“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬০
(নূর নাফিসা)
.
.
ইমরান ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। নাফিসাকে উঠুন ঝাড়ু দিতে দেখে রাস্তার দিকের টিনের গেইটটা চাপিয়ে বললো,
– উঠুন ঝাড়ু দিচ্ছো, গেইট লাগিয়ে নিবে না! আর এটা এভাবে খুলেই বা রাখছে কে!
নাফিসা বললো,
– আমি কি জানি! আমি কি রাস্তায় বেরিয়েছি নাকি!
– যাইহোক, খোলা দেখলে লাগিয়ে রাখবে।
ইমরান চলে গেলো। নাফিসার ঝাড়ু দেওয়া শেষ হতেই দেখলো ইমরান বড় ঘর থেকে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে তাদের ঘরের দিকে। যেতে যেতে ফোনে সময় দেখে বললো, “ওফ্ফ! লেট হয়ে যাচ্ছে!”
ইমরান ঘরে এসে দ্রুত গোসল করতে চলে গেলো। উঠুন ঝাড়ু দিয়ে হাপিয়ে উঠেছে নাফিসা, তাই ভাবলো সকাল সকাল গোসল সেড়ে নিলে ভালো হবে। সে-ও কাপড়চোপড় নিয়ে তৈরি হলো। সাথে বোরকাটাও নিলো ধোয়ার জন্য। দরজা খোলার শব্দে নাফিসা বাথরুমে এসে দেখলো ইমরান তার জামা কাচার ব্যবস্থা করছে। নাফিসা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– আপনি যান, আমি ধুয়ে দেই।
ইমরান মুচকি হেসে বললো,
– আমিও কাপড় কাচতে জানি। নিজের কাজ নিজে করতে ভালো লাগে।
নাফিসা তার বোরকা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– তাহলে আমারটাও কেচে দিন।
ইমরান হাসিমুখেই হাত বাড়িয়ে বললো,
– দাও।
নাফিসা আবার বোরকা গুটিয়ে নিয়ে বললো,
– আপনার না লেট হয়ে যাচ্ছে। আপনি যান।
– এতোটা সময় লাগবে না এতে।
– এতোই যেহেতু নিজের কাজ নিজে করতে জানেন তাহলে বিয়ে করে বউ এনেছেন কেন?
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
– বউকে কাজের বুয়া হিসেবে রাখার জন্য বিয়ে করিনি। বিয়ে ফরজ কাজ। তাই করেছি। এছাড়া এতো দ্রুত বিয়ে করার আরও একটা কারণ আছে, আশা করি শীঘ্রই জেনে যাবে। এখন তুমি বরং নিজেকে গুছিয়ে রেখো তাহলেই হবে।
– উঠুন, পুরুষদের এমন মেয়েলি কাজ করতে দেখতে আমার ভালো লাগে না।
– ওকে, উঠে পড়লাম। তবে কিছু কিছু কাজে স্ত্রী পুরুষের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। নিজের কাজ নিজে করাই উত্তম মনে করি।
ইমরান চলে গেলো আর নাফিসা কাপড় কেচে শুকাতে দিলো উঠুনে।
ইমরান দ্রুত তৈরি হয়ে খাওয়ার জন্য বড় ঘরে চলে গেলো। নাফিসা ভাবলো যেহেতু লেট হয়ে গেছে, ইমরানের খাবার এগিয়ে দিয়ে তারপর গোসল করতে যাওয়া যাক। তাই সে বড় ঘরে এলো। আরমান নাস্তা করে তৈরি হচ্ছে। ইমরান নিজেই খাবার নেওয়ার জন্য টেবিলের কাছে এসেছিলো। নাফিসা বললো, “আমি এনে দিচ্ছি।”
তাই ইমরান চলে গেলো। নাফিসা খাবার প্লেটে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে যাবে এমন সময় জেরিন এসে তার হাত থেকে প্লেট নিয়ে বললো,
– বাটিতে ডাল দাও।
এভাবে প্লেট কেড়ে নেওয়ায় নাফিসা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে গেছে! অত:পর বাটিতে ডাল নিলে জেরিন এসে আবার সেটাও নিয়ে গেলো। নাফিসা কিছু না বলে টেবিলের আসবাব গুছাতে লাগলো। জিহান ঘরের ভেতরই খেলা করছে আর নাফিসা কাজের সাথে জিহানকে তার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। এমনি ইমরানের ডাক পড়লো। নাফিসা সেখানে গিয়ে বললো,
– কি?
– বসো এখানে।
– কেন?
– বসতে বলেছি, বসো।
ইমরানের বিরক্তিকর মনোভাব দেখে নাফিসা তার পাশে এসে বসলো। জেরিনের মুখটা একদম কালচে ভাব ধারণ করেছে। জেরিনের খোজে জিহানকে জিজ্ঞাসাস্বরূপ আরমানের কণ্ঠ শুনে ইমরান বললো,
– জেরিন, ভাইয়া তোকে ডাকছে। যা।
জেরিন টিভির রিমোটটা খাটে থিতলে রেখে বেরিয়ে গেলো। জেরিন যাওয়ার পরপরই ইমরান নাফিসাকে বললো,
– আমি যখন খাবো, তখন আমার পাশে বসে থাকবে। এমনকি একা এখানে টিভি দেখার সময়ও বসে থাকবে। আর যদি মুরুব্বিরা কেউ থাকে তাহলে তোমাকে থাকতে হবে না। মনে থাকবে?
