি শুনতে পেলো। তারা কিচেনে কি করছে! নাজিয়া সেদিকে না গিয়ে ফরজ নামাজটা আদায় করার জন্য বাথরুমে চলে গেলো। ওযু করে নামাজ আদায় করে কিচেনে যাওয়ার সময় দেখলো আয়েশা বেগম কিচেন থেকে বেরিয়ে আসছে। নাজিয়াকে দেখে নিজ ঘরের দিকে হনহনিয়ে যেতে যেতে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “আরও কত কিছু না জানি দেখতে হয়! মাইয়া মানুষ নাকে তেল দিয়া ঘুমাইবো আর ছেলেরা আইসা রান্নাঘর সামলাইবো! এমন সুখই পাইলাম না জীবনে!”
শুনতে খারাপ লাগলেও সেটা মনে ধরলো না, নাজিয়া। সে চুপচাপ কিচেনে অগ্রসর হলো। দেখলো আরাফ আশিক দুইভাই মিলে রান্না করছে! একএকজনের নাজেহাল অবস্থা আর হাসিঠাট্টা! বিস্মিত হয়ে নাজিয়া বললো,
– এসব কি অবস্থা!
আরাফ বললো,
– এতো তারাতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে।
– তারাতাড়ি ঘুম ভেঙেছে! নামাজটাও তো ঠিকমতো পড়তে পারলাম না। ডাকলে কি হতো!
– ইচ্ছে করছিলো না ঘুমটা ভাঙাতে।
আশিক জবাব দিলো,
– ভাবি, দেখো একটু আমার অবস্থা কি করেছে ভাইয়া। তোমার ঘুম ভাঙতে পারেনি বলে আমার মাথায় ডিম ভেঙেছে। ডিম ভেঙে নাকি পরীক্ষা করে আমার মাথা শক্ত কি-না! ছি! কি বাজে গন্ধ! ওয়াক!
আশিককে থামিয়ে আরাফ বললো,
– নাজিয়া, আশিকের আগে আমার অবস্থাটাও দেখো একবার! ভাজি করার জন্য মাত্র তিনটা ডিম তার মাথায় ঠুসে ভেঙেছি বলে আমাকে আটা দিয়ে গোসল করিয়েছে! এখনো আমার যৌবন পাড় হয়নি বলে দেখতে এসেছে চুল পেকে বুড়ো হলে কেমন দেখাবে আমাকে!
– বাচ্চাদের চেয়েও খারাপ তোমরা। বের হও এখান থেকে। অনেক হয়েছে রান্না। বের হও।
– উহুম, আমাদের আনন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করো না। রান্না প্রায় শেষের দিকে। আমরা যখন বেশি খুশি হই, তখন দুই ভাই মিলে রান্না করি। লাস্ট রান্না করেছিলাম আশিকের রেজাল্টের পর, যখন সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলো৷ এরপর আজ আবারও সুযোগ এলো। আজ তোমার ছুটি।
আশিক বললো,
– ভাবি, আমাদের রান্না খেয়ে দেখবেন। একবার খেলে বারবার খেতে মন চাইবে। আয়াত জানতে পারলে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসবে।
– আচ্ছা! তাহলে তো আরও মুশকিল! এখন থেকে প্রতিদিনই তোমাদেরকে রান্না করতে হবে!
– তা আর হবে নাকি! মাসে একবার হলে খাওয়ানো যায়। তা না হলে তো আবার তোমার হাতের রান্নার স্বাদ ভুলে যেতে হবে।
– দেখি, কি কি রান্না করেছো।
নাজিয়া ঢাকনা খুলে একে একে সব দেখে তারপর বেরিয়ে গেলো বাইরে থেকে কাপড়চোপড় নেওয়ার জন্য। মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। দুইভাই রান্না শেষ করে আবার গোসল সেড়ে নামাজ পড়তে মসজিদে গেলো। নামাজ আদায় করে নাজিয়া তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বললো। আরাফের পর সে মাকে জানালো তার প্রেগন্যান্সির কথা। নাফিসা শুনে তো বাবুদের নাম রাখতেও শুরু করে দিয়েছে! তবে নাজিয়া সাবধান করে দিয়েছে, মেয়ে বাবুর নাম নিয়ে না ভাবতে। কারণ, মেয়ে বাবুর নামটা যে আরাফ রেডি করে রেখেছে! তবুও নাফিসা ভাববে। কেননা আরাফ যেটা রেখেছে সেটা ডাক নাম থাকবে আর একাধিক নাম রাখবে নাফিসা। সেই অধিকারও আরাফের সাথে কথা বলে আদায় করে নিয়েছে নাফিসা। এই প্রথম আরাফের হাতের রান্না খেলো নাজিয়া। মজা লেগেছে বেশ। বলা যায় তারা দুই ভাই পাক্কা রাধুনি! কিন্তু সেটা খাবার না খেলে বুঝা যাবে না। কেননা, প্রথমে কিচেনে গিয়ে এক একজনের যেই অবস্থা দেখেছিলো! মনে তো হয়েছিলো রান্নার র’ও জানে না! বারোটা বুঝি বাজিয়ে ছেড়েছে তারা! কিন্তু ফলস্বরূপ ভিন্ন স্বাদ পেয়েছে।
.