নাফিসা শুধু তার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। ইমরানের খাওয়া শেষ হতেই নাফিসা সব গুছিয়ে রাখছে। ইমরান বড় মা ও তার মায়ের কাছে বলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
– এসো তো একটু।
নাফিসা হাতের কাজ রেখেই তার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। তাদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
– আপনারা দুই ভাই কি একসাথেই কাজ করেন? ভাইয়া যে আপনার জন্য বসে আছে।
– হুম, ভাইয়ার সূত্রেই আমার চাকরি। কিন্তু পদ আলাদা।
– কোথায় চাকরি করেন?
– বরের কাজকর্মের খবর না জেনেই বিবাহিতা বউ আমার ঘরে!
– হুহ্! বউ কি আবার অবিবাহিতা হয়!
– হয়না? নবীন প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাকে তো বিয়ে ছাড়া বউ হিসেবেই মানে!
– ফালতু।
ইমরান হেসে বললো,
– ওহ্ ! তোমারও না বয়ফ্রেন্ড আছে! কোথায় সে?
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে একবার তাকালো শুধু তার দিকে। ইনরান আবার হেসে বললো,
– আমরা স্কয়ার গ্রুপে কর্মরত আছি। আমি স্টোক একাউন্টার হিসেবে আর ভাইয়া ম্যানেজার হিসেবে।
– ওহ্।
রুমে এসে ইমরান ঠিক করা শার্টের কলারটাই আবার নেড়েচেড়ে ঠিক করে ঘড়িটা হাতে পড়লো। নাফিসা দাড়িয়ে থেকে বললো,
– আমাকে ডেকেছেন কেন?
– এমনি।
– এমনি মানে!
– এমনি মানে এমনি! আমি রেডি হবো, অত:পর অফিসের জন্য বের হবো। আর তুমি ভালোবেসে বিদায় জানাবে। এবার বুঝতে পেরেছো?
– আযব লোক একটা! এসব অকর্মণ্য লোকদের দেখলে রাগে গা ঝিমঝিম করে!
– আচ্ছা! তাহলে তো কর্মঠ লোক হওয়ার জন্য কিছু একটা কাজ করতেই হয়!
অকর্মণ্য নয় তা প্রমাণ করতে ইমরান কিছু একটা করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো আর নাফিসা রেগে আগুন! মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে সে থু থু ফেললো এবং বললো,
– ওয়াক থু! খাচ্চোর লোক! পিশাচ! বমি বমি লাগতাছে! ছি!
ইমরান যেতে যেতে উঠুন থেকে পেছনে ফিরে ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীনভাবে বললো, “সরি”। নাফিসার ইচ্ছে করছে মাটি থেকে ইট তুলে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারতে! বাইরে বেরিয়ে গেছে তাই কিছু বললো না! একা পেলে সত্যিই কিছু একটা করতো! উঠুনের রশিতে কম্বল মেলে দিতে দিতে জেরিন দেখছিলো তাদের। নাফিসাকে থু থু ফেলতে দেখে বললো,
– কি হইছে?
বদ আচরণের কারণে এই জেরিনকে দেখলেই নাফিসার রাগ উঠে। তাই সে-ও এবার একটু কটুবাক্য বললো,
– হাসব্যান্ড ওয়াইফের মধ্যে তো কত কিছুই হতে পারে। সেটা আপনাকে কেন বলতে যাবো, ভাবি?
নাফিসার জবাবে জেরিনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নাফিসাও আর দাড়িয়ে নেই তার ফ্যাকাসে মুখ দেখার জন্য। সে গোসল করতে চলে গেলো।
আজ নাস্তার পর বড়মার সাথে গল্প করলো কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ আবার জিহানের সাথে খেলাধুলা আলাপ। পরক্ষণে চলে এলো নিজ কক্ষে। সময় যেন কাটছেই না। নিশাতও বাসায় নেই যে একটু আড্ডা দিবে। ফোন নিয়ে দেখে ব্যালেন্স নেই, যে বাবা-মা ও আপুদের সাথে কথা বলবে! ইমারজেন্সি ব্যালেন্স তো আগেই শেষ ছিলো, এখন সেটা নেওয়ারও সুযোগ নেই! বই নিলো পড়ার জন্য, পড়তেও ভালো লাগছে না। সে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। হৈচৈ শুনে ঘুম ভাঙলো দুপুরে। নাফিসা শোয়া থেকে উঠে বসে জানালা দিয়ে দেখলো পাশের বাড়িতে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। এমন ভরদুপুরে তাদের খেলতে হয়! হঠাৎ করে ঘুম ভাঙায় যেন মাথাটা ঝিম ধরে আছে! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর আযান পড়লে নামাজ আদায় করে নিলো। বিকেলটা কাটলো নিশাতের সাথে। সন্ধ্যা কাটলো রান্নাঘরে টুকটাক কাজকর্ম করে। অত:পর কাজ সেড়ে রুমে এসে ইমরানকে দেখে এখন আবার মনে হলো সকালের কথা। ইচ্ছে করছে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু সেই মনোবলটা আপাতত নেই। সময়ের সাথে সাথে সেটা মজে গেছে! ইমরান খুব মনযোগ সহকারে পড়ছে। নাফিসা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়ে নিচ্ছে। ইমরান বললো,
– পড়তে বসো না কেন তুমি?
– পড়াশোনা করে কি লাভ! একদিন তো মরেই যাবো!
– তুমি তো দেখছি সাধকদের মতো সাধনায় বসেছো! কিসের সাধনা করছো?
– সংসার সাধন!
গম্ভীরভাবে কথাটুকু বলে নাফিসা নিজেই হেসে উঠলো। ইমরানও নিচু শব্দে হেসে বললো,
– সব সাধনা বাদ রেখে এবার পাঠ্যবই সাধন করো৷
– আপনি কিসে পড়েন?
প্রশ্ন করে নাফিসা আয়নায় ইমরানের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। ইমরানও বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়নায় নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– নাই ক্লাসে।
– নাই ক্লাস! এটা আবার কোন কোর্স!
– প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর যদি আর কোনো কোর্স অর্জন করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে বাকি ক্লাস গুলোকে বলে নাই ক্লাস।
ইমরানের এমন কথা সম্পূর্ণটাই নাফিসার মাথার উপর দিয়ে গেলো! মগজে ভালোভাবে আঁটানোর জন্য সে বললো,
– আপনি বই পড়ছেন অথচ বলছেন নাই ক্লাস! বুঝলাম না আপনার কথা৷ আবার বলুন।
এবার ইমরান তুলনামূলক জোরে হেসে উঠলো এবং বললো,
– আরে বোকা, নাই ক্লাস বলতে আবার কোনো ক্লাস আছে!
– আরে বলদ! সেজন্যই তো আবার বলতে বললাম। তাছাড়া, মেয়েরা আবার বোকা হয় নাকি!
– হা হা হা! তাহলে কি হবে, বোকি?
– বোকি বলতে কোন শব্দ আছে কিনা আমার অজানা। তবে বোকার ক্ষেত্রে মেয়েরা হবে বোকা মেয়ে।
– ওহ্, আচ্ছা! মেয়ে শব্দটা বাদ পড়েছিলো, তাই না! আচ্ছা, যাও। বোকা বউ আমার! সবচেয়ে বেশি অবাক তো লাগছে এটা ভেবে, আমার বউ আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না! কিছু না জেনেই বসে গেছে বিয়ের পীড়িতে!
– হুহ্, পন্ডিত! আপনি আমার সম্পর্কে জানেন নাকি!
– হুম, জানিতো।
– কি জানেন?
– আগে আমারটা শুনো। এবছর আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হলো। খুব ইচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। আপাতত সেই চেষ্টাই করছি। আর সেজন্যই সময় পেলে বই নিয়ে বসে থাকি।
– ইচ্ছা নাকি স্বপ্ন?
– দুটোই।
– আচ্ছা, এবার বলুন আমার সম্পর্কে কি জানেন। আমিও দেখি আপনি কত পন্ডিত!
– তুমি, আমার একমাত্র শ্বশুরের তৃ-তনয়া’র মাঝে ছোট্ট তনয়া নূর নাফিসা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন একাউন্টিং- এ অনার্স করছো। কিছুদিন আগে আত্মকর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে তুমি এখন নবীন উদ্যোক্তা। নিয়মিত নামাজ ও কুরআন পড়। বেশ চতুর মেয়ে যে কি-না চাতুর্যের সাথে স্পষ্টবাদী একজনও বটে। সর্বদা সুশৃঙ্খল, মার্জিত ও শালীনতার সাথে চলাফেরা করে। অন্যকে ভালো উপদেশ দিতে জানে আর একটু বেশিই রাগ অভিমান করতে জানে।
ইমরান থামতেই নাফিসা বললো,
– এটুকুই?
– এখানে এটুকু বললাম!
– হু, আপনি অনেক কিছুই জানেন না!
– যেমন?
– যেমন আমি বাইরে যতটা সুশৃঙ্খল, ভেতরে ততটাই উশৃংখল! বাইরে বের হই বোরকা হিজাব, মাঝে মাঝে নিকাব। আর বাসায় থাকি তো উষ্কখুষ্ক এলোমেলো চুল, ফ্যাকাসে মুখ, নো অয়েল, নো ক্রিম আর নো সাজুগুজু! নিজেকে বাদে বাকিসব থাকবে গোছানো। পড়তে বসি তো চেয়ার টেবিল ছেড়ে কখনো খাটে শুয়ে-বসে, কোলে এক বালিশ রেখে, পিঠের নিচে আরেক বালিশ! কখনো মেঝেতে আমি আর বইখাতা টুল অথবা খাটে! সোফায় বসি তো পা উঠে যায় টেবিলে! খেতে বসি তো হাড়িপাতিল সব একসাথে সামনে নিয়ে। যাতে বারবার আসা-যাওয়া না করতে হয়। চুলার ধারে কাছে যাওয়া আমার মনের এলার্জি! বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিচেনে নো যাওয়া-যাওয়ি! ঘর গুছানো বাদে সকল কাজ থেকে একশো হাত দূরেই থাকি! তবে বাবামায়ের আদেশ হলে ভিন্ন ব্যাপার আরকি!
ইমরান প্রায় হা করে তার কথা শুনছিলো। নাফিসা হঠাৎ করেই কথা থামিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনি তো আস্ত একটা গাধা! নিজে না পড়ে বই খুলে রেখে শয়তানকে বিসিএস ক্যাডার বানাতে চাইছেন!
ইমরান এবার বই বন্ধ করে হাসতে লাগলো এবং হাসির সাথেই বললো,
– অদ্ভুত একটা মেয়ে তুমি!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬১
(নূর নাফিসা)
.
.
– আপনার ভাবি মনে হয় আপনাকে পছন্দ করে!