মেহতাজের বাড়ি যাবে নাহিদাকে নিয়ে। তাই আজ তারাতাড়িই বাড়ি ফিরেছে মেহেদী। নাহিদাকে বলে গিয়েছিলো রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু নাহিদা এখনো রেডি হয়নি! মাত্র গোসল সেড়ে এসেছে! মেহেদী বললো,
– এখনো রেডি হওনি! কি করছিলে এতোক্ষণ!
– মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছিলো, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি দুপুর হয়ে গেছে!
– মাথা রিমঝিম করে কেন! মাথার ভেতর তেলাপোকা নৃত্য করে নাকি!
– তোমার মতো তো, আমি তেলাপোকা পুষি না যে মাথায় গিয়ে নৃত্য করার সাহস পাবে!
মেহেদী হাহাহা করে হেসে উঠে বললো,
– দ্রুত রেডি হও।
– নামাজটা পড়ে নেই। রেডি হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। বোরকা আর হিজাব পড়বো।
– শাড়ি আর হিজাব পড়ো।
মেহেদী বাথরুমে চলে গেলো। পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়ায় নাহিদা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দুজনেই রেডি হয়ে মেহেরুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রিকশা ভাড়া করলো রেস্টুরেন্টের ঠিকানায়! নাহিদা তার সাথে রিকশায় উঠে বললো,
– আমরা কি আপুর বাসায় যাচ্ছি না?
– না, আপুর শ্বশুরের বাসায় যাচ্ছি।
– একই তো হলো না! তো রেস্টুরেন্টের কথা বলে রিকশা নিলে কেন!
– একচুয়ালি, আমি আপুকে বলেছি রাতে আসবো। তার মানে আপু রাতের জন্য রান্না করবে। এখন যদি আপুর বাসায় যাই, তাহলে তো আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে! আপুও খাবার না দিতে পেরে লজ্জায় পড়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে তারপর যাই। কি বলো!
– ছি! কি আজব চিন্তাভাবনা! এমনটা হলে বাসা থেকে খেয়ে এলে না কেন!
– রেস্টুরেন্ট খাবো বলে।
– রাতের কথা বলেছো যেহেতু, অফিস টাইম শেষে এলে কি হতো!
– একটু ছুটি পেতাম না!
– ফাকিবাজ হয়ে যাচ্ছো আবার!
– তোমার মুখে লিপস্টিকের বদলে সুপারগ্লোভ লাগানোর প্রয়োজন ছিলো! রেস্টুরেন্টে ডেটে যাচ্ছি, ভালো লাগছে না! একের পর এক শুধু উল্টাপাল্টা প্রশ্ন!
মেহতাজের বাড়ির সামনে রিকশা থামালে নাহিদা নেমে যেতে নিলো। মেহেদী তার হাত ধরে বললো,
– এই, কোথায় যাও!
– আপুর বাড়ির সামনেই তো রিকশা থামালে! নামবো না!
– রেস্টুরেন্ট এসেছি? চুপচাপ বসো।
মেহেদী গলা বাড়িয়ে দাড়োয়ানকে ডেকে তাদের কাপড়ের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বললো আসিফ ভাইয়ার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিতে। নাহিদার মাথায় গোলমাল লাগছে! কি চাইছে মেহেদী, বুঝতে পারছে না। কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না মেহেদীর নিষেধে। মেহেদী একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ব্যাগটা ঝামেলা করছিলো তাই ঝামেলা কমিয়ে দিলাম। ভালো হয়েছে না?
রিকশায় এভাবে জড়িয়ে ধরে বসায় নাহিদার লজ্জা ও অসস্তি লাগছে খুব! তবুও কিছু বললো না, কেননা মেহেদীকে উপেক্ষা করতে পারবে না সে। তাকে উপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছেও নেই তার মাঝে! রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নেমেছে এমনি মেহেদীর ফোন বেজে উঠলো। ভাড়া প্রদান করে কল ব্যাক করতেই মেহতাজের কন্ঠ শুনতে পেলো,
– ওই, তুই কোথায়?
– এইতো, বউকে নিয়ে তোমাদের ঢাকা শহর ঘুরতে এলাম।
– আমাদের ঢাকা শহর! তুই কি নোয়াখালী থাকিস নাকি!
– মনে হয়!
– ব্যাগ পাঠিয়ে তুই চলে গেলি কেন! আমি রান্নাবান্না করে বসে আছি। তোরা এলে একসাথে খাবো!
– এখনো খাওনি! ক্ষুধা তো মনে হয় বেশিই লেগেছে! সুতরাং বেশি বেশি খেয়ে নাও। আমরা সন্ধ্যায় আসছি।
– আমি বেশি বেশি খেয়ে নিবো! তুই আয় বাড়িতে! তোর খবর আছে!
– এমন হুমকি দিলে আসবো নাকি!
– তোর আসতে হবে না। নাহিদাকে দিয়ে যা।
– আমি যাবো না, আমার বউ যাবে! তা কি করে হয়!
– রাগিয়ে দিচ্ছিস কিন্তু!
– আচ্ছা, মাথা গরম করে আবার আয়াশ আরিশাকে মেরো না। আসার সময় আইস্ক্রীম নিয়ে আসবো তোমার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আইস্ক্রীম খাবে আয়াশ আরিশা।
মেহতাজ হেসে উঠেও ধমকে বললো,
– ফোন রাখ, আর তারাতাড়ি ফিরবি।
নাহিদা দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসছিলো তাদের ভাইবোনের কথা শুনে। মেহেদীকে বললো,
– মিথ্যে বললে কেন?
– কখন?
– তুমি না বললে সন্ধ্যার কথা বলেছো!
– আমি তো সন্ধ্যার কথাই বলেছি। আপু বলেছে দুপুরে এসে যেন লাঞ্চ করি। তাতে আমি রাজি হয়েছি নাকি, যে মিথ্যে হয়ে গেছে আমার কথা!
খুব প্যাচাতে পারে কথা! তাই নাহিদার আর কথা বাড়ালো না। দুজন এসে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নিলো। অত:পর টুকটাক কথা বলতে বলতে রমনার দিকে একটু হাটলো। খোলামেলা ও তুলনামূলক শান্ত পরিবেশ। ভালোই লাগছে মেহেদীর সাথে হাটতে। হিমেলের সাথে দেখা হয়েছিলো তাদের। হিমেল দু চার মিনিটের মতো সময় কাটিয়ে চলে গেছে। রমনা থেকে রাস্তায় বের হয়ে দেখা পেলো টনিকের! দুজনের জন্য দুইটা কিনে নিলো মেহেদী। অত:পর আইস্ক্রীম কিনে রিকশা নিলো মেহতাজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মেহেদীর টনিক শেষ হতেই দেখলো নাহিদারটা অর্ধেক বাকি। তাই জিজ্ঞেস করলো,
– ঝাল লাগছে?
– ঝাল খাবার তো ঝাল লাগবেই।
– দাও আর খেতে হবে না। ঝাল খেলে মাথা ব্যাথা করবে আবার।
কথাটা বলার পরপরই নাহিদার হাত থেকে নিয়ে বাকিটা মেহেদী খেতে লাগলো। নাহিদা তার দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে! চোখদুটো ছলছল করছে! এই মেহেদী একদিন বিরিয়ানিকে বলেছিলো তার এটো খাবার! অথচ আজ তার মুখে ছোয়া এটো খাবারই অনায়াসে খেয়ে নিচ্ছে! কোথায় গেল সেই মনোভাব, আর কোথায় গেলো সেই ঘৃণা! কিভাবে পারলো আজ এটো খাবার খেয়ে নিতে! টিস্যু দ্বারা চোখ মুছে নিতে দেখে মেহেদী বললো,
– ধুলাবালি লাগছে?
– উহুম।
– তাহলে?
– এমনি।
– পানি এসে গেছে তবুও বলছো এমনি! একটা সানগ্লাস পড়ে বের হলে না!
কথাটা বলে নিজেরটাই খুলে পড়িয়ে দিলো নাহিদাকে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৬
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরলে মেহতাজের বকাবকি শুনলো কিছুক্ষণ! রাতের জন্য আর রান্না করবে না। ওই খাবারই খাওয়াবে তাদের। সেদিকে মেহেদীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! সে কানে আঙুল দিয়ে চলে গেছে আয়াশ আরিশার কাছে! তার এই বদ অভ্যাসটা আয়াশ আরিশাও ধারণ করে নিয়েছে! একটু বকাঝকা করলেই আয়াশ কানে আঙুল দিয়ে পালায়। আর আরিশা বুঝে আর না বুঝে আয়াশের পিছু পিছু ছুটে! মেহতাজের রাগ হলেও আসিফ তখন হাসে! আর তখন আয়াশের দাদীর উক্তি, “পুরাই মামার মতো হইছে!”
আসিফকে সাথে নিয়ে ইশার নামাজ পড়তে বেরিয়েছে মেহেদী। নামাজের পর বাড়ির বাকিদের খাওয়া হয়ে গেলেও মেহতাজ বসে আছে তাদের জন্য। সাথে নাহিদাও। নাহিদাকে খেয়ে নিতে বলেছিলো কিন্তু সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। মেহতাজ ভাবলো মেহেদীর জন্যই সে-ও খাচ্ছে না। যতই হোক, এ বাড়িতে মেহমান সে। তাই লজ্জা পাচ্ছে বাকিদের সাথে খেতে বসতে। তাই মেহতাজ জোর করলো না। আয়াশের রুমে নাহিদা খেলা করছিলো তাদের নিয়ে। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে মেহতাজ রুমে এসে ফোন নিলো আয়াশের কাছ থেকে। অত:পর কল করতেই কেটে দিলো আর ভিডিও কল এলো মেহেদীর ফোন থেকে! মানুষ দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, টেবিল, আর খাবারসমূহ! সাথে মেহেদীর কন্ঠে ভেসে আসছে,
– তোমরা খেয়ে নাও। আমরা খাওয়া শেষ করে বাড়ি ফিরছি।
– দেখেছিস অবস্থা! তোদের পিটিয়ে ছাল তুলে নেবো আমি! ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ কতটা নির্বোধ হতে পারে! আমরা তাদের জন্য না খেয়ে বসে আছি আর তারা ঘর ছেড়ে রেস্টুরেন্ট বসে গিলছে!