হঠাৎই নাফিসা এমন কথা বলায় ইমরানের মুখে হাসির রেশ কমে গেছে। সে একটু নেড়েচেড়ে বসে বললো,
– এতো তারাতাড়ি বুঝে গেলে! আমি ভেবেছি আরও অনেক দীর্ঘ সময় লাগবে তোমার বুঝতে। এখন দেখলাম সপ্তাহ খানেক যেতেই বুঝে গেছো! যাইহোক, এখন কি আমাকে নিয়ে সন্দেহে আছো না?
– না।
– কেন?
– আই থিংক, আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই তার প্রতি।
– এতো বিশ্বাস আমার উপর!
– হুহ্ ! কচুর বিশ্বাস! বিয়ের প্রথম রাতেই আপনাদের কথপোকথন শুনেছি আমি। আর সে থেকেই পরপর কর্মকাণ্ডে বুঝেছি যতটুকু বুঝার!
– বিয়ের প্রথম রাতেই শুনেছো মানে! বুঝলাম না!
– ঘুমানোর পূর্বে আপনি ঘরে প্রবেশ করার সময় আপনার ভাবি বলছিলো না, “তুমি যাবে না এই ঘরে! সব জেনেশুনে আমাকে এভাবে ঠকাতে পারো না তুমি। তুমি শুধুই আমার, আর কারো না!” আর আপনি তখন বলেছিলেন, “আজ থেকে আমি ম্যারিড। এই ঘরে আমার বউ। দয়া করে এসব পাগলামি বন্ধ করে দে। আর নিজের অবস্থান বুঝে নে। বাড়াবাড়ি করলে পরিবারে জানাজানি হবে, যেটা তোর জন্য অমঙ্গলজনক হয়ে উঠবে!” এটুকু শোনার পর ভেবেছি নিশ্চয়ই আপনার সাথে কারো গিট্টু লেগে আছে। কিন্তু কে সে, তা বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে আপনার ভাবির আচার-ব্যবহার দেখে বুঝে গেছি তিনিই সে! কিন্তু এটা কেমন হলো! আপনার গার্লফ্রেন্ড আবার আপনারই বড় ভাবি! অথচ নেশা এখনো আপনার প্রতিই!
ইমরান বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজাটা লক করে দিলো। অত:পর আবার খাটে এসে বসে বললো,
– ও আমার গার্লফ্রেন্ড না। আমার মামাতো বোন। ও আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আমি না। মা এবং মামা দুজনেই ঠিক করে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিবে জেরিনকে। কিন্তু জেরিন আমাকে পছন্দ করতো সেটা আমিও জানতাম না, জেনেছি ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর। সে বিয়ের আরও অনেক আগে থেকেই আমার একটু বেশিই কেয়ার করতো, দুষ্টুমি ফাজলামোতেও আমার সাথে বেশি লেগে থাকতো। কিন্তু তখন আমি সেটা কাজিনদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবেই ধরে নিয়েছি। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর যখন সে সামনাসামনি এসে বলে আমাকে ভালোবাসে আর আমি যেন তাকে বিয়ে করি, তখন আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হয়নি! আমি কখনো ভাবতেও পারিনি আমার প্রতি তার এমন ফিলিংস আছে তার মাঝে! আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি আমি এসব ফিলিংস থেকে একশো হাত দূরে! সে মানছিলো না! সে বলেছে পরিবারের কাছে না বলতে পারলে যেন আমি তাকে নিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু পালিয়ে যাবো কোথায় তা নিয়েও কত রকম বুঝ দিয়েছি, কোনো কাজ হয়নি। তখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একে তো আমি এতো স্বল্প বয়সে বিয়ে করবো না তার উপর ভাইয়ার সাথে বিয়ে পাকা তাও আবার ও আমার মামাতো বোন! অনেক ভেবে আমি তার সামনেই যাইনি বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত। ভাইয়াকে যেহেতু পছন্দ নয়, তখন ভেবেছিলাম সে বিয়ে ভেঙে দিবে কিন্তু তা করেনি। তখন সেই ভেবে হাফ ছেড়েছি যে, সে হয়তো বুঝতে পেরেছে আর ভাইয়ার সাথেই খুশিমনে বিয়েতে রাজি হয়েছে। বিয়ের পর থেকে দিনের পর দিন তার কাণ্ডে আমি হাজার বোল্ডেজ শকড! দেবর হওয়া সূত্রে ভাইয়া বলা ছেড়েছে, নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে আরও রসিকতার সম্পর্কে! পরিবারের সবার সামনে আদর্শ বউ হওয়ার নাটক আর গোপনে আমার সাথে ভিন্ন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার ষড়যন্ত্র! ভেবেছি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে গেছে তবুও তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেনি৷ বরং আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে গেছে! সুযোগ পেলেই তুলে ধরে আমি একবার বললেই সে ভাইয়াকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। এদিকে আমি নিরুপায়! যদি কাউকে জানতে দেই তাহলে সংসার এবং কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরবে। আবার যদি চুপচাপ বসে থেকে তাকে প্রশ্রয় দেই তাহলেও সে, দিনের পর দিন চেষ্টা করেই যাবে আমার সংস্পর্শে আসার। অনেক ভেবেচিন্তে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করেই ফেলবো। হোক বয়স ছাব্বিশ, না বালক তো আর নয়! এবং সেই সিদ্ধান্তে সাপোর্ট করলেন বড়মা। কোনো না কোনো ভাবে তিনিও জেনে গেছেন জেরিন আমার প্রতি দুর্বল। তাই মেয়ে দেখা শুরু করলাম।
– আপনার বড়মা জেনেছে আর মা, ভাই জানতে পারেনি?