– আরে আপু, রাগ করছো কেন! আচ্ছা, বলো তুমি কি কি খাবে। আসার সময় নিয়ে আসবো। বিল কিন্তু আসিফ ভাইয়াই পে করবে।
– আমার কিছু খেতে হবে না। খেয়ে আয় তোরা বেশি করে। আর এই যে মিস্টার..
– হু, মিসেস?
– আগামী সাতদিনেও ঘরের ভাত জুটবে না কপালে।
– ধুর! কপালে ভাত নিয়ে কি হবে! মুখে দিও, তাহলেই হবে।
আয়াশ চেচিয়ে বললো,
– আব্বু আমার জন্য একটা গ্রিল নিয়ে এসো কিন্তু!
এমন ঝগড়ার মাঝে আয়াশের এমন উক্তি শুনে এদিকে নাহিদা আর ওদিকে মেহেদী ও আসিফ হেসে উঠলো। মেহতাজ প্রথমে আয়াশকে ধমকে বললো,
– ওই, চুপ থাক!
পরে আবার আসিফকে বললো,
– মুখে তোমার ভাত জুটাবো! হাড়িই বসবে না চুলায়। দেখি কিভাবে খাও। ছেলে মেয়ে সহ পুরো পরিবার নিয়ে গিয়ে রেস্টুরেন্ট খাবে এখন থেকে!
– আরে, শুনো তো। আমার কোনো দোষ নেই। মেহেদী টেনে নিয়ে চলে…
মেহতাজ কল কেটে দিলো। সাথে সাথেই আবার কল করলো কিন্তু এবারও মেহতাজ কেটে দিয়েছে! তাদের বকাঝকা করতে করতে নাহিদাকে সাথে নিয়ে খেতে বসে গেলো।
ঘন্টাখানেক পর তারা শালা দুলাভাই বাড়িতে ফিরলো। হাতে করে কিছু এনেছে তারা। দরজা খুললো অথচ হাতের প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিলে ধরলো না মেহতাজ। কারো সাথে কোনো কথাও বললো না সে। নাহিদার কোলে আরিশা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, মেহতাজ আরিশাকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। আসিফ নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলো,
– খেয়েছো নাহিদা?
– জ্বি ভাইয়া।
– তোমার আপু খেয়েছে?
– হ্যাঁ।
– আয়াশ কোথায়?
– আয়াশ তার দাদুর কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে।
– ওহ, আচ্ছা।
আসিফ চলে গেলে নাহিদা মেহেদীর পিছু পিছু আয়াশের রুমে চলে এলো। সিটি বাজাতে বাজাতে মেহেদী ফোন ওয়ালেট রেখে হাতের ঘড়ি খুলছে। নাহিদা বললো,
– কাজটা কি একটুও ঠিক হয়েছে! আপু রান্না করে বসেছিলো, আর তুমি দুপুরেও রেস্টুরেন্ট খেয়ে এলে এখনো আবার যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো! বেড়াতে এসে মানুষ এমন কান্ড করে!
– আরে, নামাজ পড়ে হাটতে হাটতে রেস্টুরেন্টের কাছে গিয়ে ক্ষুধা লেগে গেলো! তাকিয়ে দেখলাম ঝুলন্ত মুরগিটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পেট ও মুরগি কাউকেই কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই খেয়ে এলাম!
– তাই বলে একবার আপুর কথা ভাববে না! কত কষ্ট করে রান্না করলো! আর তোমরা রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া সেড়ে দিলে তো আপুর মনটা খারাপ করে।
মেহেদী নাহিদাকে একটানে সামনে দাড় করিয়ে বললো,
– ওমা! আমার গিন্নিও দেখি রাগ করে বসে আছে!
– আপু কিন্তু সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছে।
– আরে, ওসব নিয়ে ভেবো না। আসিফ ভাইয়া আছে তো।
হঠাৎই মেহেদীর চোখ পড়লো নাহিদার পেছনে থাকা আয়নায়। খোলা চুলের ফাকে লাল ফিতাটা দেখা যাচ্ছে। মেহেদী আয়নায় তাকিয়েই চুলগুলো পিঠ থেকে সরিয়ে সামনে নিয়ে এলো এবং ফিতাটা টেনে গিট খুলে ফেললো! মেহেদী হঠাৎই এমন কিছু করবে সে ভাবতে পারেনি! কখন কোন মুডে চলে যায় বলা মুশকিল! নাহিদা তাকে ঠেলে সরে আসতে চাইলে মেহেদী তাকে আলমারির আয়না ঘেঁষে আটকে ফেললো। নাহিদা চোখ বন্ধ করে আছে! মেহেদী তার কাধে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে বললো,
– চুল ভেজা কেন এখনো?