– জানলে তো নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল বেধে যেতো। হয়তো তারা আমাদের কাজিনদের সম্পর্ক হিসেবে মেনে নিয়েছে। নতুবা জেরিন এমনভাবে ম্যানেজ করে রাখে যাতে কেউ না বুঝে! বিয়ের জন্য তোমার আগে তিনটা মেয়েকে দেখেছি। বারবারই মাকে ফুসলিয়ে সে গিয়েছে সাথে। আর মায়ের কাছে এসে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দোষ খুঁজে বলেছে মেয়ে ভালো না, পছন্দ হয়নি। তোমাকে দেখার পর ভালো লেগেছে কেননা তুমি স্পষ্টবাদী। তুমি নিশ্চয়ই তার বাধ্য হয়ে থাকবে না, চঞ্চলতার সাথে তার দুর্বলতার রেশটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আরাফ ভাই বললো তোমাকে বিয়ে দিবে না। এরপর আবার আরও একটা মেয়ে দেখেছিলাম। তাকে পছন্দ হয়েছিলো কিন্তু একটু বেশিই শান্তশিষ্ট স্বভাবের। তাই ওটা বাদ দিলাম। এরপর আমার ভাগ্য টেনে নিয়ে গেলো আবার সেই তোমার কাছেই!
– বাহ! বাহ! কি সুন্দর পিরিতের কিচ্ছা! মাঝখানে টেনেহিঁচড়ে আনার জন্য আমাকেই চোখে এটে গেলো! মা যা বলে ঠিকই বলে! এ জন্যই লোকের সামনে এতো চঞ্চলতা দেখাতে নেই! কিন্তু চোখের সামনে উল্টাপাল্টা কিছু দেখলে যে আর চুপ থাকতে পারি না!
– খুব বেশি বিপদে ফেলে দিলাম তোমাকে!
– আবার জিজ্ঞেস করেন! এসব ধারালো অস্ত্র দেখলে গা জ্বলে উঠে! আমি কাউকে কটু কথা শুনাইও না, অন্যের মুখে শুনতেও পারি না!
– সরি ফর দ্যাট, বাট এছাড়া উপায় খুজে পাই নি।
– খবরদার, অপরাধ করে করে সরি যপেছেন তো! শুনতে শুনতে এখন বড্ড অসহ্য লাগে এই শব্দটা! উনিশ থেকে বিশ হলেই সরি, সরি আর সরি!
– ওক, চেষ্টা করবো না বলার। তবে এটা প্রত্যাশা করছি, এবার আমাদের দাম্পত্য জীবন দেখে সে তার উদ্দেশ্যের মোর ঘুরিয়ে নিবে। কি বলো?
– জীবনেও না।
– কেন! এখনো কি মানতে পারছো না আমাকে ও আমাদের বিয়ে! বিয়ে তো একদিন হতোই কারো না কারো সাথে। মানছি তো নিজ স্বার্থ ও পরিবারকে ভেবে তোমাকে ঘরে তুলেছি, এখন এতে আপত্তি কোথায়!
– চুপ থাকুন। আর দু চার লাইন বেশি বুঝা বন্ধ করুন। এতো বেশি প্যাচাল আমার ভালো লাগে না। আপনার ওই ভাবি মোটেও উদ্দেশ্যের মোর ঘুরাবে না এই জন্য, কারণ আপনারা তাকে আস্কারা দিয়ে রেখেছেন।
– আমি কিন্তু মোটেও না।
– মোটেও না? কম কিসে আপনি শুনি! এর জন্য তো আপনি আরও বেশি দায়ী!
– আমার দোষ এখানে কিভাবে হতে পারে!
– ও সম্পর্কে আপনার কি হয়?
– মামাতো বোন।
– এর বাইরে..
– বড় ভাইয়ের বউ।
– আশ্চর্য! ভাইয়ের বউকে কি “ভাইয়ের বউ” বলে ডাকে!
– না, “ভাবি”।
– তো, এক বাক্যে বলা যেতো না “ভাবি”! আমাকে তিনটা প্রশ্ন কেন করালেন!
ইমরান তার দিকে তাকিয়েই খাটে পা তুলে বালিশ কোলে নিতে নিতে বললো,
– কে, জানতো এতো প্যাচিয়ে নিবে!
নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– কি! আমি কথা প্যাচাই!
– না, মানে তোমার কথার ধরনে আমার মাথায় প্যাচিয়ে গেছে!
– তো সেটা বলুন না, যে আপনার মাথার দোষ।
নিশব্দে শরীর কাপিয়ে হেসে ইমরান বললো,
– ওহ্, আচ্ছা। এবার বলো, কি যেন বলছিলে ভাবি নিয়ে!
– ও বয়সে যেমন তেমন হোক, সম্পর্কে তো আপনার ভাবি তাই না?
– হুম।
– তো আপনি ভাবি ডাকেন না কেন?
– আগেই তো বললাম, ও আমার মামাতো বোন। আর আগে থেকে নাম ধরে ডেকে অভ্যস্ত।
– এজন্যই তো সে-ও তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে অভ্যস্ত! আপনি ভাবি ডাকলে সম্মাননার জন্য হলেও সে কিছুটা লজ্জাবোধ করতো! কিন্তু তা নয়! আপনিও আগের মতো, সে-ও আগের মতো। তাহলে চলছে চলুক!