নাহিদা তার টিশার্ট আকড়ে ধরে জবাব দিলো,
– হিজাবের নিচে ভেজা চুল খোপা করা ছিলো। তাই শুকায়নি এখনো।
আস্তে আস্তে মেহেদীর মাতলামো যেন বেড়ে চলেছে! এটা মদ্যনেশা নয়। সে আরও আগেই নাহিদার প্রেম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে! নাহিদার অসস্তি লাগছে খুব! অন্যের বাড়িতে আছে তারা! রুমের দরজাটাও লক করা হয়নি। চাপিয়ে রাখা হয়েছে শুধু। নাহিদা তাকে সরিয়ে দিতে বললো,
– শাড়িটা চেঞ্জ করবো আমি।
– না করলে সমস্যা কোথায়!
– ঘুমাতে পারবো না শাড়ি পড়ে।
– আমি ঘুম পাড়িয়ে দেবো।
– আমরা আপুর বাসায় আছি।
– তো?
– রুমের দরজাটা খোলা আছে।
মেহেদী তার কাছ থেকে এক হাত পরিমাণ পিছিয়ে চমকে বললো,
– হোয়াট!
নাহিদা চোখে ইশারা করলো দরজার দিকে। মেহেদী তাকিয়ে দেখলো সত্যিই দরজা খোলা!
নাহিদার মুখে লেগে আছে লজ্জাময়ী ও দুষ্টুমি হাসি। মেহেদী দাতে দাত চেপে বললো,
– বোকা মেয়ে! দরজা লাগিয়ে রুমে প্রবেশ করবে না! এখন যদি কেউ চলে আসতো!
– এজন্যই তো বলি, অলওয়েজ সেন্সে থাকা দরকার।
– আমাকে কি ননসেন্স বলার চেষ্টা করছো! আমি ননসেন্স এ ছিলাম তাই না? দাড়াও দেখাচ্ছি।
মেহেদী দরজা লাগাতে গেলে এদিকে নাহিদা হাসতে হাসতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লো। মেহেদী রুমের দরজা লাগিয়ে বাথরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
– জামাকাপড় নিয়ে গেছো তুমি?
নাহিদার কোনো জবাব এলো না তাই সে আবার বললো,
– শাড়ি কিন্তু চেঞ্জ করবে না আজ।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো মেহতাজ স্বাভাবিক আছে। রাগ তার মাঝে যা ছিলো সবটা রাতের অন্ধকারের সাথে সাথে শূন্যে মিশে গেছে। সকালে আয়াশকে নিয়ে মেহেদী স্কুলে গেছে। এরপর থেকে দুপুর পর্যন্ত মেহেদী বাসায়ই কাটালো। দুপুরে আসিফ ফেরার পর সিদ্ধান্ত নিলো এখন তারা ঘুরতে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রাতের জন্য রান্না করে আসরের নামাজের পরপরই তারা বেড়িয়ে গেলো। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দুই বাচ্চাকে নিয়ে তারা চারজন ঢাকার আশপাশ ঘুরেফিরে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাড়ি ফিরেছে। পরদিন সকাল হতেই মেহেদীর তাড়া,
“নাহিদা, দ্রুত তৈরি হও। বাসায় যাবো।”
আর মেহতাজের বারবার একই উক্তি,
“আজ যাবি না। আরও দুতিনদিন থেকে তারপর যাবি!”
প্রতুত্তরে মেহেদীর জবাব,
“নাস্তা দিলে দাও, না হয় না খেয়েই এখন চলে যাবো।”
এই মেহেদীকে মানানো দায়! যা একবার বলে তো বলে-ই! সে এমনিতেই কারো বাড়িতে থাকে না। এখানে দুই রাত কোনোভাবে কাটিয়ে এই সাজ সকালে শুরু হয়েছে তার ঘ্যানঘ্যান! নাহিদাকে নিয়ে সে চলে যাবে এখন। মেহতাজ তাকে বিকেলে যেতে বললো, তাতেও রাজি হলো না। এখন বাসায় যাবে তারপর সেখান থেকে অফিস যাবে! তার এতো তাড়া দেখে বিরক্তিসহিত মেহতাজ বললো,
“এজন্যই নাহিদাকে নিয়ে মাকে আসতে বলেছিলাম! তুই তো থাকবিই না, কাউকে শান্তিতে বেড়াতেও দিবি না।”
মেহেদীকে বকাঝকা করতে করতে মেহতাজ নাস্তা রেডি করে দিলো। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই সে নাহিদাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলো। নাহিদাকে বাসায় রেখে গোসল করে অত:পর লেট করেই অফিস চলে গেলো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৭
(নূর নাফিসা)
.
.