ইমরান খাটে হেলান দিয়ে কোলে বালিশ নিয়ে তাকিয়ে আছে নাফিসার চোখের দিকে। এখন তার মনোভাব ইতিবাচক। খুব দ্রুতই নাফিসার কথার মর্মার্থ গেথে গেছে তার মস্তিষ্কে আর খুব সহজেই তার একটা দোষও চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলেছে নাফিসা। তার চোখের সামনে বসা মেয়েটা তো সেই পাগলটা না, যে নাকি দুদিন আগেও কান্নাকাটি করতো, রাগ করতো, জেদ করে উল্টাপাল্টা বলতো! নাহ! সে পাগল কেন হতে যাবে! এ তো এক পাগলী, যার মাঝে যেমন রাগ আছে, তেমন জেদ, যেমন বুদ্ধিমতী আর তেমনই ভেজালমুক্ত! যার ভিন্ন রূপ আর ভিন্ন গুন বরাবর করে যাচ্ছে তাকে মুগ্ধ!
নাফিসা চুল বিনুনি করে উঠে পড়লো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে। ইমরানের দিকে চোখ পড়লে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
– আমার দিকে কি দেখেন?
– দেখি না, ভাবি।
– কিহ! ভাইয়ের বউকে ভাবি না ডেকে এখন নিজের বউকে ভাবি ডাকা হচ্ছে!
ইমরান জ্বিভ কেটে বললো,
– আমি তেমন কিছু বুঝাতে চাই নি। বলতে চেয়েছি তোমার দিকে দেখছি না শুধু, ভাবছিও।
– তো, সেটা না বলবেন। যাইহোক, কি ভাবছেন শুনি?
– এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।
– তো কিভাবে চালাবেন? থেমে থেমে নাকি এবার দৌড়ানো শেখাবেন?
– এগজ্যাক্টলী, এখন থেকে দৌড়াবে তা-ও আবার তোমার মাধ্যমেই।
– আবারও আমাকে টানছেন!
ইমরান বিছানা ছেড়ে নেমে হঠাৎই একহাতে নাফিসাকে কাছে টেনে বললো,
– টানবো আর কি! শক্তিশালী বন্ধনেই তো বেধে ফেলেছি।
নাফিসা ইমরানের পেটে গুতো দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
– হুহ্! সরুন! কি ভেবেছেন টা কি! সকালে কিছু বলিনি তাই এখনো চুপ থাকবো!
ইমরান তার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে হাসিমুখে বললো,
– আচ্ছা! কি বলবে শুনি?
– বলবো না, করবো।
– তা কি ই বা করবে?
নাফিসা দরজার কাছে এসে বললো,
– এই মুহূর্তে রুম থেকে পালাবো!
সামনের দাতগুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে যেই দ্রুত দরজা খুললো, অমনি পাচ আঙুল ওয়ালা এক হাত এগিয়ে এলো তার মুখ বরাবর! নাফিসা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। ইমরানও চমকে উঠেছে তার চিৎকারে! অত:পর তাকিয়ে দেখলো নিশাত দরজার ওপাশে দাড়িয়ে বুকে থু থু দিচ্ছে! নাফিসা ভয়ে চিৎকার দিয়ে হাপিয়ে উঠেছে! নিশাত বললো,
– ভাবি! এভাবে কেউ চিৎকার করে! আমি ভয় পেয়ে গেছি!
– তুমি ভয় পেয়েছো, নাকি আমাকে ভয় দেখাতে এসেছো! আমি তো ৯৯% ভয় পেয়ে ১% কম এর জন্য বেচে আছি! এভাবে কেউ ভয় দেখায়!
– আরে! আমি তোমাকে ভয় দেখাতে আসছি নাকি! আমি ডিনারের জন্য তোমাদের ডাকতে এসেছিলাম! মাত্র হাত বাড়িয়েছি দরজায় টোকা দিবো, অমনি হাজির তোমার মুখ! আমি কি জানতাম নাকি তুমি এখন দরজা খুলতে এসেছো!
নাফিসা বুকে হাত রেখে লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– আর জীবনেও এভাবে ডাকতে এসো না! জ্ঞান হারানোর অভ্যাস নেই বলে আমি এখনো দাড়িয়ে আছি গো! প্রয়োজনে এক মিটার দূর থেকে হাক ছেড়ে দিও তবুও এভাবে নিশ্চুপ নক দিও না!
নিশাত হাসতে হাসতে বললো “ওকে”, ওদিকে ইমরান এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এখন হা হা করে হেসে উঠলো এবং বললো,
– যাও, পালাও আরও বেশি বেশি!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬২
(নূর নাফিসা)
.
.
গেইটে তালা দিয়ে তিনজন একসাথেই এসেছে বড় ঘরে। ইমরান সোফায় বসে পড়লো জিহানের সাথে কার্টুন দেখতে আর নাফিসা কিচেনে এসে বাটি নিলো ভাত বেড়ে নেওয়ার জন্য। নাফিসাদের আসতে দেখে বড় মা-ও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাফিসাকে দেখলো বাটিতে ভাত নিচ্ছে আর মুখ চেপে হাসছে। বড়মা জিজ্ঞেস করলো,
– হাসছিস কেন?
নাফিসা আবিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার বড়মার দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। আবিদা বেগম তরকারির বাটি নিয়ে বেরিয়ে গেলে নাফিসা হাসতে হাসতে বললো,
– বড়মা, এখানেও দেখি ভাতের পাতিলে মুরগী ডিম পাড়ে!