১লা ফাল্গুন ছুটির দিন হওয়ায় সকালে মেহেদী নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রান্নার কাজকর্ম সেড়ে নাহিদা রুমে এসে দেখলো মেহেদী বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। নাহিদা বললো,
– নাস্তা করবে না। ওঠো। রুমটা গুছিয়ে ফেলি।
– হেপি স্প্রিং ডে।
মেহেদীর ঘুমঘুম কণ্ঠে বসন্তের শুভেচ্ছান্তে নাহিদা মৃদু হেসে জবাব দিলো,
– শুভ পহেলা ফাল্গুন।
মাথার নিচে দুই বালিশ একত্রিত করে বুকে ভর করে শুয়ে আছে মেহেদী। নাহিদা ড্রেসিং টেবিলের আসবাবপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলো। মেহেদী বললো,
– ভার্সিটি যাবে না?
– আজ ছুটির দিন।
– আজ ভার্সিটিতে প্রোগ্রামও।
– ভালো লাগে না প্রোগ্রামে যেতে।
– যাও না বলেই ভালো লাগে না।
– যেতে ভালো লাগে না বলেই যাই না।
মেহেদী উঠে এসে আলমারি খুললো। একটা প্যাকেট বের করে সে নাহিদার কাছে এসে সামনে প্যাকেট ও পেছনে সে দাড়িয়ে দুয়ের মাঝে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
নাহিদা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা কি?
– গিফট।
– ভ্যালেন্টাইন্স গিফট?
– বোথ অফ।
– উহুম, ভ্যালেন্টাইন্স হলে নিবো না। এসব ডে টে আমি উদযাপন করি না। বাঙালি বলে শুধু বাংলার অনুষ্ঠানগুলো মোটামুটি উদযাপন করি।
– ওকে, অনলি ফর স্প্রিং ডে।
নাহিদা আয়নায় তাকিয়ে দেখলো মেহেদী আয়নার বাইরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু লজ্জা লাগছে খুব! সে প্যাকেটটা হাতে নিলে মেহেদী প্যাকেট ছেড়ে তাকে জড়িয়ে রেখে বললো,
– খুলে দেখো।
নাহিদা প্যাকেট খুলে ভেতরে হাত দিতেই কেমন তুলতুলে নরম অনুভব করলো এবং ঘ্যাঙরঘ্যাঙ শব্দ করে উঠলো! নাহিদা ছোটখাটো এক চিৎকার দিয়ে প্যাকেট ফেলে দিলো! আর হাত ঘষতে লাগলো মেহেদীর শরীরে! এদিকে মেহেদী হেসে কুটিকুটি! তার হাসি দেখে নাহিদা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বললো,
– কি এটার ভেতর?
– বের করে দেখো।
– আমি পারবো না!
মেহেদী হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা উলটে দিলো ড্রেসিং টেবিলের উপর। বেরিয়ে এলো একটা হলদে রঙের শাড়ি। নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা না তো। অন্যকিছু ছিলো। কেমন যেন শব্দ হলো!
মেহেদী শাড়ি হাতে তুলে নিলে নাহিদা দেখলো ড্রেসিং টেবিলে একটা ব্যাঙ পড়ে আছে! কিন্তু এটা রাবার প্লাস্টিকের! মেহেদী ওটাতে আবার চাপ দিতেই ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করে উঠলো! নাহিদা রাগী দৃষ্টিতে তাকালে মেহেদী বললো,
– শাড়িটা ফাল্গুনের জন্য আর এটা ভ্যালেন্টাইনের জন্য। কেমন লাগলো গিফট?
নাহিদা তাকে ঠেলে সরিয়ে বললো,
– খুব বাজে লোক একটা!
– মেহেদী হাসতে হাসতে আবার তার কাছে এসে ভাজ করা শাড়িটাই মাথায় ঘোমটা ন্যায় দিলো। নাহিদা এবার তার ইচ্ছেটা পূরণ করেই ফেললো। মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত বুকে উষ্ণ ছোয়া দিলো এবং চোখ বুজে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। এখন চোখ খুলতেও লজ্জা লাগছে তার। মেহেদী বললো,
“চলো না হয় আজ লাল হলুদ পড়ি,
আমি পাঞ্জাবী আর তুমি শাড়ি।
চলতে চলতে চলে যাই ফাল্গুনের বাড়ি!”
– কোথায় ফাল্গুনের বাড়ি?
– ভার্সিটিতে।
– যাবে তুমি?
– হুম।
নাহিদা তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– নাস্তা করবে, চলো।
– গোসল করে আসি।
গোসল সেড়ে নাস্তা করে দুজন তৈরি হয়ে গেলো প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য। দশটার দিকে তারা এসেছে। মেহেদীর ফ্রেন্ডরাও এসেছে। নাহিদা নাফিসাকে কল করেছিলো কিন্তু রিসিভ করেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে দেখা পেয়ে গেছে। নাহিদা একটু উঁচু স্বরে নাফিসাকে ডাকলো। নাফিসা তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে বললো,
– আপ্পি… ! বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এসেছো!
নাহিদা চিমটি দিয়ে বললো,
– এবার বিশ্বাস হয়েছে?
– ওফ্ফ! ভাবতেও পারিনি তুমি আসবে! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে!