বড় মা এবার বুঝতে পেরে হেসে উঠলো এবং বললো,
– দরকার কি আলাদা হাড়ি বসানোর! এজন্য ভাতের সাথেই ডিম সিদ্ধ করে ফেলে। হাড়িও বাচলো, গ্যাসও বাচলো, পানিও বেচে গেলো।
– হুম, আমার মায়ের মতো মিতব্যয়ী! ভাত তুলতে গেলে আলাদীনের প্রদীপ হয়ে ডিম বেরিয়ে আসে! লুকানো প্রদীপের কথা না জেনে মাঝে মাঝে তো চামচ দিয়ে নেড়ে ফাটিয়েই ফেলি! এরপর হয়ে যায় ডিম বিরিয়ানি!
নাফিসা ও বড়মা দুজনেই হেসে উঠলো। জেরিন এসে বললো,
– কি হইছে তোমাদের!
নাফিসা বললো,
– মুরগির ডিম হইছে।
জেরিন কিছু বুঝতে না পেরে ব্রু সামান্য কুচকে তাকালো। কিন্তু নাফিসা আর তাকে স্পষ্টভাবে কিছু বললো না। নিজের কাজ করতে ব্যস্ত।
টেবিলে সবকিছু এনে নাফিসা জেরিনের আগেই ইমরান ও বড়মার খাবার প্লেটে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলো। আরমান জিহানকে ডাকলো ডিম খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু জিহান গেলো না। জেরিন আবার তরকারির বাটি নিয়ে গেছে ড্রয়িং রুমে। নাফিসা টেবিলে খাবার গুছিয়ে দিয়ে দেখলো জেরিন তার খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত! তাই নাফিসা জিহানের জন্য ডিম হাতে নিয়ে বললো,
– ভাবি, আমি জিহানকে ডিম খায়িয়ে আসি। আপনি এখানেই বসুন। এখানেও তো কিছুর প্রয়োজন হতে পারে।
– জিহানকে তোমার খাওয়াতে হবে না। আমি পরে খাওয়াবো।
কথাটা বলে জেরিন প্লেট নিয়ে চলে গেলো। নাফিসা লক্ষ্য করলো আরমান কিছুই বললো না। দেখতেই বুঝা যায় অতি সহজ সরল লোক! কিন্তু এভাবে সরলতা দেখালে চলবে, বউটা যে প্রচন্ড ঠকিয়ে যাচ্ছে তাকে!
নাফিসা ডিম রেখে নিজের জন্য খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ইমরানের পাশে বসতে বসতে বললো,
– আরে, ভাবি। ভাইয়া টেবিলে আর আপনি এখানে বসেছেন যে! ভাইয়ার তো কোনো প্রয়োজনও হতে পারে!
একই কথা এমন ভঙিতে আবার বলায় জেরিন চোখমুখ কাচুমাচু করে তাকালো। বড়মা বললো,
– ঠিকই তো! জেরিন, তুই এখানে কেন! নাফিসা ইমরানের সাথে বসেছে তোরও উচিৎ আরমানের সাথে বসার। টেবিলে না খেলে আগেও তো খেয়ে নিতে পারতি!
নাফিসার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেরিন চলে গেলো প্লেট নিয়ে। নাফিসার মুখে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে যেটা ইমরানের চোখে স্পষ্ট ধরা দিয়েছে। খাওয়ার মাঝে নাফিসা আবার ফিক করে হেসে উঠলো! বড়মা আর ইমরান উভয়েই তার দিকে তাকালো। বড়মা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হইছে?
– ভাতে মুরগী ডিম পারছে!
কথাটা বলে নাফিসা আরও বেশি হাসতে লাগলো। বড়মা মিটিমিটি হাসছেন আর ইমরান কিছুই না বুঝতে পেরে বললো,
– মানে!
– মানে আবার কি! ক্লিয়ার কথা বললাম! জিহান, তোমার জন্য ভাতে তিতি ডিম পাড়ছে। খাবে না?
জিহান কার্টুন থেকে মনযোগ সরিয়ে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি?
– ভাতের পাতিলে তিতি ডিম পাড়ছে তোমার জন্য।
– কই?
– টেবিলে।
জিহান সোফা থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেলো। আর একটু পর শুরু হলো চিৎকার চেচামেচি। ইমরান জিহানকে ডাকলো কিন্তু জিহান এলো না। এতোক্ষণে নাফিসার খাওয়া শেষ। টেবিলের কাছে এসে বুঝতে পারলো জিহান প্লেটে রাখা ডিম খাবে না, সে ভাতের পাতিলের ডিম খাবে। জেরিন বারবার বলছে এটাই ভাতের পাতিলের ডিম। কিন্তু সে মানতে রাজি না! বিরক্ত করে যাচ্ছে সবাইকে! কারো মাথায়ই কিছু ঢুকছে না। কি করে ঢুকবে! নাফিসা ছাড়া যে কেউই জানে না কি শুনে এসেছে সে! আর কি ই বা বলছে!
নাফিসার মজা লাগলো জিহান নামক নাছোড়বান্দাকে দেখে। সে ডিম নিয়ে কিচেনে গেলো। ভাতের পাতিলে ডিম রেখে তারপর পাতিল নিয়ে এসে বললো,
– জিহান, এই যে নাও।
– তিতি কই?
– এ! আবার তিতিও! তিতি তো চলে গেছে!
– ডাকো।
– আচ্ছা, কাল ডাকবো। এখন এটা খাও তুমি।
জিহান ডিম হাতে নিয়ে আবার পাতিলে আছড়ে ফেললো। নাফিসা বললো,
– আরে, কি করে!
– ভাঙি?