– তোর এই অবস্থা কেন! তুই আবার রঙ মাখামাখি করস!
– আরে! আর বলো না! এশা দিয়েছে! বিপরীতে তাকে গণে গণে চারটা লাথি দিয়েছি!
হঠাৎ বিস্মিত কন্ঠে শুনা গেলো,
” চারটা! একটাও কম হলো না!”
নাফিসা অবাক হয়ে বললো,
– ভাইয়া! আপনিও এসেছেন! বাহ, ভালোই লাগছে লাল হলুদে দুজনকে দেখতে!
মেহেদী বললো,
– থ্যাংক ইউ।
আর মেহেদীর বন্ধুরা বললো,
– আমাদেরও একটু দেখো। আমরাও তো এসেছি।
– হু, দেখলাম। এসে গেছেন যখন, বসে পড়ুন।
– কিসে বসবো? অন্তত একটা পিড়িই এগিয়ে দাও।
– এতো বড় মাঠ সাজিয়ে রেখেছি আবার পিড়ির কি প্রয়োজন! খাটি মাটির মানুষ, মাটিতেই বসে পড়ুন।
সবাই একজোটে হেসে উঠলো। মেহেদী নাহিদাকে বললো,
– থাকো তুমি নাফিসার সাথে। আমি একটু অন্যদিকে ঘুরে আসছি। প্রয়োজনে ফোন দিও।
– আচ্ছা, যাও।
স্টেজে চলছে গানবাজনা নৃত্য। নাহিদা কিছুক্ষণ নাফিসার সাথেই ঘুরাঘুরির পর দেখা পেলো তার ফ্রেন্ডদের। তারা চলে যাবে এখন। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে করতে এদিকে নাফিসাকে হারিয়ে ফেললো। ঘুড়ির মতো কোন দিক থেকে কোনদিকে চলে যায় মেয়েটা কোনো সংকেত নেই। ফ্রেন্ডদের বিদায় দিয়ে সে নাফিসাকে খুজতে লাগলো। সামনে পড়লো আশিক। বহুদিন পর আজ আশিকের দেখা পেলো। বিয়ের পর তাকে ক্লাসেও দেখেনি কোনোদিন। একপলক চোখাচোখি হয়ে গেলেও আশিক সাথে সাথেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে হাতে থাকা ফোনের দিকে। নাহিদার সামনাসামনিই আছে সে। তুলনামূলক শান্ত স্বরে বললো,
– কেমন আছো?
নাহিদা বুঝতে পারছে না কথাটা তাকেই বলেছে নাকি ফোনে কাউকে বলছে! তাকে বললে তো নিশ্চয়ই তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতো!
সে চুপচাপ ভাবতে ভাবতে এদিকে আশিক তার পথে পা চালাতে চালাতে তাচ্ছিল্যের সাথে মৃদু হেসে বলতে লাগলো, “এতোটাই ঘৃণ্য আমি যে, এখন আমার সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাধে!”
নাহিদা এবার নিশ্চিত তাকেই প্রশ্ন করেছিলো। তাই আশিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটু জোর গলায়ই বললো,
– বেশ ভালো আছি আমি। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলেছেন বিধায় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো কাকে জিজ্ঞেস করেছেন।
আশিক পেছনে ফিরে বললো,
– ওহ্! সরি। আমিও বুঝতে পারিনি যে বরাবরই তোমার বুঝতে অসুবিধা হয়ে যাবে! যাইহোক, তোমার হাসব্যান্ড আসেনি?
– এসেছে। আপনি কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ। হাসব্যান্ড এসেছে অথচ ওয়াইফকে এভাবে একা ছেড়ে দিলো কেন!
– আঁচল ধরে পিছু পিছু ঘুরার কথা ছিলো?
– বর্তমানে এমনটাই দেখা যায়।
– হতে পারে সেই বর্তমানটা কেবল লোক দেখানোর জন্য।
– হুম, হতে পারে! তা কোটিপতি তোমাকে সুখে রাখছে তো?
– ভাইয়া, আপনার কথার স্টাইল আমার পছন্দ হচ্ছে না।
– না-ই বা হতে পারে। এক্সট্রেমলি সরি, পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে কথা বলার জন্য! আসলে তোমার ভালো থাকার উত্তরে আজ “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দটা মিসিং ছিলো। তাই কেন জানি মনে হলো তুমি সুখে নেই!
তার কথায় নাহিদাও একটু বিস্মিত হলো! আসলেই কি “আলহামদুলিল্লাহ” শব্দটা মিসিং ছিলো! মিসিং কেন থাকবে! সে তো সুখেই আছে! ভাবনা কাটিয়ে জবাব দিলো,
– আমি যেমন সুখে আছি, এতেই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। ও তার বন্ধুদের সাথে গেছে। আমি তখন নাফিসার সাথে ছিলাম। মোহনার সাথে কথা বলতে বলতে এখন নাফিসাটাও কোথায় যেন চলে গেলো।
– নাফিসাকে ওদিকে দেখেছিলাম। এগিয়ে যাও, পেয়ে যাবে।
– ওকে। পড়াশোনা কেমন চলছে আপনার?