– না, এটা ভাঙা-ই। কামড়ে খেয়ে ফেলো।
জিহান ডিম হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে দৌড়ে এলো। নাফিসা পিছু পিছু এসে দেখলো টিভিতে ডিম ঠেলে দিয়ে অগি’কে বলছে, “নেও, ডিম খাও। নেও!”
জিহানের দুষ্টুমিতে নাফিসা চরম অবাক সাথে হাসিও পাচ্ছে খুব! ইমরান বললো,
– হু, ডিম খাও অগি। আর বেশি বেশি শক্তি করে জিহানকে বক্সিং দাও।
জিহান হেসে লাফিয়ে উঠলো। নাফিসা ডিম হাতে নিয়ে জিহানকে খায়িয়ে দিলো। খাওয়াদাওয়ার পর যখন তিনজন বেরিয়ে আসছিলো ইমরান জেরিনকে বললো,
– গেইটটা লাগিয়ে দিয়ে যান, ভাবি।
নিশাত ইমরানের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো আর নাফিসা মিটিমিটি! ইমরান জেরিনের দিকে না তাকালেও নাফিসা তার মুখভঙ্গি দেখে নিয়েছে। জেরিনের চেহারা দেখার মতো হয়েছে! অত:পর নিশাতের সাথে কথা বলতে বলতে ইমরানের পিছু পিছু ঘরে চলে এসেছে। নাফিসা নিশাতের রুমে চলে গেলে ইমরান তার বই নিয়ে এসে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– পড়াশোনা ইগনোর করে খুব বড় ভুল করছো। ধরো এবং পড়। নিশাত পড়তে বস।
ইমরানের কথায় নাফিসা আজ পড়লো নিশাতের রুমে। সাড়ে দশটা বেজে গেলে নাফিসা তাদের রুমে এসে দেখলো ইমরান পড়ছে। সে বই রেখে বিছানা গুছাতে লাগলো। নাফিসা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিধায় ইমরানও বই রেখে দিতে দিতে বললো,
– জেরিনের রিয়েকশন কেমন ছিলো?
নাফিসা মুখ টিপে হেসে বললো,
– জেরিন কে?
– হা হা হা! ভাবির রিয়েকশন কেমন ছিলো?
– লাইক এন আউল!
ইমরান আবারও হেসে বললো,
– আচ্ছা! প্যাঁচা দেখেছো কখনো?
– না, আমি তো জিহান। যে এখনো প্যাঁচার দর্শন পাইনি!
– জিহানও তো দেখেছে! আমাদের মেহগনি গাছে প্রায়ই আসে। আর ভোরে ডাকে হুতোম প্যাঁচা।
নাফিসা মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ বিপরীত মুখী শুয়ে আবার সমমুখী হয়ে চোখ বুজে আছে। ইমরান কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষণে চিত করে রাখা হাতের উপর হাত রেখে আঙুলের ভাজে আঙুল রাখলো। নাফিসা চোখ খুলে তাকিয়ে ইমরানের ঠোঁটের কোনে অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখতে পেল। হাতের দিকে তাকিয়ে যখন হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, ইমরান মুঠোয় ধরে বললো,
– সমস্যা কি?
নাফিসা হেচকা টান দিয়ে হাত ছুটিয়ে কম্বলের নিচে গুটিয়ে বললো,
– লাইট অফ করুন।
ইমরান লাইট অফ করে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তুমি ওদিকে ভাবিকে ঠিক করো আর আমি না হয় আমার বউকে ঠিক করি। কি বলো?
নাফিসা ছোটার জন্য জোরাজোরি করতে লাগলো। ইমরান বললো,
– আরে! এতে সমস্যা কোথায়?
নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মশারী ফাঁক করে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। নিশ্বাসের সাথে তার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে! ইমরান উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো নাফিসা দাড়িয়ে চোখ মুছছে! সে বিছানায় থেকেই বিষ্ময়ের সাথে বললো,
– নাফিসা!
নাফিসার কান্না যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে! সে বিছানা ছেড়ে নেমে কাছে আসতেই নাফিসা আরও পিছিয়ে গেলো! ইমরান বললো,
– কি হয়েছে, তোমার? কাদছো কেন?
– আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না।
– সমস্যা কি তোমার! এভাবে না কেদে বলো আমাকে।
নাফিসা কিছু না বলে কেদেই যাচ্ছে! ইমরান আবার বললো,
– আমি তোমাকে স্পর্শ করেছি বলে কি সমস্যা? আমরা তো হাসব্যান্ড ওয়াইফ। এতে এমন রিয়েক্ট করার কি আছে?
– আপনি কাছে এলে আমার ভয় লাগে!
ইমরান নাফিসার মাঝে ভয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নাফিসা কাপা কাপা হাতে বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে। এটাও বেশ বুঝতে পারছে নাফিসা এমনিতে চঞ্চল ও স্বাভাবিক হলেও নিজেকে তার সংস্পর্শে আনতেও একেবারেই অপ্রস্তুত! হয়তো বিয়ে মেনেছে কিন্তু স্বামী মানতে পারেনি। তাকে মেনে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া উচিত। ইমরান বললো,
– ঘুমাও গিয়ে। আমি স্পর্শ করবো না তোমাকে।
– আমি এখানে ঘুমাবো না। নিশাতের রুমে চলে যাবো।
– বললাম তো স্পর্শও করবো না। যাও।
নাফিসা ইমরানের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ইমরান কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করে আবার রুমে চলে এলো।
.
.
[চলবে]