– চলছে চলার মতোই।
– ক্লাসেও দেখা যায় না আপনাকে!
– কেন, মিস করো?
আশিক আজ এমন কেন করছে নাহিদা বুঝতে পারছে না। যতটুকু চেনে, সে তো এমন স্বভাবের না! এতো কিছু না ভেবে অন্যান্য জবাবের মতো এবারও কথায় জোর দিয়ে জবাব দিলো,
– না।
তার জবাবে আশিক এবারও তাচ্ছিল্যের সাথে মৃদু হাসলো। নাফিসার খোজ পেতে আশিকের দেখানো পথে তাকাতেই মেহেদীকে দেখতে পেল নাহিদা। মেহেদীও যেন তার দিকে তাকিয়েছে মাত্র। নাহিদা হাতে ইশারা করে মেহেদীকে ডাকলো। মেহেদী এগিয়ে এলে নাহিদা আশিককে উদ্দেশ্য করে বললো,
– উনি আমার হাসব্যান্ড।
আশিক সালাম দিলে মেহেদী জবাব নিলো। নাহিদা আবার মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– উনি আশিক ভাই। আমার ক্লাস ম্যাট আবার অন্যদিকে আরাফ ভাইয়ার ছোট ভাই।
মেহেদী বললো,
– চিনি তো। পরিচিত হয়েছি অনেক আগেই।
– অনেক আগে! কবে?
– রায়ানের বিয়েতে আরাফ ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
– ওহ!
মেহেদী হ্যান্ডশেক করার জন্য আশিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– কেমন আছো?
আশিকও হ্যান্ডশেক করে জবাব দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাই?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– আচ্ছা, থাকেন। আমি আসি। আল্লাহ হাফেজ।
– হুম।
আশিক চলে গেলে মেহেদী বললো,
– একা কেন তুমি? নাফিসা কোথায়?
– আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম। এর মধ্যে সে উধাও। তাকেই খুজছিলাম, আবার আশিক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
– নাফিসাকে কল দিলেই তো পারো।
– রিংটোন শুনে নাকি এই সাউন্ডের জন্য!
– চলো।
এমনি নাফিসা এসে হাজির। নাহিদা তার কাধে এক থাপ্পড় দিয়ে বললো,
– ফাজিল, কোথায় গিয়েছিস?
– আমি তো ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
– বলে যাবি না! আমি যে খুজছিলাম এদিকে!
– আমি ভাবছিলাম, তুমি বুঝি বান্ধবীর সাথে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছো। যা ঘন্টাতেও শেষ হবে না।
– হু, তোর মতোই তো!
মেহেদী বললো,
– হয়েছে, ঝগড়া পরে করো। প্রোগ্রাম প্রায় শেষের দিকে। বাসায় চলে যাবে?
– হুম, চলেই যাবো।
– ওকে, তাহলে চলো নাফিসাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে পরেই যাই।
– আচ্ছা।
তার তিনজন ভার্সিটির পার্শ্ববর্তী এক রেস্টুরেন্টে এলো। চেয়ারে বসার সময় নাহিদার চোখ পড়লো তার শাড়ির দিকে! এবার তার মাথায় ধরা দিলো, আশিক নিশ্চয়ই তাকে হলুদ শাড়ি পড়নে দেখে এমন বিহেভ করেছে! করুক, তাতে কি আসে যায়! তার স্বামী গিফট করেছে, সেখানে পর পুরুষের কথা মানতে যাবে কেন! হাজার বার পড়বে হলুদ! শুধুমাত্র তার স্বামীর জন্য।
তিনজনই গল্পগুজব সহিত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো। নাফিসা তাদের বললো,
– ভাইয়া, চলুন আজ বাসায়।
– গত সপ্তাহে না মাত্র এলাম!
– তো কি হয়েছে! আবার যাবেন। আপু চলো।
– আরে, না। তুমিই চলো আমাদের বাসায়।
নাহিদা এপাড় ওপার কোনোদিকেই কথা বলছে না! তারও ইচ্ছে করছে যেতে! কিন্তু গত সপ্তাহে মাত্র থেকে এসেছে তাই সাহস পাচ্ছে না বলার! তবুও একটু সাহস যুগিয়ে সে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– চলো না, যাই। থাকবো না। মা বাবার সাথে দেখা করে চলে আসবো।
– যাও।
– যাও মানে! তুমি যাবে না?
– চলো।
নাফিসা বললো,
– দাড়াও বুট নিয়ে আসি। আর হেটে হেটে চলে যাই।
কারো প্রতিক্রিয়ার আশায় না থেকে সে বুট কিনে নিয়ে এলো। অত:পর তিনজন বুট খেতে খেতে এবং হাটতে হাটতেই চলে এলো বাড়িতে। যদিও বলেছে শুধু দেখা করে চলে যাবে। কিন্তু রুমানা বেগম যেতে দিলো না। যেতে যেতে তারা রাতে খেয়ে তারপর বাড়ি ফিরেছে।

চলবে।